ভূমিকা
"যূযং বৈ স্বোপদেষ্টারমাচার্যং
মার্গদর্শকম্।
প্রাতিমোক্ষং হি মন্যধেব পরং পারং গতে
ময়ি।।
তদধীনং বর্তিতব্যথাচর্যং চ তদজ্ঞয়া।
গতেঽপি ময়ি কর্ত্তব্য: স্বাধ্যায়স্তস্য
সর্বথা।।২৬।।"
বুদ্ধচরিতম্, যডুবিংশঃ সর্গঃ।
"আমার মহাপরিনির্বাণের পর তোমাদের
প্রাতিমোক্ষ-কে'ই (ভিক্ষু-জীবনের নিময়) নিজেদের আচার্য, নিজেদের প্রদীপ এবং
নিজেদের দোষ উপলব্ধি করা উচিত। এই তোমাদের উপদেশক, যার অধীনে তোমরা অবস্থান করবে।
তোমাদর বিষয়টিকে ঠিক সেইভাবে আবৃত্তি করা উঠিত যেমন আমার উপস্থিতিতে, জীবনে,
সম্পাদন করতে।"
ভগবান বুদ্ধ অনুত্তর শান্তিপদের সন্ধানে
গৃহত্যাগ করেছিলেন এবং তাঁর সন্ধান তখন সম্পূর্ণ হয়েছিল যখন তিনি সম্বোধিতে গম্ভীর
শান্ত, উত্তম ও অতর্কাবার ধর্ম লাভ করেছিলেন। এই ধর্মকে দ্বিবিধ রূপে বর্ণনা করা
হয়েছে প্রতীত্যসমুৎপাদ এবং নির্বাণ। প্রতীত্যসমুৎপাদ, ইদম্প্রত্যয়তা অথবা মধ্যমা
প্রতিপদ অনিত্য সংস্কারের প্রবাহরূপ সংসারকে পরতন্ত্র এবং সাক্ষেপ সূচিত করে তথা
পরমার্থকে অন্ত বিবর্জিত এবং অনিবার্চনীয়। নির্বাণ অর্থাৎ 'নির্বাপিত হলে' সংসারের
বিরোধ ও সত্যের প্রাপ্তি সূচিত হয়। প্রতীত্যসমুৎপাদ 'ধর্ম'কে নিয়ম এবং সীমারূপে সংকেতিত
করে, নির্বাণ বিমুক্তি ও ভূমা রূপে। প্রতীত্যসমুৎপাদে সংসার'এর গভীরতম 'লক্ষণ'
(এবং পরমার্থের অলক্ষণতা) প্রকাশিত হয়, নির্বাণে আধ্যাত্মিক জীবনের লক্ষ্য।
প্রাচীন বঙ্গদেশে বৌদ্ধধর্ম ভগবান
বুদ্ধের জীবদ্দশাতেই প্রসার লাভ করে ছিল এবং বুদ্ধ স্বয়ং বঙ্গদেশে পরিভ্রমণ
করেছিলেন। 'অঙ্গুত্তর নিকায়'এ ব্যাখ্যাত হয়েছে "বঙ্গান্তপুত্র" নামক এক
যুবক বুদ্ধের নিকট হতে ভিক্ষুত্ব গ্রহণ করেছিলেন। সন্দেহাতীত ভাবে বলা যায়, এই
বঙ্গান্তপুত্র বঙ্গদেশ হতে ভগবান বুদ্ধের নিকট এসেছিলেন। 'থেরগাথা' ও 'অপাদান'এ
"বঙ্গীয়" নামে সুপ্রসিদ্ধ এক বাঙালী ভিক্ষু ও স্বনামধন্য কবির পরিচয়
মেলে, যিনি বিদ্যালাভের জন্য রাজগৃহে বসবাসকালে স্থবির সারিপুত্রের সাক্ষাৎ লাভের
সুযোগ পান, এবং অতঃপর বুদ্ধের সান্নিধ্য লাভ করে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
'ভেলপত্ত জাতক' এবং 'ধম্মপদ অট্ঠকথা'য় ব্যাখ্যাত হয়েছে ভগবান বুদ্ধ তাঁর
জীবদ্দশাতেই 'সমূহ' (?) রাজ্যের 'সাতক' নগরে পরিভ্রমণ করেছিলেন, এই সমূহ রাজ্য ছিল
প্রাচীন বঙ্গের অন্তর্গত। এই প্ররিভ্রমণের কথা ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে সুম্প্রসিদ্ধ
তিব্বতী লেখক 'সুমপা' কর্তৃক লিখিত 'পাগ-সাম্-জোঙ-জ্যাং' গ্রন্থেও বর্ণিত হয়েছে,
যা ধর্মপদ অট্ঠকথা'র বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।
অনাথপিণ্ডিক শ্রেষ্ঠীর এক কন্যা
'চুলসুভদ্রার' সঙ্গে পুণ্ড্রবর্ধণের এক বিত্তবান পরিবারের যুবকের বিবাহ সম্পন্ন
হয়েছিল। এই পুণ্ড্রবর্ধন বর্তমান বাংলাদেশের বগুড়া, রংপুর ও দিনাজপুর সংলগ্ন
অঞ্চল। শ্রেষ্ঠী কন্যার প্রচেষ্টায় অবৌদ্ধ স্বামী এবং তাঁর পরিবারের সকলেই বৌদ্ধধর্মে
দীক্ষিত হয়েছিলেন। কথিত আছে এই চুলসুভদ্রা'র আমন্ত্রণে ভগবান বুদ্ধ পুণ্ড্রবর্ধনে
পদার্পণ করেন এবং আতিথ্য গ্রহণ করেন। এই প্রসঙ্গে বুদ্ধ একটি পালি গাথায় বর্ণনা
করেছিলেন:
"দূরে সন্তো পকাসেন্তি হিমবস্তো'ব
পব্বতো।
অসন্তে'ত্থ ন দিস্সন্তি রত্তি খিতা যথা
সরা।।"
অর্থাৎ, শীলবান সৎ ব্যক্তি হিমালয় পর্বত
সদৃশ্য অতিদূর থেকে প্রকাশিত হন, তবে অসৎ ব্যক্তি রাত্রিকালীন নিক্ষিপ্ত শর তুল্য
দৃশ্যপটে উপলব্ধি হন না।
এছাড়াও, ভগবান বুদ্ধ তাঁর জীবদ্দশাতেই
যে বাংলায় এসেছিলেন তা চৈনিক পরিব্রাজক 'শুয়াং জাঙ্'এর বর্ণনাতেও সুস্পষ্ট হয়।
তাঁর বর্ণনায় ব্যক্ত হয়েছে বুদ্ধ পুণ্ড্রবর্ধন, সমতট (কুমিল্লা) ইত্যাদি স্থানে
সপ্ত দিবসকাল ধর্মোপদেশ দান করেছিলেন। এবং সেই স্থান হতে কর্ণসুবর্ণ হয়ে মগধ
(বিহার)'এ এসেছিলেন।
দশম হতে একাদশ শতাব্দীর সময়কালে
বিক্রমশীলা মহাবিহারের প্রধান আচার্য ছিলেন বঙ্গীয় কৃতি সন্তান এবং তৎকালীন
উজ্জ্বল জ্যোতিস্কসদৃশ সুপণ্ডিত ও দার্শনিক 'অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান'। তিব্বতের
রাজার আমন্ত্রণে তিনি দুর্গম হিমালয় পর্বত অতিক্রম করে সে দেশে উপস্থিত হল এবং
সেখানে বৌদ্ধধর্ম স্থাপন করেছিলেন। তাঁর এই অনন্য ও অসাধারণ কৃতিত্বের কথা কবি
সতেন্দ্রনাথ দত্তের লেখনীতে প্রতিধ্বনিত হয়েছে:
"বাঙালী অতীশ লঙ্ঘিন গিরি তুষারে
ভয়ঙ্কর।
জ্বালিল জ্ঞানের দ্বীপ তিব্বতে বাঙালী
দীপঙ্কর।।"
তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের নবজাগরণ কালে অতীশ
দীপঙ্কর ১৭৫'টির অধিক বৌদ্ধ দার্শনিক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিব্বতী এবং চৈনিক
বৌদ্ধদের নিকট অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান এখনও দ্বিতীয় বুদ্ধরূপে পূজিত হয়ে থাকেন।
ভারত ভূমিতে অষ্টম শতাব্দীতেই
বৌদ্ধধর্মের অবলুপ্তি শুরু হয়েছিল এবং মধ্যযুগে অর্থাৎ ত্রয়োদশ শতকের শুরুতেই
ভারতবর্ষ থেকে এর চিরবিলুপ্তি ঘটতে থাকে। অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ছয় শতক ভারত
ভূমি নানাবিধ ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। ভারতবর্ষের এই সময়কাল
বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে অন্ধকার যুগ হিসেবে বিবেচিত। বঙ্গদেশও এর প্রভাব থেকে মুক্ত
হতে পারেনি। পঞ্চদশ শতক থেকে বৌদ্ধধর্ম বঙ্গদেশ হতে ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত হতে শুরু
করে। শুধুমাত্র চট্টগ্রাম এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে অবশিষ্ট ছিল। উনিশশতকের সময়কালে
বৌদ্ধধর্মের পূনর্জাগরণ কাল শুরু হয়। বাংলায় বৌদ্ধধর্মের অত্যাধিক বিস্তারের কারণ
ছিল ভগবান বুদ্ধের সাম্যবাদী এবং মানব দরদী চিন্তা। তাই বঙ্গ-জননীর
সন্তান-সন্ততিরা এই ধর্মকে আপনার করে নিয়েছিল স্বাভাবিকভাবেই।
মহামতি বুদ্ধের প্রতি বিশ্বকবি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আন্তরিক শ্রদ্ধা, ভক্তি ও অনুরাগের নিদর্শন তাঁর জীবনযাত্রা ও
সাহিত্য সৃষ্টিতে সমুজ্জল হয়ে বারংবার।
সকল কলুষতামস হর,
জয় হোক তব জয়।
অমৃতবারি সিঞ্চন কর
নিখিলভুবনময়।
মহাশান্তি, মহাক্ষেম,
মহাপুণ্য, মহাপ্রেম।
জ্ঞানসূর্য, উদয় ভাতি
ধ্বংস করুক তিথির রাতি,
দুঃসহ দুঃস্বপ্ন ঘাতি
অপগত কর' ভয়।
বৌদ্ধধর্মের পুনর্জাগরণের প্রশ্নে জেমস্
প্রিন্সেস'এর নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। তিনি যদি কৌতুহলাবিষ্ট হয়ে ভারতবর্ষের
বিভিন্ন অঞ্চল-সহ বহিঃবিশ্বের বেশ কিছু অঞ্চল (বর্তমান পাকিস্থান এবং আফগানিস্থান)
উৎখনন করে প্রাচীন বৌদ্ধ অবশেষ (চৈত্য, স্তূপ, বিহার ইত্যাদি) ও বৌদ্ধ রাজা অশোকের
শিলালিপি আবিস্কার না করতেন তা হলে ভারতবর্ষের জনগণ এবং প্রাশ্চ্যাত্য পণ্ডিতগণ
জানতেই পারতেন না যে ভারতবর্ষে এককালে বৌদ্ধধর্ম নামে একটি সুপ্রসিদ্ধ ধর্ম বিরাজ
করত। উনিশ শতকে শ্রীলংকা হতে আগত বৌদ্ধ পণ্ডিত অনাগারিক ধর্মপাল ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্ম
পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং বুদ্ধগয়ায় (বিহার) অবস্থিত মহাবোধি মহাবিহার শৈব সম্প্রদায়'এর
হাত থেকে রক্ষার্থে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। কেননা বুদ্ধগয়া বিশ্বের
সকল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর নিকট একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রধানতীর্থস্থল। এইস্থানেই
বোধিবৃক্ষতলে ভগবান বুদ্ধ বহুজনের হিতার্থে, সুখার্থে সম্বোধি লাভ করেছিলেন। ললিত
বিস্তর'এ বিষয়টি এইভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে:
"ছিন্ন হয়েছে বর্ম, শান্ত রজ,
রুদ্ধ হয়েছে আস্রব শোষিত।
ছিন্ন হয়েছে বর্ম এবং এই
দুঃখের পরিসমাপ্তি হয়েছে অভিহিত।"
উত্তরকালে ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের
নবজাগরণে যে মহান মণীষী গুরুত্বপূর্ণ অবদান পালন করেছিলেন, তিনি হলেন ড. ভীমরাও
আম্বেদকর। তাঁর অনুগামীরা বর্তমানে 'নব্যবৌদ্ধ' নামে খ্যাত। যাইহোক, বর্তমান
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চল অতিপ্রাচীন কাল হতে বৌদ্ধজাতির আবাসস্থল। চট্টগ্রামের
বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অভিমত হল, প্রাচীনকালে এই অঞ্চল আরাকান সাম্রাজ্যভুক্ত থাকার
কারণে এই অঞ্চলে বহু বৌদ্ধ চৈত্য বিদ্যমান ছিল, ফলে এ স্থানের নাম হয়
'চৈত্যগ্রাম'। চৈত্য যেখানে বুদ্ধের দেহধাতু সংরক্ষিত করে প্রার্থনা করা হয়।
পরবর্তীতে এই চৈত্যের সঙ্গে গ্রাম শব্দ যুক্ত হয়ে 'চৈত্যগ্রাম' নামের উৎপত্তি হয়।
অতঃকালের বিবর্তনে চৈত্যগ্রাম হয় চট্টগ্রাম।
লামা তারনাথ-এর বিবরণে চট্টগ্রাম
অঞ্চলের বৌদ্ধদের বিবরণ পাওয়া যায়। তারনাথের পরবর্তী সময়ে এই অঞ্চলে ভ্রমণে আসেন
(১৬২৯ এবং ১৬৪৩ খ্রীঃ) এফ.এস. ম্যানরিকিউ। তাঁর লেখায় বৌদ্ধ ধর্ম এবং মগ, পেণ্ড,
আভা এবং মারমা জাতির উল্লেখ রয়েছে। সর্বোপরি তিনি 'রাউলি পুরোহিত'দের কথাও ব্যক্ত
করেছেন। ঐ সময় কালে চট্টগ্রামের শাসক ছিলেন আরাকানীরা। পণ্ডিত শ্রীমৎ ধর্মাধার
মহাস্থবির প্রণীত 'সদ্ধর্মের পুনরুত্থান' গ্রন্থে এই বিষয় সম্পর্কিত বিস্তারিত
তথ্য প্রদত্ত হয়েছে। কবি দৌলত কাজীর, সতীময়না কাব্যে তৎকালীন আরাকানী রাজা শ্রী
সুধমার পরিচয় এবং নগরের উল্লেখ দৃষ্ট হয়।
"কর্ণফুলী নদী পূর্বে আছে এক পুরী,
রোসাঙ্গ নগর নাম স্বর্গ অবতারী।
তাহাতে মগধ বংশ ধর্মে বুদ্ধাচার,
নাম শ্রীসুধর্মা রাজা ধর্ম অবতার।"
সম্ভবতঃ এই রোসাঙ্গ নগর পরবর্তী সময়ের
রাঙ্গুনীয়া অঞ্চল (ডেভিড্ উব্লিউ, ম্যান্ড্রোয়েল, ইষ্ট পাকিস্থান ডিস্ট্রিক গেজেট,
চিটাগং, ১৯৫৩, পৃঃ ৮১)। তবে সিলেটের তাম্রশাসন হতে এই তথ্য পাওয়া যায় যে
রাঙ্গুনীয়া অঞ্চল চন্দ্রবংশীয় রাজাদের শাসনাধীন ছিল। একথা অনস্বীকার্য যে
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনীয়া অঞ্চল ঐতিহাসিক, ধর্মীয় এবং ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ অনুসারে
অতীব গুরুত্বপূর্ণ। অতি প্রাচীনকাল হতে এই অঞ্চলে মগ এবং অন্যান্য পাহাড়ী
জনগোষ্ঠী বসবাস করত। এই জনগোষ্ঠীর সিংহভাগই হল বৌদ্ধ মতাবলম্বী। অতীতের ইতিহাস হতে
এই তথা পাওয়া যায় যে আরাকান অঞ্চলের মগদের সঙ্গে এই অঞ্চলের অধিবাসীদের নদীপথে
(কর্ণফুলী নদী বাণিজ্যিক কর্ম পরিচালিত হতো। অনেকে মনে করেন 'রান্যা' নাম হতে
রাঙ্গুনীয়া নামের উৎপত্তি হয়েছে। তবে ম্যাকোয়েল সাহেবের তথ্যের ন্যায় এই তথ্যের ও
কোনরূপ ঐতিহাসিক সত্যতা যাচাই করা হয় নি। কর্ণফুলী নদী ব্যতীত এই অঞ্চলের উপনদী
গুলি হল রাইখালী, ডংখাল, শিলক খাল, ইচ্ছামতি এবং চিরিঙ্গা ইত্যাদি। উত্তর
রাঙ্গুনীয়ার মহামুণি মন্দির, রাজবাড়ী, রাজনগর, রাজাভুবন এবং রাণীর হাট ঐতিাসিক
বৌদ্ধ স্মৃতি আজও বহন করে চলেছে।
ইতিপূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে যে
সুপ্রাচীনকাল হতে রাঙ্গুনীয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ জনপদরূপে পরিগণিত হয়ে এসেছে।
এপ্রসঙ্গে ঘনারাম'এর বর্ণনার কিছু উপাদান এইস্থানে প্রদান করা হল:
প্রথমে সেবক ছিল ভোজ মহারাজা।
পরিপাটী পরিপূর্ণ দিল আদ্যপূজা।।
ধূপাদত্ত দ্বিতীয়ে পুজিল সপ্রতুল।
মানিক দীপের মাঝে ধর্মের দেউল।।
অনেকের মতে এই ধর্মের দেউল হল 'মহামুণি
মন্দির'। রাঙ্গুনীয়া জনপদের অন্তর্গত বর্ধিষ্ণু বৌদ্ধ অধ্যুষিত অঞ্চল হল ঘাটচেক
গ্রাম। জনশ্রুতি আছে এই বর্ধিষ্ণু গ্রামটি অষ্টাদশ শতাব্দীর পূর্বেই গোড়াপত্তন
হয়েছিল। এই গ্রামই ছিল একসময় কালের রাঙ্গুনীয়ার শষ্য ভাণ্ডার। অষ্টাদশ শতাব্দীর
মধ্যভাগে এই গ্রামের পুণ্যপুরুষ সংঘমণীষা হরিচরণ মহাস্থবির (হরিচরণ মাথে) আকিয়াব
(আরাকান) অঞ্চল হতে বৌদ্ধ ধর্ম বিনয় শিক্ষায় শিক্ষালাভ পূর্বক স্বগ্রামে (ঘাটচেক)
প্রত্যাবর্তন করে রাঙ্গুনীয়া অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
তিনি নিজগ্রামের ঘাটচেক ধর্মামৃত বিহার
প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই অর্থে হরিচরণ মহাস্থবির রাঙ্গুনীয়ার বৌদ্ধধর্মের সংস্কারক
এবং একটি আলোকবর্তিকা স্বরূপ। ইতিহাসের সমুজ্জ্বল ধারায় বহমান এই গ্রামের অন্যান্য
সংঘ মণীষাগণ বৌদ্ধধর্মের সোপানকে অত্যন্ত উচ্চ শিখরে উন্নীত করেছেন। তাঁদের মধ্যে
মহাপণ্ডিত উপসং রাজ সুগতবংশ মহাস্থবির (১৯১২-১৯৯৮ খ্রীঃ) একজন অন্যতম সাংঘিক
ব্যক্তিত্ব। তাঁর ব্রহ্মচর্য জীবন এবং সাহিত্য কর্মের মহিমা উত্তর প্রজন্মের
চেতনাকে আরও অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করবে।
১ সেপ্টেম্বর, ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দে
মহাপণ্ডিত সুগতবংশ মহাস্থবির রাঙ্গুনীয়ার বৌদ্ধ জনবহুল ঘাটচেক গ্রামের এক
মধ্যবিত্ত বৌদ্ধ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর গৃহীনাম ফণীভূষণ বড়ুয়া। তিনি
শৈশবকাল হতে ধর্মীয় অবধারায় পুষ্ট হয়ে উঠেছিলেন এবং এই কারণেই তাঁর অন্তরে নিহীত
ছিল মহাতাপস হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় বীজ।
'জড় নই, মৃত নই, নই অন্ধকারের খনিজ,
আমি তো জীবন্তপ্রাণ, আমি এক অঙ্কুরিত
বীজ;
মাটিতে লালিত ভীরু, শুধু আজ আকাশের ডাকে
যদিও নগন্য আমি, তুচ্ছ বটবৃক্ষের সমাজে
মেলেছি সন্দিগ্ধ চোখ, স্বপ্ন ঘিরে রয়েছে
আমাকে।
বিদীর্ণ করেছি মাটি, দেখেছি আলোর
আনাগোনা
তবু ক্ষুদ্র এ শরীরে গোপনে মর্মরধ্বনি
বাজে,
শিকড়ে আমার তাই অরণ্যের বিশাল চেতনা।'
শিশু ফণীভূষণ তাঁর জন্মের এক বৎসর পর
মাতৃহারা (মহামায়া বন্ধুয়া) হন। সেই সন্ধিক্ষণে তাঁর সকল দ্বায়িত্বভার গ্রহণ
করেছিলেন জ্যেষ্ঠ মাতা সুকৃতিবালা বড়ুয়া। এর ক্ষণকাল পরেই বালক ফণীভূষণের
পিতৃদেবও পৃথিবীর মায়া পরিত্যাগ করে চিরবিদায় নিলেন। এই হৃদয়বিদারক দুঃখ তাঁর
জীবনে এনেছিল এক বিমূর্তভাব। কেননা জন্ম, জরা এবং মৃত্যু তিনি রাজকুমার
সিদ্ধার্থের ন্যায় শিশুকালেই উপলব্ধি করেছিলেন।
শিক্ষা (মানবিক এবং আধ্যাত্মিক) মানব
জীবনের এক অমূল্য সম্পদ। কেনা একটি জাতিগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ের মূল সোপান হল শিক্ষা।
সুতরাং এই অর্থে শিক্ষা ব্যতীত মানব জীবন নিরর্থক হয়।
যাবদেব অনত্থায়, অত্তং বালস্স জায়তি।
হস্তি বালস্স সুক্কংসং, মুদ্দমস্স
বিপাতয়ং।।৭২।।
মূর্খ মানুষ যতই জ্ঞানার্জন করুক না
কেন, এই সকল তার অনর্থ কর্মেই সম্পাদিত হয়। এই জ্ঞান তার মস্তককে ছিন্ন ভিন্ন করে
তার শুদ্ধ (শুক্ল) অংশকে সমূলে উচ্ছেদ করে দেয় (বালবগ্গো পঞ্চমো, ধম্মপদ)।
এক সময় প্রজ্ঞারত্ন মহাস্থবির'এর
স্নেহধন্য বালক ফণীভূষণ ঘাটচেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (১৮৭৫ খ্রীঃ প্রতিষ্ঠিত)
পঠন-পাঠন শুরু করেন। এই বিদ্যালয়ে তিনি ৫ বৎসর (১৯২০-১৯২৫ খ্রীঃ) পর্যন্ত অধ্যয়ন
করেছিলেন। ১৯২৭ খ্রীষ্টাব্দ, তাঁর জীবনে এক শুধু মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হল। এই সময়
তিনি পুণ্যপুরুষ ভদন্ত প্রজ্ঞারত্ন মহাস্থবির'এর নিকট হতে ত্রিসরণ সহ ১০
প্রব্রজ্যা শীল গ্রহণ করলেন। ভগবান বুদ্ধের বিনয় মতানুসারে নব প্রব্রজ্যিত ফণিভূষণ
হলেন "শ্রমণ সুগতবংশ"।
উপয্যঞ্জন্তি সতীমন্তো, ন নিকেতে রমন্তি
তে।
হংসা বা পল্ললং হিত্বা, ওকমোকং জহন্তি
তে।।৯১।।
সাধকজন স্মৃতিমান পূর্বক নিজ সাধনাতে
মগ্ন থাকেন, সে গার্হস্থ্য জীবনে কোনরূপ আসক্তি ধারণ করেন না। যেমন স্বচ্ছ জলাশয়ে
সন্তরিত রাজহংস মলিন জলাশয়কে পরিত্যাগ করে, ঠিক সেইভাবে সাধক সাধারণ গৃহস্থ
পরিবারের সঙ্গে কোন আসক্তি পোষণ করেন না (অরহন্তো বগ্গো, সত্তমো, ধম্মপদ)।
তাঁর শিক্ষাজীবন সম্পর্কে পণ্ডিত
ধর্মাধার মহাস্থবির বলেছেন, "অসীম মেধাশক্তির অধিবাসী সুগতবংশ শৈশবেই
প্রব্রজ্যাধর্মে দীক্ষিত হয় ভদন্ত প্রজ্ঞারত্ব মহাস্থবিরের নিকট স্বীয় জন্মভূমি
রাঙ্গুনীয়ার ঘাটচেক গ্রামে। কিন্তু শিশিক্ষু ও মুমুক্ষু সুগতবংশ ত্রিপিটকশাস্ত্র
অধ্যয়ন ও জ্ঞানাহরণের অতৃপ্ত আকাঙ্খা পরিতপ্তির সন্ধানে একস্থানে আবদ্ধ থাকে নি।
যেখানে সুযোগ পেয়েছেন, সেইখানে ছুটে গিয়েছিলেন। এই ছিল সুগতবংশের অত্যতম গুণ। সেই
গুণ খুব সীমিত জনের হয়।"
সীলদস্সসম্পন্নং, ধম্মটঠং সচ্চবেদিনং।
অত্তনো কম্ম কুব্বানং, তং জনো কুরুতে
পিয়ং।।২১৭।
যে ভিক্ষু শীল তথা জ্ঞান (দর্শন)
সম্পন্ন হন, যিনি ধর্মিষ্ঠ, সত্যবাদী হন, যিনি নিজের উত্তরাদায়িত্ব (তিন শিক্ষা)
কে পূর্ণ করেছেন, বুদ্ধিমান্ ব্যক্তিজন এইরূপ পুরুষকে 'প্রিয়' রূপে ধারণ করেন
(পিয়বগ্গো, সোলসমো, ধম্মপদ)।
শ্রমন সুগতবংশের ক্ষেত্রে ধম্মপদের এই
গাথাটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ছিল। কেননা অচিরেই তাঁর প্রজ্ঞাদীপ্তি সূর্যলোকের ন্যায়
চর্তুদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই সময় মহামুণি পাহাড়তলী গ্রামের অন্যতম পীঠস্থান সংঘরাজ
মহানন্দ বিহার ছিল (পূর্ববঙ্গের) থেরবাদী বৌদ্ধধর্মের ভরকেন্দ্র। ১৯৩৩
খ্রীষ্টাব্দে মহাপণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবিরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সংঘরাজ মহানন্দ
বিহারে 'মহামুণি' পালি কলেজ স্থাপিত হয়। তখন শ্রমন সুগতবংশ সেই কলেজে ছাত্র হিসেবে
যোগদান করে যথেষ্ট মেধার পরিচয় প্রদান করেছিলেন। ১৯৩৫ খ্রীষ্টাব্দে তিনি ভগবান
বুদ্ধের বিনয় মতে উপসম্পদা লাভ করে ভিক্ষু সুগতবংশ নামে পরিচিত হন। ভদন্ত সুগতবংশ
মহাস্থবির ছিলেন ভদন্ত হরিচরণ মহাস্থবিরের সার্থক উত্তরসূরী।
অপ্পমত্তো অয়ং গন্ধো, স্বয়ং তগরচন্দনং।
যো চ সীলবতং গন্ধো, বাতি দেবেসু
উত্তমো।।৫৬।।
টগর এবং চন্দন ইত্যাদির গন্ধ তো
সামন্য'ই হয়, কিন্তু সচ্চরিত্র (শীলবান) পুরুষের শীলের গন্ধ দেবগণ (এর বাসস্থান)
পর্যত উন্নীত হয় (পুপ্ফবগ্গো চতুত্থো, ধম্মপদ)।
পণ্ডিত সুগতবংশ মহাস্থবির ছিলেন
কর্মযোগী সাধক এবং ত্রিপিটক শাস্ত্র বিশারদ। ১৯৩৫ খ্রীষ্টাব্দে এশিয়ার সর্বপ্রথম
ডি.লিট. ডিগ্রী ভ্রান্ত অধ্যাপক ড. বেণীমাধব বন্ধুয়া এবং বৌদ্ধ শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত
বিনয়াচার্য ভদন্ত বংশদীপ মহাস্থবিরকে অধ্যক্ষ করে প্রতিষ্ঠিত হয় 'নালন্দা
বিদ্যাভবন'। এই 'ত্রিপিটক' বৌদ্ধ সাহিত্যচর্চা কেন্দ্রে ভদন্ত সুগতবংশ মহাস্থবির
শিক্ষকতা করতেন। তাঁর এই মহানুভবতা বৌদ্ধ জাতির নিকট অত্যন্ত গর্বের বিষয়।
মহাপণ্ডিত সুগতবংশ মহাস্থবির ছিলেন
দৃষ্টান্ত স্বরূপ ব্যক্তিত্ব। তিনি বুদ্ধ শাসন এবং সদ্ধর্মের উন্নতি বিধানে
নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন যেমন-
ক) ভগবান বুদ্ধের প্রধান দুই শিষ্যের
(ধর্মসেনাপতি সারিপুত্র এবং ঋদ্ধিশ্রেষ্ঠ মহামোগ্গয়ায়ন স্থবির) পবিত্র দেহধাতু
উৎসবে ভারতে যোগদান, ১৯৫২ খ্রীষ্টাব্দ।
খ) ভগবান বুদ্ধের ২৫০০ তম জন্ম জয়ন্তীতে
ভারত যাত্রা, ১৯৫৬ খ্রীষ্টাব্দ।
গ) বার্মায় (বর্তমান মায়ানমার) আয়োজিত
ষষ্ঠ মহাসঙ্গীতিতে অংশ গ্রহণ, ১৮৫৪ খ্রীষ্টাব্দ।
ঘ)বার্মায় (বর্তমান মায়ানমার) পটঠান
অধ্যয়ন, ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দ।
ঙ) বিদর্শন ভাবনা প্রশিক্ষা গ্রহণ।
চ) বিদর্শন ভাবনার জন্য ভারতের ঈগতপুরী
যাত্রা।
ছ) বিদর্শন ভাবনা প্রশিক্ষণ।
জ) তিনি সোভিয়েত রাশিয়ার ধম্ম মহা
সম্মেলনে যোগদান করেন।
বৌদ্ধ প্রধান দেশ মায়ানমার এ সুদীর্ঘ
ছয় বৎসর মহাসঙ্গায়নে যোগদান সহ ত্রিপিটক শাস্ত্রচর্চা এবং বিদর্শন ভাবনা ইত্যাদির
অনুশীলনের কারণে তাঁর জ্ঞানসাধনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনেকটাই সম্পূর্ণতা লাভ
করেছিল।
যোগা বে জয়তী ভূরি, অযোগা ভূরিসঙ্খয়ো।
এতং দ্বেধাপন্থ ঞাত্বা, ভবায় বিভবায় চ।
তথাত্তানং নিবেসেয্য, যথা ভূরি
পবভ্ঢতি।।২৮২।।
সাধনার প্রভাবেই জ্ঞান উৎপন্ন হয়। সাধনা
না করলে জ্ঞানের ক্ষয় হয় (ধম্মপদ)।
তিনি সকল সময় বলতেন 'প্রকৃত ব্রহ্মচর্য
তথা শ্রমন ও ভিক্ষুত্ব'র অর্থই হল ধ্যানময় জীবন এবং নিষ্ঠার সঙ্গে ব্রত পালনের
বিষয়টি হল ধ্যানের অঙ্গ। ভগবান বুদ্ধের লোকোত্তর জ্ঞান অধিগত করতে হলে ধ্যানের
গভীরে নিমজ্জিত হতে হবে নতুবা বুদ্ধের লোকোত্তর জ্ঞান অর্জিত হবে না।
মহামহোপাধ্যায় তথা ধর্মদীপ'এর অধিকারী
ভদন্ত সুগতবংশ মহাস্থবির প্রকৃত অর্থে একজন মহাজ্ঞানী ছিলেন। তিনি ত্রিপিটক
শাস্ত্রে প্রগাঢ় বুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। বাংলা, পালি, সংস্কৃত, হিন্দি এবং বর্মী
ভাষায় তাঁর জ্ঞান ছিল যথেষ্ট। তিনি নব্য বিদ্যার্থীগণের অভিজ্ঞতার প্রশ্নে বহু
দুষ্প্রাপ্য প্রাচীন শাস্ত্র সংগ্রহ করেছিলেন। যদিও তিনি সেই অর্থে প্রাতিষ্ঠানিক
বিদ্যাশিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না কিন্তু তিনি তাঁর অদম্য প্রচেষ্ঠা এবং জ্ঞান
পিপসার কারণে হয়ে উঠেছিলেন জ্ঞানতাপস। তাঁর অসমান্য মেধাশক্তি, নিষ্ঠা এবং সততা
বৌদ্ধজাতির অনুপ্রেরণার পথে সহায়ক হয়েছিল। তিনি সকল সময় তাঁর আচার্যগণের প্রতি
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
ভদন্ত সুগতবংশ মহাস্থবির উপলব্ধি
করেছিলেন যে পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) বৌদ্ধ জাতি যদি তথাকথিত লোকাচার এবং
বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা আর্চনা হতে মুক্ত না হয় তাহলে স্বজাতি, স্ব-জ্ঞাতি'র বিপদ
অনিবার্য। এই কারণেই তিনি তাঁর কল্যাণমিত্র ভদন্ত হরিচরণ মহাস্থবিরের যোগ্য
উত্তরসুরী রূপে সদ্ধর্মের চেতনা স্থাপন এবং কুসংস্কার মুক্ত সমাজ গঠনের কার্যে
ব্রতী হয়েছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁর কর্ম প্রচেষ্টা অত্যন প্রশংসার দাবী রাখে।
বুদ্ধসেবক পণ্ডিত সুগতবংশ মহাস্থবির ছিলেন প্রকৃত অর্থে সমাজ সংস্কারক।
নারী জাগরণের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকাকে
কোনও অর্থেই অস্বীকার করা সম্ভব নয়। তিনি অনেক অসহায় নারীকে নানাবিধ সহযোগিতার
মাধ্যমে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছিলেন। এটাও একপ্রকার কল্যাণমিত্রের লক্ষণ।
পণ্ডিত সুগতবংশ মহাস্থবির নারী জাগরণের
পাশাপাশি বৌদ্ধ যুব সমাজের অগ্রগতির প্রশ্নে সদাজাগ্রত ছিলেন। তিনি মনে করতেন যুব
সমাজকে আধুনিক শিক্ষা, ধর্মীয় চেতনা এবং ব্যবসা বাণিজ্যের কাজে অবশ্যই পারঙ্গম হতে
হবে। মান মর্যাদা, শ্রদ্ধা-সম্মান, পরিচিতি লাভের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা
প্রয়োজন, নতুবা সমাজে গ্রহণযোগতার বিষয়টি মূল্যহীন হয়ে যায়।
যথা সঙ্কারধানস্মিং, উজ্জিতস্মি মহাপথে।
পদুমং তথ জায়েথ, সুচিগন্ধং মনোরমং।।৫৮।।
এবং সঙ্কারভূতেসু, অন্ধভূতে পুথুজ্জনে।
অতিরোচেতি পঞ্ঞায়,
সম্মাসম্বুদ্ধসাবকো।।৫৯।।
যেমন মলিনতা পূর্ণ রাজমার্গে পতিত হয়েও
শুদ্ধ গন্ধযুক্ত মনোহর পদ্মপুষ্প প্রস্ফুটিত হয়, ঠিক সেইভাবে মলিনতার ন্যায়
অবিদ্যারূপী মনুষ্যগণের মধ্যে ও ভগবান বুদ্ধের সম্যক জ্ঞান প্রাপ্ত শিষ্য স্বকীয়
প্রজ্ঞা দ্বারা সর্বত্র প্রকাশিত হয় (ধম্মপদ)। ধম্মপদের এই গাথাটি অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ, কেননা বাস্তবিক অর্থে ভদন্ত সুগতবংশ মহাস্থবির ছিলেন ভগবান বুদ্ধের
সম্যক জ্ঞান প্রাপ্ত শিষ্য।
ঘাটচেক ধর্মামৃত বিহার (রাঙ্গুনীয়া)
পুনঃনির্মাণ এবং আত্মযোগী কর্মসাধক শ্রীমং হরি মহাথের কর্তৃক আরাকান অঞ্চল হতে
আনীত বুদ্ধ মূর্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সুগতবংশ মহাস্থবিরের ভূমিকাকে কোন অংশেই
খাটো করে দেখা সম্ভব নয়। অষ্টাদশ শতাব্দীকে এই সুপ্রসিদ্ধ বিহারটি নির্মিত হলেও
(হরি মহাথের প্রতিষ্ঠিত) ১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দে ভয়ংকর বন্যা এবং ১৯৭৫ খ্রীষ্টাব্দে
ইছামতী নদীর করাল গ্রাসে ধর্মামৃত বিহারটি বিলীন হয়ে গেলে সদ্ধর্মপ্রাণ সুগতবংশ
মহাস্থবির'এর ঐকান্তিক প্রেরণা এবং প্রকৌশলী নিরোদ বরণ বড়ুয়া ও ড. জিনবোধি
ভিক্ষুর পরিকল্পনায় এবং গ্রামবাসীদের আর্থিক সহায়তায় ১৯৮৮ খ্রীষ্টাব্দে বিহারটি
নতুন আঙ্গিকে নির্মিত হয়েছিল। এই মহান কর্মযজ্ঞের অন্যতম সাক্ষী ছিলেন শ্রীমৎ
শীলালংকার মহাথেরো এবং বৌদ্ধ দার্শনিক অধ্যাপক শ্রীমৎ ধর্মাধার মহাস্থবির প্রমুখ।
বীর সন্ন্যাসী মহাপ্রাজ্ঞ সুগতবংশ
মহাস্থবির ছিলেন একজন অঘোষিত মুক্তি যোদ্ধা। ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দের মুক্তি সংগ্রামে
(পূর্ব পাকিস্থানের স্বাধীনতা যুদ্ধ) তিনি পরোক্ষভাবে (জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম)
সহায়তা করেছিলেন। তাঁর যুদ্ধ ছিল অস্ত্র দিয়ে নয় সাম্য, মৈত্রী এবং মানব সেবার
বন্ধন দিয়ে। তিনি তাঁর বিহারে অনেক আশ্রয়হীন নরনারীকে আশ্রয় প্রদানের পাশাপাশি
তাদের নানাভাবে সহায়তা করে দেশ ও জাতির স্বার্থে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন।
এক্ষেত্রে তাঁর অভিমত ছিল এইরূপ:
সুসুখং বত জীবাম, বেরিনেসু অবেরিনো।
বেরিনেসু মনুস্স সু, বিহরাম অবেরিনো।।
শত্রুর সাথে অশত্রুতা (মৈত্রী) মূলক
ব্যবহারকারী সংসারে সুখপূর্বক জীবিত থাকতে পারেন। আমরা বৈরীতা পোষণকারীর সাথে
মিত্রতাপূর্ণ ব্যবহার করি।
প্রতিভা এবং সাংগঠিক দক্ষতার কারণে তিনি
একসময় বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার সহসভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৫
খ্রীষ্টাব্দে তাঁকে বাংলাদেশ ভিক্ষা মহাসভার উপ-সংঘরাজ পদে অভিষিক্ত করা হয় এবং
সেই সময় মহামান্য সংঘরাজ ছিলেন শ্রীমৎ শীলালংকার মহাস্থবির মহোদয়। তিনি যেমন
দীপ্তিমান ছিলেন, তেমনি আদর্শ আচার্য রূপে খ্যাতির শীর্ষে ছিল তাঁর অবস্থান।
তিনি স্বীয়প্রতিভা বলে বাংলাদেশ এবং
ভারতে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়
"চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা
শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গনতলে দিবস শর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র
করি,
যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে
উচ্ছ্বসিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত স্রোতে
দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়
অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়-"
পণ্ডিত সুগতবংশ মহাস্থবির তাঁর অবদানকে
চির স্মরণীয় করে রাখার জন্য প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন (১৯৭৭ খ্রীষ্টাব্দ) মহামায়া
গ্রন্থ প্রকাশনী। এই প্রকাশনী হতে তাঁর গ্রন্থ সমূহ প্রকাশিত হয়েছে এবং উক্ত
গ্রন্থ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী উপাসক-উপাসিকা এবং সুধীজনের নিকট অত্যন্ত সমাদৃত হয়েছে।
সুতরাং এই অর্থে ভদন্ত সুগতবংশ মহাস্থবির একজন ত্রিপিটক শাস্ত্রবিশারদ শুধু ছিলেন
না বৌদ্ধ সাহিত্যকে মন্থন করে জনবোধ্যরূপে প্রস্তুত করা এবং যুগোপযোগী সহজ সরল ও
প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যাখ্যা তথা বিশ্লেষণ করার মতো তাঁর বোধশক্তি ছিল অসাধারণ। তার
অধ্যয়ন নিষ্ঠা, পাণ্ডিত্য, সততা, বিনয়শীল চেতনা তিনি তাঁর সমগ্র জীবন অসংখ্য সৎ
আচার্য ও সৎচরিত্রের পুণ্য পুরুষের স্পর্শে স্বীয় জীবনকে উজ্জীবিত করেছেন। এরূপ
মহান এবং সর্বগুণ সম্পন্ন সাধকের সান্নিধ্য লাভ করা বৌদ্ধ সাংঘিক সমাজের পক্ষে
সত্যই গৌরবের বিষয়।
ধর্মারামো ধর্মরতো, ধর্মং
চানুবিচিন্তয়ন।
ধর্মং হ্যনুম্মরা ভিক্ষু:, ধর্মান্ন
পরিহীয়তে।
ভদন্ত সুগত বংশ মহাস্থবির নিরন্তর
ধর্মাচরণ এবং ধর্মচিন্তনে যদা নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর অনুপ্রেরণার প্রতিষ্ঠিত হয়
মেরুল বাড্ডা আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহার (ঢাকা)। তিনি বৌদ্ধ সমাজ এবং সদ্ধর্মের
কল্যাণে যে সকল কর্ম সম্পাদন করেছেন, তা নিরবে-নিভৃতে করেছেন এবং এটাই ছিল তাঁর
জীবনের মহত্ত্বতা।
ধর্মদানং সর্বদানং জয়তি, ধর্মরসো
সর্বরসং জয়তি।
ধর্মরতি: সর্বরতিং জয়তি, তৃষ্ণাক্ষয়:
সর্বদুঃখং জয়তি।।
ধর্মদান অন্য সকল দানকে জয়ী করে নেয়।
এইভাবে, ধর্মরূপ অমৃতপান'এর রস সকল রসকে জয়ী করে। ধর্মে প্রতি অনুরাগ (রতি-প্রেম)
ও সকল রাগের প্রতি বিজয় লাভ করে। তথা তৃষ্ণার বিনাশ সকল দুঃখকে পরাভূত করে নেয়।
ভদন্ত সুগতবংশ মহাস্থবির তৃষ্ণার ক্ষয় দ্বারা সকল দুঃখকে জয় করেছিলেন, কারণ তিনি
ছিলেন জাগতিক বিষয় ভোগ হতে মুক্ত একজন ধর্মাচারী ভিক্ষু। ১৯৯৮ খ্রীষ্টাব্দের ১
সেপ্টেম্বর, জীবনপুরের এই পথিক অর্থাৎ মহান পুণ্য পুরুষ বৌদ্ধ মণীষা সুগতবংশ
মহাস্থবির মহোদয় কালগত হন। ভগবান বুদ্ধ বলেছেন, অনিচ্চ বত সংখার। নিব্বানং পরম
সুখং।'
পণ্ডিত সুগতবংশ মহাস্থবিরের জীবন সাধন
ছিল সদ্ধর্মের অমৃতরূপী রসে পূর্ণ এবং অন্যদিকে জ্ঞানাকাশের দীপ্তশিখার দীপ্যমান।
অর্থাৎ এইভাবে-
বীততৃষ্ণো হ্যনাদানো,
নিরুক্তিম্পদবেনবিদঃ।
অক্ষরানাং সখিপাতং বেত্তি পূর্বাপরানি
চ।
স বৈ অন্তিমশরীরে মহাপ্রাজ্ঞঃ স
উচ্যতে।।
যিনি তৃষ্ণা মুক্ত হয়েছেন, যিনি
অপরিগ্রহযুক্ত, যিনি পদ নির্বাচনে দক্ষ, যিনি অক্ষরের আদি-অন্তকে উত্তমরূপে অবগত
করেছেন, এইরূপ মহাপ্রাজ্ঞ অবশ্যই এই সংসারে অন্তিম জন্মগ্রহণ করেছেন। সুতরাং তিনি
সকল বিষয়কেই অবগত করেছিলেন। তিনি সকল (সাংসারিক) ধর্ম হতে অনুপলিপ্ত হয়েছিলেন।
তিনি সকল বিষয়কেই পরিত্যাগ করেছিলেন। তাঁর সর্ববিধ তৃষ্ণা ক্ষীণ হয়ে যাওয়ার কারণে
তিনি 'বিমুক্ত' হয়েছিলেন।
কথিত আছে যিনি মনুষ্যের অন্তর্নিহিত
ভাবনাগুলি অনুসাধন করতে পারেন তিনিই সর্বজনীন সুগত পুরুষরূপে আবির্ভূত হন।
এক্ষেত্রে তাঁর জীবনাচরণ প্রমান করে তিনি প্রকৃত অর্থেই 'সুগত'। ফলে তাঁর মৃত্যু
হলেও তিনি বৌদ্ধ জাতির জন্য ধ্রুবতারা হয়ে আছেন।
এবং তাঁর মহান কীর্তি তাকে অমর করে
রেখেছে আমাদের মাঝে। শ্রদ্ধেয় ভদন্ত সুগতবংশ মহাস্থবির আপনি আজও ফিনিক্স পাখির
ন্যায় মৃতুঞ্জয়ী।
এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ।
মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।।
হে মহাসুগত, আপনার জীবন থেকে সৃষ্টি হোক
ক্রান্তিকাল। মুছে থাক অজ্ঞানতা, মলিনতা। বৌদ্ধ জাতির জীবনে নেমে আসুক নবজীবনের
সঙ্গাত। জয় হোক সত্যের...।
পরম কল্যাণমিত্র উপসংঘরাজ ভদন্ত সুগতবংশ
মহাস্থবির মহোদয়ের আর্শীবাদ পুষ্ট আমি। তাঁর সান্নিধ্যে যাওয়ার অনেকবার সুযোগ লাভ
করেছি। তাঁর মধ্যে সত্যবাদিতা তেজস্বিতা, বিনয়াবরণে পরিপূর্ণ একজন মানুষ। তিনি
দেশনা করতেন সেগুলি তাঁর অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞানের আকর থেকে। তিনিও যাঁদের সান্নিধ্য
পেয়েছেন, তাঁরা হলেন দার্শনিক বিশুদ্ধানন্দ মহাস্থবির, পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির,
ভগবানচন্দ্র মহাস্থবির, রাজগুরু ধর্মরত্ন মহাস্থবির, কবিরত্ন সুবিমল বিদ্যারত্ন
মহাস্থবির। এই সুবিমল বিদ্যারত্ন মহাস্থবির ছিলেন আমার দাদুর মামা। পণ্ডিত সুগতবংশ
মহাস্থবিরের বিভিন্ন গ্রন্থ সাধারণ মানুষকে সত্য ধর্ম দর্শনের পথ চলার সুগম করে
দিয়েছেন। ১৯৯১ সালে ঘূর্ণিঝড়ে তাঁর পায়ে আঘাত লাগলেও তিনি সমগ্র বৌদ্ধপল্লী চষে
বেড়িয়েছেন, সদ্ধর্ম প্রচার প্রসারে। ১৯৯১ সালে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে শিলক গ্রামে
শ্রীমৎ জ্ঞানবংশ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে তিনি সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছিলেন
তাঁ নেতৃত্বে এবং সভাপতিত্বে। তাছাড়া আমার শিলক গ্রামে উপাধ্যায়দেব সংঘরাজ ড.
রাষ্ট্রপাল মহাস্থবির কর্তৃক বিদর্শন ধ্যান শিবিরে গিয়ে তিনি দেশনা করতেন। সেখানে
তিনি তাঁর রচিত "বৌদ্ধ যোগ সাধনা" গ্রন্থের অলোকে দেশনা করতেন। সেখানে
তিনি বলতেন নির্বাণ লাভ বা স্রোতে পড়া এত সোজা নয়। খুব সজাগ ও সচেতন হয়ে
ধ্যানানুশীল একান্ত অপারিহার্য। শিলক গ্রামে ধ্যান শিবির চলাকালীন আমাদের পরিবার
থেকে আমার দাদু, ঠাকুর মা, মা বাবা সাধক সাধিকাদের ভোজন দান করতেন।
তাঁর প্রতিষ্ঠিত ধর্মামৃত বিহারে আমি
প্রায় সময় তাঁর আদেশ উপদেশ এ নিতে ও শুনতে যেতাম। তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ ও আপন
করে নিতেন। তিনি আমাকে আর্শীবাদ করে বলেছিলেন এই ছোট ভিক্ষু জীবনে অনেক উপরে উঠতে
পারবে এবং সুপরিপূর্ণতা আসবে। আমাকে এই কথা সরাসরি বলেননি অন্যকে বলেছেন তারাই
আমাকে এটি বলেছিলেন। তাঁর আর্শীবাদ আমি লাভ করেছি। তাঁর গুরু পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির ও তাঁর অন্যতম শিষ্য
আমার আচার্যদেব ড. জিনবোধি মহাথের মহোদয়েরও আর্শীবাদ আমি পেয়েছি। আমি এই মহান
গুণীদের আভূমি বন্দনা করছি। ড. জিনবোধি মহাথের প্রণীত " পণ্ডিত সুগতবংশ
মহাস্থবির- জীবন সাহিত্য সাধনা ও মূল্যায়ন" গ্রন্থটি সময়োপযোগী ও কালের
সাক্ষীরূপে পরিগণিত হবে এতে কোন দ্বিমতের অবকাশ থাকবে না। অনাগত সংঘ সমাজ এই
মহাপুরুষের পথ চলে নিজেদের জীবনকে আলোকোজ্জ্বল হোক। অলং ইতি বিত্থারেন।
পোর্ট ব্ল্যায়ার,
আন্দামান নিকোবর।
১৫ অগাস্ট ২০২৫, স্বাধীনতা দিবস।
২৫৬৯ বুদ্ধাব্দ ।
সুমনপাল ভিক্ষু
অতিথি অধ্যাপক
পালি বিভাগ ও বৌদ্ধবিদ্যা
অধ্যয়ন বিভাগ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
ও
পালি বিভাগ, সংস্কৃত কলেজ ও
বিশ্ববিদ্যালয়।