Friday, July 18, 2025

বড়ুয়া বৌদ্ধদের ইতিহাস এবং ভবিষৎ : স্বভূমে-বর্হিবিশ্বে

 

বড়ুয়া বৌদ্ধদের ইতিহাস এবং ভবিষৎ : স্বভূমে-বর্হিবিশ্বে

ভূমিকা

ভারতীয় উপমহাদেশে নানাবিধ গণতন্ত্র জাতিসত্তা মধ্যে অন্যতম হল 'বড়ুয়া' তবে আজ হতে প্রায় ১৫০- ২০০ বৎসর পূর্বে বড়ুয়া শব্দটি ছিল শুধুমাত্র উপাধি। বর্তমানেও 'বড়ুয়া' জাতিসত্তায় বড়ুয়া, চৌধুরী, তালুকদার, মুৎসুদ্দি, সিংহ এরূপ নানাবিধ পদবী তথা উপাধি পরিলক্ষিত হয়। তবে আরও পূর্বে সিং, প্রু, মেঙ ইত্যাদি উপাধিও বিদ্যামান ছিল। তবে রাজনৈতিক জটিলতার কারণে তথা উক্ত পরিস্থিতি হতে পরিতাপের নিমিত্তে সম্ভবত উক্ত উপাধিটিকে (বড়ুয়া) জাতিসত্তায় বহুল পরিমাণে ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয়েছিল বলে মনে করা হয়। আবার রাজবংশী (রা.), ভূইয়া, মগ বা  'বড়ুয়া' জাতিসত্তার অপর নাম।

প্রসঙ্গত উল্লেখনীয় যে, এই জাতিসত্তা শাক্য বংশোদ্ভূত। রাজ্য বিস্তারের কারণে অথবা নিজ জাতিসত্তার অস্তিত্ব সংকট হতে পরিত্রাণের অভিপ্রায়ে তারা প্রথমে মগধ অঞ্চল (বর্তমান ভারতের বিহার রাজ্যের একটি অঞ্চল) এবং কালক্রমে আরাকান অঞ্চলে উপস্থিত হয় তথা চন্দ্রবংশ নামে পরিচিত হল। 

চন্দ্রবংশীয় রাজবংশের দুই উল্লেখনীয় রাজা ছিলেন বাহুবলী। এবং রঘুপতি। উভয়েই ছিলেন সহোদর ভ্রাতা। কথিত আছে যে রাজা বাহুবলীর বংশবড়ুয়া' এবং রাজা রঘুপতির বংশ 'মারমা রাখাইন' জাতিসত্তা রূপে পরিচিত লাভ করে। মধ্যযুগে এই তিনটি জাতিসত্তা 'মগ' নামে সমাদৃত হয়। এই মগ বংশোদ্ভূত শাসকগোষ্ঠী সম্মিলিতভাবে আরাকান তার পার্শ্ববর্তী ১২টি নগরে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। তবে মধ্যযুগের শেষার্ধে ভারতীয় উপমহাদেশে ক্রমাগত যুদ্ধ এবং বহিরাগত জনগোষ্ঠীর আক্রমন ইত্যাদি কারণে মগরাজ্য বিলুপ্ত হয় পড়ে আরাকান অঞ্চল বার্মার (বর্তমান মায়ানমার) শাসকগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণভুক্ত হয়ে পড়ে। ভারতীয় উপমহাদেশে ইউরোপীয় বণিকদের আগমন তথা বৃটিশ শাসনকালে বড়ুয়া জাতিসত্তাকে একটি পৃথক জাতি তথা স্বতন্ত্র জাতিসত্তা রূপেই গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে (১৯৪৭-১৯৭১ খ্রীঃ) ভারত, বাংলাদেশ ইত্যাদি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের উৎপত্তির পরবর্তী সময়ে বড়ুয়া জাতিসত্তার ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়।

আরাকানী প্রভাব এই অঞ্চলে আরাকানী শাসন থাকার কারণে এখানে অসংখ্য বৌদ্ধ চৈত্য অবস্থিত ছিল বলে স্থানের নাম হয় চৈত্যগ্রাম... পরবর্তীকালে চৈত্যগ্রাম নাম বিবর্তিত হয়ে চট্টগ্রাম রূপে প্রাপ্ত হয়।চিৎ-তৌৎ-গৌং হতে চট্টগ্রাম, চাটিকিয়াং হতে চট্টগ্রাম ইত্যাদি। তবে এই নামকরণ প্রসঙ্গে তিনি নানাবিধ ঐতিহাসিক তথ্য উল্লেখ পাওয়া যায়। ফলে চট্টগ্রামের নামকরণ প্রসঙ্গে এই সুস্পষ্ট ধারণা পাঠকগণের সম্মুখে দর্পণের প্রতিবিম্বের ন্যায় উদ্ভাষিত হয়েছে।

মগধ অঞ্চলে মগ জাতি গোষ্ঠীর আর্বিভাব সহ মগধ সাম্রাজ্য তথা মগধ অঞ্চলের মগদের নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা। পূর্বে এরা ভারতের মগধ বা বিহার অঞ্চল থেকেই এসেছিল। মগধ থেকে এসেছিল বলেই তাদের নাম 'মগ' হয়। 

চট্টগ্রামের মগের ইতিহাস' বর্ণনায় . রামচন্দ্র বড়ুয়া বলেছেন— 'মগ কোন জাতীয় লোক এবং তাহারা চট্টগ্রামে কোথা হইতে আগমন করেন, তাহার বিবরণ ব্রহ্মার ইতিহাসে কিয়ৎ পরিমাণে জানা যাইতে পারে। ইতিহাসে বর্ণিত হইয়াছে, দক্ষিণ বেহার বা মগধ দেশীয় লোকেরাই মগ নামে পরিচিত। তাহারা রাজগৃহ পাটনা নগরের মগধরাজ জরাসন্ধ বংশজাত বলিয়া রাজবংশীয় নামে অভিহিত এবং আর্য (ক্ষত্রিয়) বংশ হইতে উৎপন্ন। সম্ভবত বেহারে হিন্দুধর্ম প্রবল হওয়াতে তাহারা চট্টগ্রামে (তৎকালীন আরাকান) আগমন করিয়া ছিলেন। বৌদ্ধদের উপর বিধর্মীদের আক্রমণ, ধর্মান্তর দেশত্যাগ প্রসঙ্গে বলা যায়, ' ... সেনবংশ তখন বঙ্গের অধিপতি। তুর্কী আক্রমণ সেনদেরও পরাজিত করেছে। এই সময় থেরবাদীরা আরাকান অন্বেষণে, এতদ প্রাচীন আরাকানের বর্তমান চট্টগ্রাম অঞ্চলে চলে আসে।

পাকিস্তান (পূর্ব) স্বাধীন বাংলাদেশে বড়ুয়াদের অবস্থান বিষয়টি  আলোচনার প্রয়োজন হয়েছে। বড়ুয়া মগ হচ্ছে সম্ভ্রান্ত শ্রেষ্ঠ অর্থবোধক, যারা শাক্যবংশীয় এবং বৌদ্ধধর্মের প্রাণকেন্দ্র মগধ আগত জাতিসত্তা।' মগেরা ধার্মিক এবং সভ্যজাতি। বাঙালীদের নিকট বড়ুয়াগণ 'মগ' নামেই পরিচিত, বাঙালী নয়। সুতরাং বড়ুয়া একটি স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠী। 

ভারত তথা বর্তমান বাংলাদেশে বড়ুয়াদের অস্তিত্ব বজায় রাখা এবং সংকট উত্তরণে একান্ত অপরিহার্য ভূমিকা পালন করা আমাদের সকলের আশু কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতিহাসের ক্রমবর্ধমানতায় আমরা বারবার ভূমিহীন হয়েছি, নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে লালন পালন করা তো দূরের কথা, সেগুলিকে বাঁচিয়ে রেখে অনাগত প্রজন্মের জন্য কিভাবে কী রেখে যেতে সেটাই আমাদের সকলকে তা ভাবতে আমি অনুরোধ করবো। আমাদের সংকীর্ণতা থেকে মুক্তির পথে অগ্রসর হতে হবে। অলং ইতি বিত্থারেন।

 

সুমনপাল ভিক্ষু

অতিথি অধ্যাপক 

পালি বিভাগ 

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

 

সংস্কৃত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়

No comments:

Post a Comment