সুমনপাল ভিক্ষু
“...সাহিত্যকে যেতে হবে শ্রমিকের বস্তিতে, তাদের ক্লেদাক্ত জীবনের ছবি হুবহু তুলে ধরতে নয়, আধুনিক সমাজের বাহক শ্রমিক শ্রেণীর যন্ত্রণাকে কে তুলে আনাই আধুনিক সাহিত্যের কাজ - পূর্বের মতো রাজা-রাজড়া, জমিদারের দুঃখ –দৈন্য দ্বন্ধহীন জীবনেতিহাস নিয়ে আধুনিক সাহিত্যসেবীর মন আর ভরে না! বরঞ্চ এই অভিশপ্ত, অশেষ দুঃখের দেশে, নিজের অভিমান বিসর্জন দিয়ে রুশ সাহিত্যের মতো যেদিন সে আরও সমাজের নিচের স্তরে নেমে গিয়ে তাদের সুখ, দুঃখ, বেদনার মাঝখানে দাঁড়াতে পারবে, সেদিন এই সাহিত্য-সাধনা কেবল স্বদেশে নয়, বিশ্ব সাহিত্যেও আপনার স্থান করে নিতে পারবে।”
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; সাহিত্যে আর্ট ও দুর্নীতি।
শুধু কি তাই? ঋত্বিক ঘটক দেখিয়েছেন কীআবে আধা সামন্ততান্ত্র্রিক এবং আধা-ঔপনিবেশীক ভারতবর্ষের সাম্রাজ্যবাদী শোষন বিস্তৃত হয়েছে সুদূর গ্রামাঞ্চলে। আর গ্রামীণ অর্থনীতির বাঁধ ভেঙ্গে ঘর থেকে উৎখাত হওয়া মানুষগুলোকে কুলি-মজুরে পরিণত করেছে সাম্রাজ্যবাদের তল্পি বাহকেরা। সেই কুলি-মজুরদের মর্মান্তিক জীবন কী অসাধারণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ঋত্বিক তাঁর সিনেমায়। নিষ্পেষিত, বঞ্চিত মানব জীবনের অপমৃত্যুর বেদনাময় ছবি জনগনকে নাড়িয়ে দেয়। সমাজের এই অব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাদের এতনাকে জাগ্রত করে তোলে। তাহলে এখন একটা প্রশ্ন হল সমাজকে অবজ্ঞা বা অবহেলা করে কি সিনেমা-শিল্প হয়? সাহিত্য হয়? না, হয় না। কোনও ভাবেই তা সম্ভব নয়। সুতরাং এই অর্থে বলতে হয় শিল্পের জন্য শিল্প না কি মানুষের জন্য? উত্তর একটাই যে মানব সমাজ ব্যতীত কোন শিল্পই সম্ভব নয়। কারণ আমাদের মস্তিস্ক এই সমাজের মধ্যেই অবস্থান করে। তাহলে আমরা কি প্রত্যক্ষ করি? প্রত্যক্ষ করি এই সমাজ, সভ্যতা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি সব কিছুই। সুতরাং এই অর্থে সমাজের দ্বন্ধ-দ্বিধা, ধূঊআন-পতন, ভলো-মন্দ আমাদের মধ্যেও নিহিত হয়। আমাদের এতনার স্তরে ও ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তাহলে সমাজকে ব্রাতজন কে কী করে চলবে জীবন বৃত্তান্ত। কারণ আমাদের মস্তিস্ক কাজ করছে বিজ্ঞানের নিয়ম মেনে, আমরা যখন দেখছি এই বস্তুজগত নিয়ম পরিবর্তনশীল, তার সঙ্গে আমাদের নিবিড় যোগসূত্র আছে, তখন নিরপেক্ষতা মানা যায় নাকি? আমরা কি কোন ভিনগ্রহের প্রানী! অথচ তথাকথিত বুদ্ধিজীবির একটা অংশ এমনটাই মনে করেন। মনে করেন তাদের শিল্প-সত্ত্বা দেশ-কাল-সমাজ নিরপেক্ষ। যেন তাদের এই উদ্ভট নিরপেক্ষতা শিল্প সত্ত্বার গতিপ্রকৃতিকে কোনও এক অদ্ভূত সুখানুভূতি প্রদান করবে। অথচ এই ব্যাধির একটু গভীরে প্রবেশ করলেই বোঝা যায় যে তাদের এই অলীক চিন্তা-আবনা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিলাস ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে এক্ষেত্রে ‘ঋত্ত্বিক ঘটক’ এর ভাবনাতে আমরা সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি পাই। ১৯৫৪ সালে তিনি ‘পলিটিক্যাল থিসিস’এ লিখলেন, “গতচার বছর আমরা কোনও উঁচুদরের শিল্পকর্ম রচনা করতে পারিনি। আমরা আমাদের কিছু পুরোনো কাজকে টেনে বার করেছি, ঝাড়পোঁছ করেছি, এবং তার একটা নতুন নাম দিয়েছি। অথবা অপেশাদারী, শৌখিন তৃতীয় শ্রেণীর কাজ করেছি। আর সর্বক্ষণ বক্তা প্রধান হয়ে থেকেছি। নিশ্চিতই এ এক ভয়ঙ্কর ঘটনা।” তিনি আরও বলেছেন, “...সত্যিকারের সৃজনশীল শিল্পী যাঁরা, আমাদের মধ্যে যাঁদের হাতে গোনা যায়, তারা ধীরে ধীরে ...বৃত্তের বাইরে চলে যাচ্ছেন।” কতটা হতাশ হলে ঋত্ত্বিকের মতো উঁচুদরের শিলঈ এমন কথা বলতে পারেন! গননাট্য সংঘ হতে যোগসূত্র বিচ্ছিন্ন করার পর ঋত্বিক সরষ্ট সিনেমাগুলি বিশেষ করে ১৯৪৭-এর দেশাগের ব্যাথা যন্ত্রণাকে উপজীব্য করে তাঁর ‘ট্রিলজি’- ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’, ও ‘সুবর্ণরেখা’, তাদের কি বাণিজ্যিক তকমা প্রদান করা যায় জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা কি তাঁর অটুট থাকেনি?
‘হায় বিধি বড়ই দারুণ...
ক্ষুধার আগুন জ্বলে আহার মেলেনা।’
-সলিল চৌধুরী।
শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নটি মানিক মুখোপাধ্যায় অত্যন্ত সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, “শিল্পী সমাজ পরিবেশ থেকেই তাঁর শিল্পের রসদ সংগ্রহ করেন। এমন কী যে রূপাশ্রয়ে তাঁর শিল্প সৃষ্টি, সেটিও সমাজ জমিন থেকে আহরিত। জগৎ-সংসারের সব কিছুর মতো শিল্পীর চেতনা, বোধ, মনন সব কিছুই নিয়ম শাসিত।” এক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন উথ্থাপিত হয় যে সব কিছুই যদি নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকে এবং কোনরূপ স্বাধীনতা না থাকে তাহলে শিল্পী নতুন কিছু সৃষ্টি করবেন কি ভাবে? এক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত সাবলীল ভাবে বলেছেন, “শিল্পীর চিন্তা একটা আপেক্ষিক স্বাধীনতা আছে, কিন্তু বস্তুজগতের স্থানকালের সীমার মধ্যেই সেই স্বাধীনতা, তার বাইরে নয়।”
“অনেক শ্রমিক আছে এইখানে।
আরো ঢের লোক আছে, সঠিক শ্রমিক নয় তারা।
স্বাভাবিক মধ্যশ্রেণী নিম্নশ্রেণী মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিধি থেকে ঝরে
এরা তবু মৃত নয়; অন্তবিহীন কাল মৃতবৎ ঘোরে।”
-জীবনানন্দ দাশ
ছন্নছাড়ার প্যারাডাইস এবং ঋত্বিক কুমার ঘটক
উত্তাল ৪০’এর অসমাপ্ত বিল্পব পূর্ব ইউরোপ জুড়ে সন্ত্রাসিবাদের উথ্থান এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকা আকাশে মুক্তি সূর্যের ম্যানিফেষ্টো শ্রমিক কৃষক ঐক্য জোট সমগ্র পৃথিবীর পটভূমি জুড়ে বিপ্লবের আহ্বান-
‘আমি বিদ্রোহী...
বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল’।
‘আমি সেই দিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের এশনে রোল
আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না।
অত্যাচারীর খড়গ কৃপা
ভীম রণভূমে রণিবে না,
বিদ্রোহী রণক্লান্ত,
আমি সেই দিন হব শান্ত’।
-নজরুল ইসলাম
সেই বিপ্লবাত্মক স্পিরিট। সমস্ত প্রকার শোষন অত্যাচারের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম। কিন্তু যথার্থই তা উচ্ছৃঙ্খল নয়। বিদ্রোহী শান্ত হবে অত্যাচার অনাচার বন্ধ হলে। এখানেই নিয়ম ভাঙার মধ্যে নৈতিকতার সুর ও মূল্যবোধের মহানতা। সুতরাং এই অর্থে সামাজিক উপপাদ্যের বিষয়টি বুঝিয়ে দেয় অন্যস্বর। ঋত্বিক ঘটকের কথায় এই অন্যস্বর ম্যনিফেষ্টো হয়ে উঠেছে। তাঁর বয়ানে বিষয়টি এরকম : “বাঙালী ছেলেদের বাঁধা এবং ফরাসিদের ও যা হয় শুনেছি যে ভেতরে একটা ক্রিয়েটিভ আর্জি দেখা দিলে প্রথমে কবিতা বেরোবে। তা দু’চারটে হতভাগা লেখা দিয়ে আমার শিল্পচর্চা শুরু হলো। তারপর আমি দেখলাম ওটা আমার হবে না, কাব্যির এক লক্ষ মাইলের মধ্যে আমি কোনদিন যেতে পারবো না। ...তারপর হলো কী, রাজনীতিতে ঢুকে পড়লাম।”
৪০’এর দশকের এই পর্বটা ছিল দ্রুত পট পরিবর্তনের প্রক্ষেপট। বঙ্গ দেশের গ্রাম বাংলার যে জীবন ছিল শান্ত নিস্তরঙ্গ, তা এক লহমায় উথাল-পাতাল হয়ে গেল। কৃত্তিম খাদ্য সংকট আহ্বান করল এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ।
তিনজন হাইড্রান্ট থেকে জল নিয়ে মগে ঢেলে চা বানাচ্ছে, আর “মাথা নেড়ে দুঃখ করে নিজেদের মধ্যেই রাজা উজির মারছে।” ওদের বক্তব্যের সার কথা হলো : “আমাদের সোনা নেই রূপো নেই তবু আমরা কে কার ক্রীতদাস?” ...এর পেরই চারজনে মিলে ‘গননা করে গেল পৃথিবীর ন্যায় অন্যায়।” – জীবনানন্দ দাশ
অপর অর্থে ঋত্বিক ঘটক বলেছেন, “মানুষকে আমি ভালোবাসি পাগলের মতো। মানুষের জন্যেই সবকিছু। মানুষই শেষ কথা। সব শিল্পেরই শেষ পর্যায়ে মানুষে পৌঁছতে হয়। যাঁরা তা করেন না, তাঁরা শিল্পী বলে আমার কাছে কোন আদর পাবেন না। ঈশ্বরে আমি আদৌ বিশ্বাস করি না। শুধু তাই নয়, এ নামটাকেই আমি ঘৃণা করি। এই সব গল্প দিয়ে আর কতদিন সমাজ সংসার চালাতে হবে, সেটা আমাকে বুঝতে হবে। এসব বানানো গল্প সম্পূর্ণ জোচ্চুরি। আর, বেবাক জোচ্চুরু দিয়ে খুব বেশীদিন ঠকানো বা ঠেকিয়ে রাখা যায় না, এটাও ভাববার সময় এসেছে।”
গোপাল অতি সুবোধ বালক...। তবে এক্ষেত্রে ঋত্বিক ঘটক (৪ নভেম্বর ১৯২৫ – ৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৭৬) এর মধ্যে সুবোধ বালক হয়ে ওঠার অভিপ্রায় সেই অর্থে গড়ে ওঠেনি। তিনি পৃথিবীর পাঠশালার সন্ধানে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় ইতি টেনে বেশ কয়েকবার বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছেন। ছেলের এইরূপ ভাবগতিক প্রত্যক্ষ করে তাঁর বাবা তাঁকে বলেছিলেন, ম্যাট্রিক পরীক্ষাটা দিলে ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যায়, নইলে মিস্তিরি হয়ে থাকতে হবে। অবশেষে তিনি বুঝেছিলেন “গল্প যথেষ্ট নয়, মানুষের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া চাই। কারণ গল্প নাড়া দেয় অনেক গভীরে গিয়ে, অনেক সময় লাগে।”
‘আসলে সে নিজেই সে নিজের ধিক্কার।
তাই তার ঘৃণা
প্রায় বিশ্বমানবকে, তাই তার রাগ
অসহায় অপরাগ অশক্ত শিশুর ভিড়ে খোঁজে
প্রতিহিংসার শিকার।
দুর্বুদ্ধি কাদায় ভারি গাদাকবুকের ফাঁকা তাগ-
সে করে চলেছে নিত্য কোনো টোটা বিনা,
নিজেই সন্ত্রাসে চোখ বোজে
দুই হাত সক্ষী তোদরে, পৌরুষের মরিয়া বিকার।
মানুষ যখন হয় মনুষ্যহীনতার উন্মাদ ধিক্কার”
-বিষ্ঞু দে।
ফরাসী ঔপন্যাসিক ও দার্শনিক অ্যালবেয়ার কামু লিখেছিলেন, “একটি জল্লাদ ও শিকারদের বিশ্বে, চিন্তাশীল মানুষদের দ্বায়িত্ব হলো, জল্লাদদের পক্ষে না থাকা।” জাতীয় আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রক্ষেপটকে পরিলক্ষিত করে ঋত্বিক ঘটক ৪০’এর দশকে বামপন্থী মতাদর্শের প্রতি অনুরক্ত হয়ে ওঠেন। এক্ষেত্রে তাঁর অবস্থান ছিল সোজা – সাপটা। এই সময় অগ্রণী, গল্প ভারতী, দেশ, শনিবারের চিঠি সহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রায় গোটা পঞ্চাশেক গল্প প্রকাশিত হয়।
“...প্রযোজনাগুলো অবশ্যই যেন সরল ও প্রত্যক্ষ হয় যা জনসাধারণ বুঝতে পারে এবং সেগুলির সৃষ্টিতে অংশ গ্রহণ করতে পারে (গণনাট্য সংঘের প্রথম ঘোষনা পত্র, ১৯৪৩ খ্রীঃ)। প্রসঙ্গত মনে রাখা প্রয়োজন ঋত্বিক ঘটক’কে সাহিত্যের জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছিলেন কল্লোল যুগের বিশিষ্ট কবি মনীশ ঘটক, অর্থাৎ তাঁর বড়দা। পরবর্তী সময়ে ঋত্বিক ঘটক গননাট্য সংঘে যুক্ত হন। মূলত অভিনয়ের প্রতি তাঁর আকর্ষণ প্রবল ছিল। সাম্যবাদের অধ্যয়ণ সহ গননাট্যে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তাঁর বৈপ্লবিক সত্ত্বার রসায়ন এক সময় পরিপক্কতা লাভ করে এবং তিনি ১৯৪৮ ক্রীঃ গননাট্য সংঘের সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫২ খ্রীঃ পর্যন্ত তিনি সম্পাদক ছিলেন। এই সময় তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি ছিল দলিল, জ্বালা, অফিসার, ভাঙা বনরে, সাঁকো ইত্যাদি।
“মানুষের উৎসব কবে? মানুষ যেদিন আপনার মনুষ্যত্বের শক্তি বিশেষ ভাবে স্মরণ করে, বিশেষ ভাবে উপলব্দি করে, সেই দিন। যে দিন আমরা আপনাদিগকে প্রাত্যহিক প্রয়োজনের দ্বারা চালিত করি, সেদিন না – যেদিন আমরা আপনাদিগকে সাংসারিক সুখদুঃখের দ্বারা ক্ষুদ্ধ করি, সেদিন না...।” – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
সুতরাং এই অর্থে ঋত্বিক ঘটক ছিলেন ছিন্নমূল মানুষের আর্তনাদ।
ছিন্নমূল ঋত্বিক এবং তারপর
“একা একা শহরের পথ থেকে পথে
অনেক হেঁটেছি আমি; অনেক দেখেছি আমি
ট্রাম বাস সব ঠিক চলে
তখন অনেক রাত - তখন অনেক তারা
মনুমেন্ট মিনারের মাথা নির্জনে ঘিরেছে
এসে…
বেবিলনে একা একা এমনই হেঁটেছি আমি
রাতের ভিতর…
হাজার হাজার ব্যস্ত বছরের পর।”
-জীবনানন্দ দাশ
দেশ বিভাগ এবং সাম্প্রদায়িক সংঘাত ঋত্বিক ঘটকের মনে এক বিয়োগাতঙ্ক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। এই ক্ষতের জ্বালা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল ‘দলিল’ নাটক। এক সময় এই নাটকটি গণনাট্য সংঘের সর্বভারতীয় সম্মলনে মঞ্চস্থ হয়। সিনেমাকে ঘিরে তাঁর যে প্যাশন ছিল তার অন্যতম কারণ, তিনি যা করতে চাইছিলেন সেই বক্তব্য সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছানো। সিনেমার ভাষা ও মাধ্যম সম্পর্কে তাঁর যা দখল সেটা গণ-সংস্কৃতির ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ করার লক্ষ্যে; এবং তিনি স্থির নিশ্চিত ছিলেন যে, সিনেমার চেয়ে অন্যতর কো’নো মাধ্যমের খোঁজ মেলে তা একই দক্ষতায় ও একই উদ্দেশ্য ব্যবহার করতে পারবেন। এই অর্থে সিনেমা সম্পর্কে ঋত্বিক বলেছেন, “…সিনেমা করবো বলে আসিনি। কাল যদি সিনেমার চেয়ে বেটার মিডিয়া বেরয় তাহলে সিনেমা কে লাথি মেরে আমি চলে যাব। আই ডোন্ট লাভ ফিল্ম।”
আবার তোরা মানুষ হ। মানুষ…। হৃত্বিক ঘটক বলতেন- “আমি প্রতি মুহূর্তে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে বোঝাবো যে, ইট ইজ নট্ এন্ড ইমাজিনারি স্টোরি বা আমি আপনাকে সস্তা আনন্দ দিতে আসেনি। প্রতি মুহূর্তে আপনাকে হাতুড়ি মেরে বোঝাবো যে যা দেখছেন তা একটা কল্পিত ঘটনা, কিন্তু এর মধ্যে যেটা বোঝায় বোঝাতে চাইছি আমার সেই ফিলিংসটা বুঝুন, সেটা সম্পূর্ণ সত্যি, সেটার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই আমি আপনাকে অ্যালার্ট করবো প্রতি মুহূর্তে। যদি আপনি সচতেন হয়ে ওঠেন, ছবি দেশে বাইরের এই সামাজিক বাধা দুর্নীতি বদলের কাজে লিপ্ত হয়ে ওঠেন, আমার প্রোচেস্টটাকে যদি আপনার মধ্যে চাপিয়ে দিতে পারি তবেই শিল্পী হিসেবে আমার সার্থকতা।”
প্রযোজক প্রমোদ লাহিড়ী ‘অযান্ত্রিক’ সিনেমার জন্য ঋত্বিককে টাকা দিয়েছিলেন। সুবোধ ঘোষ’এর বিখ্যাত গল্প ‘অযান্ত্রিক’। জ্ঞানেশ মুখার্জী, কালী ব্যানার্জি, কাজল গুপ্ত এঁরা এই সিনেমার অভিনয় করেছিলেন। তাপস সেন লিখেছেন- “’অযান্ত্রিক’ দেখে তো আমরা মুগ্ধ। কিন্তু সিনেমা হলে লোক হয়না। রোজই আমি আর ঋত্বিক হাজরার মোড়ে এসে দাঁড়াতাম। আর ঋত্বিক বলতো ‘আজ লোক হয়নি কিন্তু কাল হবে, এ ছবিতে লোক হবে না।’ রোজ দাঁড়িয়ে থাকতাম সেই আশায়…।”
‘নাগরিক’ সিনেমা অনেক বাধা-বিপত্তির মধ্যে সম্পন্ন হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে, ‘নাগরিক’ সঠিক সময় মুক্তি পেলে হয়তো ভারতীয় সিনেমার ইতিহাস অন্য ভাবে রচিত হতো! ঋত্বিক ঘটকের ছবি প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায় অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন, “…ঋত্বিক ছবিতে কিছু কিছু সোভিয়েত ছবির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু যে প্রভাবটা সেখানে অনুকরণ নয়, কারণ ঋত্বিকের প্রধান বৈশিষ্ট্য তার মৌলিকতা এবং সেটা সে শেষ পর্যন্ত বজায় রেখেছিল…।”
তাহলে সিনেমা কি সংস্কৃতির বাইরে? - কে বলবে!
ঋত্বিক ঘটকের মতো বড় মাপের শিল্পী তখন গণনাট্য আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল। যুগের আকর্ষণ’ই তাকে এপথে টেনে এনেছিল। তাহলে বলতে হয় সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটা তখন কেমন ছিল?
সেই সময়ের দেশ জুড়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের জোয়ার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সুভাষচন্দ্র বোসের আজাদ হিন্দ বাহিনী, ভারতছাড়ো আন্দোলন এবং তার কয়েক বছর পর নৌ বিদ্রোহ। এই সন্ধিক্ষণে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার রক্তচক্ষু’কে উপেক্ষা করে বহু প্রগতিশীল মানুষ, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক বামপন্থী মতাদর্শের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল। এক্ষেত্রে ঋত্বিক ঘটক ও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। মৃণাল সেনের কথায় “…আমরা অন্তসারশূন্য দেশজ ও সিনেমাকে তীব্রভাবে ঘৃণা করতে শিখেছিলাম, নতুন একটা ফ্রন্ট গড়ে তোলার জন্য মুখিয়ে উঠেছিলাম। প্যারভাইস কক্ষে’র ভাঙ্গার চেয়ার টেবিল বাসা ঐ ছোট ঘরে, যে ফ্রন্টে বিপ্লব তার সিনেমা হাত ধরাধরি করে চলবে…।”
ঋত্বিক ঘটক সিনেমা জগতে প্রবেশ করেন নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’ (১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ) সিনেমার মধ্য দিয়ে। এই সিনেমায় তিনি একই সঙ্গে অভিনয় এবং সহকারী পরিচালক রূপেও কাজ করেছিলেন। এর দু’বছর পরে তাঁর একক পরিচালনায় মুক্তি পায় ‘নাগরিক’। এই দুই সিনেমা’ই ভারতীয় সিনেমার গতানুগতিক ধারাকে প্রবল ভাবে নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছিল। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখ্যনীয় সিনেমা অর্থাৎ চলচ্চিত্র গুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ‘মেঘে ঢাকা তারা’ (১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ), ‘কোমল গান্ধার’ (১৯৬১ খ্রিস্টাব্দ) এবং ‘সুবর্ণরেখা’ (১৯৬২ খ্রিস্টাব্দ) অন্যতম; এই তিনটি চলচ্চিত্র’কে ‘ত্রয়ী’ রূপে চিহ্নিত করা হয় যার মাধ্যমে কলকাতার সমকালীন পরিস্থিতি এবং ছিন্নমূল জীবনের রুঢ় বাস্তবতা চিত্রিত হয়েছে।
‘কোমল গান্ধার’ এবং ‘সুবর্ণরেখা’ এত এগিয়ে থাকা চলচ্চিত্র ছিল যে সেই সময়কালে তা অত্যধিক সমালোচনার মুখে পড়েছিল, ফলে ব্যবসায়িক ব্যর্থতার কারণে এই দশকে তাঁর পক্ষে আর কোন চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সম্ভবপর হয়নি।
ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র জগতে পুনরাবির্ভাব ঘটে ৭০’এর দশকে। অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচিত একটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ঋত্বিক’এর অসামান্য পরিচালনায় চলচ্চিত্রে (১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে) রূপদান সম্পন্ন হয়। এই সময় অনিয়মিত জীবন যাপনের ফলে তার শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত ভেঙ্গে পড়ে এবং নিয়মিতভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়া তাঁর পক্ষে আর সম্ভবপর হয়নি। তাঁর শেষ কাজ ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ (১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ)।
‘তিতাস একটি নদীর নাম’ নামক উপন্যাসটি’কে চলচ্চিত্রে রূপদানের আগ্রহের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন,- “তিতাস পূর্ব বাংলার একটি খন্ড জীবন, এটি একটি সৎ লেখা। ইদানিং সচরাচর বাংলাদেশে (দুই বাংলাতেই) এরকম লেখা দেখা পাওয়া যায় না। এর মধ্যে আছে প্রচুর নাটকীয় উপদান, আছে দর্শনধারী রচনাবলী আছে, সত্যব্য বহু প্রাচীন সঙ্গীতের টুকরো- সব- মিশিয়ে একটি অনাবিল আনন্দ ও অভিজ্ঞতার সৃষ্টি করা যায়। ব্যাপারটা ছবিতে ধরা পড়ার জন্য জন্ম থেকেই কাঁদছিল। …অদ্বৈত বাবু যে সময়ে তিতাস নদী দেখেছেন, তখন তিতাস ও তার তীরবর্তী গ্রামীণ সভ্যতা মরতে বসেছে। বইয়ে বইয়ে তিতাস একটি নদীর নাম। তিনি এর পরের পূনর্জীবনটা দেখতে পাননি। আমি দেখাতে চাই যে মৃত্যুর পরেও এই পুনর্জীবন হচ্ছে। তিতাস এখন আবার যৌবনবতী। আমার ছবিতে গ্রাম নায়ক, তিতাস নায়িকা।”
ঋত্বিক নাটক নির্মিত চলচ্চিত্র সমূহ
নাগরিক (১৯৫২, মুক্তি ১৯৭৭), অযান্ত্রিক (১৯৫৮), বাড়ি থেকে পালিয়ে (১৯৫৮), মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০,) কোমল গান্ধার (১৯৬১), সুবর্ণরেখা (১৯৬২, মুক্তি ১৯৬৫), তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩), ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ (১৯৭৪)
কাহিনী এবং চিত্রনাট্য
মুসাফির (১৯৫৭), মধুমতি (১৯৫৮), স্বরলিপি (১৯৬০), কুমারী মন (১৯৬২), দ্বীপের নাম টিয়ারং (১৯৬৩), রাজকন্যা (১৯৬৫), হীরের প্রজাপতি (১৯৬৮)
অভিনয়
তথাপি (১৯৫০), ছিন্নমূল (১৯৫১) কুমারী মন (১৯৫২), সুবর্ণরেখা, তিতাস একটি নদীর নাম এবং ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ (১৯৭৪)
শর্ট ফিল্প এবং তথ্যচিত্র
দ্য লাইফ অফ দ্য আদিবাসিজ (১৯৫৫), প্লেসেস অফ হিষ্টোরিক ইন্টারেষ্ট ইন বিহার (১৯৫৫), সিজার্স (১৯৬২), ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান (১৯৬৩)।
ফিয়ার (১৯৬৫), রঁদেভূ (১৯৬৫), সিভিল ডিফেন্স (১৯৯৫), সায়েন্টিস্টস অফ টুমরো (১৯৬৭), ইয়ে কত্তন (হোয়াই/দ্য কোয়েশ্চন ১৯৭০), আমার লেনিন (১৯৭০), পুরুলিয়ার ছৌ (দ্য ছৌ ড্যান্স আর্ পুরুলিয়া) (১৯৭০), দুর্বার গতি পদ্মা (দ্য টার্বুলেন্ট পদ্মা (১৯৭১)
অসমাপ্ত ছবি এবং তথ্যচিত্র
বেদেনি (১৯৫১), কত অজানা রে (১৯৫৯),বগলার বঙ্গদর্শন (১৯৬৪-১৯৬৫), রঙের গোলাপ (১৯৬৮), রামকিঙ্কর (১৯৭৫) আদিবাসীদের জীবন স্রোত (হিন্দি) (১৯৫৫)
উল্লেখ্যনীয় পুরস্কার ও সম্মাননা।।
১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ, ভারত সরকার কর্তৃক শিল্পকলায় পদ্মশ্রী পুরস্কার
১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার বিভাগে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী:-
১) …এবং ঋত্বিক; শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়; দেশ হিতৈশী; ১৪৩১, ২০২৪।
২) পথিকৃৎ; শারদ সংখ্যা; অক্টোবর ২০২৪।
৩) অন দ্য কালচারাল ফ্রন্ট; ঋত্বিক ঘটক; ড. রথীন্দ্র চক্রবর্তী; অনূদিত; নাট্যচিন্তা ফাউন্ডেশন; ২০০৩।
৪) গ্রুপ থিয়েটার গণনাট্য সংঘ ও সর্বহারা নাট্য আন্দোলন; মানিক মুখোপাধ্যায়; পথিকৃৎ বিশেষ সংখ্যা; অক্টোবর ১৯৮৩।
৫) সেই ঋত্বিক, সুব্রত রুদ্র (সম্পা), প্রতিভাস সংস্করণ, কোলকাতা, ২০২০।
No comments:
Post a Comment