Saturday, December 14, 2024

ভূমিকা


বৌদ্ধ সাহিত্যে অবদান, জাতক এবং বংশ সাহিত্যের গুরুত্ব অপরিসীম অবদান সাহিত্যে ভগবান্ বুদ্ধ তথা তাঁর পূর্ববর্তী বুদ্ধগণ এবং তাদের অনুগামী সমূহের কথা বর্ণিত হয়েছে, সর্বোপরি জাতকে বর্ণিত বুদ্ধের পূর্বজন্মের কাহিনী এবং বংশ সাহিত্যে একপ্রকারের আনুপূর্বীক পরম্পরাগত সম্প্রদায়ের কথা বর্ণিত আছে।

বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘের উৎপত্তি তথা তার পরবর্তী সময়কালের ঘটনাসমূহকে উল্লিখিত করার প্রশ্নে বিনয়পিটকে উল্লেখ রয়েছে। ভগবান্ বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘে মতাদর্শগত পার্থক্য শুরু হয় এবং স্থবিরবাদ বা থেরবাদ, মহাসাংঘিক বা সর্বাস্তীবাদ ইত্যাদি বিভিন্ন শাখা উপশাখায় বিভক্ত হয়ে নিজ নিজ ধারণা অনুসারে বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘে মতাদর্শগত পার্থক্য শুরু হয় এবং স্থবিরবাদ বা থের বাদ, মহাসাংঘিক, সর্বাস্তীবাদ ইত্যাদি বিভিন্ন শাখা উপশাখায় বিভক্ত হয়ে নিজ নিজ ধারণা অনুসারে বৌদ্ধ দর্শন চর্চা শুরু করে। এদের মধ্যে স্থবিরবাদ কেবলমাত্র ত্রিপিটকে উপর ভিত্তি করে সিংহল, মায়ানমার (বার্মা), থাইল্যাণ্ড (শ্যামদেশ), কাম্বোডিয়া (কম্বোজ) প্রভৃতি দেশেল মূল বৌদ্ধধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয় এবং ত্রিপিটকের অষ্টকথা (অথকথা বা ব্যাখ্যা রচনা করে, যা 'বংশ সাহিত্যে' নামে ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। ত্রিপিটকের উপর ভিত্তি করে রচিত বুদ্ধবংশ-যেখানে ভগবান (গৌতম) বুদ্ধের পূর্ববর্তী বুদ্ধগণের ধারাবাহিক ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে।

সর্গশ্চ প্রতিসগশ্চ বংশো মনচন্তরাণি চ।

বংশানুচরিতং চেতি পুরাণং পঞ্চলক্ষণম্।। ভারতীয় শাস্ত্রকারগণ 'পুরাণেতিহাস-গ্রন্থসমূহের যে ৫টি লক্ষণ বর্ণনা করেছেন, সেগুলি হল-.সর্গ (সৃষ্টিক্রম বর্ণনা) . প্রতিসর্গ (প্রলয়ের পর পুনঃসৃষ্টিক্রমের বর্ণনা) . বংশ (রাজন্যবর্গের বংশসমূহ) . মন্বন্তর (সৃষ্টির অপর কল্প সম্পর্কে সূচনা), . বংশানুচরিত (কিছু বিশিষ্ট রাজার জীবনচর্যা সম্পর্কিত বর্ণনা। এই ৫টির মধ্যে বংশ এবং বংশানুচরিত দীপবংশ গ্রন্থের দৃষ্টিকোণ হতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পালি ভাষায় রচিত বংশ সাহিত্য যদিও প্রধানতঃ রাজন্যবর্গের বংশ তালিকা বর্ণিত হয়েছে, তবুও তাতে অন্যান্য পুরাণকাহিনীর ন্যায় অতিরিক্ত নানাবিধ বিষয়, যেমন-ধর্ম বৃত্তান্ত এবং ধার্মিক কথাসমূহ বর্ণিত হয়েছে যা পালি সাহিত্যের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী প্রয়াস বলেই পরিগণিত হয়েছে।

পালি বংশ সাহিত্যের ধারাবাহিকতা

পালি ভাষাতে বংশ বা বংস সাহিত্যের ঐতিহ্য আচার্য বুদ্ধঘোষের সময়কালের পূর্ব হতেই শুরু হয়েছিল, যা অদ্যাবধি (বংশ শতাব্দী) অবিচ্ছিন্নরূপে চলে আসছে। পালি সাহিত্যের বংশ প্রতিপাদক গ্রন্থ মুখ্যতঃ এইরূপে-

. দীপবংস, . মহাবংস, . চুলবংস, . বুদ্ধঘোসুস্পতি, . ললাটধাতু বংস। . মহাবোধিবংস, . থুপবংস, . হত্থবনগলবিহার বংস, . দাঠাবংস, ১০.-সে ধাতু বংস, ১১. গন্ধবংস এবং ১২. শাসনবংস, ১৩. জিনবংস দীপং ১৪. সঙ্গীতিবংস ১৫. রতনবিম্ব ১৬. চামদেবীবংস, ১৭. শাসনবংসদ্বীপ ইত্যাদি।

সিংহল যে দেশটি বর্তমানে শ্রীলঙ্কা নামে পরিচিত থেরবাদী বৌদ্ধধর্মের উৎসস্বরূপ। শ্রীলঙ্কার থেরগণ তাদের দেশের রাজনৈতিক ধর্মীয় ইতিহাসে মূল্যবান অবদানের জন্য ইতিবৃত্তের জগতে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে রয়েছেন। এই ইতিবৃত্ত গুলি থেকে আমরা যে কেলে প্রধান রাজনৈতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে জানতে পারি তা নয়, এগুলি দ্বীপরাষ্ট্রটির ধর্মীয় ইতিহাসের বিভিন্ন দিকের উপরও আলোকপাত করে। বংশ ব্রাহ্মণ বৃহদারণ্যক উপনিষদের মত শ্রীলঙ্কারও দ্বীপবংশ, মহাবোধিবংশ বা বোধি বংশ, দাঠাবংশ, থুপবংশ ইত্যাদি রয়েছে। শ্রীলঙ্কার বংশ সাহিত্যে দুটি পরম্পরার উল্লেখ রয়েছে যেমন রাজাপরম্পরা, অর্থাৎ রাজাদের পরম্পরা এবং থেরপরম্পরা, অর্থাৎ রাজাদের পরম্পরা এবং থের পরম্পরা বা থেরগণের পরম্পরা। এই কারণে শ্রীলঙ্কার বংশগুলিকে ঐতিহাসিক অর্ধ ঐতিহাসিক সাহিত্যের স্পষ্ট উল্লেখযোগ্য রূপ বলে বিবেচনা করা হয়। যে থেরগণ যাঁরা শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধধর্মের ক্ষেত্রে সর্বদা মহান ভূমিকা পালন করেছেন তাঁরা শ্রীলঙ্কার বংশ সাহিত্যের রচয়িতা। যদিও তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস রচনা করা তবে এখন সকলেই এটি স্বীকার করেন যে শ্রীলঙ্কার ইতিবৃত্তগুলি কাল্পনিক কাহিনীতে পরিপূর্ণ নয়, তাদের প্রধান অংশটি ইতিহাস, ইতিহাস ছাড়া কিছু নয়। যুক্তিনিষ্ঠ বিশুদ্ধ ইতিহাসের ধারণা অনুপস্থিত থাকতে পারে, কিন্তু ইতিহাসের অপরিহার্য উৎস গ্রন্থ রূপে তাদের স্থায়ী মূল্য নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। এর পাশাপাশি বার্মা থাইল্যাণ্ডে কম্বোডিয়া, লা০ সেও বেশ কিছু বংস সাহিত্য রচিত হয়েছে। সেগুলোরও সংক্ষিপ্ত আলোচনা বিষয়বস্তু হিসেবে স্থান পাবে নিম্নে।

দীপবংস:

শ্রীলঙ্কার পালি ইতিবৃত্তগুলির মধ্যে দ্বীপবংশ বা দ্বীপের ইতিহাস যে সবচেয়ে প্রাচীন তা নয় এটি বিশেষ দৃষ্টি গ্রাহ্য হওয়ার যোগ্য। B.C. Law বলেন, "সিংহলের পালি ইতিবৃত্তগুলিকে প্রাচীনকালের রচনা বলার প্রধান কারণ হল এই যে এগুলি পরবর্তীকালের রচনাগুলি এই জন্য আলাদা যে এগুলি কোন গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের রচনা, কোন ব্যক্তি লেখকের রচনা নয়। এটিকে সিংহলের সেই সাহিত্যিক রচনার সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মনে করা হয় যেটি কোন ব্যক্তি বিশেষ লেখক রচনা করেননি। পণ্ডিতদের মতে, দ্বীপবংশ রচিত হয়েছিল পালি অর্থকথা বা ভাষ্যের ভিত্তিতে। এটি একটি ঐতিহাসিক কাব্য যেটি পালি গাথায় রচিত। কিন্তু এর মধ্যে দুটি গদ্যাংশ দেখতে পাই। B.C. Law বলেন যে, এগুলির মধ্যে একটির ভিত্তি হল একটি মুল পালি সাহিত্যের রচনা যেমন দ্বিতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতের বিনয় বিবরণ এবং অপরটি অবশ্যই জাতক নিদানকথার আদলে রচিত। এগুলি পরবর্তীকালে প্রক্ষিপ্ত অংশ নাকি পরবর্তীকালে কাব্যের রূপ ধারণ করা গদ্যের অবশিষ্ট অংশ তা একটি বিতর্কিত প্রশ্ন, দ্বীপবংশে সেটির রচয়িতার নাম উল্লেখ নেই। এতে থেরী (ভিক্ষুণী) দের উল্লেখ রয়েছে। এর থেকে অনেক পণ্ডিত সিদ্ধান্ত করেন যে এটি ভিক্ষুণীদের দ্বারা সংকলিত এবং তাঁরা বিভিন্ন সময়ে এই সংকলনের কাজটি করেছিলেন। J.P. Malalasekhera- ভিক্ষুণীদের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, "নেভিল তাঁর পাণ্ডুলিপির তালিকায় দ্বীপ বংশে ভিক্ষুণীদের দেওয়া অনন্য ফলাফলের কথা উল্লেখ করেছেন এবং তাঁর মতে এর থেকে রচয়িতার সম্পর্কে একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায়।" তারপর তিনি দ্বীপবংশের রচয়িতার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বর্ণনা করেছেন "দ্বীপবংশ কোন একটি মাত্র লেখকের রচনা নয়, এটি অনেক প্রজন্মের রচনা, এটি আনন্দ বিহ্বল সঙ্গীতের একটি পরম্পরা। একে অপরকে অনুসরণ করা লেখকরা পরপর এতে যোগ করেছেন। গ্রন্থটির ভূমিকায় বলা হয়েছি, এটিকে বিভিন্ন ধরণের ফুলের মত বাঁকিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একটি মালার রূপ দেওয়া হয়েছে।

ওল্ডেনবার্গের মতে "এটি রচিত হয়েছিল খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতক পঞ্চম শতকের প্রথম তিন চতুর্থাংশের মধ্যে। G.P. Malalasekhera ওল্ডেনবার্গের সঙ্গে একমত। তিনি বলেন, "এটি চতুর্থ শতকের শুরু হওয়ার আগে বন্ধ হতে পারে না, কারণ কাহিনী ৩০২ খ্রীঃ অতিক্রম করে গিয়েছে। বুদ্ধ শেষে অনেকবার দ্বীপপুঞ্জ থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন কিন্তু তাঁর উদ্ধৃতিগুলি কোন কোন ক্ষেত্রে বর্তমান সংস্করণের থেকে পৃথক। মহাবংশে বলা হয় যে ধাতুসেন (৪৫৯-৭৭) আদেশ দিয়েছিলেন যে দ্বীপবংশ বাৎসরিক মহেন্দ্র উৎসবের সময় জনসমক্ষে আবৃত্তি করতে হবে, অর্থাৎ সময়ের মধ্যে দ্বীপবংশ রচনা সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। সময়ের পর সেটি আর ব্যবহৃত হয়নি; মহানামা' অপেক্ষাকৃত উচ্চমানের সৃষ্টি মহাবংশ গরিমায় এটিকে অতিক্রম করে গিয়েছিল। কিন্তু মনে হয়, অনেক পরবর্তী সময়কাল পর্যন্ত এটিকে অধ্যয়ন করা হত-কারণ আরণ্যকবাসী সম্প্রদায়ের তৃতীয় ধর্মকীর্তি এটিতে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে অনেক গুণসম্পন্ন গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা হিসেবে তার সদ্ধম্ম সংগহতে উল্লেখ করেছেন।

দ্বীপবংশ মুঠাশিব থেকে মহাসেন পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার একটি রাজনৈতিক ইতিহাস পরিবেশিত হয়েছে। এখানে প্রাক্ বৌদ্ধ যুগ থেকে রাজা মহাসেনের রাজত্বের শেষ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার রাজাদের কার্যকলাপের বর্ণনা রয়েছে। এটির বর্ণনা থেকে জানা যায় যে এটির প্রধান বিষয়বস্তু হল শ্রীলঙ্কা বিজয়, রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক উভয় দিক থেকেই। B.C. Law বলেন, "এটির বর্ণনা নীরস, এটিতে ব্যবহৃত শব্দগুলির অর্থ কখনও কখনও বোধগম্য হয় না। এখানে ওখানে পুনরাবৃত্তিও রয়েছে। তবে, এই ইতিবৃত্তে ঐতিহাসিক সত্যের তথ্য রয়েছে যেটি অর্থহীন কাল্পনিক কাহিনীর স্তুপের নীচে চাপা পড়ে রয়েছে। এটিকে সমালোচনামূলক ভাবে পাঠ করতে হবে যাতে সেই তথ্যগুলিকে সনাক্ত করতে হবে যাদের মাধ্যমে আমরা ইতিহাসের ঘটনাবলীকে নির্মাণ করা যায়।

দ্বীপবংশে চব্বিশটি অধ্যায় রয়েছে। এখানে শ্রীলঙ্কায় বুদ্ধের তিনবার আগমন এবং তাঁর পূর্বপুরুষদের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। গৌতম বোধিবৃক্ষের নীচে বোধিজ্ঞান লাভ করেছিলেন। তিনি কেবলমাত্র সমস্ত পৃথিবীকেই পর্যবেক্ষণ করেননি, বুঝতে পেরেছিলেন যে শ্রীলঙ্কা দ্বীপটি অর্হৎ সন্ন্যাসীদের বসবাসের যোগ্য, তিনি এই ভবিষ্যদ্বাণীও করেছিলেন যে ভারতের সম্রাট অশোকের পুত্র মহিন্দ এই দ্বীপে এসে এখানে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন। এর কিছু মিথ কাহিনী প্রচলিত আছে যা এরূপ-তারপর তিনি দ্বীপের উপর একজন স্বর্গীয় পাহারাদার নিয়োগ করলেন। তিনি দ্বীপে এলেন এবং তারপর দ্বীপের বাসিন্দা যক্ষদের বিতাড়িত করলেন। বুদ্ধ দ্বীপে দ্বিতীয়বার এলেন যখন পর্বতের সাপ সমুদ্রের সাপেদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। তিনি তাদের শান্তিতে থাকার নির্দেশ দিলেন এবং সমস্ত সাপই তার কথা মান্য করল। তিনি দ্বীপে তৃতীয়বার এসেছিলেন যখন কল্যাণীর নাগরাজ মানিয়াক্ষিকা তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।"

তারপর দ্বীপবংশে রাজকুমার মহাসম্মতের থেকে বুদ্ধের আবির্ভাব বর্ণনা করা হয়েছে যাঁকে পৃথিবীর প্রথম রাজা বলা মনে করা হয়। গৌতম বুদ্ধের পিতা ছিলেন কপিলবাস্তুর প্রধান শুদ্ধোদন এবং রাহুলভদ্র ছিলেন তাঁর পুত্র। তাছাড়া আরও অনেক রাজার উল্লেখ রয়েছে যাঁরা শুদ্ধোদনের পূর্বে এবং মহাসম্মতের পরে রাজত্ব করেছিলেন।

দ্বীপবংশ থেকে ভারতবর্ষ শ্রীলঙ্কার প্রাচীন রাজবংশগুলির একটি বংশলতিকা পাই। এখানে তিনটি বৌদ্ধ সঙ্গীতি, দ্বিতীয় সঙ্গীতির পর বিভিন্ন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উত্থান, রাজা অশোকের ধর্মাবলী, এবং বিজয় তাঁর উত্তরসূরীদের দ্বারা শ্রীলঙ্কাকে উপনিবেশে পরিণত করা ইত্যাদি বর্ণনা করা হয়েছে। মগধের রাজা অজাতশত্রু প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতির পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন এবং মহাকাশ্যপ ছিলেন সেই সঙ্গীতির সভাপতি। উপালি আনন্দের সহায়তায় এই সঙ্গীতিতে ধর্ম বিনয়কে বিন্যস্ত করা হয়। কালাশোকের রাজত্বকালে দ্বিতীয় সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়। বজ্জিপুত্তরা সংঘে দশটি শিথিলতা প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন যা বুদ্ধ অনুমোদন করেননি। তারপর বৌদ্ধ সংঘে একটি বিভাজন ঘটে। বজ্জিপুত্তরা সনাতনপন্থী ভিক্ষুদের সঙ্গে থাকতে চাইলেন না এবং তাঁরা একটি নতুন গোষ্ঠী গঠন করে মহাসাংঘিক নামে পরিচিত হলেন। তাঁর ছিলেন সর্বপ্রাচীন বিভজ্জবাদী। কথিত আছে, প্রথম বিভাজনের পর আরও অনেক বিভাজন ঘটে যার ফলে বিভিন্ন উপসম্প্রদায়ের উৎপত্তি হয়। ক্রমে মহাসাংঘিকদের থেকে আরো সাতটি উপসম্প্রদায়ের। এইভাবে মহাসাংঘিকরা একব্যবহারিক, চৈত্তিক (চৈত্যক), কৌকুত্তিক (গোকুলিকা), বহুশ্রুতীয়, প্রজ্ঞপ্তিবাদ, পূর্বশৈল, অপরশৈল সম্প্রদায়ে বিভক্ত হন। থেববাদীরা মহিশাসক, বাৎসিপুত্রিয়, সম্মিতিয়, ছন্নগারিক, ভদ্রযানিয়, ধর্মোত্তরিয়, সর্বাস্তিবাদ, ধর্মগুপ্তিক, কাশ্যপীয়, হৈমবন্ত এবং সংক্রান্তিকা সম্প্রদায়ে বিভক্ত হন। সব মিলিয়ে ছিল আঠেরটি সম্প্রদায়।

তারপর দ্বীপবংশে রাজা চন্দ্রগুপ্তের পৌত্র বিন্দুসারের পুত্র রাজা অশোকের রাজত্বকাল বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁর রাজত্বকালে অশোকের পুত্র মহিন্দ অশোকের সমসাময়িক শ্রীলঙ্কার রাজা দেবানামপিয় তিসের রাজত্বকালে সে দেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করতে গিয়েছিলেন অশোক সমগ্র জম্বুদ্বীপে ৮৪ হাজার বিহার নির্মাণ করেছিলেন। রাজা অশোকের পৃষ্ঠ পোষকতায় তৃতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল মোঙ্গলিপুত্ত তিস্সের সভাপতিত্বে। এই সঙ্গীতির পর বৌদ্ধধর্মপ্রচারকদের বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য নটি বিভিন্ন দেশে প্রেরণ করা হয়েছিল-কাশ্মীর গান্ধার, মহিষমণ্ডল, বনবাসী, অপরন্তক, যোনক, হিমবন্ত, মহার, সুবর্ণভূমি লঙ্কাতে পাঠানো হয়েছিল। দ্বীপবংশে বঙ্গের রাজকুমার বিজয়ের দ্বারা লঙ্কাদ্বীপে উপনিবেশ তৈরীর বর্ণনা রয়েছে। তারপর এখানে লঙ্কার রাজাদের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে যাঁরা বিজয়ের পর লঙ্কা শাসন করেছিলেন। গ্রন্থটিতে বৌদ্ধধর্ম প্রচারে এই সমস্ত রাজাদের ভূমিকারও উল্লেখ রয়েছে। বঙ্গের রাজা ছিলেন সিংহবাহু। তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র বিজয়ের কৃআচরণে ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। বিজয় একটি জাহাজ নিয়ে সুপ্পার ভরুকচ্চ (আধুনিক কোচ) গেলেন এবং সেখান থেকে লঙ্কাদ্বীপে উপনিবেশ স্থাপন করলেন। মতান্তরে বর্তমান মেদিনীপুরে তমলুকের তাম্রলিপ্ত বন্দর হয়ে গিয়েছিলেন। তিনিই দ্বীপের প্রথম মুকুটযুক্ত রাজা ছিলেন। বিজয়ের পর আমরা অনেক রাজার নাম পাই যারা দ্বীপেব সিংহাসন আরোহণ করেছিলেন। তারপর আমরা দেবানাম্পিয় তিস্সের রাজত্বকালে পৌঁছেই যিনি দ্বীপের প্রধানতম রাজা ছিলেন।

তারপর দ্বীপবংশে রাজা দেবানাম্পিয় তিসের রাজত্বকালে মহিন্দ সংঘমিত্রার দ্বারা শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধধর্মের প্রচার অগ্রগতির কথা বলা হয়েছে। রাজা দেবানামপিয় তিসের রাজত্বকালে মহিন্দ এই দ্বীপে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেছিলেন। এই সিংহলী রাজার সঙ্গে রাজা অশোকের সুসম্পর্ক ছিল। রাজা অশোক এই দ্বীপে বোধিবৃক্ষের একটি চারা পাঠিয়েছিলেন এবং সেটি অনুরাধাপুরে রোপণ করা হয়েছিল।

তারপর দ্বীপপুঞ্জে রাজা দেবানামপিয় তিস্মের উত্তরসূরী বিশেষত দুট্টগামনী, বট্টগামনী এবং মহাসেনের রাজত্বকালের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এর কারণ হল তাঁর অব্যবহিত উত্তরসূরীরা ছিলেন দুর্বল শাসক। দক্ষিণ ভারত থেকে দমিলরা এই দেশ আক্রমণ করে দখল করেছিল। তারপর এলেন দুট্টগামনি যিনি শ্রীলঙ্কার রাজপরিবারের একজন সদস্য ছিলেন। তিনি দমিলদের পরাজিত করে দেশ থেকে বিতাড়িত করেন এবং দেশকে বিদেশী অধিকার থেকে মুক্ত করেন। তিনি ছিলেন এক শক্তিশালী শাসক এবং বৌদ্ধধর্মের বিকাশে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। তিনি লোহপাসাদ, মহাথুপ এবং আরও অনেক বিহার নির্মাণ করেছিলেন। দুট্টগামনীর এবং আরও অনেক রাজা শ্রীলঙ্কার সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ শাসক ছিলেন বট্টগামনী। তাঁর রাজত্বকালে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা প্রথমবার তিনটি পিটক অট্টকথার লিখিত রূপ দিয়েছিলেন। তারপর অনেক রাজা দ্বীপ রাষ্ট্রটির সিংহাসনে আসীন হয়েছিলেন। তাঁরা দেশে রাজনৈতিক ধর্মীয় ইতিহাসে অত্যন্ত অকিঞ্চিতকর ভূমিকা পালন করেছিলেন। তারপর মহাসেন সিংহাসন আরোহণ করে ২৭ বছর রাজত্ব করেছিলেন। মহাসেনের রাজত্বকালের পরই ইতিবৃত্তটি শেষ হয়।

মহাবংস:

মহাবংশ বা মহাবংস বা সিংহলের রাজাদের মহৎবংশ ছিল শ্রীলঙ্কার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিবৃত্ত। B. C. Law বলেন, 'মহানামের মহৎ রচনার পালি শিরোনামের সিংহলীয় সমতুল্য শব্দ হল পজ্জপদকবংশ (পদ্যাপদরুবংশ) মহাবংশটীকা অনুসারে এর অর্থ হল মহানাম এই ইতিবৃত্তটিকে পদ্যে রচনা করেছিলেন এবং এর ভিত্তি ছিল অতীতের সিহলঅকথা মহাবংশ। টীকার রচয়িতা বলতে চেয়েছেন যে মহানামের রচনা ছিল পূর্ববর্তী একটি গদ্য ইতিবৃত্ত যেটি পধানঅকথা ছিল এবং যার ভাষাগুলি ছিল সিংহলীয়। এটি রচিত হয়েছিল অভিধর্ম ভাষ্যের ভিত্তিতে। মহানাম ছিলেন মহাবংশের রচয়িতা। তিনি সম্ভবত চতুর্থ শতকের শেষ পাদে বা পঞ্চম শতকের প্রথম পাদে বর্তমানে ছিলেন। মহাবংশটীকায় তাঁর কথা উল্লেখ রয়েছে। এখানে বলা হয়েছে যে সেনাপতি দীঘসন্দ (দীঘসন্দন) দীঘসন্দন সেনাপতি পরিবেণ নামে একটি বিহার নির্মাণ করেন যেখানে মহানাম বসবাস করতেন। চুলবংশে বলা হয়েছে যে দীঘসন্দন বিহারের একজন থের মহানাম রাজা ধাতুসেনের মামা ছিলেন এবং ধাতুসেন মহানামের অনুরোধে ভিক্ষু হয়েছিলেন। George Thrner মহানামকে বাহুসেনের মামারূপে স্বীকার করেছেন কিন্তু W. Geiger কখনও করেননি। তিনি বলেন যে মহানাম ধাতুসেনের মামা ছিলেন না। কালপঞ্জীগত কারণে, এমনকি তিনি, মহানামের তত্ত্বাবধানে ধাতুসেনের সংঘে একজন ভিক্ষুত্ব জীবন গ্রহণ করার কাহিনীকেও অস্বীকার করেছেন। চুলবংশে বলা হয়েছে যে ধাতুসেনের ছোট ছেলে রাজা প্রথম মোল্লান (৪৯৭ খ্রী-৫১৫ খ্রী) পব্বতবিহার বা সিহলগিরিবিহার নির্মাণ করে মহানামকে দান করেছিলেন। W. Geiger মহানামের বয়সের কারণে পূর্ববর্ণিত তথ্যগুলিকে অস্বীকার করেছেন। তাঁর মতে, "তিনি অতটা দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকতে পারেন না।ধাতুসেন সিংহাসন আরোহণ করেছিলেন ৪৩৬ খ্রীস্টাব্দে এবং তিনি একজন শ্রমণ হিসেবে সংঘে যোগদান করেছিলেন ৪৩৬ থেকে ৪৪১ খ্রীষ্ট মাঝামাঝি। সেইসময় তাঁর মামা মহানাম ছিলেন অতি বৃদ্ধ। ধাতুসেনের দীক্ষার সময়ে মহানামের বয়স যদি ৩০ হয়ে থাকে তাহলে যখন সিহগিরি বিহার তাঁকে অর্পণ করা হল তখন তাঁর বয়স নয়। তাই আমাদের হাতে থাকে প্রমাণ এই পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে যথেষ্ট নয়। W. Geiger বলেন যে মহাবংশের রচয়িতা মহানাম যিনি প্রথম মোপ্পল্লান (৪৯৭ খ্রীষ্ট-৫১৫ খ্রীষ্ট) এর থেকে সিহগিরি বিহার লাভ করেছিলেন তিনি এবং বৌদ্ধগ্রন্থগুলিতে ধাতুসেনের মামা হিসেবে বর্ণিত মহানাম একই ব্যক্তি হতে পারেন না। বুদ্ধগয়ায় আবিষ্কৃত একটি লিপিতে শ্রীলঙ্কার ভিক্ষু পণ্ডিতদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁরা হলেন দব, রাহুল, উপসেন, মহানাম, উপসেন (দ্বিতীয়), মহানাম (দ্বিতীয়) এই লিপিটিতে কোন তারিখ নেই। G. P. Malalasekhera মতে প্রথম উপসেন ছিলেন মহানিদ্দেস অঠকথার রচয়িতা প্রথম মহানাম ছিলেন মহাবংশের রচয়িতা।

কবি মহানামের রচনা মহাবংশ ছিল একটি নিখুঁত মহাকাব্য। W. Geiger বলেন, 'মহাবংশ এমন একজন মানুষ দ্বারা রচিত একটি শিল্পকর্ম যিনি কবি আখ্যা পাওয়ার যোগ্য। যিনি প্রায়শই স্থূল উপাদানকে প্রতিভার দ্বারা না হলেও রুচি দক্ষতার দ্বারা বিন্যস্ত করেছেন। তিনি আরও বলেন যে মহাবংশ প্রকৃত মহাকাব্য আখ্যা পাওয়ার যোগ্য। এটি একজন কবির স্বীকৃত রচনা এবং এটিতে আমরা কবিকে কর্মরত অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি। যদিও তিনি তাঁর উপাদানের উপর নির্ভরশীল যেগুলিকে তিনি যথাসম্ভব ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করতে বাধ্য, তিনি সমালোচনামূলকভাবে সেগুলিকে দেখেছেন, তাদের ত্রুটি বিচ্যুতিগুলিকে নজর করেছেন এবং সেগুলিকে নজর করেছেন এবং সেগুলিকে বাদ দিতেও উন্নত করতে চেয়েছেন। G. P. Malalasekhera মহানামের রচনার বিবরণ দিতে গিয়ে তাঁর মহাবংশের ভাষা বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণের সাহিত্যিক কর্মের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, যখন মহানাম মহাবংশ রচনা করতে শুরু করলেন 'যেটি প্রতিটি বিষয়ে তথ্যে পূর্ণ এবং রং, স্বাদ গন্ধে সমৃদ্ধ বিভিন্ন ধরণের ফুলে গাঁথা একটি সুদৃশ্য মালার মত একটি রচনা, তিনি সেটিকে সৃষ্টি করলেন প্রাচীন লেখকদের ত্রুটিগুলিকে এড়িয়ে গিয়ে।" আমরা দেখতে পাই যে তিনি তার উপাদানের উর্দ্ধে উঠতে পারলেন না। তিনি নিজেকে তার সাধ্যমত তাঁর উপাদানের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখতে চেয়েছিলেন। প্রায়শই তিনি মূল গ্রন্থের পালি গাথাগুলিকে অপরিবর্তিত অবস্থায় তাঁর রচনায় ব্যবহার করেছেন এবং অনেক জায়গায় দুটি রচনা হুবহু মিলে যায়। তিনি আরও বলেন যে মহানাম একেবারেই প্রতিভাবান ছিলেন না। তিনি ঐতিহ্য দ্বারা অতিশয় সীমাবদ্ধ ছিলেন, এবং তাঁর রচনাটিকে প্রথম শ্রেণীর সাহিত্য সৃষ্টি বলা চলে না; তবুও পালি সাহিত্যের জন্য তাঁর অবদান, এবং পরবর্তীকালের ইতিহাস অধ্যয়নের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান ছিল বিপুল, অমূল্য সম্পদ।

মহাবংশ শুরু হচ্ছে গৌতম বুদ্ধের কাহিনী দিয়ে। এখানে গৌতম বুদ্ধের লঙ্কায় তিনবার আগমনের কথা বলা হয়েছে যেটি সে সময় কেবল, "রাক্ষস, যক্ষ, পিশাচ সাপ' দ্বারা অধ্যুষিত ছিল। মহাবংশে বলা হয়েছে যে 'কেমন করে বুদ্ধ চক্ষু দিয়ে সমগ্র পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করলেন এবং একটি সুন্দর দ্বীপ দেখতে পেলেন। কেমন করে বৃহৎ উদর ক্ষুদ্র উদর নামে দুজন সাপ রাজকুমারের মধ্যে এক বিরাট যুদ্ধ শুরু হল যাঁর পরিণতিতে সমগ্র দ্বীপটি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হল, কেমন করে বুদ্ধ তাঁর সীমাহীন মৈত্রী দ্বারা জন্য করুণা অনুভব করলেন এবং দেবতাদের নিয়ে দ্বীপে উড়ে গেলেন এবং তাঁর শিক্ষার আলো ছড়ালেন যার পরিণতিতে সাপ অন্যান্য রাক্ষসরা তাঁর বিশুদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করল।

তারপর মহাবংশে বুদ্ধের পূর্বপুরুষদের, ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস তিনটি বৌদ্ধ সঙ্গীতির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এখানে একটি বিশাল তালিকার উল্লেখ করা হয়েছে যার শুরু হয়েছে মহাসম্মতকে দিয়ে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে গৌতম বুদ্ধের জন্ম হয়েছিল তাঁর বংশেই। কুশাবতী, রাজগৃহ এবং মিথিলা ছিল সেই সমস্ত স্থান যেখানে এই বংশের রাজাদের উত্তর পুরুষরা রাজত্ব করতেন, এবং তারা বিভিন্ন গোষ্ঠীতে শাসন করতেন। ওকাক্কু ছিলেন একটি গোষ্ঠীর প্রধান, তিনি কপিলবাস্তুতে রাজত্ব করতেন এবং তাঁর গোষ্ঠী শাক্য নামে পরিচিত ছিল। রাজা জয়সেনের কন্যা যশোধরা এই বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং শাক্য অঞ্জন তাঁকে বিবাহ করেছিলেন। তাঁদের দুই কন্যা ছিল মায়া প্রজাপতি। জয়সেনের পৌত্র সিংহনুর পুত্র শুদ্ধোদন মায়া প্রজাপতি উভয়কেই বিবাহ করেছিলেন। গৌতম বুদ্ধ ছিলেন শুদ্ধোদন মায়ার সন্তান, তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল ভদ্দকচ্চান এবং পুত্র ছিল রাহুল। বিম্বিসার ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তিনি তাঁর পুত্র অজাতশত্রু ছিলেন বুদ্ধের সমসাময়িক।

প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয় বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের প্রায় তিনমাস পর রাজগৃহের সপ্তপর্ণী গুহায়। সাত লক্ষ বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং অনেক গৃহী মানুষ সঙ্গীতিতে যোগ দেন। উপালি আনন্দের সহায়তায় ধম্ম বিনয়কে বিন্যস্ত করা হয়। মহাকাশ্যপ থের ছিলেন এই সঙ্গীতির সভাপতি এবং রাজা অজাতশত্রু ছিলেন পৃষ্ঠপোষক। দ্বিতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল রাজা কালাশোকের রাজত্বকালে বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের একশ বছর পরে। বজ্জিপুত্তরা দশ প্রকার শিথিলতা প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন কিন্তু এগুলিকে বুদ্ধ নিষিদ্ধ করেছিলেন।

পাবা অবন্তীর থেরগণ এবং তাদের বরিষ্ট ভিক্ষু বেরত থের ঘোষণা করলেন যে দশ প্রকাশ শিথিলতা অবৈধ এবং তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবে এই সমস্যার মীমাংসা করতে চেয়েছিলেন। তাঁরা বৈশালীতে সমবেত হন এবং রাজা কালাশোকও এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সম্মেলনের রায় সনাতনপন্থী ভিক্ষুদের পক্ষে গিয়েছিল এবং তারপর বিরুদ্ধবাদী ভিক্ষুরা আর তাঁদের সঙ্গে থাকতে না চেয়ে অন্য একটি সম্প্রদায় গঠন করে পরিচিত হলেন মহাসাংঘিক নামে। এইভাবে প্রথম বিভাজনটি হল যেটি প্রাচীন বৌদ্ধ সংঘকে দুটি ভাগে বিভক্ত করল-একটি থেরবাদ অপরটি মহাসাংঘিক।

এই দুটি সম্প্রদায় থেকে বহু সম্প্রদায় উপসম্প্রদায়ের উৎপত্তি হল। এই সঙ্গীতিতে নতুন সম্প্রদায়ের বিবর্তন দেখতে পাওয়া গেল। একথা উল্লেখযোগ্য যে দ্বিতীয় সঙ্গীতিতে ধম্ম সংকলিত হবার একশ বছরের মধ্যেই বৌদ্ধ সংঘ ১৮টি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উৎপত্তি হল। এই সবকটি সম্প্রদায়ই বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের ৩০০ থেকে ৪০০ বছরের মধ্যেই একের পর এক উৎপন্ন হল। তৃতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হত অশোকের রাজত্বকালে পাটলিপুত্রের অশোকারামে এবং এটির সভাপতি ছিলেন মোঃলিপুত্ত তিস।

মহাবংশে মহান বৌদ্ধ রাজা অশোকের রাজত্বকাল এবং ভারতবর্ষ বিদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান আলোচিত হয়েছে। বুদ্ধের পরিনির্বাণের ২১৮ বছর পর অশোক সিংহাসন আরোহন করেন এবং চার বছর রাজত্ব করার পর পাটলিপুত্রের রাজা হিসেবে তাঁর অভিষেক হয়। শ্রমণ নিগ্রোধ তাঁর কাছে বুদ্ধের ধর্ম প্রচার করেন এবং তিনি বুদ্ধের একনিষ্ঠ ভক্তে পরিণত হন। তিনি তাঁর রাজ্যে এই ধর্মের উন্নতির জন্য মহান ভূমিকা পালন করেন। সেই সময়ে অনেক বিধর্মী সংঘে যোগদান করে অনেক সমস্যা সৃষ্টি করছিল। তারা তাদের নিজেদের মতবাদকে বুদ্ধের মতবাদ বলে প্রচার করেছিল এবং সেগুলিকে ইচ্ছামত অনুসরণ করতে চেষ্টা করেছিল। এবং সেগুলিকে ইচ্ছামত অনুসরণ করতে চেষ্টা করেছিল। অশোক তাঁদের আচরণ দেখে অত্যন্ত দুঃখিত হলেন এবং অশোকারামে তৃতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতি আহ্বান করলেন। তিন হাজার ভিক্ষু প্রকৃত ধর্মের সংকলন করলেন এবং তাঁদের পরিচালনা করলেন ভদন্ত মোগ্ললিপুত্ত তিস্স। তাঁরা তাঁদের কাজ শেষ করতে নয় মাস সময় নিয়েছিলেন। সম্মেলনের শেষে মোগলিপুত্ত তিস্ম প্রচারকদের নটি বিভিন্ন দেশে পাঠালেন। এগুলি ছিল কাশ্মীর গান্ধার, মহিশক মণ্ডল, বনরবাসী, অপরন্তক, যোনক, হিমবন্ত, মহারাষ্ট্র, সুবন্নভূমি লঙ্কা। তারপর মহাবংশ ৭০০ সঙ্গী নিয়ে বিজয়ের শ্রীলঙ্কায় উপনিবেশ স্থাপনের দেবানাম্পিয় তিস্সের আমলে দ্বীপে বৌদ্ধধর্ম প্রবর্তনের, সংঘমিত্রার আগমনের বর্ণনা দিয়েছেন। রাজা সিংহবাহু ছিলেন লালার শাসক (লালারঠকে আধুনিক গুজরাটের লালা বা আধুনিক বাংলার রাঢ় হিসেবে সনাক্ত করা হয়েছে) তিনি তাঁর পুত্রের আচরণ পছন্দ করেননি এবং তার হিংসাত্মক কার্যকলাপ সহ্য করতে না পেরে তিনি তার পুত্রকে নির্বাসন দেন। বিজয় তাঁর পিতার রাজত্ব ত্যাগ করে একটি জাহাজ চড়ে ৭০০ সঙ্গী নিয়ে সুপ্পারকে যান এবং সেখান থেকে যান শ্রীলঙ্কায় যেটি তম্বপানি নামে পরিচিত হয়। তিনি সেখানে বিবাহ করেন এবং নিজেকে দ্বীপের প্রথম রাজা বলে ঘোষণা করেন এবং বহু নগর নির্মাণ করেন। পরবর্তী শাসক ছিলেন তাঁর পুত্র অভয়। তারপর পাণ্ডু জয় সিংহাসন আরোহণ করেন কিন্তু অভয় পাণ্ডুদ্বয়ের মাঝখানে ১৭ বছর পাণ্ডুভয়ের পুত্র। তিনি দ্বীপরাষ্ট্রটির সিংহাসন অধিকার করেন। তারপর দেবানাম্পিয় তিস্ম রাজা হন। তিনি ছিলেন রাজা অশোকের সমসাময়িক এবং তাঁরা দুজন খুব ভাল বন্ধু ছিলেন। দেবানামপিয় তিসের রাজত্বকালে বৌদ্ধধর্ম প্রথম এই দ্বীপে মহীন্দ্র দ্বারা পরিণত হন। তিনি মহীন্দের জন্য মহাবিহার নির্মাণ করেন। তিনি চেতিয়পাতে চেতিয় পব্বত বিহারও নির্মাণ করেন। তারপর দেবানাম্পিয় তিস্পের অনুরোধ অশোক বুদ্ধের ধাতু, ভিক্ষাপাত্র, এবং বোধিবৃক্ষের চারা শ্রীলঙ্কায় পাঠালেন। দেবী সংঘমিত্রা এই সমস্ত কিছু নিয়ে এসেছিলেন। বোধিবৃক্ষের চারাটি রোপিত

হয় অনুরাধাপুরে।

দেবানাম্পিয় তিস্সের মহিন্দ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে দ্বীপে অনেক বিহার স্তুপ নির্মাণ করেন। তিনি চল্লিশ বছর রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর পর সিংহাসন আরোহণ করেন তাঁর পুত্র উত্তীয়। তাঁর রাজত্বকালের অষ্টম বছরে মহিন্দের মৃত্যু হয়। উত্তীয় দশ বছর রাজত্ব করার পর মারা যান। তারপর মহাশিব, সুরতিস্প এবং দুজন দমিল সেন গুষ্ঠক সিংহাসনে পরপর আরোহণ করেন। এরপর রাজা হন দুট্টগামনী।

দুট্টগামনীর আদি নাম ছিল গামনী। তাঁর পিতা কাকবন্নতিস ছিলেন মহাগামের শাসক এবং মাতা বিহারদেবী ছিলেন কল্যাণীর রাজার কন্যা! গামনী চেয়েছিলেন দমিলদের দেশ থেকে বিতাড়িত করতে এবং তাঁর পিতা তাকে তা করতে দেয়নি। তিনি হতাশ হয়ে তাঁর পিতার উপর এত বিরক্ত হন যে মালয়ে চলে যান। সেখানে তিনি দুষ্ঠগামনী নামে পরিচিত হন। তাঁর পিতার মৃত্যুর পর তিনি তাঁর ভ্রাতা দুজনই সিংহাসনের দাবী জানান। দুট্টগামনী তাঁর ভাইয়ের বিরুদ্ধে দুটি যুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং বিজয়ী হন। তারপর দুই ভাইয়ের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হয়। কিছু সময় পর তিনি দমিলদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করেন। তিনি সমগ্র দ্বীপকে একটিমাত্র রাজ্যে পরিণত করেন। তিনি ছিলেন একজন ধার্মিক মানুষ। তিনি তাঁর রাজত্বে বৌদ্ধ-ধর্মের উন্নতির জন্য প্রভূত অবদান রেখেছিলেন। তিনি মরিচবটী বিহার, লৌহ প্রসাদ মহাস্তুপ নির্মাণ করেন। মহাস্তুপে ধাতু কক্ষে তিনি ধাতুগুলি স্থাপন করেন। এই দান সম্পূর্ণ বওয়ার পূর্বেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই তিনি তার ভাই তিস্পকে কাজ সমাপ্ত করার অনুরোধ জানান। রাজা একটি পালকীতে চড়ে সেটির প্রতি শ্রদ্ধা জানান। তাঁর মৃত্যুর পর তিনি তাঁর পুণ্যকাজের জন্য তুষিত স্বর্গে-যান। দুঠগামনীর মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতা সদ্ধাতিষ্য রাজা হন। তিনি ১৮ বছর রাজত্ব করেন। তিনি অনেক চৈত্য বিহার নির্মাণ করেন। তারপর থুলাথন, লজ্জাতিস, খল্লাতনগ এবং বট্টগামনী পরপর রাজা হন। শেষোক্ত রাজার রাজত্বকালে পিটক অকথা প্রমাণ লিখিতরূপ লাভ করে। তাঁর রাজত্বকালে দমিলরা কোন শক্তিশালীই হয়ে ওঠেনি, তারা সিংহাসন দখলও করেছিল। অনেক দমিল শাসক রাজত্ব করেন। আবার বট্টগামনী ক্ষমতায় আসেন। তিনি দমিলদের পরাজিত করে সিংহাসন দখল করেন এবং কয়েক বছর রাজত্ব করেন।

মহাচ্চ মহাতিষ্য ছিলেন বট্টগামনীর পালিত পুত্র। তিনি তাঁর পিতার পর রাজা হয়ে ১৪ বছর রাজত্ব করেন। তাঁর পর চোরনাগতিস্স, শিব, দমিল বাটুক, ব্রাহ্মণ নিলিয়, রাণী-অনুলা, কুটকন্ন তিস্স, বাটিকভয়, এবং মহাদাঠিক, মহানাগ রাজা হন। তাঁরা বিহার চৈত্য নির্মাণ করেন। রাণী অনুলার চরিত্র খুব খারাপ ছিল। শিব, তিস্স, দমিল, বাটুক ব্রাহ্মণ নিলয় ছিলেন তাঁর প্রেমিক এবং তিনি তাঁদের হত্যা করেন। মহাদন্তিকা পুত্র তার পিতার পর সিংহাসন আরোহন করেন। তারপর কনিরজানুতিস্প, চুলভয়, রানী শিবলী, ইলঙ্গ, চন্দমুখ, শিব, যশলিলাকতিস, শুভরাজ বংকনাতিস, গজহুকগামন, এবং মহাল্লক পরপর সিংহাসন আরোহন করেন। তঁরা দুর্বল শাসক ছিলেন এবং দ্বীপরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ধর্মীয় ইতিহাসে কোন তাৎপর্য্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেননি।

Mahallaka Naga পর রাজা হন Bhatikatissaka তিনি ১৪ বছর রাজত্ব করেন। তারপর ১২ জন রাজা পরপর সিংহাসনে আরোহন করেন। তাঁরা ছিলেন Kanitthatisska, Khujjanaga, Kuneanaga, Srinaga, Tissa, Ahayanaga, Srinaga, Vijayakumaraka, Samghatissa, Sirisanggabodhi, Gothabhaya and jotthisatissa. তাঁরা শক্তিশালী রাজা ছিলেন না, কিন্তু ধার্মিক বৌদ্ধ ছিলেন। তারা অনেক বিহার ভবন নির্মাণ করেছিলেন।

মহাসেন ছিলেন রাজা জ্যেষ্ঠতিসের ছোট ভাই। তিনি তাঁর দাদার পর রাজা হয়ে ২৭ বছর রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে মহানাম মহাবিহারের ভিক্ষুদের কোন খাদ্য না দিতে। মহাবিহারের ভিক্ষুরা সমস্যায় পড়লেন এবং বিহার ত্যাগ করে চলে গেলেন। রাজা মহাসেন অভয়গিরি বিহারের একজন অনুগামী ছিলেন। রাজা অনেক ভুল কাজ করছিলেন। তাঁর মন্ত্রী মেঘবগ্নঅভয় এতে ক্রুদ্ধ হয়ে এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাইলেন। মহাসেনের রাজত্বকালে মহাবিহার ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ল এবং বৌদ্ধধর্মের যথেচ্ছ অগ্রগতি হল না। রাজা তাঁর মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ কবে তাঁর ভুল কাজগুলির জন্য অনুতাপ প্রকাশ করলেন। তিনি মহাবিহারকে পুর্ননির্মাণ করলেন এবং সেই সঙ্গে জেবনবিহার এবং মণিহারবিহার নামে দুটি বিহার নির্মাণ করলেন। বিখ্যাত নৃপারামবিহার তিনি নির্মাণ করেছিলেন এবং এছাড়াও দুটি ভিক্ষুণীদের আবাস নির্মাণ করেছিলেন। দ্বীপবংশের মত মহাবংশ ভারতবর্ষ শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে একই ঘটনাবলীর বিবরণ দিয়েছে। অনেক স্থানে দুটি বিবরণের হুবহু সাদৃশ্য রয়েছে। এটিকে এইভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যে দুটি গ্রন্থের রচয়িতারই তাঁদের গ্রন্থ রচনায় একই উপাদানের সাহায্য নিয়েছেন।

কিন্তু মহাবংশ আরও বিস্তৃত সংস্করণ। এখানে পাণ্ডুকভয়, দুঠগামনী বট্টগামনীর মত রাজাদের রাজত্বকালের এবং শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়গুলির উত্থান বিকাশ এবং বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তন, প্রতিষ্ঠা বিকাশের মত ঘটনাগুলিকে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। H.R.Parera বলেছেন, "সম্পূর্ণতা, উপাদানের বিন্যাস সাহিত্যিক মানের দিক থেকে মহাবংশ উৎকৃষ্টতর রচনা।" B.C.Law মহাবংশের একটি বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর মতে মহাবংশ নিঃসন্দেহে সিংহলের বংশ সাহিত্যে কবি বৈশিষ্ট্য যুক্ত থের মহানামের একটি অসাধারণ রচনা। নিঃসন্দেহে এটি দীপবংশের মত পূর্বেকার একই ধরনের গ্রন্থের তুলনায় অধিকতর সম্পূর্ণ এবং এতে তার কবির কাব্য প্রতিভার উৎকৃষ্টতর সাক্ষ্য বহন করছে। H. Oldengurg এর মতে, "...দীপবংশ মহাবংশ এই দুটি রচনার ভিত্তি হল মহাবিহারের মহান ভাষ্যের ঐতিহাসিক ভূমিকা। দুটিই গ্রন্থই তাদের সাধারণ বিষয় গুলিকে পরিবেশন করছে, প্রথমটি ধাপে ধাপে প্রায় হুবহু মূল গ্রন্থটিকে অনুসরণ করেছে, দ্বিতীয়টি অধিকতর স্বাধীনতা নিখুঁত সাহিত্যিক দক্ষতাসহ অগ্রসর হয়েছে এটি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, "দীপবংশের সঙ্গে তুলনা করে বলা যায় যে মহাবংশের একটি শিল্পকর্মরূপে বিবেচিত হওয়ার সমস্ত দাবিই রয়েছে কাহিনী অত্যন্ত যুক্তিসংগতভাবে অগ্রসর হয়েছে এবং কাহিনী সূত্র কখনও আকস্মিকভাবে ভঙ্গ হয় না বা এখানে কোন পুনরাবৃত্তি নেই। এটি কখনও কখনও দীপবংশের সমান্তরালে এমনভাবে অগ্রসর হয় যে দুটি মহাকাব্যের সম্পূর্ণ পর্বই একই উপাদানের ভিন্ন পরিবেশনা। কিন্তু মহাবংশে দীপবংশকে ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ করে বা বিষয়বস্তুকে সংক্ষিপ্ত আকারে উপস্থাপন করে। দীপবংশকে তুলনায় মহাবংশে শৈলী বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণে অনেক বেশী দক্ষতা চোখে পড়ে। এছাড়াও ব্যবহৃত শব্দের সৌন্দর্য বিশেষত শব্দ নিয়ে লেখা দীপবংশের তুলনায় মহাবংশে বেশী দেখা যায়। সংক্ষেপে বলতে গেলে, মহাবংশের সর্বত্র আমরা এমন একজন কবির হাত দেখতে পাই, যিনি একটি বিশেষ লক্ষ্যে কাজ করছেন, তাঁর উপাদানগুলিকে সময় দিচ্ছেন এবং সেগুলিকে উপযুক্ত আঙ্গিকে পরিবেশন করতে চেষ্টা করছেন। দীপবংশ মহাবংশ উভয় গ্রন্থেই বহু কিংবদন্তীর উল্লেখ রয়েছে কিন্তু তারা আমাদের এমন অনেক প্রয়োজনীয় ধর্মীয় রাজনৈতিক উপাদান দান করে যেগুলি নিঃসন্দেহে প্রাচীন যুগের দ্বীপরাষ্ট্রের ইতিহাস খুঁজতে সহায়ক হবে।

চুলবংস:

চুলবংশ বা 'সিংহলীয় রাজাদের অপেক্ষাকৃত স্বল্প গুরুত্বপূর্ণ রাজবংশ 'মহাবংশের পরবর্তী অংশ। এটি আধুনিক যুগ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার একটি পারম্পর্যযুক্ত ইতিহাস পরিবেশন করে। এই নিরবিচ্ছিন্ন ধারা চলেছিল বিভিন্ন লেখকের যোগ্য পরিচালনায়। বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে মহাবংশের রচয়িতা মহানামার মৃত্যুর পর ইতিবৃত্তটিকে ধারাবাহিকতা রেখেছিলেন বিভিন্ন থেরর যাঁরা বিভিন্ন যুগে বর্তমান ছিলেন এবং তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল আধুনিক যুগ পর্যন্ত দ্বীপরাষ্ট্রটির একটি নিরবিচ্ছিন্ন ইতিহাস উপস্থাপন করা। B.C.Law বলেন, মূলমহাবংশ যার নায়ক ছিলেন দুট্টগামনী রচিত হয়েছিল মহানাম দ্বারা, এবং চূলবংশ যার নায়ক ছিলেন মহান পরাক্রমবাহু রচিত হয়েছিল ধর্মকীর্তি দ্বারা। চুলবংশের দ্বিতীয় ভাগ যার নায়ক ছিলেন কীর্তিশ্রী রচিত হয়েছিল সিদ্ধার্থ দ্বারা এবং শেষ হয়েছিল একটি অধ্যায় দ্বারা যেটি রচনা করেছিলেন হিক্কাদুভে শ্রী সুমঙ্গল। ভদন্ত যোগিবলিয় পঞঞানন্দ এটিকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত নিয়ে এসে অত্যন্ত প্রশংশনীয় কাজ করেছেন। G.P. Malalasekher মহাবংশের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, “৩০২ খ্রীষ্টাব্দে মহাসেনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সিংহলীয় রাজাদের মহাবংশ শেষ হয়। রাজাবলীতে বলা হয়েছে চুলবংশের রাজারা (ক্ষুদ্রতর রাজবংশ) আর বিশুদ্ধ রক্তের অধিকারী ছিলেন না। তারা ছিলেন সেই সমস্ত পিতামাতার সন্তান যাদের মাত্র একজন চন্দ্রবংশজাত ছিলেন, এবং বাকীরা ছিলেন তাঁদের সন্তান যারা পবিত্র বোধিবৃক্ষ বা দন্তধাতু নিয়ে গিয়েছিলেন। এই কারণে দেশের উর্বরতা কমে গিয়েছিল, এবং মহাসেনের পর যে সমস্ত রাজারা সিংহাসন আরোহন করেছিলেন তাঁরা প্রাচীনকালের রাজাদের মত ততটা শ্রদ্ধালাভ করতেন না।" Geiger B.C. Law চুলবংশের উল্লেখ করেছেন। দুটি প্রমাণের ভিত্তিতে মহানামের গ্রন্থটির পরবর্তী অংশকে চুলবংশও নামকরণের কারণ বলে গ্রহণ করেছেন () চুলবংশের একটি বিবৃতি অধ্যায় ৯৯-৭৬ () সিংহলের রাজাবলীয়তে একটি বিবৃতি। যথাযথভাবে পরীক্ষা করলে দেখা যাবে যে দুটি বিবৃতিরই অর্থ এক। দুটিতেই সিংহলের রাজাদের মহানবংশ 'ক্ষুদ্রবংশ' এই দুই ভাগে বিভক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে। রাজাবলীয়র মতে প্রথম রাজবংশ শেষ হচ্ছে মহাসেনকে দিয়ে এবং পরবর্তী বিভাগটি শুরু হচ্ছে মহাসেনের পুত্র শ্রীকীর্তি মেঘবগ্নকে দিয়ে। পরবর্তী রাজবংশটিকে চুল বা ক্ষুদ্রত্তর বলা হয় কারণ রাজারা মিশ্র রক্তের ছিলেন, তারা জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেই সমস্ত রাজাদের থেকে যারা দ্বীপে পবিত্র বোধিবৃক্ষ পবিত্র দন্ত ধাতু নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু শ্রীলঙ্কার রাজাদের এই বিভাগ থেকে একথা প্রমাণিত হয় না যে মহানাম দ্বারা রচিত ইতিবৃত্তটি মহাসেনের রাজত্বকালে দিয়ে শেষ হয়েছিল। দ্বিতীয় ধৰ্ম্মকীর্ত্তি নামে একজন থের মহাসেনের রাজত্বকালে (৩০২ খ্রীষ্ট) থেকে দম্বদেনীয়র পণ্ডিত পরাক্রমবাহুর রাজত্বকাল (১২৪০-৭৫) পর্যন্ত দ্বীপের ইতিহাস সংকলন করেন। অনেক পণ্ডিত এই বিবৃতিটির যথার্থতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। প্রতিটি নতুন ইতিবৃত্তাকার তাঁর সময়কার রাজার পূর্ববর্তী রাজাদের রাজত্বকালের বিবরণ অত্যন্ত দ্রুতভাবে উপস্থাপন করেছেন এবং তারপর সেই রাজার রাজত্বকালের বিবরণ দিয়েছেন অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে। মহান পরাক্রবাহুর রাজত্বকালে ঘটনাবহুল অধ্যায়ে একটি বিরতি রয়েছে বলে মনে হয়, দম্বদেনীয়র পরাক্রমের পর্যন্ত তার পরবর্তী রাজাদের বিবরণ অত্যন্ত দ্রুত পরিবেশন করা হয়েছে, যদিও তাঁর জন্য সাতটি অধ্যায় বরাদ্দ করা হয়েছে। সম্ভবতঃ মহান পরাক্রমবাহুর রাজত্বকালে রচিত দাঠাবংশের লেখক ধম্মকীর্তি এবং দম্বদেনীয়র পরাক্রমবাহুর রাজত্বকালে রচিত মহাবংশের লেখক ধম্মকীর্ত্তি এই দুই ধৰ্ম্মকীত্তির মধ্যে কিছু বিভ্রান্তি রয়েছে। শেষোক্তজন নিঃসন্দেহে শৈলীর কারণে পরবর্তীকালের। প্রমাণের অভাবের জনু কিছু নির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন। চুলবংশের প্রথম অংশের রচনার জন্য ধৰ্ম্মকীত্তি সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। সিংহলীয় ঐতিহ্যে ত্রয়োদশ শতকে দ্বিতীয় পরাক্রমবাহুর রাজত্বকালে ধৰ্ম্মকীত্তি নামে একজন ব্রহ্মদেশীয় ভিক্ষুর শ্রীলঙ্কায় আগমনের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু চূলবংশে ধৰ্ম্মকীত্তি নামে এমন কোন ব্রহ্মদেশীয় ভিক্ষুর উল্লেখ নেই যার সঙ্গে দ্বিতীয় পরাক্রমবাহুর রাজত্বের যোগাযোগ ছিল। চুলবংশে ধৰ্ম্মকীত্তি নামে একজন সিংহলীয় থেরের উল্লেখ পাওয়া যায় যিনি প্রথম পরাক্রমবাহুর অনুরোধে শ্রীলঙ্কার অন্যতম রাজদূত হিসেবে রামাঞা দেশ বা নিম্নব্রহ্মের রাজদরবারে গমন করেছিলেন। চুলবংশে ধম্মকীত্তি নামে একজন ভিক্ষুর বর্ণনা রয়েছে যিনি চোলদেশে বসবাস করতেন। রাজা দ্বিতীয় পরাক্রমবাহু তাঁকে তাঁর দেশ থেকে শ্রীলঙ্কায় এসে বৌদ্ধ সংঘের সংস্কার করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। অনেক পণ্ডিত মনে করেন যে তিনি ছিলেন সেই থের যিনি চুলবংশে মহাসেনের রাজত্বকাল থেকে দ্বিতীয় পরাক্রমবাহুর রাজত্বকাল পর্যন্ত সিংহলের ইতিহাস চুলবংশে রচনা করেছেন। B. C. Law উল্লেখ করেছেন যে চুলবংশের প্রথম অংশটি ৪৩টি অধ্যায় নিয়ে গঠিত। তিনি বলেন, যে প্রথম পরাক্রমবাহুর রাজত্বকালের বিবরণের ঠিক পরই, W. Geiger সেই সমস্ত রাজাদের ইতিবৃত্ত এক ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, যাঁরা প্রথম পরাক্রমবাহুর পরে সিংহালন আরোহণ করেছিলেন। সিরিমা বিক্রমসিংহে গেইগারের সঙ্গে সহমত হয়েছেন। তিনি চুলবংশের বিভিন্ন অধ্যায়ের রচয়িতাদের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন যে ৩৭তম থেকে ৭৯তম অধ্যায়ে দুটি অংশ রয়েছে এবং এই অংশদুটি একজন নয় দুজন পৃথক লেখক রচনা করেছিলেন। তিনি W. Geiger এর অভিমতকে বাতিল করে দিয়েছেন যিনি মনে করেন যে এই অধ্যায়গুলি একটিমাত্র লেখকের রচনা। Amaradasa Liyanagamage "যদিও W. Geiger দুটি অংশের মধ্যে কোন চিহ্নিতকরণ আবিষ্কার করেননি, বিক্রমসিংহ যেমন দেখিয়েছেন তেমন 'পরাক্রমের মহাকাব্য' নিয়ে আলোচনায় অন্যান্য রাজাদের সম্পর্কে আলোচনার থেকে সুষ্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এবং একথা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে এটি ভিন্ন কোন লেখকের রচনা। ঐতিহ্য অনুসারে, চুলবংশের একটি অংশ রচনা করেছিলেন ধম্মকীর্ত্তি নামে একজন থের দ্বিতীয় পরাক্রমবাহুর রাজত্বকালে, এবং তাঁর বিশ্বাস যে ত্রুটি প্রথম পরাক্রম বাহুর রাজত্বকাল নিয়ে রচিত এই

গ্রন্থটির দ্বিতীয় অংশ হতে পারে।

B.C. Law মনে করেন চুলবংশের দ্বিতীয় অংশটি এগারটি অধ্যায় নিয়ে

গঠিত। তিনি বলেন যে এটি শুরু হচ্ছে LXXX অধ্যায় গিয়ে এবং শেষ হচ্ছে

XC অধ্যায় দিয়ে। এই অংশে দ্বিতীয় বিজয়বাহুর রাজত্বকাল থেকে চতুর্থ পরাক্রমবাহুর রাজত্বকাল পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে। B.C.Law বলেন চোল দেশের অধিবাসী একজন ভিক্ষু চুলবংেশর এই অংশটির রচয়িতা ছিলেন। এই মহাথের বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শী ছিলেন এবং রাজা চতুর্থ পরাক্রমবাহু তাঁকে এই দ্বীপে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সিরিমা বিক্রমসিংঘে মনে করেন যে চুলবংশের তৃতীয় অংশ শুরু হচ্ছে দ্বিতীয় বিজয়াপুর রাজত্বকাল অর্থাৎ LXXX অধ্যায় থেকে। W. Geiger বলেন, LXXIX অধ্যায়ের ৮৪ সংখ্যক গাথায় তাঁর পান্ডুলিপিগুলির চারটিতে "নমোতস্পভগবতো অরহতো সম্মাসম্বুদ্ধস্সএই শব্দগুলির উল্লেখ রয়েছে। "এটি বুদ্ধকে সম্ভাষণ করার একটি মন্ত্র। এটি থেকে বোঝা যায় যে একটি নতুন অংশ শুরু হচ্ছে। পঞ্চম পাণ্ডুলিপি অর্থাৎ যেখানে ইতিবৃত্ত প্রথম পরাক্রমহাবাহুর দুষ্কর্মের বিবরণ দেওয়া হয়েছে সেখানে তিনটি বিভাজন চিহ্ন দেখা যায়। দ্বিতীয় বিজয়বাহু তাঁর প্রজাদের প্রথম পরাক্রম বাহুর অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। একথা বিশ্বাস করা কঠিন যে যে লেখক পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলিতে শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে প্রথম পরাক্রমবাহুর মহান অবদানের জন্য তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন, তিনিই আবার পরবর্তী অধ্যায়ে হঠাৎই তাঁর দুষ্কর্মের বর্ণনা দেবেন। অতএব, উপরোক্ত তথ্য থেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে একটি নতুন অংশ অর্থাৎ তৃতীয় অংশ যেটি কোন ভিন্ন লেখক দ্বারা রচিত শুরু হচ্ছে LXXX অধ্যায় দিয়ে এবং শেষ হচ্ছে XC অধ্যায়ের ১০২ বা ১০৪ নম্বর গাথায় চতুর্থ পরাক্রমবাহুর রাজত্বকালের অবসান দিয়ে। তবে তথ্য প্রমাণের অপ্রতুলতার জন্য চুলবংশের এই অংশের রচনাগুলি রচয়িতা সম্পর্কে কোন কিছু বলা কঠিন।

B.C.Law বলেন যে চুলবংশে সেই সময় থেকে কীর্তিশ্রী রাজসিংহের রাজত্বকাল পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার একটি নিরবিচ্ছিন্ন ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে যিনি অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সিংহাসনে আরোহন করেন। তিবতুভভাবে সুমঙ্গল থের ছিলেন এই অংশের রচয়িতা। Hikkodvve sri Sumangala Batuvantaduve Pandita সর্বশেষ অধ্যায়ের রচয়িতা সেখান ১৮১৫ সাল পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে।

মহাবংশে বিজয় থেকে সেই সমস্ত মহাসেন পর্যন্ত রাজাদের তালিকার একটি উল্লেখ রয়েছে যারা শ্রীলঙ্কা উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন এবং যাদের এই দেশের প্রথম মুকুটযুক্ত রাজা বলে গণ্য করা যায়। দীপবংশও রাজা মহাসেনের রাজত্বকালের বর্ণনা দিয়ে শেষ হয়েছে। কিন্তু চুলবংশ শুরু হয়েছে রাজাশ্রী মেঘবর্ণের রাজত্বকাল দিয়ে এবং শেষ হয়েছে প্রথম পরাক্রমবাহুর রাজত্বকাল দিয়ে। এখানে শ্রীলঙ্কার ৭৮ জন রাজার একটি বংশলতিকা দেওয়া হয়েছে। এখানে এমন অনেক অধ্যায় রয়েছে যেখানে শ্রীলঙ্কার রাজা প্রথম পরাক্রমবাহুর রাত্বকালের উচ্চ প্রশংসা করা হয়েছে। চুলবংশের এই অংশটিকে পরাক্রমের মহাকাব্য বলে বর্ণনা করেছেন। এই রাজা তাঁর দানের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তিনি দারিদ্র বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ভিক্ষা দিতেন। তিনি চোল দমিলদের যুদ্ধে পরাজিত করে তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করেছিলেন। তিনি দ্বীপটিকে ঐক্যবদ্ধ করে তারা রাজা হয়েছিলেন। তিনি বৌদ্ধদের প্রগতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। তিনি অনেক বিহার স্তুপ নির্মাণ করিয়েছিলেন। চুলবংশের দ্বিতীয় অংশ থেকে দ্বিতীয় বিজয়বাহুর রাজত্বকাল থেকে চতুর্থ পরাক্রমবাহুর রাজত্বগুলি পর্যন্ত শ্রীলঙ্কা দ্বীপের ইতিহাস পাওয়া যায়। এই গ্রন্থে শ্রীলঙ্কার ২৩ জন রাজার উল্লেখ রয়েছে। তৃতীয় বিভাগটি রাজা তৃতীয় ভুবনেকবাহুকে দিয়ে শুরু হচ্ছে এবং কীত্তিশ্রী রাজসিংহকে দিয়ে শেষ হচ্ছে। এখানে ২৪ জন রাজার উল্লেখ রয়েছে। সেই অধ্যায়ে দুজন রাজার কথা বলা হয়েছে যারা হলেন শ্রীরাজাধিরাজ শ্রীবিক্রমরাজসিংহ।

মহাবোধিবংস বা বোধিবংস

মহাবোধিবংস বা বোধিবংস হল পালি ভাষায় রচিত 'বোধিবৃক্ষের ইতিহাস বিষয়ক একটি গদ্য রচনা। M Winternitz গাথাগুলিকে কেবল 'গাথাগুলির শেষে বা সম্পূর্ণ রচনাটির শেষের দিকে খুঁজে পেয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে উপতিষ্য নামে কেজন বৌদ্ধ ভিক্ষু একাদশ শতকের প্রথমার্ধে এই গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন। কিন্তু মনে করেন যে গ্রন্থটি খ্রীষ্টীয় দশম শতকে সংকলিত হয়েছিল। তাঁর সঙ্গে সহমত হয়েছিল। D.M.dez.wickremasinghe তাঁর সঙ্গে সহমত হয়েছেন। S. Arthur Strong যিনি ১৮৯১ সালে গ্রন্থটি সম্পাদনা করেন এই মত পোষণ করেন যে বোধিবংশের রচয়িতা বুদ্ধঘোষের আমলে বর্তমান ছিলেন। তিনি বলেছেন যে গন্ধবংশে সেটির রচয়িতার একটি বিবরণ পাওয়া যায়। রচয়িতা এটি লিখেছিলেন দাঠানাগের উৎসাহে যাকে দাতা বলে সনাক্ত করা হয়েছে। গন্ধবংশে বলা হয়েছে যে বুদ্ধঘোষ শেষোক্তজনের অনুরেধে সুমঙ্গলবিলাসিনীর রচনার পরিকল্পনা করেছিলেন। মতে দাঠা দাঠানাগ দুজন ভিন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তাঁরা এক এবং অভিন্ন ছিলেন না। গন্ধবংশে দ্বীপবংশ, মহাবংশ, চুলবংশ এবং পসিম্ভিদামন্ত্রের অঠকথার সঙ্গে সঙ্গে মহাবোধিবংশেরও উল্লেখ পাওয়া যায়। এখানে শ্রীলঙ্কার ভিক্ষু-পণ্ডিতদের একটি বিবরণ রয়েছে। এখানে উপতিষ্যের একটি উল্লেখ রয়েছে। অষ্টাদশ শতকের শরণারঙ্কর সংঘবদ্ধ মধুরখ প্রকাশনী রচনা করেছিলেন যেটি পালি গ্রন্থটির সিংহলীয় সংস্করণ। তিনি বলেন বোধিবংশ দাঠানাগের অনুরোধে রচিত হয়েছিল। শাসনবংশদ্বীপে উল্লেখ রয়েছে যে উপতিষ্য বোধিবংশের লেখক ছিলেন। খ্রীষ্টীয় চতুর্দশ শতকের শুরুতে বিলগাম্মুলা মহাথের পালি রচনাটির একটি বর্ধিত সিংহলীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে উপতিষ্য পালি বোধিবংশের রচয়িতা ছিলেন। গুরুলোগোমি যিনি খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বর্তমান ছিলেন বোধিবংশ পরিকথা বা ধর্মপ্রদীপিকা রচনা করেন যেটি পালি বোধিবংশের সিংহলী ভাষ্য। তিনি বলেন উপতিষ্য পালি বোধিবংশ রচনা করেন। চূলবংশ থেকে জানা যায় দাঠানাগ রাজা চতুর্থ মহেন্দ্রের সমসাময়িক ছিলেন যিনি খ্রীষ্টীয় দশম শতকের মাঝামাঝি সিংহাসন আরোহন করেন। রাজা তাঁকে অভিধৰ্ম্ম সম্পর্ক আলোচনা- জন্য নিয়োগ করেন। D.M. dez Wickremasinge এবং W. Geiger দুজনেই তাঁকে রাজা চতুর্থ মহেন্দ্রের সমসাময়িক রূপে স্বীকার করেন এবং বলেন যে মহাবোধিবংশ খ্রীষ্টীয় দশম শতকের শেষ পাদে রচিত হয়েছিল। কোন কোন পণ্ডিত মনে করেন যে এটি চতুর্থ শতকের শেষপাদের মধ্যে রচিত হয়েছিল। S. Arthur Strong তাঁর মহাবোধিবংশের সংস্করণের মুখবন্ধে মন্তব্য করেছেন যে লেখক তাঁর গ্রন্থটি স্বাধীনতা বাগবাহুল্য নিয়ে রচনা করেছেন। প্রাচীন বৌদ্ধধর্মের অধিকাংশ ঘটনাই বোধিবৃক্ষের ছায়ায় ঘটেছে। লেখক মূলত বিভিন্ন উৎস এবং মহাবংশের মূল রচনা থেকে উপাদান সংগ্রহ করেছেন কিন্তু তিনি যে আরও অন্যান্য উপাদান ব্যবহার করেছিলেন তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে।

G.P. Malalasekhera মহাবোধিবংশের ভাষা রচনাশৈলী নিয়ে আলোচনা করেছেন তাঁর মতে, "এমনকি সেখানে মহাবোধিবংশ অন্যান্য রচনা থেকে ঋণ নিয়েছে সেখানেও তাঁর শৈলী সেই গ্রন্থগুলির থেকে পৃথক। আরও বেশী কৃত্রিম মুদ্রাদোষযুক্ত, স্তবকগুলিকে পালি ভাষায় রচনা করা হয়েছে, প্রচুর আলঙ্কারিক বিশেষণে রয়েছে এবং লেখক দীর্ঘ পর্বের ভক্ত। ভাষার ক্ষেত্রে পালির উপর সংস্কৃতের প্রভাবের সুস্পষ্ট চিহ্ন রয়েছে এবং আমরা এই গ্রন্থটিকে সংস্কৃতগন্ধী পালির পর্বে শুরু বলে গণ্য করতে পারি। কখনও কখনও পালি শব্দগুলিকে সংস্কৃতায়িত অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে এবং কখনও কখনও সংস্কৃত কাব্যের সঙ্গে পরিচিতির মাধ্যমে সংগৃহীত দীর্ঘ যুগ্মপদকে ব্যবহৃত করা হয়েছে; তাই রচনার সমগ্র সুর পদ্ধতিতে একধরণের সংস্কৃতভূত পালি ব্যবহারের প্রবণতা প্রকাশ পায়।

মহাবোধিবংশ বুদ্ধ দীপঙ্করের কাহিনী দিয়ে শুরু হচ্ছে। এখানে পূর্ববর্তী বুদ্ধগণের অধীনের বোধিসত্ত্বগণের জীবন, গৌতমের জীবন, বোধিবৃক্ষের নীচে তাঁর নির্বাণ লাভ, বোধি লাভ সংক্রান্ত আলোচনা, আনন্দের বোধিলাভ, বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ প্রথম তিনটি বৌদ্ধ সঙ্গীতিবিষয়ক আলোচনা রয়েছে। এখানে মহিন্দের ধর্মপ্রচার, শ্রীলঙ্কার, বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তন বিকাশ বুদ্ধের ধাতু বোধিবৃক্ষের শাখার শ্রীলঙ্কায় আগমন এবং সেখানে বোধিপূজা প্রবর্তনের বর্ণনা করা হয়েছে।

দাঠাবংস বা দন্তধাতুবংস:

দাঠাবংশ বা দন্তধাতুবংশ বা 'বুদ্ধের দন্তধাতুর ইতিহাস' রচিত আংশিক সংস্কৃতায়িত পালি ভাষায়। (দীর্ঘ যুগ্মপদসহ) এটি একটি মহাকাব্য। G.P. Malalasekhera বলেন, 'এটি অনুনাদী ভাষায় রচিত এবং সংস্কৃত কাব্যের মত বিস্তারিত বিবরণ দেয়' একমাত্র যেখানে লেখক বিস্তারিত বিবরণ দেবার চেষ্টা করেছেন সেখানে ছাড়া কাব্যটির অন্যত্র কঠোর সরলতা, সুমধুর শব্দে আবৃত পালি কাব্যের ছন্দের অন্যতম মনোহর দৃষ্টান্ত পরিবেশন করে যেটি বড় বড় উপমা এবং আলঙ্কারিকভাবে বিস্তৃত ধ্যান্ ধারনা থেকে মুক্ত। দাঠাবংশ শব্দভাণ্ডারের দিক থেকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। B.C. Law বলেন, 'Kern' সঠিকভাবেই মন্তব্য করেছেন যে এটি সংক্ষিপ্তসারের শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত এবং এতে আরও প্রাচীন রচনা থেকে গৃহীত অংশের পুনরাবৃত্তি রয়েছে যার সঙ্গে কম বেশী বিভিন্ন সন্দেহজনক সংযোজনও রয়েছে। দাঠাবংশের অর্থ হল গৌতম বুদ্ধের দন্তধাতুর ইতিহাস। 'বংশ' শব্দের অর্থ 'ইতিবৃত্ত, ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদি আক্ষরিকভাবে এর অর্থ বংশ, রাজবংশ ইত্যাদি। B.C. Law বলেন, "দাঠাবংশহল একটি অর্ধধর্মীয় ঐতিহাসিক ইতিবৃত্ত যা রচিত হয়েছিল উপদেশ দান এবং উদ্দেশ্য নিয়ে। এই গ্রন্থটি উল্লেখযোগ্য কারণ এটি প্রমাণ করেছে যে পালি ভাষাকেও মহাকাব্য রচনার মাধ্যমরূপে ব্যবহার করা যেতে পারে।

ধম্মকীত্তি থের যিনি পুলাও নগরের অধিবাসী ছিলেন দাঠাবংশ রচনা করেছিলেন। শাসনবংশ গন্ধবংশে বলা হয়েছে যে এটি তাঁর দ্বারা রচিত হয়েছিল। তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত ভিক্ষু যিনি তাঁর তর্কশাস্ত্র, সংস্কৃত, ব্যাকরণ, কাব্য আগম (ধর্মীয় সাহিত্য) এবং বুদ্ধের শিক্ষার জ্ঞানের জন্য সুপরিচিত ছিলেন। তিনি সারিপুত্তের একজন শিষ্য ছিলেন। কথিত আছে, রাজা প্রথম পরাক্রমবাহু তাঁর রানী লীলাবতীর অনুরোধে তাঁকে রাজগুরুর পদে নিয়োগ করেছিলেন। শ্রীলঙ্কার প্রধান সেনাপতি পরাক্রম ধর্মকীর্তিকে দাঠাবংশ রচনার অনুরোধ করেছিলেন এবং তিনি তা রচনা করেও ছিলেন। তিনি লীলাবতীকে দ্বীপের শূন্য সিংহাসন অধিকার করতে সাহায্য করেছিলেন। তারপর তিনি তাঁর প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। একথা জানা আছে যে রাণী লীলাবতীর রাজত্বকালে ধর্মকীর্তি সেনাপতি পরাক্রমের অনুরোধে দাঠাবংশ রচনা করেছিলেন। Winternitz B.C.Law উল্লেখ করেছেন যে লেখক খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকের শুরুতে পালি দাঠাবংশ রচনা করেছিলেন। ধম্মকীত্তি বলেছেন যে তাঁর গ্রন্থটির ভিত্তি হল 'দেশীয় ভাষায় রচিত' একটি প্রাচীনতর দাঠাবংশ যেটি এখন আর পাওয়া যায় না। এমন হওয়া খুব সম্ভব যে তিনি প্রাচীন ঐতিহ্যের ভিত্তিতে গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন এবং তার সঙ্গে অতিরিক্ত চিন্তা ভাবনাও যোগ করেছিলেন।

দাঠাবংশে বুদ্ধের দন্তধাতুর ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। যেটিকে শ্রীকীর্তিশ্রীমেঘবপ্নের রাজত্বের নবম বর্ষে কলিঙ্গের রাজা গুহাশিবের কন্যা হেমলতা জামাতা দন্তকুমার কলিঙ্গের রাজধানী দাঠাপুরা থেকে শ্রীলঙ্কায় নিয়ে এসেছিলেন। এটিতে পাঁচটি অধ্যায় রয়েছে। প্রথম অধ্যায়টি বুদ্ধ দীপঙ্করের বর্ণনা দিয়ে শুরু হচ্ছে। তিনি রামাবতীর মানুষদের আমন্ত্রণে সেই নগরীতে এসেছিলেন এবং সেই সময়ে সুমেধ নামে একজন সন্ন্যাসী তাঁর মহান ভক্তি প্রদর্শনের জন্য রাস্তায় শুয়ে পড়েছিলেন এবং বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের রাস্তা পার হবার জন্য তাঁর শরীরের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে হয়েছিল। দীপঙ্কর সুমেধকে এই আশীর্বাদ করেছিলেন যে ভবিষ্যকে তিনিও একজন বুদ্ধ হবেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি দশটি পারমিতা পূর্ণ করেন এবং তাঁর অন্তিম জন্মের পূর্বে তিনি স্বর্গের একজন সন্ন্যাসী ছিলেন। তারপর তিনি কপিলবাস্তুতে পুনর্জন্ম গ্রহণ করেন এবং তাঁর পিতা ছিলেন শুদ্ধোদন মাতা ছিলেন মহামায়া। তাঁর নাম ছিল সিদ্ধাত্থকুমার একজন বৃদ্ধ, একজন রোগী, একজন মৃত ব্যক্তি একজন সন্ন্যাসীকে দেখে তিনি সংসার ত্যাগ করেন। উরুবেলায় ছয়বছর কঠোর পরিশ্রম করে তিনি বোধিজ্ঞান লাভ করেন। বৈশাখী পূর্ণিমায় বোধি বৃক্ষের নীচে তিনি পরম জ্ঞান লাভ করেন। তিনি ঈষিপতনে পাঁচজন শিষ্যের একটি দলকে তিনি ধম্মচক্কপবত্তম সুত্ত দেশনা করেন।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে বোধিলাভের নয় মাস পর বুদ্ধ আকাশপথে লঙ্কায় আসেন এবং যক্ষদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার দ্বারা লঙ্কা যক্ষদের হাত থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। তারপর বুদ্ধ দেবতাদের কাছে ধর্মপ্রচার করলেন এবং দেবতা সুমনকে তিনি তাঁর একটি কেশ দান করলেন যিনি সামন্তক পাহাড়ের চূড়ায় একটি চৈত্য নির্মাণ করলেন। তারপর বুদ্ধ জেতবনে প্রত্যাবর্তন করেন। তাঁর বোধিলাভের পাঁচবছর পর তিনি আবার লঙ্কায় যান। যিনি চুলধর মহোধরের মধ্যে শান্তি স্থাপন করেন যারা একটি দামী পাথরের জন্য লড়াই করছিল। তারপর আবার বোধিলাভের আটবছর পর তিনি মন্তক্ষিকা নামে একজন নাগের অনুরোধে তিনি শ্রীলঙ্কায় যান। তিনি পাঁচশত শিষ্য নিয়ে কল্যাণীতে তাঁর গৃহে আতিথ্য করেন। সেখানে একটি চৈত্য নির্মিত হয় এবং নাগেরা সেখানে পূজা করত। তারপর বুদ্ধ সুমন্তকূট পাহাড়ে গিয়ে সেখানে তাঁর পদচিহ্ন স্থাপন করেন। তারপর তিনি অনুরাধাপুরে বোধিবৃক্ষের স্থানটি প্রদর্শন করেন। তারপর তিনি কুশীনারায় পরিনির্বাণ লাভ করেন। বুদ্ধের মৃতদেহ সম্পূর্ণভাবে দগ্ধ হয়। বুদ্ধের ইচ্ছানুসারে, তাঁর মাথা, দুটি ঘাড়ের এবং দাঁতের অস্থি ছাড়া অবশিষ্ট অস্থিগুলি পৃথক হয়। সরবাহু নামে সারিপুত্তের একজন শিষ্য বুদ্ধের একটি অস্থি নেন এবং শ্রীলঙ্কার মহিমাগে গিয়ে একটি চৈত্য নির্মাণ করেন। ক্ষেম ছিলেন একজন অর্হৎ এবং তিনি বুদ্ধের বাম দন্ত ধাতুটি গ্রহণ করেন। অবশিষ্ট অস্থি ধাতুগুলিকে নিয়ে আটটি দেশের রাজাদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। দ্রোণ নামে একজন ব্রাহ্মণ সেই বিবাদের মীমাংসা করেন এবং আটটি দেশের মধ্যে সেই ধাতুগুলিকে সমানভাগে ভাগ করে দেন। রাজারা ধাতুগুলিকে নিয়ে তাঁদের রাজ্যে সেগুলির উপর চৈত্য নির্মাণ করেন। তারপর দাঠাবংশ, থেকে দাঠাপুরায় বুদ্ধের দন্তধাতুর একটি বিবরণ, ব্রহ্মদত্ত থেকে গুহাশিব পর্যন্ত কলিঙ্গরাজাদের একটি বংশলতিকা এবং গুহাশিবের বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের একটি বিবরণ পাওয়া যায়। ক্ষেম একটি দন্তধাতু নিয়ে কলিঙ্গের রাজা ব্রহ্মদত্তকে দিয়েছিলেন। তিনি তার উপর একটি স্তূপ নির্মাণ করে পূজা করতেন। তারপর তার পুত্র কাশীরাজ সিংহাসনে বসেন। সুনন্দ ছিলেন কাশীরাজের পুত্র। গুহাশিব ছিলেন সুনন্দের পুত্র। তিনি কাশীরাজেরক পর রাজা হন তিনি বুদ্ধের পরম ভক্ত ছিলেন এবং নিগ্রন্থদের তার রাজ্য থেকে বিতাড়িত করেন। তারা পাটলিপুত্রে চলে গিয়ে রাজা পাণ্ডুর কাছে অভিযোগ জানায়। রাজা পাণ্ডু দন্ত ধাতু সহ গুহাশিবকে গ্রেফতার করে পাটলিপুত্রে নিয়ে আসার জন্য সৈন্যবাহিনী পাঠান। এরজন্য তিনি চিত্তায়নকে দায়িত্ব দেন। কিন্তু শেষোক্তজন বুদ্ধের ভক্তে পরিণত হন।

তৃতীয় অধ্যায়ে পাটলিপুত্রের রাজার সঙ্গে গুহাশিবের বিবাহ বর্ণিত হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে গুহাশিব পাটলিপুত্রে এসেছিলেন দন্তধাতুটি তাঁর মাথায় নিয়ে। তারপর নিগ্রন্থরা রাজা পাণ্ডুকে বলল দন্তধাতুটিতে আগুন লাগিয়ে দিতে এবং রাজা সেটিকে আগুনে ফেলে দিলেন। কিন্তু ধাতুটির কিছু হল না বা সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হল না। তারপর রাজা সেটিকে পাথর দিয়ে ধ্বংস করতে চাইলেন কিন্তু সেটি আকাশে উড়ে গেল। দন্তধাতুটিকে একটি বাক্সে রেখে রাজা তাঁর লোকদের বললেন সেটিকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে কিন্তু কেউ সেটা করতে পারল না। তখন রাজা ঘোষণা করলেন যে যদি কোন ব্যক্তি দন্ত ধাতুটিকে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে তাহলে তিনি তাকে পুরস্কার দেবেন। অনাথপিণ্ডিকের পৌত্রের পুত্র সেই দন্তধাতুটিকে বাক্সে মধ্যে থেকে বের করতে গেলেন। তিনি সেটির প্রশংসা করলে সেটি আকাশে উড়ে গেল এবং তারপর তাঁর মাথার উপর নেমে সেখানেই থেকে গেল। চিত্তামসের উপদেশে রাজা বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে সেটির পূজা করলেন। তিনি বন্ধুত্বপূর্ণভাবে গুহাশিবকে গ্রহণ করলেন এবং দু'জনে একত্রে বহু পুণ্য কর্ম করলেন।

চতুর্থ অধ্যায়ে দন্ত কুমারের সঙ্গে হেমলতার বিবাহের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে যে রাজা পাণ্ডু রাজা ক্ষীরধারের সঙ্গে যুদ্ধের পর তাঁর রাজত্বে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তারপর তিনি গুহাশিবকে দন্তধাতুটি সহ কলিঙ্গতে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। দন্তকুমার যিনি উজ্জয়িনীর রাজপুত্র ছিলেন দন্ত ধাতুটিকে পূজা করার জন্য কলিঙ্গতে এসেছিলেন। গুহাশিব তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন এবং হেমমালার সঙ্গে তার বিবাহ দিলেন। তারপর দাঠাবংশ সেই ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে যার জন্য দন্তধাতুটিকে শ্রীলঙ্কায় নিয়ে আসা হয়েছিল। দন্তকুমারের পরাজয়ের পর তাঁর পুত্র ভ্রাতুষপুত্ররা দন্তপুরার কাছে এসেছিলেন দন্ত ধাতুটিকে জোর করে নিয়ে আসার জন্য। তখন গুহাশিব তাঁর কন্যা জামাতাকে দন্তধাতুটি নিয়ে শ্রীলঙ্কায় যেতে বললেন। কারণ লঙ্কা ছিল এমন একটি রাষ্ট্র সেখানে বৌদ্ধধর্ম সমৃদ্ধশালী অবস্থায় ছিল। তাঁরা একটি বাণিজ্যিক নৌকায় নিরাপদে শ্রীলঙ্কায় পৌঁছান।

পঞ্চম অধ্যায়ে রাজা শ্রী কীর্তি শ্রীমেঘবর্ণের রাজত্বকালে দন্তধাতুটির শ্রীলঙ্কায় আগমনের বর্ণনা রয়েছে। দন্তধাতুটিকে অত্যন্ত ভক্তির সঙ্গে রাজপ্রাসাদে এনে সিংহাসনের উপর স্থাপন করা হয়। তারপর রাজা নয় লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে দন্তধাতুটির জন্য একটি মন্দির নির্মাণ করেন। শ্রীকীর্তি শ্রীমেঘবর্ণের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরসূরীরা যেমন বুদ্ধদাস দন্তধাতুটিকে কেবল পূজা করেননি, রক্ষাও করেছিলেন।

পবংস:

খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকে পালি ভাষায় নৃপবংশ বা 'স্তূপের ইতিহাস' রচিত হয়। এই গ্রন্থে সেই স্তুপগুলির বিবরণ রয়েছে যেগুলি শ্রীলঙ্কার রাজা দুট্টগামনীর রাজত্বকালে ভারতবর্ষ শ্রীলঙ্কায় নির্মিত হয়েছিল। এই গ্রন্থে দুঠগামনীর রাজত্বকাল সম্পর্কে জানা যায় যিনি শ্রীলঙ্কার অনুরাধাপুরে মহাস্তুপে নির্মাণ করেছিলেন। গ্রন্থটির শেষ পৃষ্ঠায় এটিকে 'থুপবরস বংস' বা 'মহাস্তূপের ইতিহাস' রূপে উল্লেখ করা হয়েছে।

ইতিবৃত্তটির শেষ পৃষ্ঠা থেকে জানা যায় যে এটি থের বচ্চিসর তৃতীয় বিজয়বাবু দ্বিতীয় পরাক্রমবাহুর রাজত্বকালে রচনা করেছিলেন। লেখক ইতিবৃত্তটির শেষ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন যে রাজা পরাক্রমবাহু তাঁর আত্মীয় ছিলেন এবং তিনি তাঁকে রাজকীয় গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিকের পদে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন সুপরিচিত পণ্ডিত এবং ত্রিপিটকে পারদর্শী।

G.P. Malalasekhera এই লেখককে কনিষ্ঠ বচিস্সর রূপে সনাক্ত করেছেন যিনি সারিপুত্তের একজন শিষ্য ছিলেন। চুলবংশ থেকে জানা যায় যে যিনি দ্বিতীয় পরাক্কমবাহুর পিতা তৃতীয় বিজয়বাহুর রাজত্বকালে বর্তমান ছিলেন তার নিজের সময়ের একজন প্রধান থের ছিলেন এবং সংঘের একজন গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী ছিলেন। তিনি শ্রীলঙ্কার সেই সমস্ত থেরদের নেতা ছিলেন যাঁরা চোল পাণ্ড্য রাজ্যে বুদ্ধের দন্তধাতু ভিক্ষা পাত্রের সন্ধানে গিয়েছিলেন সেগুলিকে নিয়ে আসার উদ্দেশ্য নিয়ে। শ্রীলঙ্কার ইতিবৃত্ত রাজরত্নাকর একটি সিংহলীয় ভাষায় রচিত ইতিবৃত্ত। এটি বলিগামপায়ার থের দ্বারা রচিত এবং এখানে তৃতীয় বচ্চিসর নামে একজনের উল্লেখ রয়েছে যিনি G.P. Malalasekhra- মতে থুপবংসের রচয়িতা বচ্চিসর ছিলেন।

থুপবংসের পাঠ্য অংশটিকে তিনটি প্রধান অধ্যায়ে বিভক্ত করা যেতে পারে যদিও এতে ষোলটি অধ্যায় রয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে বুদ্ধের পূর্ববর্তী জন্মগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এতে পূর্ববর্তী বুদ্ধগানের সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। এখানে রচয়িতা পালি ভাষায় থুপবংস রচনার যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন যেখানে একই গ্রন্থের দুটি পৃথক সংস্করণ রয়েছে। একটি সিংহলীয় ভাষায় অপরটি মাগধী ভাষায়। তাঁর মতে সিংহলীয় সংস্করণটি সকলের মঙ্গল করার পক্ষে একেবারেই উপযুক্ত নয়, এবং মগধী সংস্করণটি পরস্পরবিরোধী শব্দে পরিপূর্ণ এবং এটি সম্পূর্ণ নয়। তারপর তিনি স্তুপ শব্দটির অর্থ লিখেছেন। তিনি বলেন যে চারপ্রকার মানুষ রয়েছেন যাঁরা স্তুপ নির্মাণের যোগ্য। তাঁরা হলেন বুদ্ধ, প্রত্যেক বুদ্ধ, বুদ্ধের শ্রাবক রাজ চক্রবর্তী। একটি স্তুপ হল একটি চৈত্য এবং উপরোক্ত চারপ্রকার মানুষের যে কোন একজনের ধাতু এর মধ্যে রক্ষিত থাকে। গৌতম বুদ্ধের অস্থি কাঞ্চনমল্লিকা মহাস্তুপে রক্ষিত হয়েছিল। তিনি ত্রিশটি পারমিতা পূর্ণ করেছিলেন, পরম জ্ঞান অর্জন করেছিলেন বিভিন্ন কুশল কর্ম করেছিলেন এবং অনুপাধিশেষ নির্বাণ লাভ করেছিলেন।

তারপর লেখক সেই সমস্ত বুদ্ধগানে কথা উল্লেখ করেছেন যাঁরা গৌতম বুদ্ধের পূর্ববর্তী ছিলেন এবং সেই সমস্ত স্তুপগুলির বর্ণনা দিয়েছেন যেগুলি তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল। সুমেধ তাপস যিনি পঁচিশজন বুদ্ধের যুগে বহুবার বোধিসত্ত্বরূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই পৃথিবীতে মানুষের মঙ্গলের জন্য আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং যিনি স্বয়ং ২৫ তম বুদ্ধ গৌতম বুদ্ধ নামে পরিচিত হয়েছিলেন। তিনি বুদ্ধ দীপঙ্করের সময়ে অমরাবতী নগরীতে বাস করতেন। তিনি ব্রাহ্মণ্যকল্প কাহিনীতে পারদর্শী ছিলেন। বাল্যকালে তাঁর পিতামাতা মারা যান। তিনি তাঁর সম্পদ দরিদ্রদের দান করে সংসার ত্যাগ করেন এবং হিমবন্ত প্রদেশে চলে যান। একদা বুদ্ধ দীপঙ্কর কাম্মানগরে আসেন। সুমেধ সেটি জানতে পেরে তাঁর সেবা করতে চান। তাঁকে একটি কর্দমাক্ত রাস্তা পরিষ্কার করতে বলা হয়। তিনি সে কাজ করার পূর্বেই বুদ্ধ তাঁর অনুগামীদের নিয়ে সেখানে পৌঁছান। সুমেধ তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে পথের উপর শুয়ে পড়েন এবং তাঁরা তাঁর উপর দিয়ে হেঁটে রাস্তা পার হন। তখন দীপঙ্করবুদ্ধ তাঁকে বলেন যে ভবিষ্যতে তিনি বুদ্ধ হয়ে গৌতম বুদ্ধ নামে পরিচিত হবেন। তারপর দীপঙ্কর বুদ্ধ তাঁর নিমন্ত্রণ স্থানে গিয়ে তাঁর ভোজন গ্রহণ করেন। তিনি নন্দরামে অনুপাধিশেষ নির্বাণ লাভ করেন এবং তাঁর স্মৃতিতে একটি স্তুপ নির্মিত হয়। বোধিসত্ত্ব কোণ্ডঞঞের সময়ে বিজিতাভি রূপে জন্মগ্রহণ করেন। বিজিতাভি একজন মহান শাসক ছিলেন। তিনি বৌদ্ধ সংঘের মঙ্গলের জন্য উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। তখন বুদ্ধ কোণ্ডিন্য ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে বিজিতাভি একদিন গৌতম বুদ্ধ হবেন। তিনি বুদ্ধের ধর্মদেশনা শুনে সংসার ত্যাগ করেন। তারপর তিনি অনেক কুশলকর্ম করে ব্রহ্মলোকে জন্মগ্রহণ করেন। বুদ্ধ কোণ্ডঞ চন্দ্রমাতে পরিনির্বাণ লাভ করে এবং মানুষ তার উপর একটি চৈত্য নির্মাণ করে। বোধিসত্ত্ব বুদ্ধ মঙ্গলের সময় সুরুচি নামে একজন ব্রাহ্মণরূপে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বুদ্ধকে তাঁর গৃহে নিমন্ত্রণ করে সাতদিন ধরে তাঁর ধর্মোপদেশ শোনেন। তখন বুদ্ধ মঙ্গল ভবিষ্যদ্বাণী করলেন যে একদিন তিনি গৌতম বুদ্ধ হবেন। যখন বোধিসত্ত্ব একথা শুনলেন তখন তিনি পার্থিব জীবন ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে গেলেন। বুদ্ধ মঙ্গল পরিনির্বাণ লাভ করলে মানুষ একটি বিশাল চৈত্য নির্মাণ করল। বুদ্ধ সুমনের সময়ে বোধিসত্ত্ব একজন নাগরাজ হয়ে জন্মগ্রহণ করলেন। নাগরাজের নাম ছিল অতুল। তাঁর নিমন্ত্রণে বুদ্ধ তাঁর শিষ্যগণ তাঁর গৃহে এলে তিনি তাঁদের ভোজন দান করেন। তখন বুদ্ধ ভবিষ্যদ্বাণী করলেন যে নাগরাজ একদিন বুদ্ধ হবেন। যথাসময়ে বুদ্ধ পরিনির্বাণ লাভ করলেন এবং মানুষ তাঁর স্মৃতিতে একটি স্তুপ নির্মাণ করল। বুদ্ধ রেবতের সময়ে বোধিসত্ত্ব একজন ব্রাহ্মণ রূপে জন্মগ্রহণ করলেন যাঁর নাম ছিল অতিদেব। বুদ্ধের ধম্মোপদেশ শুনে তিনি নিজেকে শীলে স্থাপন করলেন। তখন বুদ্ধ ঘোষণা করলেন যে অতিদেব ভবিষ্যতে বুদ্ধ হবেন। বোধিসত্ত্ব বুদ্ধ শোভিতের সময়ে অজিত নামে একজন ব্রাহ্মণরূপে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বুদ্ধের ধর্মপ্রচার শুনে নিজেকে শীলে স্থাপন করেন। তখন বুদ্ধ ঘোষণা করলেন যে তিনি ভবিষ্যতে বুদ্ধ হবেন। বোধিসত্ত্ব বুদ্ধ অনোমাদসির সময়ে একজন যজ্ঞসেনাপতি রূপে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ভিক্ষু সংঘকে দান করতেন যার প্রধান ছিলেন বুদ্ধ। তারপর বুদ্ধ ঘোষণা করলেন যে বোধিসত্ত্ব ভবিষ্যতে গৌতম বুদ্ধ হবেন। বুদ্ধ পদুমের সময়ে বোধিসত্ত্ব একটি সিংহ রূপে জন্মগ্রহণ করলেন। সিংহটি বুদ্ধকে নিরোধ সমাপত্তি অবস্থায় দেখে সাতদিন পিণ্ডাচরণের সন্ধানে বের হয়নি। বুদ্ধ ঘোষণা করলেন যে সিংহটি ভবিষ্যতে বুদ্ধ হবে। বোধিসত্ত্ব বুদ্ধ নারদের সময়ে এই পৃথিবী ত্যাগ করেন এবং তিনি বুদ্ধ তাঁর অনুগামীদের ভোজন গ্রহণের জন্য নিমন্ত্রণ জানান। বুদ্ধ ভবিষ্যদ্বাণী করলেন যে তিনি গৌতম বুদ্ধ হবেন। বোধিসত্ত্ব পদুমত্তর বুদ্ধের সময়ে জটিল নামে একজন রাজারূপে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বুদ্ধ তাঁর অনুগামীদের উপহার দান করতেন। বুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন যে জটিল ভবিষ্যতে বুদ্ধ হবেন। বোধিসত্ত্ব বুদ্ধ সুমেধের সময়ে মানব নামে একজন ধনী ব্যক্তিরূপে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বুদ্ধের উপদেশ শুনে নিজেকে শরণে স্থাপন করেন। বুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন যে ভবিষ্যতে তিনি গৌতম বুদ্ধ হবেন। বোধিসত্ত্ব বুদ্ধ সুজাতের সময় একজন মহান রাজা রূপে জন্মগ্রহণ করেন। বুদ্ধের ধর্মোপদেশ শুনে তিনি তাঁর সমস্ত সম্পদ বুদ্ধ তাঁর সংঘকে দান করেন। তিনি সংসারজীবন ত্যাগ করেন। বুদ্ধ ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে তিনি গৌতম বুদ্ধ হবেন। বুদ্ধ পিয়দস্সির সময়ে বোধিসত্ত্ব কাশ্যপ নামে একজন যুবক ছিলেন। তিনি বুদ্ধের ধর্মোপদেশ শুনে তাঁর সমস্ত সম্পদ দান করে দেন। তিনি নিজেকে শীল শরণে স্থাপন করেন। বোধিসত্ত্ব বুদ্ধ অত্থদসির সময়ে সুসীম নামে একজন সন্ন্যাসীরূপে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বুদ্ধের ধর্মপ্রচার শুনে তাঁকে পূজা করতেন। বুদ্ধ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে তিনি গৌতম বুদ্ধ হবেন। বুদ্ধ ধম্মদস্সির সময়ে বোধিসত্ত্ব দেবরাজ শক্করূপে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বুদ্ধকে পূজা করতেন। বুদ্ধ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে তিনি বুদ্ধ হবেন। বুদ্ধ সিদ্ধার্থের সময়ে বোধিসত্ত্ব মঙ্গল নামে একজন সন্ন্যাসীরূপে জন্মগ্রহণ করেন। একদিন তিনি বুদ্ধকে জম্বু ফলদান করেন। বুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি ভবিষ্যতে গৌতম বুদ্ধ হবেন। বুদ্ধ তিস্সের সময়ে বোধিসত্ত্ব একজন যশস্বী ক্ষত্রিয়রূপে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সংসার জীবন ত্যাগ করে বুদ্ধকে পূজা করতেন। বুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি ভবিষ্যতে বুদ্ধ হবেন। বুদ্ধ ফুস্পের সময়ে বোধিসত্ত্ব একজন ক্ষত্রিয় রাজারূপে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নাম ছিল বিজিতাভি। তিনি সংসার জীবন ত্যাগ করেন। তিনি ত্রিপিটকে পারদর্শী ছিলেন। বুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি ভবিষ্যতে বুদ্ধ হবেন। বোধিসত্ত্ব বুদ্ধ বিপসীর সময়ে অতুল নামে এক শক্তিশালী নাগরাজ রূপে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সাতপ্রকার রত্ন সহ একটি স্বর্ণসিংহাসন বুদ্ধকে উপহার দেন। বুদ্ধ ভবিষ্যদ্বাণী করেন অতুল বুদ্ধ হবেন। শিখি বুদ্ধের সময়ে বোধিসত্ত্ব অরিন্দম নামে এক রাজারূপে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বুদ্ধ সংঘকে উপহার দিতেন। বুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি ভবিষ্যতে বুদ্ধ হবেন। বোধিসত্ত্ব বুদ্ধ বেসর সময়ে সুদস্পন নামে এক রাজারূপে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বুদ্ধ সংঘকে উপহার দান করেছিলেন। বোধিসত্ত্ব বুদ্ধ ককুসন্ধের সময়ে রাজা ক্ষেম রূপে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বুদ্ধ ভিক্ষু সংঘকে দান করতেন। তিনি বুদ্ধের উপদেশ শুনে সংসারজীবন ত্যাগ করেছিলেন। বুদ্ধ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে তিনি বুদ্ধ হবেন। বোধিসত্ত্ব বুদ্ধ কোনাগমননের সময়ে একজন রাজারূপে জন্মগ্রহণ করেন। সেই রাজার নাম ছিল পব্বত। তিনি বুদ্ধের ধর্মপ্রচার শোনেন। তিনি বুদ্ধ ভিক্ষু সংঘকে দান করতেন। বুদ্ধ তাঁকে দীক্ষাদান করেন এবং ঘোষণা করেন যে তিনি ভবিষ্যতে বুদ্ধ হবেন। বোধিসত্ত্ব বুদ্ধ কাশ্যপের সময়ে জ্যোতিপাল নামে একজন বোধিসত্ত্বরূপে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বেদে বিশারদ ছিলেন। তিনি বুদ্ধের ধর্মপ্রচার শুনে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে তিনটি পিটকে জ্ঞানলাভ করেন। বুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি বুদ্ধ হবেন।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে গৌতম বুদ্ধের জন্মগ্রহণ থেকে পরিনির্বাণ লাভ, দ্রোণ নামে এক ব্রাহ্মণ দ্বারা বুদ্ধের অস্থি বিতরণ, অজাত শত্রুর রাজগৃহে বুদ্ধের ধাতুর উপর একটি মহাস্তুপ নির্মাণ, মৌর্য সম্রাট অশোকের দ্বারা বুদ্ধের ধাতুর উপর ৮৪ হাজার স্তুপ নির্মাণ। গৌতম বুদ্ধ রাজা বেসান্তররূপে জন্মগ্রহণ করে পারমিতা সম্পাদন করেন। তিনি তুষিত স্বর্গে জন্মগ্রহণ করেন। সেখান থেকে তিনি শাক্যবংশে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানে তিনি বিলাসের মধ্যে বেড়ে ওঠেন। তিনি একজন বৃদ্ধ মানুষ, একজন অসুস্থ মানুষ, একজন মৃত মানুষ একজন সন্ন্যাসীকে দেখতে পান। এরপর তিনি সংসার ত্যাগ করেন। প্রথমে তিনি অলভ উদ্দকের কাছে যান কিন্তু তিনি তাঁদের উপদেশে সন্তুষ্ট হননি। তিনি নৈরঞ্জনা নদীর তীরে বোধিবৃক্ষের তলায় ধ্যানে বসে তিনি বোধিজ্ঞান লাভ করেন। তিনি তাঁর ধর্মকে প্রথম প্রচার করেন বেনারসে পঞ্চবণীয় ভিক্ষুর কাছে। তিনি কুশিনারায় পরিনির্বাণ লাভ করেন। পাবা থেকে কুশিনারায় মহাকাশ্যপ তাঁর অনুগামীরা আসার পর তাঁর শবাধারে আগুন ধরানো হয়। ব্রাহ্মণ দ্রোণ তাঁর অস্থিগুলিকে বিতরণ করেন। কুশিনারার মল্লগণ, মগধের রাজা অজাতশত্রু, বৈশালীর লিচ্ছবিগণ, কপিলবাস্তুর শাক্য শাসকগণ, অল্পকল্পের বুলি রামগামের কোলিয়, বেঠদীপকের ব্রাহ্মণ এবং পাবার মল্লরাও তাঁদের অংশ লাভ করলেন। ধাতুগুলি বিতরণ করার পর দ্রোণ বুদ্ধের দাঁতটি নিজের জন্য রাখলেন। তিনি এই বিষয়ে কাউকে কিছু বললেন না। কিন্তু দেবতাদের রাজা সক্ক বা শত্রু সেটিকে চুরি করে স্বর্গে নিয়ে আনলেন। ধাতুগুলি বিতরণ করার পর দ্রোণ আর দাঁতটিকে খুঁজে পেলেন না। তাই তিনি পাত্রটি নিলেন কারণ সবকটি অস্থি সেখানেই রক্ষিত ছিল। পিপ্পলীবনের মৌর্যরা সময়মত আসেনি। তারা কেবল ভস্ম পেল। রাজগৃহ, বৈশালী, কপিলবাস্তু, অল্পকল্প, রামগাম, বেঠদীপ, পাবা কুশিনারায় বুদ্ধের ধাতুর উপর মহাস্তুপ নির্মিত হল। নাগরা সেই ধাতুগুলি নিল যেগুলি রামগামে রাখা ছিল এবং তারা সেগুলিকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা যত্নের সঙ্গে রেখে দিল। কিছু সময় পর এই ধাতুগুলিকে রামগাম থেকে শ্রীলঙ্কায় নিয়ে আসা হয়েছিল। থের মহাকাশ্যপের অনুরোধে বুদ্ধের ধাতুগুলিকে রাজা অজাতশত্রু একত্রিত করে রাজগৃহের একটি স্তুপের নীচে রাখলেন। তিনি রাজগৃহের ধাতুগুলিকেও তার মধ্যে রেখেছিলেন কথিত আছে, অশোক বুদ্ধের ধাতুর উপর ৮৪০০০ স্তুপ নির্মাণ করেছিলেন।

তৃতীয় শেষ অধ্যায়ে ধাতুগুলির পরবর্তী ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য অশোকের বিভিন্ন দেশে ভিক্ষুদের প্রেরণ এবং শ্রীলঙ্কায় মহিন্দ সংঘমিত্রার আগমনের কাহিনী আলোচনা করা হয়েছে। তারপর গ্রন্থটিতে শ্রীলঙ্কায় রাজা দুট্টগামনীর রাজত্ব কার্যকলাপ আলোচনা করা হয়েছে এবং অনুরাধাপুরে তাঁর মহাস্তুপ নির্মাণের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।

রাজা বিন্দুসারের ১০০টি পুত্র ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর উজ্জয়িনীর শাসনকর্তা অশোক তিস্যকুমার ছাড়া তাঁর অন্যান্য সমস্ত ভাইকে হত্যা করে সিংহাসন অধিকার করেন। চার বছর পর অশোকের রাজ্যাভিষেক হয়। প্রথমে তিনি বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন না কিন্তু নিগ্রোধ শ্রমণের প্রভাবে তিনি বৌদ্ধধর্মের অনুগামী হয়ে ওঠেন। প্রথমোক্তজন ধম্মপদে অল্পমাদবগ্ন নামে একটি উপদেশ দিয়েছেন। রাজা তাঁর অনুগামীরা এটিকে শুনে নিজেদের পঞ্চশীল ত্রিশরণে প্রতিষ্ঠিত করেন। রাজা ৮৪ হাজার বিহার ৮৪ হাজার নগর নির্মাণ করেন। তিনি এই ৮৪ হাজার বিহারে সেই সমস্ত অস্থিগুলিকে রাখেন সেগুলিকে রাজা অজাতশত্রু রাজগৃহের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে একটি মহাস্তুপের নীচে রেখেছিলেন। তাঁর পুত্র মহিন্দ কন্যা সংঘমিত্রা বৌদ্ধ সংঘে যোগদান করেছিলেন। মোগলিপুত্ত তিস্স Majjhantika Thera কে কাশ্মীর গান্ধারে, মহারেবত থেরকে মহিশাসক মণ্ডলে রক্ষিত থেরকে বনবাসীতে যোনধম্মরক্ষিত থেরকে অপরান্তকে। মহাধম্মরক্ষিত থেরকে মহারঠে, মহারক্ষিত থেরকে যোন লোকে মঝিমথেরকে হিমবন্তদেশে, শোন উত্তীয়কে সুবগ্নভূমিতে, মহিন্দ উত্তীয়, ইন্ডীয় ভদ্দশালকে তম্বপানিদ্বীপে পাঠিয়েছিলেন বৌদ্ধধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। মহিন্দ শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিলেন রাজা দেবানামপিয় তিস্সের রাজত্বকালে। দেবানামপিয় তিস অশোকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তিনি তাঁর প্রজারা মহিন্দের অধীনে বুদ্ধের অনুগামীতে পরিণত হন। রাজা তাঁর ৫০০ জন রাণী মহিন্দের ধর্মপ্রচার শোনেন যিনি পেতবন্ধু, বিমানবন্ধু সচ্চসংহিতা ব্যাখ্যা করেছিলেন। তারপর তাঁরা নিজেদের শ্রোতাপন্ন অবস্থায় স্থাপন করেন। মহিন্দের কাছ থেকে দেবদূত সুত্ত শুনে অনেক মানুষ নিজেদের স্রোতাপন্ন অবস্থায় স্থাপন করতে সক্ষম হন। দেবানামপিয় তিস্স মহিন্দর অনুরোধে আশোকবুদ্ধের ধাতু ভিক্ষাপাত্রটি শ্রীলঙ্কায় পাঠান। এমনকি তিনি দেবানামপিয়তিস্পকে শক্কের কাছ থেকে পাওয়া বুদ্ধের ডান চোখটি পাঠান। দেবানামপিয়তিস সেটিকে স্থাপন করে তার উপর একটি মহাবিহার প্রতিষ্ঠা করেন। সংঘমিত্রা বোধিবৃক্ষের একটি শাখা নিয়ে শ্রীলঙ্কায় গিয়ে অনুলাদেবীকে প্রব্রজ্যা দান করেন থাকে দেবানামপিয় তিস্পের ভ্রাতৃবধূরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। শাখাটিকে অনুরাধাপুরে রোপণ করা হয়। সংঘমিত্রা পাঁচশ মহিলাকে প্রব্রজ্যদান করেন যাঁরা অর্হত্ব লাভ করেছিলেন। রাজা দেবানামপিয়তিস তাঁর বাদ্যে একযোজন ব্যবধানে স্তুপ নির্মাণ করেছিলেন। দেবানামপিয় তিসের মৃত্যুর পর উত্তীয়। মহাশিব মুরতিস পরপর রাজা
হন। কিন্তু দমিলরা সুরতিস্পকে পরাজিত করে সিংহাসন অধিকার করে। মুঠাশিবের পুত্র অমেলা দমিলদের পরাজিত করেন। কিন্তু চোলদেশ থাকা আসা ইলার অসেলাকে পরাজিত করেন। তারপর তিনি শ্রীলঙ্কার সিংহাসন অধিকার করেন। কিন্তু দুট্টগামনী ইলারকে পরাজিত নিহত করেন। কাকবন্নতিসের পুত্রেরা ছিলেন গামনী অভয় তিস্স। গামনী অভয় পরিচিত হন ছত্তগামনী নামে। তিনি দমিলদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তাঁর পিতা তা পছন্দ করতেন না। তাঁর পিতার মৃত্যুর পর দুট্টগামনী মহাগামের রাজা হয়ে দমিলদের দ্বীপ থেকে বিতাড়িত করলেন। তিনি দমিলদের পরাজিত করে মহিয়াঙ্গনে কম্বুতক স্তুপ নির্মাণ করলেন। বুদ্ধ তাঁর মৃত্যুর পর শ্রীলঙ্কায় গিয়ে মহিয়াঙ্গন ভ্রমণ করেছিলেন। বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর সারিপুত্তের শিষ্য সযভু বুদ্ধের কণ্ঠাস্থি শ্রীলঙ্কায় নিয়ে আসেন এবং সেই একই চৈত্যে রাখেন যেটির উচ্চতা ছিল ১২ কিউবিট। দেবানামপিয় তিসের ভাই ছিলেন চুলাভয়। তিনি এটিকে ৩০ ফুট উচ্চতায় করলেন। দমিলদের পরাজিত করে দুঠগামনী চৈত্যটির উচ্চতা বাড়িয়ে ৮০ ফুট করলেন। তিনি ৩২ জন দমিল শাসককে পরাজিত নিহত করে শ্রীলঙ্কার সিংহাসন অধিকার করেন। তিনি বৌদ্ধধর্মের বিকাশে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। তিনি মরিচবর্তী বিহার নির্মাণ করে সেটিকে বৌদ্ধসংঘকে দান করেন। তিনি সোভনমল্লি নামে মহাস্তুপটি নির্মাণ করেন যেটি একশ কুড়ি ফুট উচ্চ ছিল। এছাড়াও তিনি উপোসথাগার লৌহপাসাদও নির্মাণ করেন। সেটি নয় তলা উচ্চ ছিল। তিনি একটি মহাস্তুপ নির্মাণ করেন। তিনি বৈশাখী পূর্ণিমার দিন সেটি নির্মাণ শুরু করেন। মহাস্তুপের ভিত্তি প্রস্তুর স্থাপনের এমন অনেক ভিক্ষু উপস্থিত ছিলেন যারা জম্বুদ্বীপ থেকে এসেছিলেন। এটির ধাতুকক্ষে দুট্টগামনী রত্নখচিত একটি বোধিবৃক্ষ স্থাপন করেছিলেন। এর উপর একটি সুন্দর চাঁদোয়া রাখা হয়। রামগামের কোলিয়রা ব্রাহ্মণদ্রোণের কাছ থেকে বুদ্ধের একটি ধাতু লাভ করেছিলেন। এটিকে নাগা রাজত্বে আনা হয়। সেখান থেকে এটিকে শ্রীলঙ্কায় এনে মহাস্তুপে স্থাপন করা হয়। ইতিমধ্যে দুট্টগামনী অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি তখন দীঘবাপিতে অবস্থানরত তাঁর ভাই তিস্পকে মহাস্তুপের নির্মাণ কার্য তত্ত্বাবধান করে সমাপ্ত করতে অনুরোধ জানান। কখনও কখনও দুট্টগামনী পালকি করে সেখানে এসে তাঁর প্রার্থনা নিবেদন করে যেতেন। তিনি নিরানব্বইটি বিহার নির্মাণ করেন এবং মৃত্যুর পর তুষিত স্বর্গে আরোহণ করেন। হখবনগল্পবিহার বংস:

খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকের মধ্যভাগে দ্বিতীয় পরাক্কমবাহুর রাজত্বকালে হখবনগল্পবিহারবংশ গ্রন্থটি সবল পালি ভাষায় রচিত হয়। এই গ্রন্থে শ্রী সংঘবোধির জীবন কর্ম এবং হখবনগল্প বিহারের ইতিহাস বা শ্রীলঙ্কার পশ্চিম প্রদেশে অবস্থিত অঠন গল্লার প্রাচীন মন্দিরের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে। এটি মূলত পদ্যে রচিত, তবে এখানে গদ্যও ব্যবহৃত হয়েছে। এটি একটি পালি কাব্য যেখানে সংস্কৃতের শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। এই গ্রন্থে রচয়িতা যথেষ্ট সাহিত্যিক দক্ষতা দেখিয়েছেন। এই গ্রন্থে এগারটি অধ্যায় রয়েছে। প্রথম আটটি অধ্যায় থেকে আমরা রাজা শ্রীসংঘবোধির একটি বিবরণ পাই এবং অবশিষ্ট তিনটি অধ্যায়ে সেই স্থানে বিভিন্ন সৌধ ধর্মীয় ইমারতের নির্মাণ বর্ণনা করা হয়েছে যেখানে রাজা তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলি কাটিয়েছিলেন। গ্রন্থটির রচয়িতার নাম জানা যায় না, এটি গ্রন্থে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু শিরোনাম গাথায় রচয়িতা উল্লেখ করেছেন যে তাঁর শিক্ষক অনোমাদসি মহাস্বামী তাঁকে হথবনগল্পবিহারের একটি ইতিহাস রচনা করতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন এবং তিনি রাজা দ্বিতীয় পরাক্কমবাহুর রাজত্বকালে তা করেছিলেন। দৈবনাকামধেনু নামক একটি জ্যোতিষ গ্রন্থের রচয়িতা অনোমাদসি রাজা দ্বিতীয় পরাক্কমবাহুর রাজত্বকালে বর্তমান ছিলেন। C. E. Godakumlbura বলেন তিনি একটি সিংহলীয় ব্যাকরণ সিদ্ধান্ত সংগ্রহেরও রচয়িতা ছিলেন। তাঁকে সব্বয়িত্রীরাজ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। চুলবংশে তাঁকে মহাস্বামী নামে উল্লেখ করা হয়েছে। সম্ভবতঃ তিনি Hatthavanagallavihara Vamsa রচয়িতার শিক্ষক ছিলেন। গোঠাভয় মেঘবর্ণ Hatthavanagallavihara নির্মাতা ছিলেন। রাজা দ্বিতীয় পরাক্কমবাহু তাঁর মন্ত্রী দেবপাত্ররাজার তত্ত্বাবধান বহু অর্থব্যয়ে অনোমাদস্পির মহাস্বামীর জন্য একটি তিনতলা ভবন নির্মাণ করেন। রাজা এই বিহারটিকে কেবল মেরামতই করেননি, আটকোণা একটি মূর্তি ভবন নির্মাণ করেছিলেন। সম্ভবতঃ এই অনোমাদসি ছিলেন সেই অনোমাদসিস যিনি তাঁর শিষ্যকে Hatthavanagallavihara গ্রন্থটি রচনা করতে বলেছিলেন। এই ইতিবৃত্তটি শেষ হয়েছে দ্বিতীয় পরাক্কমবাহুর রাজত্বকাল দিয়ে। এর থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে এটি তাঁর রাজত্বকালে রচিত হয়েছিল।

সিংহলীয় ইতিবৃত্ত পূজাবলীয় রচিত হয়েছিল রাজা দ্বিতীয় পরাক্কমবাহুর রাজত্বকালে। Amaradassa Liyanggamage- মতে এই গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল ১২৬৬ সালে। এতে Hatthavanagallavihara এর দুটি স্তবকের উল্লেখ রয়েছে। এই প্রমাণের উপর ভিত্তি করে C. E. Godakumlbura এবং Amaradassa Liyanggamage মনে করে যে Hatthavanagallavihara Vamsa রচিত হয়েছিল ১২৬৬ খ্রীস্টাব্দের পূর্বে। এই ইতিবৃত্তটি দ্বিতীয় পরাক্কমবাহুর রাজত্বকালের বর্ণনা দিতে গিয়ে চন্দ্রভানুর দ্বারা শ্রীলঙ্কার আক্রমণের কথা উল্লেখ করেছে। চন্দ্রভানু দুবার শ্রীলঙ্কা আক্রমণ করেছিল, প্রথমটি ১২৪৭ খ্রীষ্টাব্দে দ্বিতীয়টি ১২৬১-১২৬২ খ্রীষ্টাব্দে। কিন্তু লেখক আমাদের জানাননি তিনি কোন আক্রমণের কথা বলছেন। তবে গ্রন্থটি থেকে জানা যায় যে চন্দ্রভানু যুদ্ধে মারা গিয়েছিলেন। এর থেকে অনুমান করা যায় যে লেখক দ্বিতীয় অভিযানের কথা বলেছেন। এই প্রমাণ থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে Hatthavanagallavihara Vamsa গ্রন্থটি ১২৬১-৬২ থেকে ১২৬৬ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে রচিত হয়েছিল। প্রথম তারিখটিকে যদি আরও পিছিয়েও নেওয়া হয় তাহলেও একথা নিরাপদ বলা যায় যে গ্রন্থটি ১২৪৭ থেকে ১২৬৬ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে রচিত হয়েছিল।

Hatthavanagallavihara নামে একটি বিহারের বিবরণ দেওয়া হয়েছে যেটি অষ্ঠানগাল্লাতে নির্মিত হয়েছিল। এটি শ্রীলঙ্কার পশ্চিম প্রদেশে অবস্থিত ছিল। ঐতিহ্য অনুসারে এই বিহারটি নির্মিত হয়েছিল সেই স্থানে যেখানে অনুরাধাপুরের ভূতপূর্ব রাজা শ্রীসংঘবোধি একজন দরিদ্র মানুষকে তাঁর মস্তকটি দান করেছিলেন। Hatthavanagallavihara Vamsa তার আটটি অধ্যায়ে শ্রীসংঘবোধির জীবনী বর্ণনা করেছে। অবশিষ্ট তিনটি অধ্যায়ে এই বিহার এবং সেখানে শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন রাজার দান পুণ্যকর্মের কথা বলা হয়েছে। ইতিবৃত্ত থেকে জানা যায় যে সিংহাসন ত্যাগ করার পর রাজা শ্রীসংঘবোধি ধ্যানে জীবনে অতিবাহিত করার জন্য জঙ্গলে যান। সেখানে তিনি একজন দরিদ্র মানুষকে তাঁর মস্তকদান করেন কারণ সিংহাসনের ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী গোঠাভয় তার মস্তক এনে দিতে পারলে পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন। ধার্মিক রাজা চেয়েছিলেন যে দরিদ্র মানুষটি গোঠাভয়ের কাছ থেকে তাঁর মস্তক মূল্য পান। সেই কারণে তিনি অপরের মঙ্গলের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয় যে বিহারটি ছিল সেই স্থান যেখানে সেই ধার্মিক রাজার অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু মহাবংশ টীকার প্রামাণিকতার উপর ভিত্তি করে বলা যায় যে অন্ত্যোষ্টিক্রিয়াটি পশ্চিমের প্রদেশে অফ্টনগাল্লাতে নয় অনুষ্ঠিত হয়েছিল অনুরাধাপুরের Issarasamana বিহারের দক্ষিণদিকে। Hatthavanagallavihar Vamsa থেকে শ্রীসংঘবোধির পারিবারিক ইতিহাস জানা যায়। এখানে বলা হয়েছে যে রাজা সিংহাসন ত্যাগ করলে তাঁর স্ত্রী তাঁকে অনুসরণ করার জন্য কেবল রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করেননি, প্রাসাদের কাছে সেই স্থানে দুঃখে মারা গিয়েছিলেন যেখানে রাজা তাঁর মস্তকটি দান করেছিলেন। শ্রীসংঘবোধির জীবনের উপর আলোকপাত করা ছাড়াও মধ্যযুগের শ্রীলঙ্কার কিছু সামাজিক বৈশিষ্ট্যের উপরও আলোকপাত করে। এটি তৃতীয় বিজয়বাহু দ্বিতীয় পরাক্কমবাহুর রাজত্বকাল সম্পর্কেও আমাদের তথ্য সরবরাহ করে। "যেহেতু এই গ্রন্থটি পূজাবলীয়র পূর্বে রচিত হয়েছিল তাই একথা বলা যায় যে এটি দ্বিতীয় পরাকম্মবাহুর রাজত্বকালের সর্বপ্রাচীন তারিখযুক্ত বিবরণী। অতএব, যদিও এর বিবরণ পূজাবলীয়র মত অতটা বিস্তৃত নয়, তা সত্বেও এটির যথেষ্ট মূল্য রয়েছে।

তৃতীয় বিজয়বাহুর রাজত্বকালের বর্ণনার পূর্বে একাদশ অধ্যায়ের প্রারম্ভিক অংশগুলিতে সেই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। যেটি মঘ আক্রমণের পূর্বে বর্তমান ছিল। এই গ্রন্থটি থেকে জানা যায় যে বিজয়বাহুর পিতার নাম ছিল বিজয়মাল্য এবং এই তথ্যটি অন্য কোন সূত্র থেকে পাওয়া যায় না। বিজয়বাহুর দ্বারা রাজপ্রাসাদ হিসেবে দম্বদেনিয় নির্মাণ, দন্তধাতু ভিক্ষা পাত্রটির পুনরুদ্ধার এবং বেলিগালাতে দন্ত ধাতুটির মন্দির নির্মাণ ছাড়াও সাধারণভাবে বৌদ্ধধর্মের প্রতি এবং বিশেষভাবে Hatthavanagallavihara Vamsa-এর প্রতি তাঁর অবদান উল্লেখিত রয়েছে।

নলাটধাতু বংস বা ললাটধাতু বংশ:

পালি নলাটধাতুবংস বা ললাট ধাতুবংশ বা সহজ কথায় ললাটবংশে বুদ্ধের কপালের ধাতুর ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। এটিতে পাঁচটি অধ্যায় রয়েছে। G.P. Malalasekhera বলেন, "নিঃসন্দেহে এটি অত্যন্ত প্রাচীন একটি গ্রন্থ এবং এটি রোহন মালয়ের ঋষি কিংবদন্তীদের চক্রের অন্তর্গত। এখানে দুট্টগামনীর পিতা কাকবন্নতিস্কের পরিবার সমসাময়িকদের কেন্দ্র করে রচিত এমন অনেক জনপ্রিয় ঐতিহ্য রয়েছে যা অন্যত্র পাওয়া যায় না। এতে গৌতম বুদ্ধের জীবন বোধিজ্ঞান লাভ, শ্রীলঙ্কায় তাঁর তিনটি আগমন মহাপরিনির্বাণ এবং দেহধাতুর বিতরণের বর্ণনা রয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে বুদ্ধের ললাট ধাতু সেই মল্লদের বর্ণনা রয়েছে যারা বুদ্ধের ধাতু বিতরণের সময়ে ললাটধাতুটি লাভ করেছিলেন। তারপর এতে এটির মহাগামের মহানাগের সময়ে শ্রীলঙ্কায় আগমন বর্ণনা করা হয়েছে যিনি এটিকে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন। এটি দীর্ঘ সময় রোহনের রাজকুমারদের হাতে ছিল। তাঁরা এটির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন। শেষ দুটি অধ্যায়ে কাকবর্ণ তিসের পরিবারের কাহিনী এই পবিত্র ধাতুটির স্বাগত জানানোর জন্য সেরুভিল্লাতে একটি বিশেষ দাগোবা নির্মাণের ইতিহাস এবং ধাতুগুলির উৎসর্গীকরণ স্থাপন বর্ণনা করা হয়েছে। পণ্ডিতদের মতে রচয়িতা নিঃসন্দেহে এই দুটি অধ্যায়ের জন্য উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন। করেছিলেন জনপ্রিয় স্থানীয় ঐতিহ্য থেকে। এটি উল্লেখযোগ্য যে দাগোবা ইত্যাদির নির্মাণ সংক্রান্ত বর্ণনার ভিত্তি হল মহাবংশ এবং লেখক এটিকে হুবহু অনুসরণ করার চেষ্টা করেছেন। আমরা এটির রচয়িতার নাম জানি না। ইতিবৃত্তটিতে এটি রচনার তারিখও উল্লেখ করা হয়নি। G.P. Malalasekhera মনে করেন এটি দশম বা একাদশ শতকে রচিত হয়েছিল। তিনি বলেন, 'ললাটবংশ মহাবোধিবংশের মধ্যে রচানশৈলীর সাদৃশ্য থেকে আমার মনে হয় এই দুটি গ্রন্থই পালি সাহিত্যের একই পর্বে অর্থাৎ খ্রীষ্টীয় দশম বা একাদশ শতকে রচিত হয়েছিল।'

শাসনবংস দ্বীপ:

শাসনবংশ দ্বীপ শ্রীলঙ্কায় ১৮৮০ খ্রীষ্টাব্দে রচনা করেছিলেন আচার্য বিমলাসার থের। লেখক বলেন, এটি পালি কাব্যে রচিত এবং পবিত্র বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র। ভাষ্য ইতিহাস ইত্যাদি থেকে সংকলিত বৌদ্ধ গীর্জার একটি ইতিহাস। এখানে সর্বশেষ বুদ্ধের সুমেধ হিসেবে জন্মগ্রহণ বিবরণ, চব্বিশজন বুদ্ধের বিবরণের উল্লেখ এবং পরিনির্বাণের সময় পর্যন্ত তাঁর সর্বশেষ জীবনের ইতিহাস পাওয়া যায়। পঞ্চম থেকে অষ্টম অধ্যায়ে তিনটি বৌদ্ধ সঙ্গীতি এবং বিদেশে বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তন বিকাশের বিবরণ পাওয়া যায়। নবম দশম অধ্যায়ে শ্রীলঙ্কায় বুদ্ধের ধর্মের স্থাপন উন্নতির এবং পিটক তাদের ভাষ্য রচনার শুরুর বিবরণ পাওয়া যায়। একাদশ অধ্যায়ে সেই সমস্ত লেখকেরদের বিবরণ পাওয়া যায় যাঁরা বুদ্ধ ঘোষের সময় থেকে পণ্ডিত পরাক্কমবাহু (১২৪০ খ্রী-১২৭৫ খ্রীঃ) - রাজত্বকাল পর্যন্ত দ্বীপের সাহিত্যজগতে মূল্যবান অবদান রেখেছিলেন। যদিও এই অধ্যায়ে কালপঞ্জীকে অনুসরণ করা হয়নি এবং এর বিন্যাসটি ত্রুটিপূর্ণ তবু এটি গুরুত্বপূর্ণ অত্যন্ত মূল্যবান। কারণ এর থেকে আমরা শ্রীলঙ্কার সাহিত্যিক কর্মকাণ্ডের একটি বিবরণ পাই। সর্বশেষ অধ্যায়ে আমার শাসকের পুনঃ স্থাপনের জন্য বিভিন্ন সিংহলীয় শাসকের দ্বারা গৃহীত ব্যবস্থার বিবরণ পাই, যখন ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে এটির উন্নতি হয়নি। এমন অনেক শাসক ছিলেন যারা বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেননি বা এই ধর্মের যথেষ্ট যত্ন নেননি বা মনোযোগী হননি। দেশের রাজনৈতিক অবস্থাও বৌদ্ধধর্মের উন্নতির পক্ষে অনুকূল ছিল না। এতে শ্রীলঙ্কায় একটি মায়ানমারীয় সম্প্রদায়, অমরপুরা সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠার উল্লেখ রয়েছে।

পালি ইতিবৃত্ত ছাড়াও আরও ইতিবৃত্ত রয়েছে যেগুলি সিংহলীয় ভাষায় রচিত। এগুলি হল পূজাবলীয়, নিকায়সংগ্রহ, ধাতুবংশ, রাজাবলীয়, রাজা রক্তাকরায়, দালাদপিরিত, দালাদা পূজাবলীয় দম্বদেনী আসনা, কাণ্ডবরুস্রিতা সদ্ধর্ম রত্নকরায়।

-কেস-ধাতু বংস

''-কেস-ধাতু বংস' বা 'ছয়টি কেশ ধাতুর ইতিহাস রচনা করেছিলেন একজন আধুনিক লেখক গদ্যে পদ্যে। এতে কোন তারিখ নেই। এটিকে সম্পাদনা করেছেন সেন্ট পিটার্সবার্গের মিয়নায়েফ একটি এটি ১৮৮৫ সালের Journal of Pali Text Society তে প্রকাশিত হয়েছিল। এটি সম্পাদক উল্লেখ করেছেন। "এটি অজ্ঞাতনামা একজন ব্রহ্মদেশীয় লেখকের অজ্ঞাত তারিখের একটি রচনা এবং বর্তমান সংস্করণের জন্য আমি দুটি ব্যবহার করেছি। হল পালি ভাষায় রচিত একটি সংক্ষিপ্ত ঐতিহাসিক রচনা।

এই রচনাটিতে সাতটি পৃষ্ঠা রয়েছে That-dum হল অপর একটি প্রতিলিপি যেটিকে একই সংকলনের একটি পুরাতন সকল থেকে প্রতিলিপি করা হয়েছে। এটিকে আমাকে দিয়েছেন ব্রহ্মদেশের সিংহাসনচ্যুত রাজার স্বর্গত গ্রন্থাগারিক Mime Kins Myojah Ah- turinwoon এবং তাঁকে আমি আমার ধন্যবাদ জানাই। আমাদের রচনাটি এটিকে Ka-ke সাতটি পৃষ্ঠায় রেখেছে।

উভয় MSS ব্রহ্মদেশীয় ভাষায় রচিত। Cha-Kesa-Dhatu Vamsa বংশ হল একটি গুরুত্বপূর্ণ পুঁথি বুদ্ধের কেশধাতুর উপর শত্রু, প্রঙ্কুন্ন, মনিমেখলা, আধিকনভিকা, বরুণানাগরাজ, দমিলমাবিক, বা দমিল উপাসক, বা মত্তবর্ণিকা দ্বারা নির্মিত স্তূপগুলি নিয়ে আলেচনা করে। Cha-Kesa-Dhatu Vamsa হল বুদ্ধের ছটি কেশধাতু যেগুলিকে ভদন্ত, অনুরুদ্ধ, শোভিত, পদুমুত্তর, গুণসাদগর, ঞাণপণ্ডিতও এবং বেরত রাজগৃহ থেকে অনেক শ্রদ্ধা, ভক্তি মনোযোগসহ সমুদ্র অতিক্রম করে দূর দেশে নিয়ে যান এবং ছয়টি মহাস্তুপ নির্মাণ করে কেশধাতুগুলিকে তার মধ্যে স্থাপন করেন। তারা বুদ্ধের দেহধাতুগুলিকে একটি স্তুপের মধ্যে স্থাপন করতে চেয়েছিলেন যাতে প্রত্যন্তদেশে বসবাসকারীরা তাদের অনুগামীরা জয়ীকে দেখতে পায়। বংশ শব্দটির অর্থ হল ইতিবৃত্ত, ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদি। আক্ষরিক এটি বোঝায় রাজবংশ, বা কূল ইত্যাদি। অতএব, Cha-Kesa-Dhatu Vamsa হল একটি অর্ধ ঐতিহাসিক নথি যেখানে বুদ্ধের কেশ ধাতুর উল্লেখ রয়েছে। পণ্ডিতদের মতে এটি থুপবংশকে সম্পূর্ণ করেছে। তাঁরা আরও মনে করেন যে ইতিহাসের এই নথিটি ছাড়া স্তুপগুলির ইতিহাস অসম্পূর্ণ।

-কেস ধাতু বংসের লেখকের নাম জানা যায়। সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয় যে গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন একজন অজ্ঞাতনামা লেখক যিনি মায়ানমারে বসবাস করতেন। তিনি পালি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তাঁর গ্রন্থে মায়ানমারের ইতিবৃত্তরূপে -কেস-ধাতু বংস সম্পর্কে কোন মন্তব্য করেননি। কিন্তু গ্রন্থটির দুটি পান্ডুলিপিই মায়ানমানে পাওয়া গিয়েছিল এবং সেগুলি মায়ানমারিস ভাষাতেই রচিত। মায়ানমারের গন্ধবংশে অনেক পালি রচনার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় কিন্তু এতে -কেস-ধাতু বংসের কোন উল্লেখ নেই। শ্রীলঙ্কার পালি সাহিত্যে এই ইতিবৃত্তটির কোন উল্লেখ নেই। কিন্তু একথা জানা যায় যে শ্রীলঙ্কায় কেসধাতুবংস নামে একটি গ্রন্থ রয়েছে।

-কেস-ধাতু বংসের দুটি অংশ রয়েছে যেখানে শক্ক, পঙ্গুঞঞ, মণিমেখলা, অধিকানভিকা, বরুণনাগরাজ এবং দমিলনাবিক বা সত্যনাবিক যা দমিল উপাসক দ্বারা বুদ্ধের কেশধাতুর উপর স্তুপ নির্মার্ণের বিবরণ রয়েছে।

বিভাগ বিভাগের শিরোনাম

ভিক্ষু

ভক্তদের নাম

সক্কপূপবংশ

অনুরুদ্ধ

সক্ক

পঙ্গুঞঞথুপবংস

শোভিত

পদুমুত্তর

পঙ্গু ঞঞ

মণিমেখলায়থুপবংস

মণিমেখলা

8 অধিকানভিকাথুপবংস

গুনসাগর

নাবিক

বরুননাগরজধূপবংস

ঞানপণ্ডিত

বেরত

বরুণ

সত্যনাবিকথুপবংস

দমিল উপাসক

চুলধূপবংশের রচয়িতা মন্তব্য করেছেন যে তাঁর উদ্দেশ্য হল:

বুদ্ধ, ধম্ম সংঘের কাছে প্রার্থনা জানিয়ে আমি সংঘের শাসনের সমৃদ্ধির জন্য ছটি কেশধাতুর ইতিহাস বা কেশধাতুবংশ বর্ণনা করছি। পঙ্গুঞরাজথুপবংশে রচয়িতা মন্তব্য করেছেন যে ভবিষ্যতে সেখানে একজন ধার্মিক রাজার জন্ম হবে। পবিত্র কেশ ধাতুটিকে প্রত্যন্তদেশে রাখা হয়েছিল এবং এই কারণে স্থানটির নাম হয় কেশবতী। নিঃসন্দেহে -কেস-ধাতু বংস একটি উৎসর্গীকৃত ইতিবৃত্ত। এবং মানুষের মঙ্গলের জন্য সমস্ত কাজ তাঁরা করেছিলেন যাঁরা বুদ্ধের পরম ভক্ত ছিলেন। গ্রন্থটিতে বলা হয়েছে যে বুদ্ধ ত্রিশটি পারমিতা পূর্ণ করেছিলেন, বোধিজ্ঞান লাভ করেছিলেন এবং অনুপধিশেষ নির্বাণ-লাভ করেছিলেন। তারপর এতে আনন্দের সঙ্গে বুদ্ধকে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে ছয়জন বৌদ্ধ ভিক্ষুর উল্লেখ রয়েছে যাদের নাম ছিল অনুরুদ্ধ, শোভিত, পদুমুত্তর, গুণসাগর, ঞান পণ্ডিত এবং রেবত এবং ছয়জন ভক্তের বিবরণ রয়েছে যারা ছিলেন দেবরাজ সক্ক, দেবপুত্র পদুমুত্তর, দেবকন্যা মণিমেখলা, নাবিক, বরুণ দমিল উপাসক বা দমিল নাবিক বা সত্যনাবিক।

-কেস-ধাতু-বংস থেকে আমরা জানতে পারি যে বুদ্ধ তাঁদের বক্তব্য শুনে মানুষের প্রতি করুণার বশবর্তী হয়ে, তাঁর দক্ষিণ হস্ত দিয়ে মস্তক স্পর্শ করেছিলেন। তিনি তাঁর মাথা থেকে ছটি কেশ ধাতু পেয়ে সেগুলিকে ছয়জন অর্হতের মধ্যে বিতরণ করেছিলেন। তাঁরা এগুলিকে অনেক শ্রদ্ধা ভক্তির সঙ্গে গ্রহণ করে নিজেদের হাতের উপর স্থাপন করেছিলেন।

-কেস-ধাতু-বংস গ্রন্থে বুদ্ধকে মহিমান্বিত করার জন্য অনেক বিশেষণ ব্যবহৃত হয়েছে যেগুলিকে বুদ্ধের উপাধি হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে। সিদ্ধার্থ গৌতম এই সমস্ত উপাসধি দ্বারা পরিচিত।

বুদ্ধ: সম্বোধি, প্রাপ্ত বা আলোকপ্রাপ্ত, ভগবান

দিনবর, দিনশ্রেষ্ঠ: বিজয়ী, বিজয়ীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ

দশবল: দশটি ক্ষমতার অধিকারী

সথা : গুরু

নরোত্তম: শ্রেষ্ঠ মানুষ লোকজেষ্ঠ মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মহাসিনো: মহর্ষি

অসম: সমান নয়

ধীর: পুরিসশোভো ষাঁড়ের মত মানুষদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ

নায়ক: নেতা

-কেস-ধাতু-বংসতে বুদ্ধের কেশের প্রশংসা করা হয়েছে। এখানে মন্তব্য করা হয়েছে ( সুন্দর কেশ) যদি তুমি বুদ্ধের দেহে জন্ম গ্রহণ করে থাক, তাহলে তুমি তোমার রক্ষককে পাবে। চিরদিন তুমি 'মানুষের মঙ্গল করবে।
এতে আরও বলা হয়েছে ' উপাসক' তিনি একজন মহান শিক্ষক, তুমি এখানে এসেছ মানুষের মঙ্গলের জন্য তাঁর দেহ ধাতুকে তুলে ধরার জন্য।

এখানে গ্রন্থটির শেষপৃষ্ঠাটিকে দেওয়া হল যেটিকে সম্পাদক কাহিনীর শুরুতে উল্লেখ করেছেন এখানে শেষ হল কেসধাতুবংস।

'যেখানে সবচেয়ে স্বর্গীয় ইতিবৃত্তের বর্ণনা করা হয়েছে। এটিকে জ্ঞানীদের খুশি করার জন্য আমি রচনা করেছিলাম সাতটি সুখ যা সবচেয়ে মহৎ শ্রদ্ধা, নৈতিক নিয়ম, শৃঙ্খলা প্রচেষ্টা আত্ম-সংযম, আত্মোৎসর্গ এবং সুমিষ্ট স্মৃতি এটি অকথিত সম্পদের সাতটি উপাদান যেটি আমাকে অর্থাৎ রচয়িতাকে পূর্ণ করবে এবং আমি উজ্জ্বল চাঁদের মত কিরণ দেয় তার আলো নিয়ে, অদ্বিতীয় প্রজ্ঞার মধ্যে দিয়ে এটি আমাকে স্বর্গের দ্বিতীয় রত্নে পরিণত করুক কেশধাতুর সেই বিশাল স্তূপ শক্তিশালী ইন্দ্র বরুণ দ্বারা পূজিত হোক।'

গন্ধবংস:

গন্ধবংস বা 'গ্রন্থের ইতিহাস' রচনা করেছিলেন মায়ানমারের নন্দপঞঞ। এটি গদ্যে রচিত। M.H.Bode মনে করেন, এটি সপ্তদশ শতকে রচিত। তিনি বলেন, "আমাদের সেই মেধাবী দূরদর্শী পণ্ডিত Minayeff এর পরিশ্রম থেকে উপকৃত হওয়া উচিত যার কাছে দেশে রচিত গন্ধবংশের আবিষ্কার প্রকাশের জন্য ঋণী, যেটি শ্রীলঙ্কার ব্রহ্মদেশের পূর্বতন পালি সাহিত্যের একটি আকর্ষণীয় বিবরণ। দুর্ভাগ্যবশত গন্ধবংশে বিস্তারিত বিবরণ তেমন পাওয়া যায় না, এবং সেই সময়ে রচিত গ্রন্থগুলি সম্পর্কে আমাদের অত্যন্ত সামান্য তথ্যই সরবরাহ করে কিন্তু এটি স্থান রচয়িতাদের সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন সমাধানে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে। Menayeff যিনি তাঁর Nonvelles Resoherches sur de Bondhhisme এর জন্য গ্রন্থটিকে ব্যবহার করেছিলেন, এর তারিখ সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হননি, কিন্তু শাসনবংশও অধিকতর আধুনিক একটি ব্রহ্মদেশীয় রচনা Pitakatthamain (1906) এর সঙ্গে তুলনা করলে মনে হয় এটি সপ্তদশ শতকে রচিত হয়েছিল। গন্ধ বংশ 'চুল গন্ধ বংশ' বা 'গ্রন্থের ক্ষুদ্র ইতিহাস' নামেও পরিচিত। এর থেকে কোন কোন পণ্ডিত মনে করেন যে মহাগন্ধবংশ নামে আরেকটি গ্রন্থ রয়েছে। M. Winternitz বলেন, "পাঁচটি অধ্যায়ে গন্ধবংশ তিনটি পিটক, নটি অঙ্গ, শিরোনাম, কখনও কখনও পরবর্তীকালের পালি গ্রন্থগুলির রচয়িতাদের নাম, তাদের জন্মস্থানের বিবরণ, তাঁদের গ্রন্থ রচনার কারণ এবং শেষে সেটি রচনার বিবরণ পেশ করেন। N.R. Ray গন্ধবংশের উল্লেখ করেছেন। তিনি গন্ধবংশের বিবরণে বলেছেন 'গন্ধবংশ যেটি সপ্তদশ শতকের অন্তর্গত একটি পূর্ববর্তী ইতিবৃত্ত পরবর্তী শাসনবংশের মত বর্ণনায় অতটা পরিপূর্ণ নয়, প্রকৃতপক্ষে সেই যুগের সম্পর্কে এবং গ্রন্থের কালপঞ্জী সম্পর্কে এতে খুব কম তথ্যই পাওয়া যায়। অতএব, গন্ধবংশের একটি। আমরা -কেস ধাতুবংসের রচয়িতার নাম জানা যায় না। সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয় যে এটি রচিত হয়েছিল একজন অজ্ঞাতনামা লেখকের দ্বারা যিনি মায়ানমারে বসবাস করতেন। তিনি পালি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। M.Η. Bode তাঁর Pali Litrature of Bruma গ্রন্থে এটি ইতিবৃত্ত হিসেবে -কেস-ধাতু- বংস সম্পর্কে কোন মন্তব্য করেননি। কিন্তু যে গ্রন্থটির দুটিই মায়ানমারে পাওয়া গিয়েছিল এবং এগুলি মায়ানমারেই রয়েছে। মায়ানমারের গন্ধবংশে পালি ভাষায় রচিত অনেক গ্রন্থ তাদের রচয়িতাদের সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে কিন্তু সেখানে -কেস-ধাতু বংসের কোন উল্লেখ নেই। কিন্তু একথা জানা আছেট যে শ্রীলঙ্কায় কেন ধাতুবংশ নামে একটি গ্রন্থ ছিল।

চামদেবীবংস:

চামদেবীবংশ বা চামদেবীর ইতিহাস পালি ভাষায় রচনা করেছিলেন ভদন্ত ফ্রা বোধিরাংসি বা মহাথের বোধিরাংসি যার-কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল ছিল হয় নব্বিসিপুরা (চিয়াংমাই বা উত্তর থাইল্যাণ্ডের হরিপুঞ্জায়াতে। এটি গদ্য পদ্যের একটি সংমিশ্রণ। এতে কোন রচনাকালের উল্লেখ নেই রাজকুমার দামরঙের মতে এটি ১৪৬০ খ্রীঃ থেকে ১৫৩০ স্ত্রী মধ্যে রচিত হয়েছিল কারণ এই সময়ে চিয়াংমাই রাজ্যে পালি সংস্কৃতি ব্যাপক সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। এই পর্বটি উত্তর থাইল্যান্ডের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক সাহিত্যিক দৃষ্টিকোন থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। এই পর্ব থেকে উত্তর থাইল্যাণ্ডের চিয়াংমাই এবং অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং শ্রীলঙ্কা থাইল্যান্ডে থেরবাদী বৌদ্ধধর্ম তার ভাষা পালির প্রবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ সংঘের সহায়তায় চিয়াং মাই বৌদ্ধধর্মের পালি ভাষার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্ররূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। G. Coldes মনে করেন যে চামদেবীবংস পঞ্চদশ শতকের প্রথম পাদে রচিত হয়েছিল। Dr. Saens Manavdiva বলেন যে বোধিরামসি জিনকালমালির লেখক রতনপঞঞ একই সমসাময়িক। চামদেবীবংশ উত্তর থাইল্যাণ্ডে বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে অধ্যয়নের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। এতে উত্তর থাইল্যাণ্ডে বুদ্ধের আগমনের বর্ণনা হয়েছে যেখানে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করে ছিলেন যে দেশের এই অংশে তাঁর ধর্ম দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। এই গ্রন্থে উত্তর থাইল্যাণ্ডের হরিপুঞ্জায় (লম্পুন বা লামফুল) এর ইতিহাস, সেখানে বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তন বিকাশ, বিভিন্ন মন্দির বুদ্ধের ধাতুর স্থাপনার ইতিহাস রয়েছে এবং এটি শেষ হয়েছে রাজা আদিত্যরাজের রাজত্বকালের বিবরণ দিয়ে যিনি একাদশ শতকে বর্তমান ছিলেন। অন্যান্য সমস্ত সিংহলীয় বা মায়ানামারীয় ইতিবৃত্তের মত চামদেবীবংশও শুরু হচ্ছে ভবিষ্যতের হরিপুঞ্জয়ের স্থানে বুদ্ধের একটি কাল্পনিক আগমনদ্বারা, যেখানে তিনি এই নগরী এবং রাজা আদিত্যরাজ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। বুদ্ধের আগমন বর্ণনা করার পর গ্রন্থটি হরিপুঞ্জয় স্থাপনের কাহিনী, বাসুদেব সুখদন্ত নামক সন্ন্যাসীকে নিয়ে চামদেবীর আগমন, তাঁর হরিপুঞ্জয় রাজ্যের রাণীর পদে লাভ লোপবুড়ি থেকে আগত ৫০০ জন ভিক্ষুর সাহায্যে সেখানে বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠা এবং সেই সমস্ত রাজাদের নাম যারা চামদেবীর পর হরিপুঞ্জ রাজ্যের সিংহাসন অধিকার করেছিলেন।

চামদেবীবংশের প্রথম বিভাগে হরিপুঞ্জয় রাজ্যের ভবিষ্যৎ স্থানে বুদ্ধের আগমনের বর্ণনা করা হয়েছে, এবং তাঁর সঙ্গে রয়েছে এই নগরী রাজা আদিত্যরাজ সম্পর্কে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী। দ্বিতীয় বিভাগে পাঁচজন ঋষির ইতিহাস এবং মিগসংঘ নগরীর প্রতিষ্ঠার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। এই পাঁচজন ঋষি ছিলেন বাসুদেব, শুক্কদন্ত, অনুসিস, বুদ্ধজটিল, এবং সুরক্ষ। তৃতীয় বিভাগ থেকে জানা যায় যে ঋষি বাসুদেব তার বন্ধু সুখদন্তকে লোপবুড়িতে একটি বার্তা পাঠান যিনি হরিপুঞ্জয় নগরী প্রতিষ্ঠা করতে এসেছিলেন। চতুর্থ বিভাগে চামদেবীর সন্ধানে সুখদত্তের লোপবুড়িতে আগমনের বর্ণনা করা হয়েছে। পঞ্চম ষষ্ঠ বিভাগে বিবরণ দেওয়া হয়েছে কেমন করে চামদেবী হরিপুঞ্জতে এসেছিলেন এবং কেমন করে বাসুদেব সুখদত্ত সমস্ত নাগরিকদের নিয়ে রাজকুমারী চামদেবীকে একটি সোনার স্তুপের উপর বসিয়ে তাঁকে রাজপদে অভিষিক্ত করেছিলেন। চামদেবী সাতবছর রাজত্ব করেছিলেন। সপ্তম বিভাগে হরিপুঞ্জয়ের শাসক এবং বর্বর রাজা মিলঙ্করাজ বা বিলঙ্করাজের যুদ্ধের বর্ণনা রয়েছে। অষ্টম বিভাগে চামদেবীর পুত্র মহাতায়সের বিবাহের বর্ণনা তাঁর রাজা হিসেবে অভিষেকের বিবরণ রয়েছে। তিনি আশি বছর রাজত্ব করেছিলেন। নবম বিভাগে মহানতায়সের দ্বারা খেলাঙ্গনগরের (নামকরণ প্রদেশের নিকট, খালেঙ্গা হল বর্তমান লাম্পাং প্রদেশ) প্রতিষ্ঠার বর্ণনা রয়েছে। দশম বিভাগে চামদেবীর আগমন খেলাঙ্গ নগরে তাঁর অবস্থানের এবং আলম্বঙ্গনগরের প্রতিষ্ঠার বর্ণনা করা হয়েছে। একাদশ বিভাগে আলম্বঙ্গ নগরে চামদেবীর রাজত্বকাল, হরিপুঞ্জয়তে তাঁর প্রত্যাবর্তন মৃত্যুর বর্ণনা রয়েছে। দ্বাদশ, ত্রয়োদশ চতুর্দশ বিভাগে বিভিন্ন শাসকের বিবরণ রয়েছে যিনি আদিত্যরাজের সময় পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন।

সঙ্গীতিবংস:

'সঙ্গীতিবংস' বা 'সঙ্গতিয়বংস' বা বৌদ্ধ সঙ্গীতির ইতিহাস পালি ভাষায় রচনা করেছিলেন ব্যাঙ্ককের Phra Wannarat ২৩৩২ বুদ্ধাব্দের চৈত্রমাসে বা ১৭৮৯ সালের ২১ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিলের মধ্যে। G. Cardes এর মতে রাজগুরু বিমলধর্ম এটি রচনা করেছিলেন। লেখক তাঁর রচনার ভূমিকায় মন্তব্য করেছেন।

উপরক্তো গাথা G. Cardes এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে সঙ্গীতিবংসের রচয়িতা ছিলেন বিমলধর্ম। এটি রচিত হয়েছিল চাও ফ্রা চক্রির পৃষ্ঠপোষকতায় পালি ধর্মীয় সাহিত্যের পরিমার্জনার ঠিক পরই যিনি থাই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম রাম (১৭৮২-১৮০৯) নামে পরিচিত ছিলেন। পঞ্চম রামের পুত্র H.R.H. Prince Chudhadhaj adhatriloka Komkhun Hejboo India Laya অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াকে স্মরণীয় করে রাখতে মহাব্রহ্মায়ুধ বা রাম এটিকে ১৯২৩ সালে প্রকাশ করার আদেশ দিয়েছিলেন। রচয়িতা তাঁর গ্রন্থে নটি বৌদ্ধ সঙ্গীতির কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন যে এর প্রথম তিনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ভারতবর্ষে চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম অষ্টম সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল শ্রীলঙ্কায়, বার্মা এবং নবম সঙ্গীতিটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল থাইল্যাণ্ডে।

সঙ্গীতিবংশ হল থাইল্যাণ্ডের আয়োথিয়া রাজ্যের রাজনৈতিক ধর্মীয় ইতিহাসের অধ্যয়নের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ আকর গ্রন্থ। এই গ্রন্থে আয়োথিয়া রাজ্যের প্রতিষ্ঠা, এটির শাসক, এটির পতন, থাইল্যান্ডে এটির রাজনৈতির গুরুত্ব এবং প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে আয়োথিয়ার সম্পর্কের বিবরণ রয়েছে। এছাড়াও এই গ্রন্থে থাইল্যাণ্ডের ধর্মীয় জগতে আয়োথিয়ার রাজাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিদান বর্ণনা রয়েছে। এই গ্রন্থে থাইল্যান্ড শ্রীলঙ্কার মধ্যেকার ধর্মীয় আদানপ্রদান এবং দক্ষিণ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বৌদ্ধধর্মের বিকাশ সম্পর্কে অনেক গুরুত্ব পূর্ণ পাওয়া যায়।

সঙ্গীতিবংশের প্রথম অধ্যায়টি জম্বুদীপ সঙ্গীতিনিদ্দেশ নামে অভিহিত। এখানে দীপঙ্করের পারমিতা প্রাপ্তি বোধিসত্ত্বের জন্ম প্রথম জীবনের বর্ণনা এবং ধৰ্ম্মপদ অত্থকথা গ্রন্থটির উল্লেখ রয়েছে। সম্বোধি পরিনির্বাণের উল্লেখ করার পর এখানে ভারতবর্ষ প্রথম সঙ্গীতির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। তারপর এখানে মহাবংশ সদ্ধম্মবংশ থেকে কয়েকটি গাথার উল্লেখ করে ভারতবর্ষের দ্বিতীয় সঙ্গীতর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এখানে অশোকের ধর্মান্তকরণ ভারতবর্ষের তৃতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতি মহিন্দের শ্রীলঙ্কায় আগমন বর্ণনা করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে গ্রন্থটিতে মহাবংশ, দ্বীপবংশ, সমন্তপাসাদিকা এবং সদ্ধম্ম সংগহের উল্লেখ রয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়টির নাম Lankadipacatutthavarasanghandessa | এখানে চতুর্থ বৌদ্ধ সঙ্গীতির উল্লেখ রয়েছে এবং শ্রীলঙ্কাতে বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস সম্পর্কে তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। এখানে অশোকের বংশলতিকার উল্লেখ রয়েছে, এছাড়াও আরও অনেক শাসকের বংশলতিকাও এখান থেকে পাওয়া যায়। তৃতীয় অধ্যায়টি Lankadiparajavamsaviddesa নামে পরিচিত। এটি শুরু হচ্ছে কপাল ধাতুর আগমনের বর্ণনা দিয়ে। এছাড়াও বর্ণনা করা হয়েছে মহাবোধির আবির্ভাব, জ্যেষ্ঠ মহিলার নির্বাণলাভ, ডানদিকের ধাতুর স্তূপের প্রতিষ্ঠা, সামনের ধাতুর আবির্ভাব, মহিরাঙ্গন স্তূপের নির্মাণ, মরিচবট্টি চৈত্য, লোহপাসাদ, সুবন্নমালি চৈত্যের নির্মাণ এবং বৌদ্ধধর্মের প্রচার। চতুর্থ অধ্যায়টির নাম হল দন্তাবতারধাতু নিদ্দেস। এখানে হরিপুঞ্জয় নগরী অধ্যায়টির নাম সম্মনসারাজ নিদ্দেস বা লব রাজবংশের রাজাদের বিবরণ। এখানে হরিপুঞ্জয়ের প্রতিষ্ঠা, চামদেবীর উত্থান, হরিপুঞ্জয়তে মহাধাতুর আবির্ভাব রাজা আদিত্যরাজ (আদিচ্চরাজ্যের) বংশের বিবরণ রয়েছে। ষষ্ঠ অধ্যায়টি লববংশরাজানিদ্দেস নামে পরিচিত এখানে লব রাজবংশের রাজাদের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এখানে রাজা মেঙ্গরাইয়ের শাসন, পবিত্র ধাতুথর সুমনের হস্তগত হওয়া, তাঁর নব্বিসপুরায় আগমন, সিংহলের মূর্তিটির সুখোতাই (সুখদয়া) তে আগমন, নব্বিসপুরার সুখারামে একটি চৈত্য নির্মাণ, মহাধাতু চৈত্যের বিবরণ, তিদ্দাকরনী মার বিবরণ, এবং উত্তর থাইল্যাণ্ডে, রত্ননির্মিত মূর্তিচির আগমন। এছাড়াও, এখানে রাজা তিলক, পুষ্কারামে বুদ্ধ মূর্তির নির্মাণ, শিখি বুদ্ধের মূর্তি নির্মাণ, চন্দনকাঠ মূর্তির ঘটনা, হরিপুঞ্জয়তে পাথরের প্রাচীর নির্মাণ সিংহল ইত্যাদির বিবরণ রয়েছে। সপ্তম অধ্যায়টির নাম Anukkamachatimarajaniddesa এখানে অয়োথিয়ার ৩৬ জন রাজার তালিকা দেওয়া হয়েছে। এঁরা হলেন রামাধিপতি সুবন্নদোল (১৩৫০-১৩৬৯), রামেশ্বর (১৩৬৯-৭০), পরম রাজাধিরাজ (বানু মহানায়ক) (১৩৭০-১৩৮৮) সুবল্লচন্দ (১৩৮৮), রামেশ্বর (২য় বার) (১৩৮৮-১৩৯৪), রামরাজা (১৩৯৪-১৩৯৭), নাগরাইন্দা (১৩৯৭), পরমার্থ রাজাধিরাজ, পবমাতিলোক্কনাথ, ইন্দ্ররাজ, রমাধিপতি (১৫২৯), বুদ্ধাঙ্কুর, রক্তধিরাজকুমার জয়রাজশ্রী, বায়াত্ত জিনরাজ (বংশধিরাজ), শিররাজমহামহিন্দ,

মহাধম্মরাজ, সিদ্ধিরত্ন, নরিস্সা, রামেশ্বর, ইন্দ্ররাজ (১৬১০- ২৮), জেট্টরাজ, আদিত্যবংশ, সুধম্মরাজ (১৬৩০), দিয়ারাজ সুবঃপ্রসাদ, অনুজরাজাধিরাজ নারায় (১৬৬৪), বিজ্জারাজ, মহুপদ, শরশক্ক, মহাচোর (১৭৩২), মহাকালরাজাধিরাজ, রমাধিপতি, উদুম্বরপুপফ (১৭৫৮), এবং জেঠধিরাজ (১৭৫৮-৬৬), অষ্টম অধ্যায়টি নবমধম্ম সংঘনিদ্দেশসনামে পরিচিত। এখানে ১৭৯৮ সালে প্রথম রামের রাজত্বকালে ব্যাঙ্ককে আয়োজিত নবম বৌদ্ধ সঙ্গীতির বিবরণ পরিবেশিত হয়েছে। রাজা প্রথম রাম ত্রিপিটক পরিমার্জণের জন্য এটি সঙ্গীতি আহ্বান করেন এছাড়াও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বৌদ্ধ সংঘের সংস্কার এবং ব্যাঙ্ককে বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠা। এই সঙ্গীতটি ব্যাঙ্ককে ১৭৮৮ সালের ১৩ নভেম্বর শুরু হয়ে ১৭৮৯ সালের ১০ এপ্রিল পর্যন্ত চলেছিল। রাজা এই সঙ্গীতিতে যোগদানদারী ভিক্ষুদের দ্বারা নির্ধারিত বিন্যস্ত ত্রিপিটকের রচনাগুলিকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্যাঙ্ককে একটি বিশেষ কক্ষ নির্মাণ করেছিলেন। সঙ্গীতিবংসের রচয়িতা এই সঙ্গীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এই গ্রন্থটির নবম বা সর্বশেষ অধ্যায়টি হল-"ঞানবংসেতি যত্তন পেন্তরদ্ধান নিদ্দেস"

এখানে রচয়িতা বিভিন্ন সুকর্মের সুফলগুলি বর্ণনা করেছেন এবং সারসংগহ থেকে পাঁচটি অংশের উল্লেখ করেছেন যেখানে অন্তবধান বা ধর্মপ্রচারের পাঁচটি পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে।

রতনবিম্ববংস :

রতনবিম্ববংস বা পান্নানির্মিত বুদ্ধের ইতিহাস পালি ভাষায় রচনা করেছিলেন একজন তরুণ চিয়াং-মাই ভিক্ষু ফ্রা ব্রহ্মরাজাপঞঞ। এটি মহাধম্মরাজবাত্তর বিহারের সজ্জানলয়েতে রচিত হয়েছিল। প্রথম রামের রাজত্বকালে এটির অস্তিত্বের কথা জানা যায়। বুদ্ধ মূর্তিটি যেটি পান্নানির্মিত বুদ্ধ নামে পরিচিত থাইল্যাণ্ডে অত্যন্ত বিখ্যাত এবং এটিকে এর চৌহদ্দির মধ্যে পান্নানির্মিত বুদ্ধের মন্দিরে রাখা আছে। রতনবিম্ববংস এই মূর্তিটির ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করে। ১৭৮২ সালে ব্যাঙ্ককে এটি স্থাপিত হওয়ার পূর্বে এটিকে থাইল্যাণ্ডের অন্যান্য অংশে এবং কম্বোডিয়া লাওসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এমন হওয়া সম্ভব যে রচয়িতা গ্রন্থটি লিখেছিলেন কোন একটি ভারতীয় আকর থেকে এবং এটি খ্রীষ্টীয় পঞ্চদশ শতকের শেষ পাদে রচিত হয়েছিল।

মিলিন্দের গুরু নাগসেন বুদ্ধের পরিনির্বাণের পঁচিশ বছর পর পান্নানির্মিত বুদ্ধমূর্তিটি নির্মাণ করেছিলেন এটি এক কিউবিক এক ইঞ্চি উঁচু এবং এর মধ্যে বুদ্ধের সাতটি ধাতু রয়েছে। "২৫৬ খ্রীষ্টাব্দে এটি ভারতবর্ষ থেকে সিংহলে স্থানান্তরিত হয় এবং সেখানেই থাকে যতদিন না পাগানের রাজা অনুরুদ্ধ ধর্মশাস্ত্রের সঠিক প্রতিলিপির সন্ধানে শ্রীলঙ্কায় এলেন। তিনি মূর্তিটি তাঁর সঙ্গে নিয়ে গেলেন, কিন্তু এটি ঝড়ে উড়ে গেল এবং এর মধ্যেকার বস্তুগুলি চলে গেল আঙ্কারে। অনিরুদ্ধ এগুলিকে উদ্ধার করার জন্য একটি জাদু ঘোড়ায় চড়ে আঙ্কোরে এলেন, কিন্তু পাগানে ফিরে যাওয়ার সময় মূর্তিটিকে লক্ষ্য করলেন না। এই জন্য পান্নানির্মিত বুদ্ধমূর্তিটি শ্যামদেশীয় আক্রমণ পর্যন্ত আঙ্কারে থেকে গেল যখন এটিকে কাম্পেং পেটে নিয়ে যাওয়া হল। শেষ পর্যন্ত মহাব্রহ্ম এটিকে ফ্রাশিহিং এর সঙ্গে চিয়াং মাইতে নিয়ে গেলেন। যখন সেন মুয়াং মা ফ্রাশিহিং কে চিয়াং মাই তে ফিরিয়ে দিলেন তখন পান্নানির্মিত বুদ্ধটি সকলের নজর এড়িয়ে গেল যেহেতু এটিকে চুন দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। দশ শতকে চিয়াং মাইয়ের রাজা এটি নিয়ে যাওয়ার জন্য লোক পাঠালেন কিন্তু এটি এত ভারী ছিল যে পাহাড়ের উপর দিয়ে নিয়ে যাওয়া গেল না। তারপর এটিকে লাম্পাং- গরুর গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়ার একটি সফলতর প্রতিষ্ঠা করা হল যেখানে এটিতে ততক্ষণ রাখা হল যতক্ষণ না তিলক এটিকে সংগ্রহ করে চিয়াংমাইদের মহাচৈত্যে স্থাপন করলেন।

সাসনবংস:

শাসনবংশ বা 'শাসনের ইতিহাস' রচিত হয়েছিল ১৮৬১ সালে মায়ানমারে (১২২৩ কলিযুগ অর্থাৎ ব্রহ্মদেশীয় বা মায়ানমারীয় সম্বৎ) পঞঞাসামী দ্বারা যিনি মায়ানমারের রাজা মৎ-দুন-মেং (মিন-ভন-মিন) এর আচার্য ছিলেন। তিনি ধম্মভিভঞেয়বংসার বা মায়ানমারের মান্দালয়ের সংঘপ্রধান বা সংঘরাজের শিষ্য ছিলেন। এইচ কার্ণ তাঁর Manual of Indian Buddhism গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে শাসনবংশ মায়ানমারের বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিবৃত্ত যেখানে বৌদ্ধধর্মের বৃদ্ধি বিস্তার সম্পর্কে জানতে পারা যায়। এটি একটি মূলপালি সাহিত্য বর্হিভূত সাহিত্য। লুই দ্যা জুয়সা তাঁর শ্রীলঙ্কার মন্দির গ্রন্থাগারগুলির পরিদর্শন সংক্রান্ত প্রতিবেদনে এটিকে একটি 'অতি আকর্ষণীয় ঐতিহাসিক রচনা' হিসেবে উল্লেখ করেছেন (১৮৭৩) শাসনবংশের উপাদানসমূহ সংগৃহীত হয়েছে পালি অট্টকথা, শ্রীলঙ্কার ইতিবৃত্ত দ্বীপবংশ মহাবংশ, সমন্তপাসাদিকা (বিনয়ের উপর রচিত ভাষ্য), মায়ানমারীয় রাজবংশ বা মহারাজবংশ, এবং মায়ানমারের রাজা ধম্মচেতির কল্যাণী লিপি (১৪৪৭ খ্রীঃ) লেখক পোরাণ বা প্রাচীন রচনাগুলিকেও ব্যবহার করেছেন। মহাবংশ থেকে অনেক গাথা হুবহু উদ্ধৃত করা হয়েছে। এন. আর রায় মন্তব্য করেছেন, 'উপরন্তু এর একটি বিশ্বাসযোগ্য ঘটনাক্রম রয়েছে এবং এটি ঘটনার রচয়িতাদের তারিখ নির্বাচন করে এবং এগুলি অন্যান্য স্বাধীন উৎসের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যায়। এর মূল্য হল এই যে এটি আমাদের ধর্ম সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত অথচ সম্পর্কিত বর্ণনা পরিবেশন করতে সাহায্য করে। কিন্তু তিনি আরো বলেছেন যে শাসনবংসের নিজস্ব কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। এম. এইচ. বোডে বর্ণনা করেছেন "শাসনবংস হল বিভ্রান্তিকর, বিশৃঙ্খল এবং সংস্কারযুক্ত এটির রচয়িতা পঞস্বামী বইটির তারিখ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন ১২২৩ কলিযুগ বা ব্রহ্মদেশীয় সম্বৎ (১৮৬১ খ্রীঃ) তিনি রাজা মিন-ডন-মিনের রাজত্বের এক প্রভাবশালী বৌদ্ধ ভিক্ষু ছিলেন এবং ঐতিহ্য বিশ্বাসের দিক থেকে সিংহলসংঘ (যা মারম্ম সংঘ বা ব্রহ্মদেশীয় সংঘ থেকে পৃথক ওল বিরোধী) এর অনুগামী ছিলেন। সিংহলসংঘ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম সম্প্রদায় যার নাম থেকে অনুমান করা যায় যে সিংহলের বৌদ্ধ সংঘের সঙ্গে এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। অন্যান্য সম্প্রদায় যাদের আধ্যাত্মিক পূর্বপুরুষগণ মহাবিহার (সিংহলের) কে ঐতিহ্যের কেন্দ্র হিসেবে দেখতে রাজী ছিলেন না, তাঁরা তাঁকে সীমিত পরিমাণে আকর্ষণ করতেন...সেই কারণে আমাদের শাসনবংশকে ত্রিপিটক সাহিত্য রচনার সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত বলে মনে করার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। তবে যাই হোক, লেখকের, নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি হল নির্দেশমূলক এবং আমাদের এমন কথা মনে করার কোন অধিকার নেই যে তিনি নিরপেক্ষ নন।"

শাসনবংশ বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস আলোচনা করে। এতে এমন সব সমস্ত ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় যাদের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসের যোগ রয়েছে। এতে অশোকের সময়ের তৃতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতির উল্লেখ পাওয়া যায় যিনি বৌদ্ধধর্মের প্রচারের জন্য নটি দেশে দূত পাঠিয়েছিলেন। তারপর এটি বিভিন্ন অধ্যায়ে নটি দেশে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস বর্ণনা করেছে। এম.এইচ, বোডে মন্তব্য করেছেন, "এই সম্পূর্ণ নটি অধ্যায় মোটামুটিভাবে দুটি অংশ বিভক্ত হয়, এই বিভাগের দ্বারা বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস হিসেবে সাসনবংসের পরিধি স্পষ্ট হয়। আমরা যেটিকে প্রথম বিভাগ (মাতিকার ক্রম থেকে সামান্য সরে গিয়ে)

বলতে পারি তা হল অসম দৈর্ঘ্যের কিছু অধ্যায়, যার অধিকাংশই অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এহং কয়েকটি কিংবদন্তী নিয়ে গঠিত এবং যাকে দ্বীপবংশে বুদ্ধঘোষের উদ্ধৃতি গাঁথা হয়েছে।

সিংহল বা সুবর্ণভূমির বর্ণনাতে অধিকতর যত্ন সম্পূর্ণতা দেখতে পাওয়া যায় অথবা বলা যেতে পারে গোষ্ঠীর অন্যান্য রচনার তুলনায় এদের মধ্যে বিষয় সম্পর্কে অধিকতর জ্ঞান পরিলক্ষিত হয়। সিংহল সম্পর্কিত অধ্যায়টির ক্ষেত্রে প্রথম অধ্যায়ের ক্ষেত্রে যেকোন থেকে উপাদান সংগৃহীত হয়েছিল সেখান থেকেই উপাদান সংগৃহীত হয়েছে; এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্রহ্মদেশীয় উৎসের একটি রচনা থেকে কিছু অংশ যার নাম বুদ্ধঘোসুপ্পত্তি। সুবর্ণভূমির ক্ষেত্রে লেখক তাঁর উত্তরসূরী হিসেবে উল্লেখ করেছেন, এছাড়াও রাজবংশ (সম্ভবত পেগু ইতিবৃত্ত) এবং শেষের লিপির কথা বলেছেন যে লিপিগুলি পঞ্চদশ শতক থেকে শুরু হওয়া বিখ্যাত কল্যাণী সীমা যার ধ্বংসাবশেষ এখনও পেগুর শহরতলীতে পাওয়া যায়।

দ্বিতীয় বিভাগ হল দীর্ঘতর এবং অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। এটি গ্রন্থটির তিন পঞ্চমাংশ কিন্তু কেবলমাত্র ষষ্ঠ অধ্যায়টি নিয়ে গঠিত। এটি অপরন্তু বা মূল ব্রহ্মদেশে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করে।

এন. আর. রায় বলেন যে তৃতীয় অধ্যায় সুবর্ণভূমি (নিম্ন মায়ানমার) এবং ষষ্ঠ অধ্যায় মরম্মমণ্ডল (অর্থাৎ উচ্চ মায়ানমার) এর ইতিহাস আলোচনা করে। তিনি আরও মন্তব্য করেছেন, "সুবর্ণভূমি সিংহলের বিবরণ যোনা করঠ, বনবাসী, কাশ্মীর, গান্ধার, মহীশাসকমণ্ডল, চীনরষ্ঠ, এবং মহারফ্টর বিবরণের তুলনায় বিষয়বস্তু সম্পর্কে গভীরতর জ্ঞান প্রকাশ করে। কিন্তু এমনকি সুবর্ণভূমিতে বৌদ্ধধর্মের বিবরণও মরম্মমণ্ডলতে বৌদ্ধধর্মের বিবরণের তুলনায় অতি সংক্ষিপ্ত এবং এই অধ্যায়টি (ষষ্ঠ অধ্যায়) কার্যক্ষেত্রে সাসনবংসের তিন পঞ্চমাংশ অধিকার করে থাকে এবং এটিই হল গ্রন্থটির দীর্ঘতম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কিন্তু সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়টি হল দুটি রাজত্বের কোন বিবরণই আমাদের আনোরথার পেগানের সিংহাসন আরোহন এবং পরবর্তীকালে তাঁর থাটন বিজয়ের পূর্বে বৌদ্ধধর্মের উত্থানপতন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না (শুধুমাত্র সুবগ্নভূমিতে অশোকের ধর্মপ্রচারক প্রেরণ এবং অস্পষ্টভাবে অরিমদ্দনের সামন্তকুটুক ধর্মবিরোধী অস্পষ্ট মন্তব্য ছাড়া) শুধুমাত্র ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্যে দিয়েই শাসনবংস আকর্ষণীয় বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। এই স্থান থেকে ইতিবৃত্তটি পূর্ণতর বিস্তৃততর বিবরণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় শুধুমাত্র মরম্মমণ্ডলের সাপেক্ষে নয়, সুবণ্ণভূমির সাপেক্ষের বটে যার মধ্যে সাসনবংস অনুসারে রামঞ দেশ (থাটন), হংসাবতী (পেগু) এবং মূর্তিমা (মর্তবান) পড়ে।

জিনবংসদীপং :

এটি শুরু হল বোধিসত্বের তুষিত স্বর্গ (স্বর্গীয় বাসস্থান) থেকে কপিলবাস্তুর রাজা শুদ্ধোদনের প্রধান মহীষী মায়ার গর্ভে অবতরণের দ্বারা। তারপর এটি এক পূর্ণিমার রাতে বুদ্ধের জন্ম, তাঁর সংসারত্যাগ, তাঁর কৃষ্ণসাধন, সুজাতার নিকট পায়সান্ন গ্রহণ, ধ্যানের মাধ্যমে বোধিজ্ঞানলাভ, বৌদ্ধধর্ম প্রচারে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং তাঁর জীবনাবসান বা মহাপরিনির্বাণ ইত্যাদির বিবরণ পরিবেশিত হয়েছে। তারপর গ্রন্থটি রাজগৃহে অনুষ্ঠিত প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতি নিয়ে আলোচনা করে যা বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর রাজা অজাতশত্রুর রাজত্বকালে। সকলের শ্রদ্ধেয় প্রবীণ ভিক্ষু মহাকশ্যপ এই সঙ্গীতির সভাপতি ছিলেন। ধম্ম বিনয় নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে উপালি আনন্দ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এরপর প্রথম অধ্যায়টি দ্বিতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতি সম্পর্কে আলোচনা করে যা রাজা কালাশোকের পৃষ্ঠপোষকতা বৈশালী নগরীতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এর থেকে জানা যায় যে বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ গ্রহণের এক শতাব্দী জিনবংসদীপং গ্রন্থের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল ভগবান্ বুদ্ধের সম্পূর্ণ জীবন এবং তা তাঁর পূর্ব জন্মের নানাবিধ ঘটনার এক অমূল্য সংকলন। তাঁর পূর্ব জন্মে অর্থাৎ দীপঙ্কর বুদ্ধের সময়কালে তিনি 'মুক্তৈধ' নামক এক ব্রাহ্মণ পুত্র রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। সেই সময়কাল হতে কপিলবাস্তুতে তাঁর সিদ্দার্থ রূপে জন্মগ্রহণ, গৃহত্যাগ তথা সম্বোধি লাভ ধর্মপ্রচার ধর্মচারিকা ইত্যাদির বিস্তৃত বর্ণনা হল ওই গ্রন্থের মুখ্য বিষয়। জিনবংসদীপ গ্রন্থে মোট ৩০ টি সর্গ বিদ্যামান।

গৌতমবুদ্ধের পূর্বজীবন জিনবংসদীপ গ্রন্থে সুমেধ তাপস থেকে শুরু করে লংকাদ্বীপে বুদ্ধের ধর্মের প্রচার প্রসার অত্যন্ত সুন্দর প্রাঞ্জল ভাষা পরিবেশিত হয়েছে।

. বুদ্ধপাল ভিক্ষু প্রণীত 'পালি সাহিত্যের বিকাশে বংশ সাহিত্যের অবদান' এই গ্রন্থটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা পাই এই গ্রন্থে। বিশেষত বুদ্ধের পরিনির্বাণের পর বৌদ্ধ পালি সাহিত্য তথা ত্রিপিটক সাহিত্য কিভাবে বিকাশ লাভ করেছিল দেশে-দেশে এবং ভারতে তথা বর্হিভারতে, কিংবা অভিলেখ গুলো কী সাক্ষ্য দেয় তার বিবরণ আমরা এই গ্রন্থকে আকর গ্রন্থ হিসেবে মূল্যায়ন করতে পারবো এতে কোন সন্দেহ নেই। বিশেষত শ্রীলংকা, মায়ানমার, থাইল্যাণ্ড, কম্বোডিয়া, লাওস বলতে গেলে গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পালি সাহিত্যের প্রচার প্রসারে এই বংশ সাহিত্যের অবদান অনস্বীকার্য। . বুদ্ধপাল তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য তথা বাংলা সাহিত্যের মধ্য দিয়ে পালি ইতিহাসকে অন্যমাত্রায় পরিবেশন করেছেন।

তাঁর এই গ্রন্থের বিষয় সূচী সাতটি অধ্যায়ে বিভক্ত করেছেন। প্রত্যেকটি অধ্যায়ের বিষয়বস্তুর নিরিখে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করেছেন। এককথায় বলতে গেলে প্রত্যেকটি অধ্যায় যেন তাঁর নখ দর্পণের বিচারে বিশ্লেষণ করেছেন। বিষয় সূচীর মধ্যে প্রথম অধ্যায়-ভূমিকা, দ্বিতীয় অধ্যায়-বিভিন্ন বংস সাহিত্যের রচনাবলি এবং আলোচিত বিষয়, তৃতীয় অধ্যায়-বংস সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয়, চতুর্থ অধ্যায়-বংস সাহিত্যে বর্ণিত প্রমুখ ঘটনাসমূহের তুলনামূলক আলোচনা, পঞ্চম অধ্যায়-ভারতীয় অভিলেখ এবং বংস সাহিত্য, ষষ্ঠ অধ্যায়- পালি সাহিত্যের ইতিহাসে বংস সাহিত্যের অবদান, সপ্তম অধ্যায়-উপসংহার।

তাঁর এই গ্রন্থটি পালি সাহিত্য তথা বৌদ্ধ অধ্যয়নরত পড়ুয়া তথা বৌদ্ধ সাহিত্য নিয়ে পঠনপাঠন করতে মুমুক্ষুজন তাঁদের জন্য অত্যন্ত উপাদেয় একটি গ্রন্থ বিশেষ। গ্রন্থটি ভাষাশৈলী অত্যন্ত উন্নত যা প্রশংসার দাবী রাখে। গ্রন্থটি পাঠ করে পাঠক পালি সাহিত্যের তথা বংস সাহিত্যের স্বাদ আস্বাদন করতে পারবে। গ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করি। অলং ইতি বিত্থারেন।

বিদর্শন শিক্ষাকেন্দ্র শ্রাবণী পূর্ণিমা ২৫৬৬ বুদ্ধাব্দ কোলকাতা

সুমনপাল ভিক্ষু

অতিথি অধ্যাপক পালি বিভাগ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

 

No comments:

Post a Comment