সুমনপাল ভিক্ষু
প্রথম সঙ্গীতি :
নলিনাক্ষ দত্ত যথার্থই দেখিয়েছেন যে বুদ্ধের মৃত্যুর পর বৌদ্ধধর্মের বিকাশের চারটি পর্যায় চিহ্নিত হয়েছিল চারটি সঙ্গীতি দ্বারা (আবৃত্তির সম্মেলন)। পালি ঐতিহ্য অনুসারে প্রথম সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিলো বুদ্ধের মৃত্যুর পর রাজগৃহে অজাতশত্রুর ব্যবস্থাপনায় পরবর্তী বর্যাবাসের সময়ে অর্থাৎ পরিনির্বাণের মাত্র তিনমাস পর ; কারণ পরিনির্বাণ ঘটেছিলো বৈশাখ মাসে, বর্ষাবাস শুরু হয়েছিল আষাঢ় মাসে এবং সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিলো শ্রাবণ মাসে। চুলবগ্গের একাদশ খন্ডে সংরক্ষিত ঐতিহ্যটিকে অততত সাহিত্যে যেমন দীপবংশ, মহাবংশ ও চৈনিক পর্যটকের বিবরণীতে প্রামাণ্য বলে গ্রহণ করা হয়েছে। এদ্বারা লিপিবদ্ধ রয়েছে যে সুভদ্দ নামে একজন ভিক্ষু বিলাপরত ভিক্ষুদের এই কথা বলে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন যে বুদ্ধের মৃত্যুর ফলে তাদের দুঃখপ্রকাশ করা উচিত নয় কারণ এতে তারা একজন নির্দয় গুরুর হাত থেকে মুক্তি পেয়েছেন। এই শ্রদ্ধাহীন মন্তব্যটি মহাকাশ্যপকে ধম্মের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বিগ্ন করেছিলো।এর ফলে তিনি প্রধান ভিক্ষুদের নিয়ে একটি সঙ্গীতি আয়োজনের প্রস্তাব দেন, যার উদ্দেশ্য ছিল ধম্মেট বিশুদ্ধতা ও নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য বুদ্ধের শিক্ষার একটি সংকলন প্রস্তুত করা। এই বিষয়ে সকলে একমত যে সঙ্গীতে অংশগ্রহণের জন্য নির্বাচিত ভিক্ষুর সংখ্যা ছিল পাঁচশ। প্রথমে আনন্দকে এই ভিক্ষুদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি কারণ তিনি কিন্তু শেষপর্যন্ত ভিক্ষুদের প্রচেষ্টায় মহাকাশ্যপ তাকে অন্তর্ভুক্ত করেন।যারা এই যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে অর্হৎ না হলেও আনন্দ স্বয়ং বুদ্ধের কাছ থেকে ধম্ম ও বিনয় শিক্ষা করেছিলেন। এছাড়াও একথা লিপিবদ্ধ রয়েছে যে প্রথম সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বই তিনি অর্হত্ব লাভ করেছিলেন। কোন কোন গ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে যে ধম্ম ও বিনয় আবৃত্তির পর আনন্দের বিরুদ্ধে কিছু কিছু অভিযোগ করা হয়েছিলো। কিন্তু দীপবংশ, মহাবংশ, বুদ্ধঘোষের সামন্তপসাদিকা ও মহাবস্তুতে তার ব্যর্থতার কোন উল্লেখ নেই। এই সঙ্গীতিতে মহাকাশ্যপ সভাপতিত্ব করেন এবং আনন্দ ও উপালি আবৃত্তিতে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেন। মর্তাদর্শের বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি বললেই চলে।সাধারণভাবে মনে করা হয় যে এই সঙ্গীতিতে ধম্ম ( আনন্দ যেটি আবৃত্তি করেছিলেন) এবং বিনয় ( উপালি যেটি আবৃত্তি করেছিলেন) নির্ধারিত হয়। অর্থঘোষের সুমঙ্গল বিলাসিনীর দাবী মত এমন কথা বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই যে প্রথম সঙ্গীতিতে অভিধম্ম ধম্মের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
প্রথম সঙ্গীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এই যে এখানে বুদ্ধের পূর্বতন সারথি চন্নকে চরম দণ্ড ( ব্রক্ষ্মদণ্ড) দান করা হয়েছিল। ভিক্ষু হিসেবে জ্যেষ্ঠ কনিষ্ঠ সমস্ত ভিক্ষুকে অপমান করেছিলেন এবং চরম অহংকারী ছিলেন। তাকে সামগ্রিকভাবে সম্পূর্ণ একঘরে করা হয়। যখন এই শাস্তি ঘোষণা করা হয় তখন তিনি গভীরভাবে অনুতপ্ত হয়ে অর্হত্ব লাভ করেন।
আধুনিক পন্ডিতদের মধ্যে প্রথম সঙ্গীতি স্বরূপ ও ঐতিহাসিকত্ব নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এ কথা ভাবা অসম্ভব যে ধম্ম ও বিনয় ধম্মের এই দুটি বিশাল অংশ দুতিন মাস সময়ের মধ্যে নিরূপিত ও নির্ধারিত হয়। সেটি করতে তৃতীয় সঙ্গীতির সময় লেগেছিল নয় মাস (অভিধম্মসহ)। যেহেতু মহাপরিনির্বাণ সুত্তে এর উল্লেখ পাওয়া যায় না তাই Oldenglerg ও Franke এটিকে সম্পূর্ণ কল্পনা মনে করেন। Rhys Danids এই যুক্তির পূণরাবৃত্তি করেছেন যদিও জোরালোভাবে নয়। কিন্তু Jacoli দেখিয়েছেন যে মহাপরিনির্বাণ সুত্তে এই সঙ্গীতির বর্ণনা দেয়া কোনো প্রয়োজন ছিলো না।কোন কোন পণ্ডিতের মধ্যে চুলবগ্গ XI আদিতে মহাপরিনিব্বাণ সুত্তের একটি অংশ ছিলো এবং পরবর্তী পর্যায়ে এটিকে মহাপরিনির্বান সূত্ত থেকে বিচ্ছিন্ন করে চুলবগ্গের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। সংযুক্তবস্তু নামে একটি গ্রন্থ পরিনিব্বাণ ও সঙ্গীতির বিবরণ রয়েছে। এই বিষয়টি এই মতকে শক্তিশালী করে, কিন্তু প্রথম সঙ্গীতির ঐতিহাসিকত্ব স্বীকার করে নেওয়ার অর্থ এটি সমস্ত কার্যবিবরণীকে স্বীকার করে নেওয়া নয়।
Pousrin এর মতে এটি একটি বিস্তৃত আকারের প্রতিমোক্ষ সম্মেলন ছিলো মাত্র। Minayeff এর মতে সঙ্গীতির বিবরণীর মধ্যে দুটি পৃথক অংশ রয়েছে যার মধ্যে উপদেশের সংকলন সম্প্রদায়গুলির উত্থানের পরে ঘটেছিলো। অতএব আমরা G C Pande এর সঙ্গে একমত হয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যদিও প্রথম সঙ্গীতিটকে এখন আর কল্পনা বলে মনে করা সম্ভব নয়।এটির প্রকৃতি ও কার্যাবলী এখনও অনিশ্চিত।
দ্বিতীয় সঙ্গীতি :
বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের একশতক থেকে ১১০ বছর পর দ্বিতীয় সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিলো (অর্থাৎ ৩৮৩:খ্রী: পূ বা ৩৭৩ খ্রী : পূ)। এটির সর্বপ্রাচীন ইতিহাসপ্রদানকারী চুলবগ্গ XI। এটির কারণ ছিল পূবদেশীয় নামে পরিচিত বৈশালীর সেই অব্দি ভিক্ষুদের গৃহীত একটি স্বাধীনতা। যারা দশটি বস্তু অনুসরণ করতেন যেটিকে (দশবঠ্ঠুনি) পাশ্চাত্যবাসীরা বৌদধর্মের বিরোধী মনে করতেন। এই দশটি বস্তু ছিলো (১) একটি শিঙায় প্রয়োজনের জন্যে লবণ রাখা (২) মধ্যাহ্নের পর আহার গ্রহণ (৩) পাশ্ববর্তী একটি গ্রামে আহার গ্রহণের ফলেঅতিরিক্ত ভোজন (৪) কোনো একটি কাজ করার পর সংঘের অনুমোদন গ্রহণ (৫) একই সীমার মধ্যে বিভিন্ন স্থানে উপোসথ পালন (৬) প্রচলিত রাজনীতিকে কোন কাজের অনুমোদনকারী বলে মনে করা (৭) ভোজনের পর মাখন দুধ পান করা (৮) রেখাবিহীন কম্বল ব্যবহার করা (৯) তাড়ি পান করা (১০) স্বর্ণ রৌপ্য গ্রহণ করা। এই সমস্ত বিষয়গুলোর মধ্যে শেষ বিষয়টি অর্থাৎ সংঘকে অর্থদান ছিলো বিনয়ের সকল সংস্করণ এবং A.K. Warder এর মত আধুনিক পন্ডিতদের মতে উদ্বেগের প্রধান কারণ। পাশ্চাত্য ভিক্ষু থের যশ যিনি বৈশালীতে আগমন করেছিলেন এই দশ প্রকার বিনয় বহির্ভূত নিয়মের সমালোচনা করেন এবং এগুলিকে বেআইনি ও অনৈতিক বলে ঘোষণা করেন। এর ফলে বার্মানিবাসী ভিক্ষুগণ তাঁকে পতিসরণিয়কম্ম অপরাধে দণ্ডিত করেন এবং যখন তিনি গৃহী সম্প্রদায়ের সামনে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন। তাঁকে তখন উপেক্ষনীয়কম্ম ( যেটি সংঘ থেকে বহিস্কার করা বোঝায়) দণ্ড দেওয়া হয়। তারপর যশ কোসাম্বীতে গিয়ে বিষয়টি আলোচনার জন্য পশ্চিম ও দক্ষিণ অঞ্চলের সমস্ত ভিক্ষুদের আমন্ত্রণ জানান। এছাড়াও তিনি অঘেোরঘন্টার পর্বতের তদন্ত সম্ভুত সনবাসী এবং সোরেয়ার - ভদন্ত রেবতের সঙ্গে যোগাযোগ করেন যাঁরা প্রত্যেকেই দশ বস্তুকে অবৈধ বলে ঘোষণা করেন। এখন রেবতের পরামর্শে ভিক্ষুগণ বৈশালীর উদ্দেশ্যে রওনা হন যেখানে এই বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছিল। সেখানে ভদন্ত সব্বকম্মীর সভাপতিত্বে সাতশ জন ভিক্ষু একটি সভায় অংশগ্রহণ করে সেখানে সর্বসম্মতভাবে বন্দিয় ভিক্ষুদের আচরণকে নিয়মবহির্ভূত ঘোষণা করা হয়।
এটি চুলবগ্গ XII এ প্রদত্ত দ্বিতীয় সঙ্গীতির বিবরণ। দীপবংশ ও সামন্তপসাদিকা অনুসারে দ্বিতীয় সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিলো রাজা কালাশোকের আমলে। দীপবংশে বলা হয়েছে যে বৈশালীর ভিক্ষুরা অপর একটি সভায় মিলিত হয়েছিলেন।এটিকে মহাসঙ্গীতি বলা হয়।মহাবংশের মতে সাতশজন থেরের সম্মেলনে ধম্ম সংকলিত হয়।অশ্বঘোষের সামন্তপসাদিকার মতে চূড়ান্ত রায়দানের পর সাতশজন ভিক্ষু ধম্ম ও বিনয় আবৃত্তি করেন এবং তাদের নতুন সংস্করণটি লিপিবদ্ধ করেন যেটি সেই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক ছিল।সঙ্গীতির চৈনিক ও তিব্বতীয় সংস্করণে সঙ্গীতি সম্পর্কে কিছু মতভেদ রয়েছে কিন্তু সঙ্গীতির উৎপত্তি সেখানে আলোচিত বিষয় ও সিদ্ধান্ত সম্পর্কে মতৈক্য রয়েছে।ওল্ডেন বাগ এই সঙ্গীতির বিশুদ্ধতা সম্পর্কে সন্দিহান। এই সঙ্গীতির ঐতিহাসিকত্ব সম্পর্কে তাঁর সন্দেহ ও এই প্রসঙ্গে Jaeobi এবং অন্যান্যদের প্রদত্ত উত্তর প্রথম সঙ্গীতির মত এক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আধুনিক পন্ডিতদের মতে দ্বিতীয় সঙ্গীতিটির আমল বলে বিবেচিত হওয়ার সমস্ত কারণ রয়েছে। এর ফলে বৌদ্ধ সংঘে বিভাজন ঘটে এবং মহাসাংঘিকরা সংঘ ত্যাগ করেন এবং এই ঘটনাটি পরবর্তীকালের তথ্য প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত হয়।
পরিনির্বাণের ২৩৬ বছর পর অশোকের ব্যবস্থাপনায় পাটলিপুত্রে তৃতীয় সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়।
ত্রিপিটকে এর উল্লেখ পাওয়া যায় না। এর সর্বপ্রাচীন উল্লেখ মেলে দীপবংশ, মহাবংশ ও সামন্তপসাদিকায়। এটির আয়োজন হয় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উত্থানের ফলে ধম্মের বিশুদ্ধতা রক্ষার প্রয়োজনে।এছাড়াও অশোকের ধর্মান্তরণের ফলে মঠগুলির পার্থিব সমৃদ্ধির প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। এর পরিণামে অনেক বিরুদ্ধ ধর্মালম্বী যারা তাদের আয় ও সম্মান হারিয়েছিলো। তারাও সংঘে প্রবেশ করে। তারা পীতবস্ত্র পরিধান করত কিন্তু তারা তাদের পূর্ববর্তী ধর্মবিশ্বাস ও আচার অনুষ্ঠান পালন করত এবং তাদের প্রচলিত ধর্মমত বিরোধী মতাদর্শকে বুদ্ধের মতাদর্শ হিসেবে প্রচার করতো।সংঘের শৃঙ্খলার এতো অবনতি ঘটেছিলো যে ধার্মিক ভিক্ষুরা সাত বছর ধরে উপোসথ ও পবারনের সংঘে যুক্ত আচার অনুষ্ঠানগুলি পালিত হতে পারেনি।যখন রাজা এটি জানতে পারলেন তখন তিনি অত্যন্ত দুঃখ পেলেন। তিনি অশোকারামে তাঁর প্রতিনিধি পাঠিয়ে আদেশ দিলেন যাতে তাঁরা অভ্যন্তরীণ মতভেদকে দূর করে আচার অনুষ্ঠানগুলি পালন করে। যাইহোক ভিক্ষুরা প্রচলিত ধর্মমতের বিরোধীদের সঙ্গে উপোসথ পালন করতে অস্বীকার করলেন। তাদের অবাধ্যতায় ক্রুদ্ধ হয়ে সেই প্রতিনিধি দুয়েকজন ভিক্ষুর মুণ্ডছেদ করলেন। শুধুমাত্র যখন তিনি ভিক্ষুদের মধ্যে রাজার নিজের ভাইকে দেখতে পেলেন তখনই তিনি সেই গণহত্যা বন্ধ করলেন এবং ফিরে গিয়ে অশোকের কাছে ঘটনাটি জানালেন। দুঃখিত হয়ে অশোক সংঘে গেলেন এবং খুঁজতে লাগলেন কে এই সমস্ত কিছুর জন্য দায়ী। কিন্তু তিনি দেখলেন ঘটনাটি নিয়ে ভিক্ষুদের নিজেদের মধ্যেই মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেছিলেন এর জন্য দায়ী রাজা। কেউ কেউ মনে করেছিলেন রাজা ও তাঁর প্রতিনিধি আবার কেউ কেউ মনে করেছিলেন অন্য কেউ। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন একমাত্র মোগলীপুত্তই এই ব্যাপারে সন্দেহ নিরসন করতে পারেন সেই সময়ে মোগলীপুত্ত তিষ্য গিয়েছিলেন অহোগঙ্গ পর্বতে সেখানে তিনি বিরুদ্ধবাদীরা সংঘে যোগ দেওয়ার পরেই আশ্রয় নিয়েছিলেন।সম্রাট তিষ্যকে পাটলীপুত্রে ফিরে আসতে রাজী করালেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন অশোকারামে ভিক্ষুদের মৃত্যুর জন্য তিনি দায়ী কিনা। তিষ্য তাকে বললেন উদ্দেশ্য ছাড়া কোন অপরাধ হয় না। রাজা এই উত্তর শুনে সন্তুষ্ট হলেন। তারপর এক সপ্তাহ ধরে তিষ্য রাজাকে বুদ্ধের শিক্ষা ব্যাখ্যা করলেন।
এরপর রাজা তাঁর আরামে গেলেন এবং সমস্ত বৌদ্ধ ভিক্ষুদের এক সম্মেলন আহ্বান করলেন। দীপবংশ (VII 50) অনুসারে এই সম্মেলনে বুদ্ধের ৬০০০০ বিশ্বস্ত অনুগামী অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিষ্যর সঙ্গে সম্রাট তাঁদের বুদ্ধের শিক্ষার মূল কথা সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন(Kimvadu sugato), যারা বিরুদ্ধবাদী বলে প্রমাণিত হয়েছিলেন সংঘ থেকে বহিষ্কার করেছিলেন এবং ধার্মিক ভিক্ষুদের প্রশ্ন করেছিলেন "বুদ্ধ কী শিক্ষা দিয়েছিলেন?" এর উত্তরে তিনি শুনলেন, "তিনি বিভাজ্যের শিক্ষা দিয়েছিলেন।" তিষ্য এই উত্তরের যথার্থতাকে স্বীকার করেছিলেন (বিভাজ্যবাদ) এবং আনন্দিত রাজা যিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে তিনি বৌদ্ধ সংঘকে পরিশুদ্ধ করেছেন।তিনি ফিরে গেলেন এবং পিছনে রয়ে গেলেন তিষ্য, যিনি সংঘের ঐক্যের নেতা ছিলেন।এখন ভিক্ষুরা উপোসথ অনুষ্ঠান পালন করতে পারছিলেন। মহাকাশ্যপও যশের দৃষ্টান্তকে অনুসরণ করে আরেকটি সম্মেলন (সঙ্গীতি) আহ্বানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন (মহাবংশের মতে অশোকের রাজত্বকালে সপ্তদশ বর্ষে)। তিনি তিনটি পিটকে পারদর্শী একহাজার জন পণ্ডিত ভিক্ষুকে নির্বাচন করলেন যাদের সাহায্যে তিনি প্রকৃত শিক্ষা (সদ্ধম্ম) কে পুনঃস্থাপিত করবেন।নয় মাস ধরে কার্যকর থাকা সঙ্গীতিতে তাঁর কথাবত্থু পকরন পঞ্চরন পেশ করেন - সেখানে তিনি ধর্মবিরোধী দর্শনগুলিকে পরীক্ষা করে খণ্ডন করেন।
সঙ্গীতিটির অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ ফলাফল হলো ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য ধর্মপ্রচারক ভিক্ষুদের প্রেরণ। অশোকের পুত্র ও কন্যা যথাক্রমে মহিন্দ্র ও সংঘমিত্রাকে এই উদ্দেশ্যে সিংহলে প্রেরণ করা হয়।
Keith তৃতীয় সঙ্গীতির পুরো বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। এই বিষয়ে অশোকের আদেশনামাগুলির ত্রিপিটক ও চৈনিক পরিব্রাজকদের নীরবতাকে এর ঐতিহাসিকত্বের বিরুদ্ধে প্রধান প্রমাণরাপে পেশ করা হয়। এই দাবিও করা হয় যে অশোক কোন একটি বিশেষ গুষ্টিকে সমর্থন করতে পারেন না। N. Dutta ও Keith এর মতে যে সঙ্গীতিটি ছিল বিশেষ একটি সম্প্রদায়ের এবং ও অশোক ও তাঁর মন্ত্রীদের এর সঙ্গে কোন যোগাযোগ থাকতে পারেনা। D.R. Bhandankar বলেন অশোক তাঁর বিভাজন আদেশনামতে স্পষ্টভাবে বলেছেন যে প্রচলিত ধর্মমত বিরোধী ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের বিচার হবে এবং এটিই ছিলো ঐতিহ্য অনুসারে ঐ সঙ্গীতির প্রধান উদ্দেশ্য। এমনও হতে পারে যে অশোক তার আদেশনামাগুলিতে তৃতীয় সঙ্গীতির কথা উল্লেখ করার মত কোন অবকাশ পাননি। আবার G.C Pande'র মত যে অশোক হয়তঃ তৃতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে ততটা ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন না পালি ঐতিহ্যে যতটা দাবি করা হয়েছে। কথাবথুর প্রসঙ্গে বর্তমানে এই বিষয়ে সহমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে এটি একবারে তৈরি হয়নি। তিষ্যের দ্বারা এর সংকলন শুরু হলেও শেষ হয়নি।
সম্প্রতি
Bonoard -Lenin তৃতীয় সঙ্গীতির ঐতিহাসিকত্ব নিয়ে পরীক্ষা করেছেন নতুনভাবে। তিনি দেখিয়েছেন যে তৃতীয় সঙ্গীতির সঙ্গে যুক্ত ঘটনাগুলির মধ্যে কোন অসম্ভাব্যতা নেই। প্রথম ও দ্বিতীয় সঙ্গীতির ইতিহাস থেকে জানা যায় যে বৌদ্ধ ও তাদের বিরোধীদের মধ্যেই শুধু নয়, প্রাক অশোক যুগে বৌদ্ধ সংঘের মধ্যেও মতভেদ ছিল। অশোকের যুগেও বাহ্যিকভাবে সংঘ ঐক্যবদ্ধ ছিল না, এটি ছিল এমন একটি সংগঠন যেখানে ভিক্ষুদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্বের ঘটনা ঘটতো এবং সঙ্গের গঠন এবং দর্শনের বিষয়েই বিভিন্ন বিতর্ক উপস্থিত হতো। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ক্রমশ গণতন্ত্রীকরণ কঠোর নিয়মকানুনের ক্রমশ শিথিল হয়ে যাওয়া, সেই সমস্ত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আবির্ভাব, যারা মূল শিক্ষাকে তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করেছিল এবং এই সমস্ত সম্প্রদায়ের অনুগামীদের ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানান্তরিত হওয়া __এই সমস্ত কিছুই সংঘের পূর্বেকার ঐক্যের অবনতি ঘটিয়ে বৌদ্ধ মঠগুলিতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতাদের আবির্ভাবের পথকে প্রশস্ত করেছিল। এমনও হতে পারে যে অন্যান্য সম্প্রদায়ের ভিক্ষুরা যারা থেরবাদের গোঁড়া দৃষ্টিকোণ প্রচলিত ধর্মমতবিরোধী ছিল তারাও অশোকারামে প্রবেশাধিকার পেয়েছিল। এর ফলে সিংহলীহ গ্রন্থে উল্লেখিত উপোসথসহ কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের যৌথ সংগঠনের কোন সুযোগ ছিল না। Bongard -Lenin এই দাবীও করেছেন যে অশোকের শাসনের পূর্বে ও দেশে কি হচ্ছে সেই বিষয়ে সাম্রাজ্য উদাসীন ছিল না।দিব্যাবদানের অশোকাবদানে পুণ্ড্রবর্ধন ও পাটলিপুত্রে বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহের উল্লেখ রয়েছে। এই সমস্ত হিংসার প্ররোচনাদাতা আজীবকগণ বৌদ্ধধর্মের অন্যান্য বিরোধীদের সঙ্গে নিহত হন এবং রাজার নিজের ভাই বৌদ্ধধর্মের বিশ্বস্ত অনুগামী বীতশোকের দুর্ঘটনাক্রমে শিরশ্ছেদ হয়।এর ফলে অশোক রক্তপাত থামাবার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হন। গ্রন্থটির চৈনিক ভাষ্যকারদের মতে প্ররোচনাদাতারা ছিল নির্গ্রন্থক, আজীবকরা নয়। তাদের অনেককেই হত্যা করা হয়েছিল যাদের মধ্যে ছিলেন রাজার ভাই যাকে ভুলবশত নির্গ্রন্থ বলে মনে করা হয়েছিল।এরপর রাজা শ্রমণদের হত্যা নিষিদ্ধ করে একটি বিশেষ আদেশনামা জারি করলেন যদিও A L Besham উত্তরের বৌদ্ধ ঐতিহ্যের তথ্যপ্রমাণকে অবিশ্বাস্য বলে উড়িয়ে দিতে আগ্রহী Bongard- Lenin মনে করেন যে অশোক এবং সম্প্রদায়ের সদস্যদের মধ্যে কারণ ছিল তার রাজত্বের শেষের বছরগুলিতে অশোকের ধর্মনীতিতে পরিবর্তন। উভয় ক্ষেত্রেই এই প্রমাণ পাওয়া যায় যে দ্বন্দ্ব নিরসনে রাজা হস্তক্ষেপ করেছিলেন এবং উভয় ঐতিহ্যেই রাজার ভাইকে দেখতেওপাওয়া যায়। তবে দক্ষিণের পালি ও উত্তরের ঐতিহ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য দেখা যায়।যদিও গোঁড়া বৌদ্ধ ও তাদের শত্রুদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব পরবর্তী (সংঘের শুদ্ধিকরণ এবং তৃতীয় সঙ্গীতি আহ্বান) র ভূমিকা হিসেবে কাজ করে। উত্তরের ঐতিহ্যে সঙ্গীতিটির কোন উল্লেখ নেই।
Bongard - Leven সাহিত্যিক কাহিনী ও পূর্বতাত্ত্বিক তথ্যের মধ্যে অনেকগুলি সাদৃশ্যের উল্লেখ করেছেন।(১)বিভাজনবাদীদের সংঘ থেকে বহিষ্কার করার প্রয়োজন বিষয়ে আদেশ নামা জারি প্রতিবেদনের সঙ্গে ব্রক্ষ্মদেশীয় ও সিংহলিও সূত্রের সাদৃশ্য রয়েছে। এর প্রত্যক্ষ সাদৃশ্য মেলে বুদ্ধঘোষের রচনায়। (২) মহাবংশ ও বুদ্ধঘোষের তথ্য প্রমাণের (সংঘের শুদ্ধিকরণ ও ঐক্যস্থাপন তথ্যের সঙ্গে Scheism ediet এর তথ্যের হুবহু মিলে যায় (Sangho Samaggo Hutnana)। সাঁচি সংস্করণ থেকে এই অনুমান করা যায় যে আদেশনামাটি জারি করা হয় সংঘের বিভাজনের পর যখন সংঘের ঐক্য পুঃস্থাপিত হয় এবং বিরোদ্ধবাদীদের সঙ্গ থেকে বহিষ্কার করা হয়। (৩) ইতিবৃত্ত (মহাবংশ) ও বুদ্ধঘোষ উপোসথ পালনকে সংঘের ঐক্য পুনঃস্থাপিত হবার সঙ্গে যোগ করেছেন। (Sangho samaggo hutnana ladakasi uposatham : samaggo sangho sannipathina
upasatham akase) Schesm আদেশনামা মতে উপসথ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে উপসথের দিন গৃহীদের এসে রাজকীয় আদেশনামার সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ দেওয়া হোক। প্রতিটি মহামাত্রকে উপোসথের দিন এসে আদেশনামা ও তার ব্যাখার সঙ্গে পরিচিতি হতে দেওয়া হোক। দীপবংশ ও Schesm ediet উভয়ই অশোককে ঐক্যের রক্ষক আখ্যা দেওয়ার ব্যাপারে সহমত পোষণ করেছে।
ইতিবৃত্ত ও আদেশনামার মধ্যে এই সাদৃশ্য গুলি আহ্বানের পূর্ববর্তী ঘটনাগুলির সত্যতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কিন্তু যেমন করে পাটলিপুত্রে অনুষ্ঠিত তৃতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতিটি সম্পর্কে সিংহলীয় বিবরণকে এই আলোকে ব্যাখ্যা করা যাবে। Bongard -Leven এই সমস্যার সমাধানে ইতিবৃত্তে লিপিবদ্ধ দুটি বিষয়কে উল্লেখযোগ্য বলে মনে করা হয়। সঙ্গীতিটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল অশোকের অধীনে এবং এটি ও পরিচালনা করেছিলেন মোগলিপুত্ত তিষ্য। মহাবংশ অনুসারে উদাহরণস্বরূপ রাজপ্রতিনিধি দ্বারা বৌদ্ধ বধ হওয়ার সপ্তম দিনে অশোক এ মঠে আসেন এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুদের একটি পরিপূর্ণ সঙ্গীতি আহ্বান করেন। এই -------জমায়েতে ( Bhikkhasanahassa samapanipata) তিনি বৌদ্ধের শিক্ষার যথার।যথার্থ অর্থ উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়েছিলেন। বিরুদ্ধবাদী দার্শনিকদের সংতত্যায়িত করে তাদের অনুগামীদের সঙ্গ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। সংঘের শুদ্ধিকরণ সদ্ধর্ম অশোক করে শুদ্ধিকরণ সম্পূর্ণ করে অশোক তিষ্যকে তার রক্ষক নিযুক্ত করলেএবং পাটলিপুত্র ফিরে গেলেন।কিছু সময় পর তিষ্য একহাজার জন শিক্ষিত ভিক্ষুকে নির্বাচন করে একটি সঙ্গীতি আহ্বান করলেন যেখানে প্রকৃত ধর্ম গ্রহণ করা হলো। তাই Bingard Leven যুক্তি দেখিয়েছেন এমনকি ইতিবৃত্তগুলিতে দুটি ঘটনার মধ্যে সম্পষ্ট পার্থক্য করা হয়েছে ঃ অশোকের অধীনে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সভা সেখানে বুদ্ধের শিক্ষা এবং সংঘের ঐক্য আলোচিত হয়, মোগলিপুত্ত তিষ্যের অধীনে আয়োজিত সঙ্গীতি সেখানে তিনি কথাবত্থু পেশ করেন। এই বিষয়টি এই ঘটনা থেকেও স্পষ্ট হয়ে যায়।অশোকের অধীনে আয়োজিত সঙ্গীতিটিকে বলা হয় সমনিপাত এবং তিষ্য দ্বারা আহূত সম্মেলনটিকে বলা হয় সঙ্গপাত।
দক্ষিণের ঐতিহ্যের "সঙ্গপতি" শব্দটিকে প্রথম ও দ্বিতীয় সম্মেলনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে.।সূত্রগুলির মধ্যে তুলনা করলে দেখা যায় ভিক্ষুদের সম্মেলনের সঙ্গে যুক্ত ইতিবৃত্তে থাকা প্রমাণগুলো উভয়ের এর ঐতিহ্যে প্রাপ্ত অশোকের অধীনে আয়োজিত _বর্ষের বিববরণের সঙ্গে মিলে যায় যার ফলে দক্ষিণের সঙ্গে সংঘস্যসমনিপাতের তথ্যের সঙ্গে অশোকাবদান ও অশোকাবদানমালা এবং _বর্ষিকা সংক্রান্ত তাবনিয়ার্থের বিবরণ মিলে যায়।অশোকাবদান অনুসারে সম্রাট সংঘের একটি পাঁচ বছরের সম্মেলন ( Panahavar shikam vrtam) আহ্বান করেন এবং সঙ্গে প্রচুর অর্থ করেন। তারানাথ উল্লেখ করেছেন অশোকের রাজত্বকালে বৌদ্ধ সংঘে এই ধরনের তিনটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল (তার বিবরণে কোন উল্লেখ নেই)।কুমারজীবের চৈনিক গ্রন্থেও বলা হয়েছে যে অশোক পাঁচ বছরের একটি বৃহৎ সভা আহ্বান (_) করেছিলেন যেখানে ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়গুলি আলোচিত হয়েছিলো। অনেক সূত্রে ঘটনাগুলিকে সঙ্গপতির সঙ্গেও যুক্ত করা হয়েছে এবং এর ফলে অশোকের -অধীনে আয়োজিত ___ সংক্রান্ত প্রাচীনতর প্রামাণিক ঐতিহ্য এবং সেই এর প্রতিবেদনটির মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে যেটিকে সিংহলীও বিভাজ্যবাদী সম্প্রদায়ের অনুগামীরা পরবর্তীকালে এমন একটি কাহিনীতেও পরিবর্তন করেছেন যেখানে অশোক স্বয়ং অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে তাঁরা দাবি করেছেন।
এইভাবে
Bingard -Levin এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে উভয়ের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক বিভাজ্যবাদী সম্প্রদায় ও উত্তরের বৌদ্ধ সম্প্রদায় এবং পরবর্তীকালের তিব্বতীয় ঐতিহাসিক তারানাথ সকলেই বৌদ্ধ সংঘের একটি সঙ্গীতির বিবরণ দিয়েছেন বা অশোক কর্তৃক সংঘের একটি আনুষ্ঠানিক আলোচনাসভা। যার উদ্দেশ্য ছিল সাংগঠনিক বিষয়বস্তু আলোচনা করা ও ঐক্য বজায় রাখা। একজন বিভাজ্যবাদী সম্প্রদায়ের অনুগামীরা ও বুদ্ধঘোষ যিনি তাঁদের অনুসরণ করেছিলেন সঙ্গীতি সংক্রান্ত এই কাহিনীটি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। যেটি উত্তরের ঐতিহ্য বা অশোকের শিলালিপি কোথাওই উল্লেখিত হয়নি। বিভাজ্যবাদীরা নিজেদের অধিকতর প্রাচীন সম্প্রদায়রূপে প্রমাণ করা এবং তাদের সম্প্রদায়ের প্রতি অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করার জন্য এটিকেই বুদ্ধের প্রকৃত শিক্ষারূপে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছে। অতএব তাঁরা তাদের ইতিবৃত্তে এমন একটি সঙ্গীতির উল্লেখ করেছেন যেখানে এই দাবি করা হয়েছে যে তিষ্য বুদ্ধের ধম্মের একটি সংহতরূপ দান করেন এবং তার কথাবত্থু পকরণ জনসম্মুখে প্রচার করেন। এমন হওয়াও অতি সম্ভব যে এই সম্প্রদায়ের পরবর্তীকালের ____কেরা তিষ্যকে এই গ্রন্থটি রচনার কৃতিত্ব দিয়েছিলেন কারণ এই মিশ্র ধরনের রচনাটি তার প্রাচীনত্ব সত্বেও মোটের উপর রচিত হয়েছিল মৌর্য যুগের অনেক পরবর্তীকালে।
সর্বপ্রাচীন
সিংহলীয় ইতিবৃত্ত ' দীপবংশ ' এ দুটি ঘটনাকে (সংঘের সম্মেলন এবং তিষ্যের সভাপতিত্বে তথাকথিত সঙ্গীতি) পৃথক করা হয়েছে, কিন্তু মহাবংশ দুটি বিষয়কে করে একত্রিত করে সঙ্গীতির তথাকথিত কাহিনী নির্মাণ করা হয়েছে এবং মহাবংশেরই এটির সংগঠনের অশোকের ভূমিকার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সম্রাটের (সংঘস্য সমনিপাত) অধীনে ভিক্ষুদের সভা সংক্রান্ত তথ্য বা সংঘে তিনি যে সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন (__বর্ষ) যেটির ঐতিহাসিকত্ব যথেষ্ট প্রমাণের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসবই সিংহলীয় ইতিবৃত্তদ্বারা পরিবর্তনরূপে বা তৃতীয় সঙ্গীতির একটি রূপ নির্মাণের কার্যে ব্যবহৃত হয়েছিল, যেখানে তিষ্য তাঁর কথাবত্থুকে জনসমক্ষে পেশ করে সেই প্রবণতার নিন্দা করেছেন যেটি বিভাজ্যবাদীদের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রচলিত ধর্মমতের বিরোধী ছিল।
এর ফলস্বরূপ তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীতের প্রতিবেদন যেটি যেটি একদেশদশী সিংহলীয় ঐতিহ্য থেকে উৎপন্ন একটি প্রকৃত ঘটনা থেকে বিভাজ্যবাদীরা সৃষ্টি করেছিলেন।মনে হয় প্রকৃত ঘটনাটি ছিল অশোকদ্বারা আহত ভিক্ষুদের একটি সভা (উত্তরের ঐতিহ্যের ____বর্ষ) যার উদ্দেশ্য ছিল বৌদ্ধ সংঘে উৎপন্ন কিছু সমস্যার সমাধান করা।
পরিনির্বাণের ২৩৬ বছর পর অশোকের ব্যবস্থাপনায় পাটলিপুত্রে তৃতীয় সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়।
ত্রিপিটকে এর উল্লেখ পাওয়া যায় না। এর সর্বপ্রাচীন উল্লেখ মেলে দীপবংশ, মহাবংশ ও সামন্তপসাদিকায়। এটির আয়োজন হয় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উত্থানের ফলে ধম্মের বিশুদ্ধতা রক্ষার প্রয়োজনে।এছাড়াও অশোকের ধর্মান্তরণের ফলে মঠগুলির পার্থিব সমৃদ্ধির প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। এর পরিণামে অনেক বিরুদ্ধ ধর্মালম্বী যারা তাদের আয় ও সম্মান হারিয়েছিলো। তারাও সংঘে প্রবেশ করে। তারা পীতবস্ত্র পরিধান করত কিন্তু তারা তাদের পূর্ববর্তী ধর্মবিশ্বাস ও আচার অনুষ্ঠান পালন করত এবং তাদের প্রচলিত ধর্মমত বিরোধী মতাদর্শকে বুদ্ধের মতাদর্শ হিসেবে প্রচার করতো।সংঘের শৃঙ্খলার এতো অবনতি ঘটেছিলো যে ধার্মিক ভিক্ষুরা সাত বছর ধরে উপোসথ ও পবারনের সংঘে যুক্ত আচার অনুষ্ঠানগুলি পালিত হতে পারেনি।যখন রাজা এটি জানতে পারলেন তখন তিনি অত্যন্ত দুঃখ পেলেন। তিনি অশোকারামে তাঁর প্রতিনিধি পাঠিয়ে আদেশ দিলেন যাতে তাঁরা অভ্যন্তরীণ মতভেদকে দূর করে আচার অনুষ্ঠানগুলি পালন করে। যাইহোক ভিক্ষুরা প্রচলিত ধর্মমতের বিরোধীদের সঙ্গে উপোসথ পালন করতে অস্বীকার করলেন। তাদের অবাধ্যতায় ক্রুদ্ধ হয়ে সেই প্রতিনিধি দুয়েকজন ভিক্ষুর মুণ্ডছেদ করলেন। শুধুমাত্র যখন তিনি ভিক্ষুদের মধ্যে রাজার নিজের ভাইকে দেখতে পেলেন তখনই তিনি সেই গণহত্যা বন্ধ করলেন এবং ফিরে গিয়ে অশোকের কাছে ঘটনাটি জানালেন। দুঃখিত হয়ে অশোক সংঘে গেলেন এবং খুঁজতে লাগলেন কে এই সমস্ত কিছুর জন্য দায়ী। কিন্তু তিনি দেখলেন ঘটনাটি নিয়ে ভিক্ষুদের নিজেদের মধ্যেই মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেছিলেন এর জন্য দায়ী রাজা। কেউ কেউ মনে করেছিলেন রাজা ও তাঁর প্রতিনিধি আবার কেউ কেউ মনে করেছিলেন অন্য কেউ। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন একমাত্র মোগলীপুত্তই এই ব্যাপারে সন্দেহ নিরসন করতে পারেন সেই সময়ে মোগলীপুত্ত তিষ্য গিয়েছিলেন অহোগঙ্গ পর্বতে সেখানে তিনি বিরুদ্ধবাদীরা সংঘে যোগ দেওয়ার পরেই আশ্রয় নিয়েছিলেন।সম্রাট তিষ্যকে পাটলীপুত্রে ফিরে আসতে রাজী করালেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন অশোকারামে ভিক্ষুদের মৃত্যুর জন্য তিনি দায়ী কিনা। তিষ্য তাকে বললেন উদ্দেশ্য ছাড়া কোন অপরাধ হয় না। রাজা এই উত্তর শুনে সন্তুষ্ট হলেন। তারপর এক সপ্তাহ ধরে তিষ্য রাজাকে বুদ্ধের শিক্ষা ব্যাখ্যা করলেন।এরপর রাজা তাঁর আরামে গেলেন এবং সমস্ত বৌদ্ধ ভিক্ষুদের এক সম্মেলন আহ্বান করলেন। দীপবংশ (VII 50) অনুসারে এই সম্মেলনে বুদ্ধের ৬০০০০ বিশ্বস্ত অনুগামী অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিষ্যর সঙ্গে সম্রাট তাঁদের বুদ্ধের শিক্ষার মূল কথা সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন
(Kimvadu sugato), যারা বিরুদ্ধবাদী বলে প্রমাণিত হয়েছিলেন সংঘ থেকে বহিষ্কার করেছিলেন এবং ধার্মিক ভিক্ষুদের প্রশ্ন করেছিলেন "বুদ্ধ কী শিক্ষা দিয়েছিলেন?" এর উত্তরে তিনি শুনলেন, "তিনি বিভাজ্যের শিক্ষা দিয়েছিলেন।" তিষ্য এই উত্তরের যথার্থতাকে স্বীকার করেছিলেন (বিভাজ্যবাদ) এবং আনন্দিত রাজা যিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে তিনি বৌদ্ধ সংঘকে পরিশুদ্ধ করেছেন।তিনি ফিরে গেলেন এবং পিছনে রয়ে গেলেন তিষ্য, যিনি সংঘের ঐক্যের নেতা ছিলেন।এখন ভিক্ষুরা উপোসথ অনুষ্ঠান পালন করতে পারছিলেন। মহাকাশ্যপও যশের দৃষ্টান্তকে অনুসরণ করে আরেকটি সম্মেলন (সঙ্গীতি) আহ্বানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন (মহাবংশের মতে অশোকের রাজত্বকালে সপ্তদশ বর্ষে)। তিনি তিনটি পিটকে পারদর্শী একহাজার জন পণ্ডিত ভিক্ষুকে নির্বাচন করলেন যাদের সাহায্যে তিনি প্রকৃত শিক্ষা (সদ্ধম্ম) কে পুনঃস্থাপিত করবেন।নয় মাস ধরে কার্যকর থাকা সঙ্গীতিতে তাঁর কথাবত্থু পকরন পঞ্চরন পেশ করেন - সেখানে তিনি ধর্মবিরোধী দর্শনগুলিকে পরীক্ষা করে খণ্ডন করেন।
সঙ্গীতিটির অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ ফলাফল হলো ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য ধর্মপ্রচারক ভিক্ষুদের প্রেরণ। অশোকের পুত্র ও কন্যা যথাক্রমে মহিন্দ্র ও সংঘমিত্রাকে এই উদ্দেশ্যে সিংহলে প্রেরণ করা হয়। Keith তৃতীয় সঙ্গীতির পুরো বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। এই বিষয়ে অশোকের আদেশনামাগুলির ত্রিপিটক ও চৈনিক পরিব্রাজকদের নীরবতাকে এর ঐতিহাসিকত্বের বিরুদ্ধে প্রধান প্রমাণরাপে পেশ করা হয়। এই দাবিও করা হয় যে অশোক কোন একটি বিশেষ গুষ্টিকে সমর্থন করতে পারেন না। N. Dutta ও Keith এর মতে যে সঙ্গীতিটি ছিল বিশেষ একটি সম্প্রদায়ের এবং ও অশোক ও তাঁর মন্ত্রীদের এর সঙ্গে কোন যোগাযোগ থাকতে পারেনা। D.R. Bhandankar বলেন অশোক তাঁর বিভাজন আদেশনামতে স্পষ্টভাবে বলেছেন যে প্রচলিত ধর্মমত বিরোধী ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের বিচার হবে এবং এটিই ছিলো ঐতিহ্য অনুসারে ঐ সঙ্গীতির প্রধান উদ্দেশ্য। এমনও হতে পারে যে অশোক তার আদেশনামাগুলিতে তৃতীয় সঙ্গীতির কথা উল্লেখ করার মত কোন অবকাশ পাননি। আবার G.C Pande'র মত যে অশোক হয়তঃ তৃতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে ততটা ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন না পালি ঐতিহ্যে যতটা দাবি করা হয়েছে। কথাবথুর প্রসঙ্গে বর্তমানে এই বিষয়ে সহমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে এটি একবারে তৈরি হয়নি। তিষ্যের দ্বারা এর সংকলন শুরু হলেও শেষ হয়নি। সম্প্রতি Bonoard -Lenin তৃতীয় সঙ্গীতির ঐতিহাসিকত্ব নিয়ে পরীক্ষা করেছেন নতুনভাবে। তিনি দেখিয়েছেন যে তৃতীয় সঙ্গীতির সঙ্গে যুক্ত ঘটনাগুলির মধ্যে কোন অসম্ভাব্যতা নেই। প্রথম ও দ্বিতীয় সঙ্গীতির ইতিহাস থেকে জানা যায় যে বৌদ্ধ ও তাদের বিরোধীদের মধ্যেই শুধু নয়, প্রাক অশোক যুগে বৌদ্ধ সংঘের মধ্যেও মতভেদ ছিল। অশোকের যুগেও বাহ্যিকভাবে সংঘ ঐক্যবদ্ধ ছিল না, এটি ছিল এমন একটি সংগঠন যেখানে ভিক্ষুদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্বের ঘটনা ঘটতো এবং সঙ্গের গঠন এবং দর্শনের বিষয়েই বিভিন্ন বিতর্ক উপস্থিত হতো। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ক্রমশ গণতন্ত্রীকরণ কঠোর নিয়মকানুনের ক্রমশ শিথিল হয়ে যাওয়া, সেই সমস্ত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আবির্ভাব, যারা মূল শিক্ষাকে তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করেছিল এবং এই সমস্ত সম্প্রদায়ের অনুগামীদের ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানান্তরিত হওয়া __এই সমস্ত কিছুই সংঘের পূর্বেকার ঐক্যের অবনতি ঘটিয়ে বৌদ্ধ মঠগুলিতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতাদের আবির্ভাবের পথকে প্রশস্ত করেছিল। এমনও হতে পারে যে অন্যান্য সম্প্রদায়ের ভিক্ষুরা যারা থেরবাদের গোঁড়া দৃষ্টিকোণ প্রচলিত ধর্মমতবিরোধী ছিল তারাও অশোকারামে প্রবেশাধিকার পেয়েছিল। এর ফলে সিংহলীহ গ্রন্থে উল্লেখিত উপোসথসহ কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের যৌথ সংগঠনের কোন সুযোগ ছিল না। Bongard -Lenin এই দাবীও করেছেন যে অশোকের শাসনের পূর্বে ও দেশে কি হচ্ছে সেই বিষয়ে সাম্রাজ্য উদাসীন ছিল না।দিব্যাবদানের অশোকাবদানে পুণ্ড্রবর্ধন ও পাটলিপুত্রে বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহের উল্লেখ রয়েছে। এই সমস্ত হিংসার প্ররোচনাদাতা আজীবকগণ বৌদ্ধধর্মের অন্যান্য বিরোধীদের সঙ্গে নিহত হন এবং রাজার নিজের ভাই বৌদ্ধধর্মের বিশ্বস্ত অনুগামী বীতশোকের দুর্ঘটনাক্রমে শিরশ্ছেদ হয়।এর ফলে অশোক রক্তপাত থামাবার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হন। গ্রন্থটির চৈনিক ভাষ্যকারদের মতে প্ররোচনাদাতারা ছিল নির্গ্রন্থক, আজীবকরা নয়। তাদের অনেককেই হত্যা করা হয়েছিল যাদের মধ্যে ছিলেন রাজার ভাই যাকে ভুলবশত নির্গ্রন্থ বলে মনে করা হয়েছিল।এরপর রাজা শ্রমণদের হত্যা নিষিদ্ধ করে একটি বিশেষ আদেশনামা জারি করলেন যদিও A L Besham উত্তরের বৌদ্ধ ঐতিহ্যের তথ্যপ্রমাণকে অবিশ্বাস্য বলে উড়িয়ে দিতে আগ্রহী Bongard- Lenin মনে করেন যে অশোক এবং সম্প্রদায়ের সদস্যদের মধ্যে কারণ ছিল তার রাজত্বের শেষের বছরগুলিতে অশোকের ধর্মনীতিতে পরিবর্তন। উভয় ক্ষেত্রেই এই প্রমাণ পাওয়া যায় যে দ্বন্দ্ব নিরসনে রাজা হস্তক্ষেপ করেছিলেন এবং উভয় ঐতিহ্যেই রাজার ভাইকে দেখতেওপাওয়া যায়। তবে দক্ষিণের পালি ও উত্তরের ঐতিহ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য দেখা যায়।যদিও গোঁড়া বৌদ্ধ ও তাদের শত্রুদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব পরবর্তী (সংঘের শুদ্ধিকরণ এবং তৃতীয় সঙ্গীতি আহ্বান) র ভূমিকা হিসেবে কাজ করে। উত্তরের ঐতিহ্যে সঙ্গীতিটির কোন উল্লেখ নেই।
Bongard - Leven সাহিত্যিক কাহিনী ও পূর্বতাত্ত্বিক তথ্যের মধ্যে অনেকগুলি সাদৃশ্যের উল্লেখ করেছেন।
(১)বিভাজনবাদীদের সংঘ থেকে বহিষ্কার করার প্রয়োজন বিষয়ে আদেশ নামা জারি প্রতিবেদনের সঙ্গে ব্রক্ষ্মদেশীয় ও সিংহলিও সূত্রের সাদৃশ্য রয়েছে। এর প্রত্যক্ষ সাদৃশ্য মেলে বুদ্ধঘোষের রচনায়। (২) মহাবংশ ও বুদ্ধঘোষের তথ্য প্রমাণের (সংঘের শুদ্ধিকরণ ও ঐক্যস্থাপন তথ্যের সঙ্গে Scheism ediet এর তথ্যের হুবহু মিলে যায় (Sangho Samaggo Hutnana)। সাঁচি সংস্করণ থেকে এই অনুমান করা যায় যে আদেশনামাটি জারি করা হয় সংঘের বিভাজনের পর যখন সংঘের ঐক্য পুঃস্থাপিত হয় এবং বিরোদ্ধবাদীদের সঙ্গ থেকে বহিষ্কার করা হয়। (৩) ইতিবৃত্ত (মহাবংশ) ও বুদ্ধঘোষ উপোসথ পালনকে সংঘের ঐক্য পুনঃস্থাপিত হবার সঙ্গে যোগ করেছেন। (Sangho samaggo hutnana ladakasi uposatham : samaggo sangho
sannipathina upasatham akase) Schesm আদেশনামা মতে উপসথ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে উপসথের দিন গৃহীদের এসে রাজকীয় আদেশনামার সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ দেওয়া হোক। প্রতিটি মহামাত্রকে উপোসথের দিন এসে আদেশনামা ও তার ব্যাখার সঙ্গে পরিচিতি হতে দেওয়া হোক। দীপবংশ ও Schesm ediet উভয়ই অশোককে ঐক্যের রক্ষক আখ্যা দেওয়ার ব্যাপারে সহমত পোষণ করেছে।
ইতিবৃত্ত ও আদেশনামার মধ্যে এই সাদৃশ্য গুলি আহ্বানের পূর্ববর্তী ঘটনাগুলির সত্যতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কিন্তু যেমন করে পাটলিপুত্রে অনুষ্ঠিত তৃতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতিটি সম্পর্কে সিংহলীয় বিবরণকে এই আলোকে ব্যাখ্যা করা যাবে। Bongard -Leven এই সমস্যার সমাধানে ইতিবৃত্তে লিপিবদ্ধ দুটি বিষয়কে উল্লেখযোগ্য বলে মনে করা হয়। সঙ্গীতিটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল অশোকের অধীনে এবং এটি ও পরিচালনা করেছিলেন মোগলিপুত্ত তিষ্য। মহাবংশ অনুসারে উদাহরণস্বরূপ রাজপ্রতিনিধি দ্বারা বৌদ্ধ বধ হওয়ার সপ্তম দিনে অশোক এ মঠে আসেন এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুদের একটি পরিপূর্ণ সঙ্গীতি আহ্বান করেন। এই -------জমায়েতে ( Bhikkhasanahassa samapanipata) তিনি বৌদ্ধের শিক্ষার যথার।যথার্থ অর্থ উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়েছিলেন। বিরুদ্ধবাদী দার্শনিকদের সংতত্যায়িত করে তাদের অনুগামীদের সঙ্গ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। সংঘের শুদ্ধিকরণ সদ্ধর্ম অশোক করে শুদ্ধিকরণ সম্পূর্ণ করে অশোক তিষ্যকে তার রক্ষক নিযুক্ত করলেএবং পাটলিপুত্র ফিরে গেলেন।কিছু সময় পর তিষ্য একহাজার জন শিক্ষিত ভিক্ষুকে নির্বাচন করে একটি সঙ্গীতি আহ্বান করলেন যেখানে প্রকৃত ধর্ম গ্রহণ করা হলো। তাই Bingard Leven যুক্তি দেখিয়েছেন এমনকি ইতিবৃত্তগুলিতে দুটি ঘটনার মধ্যে সম্পষ্ট পার্থক্য করা হয়েছে ঃ অশোকের অধীনে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সভা সেখানে বুদ্ধের শিক্ষা এবং সংঘের ঐক্য আলোচিত হয়, মোগলিপুত্ত তিষ্যের অধীনে আয়োজিত সঙ্গীতি সেখানে তিনি কথাবত্থু পেশ করেন। এই বিষয়টি এই ঘটনা থেকেও স্পষ্ট হয়ে যায়।অশোকের অধীনে আয়োজিত সঙ্গীতিটিকে বলা হয় সমনিপাত এবং তিষ্য দ্বারা আহূত সম্মেলনটিকে বলা হয় সঙ্গপাত।
দক্ষিণের ঐতিহ্যের "সঙ্গপতি" শব্দটিকে প্রথম ও দ্বিতীয় সম্মেলনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে.।সূত্রগুলির মধ্যে তুলনা করলে দেখা যায় ভিক্ষুদের সম্মেলনের সঙ্গে যুক্ত ইতিবৃত্তে থাকা প্রমাণগুলো উভয়ের এর ঐতিহ্যে প্রাপ্ত অশোকের অধীনে আয়োজিত _বর্ষের বিববরণের সঙ্গে মিলে যায় যার ফলে দক্ষিণের সঙ্গে সংঘস্যসমনিপাতের তথ্যের সঙ্গে অশোকাবদান ও অশোকাবদানমালা এবং _বর্ষিকা সংক্রান্ত তাবনিয়ার্থের বিবরণ মিলে যায়।অশোকাবদান অনুসারে সম্রাট সংঘের একটি পাঁচ বছরের সম্মেলন ( Panahavar shikam vrtam) আহ্বান করেন এবং সঙ্গে প্রচুর অর্থ করেন। তারানাথ উল্লেখ করেছেন অশোকের রাজত্বকালে বৌদ্ধ সংঘে এই ধরনের তিনটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল (তার বিবরণে কোন উল্লেখ নেই)।কুমারজীবের চৈনিক গ্রন্থেও বলা হয়েছে যে অশোক পাঁচ বছরের একটি বৃহৎ সভা আহ্বান (_) করেছিলেন যেখানে ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়গুলি আলোচিত হয়েছিলো। অনেক সূত্রে ঘটনাগুলিকে সঙ্গপতির সঙ্গেও যুক্ত করা হয়েছে এবং এর ফলে অশোকের -অধীনে আয়োজিত ___ সংক্রান্ত প্রাচীনতর প্রামাণিক ঐতিহ্য এবং সেই এর প্রতিবেদনটির মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে যেটিকে সিংহলীও বিভাজ্যবাদী সম্প্রদায়ের অনুগামীরা পরবর্তীকালে এমন একটি কাহিনীতেও পরিবর্তন করেছেন যেখানে অশোক স্বয়ং অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে তাঁরা দাবি করেছেন।
এইভাবে
Bingard -Levin এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে উভয়ের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক বিভাজ্যবাদী সম্প্রদায় ও উত্তরের বৌদ্ধ সম্প্রদায় এবং পরবর্তীকালের তিব্বতীয় ঐতিহাসিক তারানাথ সকলেই বৌদ্ধ সংঘের একটি সঙ্গীতির বিবরণ দিয়েছেন বা অশোক কর্তৃক সংঘের একটি আনুষ্ঠানিক আলোচনাসভা। যার উদ্দেশ্য ছিল সাংগঠনিক বিষয়বস্তু আলোচনা করা ও ঐক্য বজায় রাখা। একজন বিভাজ্যবাদী সম্প্রদায়ের অনুগামীরা ও বুদ্ধঘোষ যিনি তাঁদের অনুসরণ করেছিলেন সঙ্গীতি সংক্রান্ত এই কাহিনীটি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। যেটি উত্তরের ঐতিহ্য বা অশোকের শিলালিপি কোথাওই উল্লেখিত হয়নি। বিভাজ্যবাদীরা নিজেদের অধিকতর প্রাচীন সম্প্রদায়রূপে প্রমাণ করা এবং তাদের সম্প্রদায়ের প্রতি অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করার জন্য এটিকেই বুদ্ধের প্রকৃত শিক্ষারূপে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছে। অতএব তাঁরা তাদের ইতিবৃত্তে এমন একটি সঙ্গীতির উল্লেখ করেছেন যেখানে এই দাবি করা হয়েছে যে তিষ্য বুদ্ধের ধম্মের একটি সংহতরূপ দান করেন এবং তার কথাবত্থু পকরণ জনসম্মুখে প্রচার করেন। এমন হওয়াও অতি সম্ভব যে এই সম্প্রদায়ের পরবর্তীকালের ____কেরা তিষ্যকে এই গ্রন্থটি রচনার কৃতিত্ব দিয়েছিলেন কারণ এই মিশ্র ধরনের রচনাটি তার প্রাচীনত্ব সত্বেও মোটের উপর রচিত হয়েছিল মৌর্য যুগের অনেক পরবর্তীকালে।
সর্বপ্রাচীন
সিংহলীয় ইতিবৃত্ত ' দীপবংশ ' এ দুটি ঘটনাকে (সংঘের সম্মেলন এবং তিষ্যের সভাপতিত্বে তথাকথিত সঙ্গীতি) পৃথক করা হয়েছে, কিন্তু মহাবংশ দুটি বিষয়কে করে একত্রিত করে সঙ্গীতির তথাকথিত কাহিনী নির্মাণ করা হয়েছে এবং মহাবংশেরই এটির সংগঠনের অশোকের ভূমিকার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সম্রাটের (সংঘস্যসমনিপাত) অধীনে ভিক্ষুদের সভা সংক্রান্ত তথ্য বা সংঘে তিনি যে সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন (__বর্ষ) যেটির ঐতিহাসিকত্ব যথেষ্ট প্রমাণের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসবই সিংহলীয় ইতিবৃত্তদ্বারা পরিবর্তনরূপে বা তৃতীয় সঙ্গীতির একটি রূপ নির্মাণের কার্যে ব্যবহৃত হয়েছিল, যেখানে তিষ্য তাঁর কথাবত্থুকে জনসমক্ষে পেশ করে সেই প্রবণতার নিন্দা করেছেন যেটি বিভাজ্যবাদীদের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রচলিত ধর্মমতের বিরোধী ছিল। এর ফলস্বরূপ তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীতের প্রতিবেদন যেটি যেটি একদেশদশী সিংহলীয় ঐতিহ্য থেকে উৎপন্ন একটি প্রকৃত ঘটনা থেকে বিভাজ্যবাদীরা সৃষ্টি করেছিলেন।মনে হয় প্রকৃত ঘটনাটি ছিল অশোকদ্বারা আহত ভিক্ষুদের একটি সভা (উত্তরের ঐতিহ্যের ____বর্ষ) যার উদ্দেশ্য ছিল বৌদ্ধ সংঘে উৎপন্ন কিছু সমস্যার সমাধান করা।
চতুর্থ সংগীতি মহান কুষাণ সম্রাট প্রথম কনিষ্কের ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল যিনি ৭৮ খ্রীস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহন করেছিলেন বলে সাধারণত মনে করা হয়। একটি মত অনুসারে সঙ্গীতিটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল জলন্ধরে এবং হিউয়েন সাং ও পরামার্থ উল্লেখিত অপর একটি সূত্র অনুসারে সঙ্গীতিটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল কাশ্মীরে।দক্ষিণের বৌদ্ধরা এই সঙ্গীতিটিকে স্বীকার করে না এবং শ্রীলংকার ইতিবৃত্তগুলিতে এর কোনো উল্লেখ মেলে না। খুব সম্ভবত থেরবাদী বৌদ্ধরা এতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেননি। তিব্বতীয় নথিপত্র অনুসারে সঙ্গীতির অন্যতম ফল হল সংঘের মতভেদ দূর করা।প্রকৃত হিসেবে ১৮ টি সম্প্রদায়ের প্রতিটিকেই স্বীকার করা হয়। হিউয়েন সাং এর মতে ভিক্ষুদের পরস্পর বিরোধী শিক্ষায় বিভ্রান্ত হয়ে সম্রাট কনিষ্ক ভদন্ত পার্থের সঙ্গে আলোচনা করে তার পরামর্শ অনুসারে বসুমিত্রের সভাপতিত্বে এবং অশ্বঘোষের সহসভাপতিত্বক ৫০০ জন ভিক্ষুর একটি সঙ্গীতি আহ্বান করেন। তাদের বাসস্থানের জন্য একটি মঠ নির্মাণ করেন এবং প্রতিটি পিটকের উপর ভাষ্য রচনার অনুরোধ করেন সেগুলিতে ১০০০০০ শ্লোক ছিল।
এই সঙ্গীতির কাজকর্ম মূলত ভাষ্য রচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। মনে হয় যে সর্বাস্তিবাদী সম্প্রদায়ের ভিক্ষুদেরই এই সঙ্গীতিতে প্রাধান্য ছিল যদিও এমন হওয়াও সম্ভব যে অপেক্ষাকৃত কম কঠোর সম্প্রদায়গুলিসহ স্থবিরবাদী সম্প্রদায়ের প্রধান উপবিভাগগুলির প্রতিনিধিত্বও সেখানে ছিল।এই সঙ্গীতিতে মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রতিনিধিত্বের কোন প্রমাণ নেই। হিউয়েন সাং এর মতে নতুন রচিত বিভাষা গ্রন্থগুলি তাম্রফলকে খোদাই করে পাথরের বাক্সে রেখে এই উদ্দেশ্যে নির্মিত একটি স্তুপে রাখা হয়েছিল। পরমার্থ এই সঙ্গীতির সামান্য ভিন্ন একটি বিবরণ পেশ করেছেন। তার মতে এই সঙ্গীতি আহ্বান করেছিলেন সর্বাস্তিবাদীদের প্রধান গ্রন্থ জ্ঞানপ্রস্থানসূত্রের রচয়িতা জাত্যায়নী।অশ্বঘোষ এটিকে সাহিত্যিক রূপদান করেছিলেন বিভাষাশাস্ত্র রচনার জন্য এই সঙ্গীতি ১২ বছর ব্যয় করেছিল।
এই সঙ্গীতির ঐতিহাসিকত্ব সম্পর্কে পোট্টসীনের সন্দেহ রয়েছে। নলিনাক্ষ দত্তের মতে এটি ছিল সর্বাস্তিবাদী সম্প্রদায়ের একটি অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু যদিও এটির বিবরণের ক্ষেত্রে কিছু অতিশযোক্তি থাকতে পারে। কিন্তু উত্তরের বৌদ্ধদের মধ্যে শতাব্দীর পর শতাব্দি ধরে প্রচলিত ঐতিহ্যকে পরিপূর্ণভাবে অবিশ্বাস করাও সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত হবে না। প্রকৃতপক্ষে বসুবন্ধুর অভিধর্মকোষের ভিত্তি হল এই বিভাষাগুলি এবং যশোমিত্রের ভাষ্যে প্রাচীন বিভাষা থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে । এর থেকে মনে হয় রচনার জন্য যে ভাষা ব্যবহৃত হয়েছিল সেটি সংস্কৃত।
হীনযান ও মহাযান শব্দ দুটির অর্থ :
বৌদ্ধধর্মকে
মোটামুটিভাবে তিনটি যানে বিভক্ত করা যায় -_হীনযান,মহাযান ও তন্ত্রযান। “হীনযান” শব্দটিকে সাধারণভাবে প্রাথমিক বৌদ্ধধর্মের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় যেটি গৌতম বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ এর সময় থেকে।পূর্ববর্তী পর্যায়ে আলোচিত সবকটি সম্প্রদায় ছিল হীনযানের। অন্তর্গত। মহাযানের উৎপত্তি হয়েছিল হীনযান থেকে,যদিও এই সম্প্রদায়টি স্বয়ং প্রথম গোতম বুদ্ধ থেকেই উৎপত্তি লাভ করার দাবি করে। এই দুটি সম্প্রদায়কে বুঝানোর জন্য যে সমস্ত পরিভাষা ব্যবহার করা হয় সেগুলি হল (ক) বুদ্ধযান বা তথাগতযান বা বোধিসত্ত্বযান এবং (খ) শ্রাবকযান বা প্রত্যেক বুদ্ধযান।তবে মহাযান ও হীনযান এই দুটি পরিভাষাই সবচেয়ে জনপ্রিয়। "যান" এই শব্দটির পূর্বে "হীন" এবং "মহা" এই যোগ করার তাৎপর্য হলো এই যে শেষোক্তটি সাধককে পরম লক্ষ্য বুদ্ধত্ব অর্জনের পর্যায়ে নিয়ে যায় যেখানে স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ পৌঁছেছিলেন কিন্তু প্রথমোক্তটি সাধককে কেবল একজন অর্হতের পর্যায়ে নিয়ে যায়।যিনি সবদিক থেকে বুদ্ধের থেকে নিকৃষ্ট। এছাড়াও সুত্রালঙ্কারে অসত্থ বলেছেন একজন মহাজানি কখনোই অপরের মুক্তির পূর্বে মুক্তি চান না। তারা সকল প্রাণীকে তাদের পরম লক্ষ্য লাভের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে দিয়ে তবেই তারা বোধিজ্ঞান লাভ করবেন। অপরদিকে শ্রাবকযান বা প্রত্যেকবুদ্ধযানের অনুগামীরা প্রথমে তাঁদের নিজের মুক্তি খোঁজেন। এটিকে অসঙ্গ স্বার্থপর বলেছেন এবং তাঁদের পথের পূর্বে "হীন" নিজের ধর্মের ক্ষেত্রে "মহা" প্রয়োগকে যৌক্তিক বলে দাবি করেছেন।।
তাঁদের ধর্মে প্রামাণিকতা দান করার জন্য মহাযানীরা বুদ্ধের শিক্ষায় দুই প্রকার সত্যের অস্তিত্বের কথা বলেছেন। বাইরের অর্থাৎ প্রকাশ্য সত্যটি সাধারণ মানুষের জন্য এবং গূচ সত্যটিকে পন্ডিত ব্যক্তিদের জন্য। হীনযান আলোচনা করে প্রকাশ্য সত্যটি নিয়ে এবং মহাযান আলোচনা করে গূচ সত্যটি নিয়ে। মহাযানী রচনাগুলি দুটি যানের দার্শনিক ব্যাখাও দিয়ে থাকে। তারা দাবি করে যে এগুলি হল দুটি আবরণ যা সত্যকে ঢেকে রাখে। এগুলি হলো অশুদ্ধতার আবরণ (ক্লেশাবরণ) এবং অজ্ঞতার আবরণ( ___বারণ)। নৈতিক নিয়ম ও বিভিন্ন ধ্যান অনুশীলন করলে ক্লেশাবরণ দূরীভূত হয়। মহাযানীরা বিশ্বাস করে যে হীনযানীরা কেবল ক্লেশাবরণ দূর করার শিক্ষা লাভ করে এবং বাস্তবে তারা ক্লেশ থেকে মুক্ত হয়। পুদগল শূর্ণ্যতা উপলব্ধি করে এবং অর্হত্বলাভ করতে পারে মাত্র। কিন্তু মহাযানীরা ক্লেশাবরণ জ্ঞেয়াবরণ উভয়কে দূর করার উপায়ই শিক্ষা করে। এর ফলে তারা অজ্ঞতা থেকে মুক্ত হয়। পুদগল শূর্ণ্যতা ও ধর্মশূর্ণ্যতা উভয়কেই উপলব্ধি করে এবং বুদ্ধত্ব লাভ করে করে। এই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য তারা মহাযানী এই উপাধি লাভের যোগ্য।
হীনযানী ও মহাযানীদের প্রধান পার্থক্য:
শূণ্যতা বা তহোতার নিয়ম :
সংক্ষেপে মহাযানীর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল পূণ্যতা ও এবং ত্রিকায় বুদ্ধদের বহুত্ব এবং তাদের দেবত্ব বোধিসত্ত্ব ও পারমিতার ধারণা বুদ্ধ বোধিসত্ত্ব ও অন্যান্য দেবদেবীর পূজা, শ্রদ্ধা বা ভক্তির দ্বারা মুক্তির আদর্শ মুক্তি লাভের জন্য মন্ত্র ও ধারণার ব্যবহার এবং সাহিত্যক্ষেত্রে সংস্কৃত ও মিশ্র সংস্কৃতের প্রয়োগ। এছাড়াও মহাযানীরা উপাসক ও ভিক্ষুর মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য করে না (কারণ উভয়ই বোধি চিত্তের পথে হাঁটতে পারেন ঘটাতে পারেন এবং পরম লক্ষ্যের পথে অগ্রসর হতে পারেন)। অতএব গৃহীরা এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তবে আমাদের এ কথা মনে রাখতে হবে মহাযান মতবাদ হীনযানের প্রতি শত্রুভাবাপণ্য বা এটির বিরোধী কোনোটিই নয়, বরং এটি হীনযানের শিক্ষাকে সম্পূর্ণ গ্রহণ করে এর সঙ্গে এর সঙ্গে নিজস্ব ধ্যান ধারণা যোগ করে এটি নিজের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বুদ্ধ বচনের ব্যবহার করে যেগুলিকে হীনযানীরা বিশুদ্ধ বলে মনে করেন। ( হীনযানের মতই এটি চারটি আর্য সত্য, পার্থিব বস্তু, অনিত্য ও ক্ষণস্থায়ী তত্ত্ব, রাগ, দ্বেষ ও মোহ থেকে মুক্ত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা, এই পৃথিবীর সৃষ্টি ও ধ্বংস না থাকা এবং কার্যকারণতত্ত্বের শ্রেষ্ঠত্ব ইত্যাদি স্বীকার করে। তাঁর মূল মাধ্যমিককারিতা গ্রন্থে মহাযানের প্রথম মহাপ্রবক্তা নাগার্জুন কার্যকারণতত্ত্বকে সর্বোচ্চ সত্যরুপে শনাক্ত করেছেন। কিন্তু কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে উভয়ই সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এদের প্রধান পার্থক্য নিহিত রয়েছে তাদের শূণ্যতা বা অনাত্মতা ব্যাখ্যায়। এই দার্শনিক ধারণার ব্যাখ্যার পার্থক্য থেকেই অন্যান্য পার্থক্যগুলি উৎপন্ন হয়।শূণ্যম বা অনাত্মম শব্দ দুটির দ্বারা হীনযানীরা বোঝে কোন একটি ধারণার অস্তিত্বহীনতা অর্থাৎ সেটি পুদগলশূণ্যতা নামে খ্যাত। মহাযানীরা করে উৎগল শূন্যতা বা বাহ্যজগতের অনুপস্থিতি।
নলীণাক্ষ দত্ত এটিকে একটি উপমার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন। আমরা বলতে পারি যে হীনযানীরা মাটির পাত্র ও মাটির ঘোড়ার মধ্যে পার্থক্য করেন না।মহাযানীরা বলেন যে শুধু তাই নয়,পদার্থ( এক্ষেত্রে মাটি) মাটি এর কোন অস্তিত্ব নেই। এই কারণে মহাযান অনুসারে শূণ্যতা হল দুই প্রকার _পুদগলশূণ্যতা ও ___মশূণ্যতা।এই শূণ্যতা মূল -----হীন অস্তিত্ব ও অনঅস্তিত্বের অস্বীকার(অভিন্নতা বা ধর্মধাতুজ).. এই শূন্যতা হল বুদ্ধ ও চিরন্তন এর উৎপত্তি বা ধ্বংস নেই। এটি সত্য এবং কোনরকম বর্ণনার অতীত। মহাযানীরা বিশ্বাস করেন যে প্রকৃত জ্ঞান বা সত্যকে শূণ্যতা বা অর্থতা বা ধর্মধাতু উপলব্ধি না করলে সম্ভব নয়।এটিকে উপলব্ধি করা সম্ভব দুই প্রকার আবরণকে অপসারিত করলে। যথা জ্ঞেয়াবরণ ও ক্লেশাবরণ। হীনযানীরা কেবল আত্মার অনস্তিত্ব উপলব্ধির মাধ্যমে ব্যক্তিগত বোধি বা অর্হত্ব লাভ করতে পারেন। কিন্তু মহাযানীরা পুদগলনৈরাত্ম্য ও ধর্মনৈরাত্ম্যের মাধ্যমে বুদ্ধত্ব লাভ করতে পারেন এবং ক্লেশাবরণ ও জ্ঞেয়াবরণ উভয়কেই দূর করতে পারেন। তবে এই বিষয়টিকে বিবেচনা করে যে একজন ভিক্ষুক কেবল নির্মাণ লাভ করলে তা স্বার্থপরের কাজ হবে এবং দুঃখী মানুষের জন্য একজন বোধিসত্ত্ব তাঁর নির্বাণ লাভকে স্থগিত রাখলে তাঁকে শ্রেষ্ঠ আদর্শ বলে মনে করা হবে। মহাযানী আদর্শ নিঃস্বার্থ নৈতিকতাকে গ্রহণ করে যেটি অনুসারে একজন ব্যক্তির সর্বদাই পৃথিবীর মঙ্গলের জন্য কাজ করা উচিত। অর্হত্ব লাভ থেকে বন্ধুত্ব লাভের দিকে ধর্মীয় আদর্শের এই পরিবর্তন কেবল ধ্যানের জীবন কাটানো কোন একজনের তুলনায় সামাজিক কাজকর্মে যুক্ত কাউকে বেছে নেয়।
মহাযানের উত্থানের কারণসমূহ :
মহাযানের উত্থান হয়েছিল কয়েকটি কারণের সংমিশ্রণের ফলে। ডঃ হর দয়ালের মতে নিঃসন্দেহে এটি কেবলমাত্র মূল বৌদ্ধধর্মের কয়েককটি লুকায়িত প্রবনতার স্বাভাবিক বিবর্তন ছিল না। এর সঙ্গেও তো হয়েছিল ভগবৎ ও শৈব ইত্যাদি ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতি, গ্রীক শিল্পকলা, খ্রীস্টধর্ম ও অর্ধবর্বর উপজাতিদের মধ্যে প্রচারকার্য চালানোর প্রয়োজনীয়তা।
প্রাথমিক বৌদ্ধধর্মে কিছু লুকায়িত প্রবণতার বিকাশ :
মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের এমন কোন বৈশিষ্ট্য প্রায় নেই যার মূল প্রাথমিক বৌদ্ধধর্মে পাওয়া যায় না।যদিও পালি ত্রিপিটকে বৌদ্ধকে মূলত একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব বলে বর্ণনা করা হয়েছে যিনি অন্যান্য ধর্মপ্রচারকদের মতো বেঁচে ছিলেন এবং ধর্মপ্রচার করেছিলেন কিন্তু কোন কোন স্থানে তাঁকে ধম্মের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করা হয়েছে। রূপকায় ও ধর্মকায় ইত্যাদি শব্দ পালি সাহিত্যে ব্যবহৃত হয়েছে। বনমালী নামক অসুস্থ ভিক্ষুর কাছে বুদ্ধমন্তব্য করেছেন, "ওহে বনমালী এই নশ্বর দেহতে কি দেখছো, বনমালী যে আমাকে দেখে সেই ধর্মকে দেখে। আবার যে ধর্মকে দেখে সে আমাকে দেখে।" পরিনির্বাণের সময়ে বুদ্ধ বলেছিলেন ,“আমি তোমাদের যে ধর্ম ও বিনয় শিক্ষা দিয়েছি ও জানিয়েছি তারাই আমার মৃত্যুর পর তোমাদের শিক্ষক হবে, “ এমনকি ত্রিশরণেও বুদ্ধ ও ধর্মের অভিন্নতার কথা বলা হয়েছে। সনাতন থেরবাদী ঐতিহ্য অনুসারে বুদ্ধ তাঁর পরিনির্বাণের পর সম্পূর্ণভাবে বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন। কার্যকারণের যে শৃঙ্খল দেহ ও মনকে গঠন করেছিল তা সম্পূর্ণভাবে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। উপাদানের সে সমন্বয় মানুষের দেহ সৃষ্টি করে তা সম্পূর্ণ দূরীভূত হয় কেবল নির্বাণ থেকে যায় এবং এবং নির্বাণে কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিত্ব নেই। কিন্তু কেমন করে অস্তিত্বহীন কোন কিছু অস্তিত্বশীল বা কারো শরণ হতে পারে?একমাত্র ধম্ম এবং সংঘ কাউকে সুরক্ষা দিতে পারে অর্থাৎ একজন ব্যক্তি কে সেই সমস্ত কুপ্রবৃত্তির হাত থেকে রক্ষা করতে পারে যা বর্তমান এবং পরবর্তী জন্মে তার জন্য দুঃখ উৎপন্ন করতে পারে। অতএব ব্যাসাম বলেছেন যে কঠোরভাবে ব্যাখ্যাও করতে গেলে "বুদ্ধং শরণম গচ্ছামি " এই মন্ত্রটি অর্থহীন হয়ে পড়ে এবং থেরবাদী তাত্ত্বিকদের সমস্যায় ফেলে। এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে বুদ্ধ কোন অর্থে বর্তমান রয়েছেন এবং যারা তাঁর শরণ নেবে তাদের(........) হাত থেকে ধর্ম ও সংঘের থেকেও অধিক সুরক্ষা দান করে। তাই ত্রিশরন মন্ত্রের মধ্যেই মহাযানীরা ত্রিকায়ের ধারণা ভ্রমরূপে বিরাজ করছে। এর অর্থ এই যে বুদ্ধের পার্থিব রূপ হয়তো নির্বাণের ফলে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে ধম্মরূপে বুদ্ধ বা ধর্মকায়ের অস্তিত্ব রয়ে গিয়েছে।মিলিন্দপ্রশ্নে বলা হয়েছে যে যদিও বুদ্ধ সম্পূর্ণরূপে নির্বাণ লাভ করেছেন কিন্তু এখনো তিনি তাঁর ধর্মের মধ্যে অস্তিত্বশীল রয়েছেন, সম্ভবত ঠিক তেমনভাবে যেমনভাবে তুলসীদাস তাঁর রামচরিতমানস এর মধ্যে রয়েছেন।এই ধরনের যুক্তি থেরবাদী মন্ত্র বুদ্ধং শরণং গচ্ছামির মধ্যে নিহিত যৌক্তিকতার অভাবকে দূর করে না যেটি পরোক্ষভাবে ভক্তের মনকে বুদ্ধের ত্রিকায়ের মহাযানী ধারণাকে স্বীকার করার জন্য প্রস্তুত করে।
মহাযানের দুই প্রকার সত্য সম্পর্কে বলা যেতে পারে যে এটি বুদ্ধের মূল শিক্ষা থেকে আলাদা যিনি মহাপরিনির্বাণ সূত্রে সরাসরি ঘোষণা করেছেন, "আনন্দ আমি প্রকাশ্য ও গূচ বিষয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য না করে তোমাদের শিক্ষা দিয়েছি। তথাগত একজন ধম্ম শিক্ষক হিসেবে কোন কিছুই গোপন করেননি। কিন্তু এমনকি এক্ষেত্রে বিপরীত দিকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ধম্মকে বর্ণনা করা হয়েছে গভীর, দেখা কঠিন, বোঝা কঠিন, শান্ত, সূক্ষ্ম যুক্তির অতীত ইত্যাদি রূপে এবং এই কারণে বুদ্ধ বুঝতে পারছিলেন না ধম্ম প্রচার করা উচিত কিনা। শেষপর্যন্ত তিনি তাঁর প্রধান পাঁচজন অগ্রসর শিষ্যের কাছে এই ধর্ম প্রচার করার জন্য ঋষিপতন (সারনাথ) এ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তিনি সমস্ত মানুষের কাছে একভাবে প্রচার না করে বিভিন্ন মানুষের কাছে বিভিন্নভাবে প্রচার করার সিদ্ধান্ত নেন। যখন সারিপুত্ত অনাথপিণ্ডদের অসুস্থতার সময়ে তাঁর কাছে অনাত্মবাদের সূত্রটি দেখা না করেছিলেন তখন শেষোক্তজন মন্তব্য করেছিলেন "অনেকদিন ধরে আমি প্রভুর ও ধ্যানকারী ভিক্ষুদের সেবায় নিয়োজিত করেছি কিন্তু তখনও আমি এই ধরনের ধর্ম দেশনা শুনিনি "। এর উত্তরে সারিপুত্ত বলেছিলেন, "হে গৃহপতি এই ধরনের উপদেশের অর্থ শ্বেত বসন পরিহিত একজন গৃহী বুঝতে পারবেনা,এই ধরনের উপদেশের অর্থ বুঝতে পারবেন একজন সন্ন্যাসী।" সংযুক্ত নিকায়তেও বলা হয়েছে যে বুদ্ধ বলেছেন যে সত্য তিনি প্রকাশ করেছেন তা যে সত্য তিনি প্রকাশ করেননি তার থেকে অনেক কম। এই ধরনের বিবৃতি মহাযানীদের দুই ধরনের সত্যের তত্ত্বকে সমর্থন দেয়।
প্রাথমিক বৌদ্ধধর্ম ও কোনভাবে ক্ষুদ্র বা বৃহৎ কোন দেবতার অস্তিত্বকে অস্বীকার করেনি যদিও সেখানে বলা হয়েছে যে তারা সসীম সত্তা (দীঘ নিকায়ের আগম সুত্ত) এবং ব্রক্ষ্মা ও ইন্দ্রকে বুদ্ধের ভক্তরূপে দেখানো হয়েছে। মহাযান মতের উক্তির বীজ পাওয়া যেতে পারে শ্রদ্ধা নামক হীনযানী গুণের মধ্যে। যদিও পালি সাহিত্যে একথা জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে সত্যের অনুসন্ধানকারী কেবল বিশ্বাসের জন্য বুদ্ধের শিক্ষাকে গ্রহণ করা উচিত নয়, নিজেও বুদ্ধি দিয়ে যাচাই করে নেওয়া উচিত। তবু শ্রদ্ধা নামক গুণটিকেও যথেষ্ট পরিমাণে উৎসাহিত করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে বুদ্ধবচনে বিশ্বাস স্বর্গে পুর্ণজন্মকে নিশ্চিত করবে। একথা পাঁচটি গুণের মধ্যে সর্বপ্রথম, অবশিষ্টগুলি হল শীল পরার্থপরতা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা এই তালিকাটিকে নিকায়ের অনেক স্থানে দেখা যায়।
তবে একথা অবশ্যই সত্য যে প্রাথমিক বৌদ্ধধর্মে যে বিশ্বাসের মূল্য দেওয়া হয়েছে তা মোটেই ভিত্তিহীন নয়, এটি একটি যৌক্তিক বিশ্বাস যা স্বাধীন অনুসন্ধান ও সমালোচনামূলক পরীক্ষার সঙ্গে পরিপূর্ণভাবে সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু প্রভুর প্রতি সারিপিত্ত আনন্দ প্রমূখ শিষ্যের ভালোবাসা ছিল অত্যন্ত গভীর। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে বুদ্ধ, ধম্ম ও সংঘের শরণ গ্রহণ করার ধারণাটি মহাযানের ভক্তিমূলক আত্মসমর্পণের পূর্বসূরী বলে গণ্য হতে পারে। মনে করা হয় যে বুদ্ধ বলেছিলেন এমনকি যাদের আমার প্রতি অধিকতর বিশ্বাস ও স্নেহ রয়েছে তাঁরা সকলেই স্বর্গে যাবে। বুদ্ধধর্ম প্রচারে তার প্রাথমিক অনিচ্ছা সত্বেও পরম করুণার দ্বারা চালিত হয়ে পৃথিবীর কাছে অমরত্বের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন বলা যেতে পারে। এটি করুণাময় বোধিসত্ত্বের রূপ ও ভক্তির জন্ম দিয়েছিল।
তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম :
বুদ্ধের পরিনির্বাণ থেকে মুসলমানের দ্বারা ১১৯৭ খ্রীষ্টাব্দে নালন্দার ধ্বংস পর্যন্ত ১৭০০ বছরে ভারতের বৌদ্ধধর্ম
তিনটি প্রধান পর্যায়ের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হয়েছিল তথা হীনযান,মহাযান ও বজ্রযান (গূচ তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম)।এগুলির প্রতিটিরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও আদর্শ ছিল। কিন্তু এগুলি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ছিল না। প্রতিটি পূর্ববর্তী যান স্বতন্ত্রভাবে অস্তিত্বশীল থাকা ছাড়াও আংশিকভাবে পরবর্তীটির অঙ্গীভূত হয়ে গিয়েছিল।
তান্ত্রিক সাহিত্য :
বজ্রযান
পর্যায়ের বৌদ্ধতন্ত্রের এক বিরাট সাহিত্য সম্ভার রয়েছে, এদের মধ্যে রয়েছে মূল রচনা ও তাদের ভাষ্য সংস্কৃত রচনা থেকে তিব্বতীয় অনুবাদ এবং তিব্বতি ভাষার বিশাল সাহিত্য সম্ভার,,....সমাজতন্ত্র,...তন্ত্র শ্রীচক্রসম্ভাবতন্ত্র, সর্ব তথাগত তত্ত্ব সংগ্রহ, কালচক্রতন্ত্র ,তারাচক্র হল সপরিচিত বৌদ্ধ তান্ত্রিকগ্রন্থ। মঞ্জুশ্রীমলকল্প হলো একটি মন্ত্রযানী রচনা। সাধনমালা হল বজ্রযানী আচার -অনুষ্ঠান ও পূজার ৩১২ টি ক্ষুদ্র রচনার একটি সংকলন সেগুলি রচনা করেছিলেন বুদ্ধ বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ যাদের সংখ্যা ৮৪ বলে মনে করা হয়। সরহপাদের দোহাকোষ, ইন্দ্রভূতির জ্ঞানসিদ্ধি, অনঙ্গবজ্রের প্রজ্ঞাপরিচয়সিদ্ধি, নারোপার সোজোদ্দেশিকাটিকা, অদ্বযবজ্রের অদ্বযবজ্রসংগ্রহ, লক্ষ্মীর অদ্বযসিদ্ধি, ডোম্বি হেরুকার সহজসিদ্ধি, এবং বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ রচিত অনেকগুলি দোহা বর্তমান কালে প্রকাশিত হয়েছে।
তন্ত্রসমূহের অধ্যয়নে অনেক সমস্যা রয়েছে। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে অধিকাংশ সাহিত্যকেই নিরপেক্ষ বলা যেতে পারে। এর অর্থ হল এই যে তারা যেমন সক্রিয়ভাবে যথাযথ ইতিবৃত্তকে সংকলন করার চেষ্টা করে না তেমন তারা সচেতনভাবে সেগুলিকে নকল করার চেষ্টাও করে না। প্রাচীন ভারতীয় ধর্মশাস্ত্রের অধিকাংশ রচয়িতার মত বৌদ্ধতন্ত্রের লেখকরাও তাদের ব্যক্তিগত নামকে বাদ দিয়ে রচনার কৃতিত্ব কোন এক স্বর্গীয় বুদ্ধকে আরোপ করেছেন।তাদের ভাষা রচনাগুলিও অনেক সমস্যার সৃষ্টি করেছে।যদিও সাহিত্যিক রূপ হিসেবে এগুলি সূত্রের মত কিন্তু এগুলি নীতিশাস্ত্র ও দর্শনের পরিবর্তে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও যোগ নিয়ে আলোচনা করে এবং প্রথাগত ভাষ্যের অভাবে এগুলি দুর্বোধ্য। এছাড়াও এখানে যে কৌশলের কথা বলা হয়েছে তা একমাত্র তখনই অনুশীলন করা সম্ভব হবে যখন অভিষেকের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় আধ্যাত্বিক শক্তি গুরুর থেকে শিষ্যের মধ্যে সঞ্চারিত হবে।
বিভিন্নভাবে
বৌদ্ধতন্ত্রের শ্রেণীবিভাগ করা হয়েছে।একটি শ্রেণীবিভাগ অনুসারে চারটি ভাগে বিভক্ত :
(১)ক্রিয়াতন্ত্র : যে তন্ত্র মন্দির নির্মাণ দেবতার মূর্তি তৈরি ইত্যাদি আলোচনা করে।
(২) চর্যাতন্ত্র : যেটি মূল আচার অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা করে
(৩) যোগ তন্ত্র :যেটি যোগের অনুশীলন নিয়ে আলোচনা করে
(৪)অনুত্তর যোগ তন্ত্র : যেটি উচ্চতর অতীন্দ্রিয়বাদ নিয়ে আলোচনা করে।
অপর একটি শ্রেণীবিভাগ অনুসারে সমস্ত তন্ত্র পাঁচটি শ্রেণীতে বিভক্ত :
(১)ক্রিয়াতন্র (২)যোগ তন্ত্র (৩)মহাযোগতন্ত্র (৪)অনুযোগ তন্ত্র ও (৫) অতি যোগতন্ত্র।
হাজিমা নাদ্বামবার মতে, “গঠনের দিক থেকে আরেক প্রকার শ্রেণীবিভাগও সম্ভব যদিও সেটি পুরোপুরি বিধিবদ্ধ নয়।“
(১)মূল তন্ত্র :মূল তন্ত্র হলো বিষয়বস্তুর নির্দেশ (ব্যাখ্যা)
(২) লঘুতন্ত্র বা অল্পতন্ত্র: লঘুতন্ত্র হলো বিষয়বস্তুর উদ্দেশ্য (তালিকা)
(৩)আখ্যায়াত তন্ত্র :অন্য একটি তন্ত্রের ব্যাখ্যা
(৪) উত্তর তন্ত্র : ভাষ্যমূলক
(৫) উত্তরোত্তর তন্ত্র :এটি উত্তরতন্ত্রের পর স্থাপিত হয়.।
তান্ত্রিকতার অর্থ ও প্রকৃতি :
তান্ত্রিকতার ব্যাখ্যা :
তন্ত্র হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয়কে প্রভাবিত করেছিল। বৌদ্ধশৈব শক্তি ও ভাগব্য তন্ত্রের মধ্যে তত্ত্ব ও অনুশীলনের দিক থেকে উল্লেখযোগ্য মূলগত সাদৃশ্য রয়েছে -- একমাত্র পার্থক্য হল পরিভাষা পটভূমি ও ঐতিহ্যের দিক থেকে তান্ত্রিক যুগেই ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ ঐতিহ্য একত্রিত হয়ে সে ধর্মের জন্ম দেয়। এবং বর্তমানে হিন্দু ধর্ম নামে পরিচিত যে ইউরোপীয় পন্ডিত তন্ত্রকে পুনর্বাসন দেন বিশেষত কুন্ডলিনী যোগের হিন্দু তন্ত্র তিনি হলেন স্যার জন উডবফ যিনি আর্থার অ্যাভালন ছদ্ম নামে তান্ত্রিকতার উপর রচনা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেন। আধুনিক তন্ত্র পরস্পর বিরোধী মনোভাব ও মূল্যায়নের সৃষ্টি করেছে। কোন কোন পন্ডিত এটি কে যাদুশক্তি সম্পন্ন কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং অশ্লীল বলে মনে করেন। আবার অন্যান্যরা এটিকে বিজ্ঞানসম্মত ও গভীরভাবে আধ্যাত্মিক বলে মনে করেন। তন্ত্র বলতে বুঝায় যেটি রচনা সেটি সাধনা ও সিদ্ধির একটি দর্শন। মনিসের উইলিয়ামন তাঁর Dictionary গ্রন্থে একটি বিশেষ শ্রেণীর রচনা বলে বর্ণনা করেছেন যা যাদুবিষয়ক ও অতীন্দ্রিয় মন্ত্র শিক্ষা দেয়। বৈদিক গ্রন্থে তন্ত্র শব্দটি তাঁত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। স্রোতসূত্র শব্দটিকে বহু অংশবিশিষ্ট একটি কর্ম প্রক্রিয়া অর্থ ব্যবহৃত হয়েছে। মীমাংসা ঐতিহ্যে তন্ত্র হলো একটি কর্ম প্রক্রিয়া__ কোন কিছু করা বা তৈরি করার পদ্ধতি। পতঞ্জলির মহাভাষ্যে তন্ত্র শব্দটি অর্থ জ্ঞানের একটি শাখা কিন্তু রাজনীতি ও চিকিৎসা শাস্ত্রের রচয়িতারা তন্ত্র নিরুক্তি শব্দটি ব্যবহার করেছেন যার অর্থ হল যুক্তি, আশ্রয়বাদ ইত্যাদি। এই শব্দটি একটি গ্রন্থের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে (পঞ্চতন্ত্র)। আমার কোষে বিভিন্ন গ্রন্থকে তন্ত্রনি নামে উল্লেখ করা হয়েছে এবং শঙ্কর শব্দটিকে একটি দার্শনিক মত অর্থে ব্যবহৃত করেছে। ধর্মীয় অর্থে তন্ত্র শব্দটি প্রথমে বোঝায় ধর্মশাস্ত্র যার দ্বারা জ্ঞান প্রসারিত হয়। ....কারত্তি তে তন্ত্র শব্দটি পান এই মূল থেকে এসেছে। যদিও পরবর্তীকালের কোন কোন লেখক এটিকে ন্ত্র শব্দ থেকে লাভ করেছেন যার অর্থ হল জ্ঞানের উৎপত্তি। পরবর্তী স্তরে এটি রচনার একটি শ্রেণীর রূপে বর্ণনা করা হয় যেটি তত্ত্ব (অতীন্দ্রিয় নীতির বিজ্ঞান) ও সংমিশ্রণরূপে সঞ্চারিত সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে।
তন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্য :
তন্ত্রগুলিতে যে ধর্ম প্রচার করা হয় তা হল মন্ত্র, যন্ত্র, মন্ডল, মুদ্রা, মৈথুন, যোগ একটি ভয়ানক দেবতাচক্র জাঁকজমকপূর্ণ পূজা এবং আচার অনুষ্ঠান যাদুবিদ্যা, ডাকিনীবিদ্যা,... তিবাদ,জ্যোতিষশাস্ত্র, অপরসায়ন, স্ত্রী উপাদানের উপস্থিতি এবং একটি অদ্বৈতবাদী এক দর্শনের বিচিত্র মিশ্রণ। বাস্তব জগতের বিচিতিকরণ এই ধারণা যে পরমতত্ত্ব সহ সমস্ত দেবতা মানুষের দেহে বসবাস করে এটি মূল অদ্বৈততার মধ্যে একটি বাহ্যিক দ্বৈততার নীতির অনুমান মুক্তির প্রক্রিয়ার একটি অনিবার্য বৈশিষ্ট্য, একটি বিপ্লবী নৈতিকতা যে প্রতিটি বস্তু একজন বিশুদ্ধ মানুষ বা omma sanela sanehis এর জন্য বিশুদ্ধ এবং সর্বোপরি মহাসুখের ধারণা যা উৎপন্ন হয় পুরুষ (উপায়) এবং নারী (প্রজ্ঞা)র মিলনের মধ্য দিয়ে এগুলি হল তন্ত্র বা গূচ তত্ত্বের(হিন্দু ও বৌদ্ধ) মূল কথা তন্ত্রে পঞ্চ মকারের হীন অনুশীলন (পাঁচটি ও অনুশীলন যা ম দিয়ে শুরু হয়)। যেমন _মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা (হাত ও দেহের বিভিন্ন ভঙ্গিমা) এবং মৈথন (যৌনক্রিয়া) কে প্রকাশ্যে সুপারিশ করা হয় এবং যে সমস্ত মানুষদের উচ্চ নৈতিক চরিত্রের অধিকারী মনে করা হতো তারাও এই ধরনের জীবন যাপন করতেন।গূহ্য সমাজে কেবল মিথ্যা ভাষণ বা চুরি তো বটেই এমনকি হত্যা কেউ সুপারিশ এবং অনুমোদন করা হয়েছে। অন্যতম জনপ্রিয় ও সুপরিচিত তন্ত্র রচনা মহা নির্বাণ তন্ত্র থেকে তান্ত্রিক ধর্মের সাধারণ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারনা পাওয়া যায়। এটি অনুসারে ব্রহ্মশক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়,। এটি সমস্ত সত্তার চিরন্তন গতিশীল উৎস এটি লক্ষ্য করা যায় যে সমস্ত জীবনে শুরু হয় একজন নারীর গর্ভ থেকে, তাই আমাদের উচিত পরম সৃষ্টি নীতিকে পিতা নয় মাতার দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা। প্রকৃতি ও মায়ার মত দার্শনিক ধারণা এবং পার্বতী, দুর্গা, লক্ষ্মী ও রাধার মত কিংবদন্তীর চরিত্র সৃষ্টির নারী নীতির উৎস এবং জগমাতা (পৃথিবীর মাতা) র বিভিন্ন নামমাত্র ব্রক্ষ্ম, বিষ্ণু, শিবসহ সমস্ত দেবতা স্বর্গীয় মায়ের অন্তর্ভুক্ত এবং তাঁর থেকে উৎপন্ন। অতএব এই সম্প্রদায় প্রতিটি নারীকে এই জগন্মাতার অবতার বলে মনে করে। বৌদ্ধ তন্ত্রের উপায় ও প্রজ্ঞা হিন্দু তন্ত্রের যথাক্রমে শিব ও শক্তির সঙ্গে মেলে। যখন শিবকে পূজা করা হয় তখন তার সঙ্গিনী শক্তিকেও পূজা করা হয় যখন শক্তিকে পূজা করা হয় তখন তার সঙ্গী শিবকেও পূজা করা হয় কারণ তারা অবিচ্ছেদ্য।
এইভাবে শক্তিবাদ গ্রন্থের বিভিন্ন শাখার দর্শনের মূলনীতি এই বিশ্ব জগতের বিভিন্ন বাহ্যিক রূপের উৎস হলো শক্তি বা আদিম নারী ক্ষমতা। এই রূপগুলির মাধ্যমে মানুষ উত্থিত হয়ে বিশ্বব্যাপী নীতির সঙ্গে মিলিত হতে পারে।
তন্ত্রের উৎস:
তন্ত্রের উৎস কি বিদেশী?
অনেক পন্ডিতের মধ্যে তন্ত্রের উৎস হলো বিদেশী। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বিশ্বাস যে তন্ত্রের উৎস হলো বিদেশী। এটি সম্ভবত এসেছিল স্কাইথিয়ানদের মাগি পুরোহিতদের কাছ থেকে। ভট্টাচার্যের মতে ধর্মে শক্তি পূজার প্রবর্তন এতটাই অভাবতীয় যে আমরা স্বীকার করতে বাধ্য হই যে এটি একটি বিদেশী প্রভাব। পি সি বাগচি তন্ত্রের মধ্যে ভাব্য বিদেশী তিব্বতীয় উপাদানের অস্তিত্ব নির্দেশ করেন। তিনি মনে করেন যে ভারতীয় সাধকদের সঙ্গে তিব্বতের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল :এই কারণে লামাধর্মের মধ্যে আমরা তন্ত্রের চিহ্ন দেখতে পাই। সাম্প্রতিক কালে আলেক্স ওয়েম্যান বৌদ্ধ তন্ত্রের কিছু গ্রীক রোমান উপাদানের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চেয়েছেন। কিন্তু অধিকাংশ পন্ডিত সাধারণভাবে তন্ত্রের অস্তিত্বকে ভারতবর্ষের প্রাক বৌদ্ধধর্মের মধ্যে খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছেন। জন উড্রফের মতে তন্ত্র হলো বৈদিক কর্মকাণ্ডের সেই বিবর্তন যেটি তন্ত্রশাস্ত্র নামে কলিযুগের ধর্মশাস্ত্র চার্লস এলিসয়ের মতে তন্ত্র কোন ধর্মীয় তত্ত্ব নয় ধর্মীয় জাদু। মনিসের উইলিয়ামস তন্ত্রের উৎস কে সাংখ্যের পুরুষ ও প্রকৃতি তত্ত্বের মধ্যে দেখেছেন। গোপীনাথ কবিরাজ বিশ্বাস করেন তন্ত্রের মূল বৈদিক ধর্মের মধ্যে প্রোথিত। G C Pande র মতে মানুষের প্রাচীনতম ধর্ম প্রকৃতিতে কম-বেশি তান্ত্রিক। তিনি দেখিয়েছেন ভারতবর্ষের প্রাক বৌদ্ধধর্মের মধ্যে বহু তান্ত্রিক উপাদান দেখতে পাওয়া যায়। এল.এম.যোশীও প্রায় একই বক্তব্য করেছেন। আধুনিক পন্ডিতেরা সঠিকভাবে দেখিয়েছেন যে তন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো শক্তি সাহাচর্যের ধারণা যেটি একদিকে মাতৃকা দেবী ও অপরদিকে লিঙ্গ পূজা ও শিব ধর্মের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। কিন্তু আমরা দেখেছি যে উভয় উপাদানই সিন্ধু সভ্যতার ধর্মের মধ্যে বর্তমান ছিল। এটি ছিল মাতৃ দেবতার বিশ্বাস লিঙ্গ ও যোনি পূজা, যোগ দ্বৈততা (সৃষ্টির পুরুষ ও নারীর নীতির দ্বৈততার ধারণা) এবং যোগের অনুশীলন। এই সমস্ত বিষয় ছিল অনির্দিষ্ট ধর্মীয় ও আচার অনুষ্ঠানের মিশ্রণের উপাদান যেটি পরবর্তীকালে তান্ত্রিক ঐতিহ্য নামে পরিচিত। বৈদিক ধর্মেও ইতিমধ্যেই তন্ত্রের বিভিন্ন উপাদান উপস্থিত ছিল, আরো অনেক উপাদান সাফল্যের সঙ্গে গৃহীত হয়েছিল এবং অনেক গুলিকে পবিত্র গ্রন্থ গুলি বৈধ করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিলক্ষেত্রের উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য যৌনগন্ধী বহু আচার অনুষ্ঠান বেদে স্বীকৃতি লাভ করেছে। পরবর্তীকালে এগুলির ব্যাখ্যা ও প্রদান করা হয়। বৈদিক সাহিত্যের বিভিন্ন অংশে মারন উচাটন ইত্যাদি প্রক্রিয়ার স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে।
অথববেদের অনেক আচার অনুষ্ঠান অনেকটা তন্ত্রের আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গে অভিন্ন। বৈদিক গ্রন্থে সময়যজ্ঞ এবং হাবিরজ্ঞের সুপারিশ করা হয়েছে যে গুলির মধ্যে রয়েছে। SB তে বলা হয়েছে মদ্য হল সর্বদা বিশুদ্ধ এবং এটি উৎসর্গকারীদের বিশুদ্ধ করে। গূচ বৌদ্ধধর্ম কিছুটা পরিবর্তন করে হোমের অনুষ্ঠানকে গ্রহণ করে। বৈদিক গ্রন্থে উল্লেখিত দেহের কিছু অংশে দেবতার কথা ধ্যান এবং ওই সমস্ত অঙ্গ স্পর্শ করার মধ্য দিয়ে দেবতার ব্যান করা তান্ত্রিক ন্যায় সমতুল্য খট,ফট,হুম ইত্যাদি অর্পিত অর্থহীন শব্দের ব্যবহার ও বৈদিক গ্রন্থে দিতে দেখা যায়। ঋগ্বেদের প্রায় ১২ টি স্তোত্র জাদু বিদ্যা বিষয়ক। জাদু হল অথর্ববেদের প্রধান ও মূল বিষয়বস্তু।তাই উপনিচ্ছদ (১৭) সমস্ত বিশ্বজগতকে মানব দেহের সমতুল্য বলে মনে করা হয়েছে। Brup তে (I. i.i) এ উৎসর্গিত ঘোড়াকে জগতের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।মানবদেহের একই রকম প্রতীকী বর্ণনা দেওয়া হয়েছে Charupa ( VIII. 1.3) এবং শৈতাস্বর ( II. 12) এ একটি সিদ্ধদেহের কথা বলা হয়েছে। উপনিষদে বর্ণিত পঞ্চবিদ্যার ও সুস্পষ্ট তান্ত্রিক তাৎপর্য রয়েছে।উপরোক্ত ঘটনা থেকে এটি পরিষ্কার যে তান্ত্রিক ধর্মের সবদিক সাহিত্যে দেখা যাচ্ছে বৈদিক সমাজেই লিঙ্গ পূজা ও মাতৃপূজা সমাজে ক্রমশ আরো বেশি স্বীকৃতি লাভ করেছিল।মন্ত্র বলি অলৌকিক ক্রিয়া মাছ মদের ব্যবহার বৈদিক জানা ছিল তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক বহু উপাদান প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে উৎপন্ন হয়েছিল। যদিও এটি নিশ্চিতভাবে পরবর্তীকালে বিবর্তিত। যদিও পরবর্তীকালে তান্ত্রিক লেখকরা বেদের উপর ভিত্তি করেছিলেন। বৈদিক সাহিত্যের গোঁড়া অনুগামীরা এগুলির অবৈদিক বৈশিষ্ট্যের উপর আরোপ করেছিলেন।বহু আধুনিক শিক্ষিত ভারতীয় ও বিদেশী পণ্ডিতদের মতে তন্ত্রকে সেই সাধারণ মূল্যবোধের বাইরে গিয়ে মূল্যায়ন করা উচিত _ যা হিন্দু ধর্ম মান্য করে থাকে।
এছাড়াও জনপ্রিয় ধারণায় শক্তিবাদ ও তন্ত্র এত বেশি "তন্ত্র" শব্দটির সঙ্গে অভিন্ন উঠেছে যে তন্ত্র শব্দটি কেবল শক্তিদের ধর্ম সাহিত্য এবং আগম শব্দটি কেবল শিব ও সংহিতা ও কান্ড ওরাত্র রাত্র শব্দটিকে বৈষ্ণবদের ধর্ম গ্রন্থ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।Winternitz বলে " যখন আমরা তন্ত্রের কথা ভাবি তখন আমরা মূলত শক্তিদের গ্রন্থের কথাযই ভাবি। "আবার এই যুক্তি ও দেখানহয়েছে যে ব্রাহ্মণবাদী সাহিত্যের চিরাচরিত বিভাগ ছিল বেদ। স্মৃতি, পুরাণ ও তন্ত্র __ এটিই ছিল কালানক্রমিক বিন্যাস এবং পৃথিবীর চারটি পর্যায়ে বিভক্ত। জুন উডফ, গোপিনাথ কবিরাজ, জি সি পান্ডে এবং আরো অনেক পন্ডিত এই মতের বিরুদ্ধে মন্তব্য করেছেন।
(ক) তন্ত্রগুলি স্মৃতি বা নিগম ঐতিহ্যের বিপরীতে নিজেদের বেদ, শ্রুতি বা আগম "প্রকাশ" নামে উল্লেখ করেছে। সাধারণত এগুলিকে শ্রুতি শাখা বিশেষ নামে সংজ্ঞায়িত করা হয়। বাগচির তন্ত্রনিশাসতত্ব সংহিতায় বলা হয়েছে তন্ত্র হলো বেদান্ত ও সাংখ্যব গুচ তত্ত্বের শীর্ষবিন্দু। একই ধরনের প্রাচীন একটি তান্ত্রিক রচনা পিঙ্গলমাথা'য় বলা হয়েছে, "তন্ত্র প্রথম প্রকাশ করেছিলেন শিব এবং তারপর ঐতিহ্যের মাধ্যমে এটি সঞ্চারিত হয়েছে। এটি একটি আগম যা চন্ড (বেদ) এর বৈশিষ্ট্য রয়েছে।" প্রপঞ্চস্বর এবং অন্যান্য তন্ত্র বৈদিক মহারাজ ও মন্ত্রের উদাহরণ দেয় : এবং মেরুতন্ত্রে বলা হয়েছে যেহেতু মন্ত্র বেদের অংশ, তেমন তন্ত্র বেদের অংশ। নিরূত্তর তন্ত্রে তন্ত্রকে পঞ্চম বেধ এবং কাউলাচারকে পঞ্চম আশ্রম বলা হয়েছে। যেটি অন্যদের অনুসরণ করে। মৎস্যসুক্ত মহাতন্ত্রে বলা হয়েছে যে সাধকদের অবশ্যই বিশুদ্ধাত্মা হতে হবে এবং বেদকে জানতে হবে। যে বৈদিক প্রিয়া শূণ্য সে অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে গন্ধর্ব তন্ত্রে বলা হয়েছে যে তান্ত্রিক সাধককে অবশ্যই বেদে বিশ্বাসী হতে হবে। ব্রাহ্মণদের সঙ্গে যুক্ত এবং ব্রাহ্মণের মধ্যে আশ্রয় নিতে হবে। কুলার্গব তন্ত্রে তন্ত্রকে বৈদান্তিক (মানসিকতায় বৈদিক) রূপে বর্ণনা করা হয়েছে, যে বেদের থেকে শ্রেষ্ঠ কোন জ্ঞান নেই এবং কাউলের থেকে শ্রেষ্ঠ কোন ধর্ম নেই। রুদ্রায় মালা অনুসারে প্রধান দেবী হলেন অথর্ববেদিক গুষ্টীর। দুলহান বেত্য তন্ত্রের বৈদিক উৎপত্তির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ভাস্কর আচার্য তন্ত্রকে উপনিরী নিচদের উপনিশদের পরিপূরক বলে মনে করেছিল।নাথানন্দ নাত তার দাম বিলাস ভাষ্য বেদের মধ্যে তান্ত্রিক মন্ত্রের উৎপত্তি আবিষ্কার করতে চেষ্টা করেছেন লক্ষী দার পিএস থেকে অংশ উদ্ধৃত করেছেন করেছেন যে এগুলোর মধ্যে ত্রিবিদ্যার শ্রীবিদ্যাস উল্লেখ রয়েছে। তান্ত্রিক মন্ত্রে মন্ত্রের ব্যবহার ও একই জিনিসের ইঙ্গিত দেয় বিভিন্ন দেবদেবীর আহ্বান সূচক গায়ত্রী মন্ত্রের তান্ত্রিক রহনও আমরা দেখতে পাই।
ক) বৈদিক সাহিত্যের বেদ, স্মৃতি পুরান এবং তন্ত্রের বিভাজন এর অর্থ এই নয় যে এদের মধ্যে কোন সাদৃশ্য নেই।কোন কোন তন্ত্রের আদর্শ যেমন সাহিত্যের কিছু অংশে পুরান সাহিত্যের কোন কোন অংশকে পড়তে প্রায় তন্ত্র গ্রন্থের মতই মনে হয় এর অর্থ তান্ত্রিক সাহিত্য যদি পুরান সাহিত্যের পূর্বে ন্যাস্ত হয় অন্তত পুরান সাহিত্যের সময় অস্তিত্বশীল ছিল অতএব তান্ত্রিক যুগ পুরান্তিদা যুজ্ঞে অনুসরণ করেছিল একথা পুরোপুরি সঠিক নয়।
খ)তন্ত্রের মানসিকতা মূলত বেদের মত ছিল। বৈদিক সংহীতার ধর্ম ছিল আচার অনুষ্ঠান কেন্দ্রিক। কালক্রমে এটি দেবতা নিরপেক্ষ, জাদুকেন্দ্রিক, আচার অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যেটি নিজের শক্তিতেই ফলপ্রদ এবং সুফল ও কুফল উভয় উৎপাদনেই সক্ষম। এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল সঠিকভাবে মন্ত্রোচ্চারণ করা। তান্ত্রিক সাধনার উদ্দেশ্য হল বৈদিক ধরনের এবং যৌগিক ধরনের গূচ: আচার অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক শক্তিগুলিকে পরাজিত করা এবং শিব ও শক্তির মিলন ঘটানো। এই ধরনের গুচ আচার অনুষ্ঠানের সূত্রপাত দেখতে পাওয়া যায় ব্রাহ্মণ এবং উপনিষদের দুল্লুকাভট্ট তারঁ মনু সম্পর্কিত ভাষ্যে চিরাচরিত জ্ঞানকে বৈদিক ও তান্ত্রিক এই দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন এবং এই বিভাগটি একেবারেই ভিত্তিন নয় ভিত্তিহীন নয় কিন্তু কাল ক্রমে জ্ঞানের এই দুটি বিভাগ আর দুটি থাকলো না একটিতে পরিণত হলো।
(গ) বামাচারি অনুশীলনী তন্ত্রের সবকিছু নয়। কুলানোবতন্ত্রে সাতটি পথ বা আচারের কথা বলা হয়েছে যার শুরু বেদাচার দিয়ে শেষ কূলাচার দিয়ে।অন্যান্য তন্ত্রে আরও দুটি যোগ করা হয়েছে অঘোর ও মোগ। প্রকৃতপক্ষে তন্ত্র শব্দ এত ব্যাপক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ যে কেবল শক্তি নয় শৈব...??... গণপত্য ও বৌদ্ধ (এটির বিভিন্ন উপরিভাগসহ তন্ত্র ও এর অন্তর্গত) এবং এই কারণে তন্ত্রকে কেবল চীন, তিব্বত বা অন্য কোন বিদেশী রাষ্ট্রের উপহার বলে মনে করলে চলবে না।
বুদ্ধ স্বয়ং কি তন্ত্র শিক্ষা দিয়েছিলেন :তৃতীয় ধর্মচক্র প্রবর্তনের ঐতিহ্য :
এখানে একথা উল্লেখ করা যেতে পারে যে তন্ত্রগুলি হিন্দু বা বৌদ্ধ যেমনই হোক না কেন ঐতিহাসিকত্বের দাবি করে না। বৌদ্ধ তন্ত্রের ক্ষেত্রে বলা চলে এদের উৎস স্বয়ং বুদ্ধের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায়। সৈকোদ্দেসটিকা কালচক্র তন্ত্রের সেকোদ্দেশ বিভাগের একটি মন্তব্য অনুসারে মন্ত্রযান সর্বপ্রথম শিক্ষা দেন বুদ্ধ দীপঙ্কর এবং এটিকে আমাদের যুগে গ্রহণ করেন শাক্যমুনি বুদ্ধ। সম্ভলের রাজা সুচন্দ্রের অনুরোধে গৌতমবুদ্ধ ধন...? একটি সভা আহবান করেন তৃতীয়বার ধর্মচক্র প্রবর্তন করেন এবং গুঢ় পথ বা মন্ত্রযান সম্পর্কে উপদেশ দেন। ঠিক যেমনভাবে পূর্বে তিনি হীনযান ও মহাযান ধর্মপ্রচার করেছিলেন যথাক্রমে ঋষিপতন ও পুধকুটে। তবে তিব্বতীয় ঐতিহ্যে এই ঘটনার তিনটি পৃথক তারিখ পাওয়া যায়, এদের কারও কারও মতে ঘটনাটি সম্বোধির প্রথম বছরে ঘটেছিল। কারও কারও মতে এটি ষোড়শ বছরে ঘটেছিল এবং তৃতীয় ঐতিহ্য অনুসারে ঘটনাটি বুদ্ধের পরিনির্বানের অব্যবহিত পূর্বে ঘটেছিল। কিন্তু যোগীর মতে তৃতীয় ধর্মচক্র প্রবর্তনের ঐতিহ্য দ্বিতীয় টির মতোই আপাতভাবে একটি পরবর্তী কল্পনা। বুদ্ধ অন্ধ অশ্বতলে গিয়েছিলেন এটি দেখানোর বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ নেই। সম্ভবত সর্ব প্রাচীন বৈপুল্যশাস্ত্র মঞ্জুশ্রীকল্প (যেখানে মন্ত্রজানের বহু উপাদান রয়েছে) তৃতীয় ধর্মচক্র প্রবর্তন সম্পর্কে জানেনা যদিও এটি মন্ত্রশসিদ্ধিক অনুশীলনের কেন্দ্র হিসেবে শ্রীপর্বত ও শ্রীধন্যকাটের??.. অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞাত.।কিন্তু সম্ভবত সর্ব প্রাচীনতান্ত্রিক গ্রন্থ গুহ্যসমাজতন্ত্রে তান্ত্রিক ধর্মের মূল বৈশিষ্ট্য গুলি পাওয়া গেলেও কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। বরং এটি তান্ত্রিক বৌদ্ধ ঐতিহ্যের বিরোধিতা করে বলে মনে করা হয় যখন এটি বলে যে দীপঙ্কর বুদ্ধ গুহ্যসমাজের বৈশিষ্ট্য শিক্ষা দেন নি বরং সেই মানসিকতায় আঘাত ও বিস্ময়ের বিস্তারিত বিবরণ দেন যা বোদ্ধিসত্ত্বগণ লাভ করেছিলেন। বৈপ্লবিক তন্ত্র শিক্ষা শোনার পর তবে এ সমস্ত বিষয় সত্ত্বেও তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে বহু সাধনা ও মন্ত্রের কৃতিত্ব গৌতম বুদ্ধকে দেওয়া হয় এবং তাঁকে একজন প্রথম শ্রেণীর তান্ত্রিক বলে দাবি করা হয়। এমনকি এই দাবীও করা হয় যে তিনি স্বয়ং এই মহাসত্যকে আবিষ্কার করেছিলেন যে বুদ্ধত্ব স্ত্রী জননাঙ্গের মধ্যে থাকে এবং বজ্রযোগিনীও সঙ্গ সুখ লাভ করাকালীন এই গোপন দান করেছিলেন। বিনয় দোষ ভট্টাচার্যের মতো কিছু আধুনিক পন্ডিত মনে করেন যে তন্ত্র মন্ত্র ধারণা ও মুদ্রা গৌতম বুদ্ধই গৃহী মানুষদের শিখিয়েছিলেন। কিন্তু তান্ত্রিক সাধনাকে বুদ্ধের সৃষ্টি বা আবিষ্কার বলা যায় না। উইন্টারনিটদের মতে তন্ত্র-মন্ত্র ও ধারণার অস্তিত্ব বুদ্ধের যুগে ছিল এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। বুদ্ধ কুসংস্কারও অন্ধ বিশ্বাসকে নিরুৎসাহিত করে সমালোচনামূলক অনুসন্ধিৎসাকে উৎসাহিত করতেন।। কথাবত্থুতে বলা হয়েছে তিনি জাদু ও অলৌকিক শক্তি প্রয়োগের পক্ষে ছিলেন না এবং এগুলোকে কালা জাদু বলে মনে করতেন। ব্রাহ্মজালসূত্তে ছদ্ম বিজ্ঞানের একটি দীর্ঘ তালিকা প্রদান করা হয়েছে যেগুলিকে বুদ্ধ নিম্ন শ্রেণীর কলা বলে নিন্দা করেছিলেন।
কিন্তু বুদ্ধ সাধারনভাবে জাদু ও মন্ত্রের বিষয়ে উৎসাহী ছিলেন না এর অর্থ এই নয় যে তিনি এগুলির ক্ষমতায় বিশ্বাসী ছিলেন না বা প্রাচীন বৌদ্ধধর্মের সেই সমস্ত উপাদানগুলি থেকে মুক্ত ছিল যা পরবর্তীকালে তন্ত্রের রূপ গ্রহণ করেছিল। যদি এই সমস্ত উপাদানের অস্তিত্ব বৈদিক যুগ এমন কি প্রাক বৈদিক যুগের সমাজে এবং বুদ্ধের যুগে ব্রাহ্মণ্য ও জৈন সমাজেও থেকে থাকে তাহলে কেমন করে এই দাবি করা সম্ভব যে বুদ্ধ এবং তাঁর অনুগামীরা এগুলি থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত থাকবেন।বিশেষত এই বিষয়টির আলোকে যে পরবর্তীকালে তান্ত্রিক ধর্ম বৌদ্ধধর্মকে এমন ভাবে পরিবর্তিত করে দেবে যে তাকে একেবারে সনাক্তই করা যাবে না। এ কথা সত্য যে কয়েকটি জাদুবিদ্যা তিরাচ্ছন্ন বিদ্যা বা মিথ্যা আনন্দের বলে নিন্দা করেছিলেন। কিন্তু এই নিন্দা থেকেই তাদের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়। এছাড়াও বুদ্ধ দাবী করেছেন যে যারা অর্হত্ব তো লাভ করেন তারা কিছু অলৌকিক শক্তি লাভ করেন। বুদ্ধা স্বয়ং ঋদ্ধিকে অনুশীলন করতেন তিনি সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করার জন্য রিদ্ধিও প্রদর্শন করেছিলেন। কথিত আছে যে তিনি একটি জাগনের সঙ্গে একঘরে থেকে সেটিকে একটি পতঙ্গে পরিবর্তন করে জটিলদের ধর্মান্তরিত করেছিলেন আগুনের একটিমাত্র এমন অনেক সন্ন্যাসীকে পাঠিয়ে যারা নদীতে স্নান করতে ঠান্ডায় কাবু হয়ে পড়েছিলেন, জলের উপর দিয়ে হেঁটেছিলেন এবং এবং স্বর্গীয় অপ্সরাদের দেখিয়ে নন্দকে ধর্মান্তরিত করেছিলেন।পতিসুত্তে তিনি তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার জন্য গর্ব প্রকাশ করেছেন। তাঁর শিষ্য মোগল্লানেরও এই ধরনের ক্ষমতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। দীঘ নিকায়তে একটি সম্পূর্ণ সুত্ত রয়েছে যেটি কে পরিত্ত বা রক্ষা (সুরক্ষার মন্ত্র) রূপে বর্ণনা করা হয়েছে যেটিকে মুখস্ত করলে অশুভের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। এই ধরনের অধিকাংশ পরিত্ত মহামুনির অন্তর্গত হয়েছে যেটি একটি গুঢ় রচনা। দীঘ নিকায়ের মহাসময় সূত্তন্তে এক ধরনের গুচ বৌদ্ধধর্মের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। বিনয় পিটক অনুসারে বুদ্ধের একজন শিষ্য ভরদ্বাজ অলৌকিকভাবে আকাশে উড়ে বুদ্ধের ভিক্ষা পাত্রটিকে নামিয়ে আনেন যেটিকে একটি শ্রেষ্টী অনেক উপরে ধরে রেখেছিলেন। চুল্লবগ্গ V..6 তে একটি মন্ত্র রয়েছে যেটি কে বুদ্ধ সর্পাঘাতের ভয়কে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করতে বলেছেন। ত্রিশরণ মন্ত্র উচ্চারিত হয় বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া এবং উন্নতি লাভের জন্য। সামান্য পরবর্তীকালে মন্ত্র বা ধারণাগুলি মহাসাংঘিক রচনার একটি বিভাগরূপে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল । মূলসর্বাস্তিবাদ বিনয়ে মহাময় ধারণা পূর্ণ দৈর্ঘ্যে আবির্ভূত হন। অতএব এ কথা স্পষ্ট যে প্রাচীন বৌদ্ধদের মনতন্ত্র মন্ত্রের উপযোগিতা সম্পর্কে পুরোপুরি অবিশ্বাসী ছিল না। বুদ্ধ ভিক্ষদের ক্ষেত্রে তন্ত্র মন্ত্রের ব্যবহার বা তান্ত্রিক আচার অনুষ্ঠান পালন বা মাংস, মাছ মদ বা বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে মৈথুনের অনুমতি দেননি। কিন্তু মনে হয় বহুভিক্ষুই গোপনে তাঁর নির্দেশ অমান্য করতেন। এর ফলে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে একটি গূহ্য গুষ্টীর আবির্ভাব যারা সেই সমস্ত আচার পালন করত যা বুদ্ধ নিষিদ্ধ করেছিলেন। কালক্রমে এই গোপন গোষ্ঠীগুলি গূহ্যসমাজ নামে বৃহৎ গুষ্টীতে পরিণত হয় যেটি গূহ্যসমাজতন্ত্র নামে নিজেদের গ্রন্থ রচনা করে।
তান্ত্রিক বৌদ্ধদের ঐতিহাসিক আবির্ভাব :
আধুনিক পণ্ডিতদের মধ্যে স্বীকৃত মতামত হল মূল তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম আবির্ভূত হয় খ্রীষ্টিয় সপ্তম শতকে। তবে বিনয়তোষ ভট্টাচার্য, তুচ্চি গোপীনাথ কবিরাজ এবং জি সি পান্ডের মতে গুঢ় বৌদ্ধধর্মের প্রকাশ ঘটেছিল মৈত্রেয় ও অসঙ্গের সময়ে রাহুল সংস্কৃন্ত্যায়ণ মন্ত্রযানের প্রাচীনতত্ত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। প্রমাণ হিসেবে এই পন্ডিতেরা বলেন যে তারানাথ বিশ্বাস করতেন যে গোপনতন্ত্র ও তান্ত্রিক ধারণা মহাযানী শিক্ষক নাগার্জুনের মতোই প্রাচীন এবং প্রায় ৩০০ বছর ধরে এগুলি গোপনে শুরু থেকে শিষ্যের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। এছাড়াও মৈত্রেয়নাথের সঙ্গে অসঙ্গেরর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিষয়ে এবং তাঁদের গূচ বৌদ্ধধর্মের সম্পর্কে বিষয়ে জোরালো চৈনিক ও তিব্বতীয় ঐতিহ্য রয়েছে এছাড়াও তান্ত্রিক বা অর্ধতান্ত্রিক প্রকৃতির অনেক রচনা রয়েছে যেগুলি ৭৮০ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বে রচিত।তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে এখনো পর্যন্ত প্রাপ্ত সর্বপ্রাচীন রচনা হলো গুহ্যসমাজতন্ত্র (খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতক) এবং মঞ্জুশ্রীকল্প। প্রথমটির বিষয়বস্তু যোগ (সাধারণ ধ্যান) এবং অনুত্তরযোগ (ধ্যানের তান্ত্রিক রূপ) এবং দ্বিতীয়টির বিষয়বস্তু হল মুদ্রা (আঙ্গুল ও দেহের ভঙ্গিমা), মন্ডল (অতীন্দ্রিয় নকশা) মন্ত্র (আচার অনুষ্ঠান), চর্যা( পূজায় পুরোহিতের কর্তব্য), শীল(নৈতিক নিয়ম অনুশীলন),, দ্রুত (শপথ), শিষ্টাচার ( কর্মে পরিছন্নতা) নিয়ম ( ধর্মীয় রীতিনীতি), জপ (প্রার্থনা বিড়বিড় করা) এবং ধ্যান মঞ্জুশ্রীকল্প তান্ত্রিক দেবদেবীদের চিত্র অঙ্কন সম্পর্কে বিভিন্ন নির্দেশ দেয়। একইভাবে এটি কেবল জনপ্রিয় মহাযান ধর্মের বিকাশকে নির্দেশ করে না, তান্ত্রিক পূজাও আচার অনুষ্ঠানের বৃদ্ধিকেও নির্দেশ করে। যদিও এই রচনাটি গুপ্ত যুগে সংশোধিত হয়েছিল। এটির মূল রূপটি খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর। অন্যান্য প্রাচীন তান্ত্রিক রচনার মধ্যে রয়েছে দ্ববব্যহসুত্র ( যেটির অস্তিত্ব ছিল সম্ভবত খ্রীষ্টীয় চতুর্থ এর পূর্বে) , মধ্য এশিয়াতে আবিষ্কৃত নীলকান্ত ধারণী এবং তারাকে আহ্বানকারী মহাপ্রত্যঙ্গ ধারণী যেটি সম্ভ খ্রীষ্টীয় তৃতীয় শতকে রচিত হয়েছিল।
পূর্বের আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট যে খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতকের কয়েক শতক পূর্বেই তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের আবির্ভাব হয়েছে ঘটেছিল। প্রকৃতপক্ষে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের আবির্ভাব মহাযানী বৌদ্ধধর্মের সূত্রপাত এর সঙ্গে যুক্ত। প্রকৃতপক্ষে তিব্বতীয়রা কখনোই মহাযান ও বজ্রযান এর মধ্যে পার্থক্য করেনি এবং স্বয়ং নাগার্জুনকে গুহ্য হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের প্রাচীন কেন্দ্র :
বিনয় দোষ ভট্টাচার্য, এস কে দে,উইন্টারনিটজ প্রমুখের মতে তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের আদিনিবাস ছিল পূর্ব ভারতে বিশেষত বাংলা (বঙ্গ ও সমতট অঞ্চল) আসাম ও উড়িষ্যা পাল যুগে নালন্দা বিক্রমশিলা ও দন্তপুরী ছিল এর প্রধান কেন্দ্র। কিন্তু রাহুল সংস্কৃতায়ন মনে করেন মন্ত্রযান ও বজ্রযান উদ্ভব হয়েছিল অন্ধ্রের শ্রীপর্বত ও ধন্য..??? অঞ্চলে। তন্ত্র একটি ঐতিহ্য রয়েছে যে কামাখ্যা, শ্রীহট্ট, উড্ডিয়ান এবং পুর্ণগিরি ছিলো গূচতন্ত্রের সেই সমস্ত কেন্দ্র যেখানে শক্তিপূজা প্রথম প্রচলিত হয়। বিনয় দোষ ভট্টাচার্য এই সমস্ত পাঠগুলিকে পূর্বভারতে সনাক্ত করেছেন তার মতে এই তালিকায় উড্ডিয়ানের অবস্থান ছিল বঙ্গ সমতট অঞ্চলে। তবে এল এম যোশীর মতে বৌদ্ধতান্ত্রিকতার উৎপত্তি হয়েছিল দুটি স্থানে দূরবর্তী দক্ষিণ ও উত্তর পশ্চিম অন্ধ্রের সঙ্গে গূঢ়তন্ত্রের প্রাচীন যোগাযোগের বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় নিম্নলিখিত বিষয়গুলি থেকে
(১)প্রজ্ঞাপারমিতার সর্ব প্রাচীন গ্রন্থ থেকে জানা যায় মন্ত্রযান সৃষ্টিকারী রচনা প্রজ্ঞাপারমিতার সৃষ্টি হয়েছিল দক্ষিণপথে।
(২)সেকোদেব থেকে জানা যায় যে মন্ত্র যান শ্রীধন্যকটকে প্রচারিত হয়েছিল।
(৩)বিভিন্ন বৌদ্ধ ঐতিহ্য গুচতত্বের রক্ষাকর্তা নাগার্জুনকে শ্রীপর্বতের সঙ্গে যুক্ত করেন।
(৪) হিউয়েন সাং এর মতে মহাসাংঘিক ধারণীর একটি সম্পূর্ণ পিটক ছিল অন্ধ্রে সমৃদ্ধি লাভ করেছিলেন।
(৫) আর্যমঞ্জুশ্রীকল্প আবিষ্কৃত ও সম্ভবত রচিত হয়েছিল দক্ষিণ ভারতে।
(৬) হিউয়েন সাং লিপিবদ্ধ করেছেন যে ভববিবেক ধন্যকটকে গিয়েছিলেন সেখানে তিনি দীর্ঘ সময় ধরে বজ্রপানি ধারণি আবৃত্তি করেছিলেন।
(৭) বানভট্টের হর্ষচরিত ও কাদম্বরীর ভবভূতির মালতিমাধব এবং জলহনেক রাজতরঙ্গিনীতে লিপিবদ্ধ রয়েছে যে শ্রী পর্বত ছিল তন্ত্র ও মন্ত্রের এক মহান কেন্দ্র।
তান্ত্রিক ধর্মের আরেকটি বিশাল প্রাচীন কেন্দ্র ছিল উড্ডিযান ও উড্যান যেটিকে চারটি তান্ত্রিক পাঠের অন্যতম রূপে বর্ণনা করা হয়েছে বহু পন্ডিত উড্ডিয়ানকে উডিষ্যারূপে সনাক্ত করেছেন বা বঙ্গ সমতট অঞ্চলে অবস্থিত বলে মনে করেছেন। কিছু ওয়াডেল, লেডি উচ্চি, বাগচি এবং যোশীর মতে এটি হিউয়েন সাং এর উড্ডীয়ান এবং পাকিস্তানের আধুনিক সোয়াট উপত্যকার সঙ্গে অভিন্ন। হিউয়েন সাং বলেন সোয়াট উপত্যকার অধিবাসীরা তন্ত্র মন্ত্রকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করত পালি সাহিত্যে গান্ধাররাজ্যকে ডাকিনি ও ওজাবিদ্যার শিল্প বলে মনে উল্লেখ করা হয়েছে।হিউয়েন সাং চারটি পবিত্র স্থান সম্পর্কে কিংবদন্তি বর্ণনা করেছেন উড্ডিয়ানে বুদ্ধ পূর্বজন্মে তার হাত-পা ছেদন করেছিলেন (শিবের স্ত্রী সতীর দেহ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করার কিংবদন্তির সঙ্গে তুলনীয়)। প্রত্নতাত্ত্বিক খননটি থেকেও উত্তর-পশ্চিমে তান্ত্রিক ধর্মের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে। শেষত অসঙ্গ (যিনি গুচ তত্ত্বের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত ছিলেন), পদ্মাসম্ভব (তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্মের প্রাণপুরুষ), ইন্দ্রভূতি (একজন তান্ত্রিক লেখক) এবং চান্টুনা (কাশ্মীরের রাজা ললিতাদিত্যের ওঝা প্রধানমন্ত্রী) সকলেই তুখারা দেশের মানুষ ছিলেন।
তান্ত্রিক ধর্ম মূলত ব্রাহ্মণ্য না বৌদ্ধ :??
এই বিষয়ে অফ বা অগ্রসর হওয়ার পূর্বে তান্ত্রিকধর্ম বৌদ্ধধর্মে ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাবে প্রবেশ করেছিল কিনা তা সংক্ষেপে আলোচনা করা যেতে পারে। অস্টিন ওয়াডেল এর মতে বৌদ্ধধর্ম শৈব মূর্তিপূজা,শক্তি পূজা ও ভূত-পেততত্ত্ব ছাড়া আর কিছুই নয়। পক্ষান্তরে বিনয়তোষ ভট্টাচার্য introduction to Buddhist esolarism নামক গ্রন্থে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে বৌদ্ধরাযই তাদের ধর্মে প্রথম তন্ত্রের প্রবেশ ঘটিয়েছিলেন এবং হিন্দুরা এগুলিকে পরবর্তীকালে বৌদ্ধদের থেকে ধার করেছিলেন। অনাগরিক গোবিন্দও বলেন যে হিন্দু ধর্মের উপর তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের প্রভাব এত ব্যাপক যে আজও পশ্চিমী পন্ডিতেরা এই ধারণার বশবর্তি হয়ে পরিশ্রম করছেন যে তান্ত্রিক ধর্ম হিন্দুদের সৃষ্টি যেটিকে পরবর্তীকালে অধিকার করেছিলেন মোটামুটিভাবে পতনশীল বৌদ্ধধর্ম। তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন "বৌদ্ধতন্ত্রকে শৈব ধর্মের ফলাফলরূপে একমাত্র তারাই ঘোষণা করতে পারে যাদের তান্ত্রিক সাহিত্য সম্পর্কে কোন প্রত্যক্ষ জ্ঞান নেই। " হিন্দুতন্ত্র ও বৌদ্ধতন্ত্রের (সেগুলি প্রধানত তিব্বতীয় ভাষায় সংরক্ষিত ছিল এবং এইজন্য দীর্ঘকাল ভারততত্ত্ববিদদের দৃষ্টির অগোচরে ছিল) তুলনা করলে বাহ্যিক সাদৃশ্য সত্বেও পদ্ধতি ও উদ্দেশ্যের দিক থেকে অনেক বিস্ময়কর পার্থক্য নজরে পড়বে এবং বৌদ্ধতন্ত্রের আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক অগ্রাধিকার ও নিজস্বতা দৃষ্টিগোচর হবে। কিন্তু আমরা এই দুটি মতের কোনোটির সঙ্গেই একমত নই। আমরা মনে করি বৌদ্ধতন্ত্র বা ব্রাহ্মণ্য তন্ত্রের অগ্রাধিকারের প্রশ্নটি উঠেই না কারণ এরা উভয়ই সেই বীজ থেকে একই সঙ্গে উৎপন্ন হয়েছিল যার উৎস খুঁজে পাওয়া যাবে প্রাকবৌদ্ধ যুগে মন্ত্র বলতে বুঝায় প্রার্থনা যা দেবতার কাছে পবিত্র। মন্ত্র বলতে জাদুকেও বুঝায়। অতএব "প্রাম" হল প্রজ্ঞাপারমিতার প্রতীক একটি মন্ত্র প্রায়ই প্রতীকিভাবে একজন দেবতা বা এমনকি ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্ব করে। তাই "ত্তম" শব্দটি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে বোঝায় । মঞ্জুশ্রীকল্প মন্ত্র ও তাদের গুণের বিবরণে পূর্ণ মন্ত্রগুলি ধারণী থেকে উৎপন্ন হয়েছে বলে মনে হয়। গুহ্যসমাজ ও হেবজ্রতন্ত্রে মন্ত্রাচার সম্পর্কে একটি সম্পূর্ণ অধ্যায় রচিত হয়েছে। মহাসংঘিকরা ধারণী পিটক রচনা করেছিলেন বলে জানা গিয়েছে। ধারণীগুলি অনেক প্রাচীন মহাযানীগ্রন্থেও উদ্ধৃত করা হয়েছে। গিলগিটে আবিষ্কৃত প্রাচীন লিপি বিজ্ঞান অনুসারে খ্রীষ্টীয় পঞ্চতম ও ষষ্ঠ শতকে রচিত অনেক পুঁথিতে ধারণী ও মন্ত্র রয়েছে। এই পুঁথিগুলির বিষয়বস্তু নিঃসন্দেহে তাদের লিপির থেকে প্রাচীনতর।....??? হতে একটি ধারণী বুদ্ধ রচনা করেছিলেন বলা হয়েছে। লঙ্কাবতারে অনেক জাদু মন্ত্র রয়েছে এবং বোধিসত্ত্বভূমিতে পদাংশগুলির অর্থ এবং অতীন্দ্রিয় বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা রয়েছে। মন্ত্র ছাড়াও তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের অপর বৈশিষ্ট্য হল বহু এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ দেব মন্ডলী যদিও মহাযানীরা দীর্ঘ সময় ধরে বুদ্ধগণ, বোধিসত্ত্বগণ, কয়েকজন অর্ধদেবতা এবং কয়েকজন দেবতায় পরিচিত সাধু পূজা করে আসছিলেন তবু বৌদ্ধ দেবতা মন্ডলীর সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ হলো বৌদ্ধধর্মের তান্ত্রিক পর্যায়। তান্ত্রিক বৌদ্ধ রচনায় সাধারণত জটিল উপাসনাতত্ত্ব, মূর্তিতত্ত্ব, ধ্যানী বুদ্ধ (অক্ষোভ্য বৈবোচন অমিতাভ রত্নসম্ভব এবং অমোঘসিদ্ধি এর ঈশ্বর তন্ত্র সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা রয়েছে। এদের প্রত্যেকে একটি শক্তি বা সাধনসঙ্গিনী একজন মানব বৌদ্ধ। একজন বোধিসত্ত্ব, একটি পরিবার, একটি বীজমন্ত্র, একটি মৌল, একটি রং একটি সন্ধি, একটি যান এবং মানব দেহের একটি বিশেষ দিক ও অবস্থানের সঙ্গে যুক্ত। তান্ত্রিক ধর্মের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল শক্তির উপাসনা। পণ্ডিতদের মতে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র ও বৌদ্ধতন্ত্রের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল শেষ উক্তিটি শক্তি পূজা করেনা স্বর্গীয় ক্ষমতা, শিবের সৃষ্টিশীল নারী বৈশিষ্ট্য বৌদ্ধধর্মে কোন ভূমিকা পালন করে না। বৌদ্ধদের কাছে শক্তি হল মায়া। এটি হলো সেই ক্ষমতা যা ভ্রম সৃষ্টি করে এবং যার থেকে একমাত্র প্রজ্ঞাই আমাদের মুক্ত করতে পারে। কিন্তু আমরা এই পরিবর্তনের সঙ্গে একমত হতে পারি না। বৌদ্ধতান্ত্রিকরা হিন্দুতান্ত্রিকদের মতোই শক্তি সাহচর্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এমনকি তারা একথা ও বিশ্বাস করেন যে শাক্যমুনি স্বয়ং এ কথা আবিষ্কার করেছেন যে বুদ্ধত্ব থাকে স্ত্রী যৌনাঙ্গে এবং বজ্রযোগিনী সঙ্গে মিলনের মহাসুখ লাভের সময়ে এই গুপ্ত শিক্ষা দান করেছেন। L M Jashi কে উদ্ধৃত করে বলা যায় বৌদ্ধ তান্ত্রিক সংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গুরুত্ব প্রদান এটিকে আমরা শক্তি পূজা বা স্ত্রী শক্তির পূজা বা আধ্যাত্মিক সাধনায় সঙ্গিনীর সঙ্গে যৌথ প্রচেষ্টা বলতে পারি পণ্ডিতরা এই বিষয়ে একমত যে শক্তি সাধনাই হিন্দু বা বৌদ্ধতন্ত্রের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বস্তু।
তান্ত্রিক সাধনার অর্থ হল যথাযথ মন্ত্র জপ করা বা দেবীর রুপ বা প্রতীক বিষয়ে ধ্যান করার মাধ্যমে দেব দেবীকে আহবান করা।।মিশ্র সংস্কৃত ভাষায় প্রাপ্ত অনেকগুলি সাধনায় রয়েছে বিভিন্ন দেবদেবীর প্রশংসা যাদের প্রার্থনা বিভিন্ন রূপ মূর্তিতত্ত্বের বিস্তারিত বর্ণনা এবং এবং পূজা পদ্ধতি ইত্যাদি। তান্ত্রিক ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো মণ্ডল।"মণ্ডল" "শব্দের অর্থ হলো বৃত্ত। কিন্তু কৌশলগতভাবে এটি ভারতীয় অতীন্দ্রিয়বাদের একটি অন্যতম সুক্ষ্ম ধারণাকে বোঝায়। এখানে মণ্ডল বলতে বুঝায় অস্তিত্বের একটি আদর্শগত পরিবেশন একটি অলৌকিক বৃত্ত একটি জাদু নকশা বা দেবত্বের এলাকা তুচ্চি বলেন "মণ্ডল একটি পবিত্র পৃষ্ঠতল অঙ্কন করে এবং এটিকে দৈত্য বৃত্তদ্বারা পরিবেশিত ধ্বংসকারী শক্তির আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। "প্রায় প্রতিটি তান্ত্রিক গ্রন্থে গুরু বা শিক্ষকের গুরুত্ব কথা বলা হয়েছে গুরুর দয়া ও পথ নির্দেশ ছাড়া সাধনার পথে অগ্রসর হওয়া অসম্ভব। গুরুকে সত্যের মুর্ত প্রতীক হিসেবে শ্রদ্ধা ও মান্য করতে হবে। তাঁকে ঈশ্বর রূপে ভক্তি করতে হবে। তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে পরম সত্যকে প্রায়ই প্রজ্ঞার ও উপাদায়ের ঐক্য রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এটিকে অদ্বয দুয়ের মধ্যে এক এবং পরম উপলব্ধির পর্যায়রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রজ্ঞা হল শূণ্যতার সঙ্গে অভিন্ন এবং উপায় এর সঙ্গে অভিন্ন। মহাযান সূত্রে এই শব্দ দুটি অত্যন্ত সুপরিচিত। বোধিসত্ত্ব করুণা ও প্রজ্ঞা উভয়েরই প্রতিমূর্তি। তিনি পার্থিব বস্তুর শূণ্যতাকে উপলব্ধি করেন এবং জানেন যে এই সংসার ক্ষণস্থায়ী ও দুঃখময়। করুণার বশবর্তী হয়ে তিনি দুর্দশাগ্রস্থ প্রাণীদের মুক্তির জন্য প্রচেষ্টা চালান
তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে নির্বাণকে মহাসুখ রূপে দেখা হয়েছে। এর অর্থ হল এই যে পরম সত্য এক ধরনের মহা সুখ বিভিন্ন প্রকার সুখের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। এটি শূণ্যতা ও করুণা বা প্রজ্ঞা ও উপায়ের মধ্যে ঐক্য; মহাসুখ হল প্রজ্ঞাপায় অর্থাৎ প্রজ্ঞা ও উপায় এর অদ্বয় মিলন। মহাসুখ হল সমস্ত তথাগতদের প্রজ্ঞা এবং প্রকৃতির দিক থেকে এটি কে নিজেই জানা যায়( স্বসংবেদ)। এটিকে নেতিবাচকভাবে ও বর্ণনা করা হয়েছে। এইজন্য সবহ বলেন মহাসুখ হল নিঃস্বভাব, অনির্বচনীয় এবং আত্ম বা অনাত্ম মুক্ত।
বৌদ্ধ তন্ত্রের ভাষা মিশ্র সংস্কৃত কিন্তু এর অর্থ হলো বিশেষ ; "জটিল ও অলৌকিক" এটিকে বলা হয় সন্ধ্যাভাষা যার দ্বারা বোঝা যায় দীক্ষিতদের সেই মন্ডলীর একটি ভাষাতাত্ত্বিক মাধ্যম যেখানে তার সদস্যরা কিছু ঐচ্ছিক প্রতীক এবং চিহ্ন ব্যবহার করে যার নাম হল চোমা। এটি কোন গ্রন্থের অগভীর অর্থের পরিবর্তে প্রকৃত অর্থকে বোঝায়।
তন্ত্রের বিভিন্ন সম্প্রদায় :
মন্ত্রযান :
তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের অনেক রূপ রয়েছে এবং এগুলির থেকে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উৎপত্তি হয়েছে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে এটির প্রাচীনতম পর্যায়ে কে সাধারণত মন্ত্রযান বলা হয়ে থাকে। কঠোরভাবে বলতে গেলে মন্ত্রযানের বিষয়বস্তু হলো মন্ত্র (বিশেষ পদ্ধতিতে উচ্চারিত এবং বিশেষভাবে সংযুক্ত কয়েকটি শব্দ) এবং মন্ত্র (জাদু বৃত্ত) এবং এর মধ্যে রয়েছে ধারণী,, মালা মন্ত্র, হৃদয় মন্ত্র ইত্যাদি। এখানে বিশ্বাস করা হয় যে মন্ত্র উচ্চারণ করলে অলৌকিক ক্ষমতার উৎপত্তি হয় এগুলো সাহায্যে সাধক তার মনের যেকোনো বাসনাকে পূর্ণ করতে পারে। যেমন ধন-সম্পদ, বিজয়,সিদ্ধি এমনকি মুক্তি। মন্ত্র বা মন্ডল মন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত কারণ মন্ত্র কোন ক্ষমতা দান করতে পারে না যদি না এর যথাযথ স্থানে যথাযথ মন্ত্রের অক্ষর স্থাপিত হয় আর্যমঞ্জুশ্রীকল্প গুহ্যসমাজতন্ত্র এবং সদ্ধর্মপুন্ডবীজ মন্ত্র এবং ধারণানিতে পরিপূর্ণ এবং এগুলি রচিত হয়েছিল খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতাব্দী নাগাদ। একটি সম্প্রদায় হিসেবে মন্ত্রযানকে নাগার্জুনের সমসাময়িক মনে করা হয়।
বজ্রযান:
গুহ্য সমাজে বাহ্য জগতের একটি বিবরণ রয়েছে এবং মনে করা হয়, মূল তথাগত বা পরম সত্য থেকে উৎপন্ন। প্রাচীন বৌদ্ধদের পাঁচ প্রকার অন্ধ স্কন্ধ এবং রাগ মোহ ও দ্বেষের মত অকুশগুলিকেও বুদ্ধের ব্যক্তিভবন বলে মনে করা হয় এবং আরো মনে করা হয়। এগুলি মূল তথাগত থেকে উৎপন্ন এবং এটির নাম বস্তু স্বাগত এই কারণে সমস্ত বুদ্ধের উৎস হল বজ্র এবং এটি পূর্ণ্যতা বা সত্যের সঙ্গে অভিন্ন। কিন্তু বজ্রযানে শূর্ণ্যতা হল সদর্থক কিছু (যেটি কে ইন্দ্রামতি মহা শোক এবং অনজ্ঞ ভদ্র প্রজ্ঞাপায়রূপে সংজ্ঞায়িত করেছেন। কোন বৈশিষ্ট্যশূণ্য হওয়ায় বজ্র আমাদের সত্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অক্ষম এবং নিজেকে কায়-বাক-চিত্ত-বজ্রে পরিণত করে এবং বজ্রযানের পথ প্রদর্শন করে (হীরক মার্গ)। এই কারণে বজ্রযানীরা বুদ্ধের ত্রিকায় সম্পর্কে মাধ্যমিকদের মত যোগাচারী মতকে সমর্থন করে এবং বজ্রকে বা শূন্যতাকে সংসারের সঙ্গে অভিন্ন মনে করে। বজ্রযানী সাধকদের এই শিক্ষা দেয়া হয় যে মল-মূত্র ইত্যাদি কোন সুখাদ্যের থেকে পৃথক নয় এবং মা-বোন বা অপরের স্ত্রী বা নিম্নবর্ণের কোন নারীকে অন্যান্য নারীদের মতোই উপভোগ করা যেতে পারে।
যদিও অনেক দিক থেকে বিকৃত কিন্তু তবু বৌদ্ধ ধর্মে বজ্রযানের অনেক অবদান রয়েছে। কোন কোন হিন্দুও এর দর্শন দেবদেবী মন্ত্র সাধনা ইত্যাদি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।
সিদ্ধাচার্যদের পূজা :
সমস্ত ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায় এই সিদ্ধি ( মানসিক ও অলৌকিক ক্ষমতা) র ধারণা প্রচলিত। ব্রাহ্মণবাদী রচনায় আট প্রকার সিদ্ধির কথা বলা হয়েছে। বৌদ্ধ রচনায় ১০ প্রকার ক্ষমতা ( ইদ্ধি,ঋদ্ধি, অভিজ্ঞা)র কথা বলা হয়েছে যেমন নিজের মানসিক মূর্তি তৈরি করা, অদৃশ্য হওয়া, দেওয়াল ইত্যাদি কঠিন পদার্থের মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া, কঠিন জমি ভেদ করে নিচে যাওয়া যেন সেটা জল, জলের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া, আকাশে উড়া, চাঁদ ও সূর্যকে স্পর্শ করা সর্বোচ্চ স্বর্গে আরোহন করায় ইত্যাদি।
বৌদ্ধ তান্ত্রিকেরা যারা অষ্টম থেকে দশম শতকের মধ্যে বর্তমান ছিলেন তারা চষাশিজন সিদ্দর তত্ব নির্মাণ করেছিলেন। যারা যোগের মাধ্যমে অলৌকিক শক্তি অর্জন করেছিলেন। জ্যোতিজর্মা (চতুর্দশ শতক) এদের নাম উল্লেখ করেছেন এবং তিব্বতীয় গ্রন্থ থেকে তাদের জীবনী সম্পর্কে জানা যায়। তাদের নাম হল
(১) লোহি বা লুই পা (২)লীলা পা,(৩) বীরূপা (৪)ডোম্বি পা (৫)সবর(সবরি) পা (৬)সবই পা (রাহুল ভদ্র) (৭)কঙ্কালি পা (৮)মিনা পা (৯) গোরাক্ষপা (১০) চৌরঙ্গি পা (১১) বিনা পা (১২) শান্তি পা, (১৩)জ্ঞাতিপা (১৪)চারুমতি পা (১৫)খন্দ পা, (১৬)নাগার্জুন, (১৭) কানহা-পা
(১৮)জর্নাবি (আর্মদেব), (১৯)থাগানা পা (২০) নিরোপা (২১)শালি পা (শৃগলি), (২২) তিলো পা (তালিকা পাদ) (২৩) ছাত্র পা (২৪)ভদ্র পা, (২৫) দ্বিখণ্ডি পা, (২৬)অযোগি পা,(২৭) কাদা-পা, (২৮)দ্বিখণ্ড পা, (২৯)কঙ্কনা পা,(৩০)কম্বলা পা, (৩১)গেঙ্গি (টেঙ্কি পা), (৩২)ছাড়ে পা,(৩৩) তনহি পা,(৩৪) কুজ্জুরি পা (৩৫)চজবি (কশুলি পা), (৩৬)ধর্মপা (৩৭)মাহি পা, (৩৮) অচিন্তি পা,(৩৯) বাভাহি বা ডলহ পা,(৪০) নলিন পা, (৪১)ভুসুকু পা, (৪২) ইন্দ্রাভূতি,(৪৩) মেঘপাদ (মেঘপা) ,(৪৪) কুঠাবি পা বা কুঠালি পা,(৪৫)কর্মর পা, (৪৬) জলন্ধর পা, (৪৭)রাহুল পা,(৪৮) গর্ভরি পা, (৪৯)চকরি পা, (৫০) মেদিনি পা,,(৫১) পঙ্কজ পা, (৫২)ঘণ্টা পা,(৫৩)যোগিপা, (৫৪)চেলুকা পা, (৫৫)ভাগুবি (গুণ্ডারি) পা, (৫৬) লুঞ্চাকা পা, (৫৭)নিগুণ পা,(৫৮) জয়াননন্দ, (৫৯) চর্পতি পা,(৬০) চম্পক পা,(৬১)ভীষণ (ভিখন) পা,(৬২) ভালি (তেলি), তাইলি) পা,(৬৩) কুমারী পা,(৬৪)চারস্লটি বা চাভবি বা জাভবি পা (৬৫)মনিভদ্রা (যোগিনী) (৬৬) মেখলা পা (যোগিনী ), (৬৭)মনখানা পা (যোগিনী), (৬৮)কলকল পা (৬৯) কষ্যাধী পা (৭০)দাউদি বা চাহুলী পা (৭১)উচালি পা, (৭২) কপালা পা, (৭৩)কিলা পা, (৭৪)পুষ্কর বা সাগর পা, (৭৫)সর্বভক্ষ পা, (৭৬) নাগোবোটি পা, (৭৭)দ্বারিকা পা, (৭৮)পুত্তলি বা পুতলি পা, (৭৯)পনহ বা উপনহ পা,(৮০) কোকালি পা, (৮১) অনঙ্গ পা, (৮২) লক্ষ্মীঙ্কর (যোগিনী), (৮৩) সমুদ্র পা, এবং, (৮৪) ডালি বা ভ্যালি পা।
কোন কোন পন্ডিতের মতে ৮৪ জন সিদ্ধাচার্যের এই তালিকার কোন ঐতিহাসিক মূল্য নেই। তাঁরা এই যুক্তি পেশ করেন যে ৮৪ সংখ্যাটির একটি অলৌকিক ব্যাঞ্জনার কারণে অতগুলি নাম (তা বাস্তবের হোক বা কল্পনার) তালিকাপুর্ণ করার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। কিন্তু একথাও সত্য যে এ তালিকার অনেক শিক্ষকেরই বাস্তবে অস্তিত্ব ছিল এবং তাঁদের পাণ্ডিত্য এবং আধ্যাত্বিক সাফল্যের জন্য বৌদ্ধিক জগতে পরিচিত হয়েছেন। তাঁদের অনেক রচনা এবং সঙ্গী আংশিকভাবে তাদের মূলরূপে কিন্তু প্রধানত তিব্বতীয় অনুবাদের মাধ্যমে সংরক্ষিত হয়েছে (তাঞ্জুল খণ্ড XL VII এবং XL VIII)।
বিভিন্ন সিদ্ধাচার্যদের তারিখ সম্পর্কে বলা যায় যে প্রথমোক্তজন অর্থাৎ লুহিপা সম্ভবত ছিলেন অন্যান্য ঐতিহ্যের মৎসেন্দ্রনাথের সঙ্গে অভিন্ন যিনি খ্রিস্টীয় দশম শতকের শুরুতে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। সিদ্ধাচার্য খ্রিস্টীয় দশম শতকে বর্তমান ছিলেন এবং চারপাতিও তাই।তিলোপা বাংলার রাজা প্রথম মহিপালের (৯৮৮-১০৩৮)সমসাময়িক ছিলেন এবং নারোপা ছিলেন তাঁর শিষ্য। জলন্ধর পা ও কানহো পা একাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বর্তমান ছিলেন। এইভাবে সবচেয়ে বিখ্যাত সিদ্ধাচার্যগণ দশম ও একাদশ শতকে বর্তমান ছিলেন। যদিও তাদের কেউ কেউ দ্বাদশ শতকে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। তাদের অধিকাংশকেই বাহ্যিকভাবে একাদশ শতকে স্থান দেওয়া যেতে পারে। সিদ্ধাচার্যরা সাধারণভাবে তন্ত্র শিক্ষা দিতেন একজন উপযুক্ত গুরু ছাড়া আর কারো শিষ্যকে তন্ত্র সাধনার রহস্যে দীক্ষা দেওয়ার অধিকার ছিল না। গুরুর দায়িত্ব ছিল শিষ্যের বিশেষ প্রবণতাটিকে বের করে তাকে তার পক্ষে উপযুক্ত সাধনা পদ্ধতি সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়া। এই ধরনের পাঁচটি কূল রয়েছে এগুলি হল -ডোম্বি, নাটি,রজকী,চণ্ডালি ও ব্রাহ্মণী। এই কুলগুলির মূল বৈশিষ্ট্যগুলি নির্ধারিত হয় পাঁচটি স্কন্ধ, পাঁচটি কূল হল প্রজ্ঞার পাঁচটি দিক। শক্তি পাঁচটি বিভিন্ন রূপ গ্রহণ করে প্রতিটি স্কন্ধের বা উপাদানের আধিপত্যের উপর নির্ভর করে। দীক্ষিতের সবচেয়ে ভালো উপায় হল তার সাধনার সময়ে তার বিশেষ কূল শক্তিকে অনুসরণ করা। সিদ্ধ সাধনা হল সিদ্ধাচার্যদের দ্বারা নির্মিত যোগের একটি নতুন রূপের অনুশীলন। এটি অনুসারে দেহের মধ্যে ৩২ টি নাড়ি রয়েছে।অলৌকিক শক্তি যার উৎপত্তিস্থল হলো নাভিতে। এই নাড়িগুলির মধ্যে দিয়ে উপরে প্রবাহিত হয়ে মস্তিষ্কের মধ্যে সর্বোচ্চ মহাসুখ স্থানে পৌঁছয়। এই নাড়িগুলিকে বিভিন্ন নাম দেওয়া হয়েছে, যেমন_ ললনা, বসনা অবধুতি,প্রবণা, কৃষ্ণ জপিনী, সামান্য পাঠকি,সুমনা, কামিনী ইত্যাদি। ছাড়াও দেহের মধ্যে আরো অনেকগুলি স্থান রয়েছে যেগুলি হয় পদ্মা নয় চক্র বলা হয়। এগুলিকে বিভিন্ন তীর্থস্থানের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে যেমন উড্ডিয়ান, জলন্ধর, পূর্ণগিরি এবং কামরূপ। উর্ধ্বগতিতে অলৌকিক শক্তিকে এগুলিকে অতিক্রম করে যেতে হয়।
সাধনার পরম লক্ষ্য হলো সহজেের পর্যায়ে লাভ যেটি হল পরম সুখের একটি পর্যায়লাভ যার কোন শুরু বা শেষ নেই এবং যা দ্বৈততা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এই পর্যায়ে সাধক কেবল নিজেকেই একমাত্র সত্যরূপে আবিষ্কার করে যা বিশ্বজগৎ ও বুদ্ধের সঙ্গে অভিন্ন। তিনি এমন একটি সত্তা মুক্ত অন্য সবকিছুই তখন অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে।সর্বোচ্চ পর্যায়ে লক্ষ্যে পৌঁছালে কিছু দৈহিক অলৌকিকতা সৃষ্টি হয়।অতএব?? সাধনার উপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল যার মধ্যে রয়েছে দেহের Transubstantiation পরবর্তীকালে সিদ্ধাচার্যদের অনুগামীরা এটিকে চরম পর্যায়ে নিয়ে গেলেন এবং নিজেদের কেবলমাত্র একটি অপরিবর্তনীয় নিখুঁত ও জরাহীন দেহ লাভ করায় ব্যস্ত রাখলেন তাদের তাদের দীর্ঘজীবন দান করবে। এটিকে বিভিন্ন উপায়ে লাভ করা যেতে পারে যে গুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বোধিচিত্ত (বীর্য) এর ঊর্ধ্বগমন। বোধিচিত্রের চর্চা কিছু অপরসায়নের চর্চার সঙ্গে যুক্ত ছিল। সিদ্ধাচার্য নাগার্জুন সাধনার সঙ্গে অপরসায়নকে যুক্ত করেছিলেন। সিদ্ধাচার্যগণ সাধনার ক্ষেত্রে আরো অনেক কিছু উদ্ভাবন করেছিলেন কিন্তু বর্তমানে তাদের অনুসরণ করা অত্যন্ত কঠিন কারণ তাদের গ্রন্থগুলি অত্যন্ত প্রতীকি ভাষায় রচিত।
নাগপন্থা :
নাথপন্থীরা বজ্রযান ও ৮৪ জন সিদ্ধাচার্য দ্বারা অনুপ্রাণিত.।নাথপন্থীদের প্রবক্তারা বৌদ্ধ তন্ত্রের শিক্ষা গুলির হিন্দুকরণ করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তান্ত্রিক ধর্ম একটি বিশাল সমন্বয়কারি শক্তিতে পরিণত হয়েছিল এবং এর প্রতিফলন নাথ সম্প্রদায়ের মধ্যে।প্রথমে নাথরা ছিল সংখ্যায় নয়।কখনো কখনো এদের বৌদ্ধদের ৮৪ জন সিদ্ধাচার্যের নামের তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয় কিন্তু এই দুটি সম্প্রদায়কে অভিন্ন মনে করলে ভুল হবে। । নাথপন্থীরা যোগ ও হঠযুগের রাত্রে অনেক নতুন উপাদান যোগ করেছিলেন যেগুলি বৌদ্ধ তন্ত্রের প্রবক্তাদের শিক্ষার থেকে ভিন্ন। সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগে নাথ পন্থা ৮৪ জন সিদ্ধাচার্যের শিক্ষা ও অতীন্দ্রিয় সঙ্গীতের মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।এটি নেপাল ও তিব্বতে ছড়িয়ে পড়ে এবং তান্ত্রিক গ্রন্থ তিব্বতীয় ভাষায় অনূদিত হয়।কিছু কিছু রচনা চীনেও পৌঁছয় এবং বর্তমানে এগুলি চীনা অনুবাদে পাওয়া যায়
সহজযান :
বজ্রযান পরবর্তীকালের অন্যান্য অনেক যানের জন্ম দেয় যেমন সহজযান ও কালচক্র জান এই কথা মনে করা হয় যে সিদ্ধাচার্য সরহের মাধ্যমে বজ্রযানের সূত্রপাত হয়েছিল। সহজযান বলতে তিনি বুঝিয়েছিলেন সহজ পথ। তার মতে খাওয়া পান করা,ও আনন্দ করার মাধ্যমেও সিদ্ধি লাভ করা যেতে পারে। এর দ্বারা নির্বাণ লাভের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতাকে বাতিল করা হয়। উড্ডীয়ানের রাজা ইন্দ্রভূুতির বোন লক্ষ্মীঙ্করদেবী (৭২৯ খ্রী) ছিলেন আর একজন মহান সহজযানী। তিনি তার অদ্বয়সিদ্ধি গ্রন্থে ঘোষণা করেছেন যে দুঃখ,উপবাস, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান বা সমাজ এর নিয়ম মান্য করা কোন কিছুই মুক্তি লাভের জন্য প্রয়োজনীয় নয়। কাঠের,পাথরের বা মাটির দেবতার মূর্তির সামনে নতজানু হয় নিরর্থক। সাধককে অবশ্যই নিজের দেহের কাছে অর্ঘ্য নিবেদন করতে হবে এখানে সমস্ত দেবতার বসবাস এই আন্দোলন বৈষ্ণব ধর্মের উপরেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।
কালচক্রযাব
:
কালচক্রযানকে বজ্রযানের পরবর্তী বিবর্তন বলে মনে করা হয়। কালচক্রতন্ত্র ও সেটির ভাষ্য পুন্ডরীক রচিত বিমলপ্রভা অনুসারে বা সময় করুনার বাহ্যিক প্রকাশ এবং চক্র হলো বস্তুজগৎ।কালচক্র হলেন একজন ভয়ানক দেবতা শূন্যতা ও করুণার প্রতিমূর্তি যাকে আলিঙ্গন করে রয়েছেন শক্তি বা দেবী প্রজ্ঞা। এইভাবে কালচক্র অদ্বয়ের দার্শনিক ধারণাকে
সচীত করে।এটি প্রজ্ঞা ও উপায়ের মিলন। কাল চক্রকে আদি বুদ্ধ বা বুদ্ধগণেরও অর্থাৎ ধ্যানী বুদ্ধদেরও জনক বলে মনে করা হয়। নিজের দেহের মধ্যে সমস্ত পৃথিবী প্রকাশিত হয় এই ধারণার সহজযান ও নাথপন্থার দর্শনের সাদৃশ্য রয়েছে। পূর্ব ভারত ও হিমালয় অঞ্চলে এই দর্শন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
এখানে ধর্ম পূজারও উল্লেখ করা যেতে পারে। এর অনুগামীরা আসে মূলত সমাজের নিম্নবর্ণ থেকে -যেমন ডোম ডাল, চন্ডাল ইত্যাদি.।এটি বজ্রযান ও মন্ত্রযান ইত্যাদি বৌদ্ধ সম্প্রদায় থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেছে।
বৌদ্ধ তন্ত্রের মূল্যায়ন
বৌদ্ধ তন্ত্রের সমালোচনা :
বহু আধুনিক পন্ডিত বুদ্ধতন্ত্রের ব্যাপক সমালোচনা করেছেন। নলিনাক্ষ দত্তের মতে, " এই ধর্ম নিজেকে অতীন্দ্রিয়বাদের কুয়াশায় হারিয়ে ফেলে যতগুলি মুদ্রার, মন্ডল, ভূতপ্রেতে বিশ্বাস এবং দেবদেবী ও রাক্ষসের পূজার গ্রাসে পড়েছিল। একইভাবে পৃথিবীর অন্যতম মহত্বম মানুষের শিক্ষা বিকৃত হয়ে পড়েছিল। এছাড়াও ধর্ম ও দর্শনের প্রয়োজনীয় ও পরিস্থিতির মানুষের মনকে সর্বনিম্ন অশ্লীলতার স্তরে নামানো হয়েছিল।?? রাজেন্দ্রলাল মিত্র উইন্টারনিটজ, চার্লস এলিয়ট ও পেটসিনসহ অন্যান্য আরো অনেক পন্ডিত তরুণ যোগী ও যোগিনীদের গোপন দীক্ষা অনুশীলন নিজের অনুমান মাংস ও মদ্যের ব্যবহার এবং গূচ তত্বের গ্রন্থের সেগুলির প্রায়ই উল্লেখকে নিন্দা করেছেন করেছেন। বিনয়তোষ ভট্টাচার্য তন্ত্রগুলিকে অনৈতিকতার নিকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত এবং পাপ বলে মন্তব্য করেছেন এবং তন্ত্রসাধনাকে রোগ বলে উল্লেখ করেছেন।
তবে তন্ত্রের অনেক সমালোচকও স্বীকার করেছেন যে তান্ত্রিক সাধনা প্রদান করে এবং অনেক সাধককে তা আধ্যাত্মিক পর্যায়ে আরোহন করতে সাহায্য করেছে এবং তন্ত্র এমন গভীর ও সূক্ষ্ণবিষয় নিয়ে আলোচনা করে যেগুলিকে উপলব্ধি করতে পারেন একমাত্র তারা যারা তাদের আধ্যাত্মিক শিক্ষকদের কাছ থেকে গূঢ় শিক্ষা লাভ করেছে।"এ কথাও উল্লেখ করা হয়েছে যে তন্ত্রগুলিতে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে তাদের ভাষাকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা উচিত নয় এবং সেগুলির অনুশীলন সাধারণ মানুষের উচিত নয়। এছাড়াও এমন অনেক পন্ডিত রয়েছেন যাঁরা তন্ত্রের উপর প্রশংসার বর্ষণ করেছেন। তুচ্চির মতে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ""তন্ত্রগুলিতে ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার সর্বোচ্চ প্রকাশ রয়েছে, যেটিকে বাইরে থেকে দেখলে অদ্ভুত মনে হতে পারে, যার প্রধান কারণ আমরা সর্বদা সেই প্রতীকি ভাষাটিকে বুঝতে পারিনা যাতে এটি রচিত হয়েছিল। "স্নেলগ্রোড?? লামা অনাগরিক গোবিন্দ তন্ত্রকে আধুনিক পণ্ডিতদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে চেষ্টা করেছেন। আমাদের মনে হয় যে তন্ত্রের রহস্য সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা সত্বেও একথা অস্বীকার করা যাবে না যে তন্ত্র সম্পর্কে যতটুকু জানা রয়েছে তাই আমাদের মধ্যে এক ধরনের বিতৃষ্ণার অনুভূতি জাগ্রত করার পক্ষে যথেষ্ট। বুদ্ধত্ব যোনির মধ্যে বাস করে, দ্বাম কে দ্বাম দ্বারা ধ্বংস করতে হয়, নির্বাণকে একটি যুবতীর আলিঙ্গনের মধ্যে পাওয়া যায় এবং মা বা বোন বা অন্যান্য উপভোগের উপযুক্ত নারীর থেকে আলাদা কিছু নয় এবং পঞ্চ মকারের ব্যবহার ধর্মীয় আচরণ অনুষ্ঠান পালনের জন্য অবশ্যপ্রয়োজনীয় এই সমস্ত ধারণাকে তান্ত্রিক দর্শন স্পষ্টই বিশাল উচ্চতা স্পর্শ করা সত্বেও সমর্থন করা যায় না।
সমাজ পরিবর্তনের কারণ হিসেবে তান্ত্রিক ধর্ম :
মনে হয় যে তন্ত্রসাধনা বিশেষভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল পতিত ও স্বেচ্ছায় পতিত হওয়া মানুষ এবং গৃহহীন ভবঘুরেদের মধ্যে। তান্ত্রিক চিন্তা বা বর্ণব্যবস্থাকে মান্য করতেন না। কুশনবরত্নতে জাতিভেদকে একটি বন্ধন হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে যেটিকে সাধককে কেটে ফেলতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে তান্ত্রিক আচার অনুষ্ঠান পৌরোহিত্য করতেন নিম্নবর্ণের মানুষ। সিদ্ধাচার্যদের রচনায় নৈরাত্মতাকে একটি ডোম্বি বালিকা বলে মনে করা হয়েছে। তাকে বিয়ে করে সাধক পুনর্জন্ম থেকে অব্যাহতি পাবেন এবং অনুত্তর জগতকে যৌতুক রূপে লাভ করেন। তিনি যোগিনীদের সঙ্গে নিয়ে তাঁর সঙ্গে যৌন মিলনে সময় ব্যয় করেন। তিনি তাঁর সঙ্গে দিন রাত কাটান। যে যোগী ডোম্বির সঙ্গ উপভোগ করেন সহজ সুখ দ্বারা উন্মাদ হয়ে পড়েন এবং তাঁকে এক মুহূর্তের জন্যেও ছেড়ে যান না। একইভাবে ভূসুকপাদ কল্পনা করেন অবধুতি একটি চন্ডাল রমণী রূপে এই প্রক্রিয়ায় সামিল হয়েছেন এবং দাবি করেন তিনি তাকে বিয়ে করেছেন। ডোম্বি পা একজন মাতঙ্গ কন্যার কথা কল্পনা করেছেন যে গঙ্গা ও যমুনার মাঝখান দিয়ে নৌকা চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি নৈরাত্মের প্রতীক যা মানুষকে মধ্যপন্থার পথ দিয়ে মহাসুখের দিকে চালিত করে।সরহ পা নৈরাত্মতাকে ও শূণ্যতাকে একটি শবরীকন্যার সঙ্গে তুলনা করেছেন যে মহাস্থানে বসবাস করে। ইন্দ্রভূতির মতে নিম্ন বর্ণের ও পতিত পরিবারের নারীরা গূচতন্ত্রের সাধনার জন্য বিশেষভাবে উপযুক্ত যেমন চন্ডালিনী।গুহ্যসমাজে ধোপাানীদের এই কর্মের জন্য বিশেষভাবে সুপারিশ করা হয়েছে। ৮৪ জন সিদ্ধাচার্যের একটা বড় অংশ নিম্নবর্ণের অন্তর্গত ছিলেন (তাদের প্রায় অর্ধেক ডোম্বি, চামার, চন্ডাল, ধোপা, কলু, দর্জি, জেলে, কাঠুরে, মুচি ইত্যাদি শ্রেণীর) এবং এর থেকে অনুমান করা যায় যে তান্ত্রিক ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন মূলত নিম্ন বর্ণের মানুষেরা। কোন কোন নারী ও সিদ্ধাচার্য হয়েছিলেন। রাজা ইন্দ্রভূতির বোন লঙ্কীঙ্কর সম্ভলনগরে বাস করতেন, মণিভদ্র মগদের একজন পরিচারিকা ছিলেন, কলকলা পা দেবীকোট (উত্তরবঙ্গ) এ বসবাস করতেন এবং মেখলা পা অগচেনগড়ের ঘরের একজন গৃহীর কন্যা ছিলেন। স্পষ্টতই সিদ্ধাচার্যরা প্রথা এবং সামাজিক বিধিনিষেধের পরোয়া করতেন না এবং এই শিক্ষা দিয়েছিলেন যে সমস্ত শ্রেণীই সমান। নারী -পুরুষ, ব্রাহ্মণ, ডোম, রাজা- দাস এদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। সবহ বা রাহুলভদ্র যিনি জাতিতে ব্রাহ্মণ ছিলেন তিনি সহ তাঁদের কয়েকজন স্বেচ্ছায় অচ্ছুৎ হয়েছিলেন। কথিত আছে সরহ একজন শবনির্মাতার কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন।যিনি নিচ জাতিভক্ত ছিলেন। তাঁর প্রথম দুহাতে তিনি তাঁর পূর্বতন উঁচু জাতিকে আক্রমণ করেছেন। তিনি পাণ্ডিত্য ও ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা কেউ অস্বীকার করেছেন। সংস্কৃতের পরিবর্তে স্থানীয় ভাষা বা অপভ্রংশের ব্যবহারও একই মানসিকতার প্রকাশ।সরহ নালন্দায় হরিভদ্রের অধীনে শিক্ষালাভ করেছেন। হরিভদ্র ছিলেন বিখ্যাত পণ্ডিত ও ধর্মপ্রচারক শান্তরক্ষিতের শিষ্য। হরিভদ্র রাজা ধর্মপাল (৭৭০- ৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) এর সমসাময়িক ছিলেন.।তাই স্বরই ধর্মপালের রাজত্বেই খ্যাতি লাভ করেছিলেন। অধ্যয়ন সমাপ্ত করে তিনি তান্ত্রিকধর্ম অনুশীলন করতে শুরু করেন এবং উচ্চ ও নীচ জাতির বিভেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে নিপীড়িত ও নিম্নবর্ণীয় মানুষের ততটাই পবিত্রতা রয়েছে যতটা রয়েছে সমাজের সুবিধাভোগী ও উঁচু শ্রেণির। তিনি নিম্নবর্ণের মানুষের আধ্যাত্মিক ভাবনা ও অন্যান্য শ্রেণীর মানুষদের সঙ্গে তাদের সমতার কথা ঘোষণা করেন। তিনি লক্ষ্য করেন যে ব্রাহ্মণগণ বৃথাই বেদ পাঠ করে এবং বস্তুর মূল চরিত্র জানেনা। পানাহার সম্বলিত সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞার নিষ্ফলতার কথা ঘোষণা করে সরহে মানুষকে চন্ডালের জন্যে খাদ্য ও পানীয় গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। একইভাবে তিনি সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে নিম্নশ্রেণীর মানুষের শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। শীঘ্রই এই আন্দোলন গতিলাভ করেছিল। অন্যান্য যোগীরাও যাদের মধ্যে সহজ জানি ও নাথ উভয় সম্প্রদায়ের সিদ্ধাচার্যগণ ছিলেন। তাঁরাও জাতিভেদ মানতেন না এবং এটির বিরুদ্ধে আন্দোলনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। মুসলমান আক্রমণের সময়ে এই আন্দোলন পুরোদমে চলছিল এবং মুসলমান বিজয়ের পর এটি সমগ্র দেশকে প্লাবিত করেছিল। এটি জীবন-যাপন ও চিন্তা ভাবনার প্রণালীকে ঝাঁকিয়ে মানুষের মন ও হৃদয়কে প্রকাশ করেছিল। দেশের সমস্ত মানুষ মানসিক ও আধ্যাত্মিক অস্থিরতার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। জনসাধারণের মনস্তত্ত্ব একটি গভীর সংকটের মধ্যে দিয়ে গিয়েছিল এবং মূল্যবোধ ধারণাও জীবনের সম্পর্কে প্রচলিত বিশ্বাসে চিড় ধরেছিল। এইভাবে এটি স্পষ্ট যে সিদ্ধাচার্যরা নিম্নবর্ণ অস্পৃশ্য ও সমাজে অপাঙক্তেয় মানুষদের দিক থেকে সবকিছু চিন্তা করেছিলেন। তাঁদের সমস্ত চিত্রকল্প ও ধারণা নিম্নবর্ণের মানুষকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছিল এবং তাদের উপদেশে তাদের পরিবেশের বা??? শব্দ পাওয়া যায়। লুই রেনোডের মতে, "তান্ত্রিক দর্শন ছিল গূচতত্ত্ব ও গণতন্ত্র অনুসারী কারণ তারা জাতি ও সম্প্রদায়ের বিধি-নিষেধ কে মান্য করেন নি।এটি ছিল এক ধরনের free missionary..
No comments:
Post a Comment