Saturday, December 14, 2024

ভারহুত স্তুপ : একটি পর্যালোচনা

 

সুমনপাল ভিক্ষু


ভারহুত মধ্যভারতের মধ্য প্রদেশে অবস্থিত সাতনা জেলার একটি গ্রাম। এটি বৌদ্ধ স্তুপের নিদর্শনের জন্য বিখ্যাত। যেটি ভারহুত স্তুপকে অনন্য করেছে তা হল প্রতিটি প্যানেল সুস্পষ্টভাবে ব্রাম্মী লিপি দ্বারা চিত্রিত, যার দ্বারা উল্লেখ করা হয়েছে প্যানেলগুলিতে কি বর্ণিত হয়েছে। ভারহুত স্তুপের প্রধান দায়ক ছিলেন রাজা ধনভূতি।

ভারহুতের ভাষ্কর্য ভারতীয় ও বৌদ্ধ শিল্প কলার প্রাচীনতম দৃষ্টান্তের অন্যতম যেটি অশোকের (২৬০ খ্রী. পূর্ব আনুমানিক)  পরবর্তী এবং (আনুমানিক ১১৫  খ্রী. পূর্ব) শুঙ্গ যুগের সাচিঁ স্তুপ নং ২ এর সামান্য পরবর্তী। ঐতিহাসিকগণ অশোকের পরবর্তীকালের উল্লেখ করেছেন তা সর্বৈব সত্য হতে পারে না, কারণ অশোক পরবর্তী শুঙ্গ শাসক বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল না। অশোকের সময়কালে নির্মিত স্তুপ ও ভাস্কর্য গুলো হয়তো কিছুটা সংস্কার করেছিল, তার মানে এই নয়, শুঙ্গ যুগে সেগুলি নির্মিত হয়েছিল। যদিও এটি বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে সাচিঁ, অমরাবতী  এবং অন্যান্য কয়েকটি স্তুপের তুলনায় অধিকতর প্রাদেশিক, প্রচুর পরিমাণে স্থাপত্য সাধারণত ভাল অবস্থায় টিকে গিয়েছে। সাম্প্রতিক পন্ডিতেরা ভারহুতের রেলিংকে ১২৫- ১০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দের এবং সাঁচি স্তুপ নং ২ এর পরবর্তীকালের বলেছেন। এটাও সঠিক তথ্য বলে মেনে নেওয়া যায় না। সাঁচির তুলনায় ভারতহুতের দেবতার মূর্তগুলিতে অনেক বেশি প্রকারভেদ দেখা যায়। তোরণগুলি রেলিং এর সামান্য পরে নির্মিত হয়েছিল এবং এগুলি ১০০-৭৫ খ্রী. পূর্বে নির্মিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। ঐতিহাসিক অজিত কুমার অন্যান্য তারিখযুক্ত শিল্পকর্ম যেমন মথুরা শিল্প বিশেষত শাসক সোদামের নাম খোদাই করা ভাষ্কর্য বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তুলনা করে ভারহুত স্তুপ জন্য একটি পরবর্তীসময়কাল নির্ধারণ করেছেন যেটি হল খ্রীষ্টীয় প্রথম শতক। ভারহুত স্তুপের বহু নির্দশন বর্তমানে কোলকাতার ভারতীয় জাদুঘরে এবং ভারতের অন্যান্য জাদুঘর ও বিদেশে জাদুঘরে রক্ষিত আছে। এই প্রত্নস্থলে সামান্য প্রত্নসামগ্রীই রয়েছে। 

খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতক পর্যন্ত বৌদ্ধধর্ম ভারহুতে টিকে ছিল। ১১০০ খ্রীস্টাব্দ নাগাদ একটি ক্ষুদ্র মন্দিরকে বড় করা হয় এবং একটি নতুন বুদ্ধমূর্তি স্থাপিত হয় এই প্রত্নস্থলটি ঐ যুগের একটি বিশাল সংস্কৃত লিপি পাওয়া গিয়েছিল কিন্তু সেটা হারিয়ে গেছে বলে মনে হয়। এটি কলচুরি রাজাদের উল্লেখকারী ১১৫৮ খ্রীষ্টাব্দের লাল পহাদ লিপির থেকে পৃথক।

 কোন কোন সাম্প্রতিক পুর্ণমূল্যায়নে ভারতহুত স্তুপকে শুঙ্গ যুগ থেকে পৃথক করে স্তুপটিকে খ্রীষ্টীয় ১ম শতকের বলা হয়েছে। এর ভিত্তি হল আরও উৎকৃষ্টভাবে কাল নির্ধারিত হওয়া মথুরা শিল্পের সঙ্গে এর শৈলীগত সাদৃশ্য এবং ঐতিহ্যগত Paleography দ্বারা নির্ধারিত এর প্রাচীনত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন।

ভারহুত স্তুপ মৌয সম্রাট অশোকের দ্বারা খ্রী. পূ: তৃতীয় শতকে প্রথম নির্মিত হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু অনেক শিল্পকর্ম বিশেষত তোরণ ও রেলিং শুঙ্গ যুগে নির্মিত হয়েছিল বলে মনে হয় এবং কিছু শিল্পকর্ম ছিল খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক বা তার পরবর্তী সময়ের। নয়ত ঐ ভাষ্কর্যগুলো যুক্ত হয়েছিল উত্তর ভারতের বেশ একটি বৌদ্ধ সুখনদের রাজত্ব কালে।  

কেন্দ্রীয় স্তুপটি একটি পাথরের প্রাচীর ও চারটি তোরণ ফটক দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল অনেকটি সাঁচির ব্যবস্থাপনার মত। প্রাচীরের একটি বড় অংশকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে কিন্তু চারটি তোরণের মাত্র একটি রয়েছে। 

স্তুপের ফটকের একটি স্তম্ভের উপরের একটি লিপিতে এটির নির্মার্ণ সম্পর্কে বলা হয়েছে সুগদের রাজত্বকালে, বাৎসিপুত্র ধনভূতি দ্বারা। 'সুগনম রাজে' এই শব্দগুচ্ছটি কমাতে পারে ' শুঙ্গদের রাজত্বকালে' কিন্তু তবু এতে বিভ্রান্তি থেকেই যায় কারণ এটি 'সুখনদের রাজত্বকালে'ও বোঝাতে পারে। যেটি উত্তর ভারতের একটি বৌদ্ধ রাজ্য। ভারতবর্ষের শিলালিপিতে 'শুঙ্গ' নামটির দ্বিতীয় কোন উল্লেখ নেই।  লিপিটিতে লেখা রয়েছে। 

ধনভূতি লিপি: 

 

১) সুগানাম রাজে রানো গাগিপুতসা বিসাদেবসা।

২) পৌডতেন, গোতিপুতসা আগারাজুসা পুতেনা।

৩) বচ্চিপুতেনা ধনভূতিনা কারিতম্ তোরণম্ 

৪) শিলাকম্মমতো চা উপামনো।

 

সুগদের রাজত্বকালে ( সুখন বা সুঙ্গ) এই তোরণ নির্মিত হয় এবং পাথরের কাজটি করিয়েছিলেন ধনভূতি, বচ্চির পুত্র, অগারাজুর পুত্র, গোতি ও রাজা বাসুদেবের নাতি, গগির পুত্র।

ধনভূতির তোরণ স্তম্ভলিপি যদি রাজবংশটিকে 'সুঙ্গ' বলে ধরা হয় যেহেতু ধনভূতি একটি বৌদ্ধ সৌধকে প্রচুর পরিমানে উৎসর্গ করেছিলেন, এবং বিপরীত দিকে শুঙ্গরা হিন্দু রাজবংশ বলে পরিচিত, তাই মনে হয় ধনভূতি নিজে শুঙ্গ রাজবংশের সদস্য ছিলেন না। শুঙ্গ রাজাদের নামের তালিকা তাঁর নাম পাওয়া যায় না। 'সুঙ্গদের রাজত্বকালে' এই উল্লেখটি থেকে মনে করা চলে যে তিনি স্বয়ং কোন শুঙ্গ শাসক ছিলেন না, তিনি শুঙ্গদের রাজাদের অধীনস্থ কোন শাসক হয়ে থাকতে পারেন, বা পার্শ্ববর্তী এলাকার কোন শাসক হতে পারেন যেমন কোশল বা পাঞ্চাল।

ভারহুতের নিদর্শনের অনেক স্থানে খরোষ্টি লিপির ব্যবহার দেখা গেছে যার থেকে অনুমান করা যায় নির্মাতাদের অন্তত কয়েকজন উত্তর ভারত বিশেষত গান্ধার থেকে এসেছিল যেখানে খরোষ্ঠী লিপি ব্যবহৃত হত। কানিংহাম ব্যাখ্যা করেছেন খরোষ্ঠী লিপি  পাওয়া গেছে তোরণের স্তম্ভশীর্ষের প্রধান কড়িকাঠে কিন্তু রেলিংগুলিতে কেবলমাত্র ভারতীয় চিহ্ন রয়েছে যার থেকে অনুমান করা যায় যে তোরণগুলি যা শৈল্পিক দৃষ্টিকোণ থেকে বেশি উন্নতমানের তৈরি হয়েছিল উত্তরের শিল্পীদের দ্বারা এবং রেলিংগুলি নির্মিত হয়েছিল স্থানীয় শিল্পীদের দ্বারা।

কোন কোন পণ্ডিতের মতে হেলনীয় ভাস্করদের সঙ্গেও সাঁচি ও ভারহুতের স্তুপের কিছু যোগাযোগ ছিল। কাঠামোটি সব মিলিয়ে এবং এর কিছু কিছু উপাদান থেকে হেলেনীয় ও অন্যান্য বিদেশি প্রভাবের ইঙ্গিত মেলে যেমন বাঁশির ঘন্টা, হেলেনীয় পেলমেট বা হানিসকল মোটিফের প্রভূত ব্যবহার। তবে শিল্পীদের দেশগত পরিচয় ছাড়াও তোরণটি কিন্তু চরিত্রের দিক থেকে দৃঢ়ভাবে ভারতীয়। 

মনে হয় রেলিংগুলি সর্বপ্রথম নির্মিত হয়েছিল খ্রী. পূর্ব ১২৫ থেকে খ্রী. পূর্ব ১০০ র মধ্যে। বিরাট তোরণটি নির্মিত হয়েছিল পরবর্তীকালে ১০০ খ্রী: পূর্ব থেকে ৭৫ খ্রী: পূর্বের মধ্যে। শৈল্পিক দৃষ্টিকোণ থেকে রেলিংগুলির অলঙ্করণকে সাঁচির স্তুপ নং ২ এর থেকে পরবর্তীকালের মনে করা হয়। রেলিং এর অলঙ্করণ খ্রী. পূর্ব ১০০ অব্দ,  তোরণের সম্ভবত ৭৫ খ্রী: পূর্ব।

১৮৭৩ সালে ক্যানিংহাম ভারহুত ভ্রমণে আসেন। পরবর্তী বছর তিনি প্রত্নস্থলটিতে খননকার্য চালান। ক্যানিংকামের সহকারী জোসেফ ডেভিড বেগলার। খননকার্য চালিয়ে যান এবং কাজটিকে অসংখ্য আলোকচিত্রের সাহায্যে নথিভুক্ত করেন। 

খ্রী. পূর্ব ২য় শতকে শুঙ্গ যুগের ভারহুতের একটি স্তম্ভ ভারহুত স্থাপত্য শৈলীর একটি নিদর্শন, যার মধ্যে পারসিক ও গ্রীক শৈলী অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বলে মনে করা হয়, এবং শৈলাটি অনেকটা পাটলিপুত্র শৈলীর মত। 

ভারহুত স্তুপ চত্বরের অন্তর্ভুক্ত হল মধ্যযুগের একটি মন্দির। (ফলক ২), যার মধ্যে রয়েছে বুদ্ধের একটি বিশাল মূর্তি, এবং ভাষ্কর্যের কয়েকটি খন্ডিতাংশ যেখানে বুদ্ধমূর্তির সঙ্গে ব্রহ্ম, ইন্দ্র ইত্যাদির মূর্তি দেখা যাচ্ছে। বেগলার দশম শতকের একটি বৌদ্ধ সংস্কৃত লিপির ও আলোকচিত্র গ্রহর করে ছিলেন যার সম্পর্কে এখনও কিছুই জানা যায় না। 

ধ্বংসপ্রাপ্ত স্তুপটি যেটির প্রধান কাঠামোর ভিতটুকু ছাড়া আর কিছুই নেই এখনও ভারহুতে রয়েছে, তবে তোরণ ও রেলিং খুলে নিয়ে কোলকাতার ভারতীয় জাদুঘরে পুনরায় জোড়া দেওয়া হয়েছে।  এগুলির মধ্যে বুদ্ধের পূর্বজন্মের বা জাতক কাহিনীর অনেকগুলি কাহিনী রয়েছে। এগুলির অনেকগুলি হল বিশাল গোলাকৃতি পদক আকৃতির। এরকম দুটি রয়েছে ওয়াশিংটনের Freer Gallery of Art/ Arthur M Sackler Galleryতে। 

 প্রাথমিক বৌদ্ধ শিল্পকলার মূর্তিহীন পর্যায়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বুদ্ধকে সে সময়ে কেবল ধর্মচক্র, বোধিবৃক্ষ, শূন্য আসন, পদচিহ্ন বা ত্রিরত্ন প্রতীক দ্বারা বোঝানো হত। 

এই শৈলী ভারতীয় শিল্পকলার প্রাচীনতম পর্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করে এবং কেবলমাত্র একটি ইন্দো গ্রীক সেনার মূর্তি ছাড়া সবকটি মূর্তিকে ভারতীয় ধূতি পরিহিত অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। ভারহুতের ভাস্কর্য সাচিঁ স্তুপ নং ২ এর চিত্র ও পূর্ববর্তী অজন্তা গুহাচিত্রের সামান্য পরবর্তী।

ভারহুতের ভাস্কর্যের একটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য হল বর্ণনাত্নক চিত্রের মধ্যে রচনার অন্তর্ভুক্তি যা প্রায়ই কোন সনাক্ত করে। ভারহুতের ভাস্কর্যগুলি প্রাচীন ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধশিল্পকলার ক্রমবিকাশের ইতিহাস নির্ণয়ে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ১৩৬ টি লিপিতে দাতাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলির মধ্যে রয়েছে বিদিশা, পুরিকা ( বিন্ধ্য পার্বত্য অঞ্চলের একটি শহর), পাটলিপুত্র( বিহার), কারহাদ( মহারাষ্ট্র),  ডোজকাটা ( বিদর্ভ, পূর্ব মহারাষ্ট্র),  কোসাম্বি( উত্তর প্রদেশ) ও নাসিক ( মহারাষ্ট্র)  এর মানুষ। ৮২ টি লিপি দ্বারা জাতক, বুদ্ধের জীবন, পূর্বতন মানুষী বুদ্ধের কাহিনী যক্ষ ও যক্ষিণীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। 

ভারতহুতের চারটিত আদি তোরণের মধ্যে কেবল পূর্বদিকেরটিই অস্থিত্ব রয়েছে। এটি নির্মিত হয়েছিল ১০০ খ্রী. পূর্ব থেকে ৭৫ খ্রী. পূর্ব মধ্যে (শৈল্পিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বলা যায় সম্ভবত খ্রী. পূর্ব ৭৫ অব্দে) এবং অতএব এটি রেলিংগুলির পরবর্তীকালের। 

যেহেতু কারিগররা তোরণটির সমগ্র কাঠামো মুড়ে গান্ধারের লিপি খরোষ্ঠীতে রাজমিস্ত্রীর চিহ্ন একে়ঁছিল তাই মনে করা হয় তারা উত্তর পশ্চিম ভারত (সম্ভবত গান্ধার থেকে এসেছিল)। সেই সময়ে গান্ধার ইন্দো গ্রীক রাজ্যের কেন্দ্রে ছিল এবং এই কারিগররা সম্ভববত তোরণটির নির্মাণে ইন্দো গ্রীক কৌশল ও প্রযুক্তি ব্যবহার করেছিল। বিপরীত পক্ষে,  স্থানীয় ব্রাহ্মী লিপি তোরণের উপর পাওয়া যায় নি কেবলমাত্র রেলিং এর উপর পাওয়া গিয়েছে (এরকম ২৭ টি রাজমিস্ত্রীদের চিহ্ন পাওয়া গেছে)।  এর থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় সম্ভবত স্থানীয় কারিগররা রেলিংগুলো নির্মাণ করেছিল। ঐ কাঠামোটি সব মিলিয়ে এবং অন্যান্য অনেক উপাদানের দিক থেকে হেলেনীয় ও অন্যান্য বিদেশি প্রভাবের ইঙ্গিত দেয়। তবে দানকারীদের উৎপত্তি ছাড়াও তোরণটিতে শক্তিশালী ভারতীয় বৈশিষ্ট্য রয়ে গিয়েছে। 

Archive  গুলিতে প্রাণীদের চিত্র রয়েছে।  যারা বুদ্ধের প্রতি তাদের ভক্তি প্রকাশ করেছে। (যার প্রতীক হল মধ্যস্থলে শূন্য সিংহাসন)।  উপরের architrave (কেবলসম্মুখেরটি)। এ দুটি সিংহ, একটি গ্রিফিন ( বামদিক) এবং একটি মানুষের মাথা সহ সিংহ ( স্ফিংস)  নীচের architrave টিতে দেখা যাচ্ছে প্রতীকী বুদ্ধের চারপাশে চারটি হাতী এবং দুটি মনুষ্য ভক্ত। Architrave গুলির মধ্যে রয়েছে  lealustrate  স্তম্ভ  যেগুলির কয়েকটি ভারতীয় মূর্তি দ্বারা অলঙ্কৃত। এই স্তম্ভগুলির ভিত্তিতে পাঁচটি খরোষ্ঠী রাজমিস্ত্রীর চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে (সর্বগ্র তোরণে সর্বমোট আটটির মধ্যে)।

উপরের এবং মাঝের archivales গুলির মধ্যে একই ধরনের lealustrate স্তম্ভ ছিল কিন্তু সেটি হারিয়ে গেছে। শৈল্পিক বিশ্লেষণের উপর নির্ভর করে রেলিংগুলির নির্মাণের সময়কাল নিরূপণ করা হয়েছে ১২৫- ১০০ খ্রী. পূর্ব: খুব সম্ভবত ১০০ খ্রী. পূর্ব। নকশাগুলি অত্যন্ত উন্নতমানের এবং সাঁচি স্তুপ নং ২ এর পরিবর্তীকালীন। 

রাজমিস্ত্রীদের সমস্থ চিহ্ন ব্রাহ্মী লিপিতে এগুলির সংখ্যা ২৮। এর থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে কারিগররা রেলিং নির্মাণ করেছিল তারা স্থানীয় ছিল। রেলিংগুলি প্রায় সবটাইে চিত্রে পূর্ণ, এতে বিভিন্ন বুদ্ধের পূর্ববর্তী জন্ম,  ঐতিহাসিক বুদ্ধের জীবনের বিভিন্ন ঘটানা, এবং ভক্তি মূলক দৃশ্য। এছাড়াও অনেকগুলি পদক রয়েছে যেগুলি ভক্তদের বা দায়কদের প্রতিনিধিত্ব করে বলে মনে করা হয়।

বোধিবৃক্ষের চারপাশের হীরক সিংহাসন এবং মহাবোধি মন্দির। হীরক সিংহাসনের সঙ্গে সম্পর্কিত খোদিত ভারহুত লিপি অনুসারে অশোকের মূল মহাবোধি মন্দির ছিল স্তম্ভের দ্বারা সমর্থিত একটি উন্মুক্ত চত্বর। মাঝখানে দেখা যাচ্ছে একটি হীরক সিংহাসন বা বজ্রাসন, যেটি সামনে চারটি pilaslir  দ্বার অলঙ্কৃত।  ঐ সিংহাসনটি পিছনে বোধিবৃক্ষের গুঁড়ি দেখা যাচ্ছে। যটি ঐ ইমারতের অনেক উপরে পৌঁচচ্ছে এবং বৃক্ষটির প্রতিটি পাশে ত্রিরত্ন ও ধর্মচিত্রের যৌথ প্রতীক রয়েছে যেটি একটি ছোট স্তম্ভের উপর দন্ডায়মান। বজ্রাসন কক্ষের প্রতিটি দিকে একই শৈলীর একটি পাতায় কক্ষ রয়েছে।  সিংহাসনটির উপরটি ফুল, দ্বারা অলঙ্কৃত কিন্তু সেখানে কোন বুদ্ধমূর্তি নেই। 

চিত্রটিতে নিম্নলিখিত লিপিটি খোদিত আছে। ভগবতো শাক্যমুনি বোধি দেবতা শাক্যমুনির বোধি বৃক্ষ। এবং এর দ্বারা ঐ চিত্রটির অর্থ নিশ্চিত হয়।

তিকুতিকো চাকামো: ঐ চিত্রের উপরে লিপিতে ' তিকুতিকো চাকামো উল্লেখ করা হয়েছে ( বা ধর্মের ত্রিমুখী চক্র)। এই দৃশ্যে সাতটি হাতী। একটি বিরাট তিন মাথাযুক্ত সাপ ( নাগ) এবং দুটি সিংহ দেখা যাচ্ছে। চিত্রটি থেকে তাদের এই বিশেষ ধর্মচক্র সম্পর্কে ভক্তি প্রকাশিত হচ্ছে। 

মায়ার স্বপ্ন: মায়ার স্বপ্নের এই খোদাই করা চিত্র সেই কাহিনী বলছে যেখানে বুদ্ধের মা এই স্বপ্ন দেখেছিলেন যে একটি শ্বেত হস্তী, তাঁর শরীরে প্রবেশ করছে। এটি হল বুদ্ধের গর্ভধারণের মুহূর্ত। নিদ্রিতা রাণীকে তিনজন পারিচারিকা ঘিরে রয়েছে তাদের মধ্যে একজন একটি চুড়ি পরে রয়েছে। বিছানার শিয়রের কাছে একটি জলপাত্র রাখা হয়েছে।  সেটির পায়েরকাছে একটি ধূপদানি। মায়ার কুমারী হিসেবে গর্ভধারণের কাহিনী বহু শতাব্দী ধরে প্রচলিত রয়েছে এবং এটি গান্ধারের গ্রীক - বৌদ্ধ শিল্পরীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। কারণ Archelaus of carrhae (২৭৮খ্রী.) এবং Saint Jerome ( ৩৪০ খ্রী.) উভয়ই বুদ্ধকে নাম ধরে উল্লেখ করেছিন এবং মায়ের কুমারী অবস্থায় তাঁর গর্ভধারনের বিষয়টিকে বর্ণনা করেছেন। এই সম্ভবনার কথা বলা হয়েছে যে বুদ্ধের জন্ম সংক্রান্ত কিংবদন্তি খ্রীষ্ট ধর্মকে প্রভাবিত করেছে।

প্যানেলের নীচের অংশে ত্রয়স্ত্রিংশ স্বর্গে বহু দেবদেবী রয়েছে সেখানে ইন্দ্র প্রধান; তিনি বোধিসত্ত্বের কেশ দ্বারা পূজা করছেন এবং তা নিয়ে আনন্দ প্রকাশ করছেন। বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রের কাহিনি অনুসারে সন্ন্যাস গ্রহণের পূর্বে বুদ্ধ রাজপুত্রের বেশ ত্যাগ করে এবং তলোয়ার দিয়ে তাঁর দীর্ঘ কেশ কেটে ফেলে তাঁর পাগড়ি ও কেশ হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে এগুলো ত্রয়স্ত্রিংশে স্বর্গে দেবতাদের কাছে পৌঁছে যায় এবং তাঁরা এগুলির পূজা করেন।

সঙ্কিস্সতে বুদ্ধের ত্রয়স্ত্রিংশ স্বর্গ থেকে অবরতণ: বুদ্ধ ত্রয়স্ত্রিংশ স্বর্গ থেকে নেমে আসেন সেখানে তাঁর মা মায়া পুর্নজন্ম লাভ করেছিলেন এবং যেখানে তিনি তাঁর মাকে সদ্ধর্ম শিক্ষাদান করার জন্য আরোহণ করেছিলেন।  মনে করা হয় এই অলৌকিক ঘটনাটি ঘটেছিল সঙ্কিস্যতে সেই চিত্রটির মধ্যে রয়েছে সেই অলৌকিক মই যার মাধ্যমে বুদ্ধ ত্রয়স্ত্রিংশ স্বর্গ থেকে অবরতণ করেছিলেন এবং তাঁর সঙ্গী ছিলেন ব্রহ্মা ও ইন্দ্র। মইয়ের পাদদেশে রয়েছে গাছ ও সিংহাসন,  যেগুলি বুদ্ধের উপস্থিতির প্রতীক, বুদ্ধের চর্তুদিকে ভক্তদের ভীড় যা এই ইঙ্গিত দেয় যে বুদ্ধ পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন।

জেতবন বিহার- নিম্নের লিপিটি যেটি ভাস্কর্যটির ঠিক নিচে স্থাপিত হয়েছে বিহার এবং সেটির নির্মাতা অনাথপিণ্ডিকের নাম প্রকাশ করে (অনাথপিণ্ডিকের বহু সোনার মোহর দিয়ে জেতবনের ক্রেতা হয়ে সেটিকে উপহার দিচ্ছেন।

অনাথপিণ্ডিক নামে একজন গৃহী ১৮ কোটি স্বর্ণমুদ্রা জেত উদ্যান ক্রয় করে বিহার নির্মাণ শুরু করেন। এর মাঝে তিনি বুদ্ধের চন্দ্রাতপ নির্মাণ করেন। অনাথপিণ্ডিক জেতবনে অনেকগুলি বিহার নির্মাণ করেন যতদিন না গৌতম বুদ্ধ রাজগৃহ থেকে শ্রাবস্তীতে আসেন সেখানেই শ্রেষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। বুদ্ধ অনেক ভিক্ষুকে সঙ্গে নিয়ে জেতবন বিহারে প্রবেশ করেন। তখন তাঁকে প্রশ্ন করেন "প্রভু, এই বিহারে ব্যাপারে আমি যেমন করে অগ্রসর হতে পারি?" যেহেতু আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন গৃহস্থ এই বিহারটিকে আপনি বৌদ্ধ সংঘকে দান করুন।  তখন অনাথপিণ্ডিক উত্তর দিলেন, এই বিহারটিকে আমি বৌদ্ধ সংঘকে দান করলাম যার প্রধান হলেন বুদ্ধ।

 

অনাথপিণ্ডিক দ্বারা বিহারটির স্থাপনের বণর্না দিতে গিয়ে ভাস্কররা বিহারের দৃশ্য অঙ্কন করেছে। সামনে রয়েছে গরুর গাড়ি, যার বলদগুলি বাধাঁ নয় এবং শৃঙ্কলটি উপরের দিকে হেলান যার থেকে বোঝা যাচ্ছে শৃঙ্কলটি বদ্ধ নয়। এটি দেখান হচ্ছে যে গাড়িটিকে খালি করা হয়েছে। সামনে রয়েছে দুজন মানুষ যারা দুজনেই তাদের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ও তর্জনীর মধ্যে একটি ছোট বস্তু রেখে দিয়েছে। এই দুজন মানুষের একজন অনাথপিণ্ডিক স্বয়ং এবং আরেকজন তাঁর কোষাধ্যক্ষ।  তাঁরা দু'জন গাড়িতে করে আনা মোহর গুনছেন। তাদের উপরে দুটি মূর্তি উপবিষ্ট যারা মোহরগুলি দিয়ে বাগানের উপরিতল ঢেকে দিচ্ছে যেগুলিকে দেখান হচ্ছে বর্গাকার টুকরো হিসেবে যেগুলি পরষ্পরকে ধরে রয়েছে ঐ ক্রয়ের মূল্য হিসেবে। বাঁ দিকে রয়েছে আরো ছয়টি মূর্তি সম্ভবত জেত রাজকুমার ও তাঁর বন্ধুদের। চিত্রটির মাঝখানে রয়েছেন অনাথপিণ্ডিক স্বয়ং, তিনি একটি পাত্র দুহাতে যেটি অনেকটা চায়ের কেটলির মত। তাঁর উদ্দেশ্য হল বুদ্ধের হাতের উপরে জল ঢালা তাঁর উপহার সম্পূর্ণ হবার শপথ হিসেব। 

 

অনাথপিণ্ডিক যিনি তাঁর উদারতার জন্য এবং মহৎ চরিত্রের জন্য পরিচিত ছিলেন মৃত্যর পর তুষিত স্বর্গে প্রবেশ করে বোধিসত্ত্ব হয়েছিলেন। 

মহাকপি জাতক: এই জাতক কাহিনীতে এক বানর রাজ রূপে জন্মগ্রহণ করা রূপে পূর্বজন্মে একটি সেতুর জন্য তাঁর নিজের দেহ উৎসর্গ করেন যাতে অন্যান্য বানররা পালিয়ে যেতে পারে যখন একজন মানবরাজ তাদেঁর আক্রমণ করেছিল। নদীটির একটি ক্ষুদ্র অংশ যার উপর দিয়ে বানররা পালাচ্ছিল মৎস্য নকশার দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে। (মহাকপি জাতক, ভারহুত আনুমানিক ১০০ খ্রী. পূর্ব: ভারতীয় জাদুঘর ফলদাতা)। মহাকপি জাতকের চিত্র সাঁচিতে ও দৃশ্যমান।

নিগ্রোধমৃগ জাতক: নিগ্রোধ মৃগ জাতক ( বট বৃক্ষ কাহিনী)।  এই কাহিনীতে বলা হয়েছে যেমন করে বোধিসত্ত্ব একটি সোনালী গর্ভবতী হরিণকে বলির মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। পদকটিতে তিনটি দৃশ্য রয়েছে (১) চারটি হরিণ পালিয়ে যাচ্ছে এবং একটি দূরে বাম দিকে তাকিয়ে রয়েছে এবং একদম ডানদিকে তীর হাতে একটি মানুষ দ্বিতীয় দৃশ্যটির প্রতিনিধিত্ব করছে। এটি হল একটি গর্ভবতী হরিণকে হত্যা করা হচ্ছে কিন্তু বট মৃগটি তাকে চলে যেতে বলেছে এবং তার স্থান গ্রহণ করেছে। রাধুঁনী/ কসাই এটি দেখছে এবং তারপর রাজার কাছে গিয়ে বলছে। যিনি তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে আসছেন (৩) তৃতীয় দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে সেই হরিণটি মাঝখানে বসে রাজাকে ধর্মোপদেশ দিচ্ছে এবং রাজা হাত জোড় করে পদ্দা সহকারে শুনছেন। এই দৃশ্যের বার্তা হল আমাদের উচিত ভাল মানুষের সঙ্গে মেশা)। 

কুরুঙ্গ মৃগ জাতক: এই কাহিনীটি হল তিজন বন্ধু সম্পর্কে যারা একটি জঙ্গলে বাস করত এরা হল একটি হরিণ, একটি কাঠঠোকক ও একটি কচ্ছপ। একদিন হরিণটির একজন শিকারীর ফাঁদে পড়ল, এবং কচ্ছপটি দড়িওটি দাঁত দিয়ে কাটতে চেষ্টা করল হরিণিটিকে মুক্ত করার জন্য,  এবং কাঠঠোকরা অমঙ্গলজনক শব্দ করছিল যাতে শিকারী তার কুটিরে আবদ্ধ থাকে। হরিণটি পালিয়ে গেল কিন্তু কচ্ছপটি তার প্রচেষ্টায় ক্লান্ত হয়ে ব্যাধের হাতে ধরা পড়ল। তখন হরিণটি ব্যাধটিকে তাকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে অনুসরণ করতে প্রলুদ্ধ করল যাতে কচ্ছপটি পালাতে পারে। হরিণটি হল বোধিসত্ত্ব। অর্থাৎ পূর্ববর্তী জীবনের বুদ্ধ, কাঠঠোকরাটি ছিল বুদ্ধের শিষ্য সারিপুত্ত, এবং বু্দ্ধের শিষ্য মোগ্গল্লান ছিলেন পূর্ব জন্মের কচ্ছপ,  বুদ্ধের চিরাচরিত শত্রু দেবদত্ত ছিল সেই শিকারী। কাহিনীটির উদ্দেশ্য হল পূর্ব জন্মেও বুদ্ধ ও তাঁর শিষ্যদের বন্ধুত্ব ও সহোযোগিতা ও দেবদত্তের শয়তানি দেখান,।

 মুগ পকায় জাতক/ মুগ পক্ষ জাতক/ তেমিয় জাতক: এটি হল মূক রাজকুমারের কাহিনি,  বারাণসীর রাজার স্ত্রী চম্পাদেবীর কোন পুত্র ছিল না। দেবরাজ শঙ্ক তাকেঁ সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি বোধিসত্ত্ব (বুদ্ধকে ত্রয়স্ত্রিংশ স্বর্গ থেকে অবতরণ করে তাঁর গর্ভে প্রবেশ করতে রাজী করালেন যাতে তিনি একটি পুত্রের জন্ম দিতে পারেন। এই জন্য বুদ্ধ রাণীর গর্ভে প্রবেশ প্রবেশ করলেন,  এবং যখন তাঁর জন্ম হল তখন তাঁকে তেমিয় নামে ডাকা হত। 

তখন তেমিয় বুঝতে পারলেন তাঁর বাবা হলেন একজন রাজা; কিন্তু নিজে একটি পূর্ব জন্মে বারাণসীর রাজা হয়ে যার শেষ হয়েছিল ২০০০০বছর নরকবাসের মাধ্যমে তিনি আর সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হতে চাইলেন না। তাই উত্তরাধিকার সূত্রে রাজা হওয়া এড়িয়ে যাওয়ার জন্য তিনি বোবা ও নিষ্ক্রিয় সেজে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। অপদার্থ হওয়ায় তাঁর বাবা তাঁকে হত্যা করার ব্যবস্থা করলেন এবং অপরাধটি করার জন্য সারথী সুনন্দকে দায়িত্ব দিলেন। যখন সুনন্দ তাঁকে পুঁতে দেবার জন্য মাটি খুঁড়ছিল তখন তিনি সুনন্দ তাঁর কৌশলের কথা বললেুএবং মুগ্ধ হয়ে সুনন্দ সন্ন্যাসী হয়ে তেমিয়কে অনুসরণ করতে চাইলেন।

তারপর তেমিয় রাজা ও রাণীকে উপদেশ দিলেন। তাঁরাও এই উপদেশ শুনে মুগ্ধ হলেনএবং সন্ন্যাস গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। শীঘ্রই রাজ্যের সমস্ত নাগরিক এবং দুটি প্রতিবেশী রাজ্যের সমস্ত নাগরিক তেমিয়র শিষ্যত্ব গ্রহণ করল। 

ঐ চিত্রে দেখা যাচ্ছে শিষ্য তেমিয় রাজার কোলে (উপরের বাম দিকে)। তারপর তেমিয়কে চিতাখানায় সারথি সুনন্দর পিছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে যে চিতা খুঁড়ছে ( নীচে ডানদিকে), তারপর সন্ন্যাসী তেমিয় মানুষকে উপদেশ দিচ্ছেন ( উপরে ডান দিকে)। 

ভারহুত যবন: স্পষ্টতই গ্রীক (ইন্দো গ্রীক) বা সে সময়ে মধ্য ভারতের মানুষের কাছে যবন নামে পরিচিত ছিল। এখানে একজন গ্রীক সৈন্যকে দ্বারপাল হিসেবে দেখা যাচ্ছে এর প্রমাণ হল তার কেশবিন্যাস, (ছোট কোকড়ান চুল, গ্রীক রাজকীয় মাথার ব্যান্ড) পোশাক ও জুতো। তার ডান হাতে সে একটি আর্ভুর লতা ধরে আছে যেটি তার দেশের প্রতীক। তার তলোয়ারের খাপে বৌদ্ধদের প্রতীক নন্দীপাট অঙ্কিত রয়েছে। 

চিত্রের উপর একটি লিপি রয়েছে সেটিকে ৫৫ লিপি রূপে শ্রেণীবিভক্ত করা হয়েছে। ব্রাহ্মী লিপিতে বাম থেকে ডানদিকে লেখা হয়েছে। গৃহী ভ্রাতা মহিলার স্তম্ভ উপহার- বুদ্ধের মা মায়া যিনি মায়াদেবী নামেও পরিচিত ছিলেন শাক্যদের রাণী এবং গৌতম বুদ্ধের জন্মদাত্রী মা ছিলেন যাঁর শিক্ষার উপর ভিত্তি করে বৌদ্ধধর্ম তৈরী হয়েছিল। তিনি ছিলেন শাক্যরাজা শুদ্ধোদনের স্ত্রী, তিনি ছিলেন বুদ্ধের দীক্ষিত প্রথম ভিক্ষুণী মহাপ্রজাপতি গৌতমীর ভগিনী।  আবার একই সঙ্গে তিনি ছিলেন বৌদ্ধধর্মের একজন গুরুত্বপূর্ণ দেবী। তিনি হলেন প্রাচুর্য ও সৌভাগ্যের দেবী, এবং প্রাচীনতম অস্থিত্বশীল স্তুপ ও গুহায় তাঁর চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। 

সাধারণ মূর্তিতত্ত্বে তাঁকে মহামায়া বা মহাদেবী বলা হয়েছে, তিনি পদ্মের উপর দণ্ডায়মান অবস্থায় রয়েছে। তাঁর পাশে দুটি হাতী জল ছেটাচ্ছে। লক্ষী ইতিপূর্বেই অর্থাৎ খ্রী. পূর্ব ১৮০ অব্দে ইন্দো গ্রীক মুদ্রায় আবির্ভূত হয়েছেন ( পদ্মফুল হাতে ধরা একজন নর্তকীরূপে) এবং পরবর্তীকালে ১ম শতকে ইন্দো স্কাইথিয় মুদ্রায় তাঁকে দেখা যাচ্ছে। 

এছাড়া একটি সংস্কৃত লিপি ছাড়া একাদশ দ্বাদশ শতকের একটি বৌদ্ধ ভাস্কর্যও পাওয়া গিয়েছে। এর থেকে প্রমাণিত হয় যে বৌদ্ধধর্ম খ্রীষ্টীয় একাদশ দ্বাদশ শতক পর্যন্ত এই অঞ্চলে টিকে গিয়েছিল যদিও এর মধ্যবর্তী সময়কার কোন কিছুই পাওয়া যায় নি। 

প্রাচীন স্তুপের জাঁকজমকপূর্ণ প্রস্তর রেলিং ছাড়াও একটি মধ্যযুগীয় বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। এই ধ্বংসবশেষে রয়েছে একটি বিশাল মূর্তি, যেটি ১০০০ খ্রী. খুব বেশী পূর্বে নয়। এমন হওয়া সম্ভব মনে হয় যে বৌদ্ধধর্মের অনুশীলন প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে নির্বিঘ্নে করা সম্ভব হয়েছিল সর্বত্র মুসলমানদের আবির্ভাব বৌদ্ধধর্মকে অন্তিম আঘাত দিয়েছিল। তাদের ধর্মান্ধতা ও অসহিষ্ণুতা বৌদ্ধধর্মের সেই সামান্য চিহ্নটুকুকেও ধ্বংস করেছিল যা ব্রাহ্মণদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। 

আলোকজাণ্ডার কানিংহাম,  ভারহুত স্তুপ যদিও সবচেয়ে পরিচিত নিদর্শনগুলি খ্রী. পূর্ব বা খ্রীষ্টীয় প্রথম শতকের,  সাঁচির মতই ভারহুত স্তুপও এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে বৌদ্ধ সংঘের কেন্দ্ররূপে ব্যবহৃত হয়ে চলেছিল। কিন্তু ভারহুতের সৌধগুলি শেষ পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যায় এবং অধিকাংশ নিদর্শনই স্থানীয় গ্রামবাসীরা গৃহ নির্মাণের সামগ্রী রূপে ব্যবহার করেছিল।

সাঁচি ভারহুতের নিকটবর্তী এলাকায় অনেকগুলি অপ্রধান স্তুপ ও বৌদ্ধ মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছিল যেগুলি নির্মাণকাল ছিল দ্বাদশ শতক পর্যন্ত। এর থেকে প্রমাণিত হয় বৌদ্ধধর্ম এই এলাকায় বহুল প্রচলিত ছিল এবং কেবল সাঁচি ও ভারহুতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এগুলি খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতক পর্যন্ত টিকেছিল সাঁচি মন্দির চত্বরের মত যদিও খ্রীষ্টীয় নবম দশম শতক থেকেই সেগুলির পতন হতে শুরু হয়েছিল।

বাঁশিপুর গ্রাম দামহ

মাদিঘাট রেওয়া জেলা 

বুদ্ধদন্ড সিংগ্রৌলি

বিলহারি কাটনি 

কুঁয়ারপুর, সাগর জেলা / বংশ দমহ জেলা 

দামহ জাদুঘর বুদ্ধ

দেউড় কোঠার রেওয়া দেবগড়, ললিতপুর

খামুরাহো,জাদুঘর

মাহোবা,  একাদশ - দ্বাদশ শতক ভাস্কর্য 


মধ্যপ্রদেশের ভারহুত স্তুপ থেকে পূর্বে তোরণ ও বেদিকার পুনর্ণনির্মাণ, আনুমানিক খ্রী. পূর্ব: ১২৫ অব্দ খ্রী. পূর্ব: ৭৩ অব্দ) শুঙ্গ রাজত্বকাল বেলেপাথর - ( ভারতীয় জাদুঘর,  কোলকাতা, ফোটো বিশ্বরূপ গাঙ্গুলি

অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে কাটা বেলেপাথর একদা মধ্যপ্রদেশের সাতনার ভারহুতের স্তুপকে পরিবেষ্টন করেছিল। এই অগভীর চিত্রগুলি তৈরি হয়েছিল কাহিনীমূলক বৌদ্ধ শিল্পকলার প্রাচীন দৃষ্টান্ত হিসেবে। এগুলি চিত্রের মাধ্যমে বুদ্ধের শিক্ষা, জাতক কাহিনী থেকে দৃশ্যাবলী এবং ঐতিহাসিক বুদ্ধের জীবন থেকে দৃশ্যাবলীর অনেকগুলিই সরাসরি বুদ্ধের শিক্ষা খ্রীষ্টীয় প্রথম শতকের বৌদ্ধ শিল্পের উল্লেখ করে তাঁকে কখনই রক্ত মাংসের চেহারায় চিত্রগুলিতে আনা হয়নি কিন্তু পরিবর্তে পরিবেশিত হয়েছেন প্রতীকী চিত্রদ্বারা ঢ়েমন চাকা, সিংহাসন,  এবং পদচিহ্ন যেগুলি বুদ্ধপদ নামে পরিচিত।

যদিও স্তুপটি এখন আর দাঁড়িয়ে নেই, রেলিং এর এবং তোরণের অংশবিশেষ সহ এটির ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার হয়েছিল। পণ্ডিতগণ বিশ্বাস করেন যদিও ভারহুত স্তুপ খ্রী. পূর্ব ২৫০ অব্দে অশোকের রাজত্বকালে নির্মিত হয়েছিল, এক শতক পর শুঙ্গ যুগে এটির বিস্তার ঘটে এবং স্তুপের চারটি প্রবেশপথে বেদিকা ও তোরণ নির্মিত হয়।

বেদিকা: ভারহুত বেদিকার উচ্চতা ও মিটার ও পরিধি ২০ মিটার। স্তম্ভসহ এটির গঠনের সর্বত্র চিত্র খোদিত হয়েছে পদক একটি স্তম্ভকে আরেকটি স্তম্ভের সঙ্গে যুক্ত করেছে, এবং প্যানেল যেটি বেদিকার দৈর্ঘ্য বরাবর গিয়েছে সেটি উপরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। বেদিকার ও বাইরের ও ভিতরের উপরিতলে যে চিত্রগুলো রয়েছে সেগুলির মধ্যে রয়েছে জাতক কাহিনির চিত্র থেকে বিভিন্ন মূর্তির চিত্র যেমন যক্ষ ও যক্ষী, বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীর চিত্র যেমন হাতি, পদ্ম ও বানর। 

বেদিকার প্রতিটি স্তম্ভে রয়েছে মনুষ্যমূর্তি ও পশুদের  চিত্রসহ বিভিন্ন খোদাই কার্য,  একটি জনপ্রিয় প্রতীক হল পদ্ম যেটি কোন কোন স্থানে একটি ফুল হিসেবে বর্ণিত হয়েছে এবং কোন কোন স্থানে এটির কেন্দ্র থেকে মনুষ্যমূর্তি বের হয়ে আসছে।

স্তম্ভগুলি বৌদ্ধ শিল্পকলায় বিভিন্ন বিষয় দেখাচ্ছে যেমন জাতক কাহিনি যেখানে বুদ্ধের পূর্বে জীবনের কাহিনী ও তাঁর বিভিন্ন গুণাবলী লিপিবদ্ধ হয়েছে।  প্রতিটি পদকে বিভিন্ন ঘটনা পরিবেশিত হয়েছে। অন্যান্য বিখ্যাত চিত্র হল মহাকপি জাতক। কল্পতরুর নিরবিচ্ছিন্ন চিত্র দেখা যায় বেদিকা, যেখানে রয়েছে রত্ন,  ফুল এবং ফলের চিত্র। যা বিভিন্ন কাহিনীকে যুক্ত করছে। বেশিকার উপর চিত্রের বিভন্নতা সত্বেও অধিকাংশ খোদাই কার্য করা হয়েছে ব্রাহ্মী লিপিতে যার ফলে বিষয়বস্তু সনাক্তকরণ সহজ হয়েছে।

তোরণ: তোরণটি প্রস্তর নির্মিত এবং বাইরে ও ভিতরে খোদাইকৃত। অনুমান করা করা হয় যে ভারহুত স্তুপে চারটি তোরণ ছিল যদিও কেবল পূর্বতোরণের ধ্বংসাবশেষই পাওয়া গিয়েছে। তোরণগুলি ছিল মোটামুটি ৬ থেকে ৭ মি উঁচু,  এখানে দুটি স্তম্ভ ছিল যা তিনটি বাকানো archivate এর ভার বহন করছিল। archivate শেষে মকরের চেহারা ছিল যেটি বাইরের দিকে সামান্য বাঁকানো ছিল। তোরণের উপরের চিত্রগুলি ছিল পশু, উদ্ভিদ বিমূর্ত ও স্থাপত্য উপাদান যা গ্রীক প্রভাব নির্দেশ করে।  এছাড়া খরোষ্ঠী লিপি থেকে বোঝায় যায় তোরণটি শুঙ্গ রাজবংশের সময় নির্মিত হয়েছিল।  তবে এই চিত্রগুলি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, তোরণটির উপর একটি পদ্ম চাকতি রয়েছে তার উপরে রয়েছে তিনদিকে ত্রিরত্ন যুক্ত ধর্মচক্র যেটি বৌদ্ধ শিক্ষা ও মৌর্য শিল্পকলার কথা স্মরণ করায়। 

স্থান, কাল ও মাত্রার দিক থেকে ভারতহুতের ভাস্কর্য  যুক্তির পরিবর্তে কাহিনীর উপর গুরুত্বদানের জন্য পরিচিত। বণর্নার বাস্তবতার উপর গুরুত্ব না দিয়ে কাহিনীর কিছু কিছু অংশকে বিস্তৃত করা হয়েছে। কাহিনীর ক্রম দেখানোর জন্য ভাস্কর্যরা সমস্ত পর্ব জুড়ে প্রায়ই একই রূপের পুনরাবৃত্তি করেছেন। এই পদ্ধতি জাতকগুলিতে ও অনুসৃত হয়েছে। মনুষ্য মূর্তিগুলিতে স্বাতন্ত্র্যের অভাব শুঙ্গ যুগের ভাস্কর্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

রেলিং ও ফটকের বাইরেরও ভিতরের উপরিতলে খোদিত বুদ্ধের জীবন ও শিক্ষার বর্ণনাকারী চিত্রগুলি সেই ভক্তদের দর্শনের জন্য অঙ্কিত হয়েছিল যারা স্তুপটিকে প্রদক্ষিণ করবেন। এগুলির সঙ্গের লিপিগুলির কারণে ভাস্কর্যগুলি ভারতবর্ষে প্রাচীন বৌদ্ধধর্মের ক্রমবিকাশ এবং বৌদ্ধ মূর্তিতত্ব অনুধাবনের ক্ষেত্রে অপরিহার্য। 

ভারহুত স্তুপের চিত্র ভাস্কর্যগুলিকে প্রায়ই সাঁচি স্তুপ ২ এর স্তম্ভের সঙ্গে তুলনা করা হয় যটিও শুঙ্গ রাজবংশের যুগে নির্মিত হয়েছিল। তবে ভারহুতের ভাস্কর্যগুলিকে সাধারণত সূক্ষ্মতর বলে মনে করা হয়। এগুলির অধিকাংশ নিদর্শনকেই কোলকাতায় স্থানান্তরিত করা হয়েছে কয়েকটি রক্ষিত আছে এলাহাবাদ জাদুঘরে।


আকর গ্রন্থসূচী:


১। বড়ুয়া, বেণীমাধব, ভারহুত, প্রথম প্রকাশ,  ১৯৩৪, দ্বিতীয় প্রকাশ রিপ্রিন্ট এণ্ড কমবাইন্ড এডিশন, ২০১৯, টুওয়ার্ডস্ ফ্রিডম, কোলকাতা।

২। কুমার, অজিত (২০১৪)। "ভারহুত ভাস্কর্য এণ্ড দেয়ার আনটেইনেব্যাল শুঙ্গ এশোসিয়শন"। হেরিটেজ: জার্নাল অফ মাল্টিডিসিপ্লিনারি স্টাডিজ ইন আর্কিওলজি।

৩। বৌদ্ধ সংস্কৃত শিলালিপি খ্রিস্টীয় ১০ম শতাব্দীর স্ল্যাব, (?)ভারহুত, ব্রিটিশ লাইব্রেরি, ২৬ মার্চ ২০০৯।

৪। কানিংহাম, স্যার আলেকজান্ডার (১৮৭৯)। ভারহুতের স্তূপ: খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে বৌদ্ধ কিংবদন্তি এবং ইতিহাসের চিত্রিত অসংখ্য ভাস্কর্য দিয়ে অলঙ্কৃত একটি বৌদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ । লন্ডন: ডাব্লুএইচ অ্যালেন ।

৫। আলেকজান্ডার কানিংহাম, গ্রেট ব্রিটেন ইন্ডিয়া অফিস (১৮৭৯)। ভারহুতের স্তূপ: বহুগুণে অলঙ্কৃত একটি বৌদ্ধ সৌধ... ডব্লিউএইচ অ্যালেন অ্যান্ড কোং পি.।

৬। ইন্ডিয়া আর্কিওলজিক্যাল রিপোর্ট, কানিংহাম, পৃ. ১৮৫-১৯৬।

 

শব্দ মিছিলের ইশতেহার


সুমনপাল ভিক্ষু

 

“...সাহিত্যকে যেতে হবে শ্রমিকের বস্তিতে, তাদের ক্লেদাক্ত জীবনের ছবি হুবহু তুলে ধরতে নয়, আধুনিক সমাজের বাহক শ্রমিক শ্রেণীর যন্ত্রণাকে কে তুলে আনাই আধুনিক সাহিত্যের কাজ - পূর্বের মতো রাজা-রাজড়া, জমিদারের দুঃখদৈন্য দ্বন্ধহীন জীবনেতিহাস নিয়ে আধুনিক সাহিত্যসেবীর মন আর ভরে না! বরঞ্চ এই অভিশপ্ত, অশেষ দুঃখের দেশে, নিজের অভিমান বিসর্জন দিয়ে রুশ সাহিত্যের মতো যেদিন সে আরও সমাজের নিচের স্তরে নেমে গিয়ে তাদের সুখ, দুঃখ, বেদনার মাঝখানে দাঁড়াতে পারবে, সেদিন এই সাহিত্য-সাধনা কেবল স্বদেশে নয়, বিশ্ব সাহিত্যেও আপনার স্থান করে নিতে পারবে।

 শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; সাহিত্যে আর্ট দুর্নীতি।

শুধু কি তাই? ঋত্বিক ঘটক দেখিয়েছেন কীআবে আধা সামন্ততান্ত্র্রিক এবং আধা-ঔপনিবেশীক ভারতবর্ষের সাম্রাজ্যবাদী শোষন বিস্তৃত হয়েছে সুদূর গ্রামাঞ্চলে। আর গ্রামীণ অর্থনীতির বাঁধ ভেঙ্গে ঘর থেকে উৎখাত হওয়া মানুষগুলোকে কুলি-মজুরে পরিণত করেছে সাম্রাজ্যবাদের তল্পি বাহকেরা। সেই কুলি-মজুরদের মর্মান্তিক জীবন কী অসাধারণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ঋত্বিক তাঁর সিনেমায়। নিষ্পেষিত, বঞ্চিত মানব জীবনের অপমৃত্যুর বেদনাময় ছবি জনগনকে নাড়িয়ে দেয়। সমাজের এই অব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাদের এতনাকে জাগ্রত করে তোলে। তাহলে এখন একটা প্রশ্ন হল সমাজকে অবজ্ঞা বা অবহেলা করে কি সিনেমা-শিল্প হয়? সাহিত্য হয়? না, হয় না। কোনও ভাবেই তা সম্ভব নয়। সুতরাং এই অর্থে বলতে হয় শিল্পের জন্য শিল্প না কি মানুষের জন্য? উত্তর একটাই যে মানব সমাজ ব্যতীত কোন শিল্পই সম্ভব নয়। কারণ আমাদের মস্তিস্ক এই সমাজের মধ্যেই অবস্থান করে। তাহলে আমরা কি প্রত্যক্ষ করি? প্রত্যক্ষ করি এই সমাজ, সভ্যতা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি সব কিছুই। সুতরাং এই অর্থে সমাজের দ্বন্ধ-দ্বিধা, ধূঊআন-পতন, ভলো-মন্দ আমাদের মধ্যেও নিহিত হয়। আমাদের এতনার স্তরে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তাহলে সমাজকে ব্রাতজন কে কী করে চলবে জীবন বৃত্তান্ত। কারণ আমাদের মস্তিস্ক কাজ করছে বিজ্ঞানের নিয়ম মেনে, আমরা যখন দেখছি এই বস্তুজগত নিয়ম পরিবর্তনশীল, তার সঙ্গে আমাদের নিবিড় যোগসূত্র আছে, তখন নিরপেক্ষতা মানা যায় নাকি? আমরা কি কোন ভিনগ্রহের প্রানী! অথচ তথাকথিত বুদ্ধিজীবির একটা অংশ এমনটাই মনে করেন। মনে করেন তাদের শিল্প-সত্ত্বা দেশ-কাল-সমাজ নিরপেক্ষ। যেন তাদের এই উদ্ভট নিরপেক্ষতা শিল্প সত্ত্বার গতিপ্রকৃতিকে কোনও এক অদ্ভূত সুখানুভূতি প্রদান করবে। অথচ এই ব্যাধির একটু গভীরে প্রবেশ করলেই বোঝা যায় যে তাদের এই অলীক চিন্তা-আবনা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিলাস ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে এক্ষেত্রেঋত্ত্বিক ঘটকএর ভাবনাতে আমরা সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি পাই। ১৯৫৪ সালে তিনিপলিটিক্যাল থিসিস লিখলেন, “গতচার বছর আমরা কোনও উঁচুদরের শিল্পকর্ম রচনা করতে পারিনি। আমরা আমাদের কিছু পুরোনো কাজকে টেনে বার করেছি, ঝাড়পোঁছ করেছি, এবং তার একটা নতুন নাম দিয়েছি। অথবা অপেশাদারী, শৌখিন তৃতীয় শ্রেণীর কাজ করেছি। আর সর্বক্ষণ বক্তা প্রধান হয়ে থেকেছি। নিশ্চিতই এক ভয়ঙ্কর ঘটনা।তিনি আরও বলেছেন, “...সত্যিকারের সৃজনশীল শিল্পী যাঁরা, আমাদের মধ্যে যাঁদের হাতে গোনা যায়, তারা ধীরে ধীরে ...বৃত্তের বাইরে চলে যাচ্ছেন।কতটা হতাশ হলে ঋত্ত্বিকের মতো উঁচুদরের শিলঈ এমন কথা বলতে পারেন! গননাট্য সংঘ হতে যোগসূত্র বিচ্ছিন্ন করার পর ঋত্বিক সরষ্ট সিনেমাগুলি বিশেষ করে ১৯৪৭-এর দেশাগের ব্যাথা যন্ত্রণাকে উপজীব্য করে তাঁরট্রিলজি’- ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’, সুবর্ণরেখা’, তাদের কি বাণিজ্যিক তকমা প্রদান করা যায় জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা কি তাঁর অটুট থাকেনি?

হায় বিধি বড়ই দারুণ...

ক্ষুধার আগুন জ্বলে আহার মেলেনা।

-সলিল চৌধুরী।

শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নটি মানিক মুখোপাধ্যায় অত্যন্ত সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, “শিল্পী সমাজ পরিবেশ থেকেই তাঁর শিল্পের রসদ সংগ্রহ করেন। এমন কী যে রূপাশ্রয়ে তাঁর শিল্প সৃষ্টি, সেটিও সমাজ জমিন থেকে আহরিত। জগৎ-সংসারের সব কিছুর মতো শিল্পীর চেতনা, বোধ, মনন সব কিছুই নিয়ম শাসিত।এক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন উথ্থাপিত হয় যে সব কিছুই যদি নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকে এবং কোনরূপ স্বাধীনতা না থাকে তাহলে শিল্পী নতুন কিছু সৃষ্টি করবেন কি ভাবে? এক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত সাবলীল ভাবে বলেছেন, “শিল্পীর চিন্তা একটা আপেক্ষিক স্বাধীনতা আছে, কিন্তু বস্তুজগতের স্থানকালের সীমার মধ্যেই সেই স্বাধীনতা, তার বাইরে নয়।

অনেক শ্রমিক আছে এইখানে।

আরো ঢের লোক আছে, সঠিক শ্রমিক নয় তারা।

স্বাভাবিক মধ্যশ্রেণী নিম্নশ্রেণী মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিধি থেকে ঝরে

এরা তবু মৃত নয়; অন্তবিহীন কাল মৃতবৎ ঘোরে।

-জীবনানন্দ দাশ

ছন্নছাড়ার প্যারাডাইস এবং ঋত্বিক কুমার ঘটক

উত্তাল ৪০এর অসমাপ্ত বিল্পব পূর্ব ইউরোপ জুড়ে সন্ত্রাসিবাদের উথ্থান এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকা আকাশে মুক্তি সূর্যের ম্যানিফেষ্টো শ্রমিক কৃষক ঐক্য জোট সমগ্র পৃথিবীর পটভূমি জুড়ে বিপ্লবের আহ্বান-

 

আমি বিদ্রোহী...

বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন

আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল

আমি সেই দিন হব শান্ত

যবে উৎপীড়িতের এশনে রোল

আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না।

অত্যাচারীর খড়গ কৃপা

ভীম রণভূমে রণিবে না,

বিদ্রোহী রণক্লান্ত,

আমি সেই দিন হব শান্ত

-নজরুল ইসলাম

 

সেই বিপ্লবাত্মক স্পিরিট। সমস্ত প্রকার শোষন অত্যাচারের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম। কিন্তু যথার্থই তা উচ্ছৃঙ্খল নয়। বিদ্রোহী শান্ত হবে অত্যাচার অনাচার বন্ধ হলে। এখানেই নিয়ম ভাঙার মধ্যে নৈতিকতার সুর মূল্যবোধের মহানতা। সুতরাং এই অর্থে সামাজিক উপপাদ্যের বিষয়টি বুঝিয়ে দেয় অন্যস্বর। ঋত্বিক ঘটকের কথায় এই অন্যস্বর ম্যনিফেষ্টো হয়ে উঠেছে। তাঁর বয়ানে বিষয়টি এরকম : “বাঙালী ছেলেদের বাঁধা এবং ফরাসিদের যা হয় শুনেছি যে ভেতরে একটা ক্রিয়েটিভ আর্জি দেখা দিলে প্রথমে কবিতা বেরোবে। তা দুচারটে হতভাগা লেখা দিয়ে আমার শিল্পচর্চা শুরু হলো। তারপর আমি দেখলাম ওটা আমার হবে না, কাব্যির এক লক্ষ মাইলের মধ্যে আমি কোনদিন যেতে পারবো না। ...তারপর হলো কী, রাজনীতিতে ঢুকে পড়লাম।

৪০এর দশকের এই পর্বটা ছিল দ্রুত পট পরিবর্তনের প্রক্ষেপট। বঙ্গ দেশের গ্রাম বাংলার যে জীবন ছিল শান্ত নিস্তরঙ্গ, তা এক লহমায় উথাল-পাতাল হয়ে গেল। কৃত্তিম খাদ্য সংকট আহ্বান করল এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ।

তিনজন হাইড্রান্ট থেকে জল নিয়ে মগে ঢেলে চা বানাচ্ছে, আরমাথা নেড়ে দুঃখ করে নিজেদের মধ্যেই রাজা উজির মারছে।ওদের বক্তব্যের সার কথা হলো : “আমাদের সোনা নেই রূপো নেই তবু আমরা কে কার ক্রীতদাস?” ...এর পেরই চারজনে মিলেগননা করে গেল পৃথিবীর ন্যায় অন্যায়।” – জীবনানন্দ দাশ

অপর অর্থে ঋত্বিক ঘটক বলেছেন, “মানুষকে আমি ভালোবাসি পাগলের মতো। মানুষের জন্যেই সবকিছু। মানুষই শেষ কথা। সব শিল্পেরই শেষ পর্যায়ে মানুষে পৌঁছতে হয়। যাঁরা তা করেন না, তাঁরা শিল্পী বলে আমার কাছে কোন আদর পাবেন না। ঈশ্বরে আমি আদৌ বিশ্বাস করি না। শুধু তাই নয়, নামটাকেই আমি ঘৃণা করি। এই সব গল্প দিয়ে আর কতদিন সমাজ সংসার চালাতে হবে, সেটা আমাকে বুঝতে হবে। এসব বানানো গল্প সম্পূর্ণ জোচ্চুরি। আর, বেবাক জোচ্চুরু দিয়ে খুব বেশীদিন ঠকানো বা ঠেকিয়ে রাখা যায় না, এটাও ভাববার সময় এসেছে।

গোপাল অতি সুবোধ বালক... তবে এক্ষেত্রে ঋত্বিক ঘটক ( নভেম্বর ১৯২৫ ফেব্রুয়ারী ১৯৭৬) এর মধ্যে সুবোধ বালক হয়ে ওঠার অভিপ্রায় সেই অর্থে গড়ে ওঠেনি। তিনি পৃথিবীর পাঠশালার সন্ধানে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় ইতি টেনে বেশ কয়েকবার বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছেন। ছেলের এইরূপ ভাবগতিক প্রত্যক্ষ করে তাঁর বাবা তাঁকে বলেছিলেন, ম্যাট্রিক পরীক্ষাটা দিলে ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যায়, নইলে মিস্তিরি হয়ে থাকতে হবে। অবশেষে তিনি বুঝেছিলেনগল্প যথেষ্ট নয়, মানুষের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া চাই। কারণ গল্প নাড়া দেয় অনেক গভীরে গিয়ে, অনেক সময় লাগে।

আসলে সে নিজেই সে নিজের ধিক্কার।

তাই তার ঘৃণা

প্রায় বিশ্বমানবকে, তাই তার রাগ

অসহায় অপরাগ অশক্ত শিশুর ভিড়ে খোঁজে

প্রতিহিংসার শিকার।

দুর্বুদ্ধি কাদায় ভারি গাদাকবুকের ফাঁকা তাগ-

সে করে চলেছে নিত্য কোনো টোটা বিনা,

নিজেই সন্ত্রাসে চোখ বোজে

দুই হাত সক্ষী তোদরে, পৌরুষের মরিয়া বিকার।

মানুষ যখন হয় মনুষ্যহীনতার উন্মাদ ধিক্কার

-বিষ্ঞু দে।

ফরাসী ঔপন্যাসিক দার্শনিক অ্যালবেয়ার কামু লিখেছিলেন, “একটি জল্লাদ শিকারদের বিশ্বে, চিন্তাশীল মানুষদের দ্বায়িত্ব হলো, জল্লাদদের পক্ষে না থাকা।জাতীয় আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রক্ষেপটকে পরিলক্ষিত করে ঋত্বিক ঘটক ৪০এর দশকে বামপন্থী মতাদর্শের প্রতি অনুরক্ত হয়ে ওঠেন। এক্ষেত্রে তাঁর অবস্থান ছিল সোজাসাপটা। এই সময় অগ্রণী, গল্প ভারতী, দেশ, শনিবারের চিঠি সহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রায় গোটা পঞ্চাশেক গল্প প্রকাশিত হয়।

“...প্রযোজনাগুলো অবশ্যই যেন সরল প্রত্যক্ষ হয় যা জনসাধারণ বুঝতে পারে এবং সেগুলির সৃষ্টিতে অংশ গ্রহণ করতে পারে (গণনাট্য সংঘের প্রথম ঘোষনা পত্র, ১৯৪৩ খ্রীঃ) প্রসঙ্গত মনে রাখা প্রয়োজন ঋত্বিক ঘটককে সাহিত্যের জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছিলেন কল্লোল যুগের বিশিষ্ট কবি মনীশ ঘটক, অর্থাৎ তাঁর বড়দা। পরবর্তী সময়ে ঋত্বিক ঘটক গননাট্য সংঘে যুক্ত হন। মূলত অভিনয়ের প্রতি তাঁর আকর্ষণ প্রবল ছিল। সাম্যবাদের অধ্যয়ণ সহ গননাট্যে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তাঁর বৈপ্লবিক সত্ত্বার রসায়ন এক সময় পরিপক্কতা লাভ করে এবং তিনি ১৯৪৮ ক্রীঃ গননাট্য সংঘের সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫২ খ্রীঃ পর্যন্ত তিনি সম্পাদক ছিলেন। এই সময় তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি ছিল দলিল, জ্বালা, অফিসার, ভাঙা বনরে, সাঁকো ইত্যাদি।

মানুষের উৎসব কবে? মানুষ যেদিন আপনার মনুষ্যত্বের শক্তি বিশেষ ভাবে স্মরণ করে, বিশেষ ভাবে উপলব্দি করে, সেই দিন। যে দিন আমরা আপনাদিগকে প্রাত্যহিক প্রয়োজনের দ্বারা চালিত করি, সেদিন নাযেদিন আমরা আপনাদিগকে সাংসারিক সুখদুঃখের দ্বারা ক্ষুদ্ধ করি, সেদিন না...” – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

সুতরাং এই অর্থে ঋত্বিক ঘটক ছিলেন ছিন্নমূল মানুষের আর্তনাদ।

ছিন্নমূল ঋত্বিক এবং তারপর

 

একা একা শহরের পথ থেকে পথে

অনেক হেঁটেছি আমি; অনেক দেখেছি আমি

ট্রাম বাস সব ঠিক চলে

তখন অনেক রাত - তখন অনেক তারা

মনুমেন্ট মিনারের মাথা নির্জনে ঘিরেছে

এসে

বেবিলনে একা একা এমনই হেঁটেছি আমি

রাতের ভিতর

হাজার হাজার ব্যস্ত বছরের পর।

-জীবনানন্দ দাশ

দেশ বিভাগ এবং সাম্প্রদায়িক সংঘাত ঋত্বিক ঘটকের মনে এক বিয়োগাতঙ্ক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। এই ক্ষতের জ্বালা থেকে উদ্ভূত হয়েছিলদলিলনাটক। এক সময় এই নাটকটি গণনাট্য সংঘের সর্বভারতীয় সম্মলনে মঞ্চস্থ হয়। সিনেমাকে ঘিরে তাঁর যে প্যাশন ছিল তার অন্যতম কারণ, তিনি যা করতে চাইছিলেন সেই বক্তব্য সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছানো। সিনেমার ভাষা মাধ্যম সম্পর্কে তাঁর যা দখল সেটা গণ-সংস্কৃতির ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ করার লক্ষ্যে; এবং তিনি স্থির নিশ্চিত ছিলেন যে, সিনেমার চেয়ে অন্যতর কোনো মাধ্যমের খোঁজ মেলে তা একই দক্ষতায় একই উদ্দেশ্য ব্যবহার করতে পারবেন। এই অর্থে সিনেমা সম্পর্কে ঋত্বিক বলেছেন, “…সিনেমা করবো বলে আসিনি। কাল যদি সিনেমার চেয়ে বেটার মিডিয়া বেরয় তাহলে সিনেমা কে লাথি মেরে আমি চলে যাব। আই ডোন্ট লাভ ফিল্ম।

আবার তোরা মানুষ হ। মানুষ হৃত্বিক ঘটক বলতেন- “আমি প্রতি মুহূর্তে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে বোঝাবো যে, ইট ইজ নট্এন্ড ইমাজিনারি স্টোরি বা আমি আপনাকে সস্তা আনন্দ দিতে আসেনি। প্রতি মুহূর্তে আপনাকে হাতুড়ি মেরে বোঝাবো যে যা দেখছেন তা একটা কল্পিত ঘটনা, কিন্তু এর মধ্যে যেটা বোঝায় বোঝাতে চাইছি আমার সেই ফিলিংসটা বুঝুন, সেটা সম্পূর্ণ সত্যি, সেটার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই আমি আপনাকে অ্যালার্ট করবো প্রতি মুহূর্তে। যদি আপনি সচতেন হয়ে ওঠেন, ছবি দেশে বাইরের এই সামাজিক বাধা দুর্নীতি বদলের কাজে লিপ্ত হয়ে ওঠেন, আমার প্রোচেস্টটাকে যদি আপনার মধ্যে চাপিয়ে দিতে পারি তবেই শিল্পী হিসেবে আমার সার্থকতা।

প্রযোজক প্রমোদ লাহিড়ীঅযান্ত্রিকসিনেমার জন্য ঋত্বিককে টাকা দিয়েছিলেন। সুবোধ ঘোষএর বিখ্যাত গল্পঅযান্ত্রিক জ্ঞানেশ মুখার্জী, কালী ব্যানার্জি, কাজল গুপ্ত এঁরা এই সিনেমার অভিনয় করেছিলেন। তাপস সেন লিখেছেন- “’অযান্ত্রিকদেখে তো আমরা মুগ্ধ। কিন্তু সিনেমা হলে লোক হয়না। রোজই আমি আর ঋত্বিক হাজরার মোড়ে এসে দাঁড়াতাম। আর ঋত্বিক বলতোআজ লোক হয়নি কিন্তু কাল হবে, ছবিতে লোক হবে না।রোজ দাঁড়িয়ে থাকতাম সেই আশায়

নাগরিকসিনেমা অনেক বাধা-বিপত্তির মধ্যে সম্পন্ন হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে, ‘নাগরিকসঠিক সময় মুক্তি পেলে হয়তো ভারতীয় সিনেমার ইতিহাস অন্য ভাবে রচিত হতো! ঋত্বিক ঘটকের ছবি প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায় অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন, “…ঋত্বিক ছবিতে কিছু কিছু সোভিয়েত ছবির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু যে প্রভাবটা সেখানে অনুকরণ নয়, কারণ ঋত্বিকের প্রধান  বৈশিষ্ট্য তার মৌলিকতা এবং সেটা সে শেষ পর্যন্ত বজায় রেখেছিল

তাহলে সিনেমা কি সংস্কৃতির বাইরে? - কে বলবে!

ঋত্বিক ঘটকের মতো বড় মাপের শিল্পী তখন গণনাট্য আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল। যুগের আকর্ষণ তাকে এপথে টেনে এনেছিল। তাহলে বলতে হয় সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটা তখন কেমন ছিল?

সেই সময়ের দেশ জুড়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের জোয়ার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সুভাষচন্দ্র বোসের আজাদ হিন্দ বাহিনী, ভারতছাড়ো আন্দোলন এবং তার কয়েক বছর পর নৌ বিদ্রোহ। এই সন্ধিক্ষণে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বহু প্রগতিশীল মানুষ, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক বামপন্থী মতাদর্শের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল। এক্ষেত্রে ঋত্বিক ঘটক তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। মৃণাল সেনের কথায় “…আমরা অন্তসারশূন্য দেশজ সিনেমাকে তীব্রভাবে ঘৃণা করতে শিখেছিলাম, নতুন একটা ফ্রন্ট গড়ে তোলার জন্য মুখিয়ে উঠেছিলাম। প্যারভাইস কক্ষে ভাঙ্গার চেয়ার টেবিল বাসা ছোট ঘরে, যে ফ্রন্টে বিপ্লব তার সিনেমা হাত ধরাধরি করে চলবে

ঋত্বিক ঘটক সিনেমা জগতে প্রবেশ করেন নিমাই ঘোষেরছিন্নমূল’ (১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ) সিনেমার মধ্য দিয়ে। এই সিনেমায় তিনি একই সঙ্গে অভিনয় এবং সহকারী পরিচালক রূপেও কাজ করেছিলেন। এর দুবছর পরে তাঁর একক পরিচালনায় মুক্তি পায়নাগরিক এই দুই সিনেমা ভারতীয় সিনেমার গতানুগতিক ধারাকে প্রবল ভাবে নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছিল। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখ্যনীয় সিনেমা অর্থাৎ চলচ্চিত্র গুলির মধ্যে অন্যতম ছিলমেঘে ঢাকা তারা’ (১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ), ‘কোমল গান্ধার’ (১৯৬১ খ্রিস্টাব্দ) এবংসুবর্ণরেখা’ (১৯৬২ খ্রিস্টাব্দ) অন্যতম; এই তিনটি চলচ্চিত্রকেত্রয়ীরূপে চিহ্নিত করা হয় যার মাধ্যমে কলকাতার সমকালীন পরিস্থিতি এবং ছিন্নমূল জীবনের রুঢ় বাস্তবতা চিত্রিত হয়েছে।

কোমল গান্ধারএবংসুবর্ণরেখাএত এগিয়ে থাকা চলচ্চিত্র ছিল যে সেই সময়কালে তা অত্যধিক সমালোচনার মুখে পড়েছিল, ফলে ব্যবসায়িক ব্যর্থতার কারণে এই দশকে তাঁর পক্ষে আর কোন চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সম্ভবপর হয়নি।

ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র জগতে পুনরাবির্ভাব ঘটে ৭০এর দশকে। অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচিত একটি বিখ্যাত উপন্যাসতিতাস একটি নদীর নামঋত্বিকএর অসামান্য পরিচালনায় চলচ্চিত্রে (১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে) রূপদান সম্পন্ন হয়। এই সময় অনিয়মিত জীবন যাপনের ফলে তার শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত ভেঙ্গে পড়ে এবং নিয়মিতভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়া তাঁর পক্ষে আর সম্ভবপর হয়নি। তাঁর শেষ কাজযুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ (১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ)

তিতাস একটি নদীর নামনামক উপন্যাসটিকে চলচ্চিত্রে রূপদানের আগ্রহের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন,- “তিতাস পূর্ব বাংলার একটি খন্ড জীবন, এটি একটি সৎ লেখা। ইদানিং সচরাচর  বাংলাদেশে (দুই বাংলাতেই) এরকম লেখা দেখা পাওয়া যায় না। এর মধ্যে আছে প্রচুর নাটকীয় উপদান, আছে দর্শনধারী রচনাবলী আছে, সত্যব্য বহু প্রাচীন সঙ্গীতের টুকরো- সব- মিশিয়ে একটি অনাবিল আনন্দ অভিজ্ঞতার সৃষ্টি করা যায়। ব্যাপারটা ছবিতে ধরা পড়ার জন্য জন্ম থেকেই কাঁদছিল।অদ্বৈত বাবু যে সময়ে তিতাস নদী দেখেছেন, তখন তিতাস তার তীরবর্তী গ্রামীণ সভ্যতা মরতে বসেছে। বইয়ে বইয়ে তিতাস একটি নদীর নাম। তিনি এর পরের পূনর্জীবনটা দেখতে পাননি। আমি দেখাতে চাই যে মৃত্যুর পরেও এই পুনর্জীবন হচ্ছে। তিতাস এখন আবার যৌবনবতী। আমার ছবিতে গ্রাম নায়ক, তিতাস নায়িকা।

ঋত্বিক নাটক নির্মিত চলচ্চিত্র সমূহ

নাগরিক (১৯৫২, মুক্তি ১৯৭৭), অযান্ত্রিক (১৯৫৮), বাড়ি থেকে পালিয়ে (১৯৫৮), মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০,) কোমল গান্ধার (১৯৬১), সুবর্ণরেখা (১৯৬২, মুক্তি ১৯৬৫), তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩), ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ (১৯৭৪)

কাহিনী এবং চিত্রনাট্য

মুসাফির (১৯৫৭), মধুমতি (১৯৫৮), স্বরলিপি (১৯৬০), কুমারী মন (১৯৬২), দ্বীপের নাম টিয়ারং (১৯৬৩), রাজকন্যা (১৯৬৫), হীরের প্রজাপতি (১৯৬৮)

অভিনয়

তথাপি (১৯৫০), ছিন্নমূল (১৯৫১) কুমারী মন (১৯৫২), সুবর্ণরেখা, তিতাস একটি নদীর নাম এবংযুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ (১৯৭৪)

শর্ট ফিল্প এবং তথ্যচিত্র

দ্য লাইফ অফ দ্য আদিবাসিজ (১৯৫৫), প্লেসেস অফ হিষ্টোরিক ইন্টারেষ্ট ইন বিহার (১৯৫৫), সিজার্স (১৯৬২), ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান (১৯৬৩)

ফিয়ার (১৯৬৫), রঁদেভূ (১৯৬৫), সিভিল ডিফেন্স (১৯৯৫), সায়েন্টিস্টস অফ টুমরো (১৯৬৭), ইয়ে কত্তন (হোয়াই/দ্য কোয়েশ্চন ১৯৭০), আমার লেনিন (১৯৭০), পুরুলিয়ার ছৌ (দ্য ছৌ ড্যান্স আর্ পুরুলিয়া) (১৯৭০), দুর্বার গতি পদ্মা (দ্য টার্বুলেন্ট পদ্মা (১৯৭১)

অসমাপ্ত ছবি এবং তথ্যচিত্র

বেদেনি (১৯৫১), কত অজানা রে (১৯৫৯),বগলার বঙ্গদর্শন (১৯৬৪-১৯৬৫), রঙের গোলাপ (১৯৬৮), রামকিঙ্কর (১৯৭৫) আদিবাসীদের জীবন স্রোত (হিন্দি) (১৯৫৫)

উল্লেখ্যনীয় পুরস্কার সম্মাননা।।

১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ, ভারত সরকার কর্তৃক শিল্পকলায় পদ্মশ্রী পুরস্কার

১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দযুক্তি তক্কো আর গপ্পোচলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার বিভাগে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ।

 

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী:-

) …এবং ঋত্বিক; শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়; দেশ হিতৈশী; ১৪৩১, ২০২৪।

) পথিকৃৎ; শারদ সংখ্যা; অক্টোবর ২০২৪।

) অন দ্য কালচারাল ফ্রন্ট; ঋত্বিক ঘটক; . রথীন্দ্র চক্রবর্তী; অনূদিত; নাট্যচিন্তা ফাউন্ডেশন; ২০০৩।

) গ্রুপ থিয়েটার গণনাট্য সংঘ সর্বহারা নাট্য আন্দোলন; মানিক মুখোপাধ্যায়; পথিকৃৎ বিশেষ সংখ্যা; অক্টোবর ১৯৮৩।

) সেই ঋত্বিকসুব্রত রুদ্র (সম্পা), প্রতিভাস সংস্করণ, কোলকাতা, ২০২০।