Sunday, June 2, 2024

ধম্মাশোকানুস্মৃতি (মহামতি অশোকের প্রতিফলিত স্মরণ)

 সুমনপাল ভিক্ষু


আজ্ঞাপ্য ব্যবধূতভিম্বভমরাম্‌ একাতপত্রাং মহীং
উৎপাটচ প্রতিগর্বিতামরিগনান্‌ আশ্বাস্য দীনাতুরান।
ভ্রষ্টাহস্থাহসতনো ন ভাতি কৃপনঃ সংপ্রত্যশোকো নৃপশ্
ছিন্নম্লানবিশীর্ণপত্রকুসুমঃ শুষ্যত্যশোকো যথা।।
পুণঃ একচ্ছত্রসমুচ্ছয়াং বসুমতীমাজ্ঞাথয়ত যঃ পুরা
         লোকং তাথয়তি স্ম মধ্যদিবস প্রাপ্তো দিবা ভাস্কর।
         ‘ভাগ্যচ্ছিদ্রমবেক্ষ্য সোহদ্য নৃপতিঃ স্বৈঃ কর্মভির্বঞ্চিতঃ
         সংপ্রাপ্তে দিবসফয়ে রবিরিব ভ্রষ্টপ্রভাবঃ স্থিতঃ।।
                           -অশোকাবদানং, পৃঃ ১৩০।
“আমি প্রকাশ্যে একজন বৌদ্ধ”।
সুমি পাকাসা (সা) কে (ই)।
“আমি প্রকাশ্যে শাক্য”।
রূপনাথ মাইনর রক্, এভিক্ট-ভ’এ অশোক।
মহামতি অশোকের বুদ্ধধম্মোর উপস্থাপনাঃ
অশোকের মাইনর রক্ এভিক্ট এবং অশোক প্রস্তাবিত প্রামাণিক গ্রন্থসূচী রাজস্থানে পাওয়া গেছে। অশোকের ধম্মলিপি’তে ৭টি গ্রন্থের উল্লেখ রয়েছে। সর্বোপরি তাঁর ধম্মলিপি’তে ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের প্রতি সম্বোধন করা হয়েছে।
ধম্মলিপির’র আদেশটি নিম্নরূপ:
আদেশের শুরু :
মগদের রাজা প্রিয়দর্শী সংঘকে অভিবাদন জ্ঞাপন পূর্বক তাদের সুস্বাস্থ্য এবং সুখী জীবনযাপনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
এটা আপনি অবগত আছেন, হে শ্রদ্ধেয় মহাশয়, বুদ্ধ, ধম্ম এবং সংঘের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস কতটা মহান। যাই হোক না কেন, শ্রদ্ধেয় মহাশয়, আশীবার্দ পুষ্ট বুদ্ধের দ্বারা বলা ভাল। তবুও হে শ্রদ্ধেয় মহাশয়, আমি ভাবতে পারি যে এইভাবে ধম্ম চিরকাল স্থায়ী হবে এবং আমি তা করার অধিকারী। এগুলি হল, হে শ্রদ্ধেয় মহাশয়, ধম্মের গ্রন্থ (ধম্মাথালিয়া)।
১. বিনয়সমুকস্ (বিনয় সমর শ্রেষ্ঠত্ব)
২. অলিয়বসানি (আরিয়াভাসা : নোবেল লিভিং)
৩. অনাগতভয় (ভবিষৎ’এ ভয়)
৪. মুনিগাথা (মুনির গাথা/বুদ্ধের দেশনা)
৫. অর্থসূত্তা (মুনির উপর সুত্ত)
৬. উপতিস্‌পসিন (সারিপুত্তের প্রশ্ন)
৭. লাঘুলোবাদ (রাহুলকে নির্দেশাবলী)
ধম্মের এই গ্রন্থসমূহ আমি কামনা করি।
কেন?
কারণ অসংখ্য মানুষ, যাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভিক্ষু। সেইসাথে ভিক্ষুগণ প্রায়শই তাদের কথা শ্রবণ এবং উপলব্দি করতে পারেন। এই কারণে হে শ্রদ্ধেয় মহাশয়, আমি এটি খোদাই করে দিয়েছি, যাতে তাঁরা আমার উদ্দেশ্য অবগত করতে পারি।
আদেশের সমাপ্তি।
মহামতি অসোকের বুদ্ধ এবং তাঁর ধম্মের পাঠ:
অশোকের উল্লেখিত ৭ টি গ্রন্থ এবং ভিক্ষুগণকে সম্বোধনের বিষয়টি তাঁর মনের নীল নকশা প্রদান করবে। পন্ডিতগণ ত্রিপিটকে তাঁর শ্রাস্ত্রীয় উপস্থিতির সন্ধান পেয়েছেন।
৭’ টি গ্রন্থের তালিকা :
১. বিনয়সমুকস্ (বিনয়অমর শ্রেষ্ঠতা)।।
১.১ মধ্যপন্থা অনুশীলন
১.২ চারি আর্যসত্য উপলব্দি
২. অলিয়বসানি (আরিয়াভাসা : নোবেল লিভিং)।।
২.১ পঞ্চপ্রতিবন্ধকতা হতে মুক্তি লাভ (পঞ্চ নিবারণ)
২.২ ৬ ইন্দ্রিয় বস্তুতে লিপ্ত হওয়া হ’তে বিরত থাকা
২.৩ মননশীলতার সঙ্গে মনকে রক্ষা করা
২.৪ ৪টি পরিশ্রম
২.৫ মতবাদ প্রত্যাখ্যান
২.৬ তনহা পরিত্যাগ (তৃষ্ঞা)
২.৭ বিশুদ্ধ মনের কর্ষন
২.৮ সমম ও বিদর্শন কর্ষন করা
২.৯ রাগ, দোষ ও মোহ বর্জন
২.১০ মনের মুক্তি
পঞ্চ বিষাদ পরিতাজ্য করা উচিত :
৩.১ ভিক্ষুগণ তাদের দেহ, শীল, মন এবং প্রজ্ঞার কর্ষন না করে উচ্চতর আদেশ প্রদান করবেন না।
৩.২ ভিক্ষুগণ তাদের দেহ, শীল, মন এবং প্রজ্ঞার কর্ষণ না ক’রে অন্যদের সমর্থন করবেন না।
৩.৩ ভিক্ষুগণ তাদের দেহ, শীল, মন এবং প্রজ্ঞার কর্ষণ না ক’রে অন্যান্য বিষয়ের আলোচনায় প্রবেশ করবেন না।
৩.৪ ভিক্ষুগণ তাদের দেহ, শীল, মন এবং প্রজ্ঞার কর্ষণ না ক’রে গভীর ধম্ম অধ্যয়ন করবেন না এবং তা উপযোগী মনে করবেন না।
৩.৫ ভিক্ষুগণ সুন্দর স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্নসহ কথা বলে আনন্দিত হবেন।
৪. মুনিগাথা (বুদ্ধ দেশনা)।।
এটি মিনিগাথায় পালিত, মুনির আদর্শ যা মিনির গুণাবলী এবং একজন মুনির জীবনযাপনের সঙ্গে গৃহস্থ জীবন যাপনের তুলনা করে।
৫. মুনিসুত্ত (অর্থসুত্তা)।।
যা দুঃখ-কষ্টের দিকে টেনে নিয়ে যায়, তা থেকে কীভাবে দুরত্ব বজায় রাখা যায়, একথায় কায়, বাক্‌ এবং চিত্ত (মন) কে সংযত করা।
৫.১ শরীরের নিস্তব্দতা :
জীবন নেওয়া (হত্যা ইত্যাদি) থেকে বিরত থাকুন।
অদত্ত বস্তু গ্রহণ অর্থাৎ যা প্রদান যোগ্য নয় তা গ্রহণ হতে বিরত থাকুন। যৌন অসদাচরণ হতে বিরত থাকুন।
৫.২ বক্তব্যের নীরবতা :
মিথ্যা বাক্য হতে বিরত থাকুন।
অপবাদ হতে বিরত থাকুন।
কটু (কু-বাক্য) এবং কর্কশ বাক্য হতে বিরত থাকুন।
অলসতা’ হতে বিরত থাকুন।
৫.৩ মনের নীরবতা :
আবেগের বিলোপ সাধন।
আবেগ মু্ক্ত অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করা।
৬. উপতিসপসিন (বারিপুত্তের প্রশ্ন) ।।
৬.১ নির্ভীকতার কর্ষণ করা।
৬.২ সকলের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা পোষন করা।
৬.৩ তৃপ্তি এবং সংযম চাষ করা।
৬.৪ মননশীলতা চাষ করা।
৬.৫ ধৈর্য্য চাষ করা।
৬.৬ বিশুদ্ধতা চাষ করা।
৬.৭ মনের স্বাধীনতা চাষ করা।
৭. লাঘুলোবাদ (রাহুলকে নির্দেশাবলী) ।।
৭.১ ইচ্ছাকৃত মিথ্যাবাক্য ব্যক্ত করার প্রশ্নে লজ্জিত হন।
৭.২ কর্মসম্পাদনের পূর্বে চিন্তা করা। অর্থাৎ যে কর্মটি নিজের তথা অপরের ক্ষেত্রে মন্দ, তা উভয়ের ক্ষেত্রে বিপদ ডেকে আনবে কিনা।
৭.৩ এই প্রতিফলন অবশ্যই শারীরীক ক্রিয়া, বক্তব্য এবং চিন্তার প্রশ্নে করা উচিৎ (শরীর, বক্তব্য এবং মনের ক্রিয়া)।
উপসংহার :
এইভাবে, অশোকের ধম্মের উপস্থাপনা যা তিনি উল্লেখ করেছেন তা ৭টি প্রামানিক গ্রন্থে এইভাবে ব্যক্ত করেছেন।
মহামতি অশোক বুদ্ধের প্রয়োজনীয় শিক্ষাগুলি অনুশীলনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন এবং বুদ্ধের উদাহরণকে সামনে রেখে ভবিষৎ’এর বিপদ এড়াতে তথা উৎকৃষ্ট ‘মনচাষা’ হয়ে মহৎ জীবনকে ধারণ করতে বলেছিলেন।
মহামতি ধম্মাশোক : ভারতীয় ইতিহাস এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি।।
ভারতীয় ইতিহাসের একটি মিথ্যাদৃষ্ট মূলক অধ্যায় ব্রাহ্মণবাদী কল্পনা দ্বারা রচিত হয়েছে। এই ইতিহাসের সম্পূর্ণ অংশই হল অভিসন্ধি মূলক এবং সামন্তবাদী। ভারতীয় উপমহাদেশ হতে বুদ্ধ শাসন এবং তাঁর একনিষ্ট উপাসক সম্রাট অশোক’কে মুছে বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করলে এটি আরও স্পষ্টতর হয়ে উঠবে।
যথা হি চোরঃ স তথা হি বুদ্ধস্তথাগতং নাস্তিকমন্ত্র বিদ্ধি।
তস্মাদি যঃ শঙ্ক্যতমঃ প্রজাণাম্ ন নাস্তিকেনাভিমুখো বুধঃ স্যাত্।।
                      -বাল্মিকী রামায়ণ, ২.১০৯.৩৪।
ইতিহাসবিদ চার্লস্ অ্যালেনের মতে, অশোক ভারতের প্রতিষ্ঠাতা। ভারতীয় ইতিহাস তাই অশোকের নথি হতে অধ্যয়ন করা আবশ্যক। মৌখিক তথ্যের বিপরীতে, অশোকের তথ্যগুলি পাথরে খোদাই করা এবং সেগুলি (শিলালিপি) সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে বিদ্যমান। ভারতের ইতিহাস রচনার প্রামানিক তথ্য রূপে অশোকের অভিলেখ গুলিই হবে একমাত্র প্রামানিক দলিল। এর বিপরীতে অন্যান্য সমস্ত তথ্য সমূহকে অনুমানমূলক রূপে গ্রহণ করা উচিৎ।
প্রাচীন ভারত সম্পর্কিত একজন মহান ইতিহাসবিদ এবং অশোক গবেষনার একজন প্রসিদ্ধ নাম, অধ্যাপক প্যাট্রিক অলিভেলে অশোকের শিলালিপি গুলিকে যথার্থ অর্থে অশোকের লেখা বলে অভিহিত করেছেন।
অশোকের লেখা অধ্যয়নের পরে তার উপসংহারও চমকপ্রদ। তিনি অশোকের নীরবতাকে উল্লেখ করেছেন যা প্রাচীন ভারতে ‘বিশিশ্থ’ রূপে পরিগণিত হয়। অশোকের লেখায় প্রাচীন ভারতে যা জোর দেওয়া হয়েছে তার অনুপস্থিতি ভারতের সমগ্র ইতিহাস পর্যালোচনার একটি মঞ্চ নির্মান করে।
অশোকের অভিলেখ’তে এগুলি অনুপস্থিত :
১. বর্ণ ব্যবস্থা
২. পুর্নজন্ম এবং কর্মবাদ (শ্রম)
৩. বৈদিক শ্রেণী রূপে গৃহস্থ সমাজ
৪. দ্বি-জন্মের ধারণা
যদিও আমরা ৩নং পয়েন্টের আলোচনাকে একপাশে সরিয়ে রেখে অবশিষ্ট পয়েন্ট নিয়ে ও আলোচনা করি (প্রাচীন ভারতের ইতিহাস অধ্যয়নের প্রশ্নে) এবং তা সঠিক রেকর্ড স্থাপনের ক্ষেত্রে অতীব গুরুত্বপূর্ণ হবে।
এখন অধ্যয়ণগুলি দেখায় যে বর্ণাশ্রম ধর্ম’ হল বৌদ্ধধর্মের পরবর্তী বিকাশ এবং এই অর্থে ব্রাহ্মণ্যবাদী সাহিত্যের বেশিরভাগই উত্তর-বৌদ্ধ যুগেই রচিত হয়েছে। সেই সময় ভারতে এক শ্রেণীর ধর্মীয় গোষ্ঠী (বৌদ্ধ মতে অন্য তীর্থিক) রূপে ব্রাহ্মণদে অস্তিত্ব ছিল। এটি ‘দল’ বা গোষ্ঠী ছিল না যেমনটি আজ ইতিহাস বইতে পড়ানো হয়। মনে হয় যে সেই সময় ভারতীয় সমাজে বর্ণ ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ ভাবে গঠিত হয়নি এবং বধিত ভাবে সেখানে কোনরূপ জাতি ভেদও ছিল না। যা এখন আমরা প্রত্যক্ষ করছি।
অশোকের লেখায় পুনর্জন্ম এবং কর্মবাদের অনুপস্থিতি অর্থাৎ দ্বিতীয় পয়েন্টটিও গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় মন কর্মফল এবং পুণর্জন্মের অনুমানে আচ্ছন্ন। বুদ্ধের মূল শিক্ষা হতে এই বিষয়টি সম্পূর্ণ অর্থে ভিন্ন। ব্রাহ্মণ পরিকল্পনায় কর্মফল এবং পুনর্জন্ম বর্ণ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত। এই অর্থে কর্ম (শ্রম) হল বণফের ন্যায্যতা।
চতুর্থ অনুপস্থিতি যা দ্বিগুন জন্ম (দ্বিজ) ধারণারে এক উল্লেখ্যণীয় প্রমাণ এবং যা এই সত্যটিকে নির্দেশ করে যে তৎকালীন বৌদ্ধ ভারত ছিল বাস্তবিক অর্থে সমাজতান্ত্রিক সমাজ। এটি অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীর ন্যায় ব্রাহ্মণদের শুধুমাত্র একটি শ্রেণীরূপেই গ্রহণ করেছিল। সেই ব্রাহ্মণরা ছিল একটি পেরিফেরাল শ্রেণী এবং সেই অর্থে বর্ণ ব্যবস্থার পরিকাঠামো ও তখন নির্মিত হয়নি।
ড. আম্বেদকর যেভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন তা এই আলোচনাতেই স্পষ্টতর হয়ে ওঠে।
১. ভারতীয় অস্পৃশ্যরা বিচারাধীন বৌদ্ধ
২. বর্তমান যাদেরকে শুদ্ররূপে প্রতিপন্ন করা হয় তারা ব্রাহ্মণীয় কল্পনার শ্রেণীবদ্ধ কাঠামোর শুদ্র নয়। বিগত ২০০ বৎসরের ব্রাহ্মণ্য প্রচারের কারণে বর্তমান ভারতীয়দের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে ইচ্ছাকৃত ভাবে (শোষন করার অভিপ্রায়ে) শুদ্র বলা হয়।
যদি সেই অর্থে ভারতীয় ইতিহাসের একটি পরিস্কার ছবি পেতে হয় তাহলে ড. আম্বেদকরের লেখার সঙ্গে মহামতি অশোকের অভিলেখগুলিকেও সমান্তরাল ভাবে অনিশীলন করা উচিত।
অধ্যাপক অ্যালফ্ হিলটেবিটেল বৌদ্ধ ও বৈদিক শাস্ত্রে ধম্ম/ধর্মের বিভিন্ন অর্থ ব্যাখ্যা করেছেন। এই সুবিশাল গ্রন্থটি ধম্ম/ধর্ম শব্দের নানাবিধ অর্থ সম্পর্কিত তথ্যের একটি সমৃদ্ধ উৎস এবং ভারতীয় ইতিহাসের যে কোন ছাত্রের জন্য অপরিহার্য। যাই হোক, এই বিষয় টি অশোকের ধম্ম কে উপলব্দি করার বিষয়ে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে তথা যেমনটি স্পষ্ট অর্থে অধ্যাপক হিলটেবিটেল দ্বারা ব্যাখ্যাত হয়েছে, যা পরে আম্বেদকরের ধম্মের আলোচনার সঙ্গে তুলনা করা হবে। ভারতীয় ইতিহাসের এই দুই মহান ব্যক্তিত্বকে উপলব্দি করা এই মুহূর্তে কতটা জরুরি যখন ভারত সামন্তবাদ তথা কর্তৃত্ববাদী শাসনের মুখোমুখি।
চালর্স অ্যালেন মহামতি অশোককে বৃহত্তর ভরতের প্রতিষ্ঠাতা পিতা রূপে উল্লেখ করেছেন এবং ড. আম্বেদকর ভারতকে একটি গণ-প্রজাতন্ত্রের পরিণত করার প্রশ্নে একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক ভূমিকা পালন করেছেন। অশোক এবং আম্বেদকর, উভয়েরই মার্গপ্রদর্শক হলেন মহান বুদ্ধ। শাক্যমুনি বুদ্ধকে উল্লেখ করার সময় অশোক তাকে ‘আমাদের বুদ্ধ’ রূপে উল্লেখ করার সময় আম্বেদকর তাকে “আমার বুদ্ধ’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। তাদের এই সম্বোধন বুদ্ধের প্রতি গভীর ভালবাসা এবং বিশ্বাস প্রদর্শন করে।
অশোক বিষয়ক পন্ডিত হ্যারিফক্‌ একটি আর্কষণীয় অনুমানের প্রতি ঈঙ্গিত করেছেন যে অশোক সম্ভবত স্বয়ং ধম্মলিপির আবিস্কারক এবং যে শাস্ত্রটি সমস্ত ভারতীয় লিপির জননী হয়ে উঠেছে। তিনি আরও মনে করেন যে অশোক গ্রীক বর্ণমালার উপর তার লেখ্যগুলি তৈরী করেছিলেন। তবে একথা উল্লেখ্যনীয় যে ধম্মলিপি গ্রীক লিপি হতে সম্পূর্ণ অর্থেই ভিন্ন।
প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা বা সিন্ধু সভ্যতায় বর্ণমালার প্রচলন ছিল কিন্তু তা এখনও পাঠোদ্বার সম্ভব হয়নি। অশোক প্রবর্তিত শিলালিপি এবং স্তম্ভের আদেশ সেই অর্থে প্রথম প্রমাণ গঠন করে এবং তাই ধম্ম/ধর্ম শব্দের অনুসন্ধান।
মহামতি অশোক তাঁর আদেশে প্রায় ১১১ বার ধম্ম শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তিনি তাঁর আদেশকে ধম্মলিপি রূপে ঘোষণা করেছিলেন। অশোক প্রদত্ত ‘ধম্ম’ শব্দের অর্থ হল ধর্মপরায়ণতা রাজা এবং পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধা ও সত্য পক্ষ অবলম্বন। তিনি ধম্মের প্রচারার্থে ধম্মযাত্রা পরিচালনা এবং সদ্ধর্মকে রক্ষার প্রশ্নে সদা সচেষ্ট ছিলেন। এখন আমরা ক্রমানুসারে অশোকের জীবনগন বিন্যাসের নানাবিধ বিষয়গুলি আলোচনা করতে পারি।
অশোক তাঁর রাজত্বের মধ্যবর্তী সময়কালে সদ্ধর্মকে একটি সুদৃঢ় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রদান করেছিলেন। এই ধম্মের মূলভিত্তি ছিল ‘ধম্মানুশাসন’।
এই ধম্মের মূল ছিল মাতা ও পিতার প্রতি আনুগত্য, বন্ধুদের প্রতি উদারতা, পরিবারের সদস্য, আত্মীয়, অন্বেষণকারীর প্রতি সহমর্মিতা পোষন, জীবন হত্যা না করা এবং ব্যয়-সম্পদের সংযম। তিনি একইভাবে শীলচর্চাকেও উৎসাহিত করতেন। তিনি জনগনকে যে কোন অপকর্ম হতে বিরত থাকতে বলেছেন।
অশোকের সদধম্ম শব্দের ব্যবহার অত্যন্ত আকর্ষনীয়। অশোকের শাসনের মূলনীতি ছিল কোনো শ্রেণী বা গোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য না করা। তিনি সমতা প্রচার করেছিলেন। ধম্মাশোক এইভাবে ধম্ম শব্দটিকে একটি সমতাবাদী এবং সর্বজনীন স্তরে উথ্থাপন করেছিলেন যা এটিকে ধর্মীয় গোষ্ঠী ও সমস্ত ধরণের অন্যান্য ধারণাগুলির কার্যকারিতা বিচারের দৃষ্টিকোন রূপে নির্মাণ করে। অশোকের ধর্ম সেই অর্থে সর্বজনীন তথা অসাম্প্রদায়িক। তাঁর ধম্ম কূল, বর্ণ, এমন কি রাজধর্মেরও উর্দ্ধে।
পন্ডিতবর্গের অভিমত অনুসারে সম্রাট অশোক ধম্ম শব্দটি অভিধমীয় উপায়ে ধ্যানমূলক আত্ম-পরীক্ষা রূপে ব্যবহার করেছিলেন। ‘ধম্ম’ শব্দের এই ব্যাখ্যা হিংসা, ক্রোধ, নিষ্ঠুরতা, অলসতা এবং ক্লান্তির ন্যায় প্রবণতা হতে মনকে রক্ষা করে নিরপেক্ষতার অনুশীলন অর্থে বোঝায়। তিনি ধম্মকে সমবেদনা (দয়া), ভাগ করা (দান), সত্য (সাককা) এবং মনের বিশুদ্ধতা (সোকায়ে) রূপে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এই বিষয়টি ধ্যানমূলক স্ব-অনুসন্ধানের সাথে অনুশীলন করা হয়। অশোক ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি দুটি উপায়ে ধম্মে অগ্রগতি অর্জন করেছেন। (এটি প্রসারে) ধম্ম নিয়ামেন (ধম্মের আইন দ্বারা) এবং নিজ্জাত্তি (ধ্যান অনুশীলন)।
অশোকের ধম্মে আরও অনেক উল্লেখ্যণীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে কিন্তু উপরোক্ত আলোচনাই তাঁর ধম্মকে সর্বজনীন, অসাম্প্রদায়িক, অ-বৈষম্যহীন, সর্বকালের জন্য, সমস্ত জীবনকূলের উপকারের জন্য অনুশীলনের মাধ্যমে স্পষ্ট ভাবে আলোকপাত করার পক্ষে যথেষ্ট। বিশ্বে দ্বন্ধের উৎসগুলি সম্পর্কে অনুশীলন, নিজের মনকে রক্ষা করা এবং নিরপেক্ষ মনোভাব অর্জনের প্রশ্নে অশোকের ধম্মানুশাসন অত্যন্ত জরুরি। সুতরাং এই অর্থে বলা যায় যে অশোকের ধম্ম রাষ্ট্র পরিকল্পনা আজও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনার প্রশ্নে সমান অর্থে প্রাসঙ্গিক।
আধুনিক বিশ্বে ড. আম্বেদকরের আবির্ভাব একটি উল্লেখ্যনীয় ঘটনা। বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হতে শিক্ষিত হওয়া এবং ভারতবর্ষে অন্ধকার বর্ণপ্রথার অন্ধকূপ হতে মুক্তি প্রদানের অভিপ্রায়ে লক্ষ লক্ষ জনগনকে নেতৃত্ব দেওয়া তথা ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, সাম্য, ভাতৃত্ব, মর্যাদা এবং অখন্ডতার মূল্যবোধের প্রতি ভিত্তি করে গনতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র রূপে ভারতকে একটি সুদৃঢ় ভিত প্রদান করা’র বিষয়টি সম্রাট অশোকের সিদ্ধান্তের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়।
তবে এক্ষেত্রে বলতে ্য় যে ধম্ম্রপচারের জন্য অশোকের নিকট সম্পদ ছিল কিন্তু আম্বেদকরকে ধম্মপ্রচারের প্রয়োজনে সম্পদ তৈরী করতে হয়েছিল। তাকে মানুষকে শিক্ষিত করতে হয়েছে এবং একই সাথে লড়াই ও করতে হয়েছে বর্ণব্যবস্থার বিরুদ্ধে। তাঁর আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হ’ল ‘বুদ্ধ এবং তাঁর ধম্ম’ নামক উল্লেখ্যনীয় গ্রন্থ রচনা। সর্বোপরি তিনি যে বৈপ্লবিক কর্মটি সম্পাদন করেছিলেন তাহ’ল বুদ্ধের ধম্মকে ভারতের নতুন প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি রূপে স্থাপন করেছিলেন। ফলে স্বাধীন ভারতের সংবিধান আইনগত ভাবে সব ধরণের বৈষম্যদূর করেছে এবং বর্ণপ্রথাকে বেআইনি ঘোষণা করেছে।
সম্রাট অশোক হয়ত তেমন ভাবে বর্ণবাদী সমাজ ব্যবস্থার মুখোমুখি হননি। তবে তাঁর সমতাবাদী এবং মানবিক শাসন পরজীবী পুরোহিত শ্রেণীকে শঙ্কিত করে তুলেছিল। ফলে উত্তরকালে তারা অশোকের মূল্যবোধ এবং ধারণাগুলিকে দেবত্ববাদ তথা অদৃষ্টবাদের মাধ্যমে মুছে ফেলেছিল। আম্বেদকর ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের সাথে সাথে সামন্তবাদী এবং অধিকতর সংগঠিত ব্রাহ্মণ্যবাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ফলে মূল অর্থে মনুবাদের পুষ্টপোষক ব্রাহ্মণ্যধর্ম প্রবলভাবে আম্বেদকর বিরোধী এবং ধম্মকে বিকৃত করার প্রচেষ্টায় ক্রমাগত ঘৃণার বাতাবরণ তৈরী করে চলেছে।
সম্রাট অশোক এবং ভারত নির্মাণ ।।
কিছু সূত্র অনুসারে জানা যায় যে ১৪ এপ্রিল মহান সম্রাট অশোকের জন্মদিন। যদিও অশোকের সঠিক জন্মতিথি নির্ণয় করা কঠিন, তবুও সত্য যে তিনি কোনো পৌরানিক বা কাল্পনিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না।
অশোকের নাম এবং গৌরব মহানদী হতে ভোলগা পর্যন্ত অনুরণিত হয়েছিল, যেমনটি মহান ইতিহাসবিদ এইচ.জি.ওয়েলস্‌ বলেছিলেন। সম্রাট অশোক সম্পর্কে আজ আমরা যেভাবে জানি, সম্ভবত অন্য কোন উদারনৈতিক এবং গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন সম্রাটের ইতিহাস সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যায় না।
ভারত পৌরাণিকতা এবং বর্ণাশ্রমের কবলে পড়ে অশোককে সম্পূর্ণ অর্থেই ভূলে গিয়েছিল। এক অর্থে অশোক এবং বুদ্ধের ধম্মকে যারা অপছন্দ করতেন তারা অত্যন্ত সুকৌশলে নিজেদের মনগজ ইতিহাসের আড়ালে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তাঁর শিলালেখ বা অভিলেখ গুলি আবিস্কৃত হওয়ার ফলে আমরা অশোক এবং তাঁর ধম্মনীতি সম্পর্কে জানতে পারি।
আধুনিক ভারত সেই অর্থে অশোকের কাছে ঋণী। স্বাধীন ভারতের জাতীয় পতাকায় যে চক্র প্রতীক রয়েছে তা মূলতঃ ধম্মচক্র বা অশোক চক্র নামে পরিচিত। ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতীকে যে সিংহ চিহ্ন রয়েছে তাও অশোকের রাজকীয় প্রতীক হতে গৃহীত।
অশোক মানবতাবাদী এবং জনকল্যানকামী ছিলেন। তিনি জনগনের সুবিধার্থে চিকিৎসালয়, বিশ্রামাগার, জলাশয় এবং কূপ নির্মাণ করেছিলেন। তিনি নারী সুরক্ষার প্রশ্নেও সদা সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর রাজনীতি ছিল সদ্ধর্ম ভিত্তিক। এমনকি তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষু হওয়ার পূর্বে নিজেকে শাক্য রূপে ঘোষণা করে ছিলেন।
অশোকের শাস্ত্র, চীনা পর্যটক (শুয়াং জ্যাঙ্‌প্রমুখ) দের ভারতীয় ইতিহাস সম্পর্কিত ভ্রমণ বৃতান্ত এবং প্রাচ্যের ইতিহাসবিদ’দের আবিস্কার না হলে ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কিত ইতিহাস ব্রাহ্মণ্যবাদীদের নির্মিত মিথের কুয়াশায় বিলীন হয়ে যেত।
অশোক এবং বৌদ্ধ ধর্মের উপর ব্রাহ্মণ্যবাদী আক্রমণ এখন সর্বজন বিদিত। বৌদ্ধ আদর্শ গঠিত মৌর্য সাম্রাজ্য তথা অহিংসা-শান্তির ভারতকে ধ্বংস করার প্রশ্নে ব্রাহ্মণ্যবাদের পৃষ্টপোষক শুঙ্গবংশ (পুষ্যমিত্র শুঙ্গ) হিংসা, মিথ্যাচার এবং কপটতার আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন।
অশোক অনেক নীতির চর্চা এবং প্রচার করেছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম এবং গুরুত্বপূর্ণ হল ‘সমবায়-সাধু’। ইংরাজীতে যার অর্থ হয় ‘হারমনি ইজ দ্য বেষ্ট’। সমাজে সম্প্রীতি হল সর্বোত্তম নীতি। কারণ সমাজ ধর্ম, ভাষা, বর্ণ এবং জাতি দ্বারা বিভক্ত হয়। যখন একটি’র বৈষম্য দেখা দেয়, তখন সমাজ অত্যন্ত দুর্গতির পঙ্কে নিমজ্জিত হয় এবং তাই সমাজের সর্বোত্তম নীতি হল সম্প্রীতি বজায় রাখা।
দ্বিতীয় নীতিটি হল রাষ্ট্রের প্রশাসন বা যে কোন প্রকল্পের ক্ষেত্রে ‘মধ্যম মার্গ’ ব্যবহার করা। এটিকে স্থির পদক্ষেপ রূপে গ্রহণ করা উপযোগী হতে পারে।
অবিচলিত কর্ম এবং কোন হঠকারিতা নয়।
অশোকের এই নীতি আজ আমাদের প্রয়োজন। কারণ হঠকারি বা তাড়াহুড়ো করে যা কিছু করা হয় তা হবে আমনোযোগী এবং এইটি ধ্বংসাত্মকও হতে পারে। সুতরাং সমাজ বিকাশের স্বার্থে চিন্তার বিকাশ করুণ, শিক্ষার প্রসার ঘটান এবং মানুষকে নিজের বিকাশের প্রশ্নে চিন্তা করতে দিন। এই বিষয়টিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে, ‘অনিভিক্ষি’। এর অর্থ হল চিন্তার সংস্কৃতি, স্পষ্টভাবে এবং সৃজনশীল ভাবে চিন্তা করা। সেই সময় অশোকের অনুসরণে প্রাচীন ভারতে শিল্প-বিজ্ঞান দ্রুত অগ্রসর হয়েছিল এবং ভারত পৃথিবীতে পপধম শিক্ষার বিকাশে নালন্দা, তক্ষশীলা ও বিক্রমশীলা ও বিক্রমশীলার ন্যায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
অশোক দ্বারা প্রচারিত নীতি সমূহ।।
১. সম্প্রীতি সর্বিত্তম এবং সর্বোচ্চ।
২. হঠকারীতা ব্যতীত অবিচলিত কম।
৩. সকলের মঙ্গলার্থে চিন্তা ও জ্ঞানের সংস্কৃতি।
ধম্মাশোক দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন ড. আম্বেদকর, যিনি স্বয়ং শিক্ষা-সংস্কৃতির (অনভিক্ষি) প্রচার করেছিলেন এবং সংগঠিত করেছিলেন সমাজের ব্রাত্যজনকে। অপর অর্থে বলা যায় তিনি অশোকের নীতি শিক্ষা এবং সমাজ বিকাশের ভাবনাকে আন্দোলন-সংগঠনের মাধ্যমে তাঁর সময়ের সমাজকে পরিবর্তন করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন, যা আজও প্রাসঙ্গিক।

১২.০৪.২০২৩ 

একটি সত্যবাদিতার প্রতিভাস সম্পর্কে আমার অন্তিম বাণীl


মাষ্টার শিং য়ুন

ফো-কুয়াং শান মোনাষ্ট্রি

অনুবাদ: সুমনপাল ভিক্ষু


আমি আমার দেহ ও মনকে উৎসর্গ করেছি বৌদ্ধধর্মের জন্য এবং আমার জীবনের পরিস্থিতি অনুযায়ী জীবনযাপন করেছি। প্রিয় ধর্মরক্ষক, বন্ধু ও শিষ্যগণ আমি আপনাদের সকলের কাছে একটি সৎ উন্মোচন করতে চলেছি। আমার সমস্ত জীবনে অনেকে আমাকে ধনী মনে করেছে, কিন্তু সত্যি কথা হল দরিদ্র থাকাটা সবসময় আমার জীবনের উদ্দেশ্য ছিল। আমি একটি দরিদ্র পরিবারে বেড়ে উঠেছি, কিন্তু কখনই নিজেকে দরিদ্র বলে মনে করিনি কারণ আমি অন্তরে সবসময়ই নিজেকে ধনী বলে মনে করেছি। আমি বয়স্ক হয়ে যাওয়ার পরও অনেকে আমাকে ধনী বলে, কারণ তাদের বিশ্বাস আমি অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক সংগঠন, প্রকাশনা সংস্থা ইত্যাদির মালিক। তবে আমি কখনও মনে করিনি যে আমি কোন কিছুর মালিক, কারণ সেগুলি সাধারণ মানুষের, আমার নয়। যদিও আমি এই পৃথিবীতে অনেক বিহার নির্মাণ করেছি, এই ভবনগুলি এমনকি এগুলির কোন আসবাবও আমার নয়। আমার মাথার উপর একটি টালি বা আমার পায়ের তলায় আবর্জনার একটি ছোট ঢিবিও আমার নয়। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত সমস্ত কিছুই সমস্ত পৃথিবীর, তাই সেখানে ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকে কেমন করে? তবু, আমার মনে মনে আমি অনুভব করি যে সমস্ত পৃথিবীটাই আমার। আমার কখনও নিজস্ব দেরাজ বা ডেস্ক ছিল না। যদিও আমার শিষ্যরা আমার জন্য এগুলি তৈরী করে দিয়েছে, আমি কখনও এগুলি ব্যবহার করিনি। আমার জীবনে আমি খুব কম দোকানে কেনাকাটা করতে গিয়েছি, আমার কখনও কোন সঞ্চয় ছিল না। আমার যা কিছু আছে তার সবই সাধারণ মানুষের ফো-কুয়াং শান সংঘের বা বিহারের। একইভাবে আমার সমস্ত শিষ্যের উচিত একই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বৌদ্ধধর্মকে তাদের শরীর ও দান করা এবং নিজের জীবনের পরিস্থিতি অনুযায়ী জীবনযাপন করা।

আমার সমস্ত জীবনে অনেক মানুষ আমাকে এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে ভেবেছি যে সভা সমিতি আয়োজন অত্যন্ত একা কারণ এমন কেউ নেই যাকে আমি আমিত্বের অনুপস্থিতি—একজন অবনমিত ভিক্ষুর উপদেশবাণী আমার সবচেয়ে প্রিয় বা সবচেয়ে অগ্রিম ব্যক্তি বলে মনে করি। অন্য অনেকে ভাবতে পারে আমার অনেক শিষ্য ও ভক্ত রয়েছে, কিন্তু আমি কখনই তাদের আমার নিজের বলে মনে করিনি, কারণ তাদের জন্য আমার ইচ্ছা শুধুমাত্র এই যে তারা বৌদ্ধধর্মে তাদের নিজেদের খুঁজে পাক। আপনাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার মত আমার কোন সম্পত্তি যেমন অর্থ জমি ইত্যাদি নেই। যদি আপনি কিছু চান তাহলে স্মৃতি হিসেবে আমার অনেকগুলি বইয়ের একটি রেখে দিন। যদি আপনি কিছুই না চান তাহলে আমার উপদেশ বাকা আপনার কোন কাজে লাগবে না। আমার দেওয়ার মত কিছু যা কিছু রয়েছে তা হল মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্ম যার থেকে আপনি শিখতে পারবেন এবং বিহার যাকে আপনি সাহায্য করতে পারবেন। আমি কাউকে অনুগ্রহ করি না। সংঘের একটি ব্যবস্থা এবং পদমর্যাদা নির্ধারণের একটি পদ্ধতি রয়েছে। তবুও নিরপেক্ষতা রক্ষা করা সহজ নয়। পদোন্নতি নির্ভর করে একটি বিশেষ পদে একজনের কাজকর্ম, তার শিক্ষা, আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং সাফল্যের উপর এবং এগুলির ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে পার্থক্য হয়। সাফল্য, পদমর্যাদা এবং স্বীকৃতি সমস্ত কিছু একজন ব্যক্তির নিজস্ব সদগুণের উপর নির্ভর করে অতএব ব্যক্তিগতভাবে আমি একথা বলতে পারি না যে কোন ব্যক্তিবিশেষের পদোন্নতি হওয়া উচিত কি উচিত নয়। আমি আমার শিষ্যদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি এই কারণে যে আমি তাদের কারও সম্পর্কে স্বতন্ত্রভাবে প্রশংসা করে তাদের খুশি করতে পারি না। তবে এটিকে তারা নিরপেক্ষতার একটি শিক্ষা বলে মনে। করতে পারে। পরিচালন সমিতির আপনার পদোন্নতি বা পদাবনতি নির্ধারণের অধিকার রয়েছে, এবং একজন ভিক্ষু হিসেবে আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে আপনার সাফল্য নির্ধারিত হবে ধর্মের মাপকাঠিতে। এক্ষেত্রে কোন পার্থিব নিয়ম আপনার মূল্যায়ন করতে পারবে না। ভবিষ্যতের যা নিয়ে আমি চিন্তিত তা হল আমার শিষ্যদের কর্মের স্থানান্তরণ। যদিও ফো-কুয়াং শান কোন সরকার নয় তা সত্ত্বেও এতে অসংখ্য বিভাগ ও কর্ম স্থানান্তরণ ব্যবস্থা রয়েছে। সংঘের পরিচালন ব্যবস্থা প্রতিটি পদে উপযুক্ত ব্যক্তিকে বসাতে চেষ্টা করবে। যে পদে কোন ব্যক্তিকে বসান হবে তার সঙ্গে ব্যক্তিগত আগ্রহ বা ধারণার কোন পার্থক্য হলে তাকে সমাধান করতে হবে। এই পৃথিবীতে সমতাকে মাপা খুব কঠিন, তাই কেমন করে আমরা শান্তিপূর্ণ ও সুখী জীবনযাপন করতে পারব তা নির্ধারিত হয় সমতার সম্পর্কে বিভিন্ন ধরণের সংজ্ঞার দ্বারা।

আমার সমস্ত জীবনে অনেক ভেবেছে যে আমি এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলি গড়ে তুলতে অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু প্রকৃত সত্য হল এই যে বিষয়টি আমার পক্ষে অত্যন্ত সহজ সরল ছিল কারণ সমবেত প্রচেষ্টায় আমি দলের অংশ ছিলাম মাত্র। আমি এই লক্ষ্য পূরণের সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছি এবং বাকীটা রেখে দিয়েছি বাহ্যিক পরিস্থিতির জন্য। অনেকে মনে করে আমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞ; কিন্তু প্রকৃত সত্য হল এই যে আমি শুধুমাত্র বিশ্বাস করি নিয়ন্ত্রণে কোন চেষ্টা না করাতে। আমি সকলকে পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতা করার জন্য ধন্যবাদ জানাই কারণ শীল ও নিয়ম ছাড়া আমাদের অপরকে শৃঙ্খলা শিক্ষা দেওয়ার কোন অধিকার নেই। এই পৃথিবীতে কোন কিছুকে আসতে দেখে আনন্দিত হবার বা কোন কিছুকে চলে যেতে দুঃখিত হবার কোন কারণ নেই। কোন না কোনভাবে আমাদের সকলের মুক্ত হওয়ার অধিকার আছে এবং সহজ হওয়ার অধিকার আছে যখন আমরা পরিস্থিতি অনুযায়ী চলি। ধর্মের পথকে অনুসরণ করে চললে আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হব। আমার সমস্ত জীবনে আমি দানের দর্শনকে অনুসরণ করেছি। আমি সবসময় অপরের প্রশংসা করেছি, তাদের ইচ্ছাকে পূর্ণ করেছি। এর গুরুত্ব সম্পর্কে পরিপূর্ণ সচেতন থেকে আমি যেখানেই যাই সেখানেই ধর্মের বীজ ছড়ানোর চেষ্টা করি। এই কারণে Buddha Light-এর সদস্যদের জীবনের মূলমন্ত্র আমি প্রতিষ্ঠা করেছি : 'অপরকে বিশ্বাস জোগাও, আনন্দ দাও, আশা দাও এবং সুবিধা দাও।” আমার অনেকগুলি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের পিছনে উদ্দীপনা হিসেবে কাজ করেছে আমার কখনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পাওয়া। এর ফলে আমি বুঝতে পেরেছি শুধুমাত্র শিক্ষাই আত্মবিকাশ ও চরিত্রের পরিবর্তনে সাহায্য করতে পারে। আমি লেখালিখিতেও সময় দিয়েছি কারণ বুদ্ধের কাছ থেকে ধর্মের যে ধারা আমি উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছি তা যেন আত্মার নিজের হৃদয় থেকে সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তেই থাকে। আমার সমস্ত জীবন আমি নিম্নলিখিত নীতিগুলি মেনে চলেছি “এগিয়ে যাওয়ার জন্য পিছিয়ে যাওয়া জনতাকে নিজের মত মনে করা; কিছু পাওয়ার জন্য কিছু না থাকা; শূন্যতার মধ্যে আনন্দলাভ করা। আমার সমস্ত সন্ন্যাসী শিষ্যের উচিত সমস্ত কিছুকে অতিক্রম করে যাওয়ার মন নিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা, এবং অতিক্রম করে যাওয়ার মানসিকতা নিয়ে পার্থিব কাজকর্ম অংশগ্রহণ করা।” এছাড়াও তার মিতব্যয়ীতার মধ্যে দিয়ে জীবন কাটাবে এবং কোন পার্থিব সম্পদ সঞ্চয় করবে না। বুদ্ধের সময় থেকে চলে আসা কেবল তিন পোশাক ও একটি পাত্র রাখার নিয়ম এবং একজন ব্রহ্মচর্য অনুশীলনকারীর মাত্র আঠেরোটি ব্যক্তিগত সম্পত্তি আমিত্বের অনুপস্থিতি—–—একজন অবনমিত ভিক্ষুর উপদেশবাণী রাখার নিয়ম শুধুমাত্র যে বিনয় অনুসারী তাই নয়, এগুলি সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবা উচিত এবং মনে রাখা উচিত। ফো-কুয়াং শানের শিষ্যরা কখনও ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে তহবিল সংগ্রহ করবে না, সঞ্চয় করবে না, বিহার নির্মাণ করবে না বা ভক্তদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে না। যদি সকলে এই নিয়ম মেনে চলে তাহলে ফো-কুয়াং শান পরম্পরায় গৌরব অন্তহীন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে।

সকলকে “গৌরব যুদ্ধের, সাফল্য সমাজের, সুফল বিহারের এবং পুণ্য ভক্তের এই কথাটি মেনে চলা উচিত। একজনের অবশ্যই জানা উচিত ‘বুদ্ধের পথ বিশাল শূন্যতাকে পূরণ করে; এই সত্যটি ধর্ম জগতের সর্বত্র উপস্থিত থাকে।” এই ধর্ম জগতের সমস্ত কিছু আমার; কিন্তু অস্থায়ীত্বের ঘটনা আমাকে বলে কোন কিছুই আমার নয়। পার্থিব বিষয়ে অতিরিক্ত আসক্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই, মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্মের অনুশীলনকারীকে অবশ্যই পৃথিবীর সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হবে, কিন্তু ফুল ও পাখিদের উপর নজর রাখা একজন কাকতাড়ুয়ার মত আমাদের খুব বেশি উদ্যোগী হওয়া উচিত নয়। আমার সমস্ত শিষ্যদের ধর্ম ছাড়া আর আর কিছু থাকা উচিত নয়। সমস্ত কিছু যেমন অর্থ এবং পার্থিব জিনিসপত্র যখনই সম্ভব হবে তখনই দান করে দেওয়া কারণ তারা হল সেই সম্পদ যার মালিক হল এই পৃথিবী। বিহারের সমস্ত সম্পত্তি জনগণের সমস্ত হওয়া উচিত কারণ আমাদের যা কিছু আছে বিহার তার সবগুলিই সরবরাহ করে। অতএব সেগুলি নিয়ে খুব বেশি ব্যস্ত থাকা বা তর্ক করার কোন প্রয়োজন নেই। যতদিন আমরা একটি ন্যায়সঙ্গত বিশ্বাসকে প্রচার করছি ততদিন আমাদের মূল প্রয়োজনগুলি নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। এছাড়া আমার ইচ্ছা এই যে আমার শিষ্যরা যেন দৈনন্দিন প্রয়োজনের সমস্যাগুলি নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত না হয় কারণ এগুলি তুচ্ছ বিষয়। আমি বিশ্বাস করি বিহার তার সমস্তbউপার্জনকে সৎ কাজে ব্যয় করবে। কোন অর্থ না রাখাই হল ফো-কুয়াং শানের শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের চাবিকাঠি।

বিহারের দৈনন্দিন প্রয়োজন ছাড়াও যে কোন অর্থ সাংস্কৃতিক, শিক্ষামূলক, বা দাতব্য প্রচেষ্টায় ব্যয় করা উচিত। ফো-কুয়াং শান সকলের কাছ থেকে অর্থ পায়, সেই জন্য তার উচিত সকলকে অর্থ দান করা, আমাদের অবশ্যই জরুরী ভিত্তিক ত্রাণ, নিঃসহায় মানুষদের যত্ন, এবং দরিদ্রদের দান করতে হবে। বিপর্যয় ও দুর্ভাগ্য এই দুটি পৃথিবীর দুর্ভাগ্য, তাই আমাদের ত্রাণকার্যে অবদান রাখা উচিত। ফো-কুয়াং শান, বুদ্ধ মেমোরিয়াল সেন্টার এবং সমস্ত পাখা বিহারের জমি রাষ্ট্রের অধিকারে নয় বা লিজ নেওয়া নয়। এই সমস্ত জমি কেনা হয়েছিল ভক্তদের দেওয়া দানের অর্থ দিয়ে। একমাত্র তাই-চুং-এর ন্যাশনাল ব্রডকাস্ট নেটওয়ার্ক ছাড়া এই সমস্ত সম্পত্তির মালিক হল ফৌ-কুয়াং শানের ভিক্ষু ও গৃহী ভক্ত সম্প্রদায়। এই সম্পত্তির কোনটিই যৌথ মালিকানার অধীনে বা অন্য কোন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নয়। ফো-কুয়াং শানের প্রতিষ্ঠার পর থেকে জমি কেনা বা গৃহ নির্মাণের জন্য কোন অর্থ ঋণ করা হয়নি।

ভক্তদের আরও ভাল পরিবেশ দেওয়ার জন্য শাখা বিহারগুলিকে সাহায্য করতে হবে এবং সেগুলিকে সংস্কার করতে হবে। যদি কোন একটি শাখা চালান কঠিন হয়ে পড়ে তাহলে স্থানীয় ভক্তদের সম্পত্তি নিয়ে সেটিকে বন্ধ করে দিতে হবে এবং সাংস্কৃতিক, শিক্ষামূলক, শিক্ষামূলক এবং দাতব্য কাজকর্মের প্রতি মনোনিবেশ করতে হবে। কোন কিছুকেই ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা যাবে না। অন্য কোন বৌদ্ধ সংগঠন বা কোন ব্যক্তির সঙ্গে কখনই কোন এড়িয়ে চলার জন্য কোন ঋণ নেওয়া যাবে না। আমি আমার সমস্ত জীবন বুদ্ধকে উৎসর্গ করেছি এবং তাঁকে আমার শিক্ষক ও বৌদ্ধধর্মকে আমার পথ হিসেবে গ্রহণ করেছি। অতএব আমাদের ভবিষ্যতের অনুশীলনে আমাদের উচিত বুদ্ধ ও তাঁর দশ শিষ্যকে আদর্শ হিসেবে এবং অন্যান্য বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করা। বৌদ্ধধর্ম প্রচারে সমস্ত পৃথিবীর শাখা বিহারগুলির উচিত স্থানীয়করণের জন্য চেষ্টা করে স্থানীয় ব্যক্তিদের বিহার হিসেবে নিয়োগ করা। মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে আমার সমস্ত শিক্ষাই প্রতিটি পরিবার ও সমস্ত মানুষের কাছে পৌঁছানো উচিত আমার সমস্ত জীবন আমি মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্ম প্রচার করতে চেষ্টা করেছি। যা কিছু বুদ্ধ স্বয়ং শিখিয়েছেন, তা মানুষের প্রয়োজন, তা বিশুদ্ধ, তা পূর্ণশীল ও সুন্দর, যে কোন শিক্ষা যা মানবতা সুখকে বৃদ্ধি করে তাকে মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্ম বলে মনে করা হয়। এছাড়াও আমাদের দুঃখকে সেই শর্ত হিসেবে মনে করা উচিত যা আমাদের শক্তিশালী করে। ক্ষণস্থায়ীত্বের অর্থ হল এই যে কোনকিছুই স্থির নয়, এটি আমাদের ভবিষ্যৎকে পরিবর্তন করতে পারে এবং জীবনকে উন্নত করতে পারে। শূন্যতার অর্থ ‘নাস্তিত্ব’ নয়, বরং এটি অস্তিত্বের ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। একমাত্র শূন্যতা থাকলে তবেই অস্তিত্ব থাকতে পারে। আমার নিজের জীবনে আমি কখনও কোন কিছুর মালিক ছিলাম না; এটি কি প্রকৃত শূন্যতা থেকে জেগে ওঠা বিস্ময়কর অস্তিত্বের ধারণা নয়? আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্মের শিক্ষা মানুষের জন্য ভবিষ্যতে দিক নির্দেশকারী আলোকরশ্মি হতে চলেছে। ভাল কথা বলা সত্যবাদিতা, ভাল কাজ করা পুণ্যশীল, ভাল চিন্তা করা সুন্দর। ভালত্বের তিনটি কাজ করার মাধ্যমে আমাদের অতি অবশ্যই সত্য, সত্য ও সুন্দরকে আমাদের সমাজের গভীরে প্রবেশ করার সুযোগ দিতে হবে। জ্ঞান হল প্রজ্ঞা, উদারতা হল করুণা এবং সাহস হল বোধিজ্ঞান। আমাদের অতি অবশ্যই এগুলিকে অর্জনের জন্য চেষ্টা করতে হবে যাতে করে আমরা আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য বোধিসত্ত্ব পথ অনুশীলন করে নৈতিকথা, মনঃসংযোগ এবং প্রজ্ঞাযুক্ত একটি মনের বিকাশ ঘটাতে পারি।

মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্মের বুদ্ধের থেকে উৎপন্ন হয়ে বর্তমানে বহুদূর বিস্তৃত হয়েছে। তবে, মতভেদের উপর গুরুত্ব দেওয়ার ফলে বৌদ্ধধর্ম ভারতবর্ষে স্থবিরবাদ ও মহাসাংঘিক সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়েছে এবং পরবর্তীকালে চীনদেশে আটটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়েছে। এগুলির মধ্যে দর্শন ও আচার অনুষ্ঠানের পার্থক্য বোধগম্য, কিন্তু আমরা যদি কে ভুল কে ঠিক তা নিয়ে চিন্তা করি তাহলে আমরা বুদ্ধের মন থেকে আরও দূরে সরে যাব। এই কারণে ফো-কুয়াং শান ও বুদ্ধাস লাইট ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের বিকাশ নিঃসন্দেহে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সমন্বয়কারী বৌদ্ধ সংগঠনগুলির অন্যতম হবে। যদি আমাদের মধ্যে কেউ ফো-কুয়াং শানের ভিক্ষু ও গৃহী সম্প্রদায়ের সম্ভাবনা রক্ষায় আগ্রহী হন তাহলে তিনি একটি সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রাচীন ভিক্ষুদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পাবেন। যাই হোক একটি নতুন সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা নির্ভর করে পরবর্তী প্রজন্মের প্রচেষ্টা ও অর্জিত সাফল্যের উপর। যারা মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্মের প্রচেষ্টার সঙ্গে চোখে চোখ মেলাতে পারেন না। তাঁদের জন্য এই প্রবাদটি উদ্ধৃত করতে পারি, যদি কেউ ইতিমধ্যেই আত্মার প্রতি আসক্তিকে দূর করতে পারে; ধর্মের প্রতি আসক্তিকে দূর করা কঠিন। যদি কেউ তাদের নিজেদের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আমাদের খোলা মনে। সেই শাখাটিকে ফো-কুয়াং শান পরিবারের অংশরূপে গ্রহণ করতে হবে। যতক্ষণ না সেই প্রতিষ্ঠানটি ফো-কুয়াং শানের বিরোধী কোন কাজ করছে বা তাকে বিকৃত করছে ততক্ষণ সেটিকে আমাদের সহ্য করতেই হবে। আমাদের লক্ষ্য আমাদের ব্যক্তিগত সাফল্যের উপর নিবদ্ধ নয়, বয়স বা লিঙ্গ নির্বিশেষে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের উপর নিবদ্ধ। বুদ্ধের আলোর মহান পথে ভিক্ষু ও গৃহী সম্প্রদায়ের চারটি সভার ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত ভূমিকা রয়েছে।

ফো-কুয়াং শানের ভিক্ষু, ভিক্ষুণীদের বৌদ্ধধর্ম প্রচারের দায়িত্ব গ্রহণ করা উচিত, এবং BLIA-এর উপাসক-উপাসিকাদের উচিত তাদের ক্ষমতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা। আমাদের শক্তি, সাধারণ বোধ এবং সম্ভাবনাকে একত্রিত করে আমরা সমবেতভাবে BLIA-কে এগিয়ে নিয়ে যাব, যাতে করে বুদ্ধের আলো সর্বত্র ঝলমল করে এবং ধর্মের প্রবাহ বইতেই থাকে। BLIA-এর সদস্যদের এমন একটি জীবিকা গ্রহণ করতে উৎসাহিত করতে হবে যা আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। আমাদের উচিত পরস্পরকে সাহায্য করা যাতে আমরা একত্রে উন্নতি করতে পারি।

যদিও BLIA ফো-কুয়াং শানের সংঘের অধীনস্থ একটি সংস্থা, ভিক্ষু ও গৃহী ব্যক্তি উভয়ই কোনরকম বিতর্ক বা দ্বন্দ্ব ছাড়াই মিলেমিশে থাকতে পারে ঠিক যেভাবে অস্তিত্ব ও শূন্যতা একই মুদ্রার দুটি পিঠ। ফো-কুয়াং শানে ইতিমধ্যেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে; অতএব ফো-কুয়াং শান ও BLIA-এর নেতাদের একমত হয়ে স্বীকৃত মাপকাঠিকে মেনে চলতে হবে এবং জনমতের কথাও মনে রাখতে হবে। সাম্যের একজন প্রবক্তা হিসেবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে নারী পুরুষ, ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সকলেই সমান। সমস্ত জীবিত প্রাণীর মধ্যে বুদ্ধ প্রকৃতি রয়েছে এবং তারা সকলেই নির্বাক লাভ করতে পারে। অতএব আমি ‘মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাও ‘জীবনের প্রতি অধিকার’ এই বিশ্বাসের মাধ্যমে ‘সমস্ত জীবন্ত প্রাণীর মধ্যে সমতা’ ও এই মন্ত্রকে কার্যে পরিণত করতে আশা করি। ফো-কুয়াং শানে আমাদের প্রতিটি গাছ ও ফুলকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতে হয়, প্রতিবেশীদের যত্ন করতে হয়, শিশু আবাসে তরুণদের উৎসাহ দিতে হয়, বৃদ্ধাবাসে বয়স্কদের জন্য দুশ্চিন্তা প্রকাশ করতে হয় এবং সংঘ সম্প্রদায়ে বয়স্কদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হয়। আমি আশা করি যে, আমি মানবতার জন্য উত্তম কারণ ও শর্ত, আমার অনুগামীদের জন্য ধর্মের আবেগ, নিজের জন্য বিশ্বাসের বীজ এবং বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানের জন্য অতুলনীয় গৌরব রেখে যাব। সমস্ত পৃথিবী কার্য কারণ নিয়ম শর্ত, ফল ইত্যাদিতে বিশ্বাস করুক। আমি আশা করি যে প্রত্যেক করুণা, দয়া, আনন্দ ও ক্ষান্তি অনুশীলন করবে এবং পৃথিবীর জন্য তাদের শুভকামনা রেখে যাবে। মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ যেমন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, টেলিভিশন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, সংবাদপত্র প্রকাশনা, প্রকাশনা সংস্থা, মেঘ ও জল ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার, বৃদ্ধাবাস, শিশু আবাস এবং সমাজের মঙ্গলের জন্য সেবা ইত্যাদিকে অবিরাম সাহায্য করে যেতেই হবে। ওয়াটার ড্রপ ট্রি হাউসগুলিকে ‘এক বিন্দু জলের জন্য কৃতজ্ঞতা’র ধারণাকে আরও বেশি করে গুরুত্ব দিতে হবে। যদি আমাদের সুযোগ হয় আমাদের ফো-কুয়াং শানের ভূতপূর্ব বিহার দর্শন করতে হবে যেটি হল চীনদেশের যি-শিং-এর তা-জুয়ে বিহার। আমি সর্বদা সাংস্কৃতিক, শিক্ষামূলক এবং সেবামূলক কাজকর্মের সম্মান করে এসেছি; অতএব আমি সম্মানীয় মাস্টার শিঙ য়ুন পাব্লিক এডুকেশন ট্রাস্ট ফাণ্ড স্থাপন করেছি যা এখনও পর্যন্ত একশ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থসংগ্রহ করেছে। মুষ্টিমেয় কয়েকজন ভক্তের অর্থ সাহায্য ছাড়া এর বেশিরভাগ তহবিলই এসেছে আমার ক্যালিগ্র্যাফি এবং আমার বই থেকে প্রাপ্ত রয়্যালিটি থেকে। ভবিষ্যতে এই প্রচেষ্টাগুলি সহায়তা লাভ করতে পারে ফো-কুয়াং শানের প্রবীনদের কাছ থেকে এবং সেই সমস্ত বৌদ্ধদের কাছ থেকে যাঁরা তাঁদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অর্থকে ট্রাস্টের ফাণ্ডে জমা রাখবেন এবং সমাজের মঙ্গল ও দেশের উন্নতিতে সুদৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। পুরস্কার, যেমন সত্যবাদিতা, ধার্মিকতা ও সুন্দর মিডিয়া পুরস্কার, Three Acts of Goodness Schools Global Chinese Literature Award, ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে যতক্ষণ তহবিলে অর্থ থাকবে। সমাজের প্রগতিতে সাহায্য করা প্রতিটি বৌদ্ধের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হওয়া উচিত। শিক্ষার ক্ষেত্রে বিহারের অর্থের সবচেয়ে বেশী অংশে ব্যয় করা হয় অনেকগুলি বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চবিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে। যতদিন সঠিক পরিস্থিতি বর্তমান রয়েছে সেই সমস্ত বিদ্যালয়ের পরিচালন ব্যবস্থা যতদিন তাদের কেনা বা বিক্রি নাbহয় সেই সমস্ত ব্যক্তির শর্তহীনভাবে তুলে দেওয়া যেতে পারে, যাদের এই বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে। যদি বিদ্যালয়গুলি বিক্রি হয়ে যায় তাহলে তহবিল সংগ্রহে যাঁরা অবদান রেখেছিলেন তাঁদের কাছে আমরা কী জবাবদিহি করব? এটি ফো-কুয়াং শানের সুনামের পক্ষে উপকারী হবে না এবং এর ফলে আমাদের জনগণের সমালোচনার মুখোমুখি হতে হবে। যে কোন গোষ্ঠী যা ফো-কুয়াং শানের সাংস্কৃতিকখ ও শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডে অবদান রাখে তাকে তার ব্যয় করা অর্থ শোধ করে দিতে হবে, যাতে করে যাদের উদ্দীপনা ও উৎসাহ রয়েছে তারা আরও ঘনিষ্ঠভাবে একত্রিত হতে পারে গঠনমূলক মন্তব্য এমনকি সমালোচনাকেও বাতিল করা উচিত নয়, আমাদের ‘নিজেদের ভুল ধরিয়ে দিলে আনন্দ পাওয়া’র মত উদার হতে হবে। আমাদের সকলের মতামতকে স্বীকার করতে হবে যাতে করে তা আরও বেশি করে আমাদের সমর্থন করে। প্রায়শই আমি ভিক্ষু শিষ্যদের আগাছা নির্মূল করতে ও ফুল ছাঁটতে দেখেছি। আমি আরও দেখেছি পরিবেশ যত্ন বিভাগের সহ অনুশীলনকারীরা বিভিন্ন বস্তুরbপুনঃব্যবহার করছে, নির্মাণ বিভাগ মেরামত এবং তত্ত্বাবধানের কাজ করছে, স্বদেশ ও বিদেশের কর্মসমিতি তাদের কাজ করে চলেছে, বিহারের কর্মচারী ও তার প্রধান বিহার দেখাশোনা করে চলেছে। তাদের প্রচেষ্টা ও দায়িত্ব গ্রহণের ইচ্ছা ফো-কুয়াং শানের সাফল্যের অন্তরালের প্রকৃত শক্তি; আমি এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি এবং এর জন্য সাধুবাদ জানিয়েছি। কারও শপথ ছাড়া ফো-কুয়াং শান আজকে যেখানে আছে সেখানে কেমনভাবে পৌঁছত? আজকে থেকে অতিথি আপ্যায়ন, ভক্তদের যত্ন, এবং স্বেচ্ছাসেবকদের যোগদান ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত যাতে করে আমাদের ধর্মীয় সংগঠনটি আরও সম্পূর্ণ হতে পারে। অতএব আমার সারা জীবনের আকাঙ্ক্ষা এই যে সকলের সকলে মিলেমিশে কাজ করার মানসিকতা জয়ী হোক এবং বজায় থাকুক কোনরকম অভিযোগ বা আপশোস ছাড়াই। যেহেতু কেউই একা একা বাঁচতে পারে না, সকলের উচিত একে অপরকে শ্রদ্ধা ও সাহায্য করা যাতে করে সকলে সহাবস্থান ও উন্নতি করতে পারে। একমাত্র তখনই একজন বুদ্ধের শিক্ষার মূল কথাটি বুঝতে পারবে। বিহার বা জনগণের ক্ষতি হবার সুযোগ না দিয়ে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থকে ত্যাগ করে সহিষ্ণু হওয়াই শ্রেয়। আমার নিজের শহরের পূর্বসূরীদের একজন তাং রাজবংশের মাস্টার চিয়ানজেনকে সংস্কৃতি প্রচারের জন্য অনেক কষ্ট করে জাপানে যেতে হয়েছিল। তাঁর গ্রামে ফিরে যাওয়ার আর কোন সম্ভাবনা ছিল না। তিনি নিম্নলিখিত গাথাটি লিখেছিলেন, “পর্বত, নদী, বিদেশ পার হয়ে; একই সূর্য, চাঁদ ও আকাশের নীচেbসমস্ত স্থানে। আমি বুদ্ধের সমস্ত সন্তানের উপর এই আশা রাখছি যে তারা একত্রে সাদৃশ্য তৈরী করবে। জীবনের প্রবাহ একটি নদীর মত যা কখনও ফিরে আসে না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত একদিন ফিরেই আসতে হবে, যেহেতু একটি জীবনের শেষ অপর একটি জীবনের শুরুকে চিহ্নিত করে।”কোন মানুষেই দ্বীপ নয়; বাঁচবার জন্য আমাদের বিভিন্ন মানুষ যেমন পণ্ডিত, কৃষক, শিল্পী, বণিক এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক বস্তু যেমন সূর্য, চাঁদ, তারা, নক্ষত্র, পৃথিবী, জল, আগুন ও বাতাস ইত্যাদির সাহায্য প্রয়োজন। প্রকৃতির সমস্ত কিছু যেমন সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, পর্বত, নদী এবং পৃথিবী সকলেই আমাদের জীবনের অংশ। অতএব আমরা সেই পৃথিবীকে মর্যাদা দেব যাকে আমাদের বাড়ি বলি এবং এই গ্রহের সমস্ত প্রাণীকে সাহায্য করব হাতে করে আমরা সেই সমস্ত উপকার ও সুবিধার দয়ার প্রতিদান দিতে পারি যা আমরা পূর্বে লাভ করেছি। আমরা প্রত্যেকেই এই পৃথিবীতে এসেছি শূন্য হাতে এবং পৃথিবী ত্যাগ করেও যাব শূন্য হাতে। আমি আপনাকে একথা বলতে পারব না যে আমি এই পৃথিবীতে কী নিয়ে এসেছি। কিন্তু আমি আমার সঙ্গে আনন্দ নিয়ে যাব। আমি কখনই ভুলে যাব না সেই সমস্ত ভক্তদের যাঁরা খুশি হয়ে আমাকে সাহায্য করেছেন; এবং সেই সমস্ত সহ অনুশীলনকারীদেরও মনে রাখব যাঁরা আমাকে আশীর্বাদ করেছেন।

আমি কখনই ভুলব না সেই সমস্ত পরিস্থিতিগুলিকে যেগুলি আমাকে সাহায্য করেছে কারণ এগুলি আমার হৃদয়ে স্থায়ী আসন লাভ করেছে। বুদ্ধের আশীর্বাদ এবং এই জীবনে পাওয়া বন্ধুত্বগুলি সত্যিই অসাধারণ; আমি অনুভব করি এই পৃথিবীতে আমার জীবন অত্যন্ত মূল্যবানভাবে অতিবাহিত হয়েছে। আমি শপথ করছি যে আমি জীবনের পর জীবন বুদ্ধকে উৎসর্গ করব এবং চার প্রকার কৃতজ্ঞতার প্রতিদান দিয়ে সমস্ত প্রাণীর সেবা করব। এই জীবনের পরিসমাপ্তি সম্পর্কে বলতে পারি যে কোন নিদর্শন থাকবে না এবং সমস্ত অপ্রয়োজনীয় ও জাঁকজমকপূর্ণ আনুষ্ঠানিকতা বাতিল হয়ে যাবে। শুধুমাত্র কয়েকটি সরল কথা লেখা বা যাঁরা আমার অভাব অনুভব করছেন পার্থিব জীবনের শব্দ থেকে বেছে নেওয়া বৌদ্ধ সঙ্গীত গাইতে পারেন। তবে আমার মতে আমাকে মনে রাখার সবচেয়ে ভাল উপায় যেটি আমার আন্তরিক ইচ্ছাও বটে সরল মনে মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্মের শিক্ষাকে ধারণ করে রাখা এবং সর্বদাই সেগুলিকে অনুশীলন করা। ভক্তদের শান্তি ও সুখ ছাড়াও শেষে আমি যাদের জন্য চিন্তিত তারা হলেন মঠের সকলে—বিশেষত বৌদ্ধ কলেজের ছাত্র ও শিক্ষক সকলে যেহেতু তাঁরা হলেন ফো-কুয়াং শানের ভবিষ্যৎ বোধি বীজ, তাই তাঁদের অবশ্যই শক্তিশালী ও ইচ্ছুক হতে হবে যাতে করে মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্ম ততদিন স্থায়ী হতে পারে যতদিন পৃথিবী স্থায়ী হবে এবং সর্বদা আমাদের একটি অংশ হতে পারে। ধর্মের পতাকা যেন উপড়ে না যায়। জ্ঞানের আলোক যেন কখনও নিভে না যায়। আপনারা সকলে মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্মের পথে অগ্রসর হতে থাকুন যাতে করে আপনারা পরস্পরকে উৎসাহিত করতে পারেন এবং বৌদ্ধধর্মের স্বার্থে ভালভাবে নিজের যত্ন নিতে পারেন।

অনুবাদ: সুমনপাল ভিক্ষু

বৌদ্ধধর্ম এবং মানবাধিকার

ভূমিকা


"রূপস্য হস্তী ব্যবাবৎ বকাস্য শোকস্য সোনির্দিধবং রর্তীবল।
মাশ: স্বাতীনাং রিপুরিন্দ্রিয়ানাােসা জরা পরের উন্ম:।।
পীতং হালেনালি পড়া: শিশুরে কালেম ভুরা: পরিবৃন্তপূর্ব্যাস্থা! ক্রপেন ভত্বা  চ সুবা বহুমান ক্রেতেনের জরাপুলেত: "" -ব্যাচেরিতা, ৩/৫০-৫০।,,,,,

যে সত্যের ক্ষেত্রে রাপাবর্তী এক নবজাত শিশুর প্রাণ রক্ষাতে নিজের দুইটি স্তনকে ছদন করেছিলেন, সেই সত্য,  না তো রাজ্যের প্রশ্নে, না তো ভোগের প্রশ্নে, না তো ইন্দ্রত্ব লাভের প্রশ্নে, না তো চক্রবর্তী- প্রাপ্তির প্রশ্নে আর না তো অন্য কোন ইচ্ছা দ্বারা প্রেরিত হয়ে সম্পূর্ণ হয়েছিল, এই সত্যের পশ্চাতে এক উদার নৈতিক ভাবনা ছিল অপ্রান্ত সম্যক সম্বোধি কে সম্বোধি লাভ করাবো, যিনি ইন্দ্রির লোলুপ , তাঁকে ইন্দ্রিয় - নিগ্রহ এবং আন্তাদমনের শিক্ষা প্রদান করবো, যিনি অমুক্ত, তাঁকে মুক্ত করবো, যিনি নিঃসাহার, তাঁকে আশ্রয় দান করবো এবং যিনি দুঃখী তাঁকে দুঃখ হতে নিবৃত্তি দান করবো।

এই সত্য দ্বারা উৎসাহিত হয়ে এবং দুঃখী মানুষের আর্তনাদকে সহ্য না করার কারনে বোধিসত্ত্ব মহাসত্ত্ব সিদ্ধার্থ ,  সম্যক সম্বুদ্ধ  হয়ে বহু জনের হিতার্থে, সুখার্থে সে দর্শন তত্ত্বের প্রচার করেছিলেন তা ভারত- বর্ষে গণ্ডি অতিক্রম করে বিশ্ব ধর্মে পরিণত হয়েছিল এবং এই বিশ্ব ধর্ম কোনোরূপ বলপ্রয়োগ তথা সাধারণ জনগণের উপর হিংসাশ্রয়ী ভাবে প্রদান করা হয়নি, উপরক্ত সম্পূর্ণভাবে অহিংসার মাধ্যমে বিস্তৃত হয়েছিল এই কারণেই গৌতম বুদ্ধকে পৃথিবীর প্রথম মানবতারবাদের রূপরকার তথা বৌদ্ধধর্মকে মানতাবাদী ধর্ম বলা হয়। 

তবে এখানে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে গৌতম বুদ্ধ রাজতন্ত্রের বিলোপ সাধন না করে কিভাবে মানবতাবাদের জনক হয়ে উঠেছিলেন এবং বৌদ্ধধর্ম কিভাবে মানবতাবাদী ধর্ম? এর উত্তরে বলা যায় যে গৌতম বুদ্ধ কোন অর্থের রাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন না ফলে তাঁর মতাদর্শের প্রভাবে মগধ বা অন্যান্য জনপদের শাসককুল ও জনগণ বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণের মাধ্যমে রাজতন্ত্রকে গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর মধ্যে একত্রীভূত করেছিলেন। এক্ষেত্রে মহামতির অশোকের লাজুলামন্দাগিরি লঘু গিরিলেখ এক উৎকৃষ্ট, উদাহরণ রুপের পণ্য হতে পারে, যেমন -

"দেবপ্রিয় এরকম আজ্ঞা করেছেন- মাতাপিতার সেবা করবে এবং প্রাণীদের জীবনের গুরুত্ব বিশেষভাবে মনে করবে, সত্য কথা বলবে। এই রকম গুণযুক্ত ধর্মই প্রচলিত হওয়া উচিত। আর এটা কার্যে পরিনত হওয়া

অপর অর্থে বলা যায় যে মহামানব গৌতম বুদ্ধ তাঁর দর্শন তথ্য  প্রচারার্থে যে ভিক্ষু এবং ভিক্ষুণী সংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা কোন অর্থেই লক্ষণ শীল বা বর্ণবাদের আঙ্গিকে প্রতিষ্ঠিত হয়নি উপরন্তু সংঘ ছিল গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা পূর্ণ এবং বর্ণবাদের পরিবর্তে মানবাধিকারের আঙ্গিকে প্রতিষ্ঠিত ফলে অলন্তি বিলম্বের সংঘ হয়ে উঠেছিল বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা জাত-পাত বিরোধী গণতান্ত্রিক পরিকাঠাখো যুক্ত একটি সংগঠন। বৌদি ধর্ম নারী মুক্তি এবং নারী শিক্ষার প্রচার-প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করার ফলে বিভিন্ন স্তরের নারী বৌদ্ধ সংঘে প্রবেশ করেছিল এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার কার্যে নিজেদের সমর্পণ করেছিল। বৌদ্ধ ধর্ম তথা মহামানব বুদ্ধ কোন অর্থে সমাজের প্রচলিত অন্ধ বিশ্বাস কে গ্রহণ করে নি, ফলে সমাজের পরিকাঠামোর উন্নতি বিধান ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনের প্রশ্নে বৌদ্ধ ধর্ম হয়ে উঠেছিল মানবতাবাদী ধর্ম যা আজও অম্লান। সর্বোপরি বৌদ্ধ ধর্ম  আন্তর্জাতিক ধর্ম হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে তার অহিংসাবাদী পরিকাঠামো তথা মানবতাবাদী কার্যকলাপ কে কোন অর্থে অস্বীকার করা সমভব নয়। 

“নিরাধরাং জগতক্র তীব্রতাত্যা ভ্রমত্যলম ।  তদায়ত্তস্ত জীবোহরং শ্রান্তিভূমিং ন গচ্ছতি ।।

অনুরুপ ভাবে-

"জীবলোকান বা পঞ্চৈবম্ পশ্যাদ্দিব্য  চক্ষুষা  ন পেবে তেসু বৈ সারং  রম্ভাপ্তম্ভোদরেন্বিব।।
- বুদ্ধচরিতম,পূঃ ২০২। 
সৃষ্টি প্রকাশনীর কর্ণধারকে অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা জানাই। অলং ইতি বিত্থারেন।

সুমনপাল ভিক্ষু ।

সংস্কৃত বৌদ্ধ সাহিত্য প্রাচীন ভারত

 ভূমিকা




ধর্মে স্থিতোহসি বিমলে শুভবুদ্ধিসত্ত্ব।
সর্বজ্ঞতামভিগমন হৃদয়ের সাধো,
মহ্যংশির: সৃজ মহাকরুণাগ্রচেতা।
মহ্যৎ দদশ্ব মম তোণকরো তবাদ্য ॥
-দিব্যাবদান, ২০০/২৯-৩২।

থেরবাদী বৌদ্ধ সাহিত্যে (পালি সাহিত্য) ভগবান বুদ্ধের  দার্শনিক সিদ্ধান্ত সম্মুখ সমুহ কে প্রবলভাবে গুরুত্ব প্রদান করা হলেও তথাকথিত ঈশ্বরবাদ বা দেবত্ববাদকে তেমন ভাবে গুরুত্ব প্রদান করা হয়নি। অপরদিকে মহাসাংঘিক বা উত্তরকালে মহাযান তথা অন্যান্য সংঘকৃত নিকায় সমৃহ তে ভগবান বুদ্ধের  বিভিন্ন রূপের চিত্রণ অবদান- কথা'র মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে। অবদানশতক এবং দিব্যাবাদান সংস্কৃত বৌদ্ধ সাহিত্যের এক উজ্জ্বল উদ্ধার । অন্যান্য সংবাকৃত বৌদ্ধ সাহিত্য সমূহের মধ্যে ললিত বিস্তর, মহাবস্তু , সদ্ধর্মপুণ্ডরীক, সুখাবতীব্যুহ, বুদ্ধচরিত , সৌন্দরানন্দ, বজ্রসূচী এবং বোধিসত্ত্বাবদান কল্পলতা, ইত্যাদির ভূমিকা কোন সংঘেই করা যায়। এই সকল গ্রন্হ সমূহের বিষয় ধর্ম, বুদ্ধ এবং সংঘ তথা বোধিসত্ত্বের জীবন পর্যন্ত সীমিত নয় অধিকিন্তু  এর বিষয় প্রাচীন ভারতীয় সমাজ, জনপদ (অধুনা রাষ্ট্র),অর্থ, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, সাহিত্য, কলা-স্থাপত্য, চিকিৎসা ব্যবস্থা-বিজ্ঞান তথা  ভূগোল 'এর বিভিন্ন অঙ্গের প্রতি  অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাবে আলোকপাত করেছে।

কবি অশ্বঘোষ এবং তাঁর গ্রন্হ  বুদ্ধ চরিত ' প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসে এক প্রসিদ্ব গ্রন্হ । বুদ্ধ চরিত' গ্রন্হ বুদ্ধের  জীবনে এবং তাঁর বলার ধর্মীয় সিদ্বান্ত অত্যন্ত কাব্যিক শৈলীর মাধ্যমে প্রতিপাদিত হয়েছে। সংঘবতার সূত্র যদিও দার্শনিক গ্রন্হ তথাপি এই গ্রন্হ ঐতিহাসিক এবং সাংকেতিক সামগ্রী প্রচুর মাত্রায় বিদ্যমান রয়েছে। এইতাবে আর্যঞ্জুশ্রী মূলকল্প দর্শন, ভূগোল, ইতিহাস, জ্যোতিষ, গনিত, তন্ত্র ইত্যাদির এক মিশ্রিত গ্রন্হ যা অত্যন্ত দূরুহ এবং সাংকেতিকও বটে।

মহাবস্তুতে পৃথিবী, এর চাতুদ্বীর্প, মহাকোশ, জনপদ এবং নগর সমূহ ( নগর জনপদ) এবং গণরাজ্য (লিচ্ছ,বি, কৌলিয় এবং শাক্য) তথা গ্রাম, নদী ও পর্বতের উল্লেখ ও পাওয়া যায় । সব থেকে গুরুত্ব পূর্ণ বিষয় এই যে এই মহাগ্রন্থে মহাজনপদেরে বিভিন্ন তালিকা (১৬, ১৪ ও ৭' এর) প্রাপ্ত হয়। ৭ জনপদ এর তালিকা'তে মহাজনপদের, সাথে সাথে  তাদের রাজধানী সমূহ ও উল্লেখিত হয়েছে। ভারতবর্ষকে এই গ্রন্থে শকটমুখ তথা সংকুচিত বলা হয়েছে। ললিত বিস্তর অনুসারে এই সর্বাধার মহাপৃথিবী (ইয়াং সহী সর্বব্যতাৎপ্রতিষ্ঠা) যা ৪  মহাসাগর দ্বারা বেষ্টিত। এতে ষোড়শ জনপদ, উত্তরাপথ, দক্ষিণাপথ এবং প্রত্যন্ত জনপদের  উল্লেখ  পাওয়া যায়। শার্দূলকর্ণাবদান হতে জনপদের এবং গনের গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায়। দিব্যাবদান গ্রন্হ'র ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম । এই গ্রন্হ বিম্বিসার হতে ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজা পুণ্যমিত্র শুঙ্গ পযন্ত মগদের ইতিহাস দৃষ্ট হয়। করুনা পুণ্ডরীক এ যবন ( গ্রীক ) রাজা মিলিন্দ ( মিরান্ডার)'র উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া পুরাণত  রাজধর্মের কথা ও বর্ণিত হয়েছে। যেমন-

"যে চ ক্ষত্রাণি রক্ষন্ত পালয়ন্তি সজা প্রজাঃ।
সত্বরক্ষাব্রতাচারাঃ ক্ষত্রিয়াস্তে নৃপা নরাঃ 
 যে রঞ্জয়ন্তি ধর্মার্থে লোকাগ্নীতি প্রয়োজকঃ ল।

রাজানস্তে মহাবীরাঃ সর্বধম্মাভিপাবালকাঃ।।"

বজ্রসূচী এবং দিব্যাবদান  (শার্দূলকর্ণাবদান) 'এ চতুবর্ণ ব্যবস্থা কঠোর সমালোচনা করার সঙ্গে সঙ্গে একই বর্ণ এবং জাতির সমানতার সিদ্ধান্তকে প্রতিপাদন করা হয়েছে। দর্শন ক্ষেত্রে শূন্যবাানে এবং প্রজ্ঞা (বিজ্ঞান) তথা যোগ আচার ( সৌন্দরেন্দ কাব্য ১৪/১৬) মতবাদেরে প্রভাব প্রচলিত ছিল। মহাবস্তু তে' কপিলাবস্তু এবং রাজগৃহের সুদীর্ঘ তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। অশোকাবাদাম' এ বৌদ্ধ ধর্মের বৈরী রুপের ব্রাহ্মণ ধর্মের উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া বেদোক্ত বিধি, যঞ্জ এবং ব্রাহ্মণ দেবী দেবতার ও বিবরণ দেখা হয়। সাধারণ জনগণ' এর বিশ্বাস বৌদ্ধ ধর্মের পাশাপাশি মিথ্যা দৃষ্টি মূলক ধর্ম- নরক, স্বর্গ, তথা নাথ, যক্ষ ইত্যাদির প্রতি ছিল। বোধিসত্ত্ব বধান কল্পলতা'তে এর দীর্ঘ বিবরণ পাওয়া যায়। দিব্যাবদানে গায়ত্রী মন্ত্রের নিন্দা এবং পুষ্যমিত্র শুঙ্গ'কে বৌদ্ধ বিরোধী বলা হয়েছে।

"নাহং নরেন্দ্রো ন  নরেন্দ্রপুত্রঃ
পাদোপজীবী তব দেব  ভূত্যঃ
অথাপ্রিয়স্যেব নিবেদনার্থ
মিহাগতো হ হং তব  পাদমূলম"।
-দিব্যাবদান, ৪৩০/১৬
সৃষ্টি প্রকাশনীর কর্ণধারকে অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা জানাই। অলং ইতি বিত্থারেন।

সুমনপাল ভিক্ষু।

Preface

 Preface


The History of the Baruas: In the ancient literature of Bengal we come across a priest class known as the Raul. This class is still present in the Chakma Buddhist class of Assam. On the other hand Barua is the title of the Brahmins of Assam. Again there are traces of Kayastha Baruas and Baidya Baruas also. We also find mention of the Barua tribes in the Rajmala of Tripura. There are different opinions about the origin of the Baruas. Some opine that the Baruas originated from the Arakan tribe but this view seems to be erroneous. According to Beni Madhab Barua the Kshatriya Buddhists of Magadha and Vaishali migrated from Briji to Chattagram and the word Barua originated from the word Briji. As a result of the intermarriage between Baruas and the Arakani Buddhists they mingled with each other. The Buddhist monks who in order to save their life and honour fled from Magadha could not bring any religious texts with them.That is why they did not know the basic tenets of their religion. They conducted the rituals with the help of their memories. During the same time the Buddhists began to worship gods and goddesses like Durga and Shitala. In this way they lost their identity. Gradually they left the complex philosophical doctrine associated with religion and started to practice spell and incarnation. As a result of the destruction of the Buddhist monsteries most of the Buddhist religious teacher either fled or were killed. As a result of this the leaderless Buddhists had to accept the dominance of the Brahmins. Again, after Islamic invasion  Buddha images were dislodged from various monasteries of East Bengal to make way for the practice of Islam. After the establishment of British rule in India some Buddhists converted themselves to Christianity in order to gain economic advantages The rest of the Buddhists somehow managed to survive. Again Kumaril Bhatta of Guwahati with the help of his associates reconverted some Buddhists to Hinduism. Most probably they are the  forefathers of the Baruas of Assam. 

Religion and Society:

Even before the establishment of the Pala  dynasty two eminent Chinese travellers Fa Hien and Hiuen Tsang came to Bengal and witnessed the condition of Buddhism there. 
Among the dynasties that patronized Buddhism we may mention the names of the Khargas (7th Century A.D.  to 8th Century A.D.), the Palas (8th century A.D. to 12th century A.D), the Chandras(10th century A.D..to 12th Century A.D), the Devarajas and the tiny rulers of Pattikera (10th to 11th Century A.D ). 

Brahmanism originated in Bengal during the 11th and 12th centuries and during the last half of the 12 th century.  Muslim rule was established in Bengal after the invasion of the Turkish General Baktiar Khalji. As of result of this Buddhism was destroyed in Bengal though it somehow managed to survive at Chittagong which is situated in a remote corner of Bengal. 
Subsequently some young monks of Chittagong went to Buddhist countries like Sri Lanka and Burma and after learning about this religion they spread that ancient religion through campaigning and writings. With the help of the path demonstrated by them Buddhism in Bengal has attained its rejuvenated form. In this regard the name of Venerable Saramaya Mahathera may be particularly mentioned. 

People from different other communities increased the number of Baruas by adopting Buddhism. The Barua society is not divided by caste and creed. But there are difference between the members of the Barua community. Nowadays the Baruas of Chittagong are educated and financially well off. Though they are not frequently seen in the arena of politics they are engaged in professions like dctor, officer and professors. They have also successfully worked in the police force and armed forces. But they are yet to completely restore the lost glory of their forefathers who migrated from Briji.

What are the Three Refuges in Buddhism?

Ans: The three refuges in Buddhism are Buddha, Dhamma and Sangha. 

What are the attributes of the Buddha?

Buddha is an exalted one because after having vanquished all craving, aversion and delusion he has completely liberated. He has conquered all his enemies after annihilating them in the fom of mental impurities himself.  He has attained ultimate enlightenment. His wisdom and conduct are perfect. He has attained ultimate truth (sugato) because his body speech and mind are pure. He has known the world through personal experience (loka  vidhu). He is the best charioteer of tameable man (anuttaro purisa damma sarathi). He is the teacher of gods and man. We ourselves will become Buddha if we can attain these qualites.

What are the attributes of the Dhamma taught by the Buddha?

Dhamma has the following attributes.
It is well explained (svakkhato)
It can be experienced in this life (sanditthiko), It gives immediate results ( akaliko), It invites people to come and see  (ehi- passiko), Every successive step takes one towards the final goal of full liberation ( opanayiko), It is to be experienced by each person average intelligence, for oneself ( paccattam veditabbo vinnuhiti).

What are the attributes of the Sangha?

Like Buddha and Dhamma, Sangha is characterized by universal qualities such as being worthy of invitation (ahuneyyo), worthy of hospitality ( pahuneyyo), worthy of offerings ( dakkhineyo), worthy to be saluted with folded hands ( anjali- karaniyo), field of merit per excellence ( anuttarm punna-- khettam), tranquil ( danto, santo), free from passion, spotless ( virajo, vimalo), composed, not diffused ( nippapanco). 

What is Pancashila.

Ans: Pancashila is the basic principles to purify one's mind through the five precepts for training. This comprises of 1. Refraining from killing anything that breathes
2. Refraining from taking anything that is not given,
3. Refraining from sexual misconduct
4 Refraining from speaking false
5 Refraining from intoxication. 

What is noble eight fold path?

Ans: The noble eight fold path is the collection of eight noble practices that lead to the cessation of suffering. They are 1. Right View 2. Right Thought 3. Right Speech 4. Right Action 5. Right Livelihood 6. Right Effort 7. Right Mindfulness 8.  Right Concentration
What are the four noble truths?
The four noble truths are the truth of suffering, the truth of causes of suffering the truth of cessation of suffering and the truth of ways to cessation of suffering. 

What is the ultimate aim in Buddhism?

Ans: Nirvana is the ultimate aim in Buddhism.  
What is Nirvana?

Ans: Nirvana is the ultimate extinction of desire, hatred, ignorance and ultimately of suffering and death.

In the end we would like to thank the main authors, editor and publisher for their effort to bring out this present volume for the information of the reader. This book will serve the purpose of both the scholars and the general public alike.

Sumanapal Bhikkhu

কথামুখ

 কথামুখ


বড়ুয়া জাতির ইতিবৃত্ত, বাংলার প্রাচীন সাহিত্যে রাউল নামে একটি পুরোহিত সম্প্রদায়ের কথা জানা যায়। চাকমা বৌদ্ধ সমাজে এই সম্প্রদায় এখনো বত´মান। অপরদিকে বড়ুয়া হল আসাম প্রদেশের ব্রাহ্মণদের উপাধি। আবার সেখানে বৈদ্য বড়ুয়া ও কায়স্থ বড়ুয়াদেরও সন্ধান পাওয়া যায়। ত্রিপুরার রাজমালাতেও বড়ুয়া জাতির উল্লেখ 
মেলে। বড়ুয়া জাতির উৎপত্তি সম্পকে´ বিভিন্ন মত আছে। কেউ কেউ মনে করেন বড়ুয়ারা আরাকান জাতি থেকে উৎপন্ন, তবে এই ধারণা ভ্রান্ত বলে মনে হয়। ড: বেণীমাধব বড়ুয়ার মতে‌ বৈশালী ও মগধের ক্ষত্রিয় বৌদ্ধগণ বৃজি থেকে চট্টগ্রামে আগমন করেছিলেন এবং বজ্জি শব্দ থেকেই বড়ুয়া শব্দের উদ্ভব। কয় বড়ুয়া ও আরাকানী বৌদ্ধদের বিবাহের ফলে তারা একে অপরের সঙ্গে মিশে যায়। যে সমস্ত বৌদ্ধ ভিক্ষুরা প্রাণ ও মান রক্ষা জন্য মগধ ত্যাগ করে এসেছিলেন তাঁরা সঙ্গে করে কোন ধম´গ্রন্থ আনতে পারেননি। তাই তাঁরা ধমে´ সার কথা জানতেন না‌ । তাঁদের স্মৃতির উপর ভিত্তি করেই তাঁরা ধমী´য় কাযা´দি চালাতেন এবং ধমে´র সারকথা তাঁদের জানা ছিল না। আবার সেই একই সময়ে বড়ুয়ারা দুগা´, লক্ষ্মী, শীতলা ইত্যাদি দেবদেবীদের পূজা করতে শুরু করলেন। .এইভাবে বৌদ্ধরা ক্রমশ তাদের স্বাতণ্ত্র্য হারিয়ে ফেললেন। ক্রমশ দশ´নের জটিল তত্ত্ব পরিত্যাগ করে তারা তণ্ত্রমণ্ত্রের চচা´ করতে শুরু করলেন। বিভিন্ন্ বৌদ্ধবিহার ধ্বংসের ফলে‌ অধিকাংশ বৌদ্ধ ধম´গুরুরা হয় আত্মোপন করলেন নয়ত নিহত হলেন এবং এর ফলে কাণ্ডারিহীন বৌদ্ধরা ব্রাহ্মণদের আধিপত্য স্বীকার করতে বাধ্য‌ হল। এছাড়াও স্থানীয় বৌদ্ধদের ইসলাম ধমে´ দীক্ষিত করার পর পূব´বঙ্গের বিভিন্ন স্থানের বিহারগুলিতে বুদ্ধমূতি´ অপসারিত করে ইসলাম ধমে´র উপাসনা শুরু হয়। এরপর ভারতবষে´ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে কিছু বৌদ্ধ আথি´ক সুযোগ সুবিধা লাভের আশায় খ্রীষ্টধম´গ্রহণ করে। অবশিষ্ট বৌদ্ধরা কোনক্রমে বৌদ্ধ হিসেবে তাদের অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখলেন। রাউলিরাই তাদের ধম´জীবনের তত্ত্বাবধান করতেন। 

এছাড়া কুমারিল ভট্ট গৌহাটিতে তাঁর অনুচরদের মাধ্যমে বেশ কিছু বৌদ্ধকে পুনরায় হিন্দুধমে´ দীক্ষিত করেন। সম্ভবত তারাই আসামী বড়ুয়া।  ধম´ ও সমাজ, সংস্কৃত ভাষায় রচিত বিনয়পিটক থেকে প্রমাণ
পাওয়া‌ যায় যে মৌয´ শাসনের পূবে´ 
পূব´বাংলায় বৌদ্ধধমে´র অস্তিত্ব ছিল। দুজন প্রখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক ফা হিয়েন ও হিউয়েন সাং বাংলায় এসে বৌদ্ধধমে´র 
অবস্থা প্রত্যক্ষ করেন। পরবতী´কালে যে সমস্ত রাজবংশ বৌদ্ধধমে´র পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন  তাঁরা হলেন খাড়িয়া রাজন্যবগ´( খ্রীষ্টীয় সপ্তম থেকে অষ্টম শতক), পান রাজন্যবগ´ (খ্রীষ্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতক), চন্দ্রবংশীয় রাজন্যবগ´ ( দশম থেকে একাদশ খ্রীষ্টাব্দ), দেবরাজগণ ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পট্টিকেরা শাসকগণ দশম থেকে একাদশ শতক)। খ্রীষ্টীয়
একাদশ থেকে দ্বাদশ শতকে বাংলায় ব্রাহ্মণ্যধমে´র অভ্যূদয় ঘটে এবং দ্বাদশ শতকের শেষভাগে তুকী´সেনাপতি বক্তিয়ার খলজির আক্রমণে বাংলায় মুসলমান অধিকার কায়েম‌ হয় এবং এর‌ ফলস্বরূপ
বাংলাদেশে বৌদ্ধধমে´র পতন ঘটে যদিও বাংলার এক কোণ চট্টগ্রামে এই ধম´ টিমটিম করে জ্বলতে থাকে। পরবতী´কালে বাংলার কিছু তরুণ ভিক্ষু ব্রহ্মদেশ, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি বৌদ্ধপ্রধান দেশে গিয়ে  এই ধম´ সম্বন্ধে
শিক্ষালাভ করে সেই প্রাচীন ধম´কে প্রচার ও লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেন। তাঁদের প্রদশি´ত পথেই বাংলায় বৌদ্ধধম´ তার পুনরুজ্জীবিত রূপটি লাভ করেছে। এই বিষয়ে আরাকানের সংঘরাজ ভদন্ত ভদন্ত সারমেধ মহাথেরর নাম বিশেষভবে উল্লেখযোগ্য। 

     অন্যান্য সম্প্রদায় থেকেও বিভিন্ন মানুষ বৌদ্ধধম´ গ্রহণ করে বড়ুয়াদের সংখ্যাবৃদ্ধি করেছিল। বড়ুয়া সমাজে জাতিভেদ ও কৌলিন্যপ্রথা নেই। তবে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে
স্বাতণ্ত্র্য রয়েছে। বত´মানে চট্টগ্রামের বড়ুয়ারা শিক্ষিত এবং আথি´ক দিক থেকে স্বচ্ছল। রাজনীতির আঙিনায় বড়ুয়াদের পদচারণা‌ অপেক্ষাকৃত কম হলেও অনেকেই ইঞ্জিনিয়র ডাক্তার, অফিসার, অধ্যাপক ইত্যাদি পেশায় নিয়ুক্ত আছেন। সৈন্যবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীতেও‌ তাঁরা সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছেন। তবে তাঁদের বৃজি থেকে চলে আসা
পূব´পুরুষদের গৌরব তাঁরা এখনো পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করতে পারেননি।

বৌদ্ধধম´ শিক্ষা: 
ত্রিরত্ন কাকে বলে?
বুদ্ধ রত্ন ধম´ রত্ন আর সংঘ রত্নের সমষ্টিকে ত্রিরত্ন বলে।  
বুদ্ধের নয়গুণ‌ কি কি?
সম্যকসম্বুদ্ধ, বিদ্যাচরণসম্পন্ন, সুগত, লোকবিদ,অতুলনীয়, শ্রেষ্ঠ সারথি, দেবতা ও মানুষের
শাস্তা বা শিক্ষক,এবং ভগবান। 
ধমে´র ছয় গুণ কি কি? 
১. এই ধম´ সুব্যাখাত বা সুপ্রকাশিত
২‍. এই ধম´ স্বয়ং দ্রষ্টব্য বা নিজে দেখার যোগ্য
৩‍  এই ধম´ কালাকালবিহীন। যখনই এই ধম´ পালন করা হয় তখনই
৪. এই ধম´ এসে দেখা বা নিজের বিচারবুদ্ধি দিয়ে বিবেচনার যোগ্য
৫ এই ধম´ নিবা´ণ প্রাপক বা নিবা´ণে উপনীতকরে
৬. এই ধম´ বিদ্বানগণ কতৃ´ক প্রত্যক্ষও জ্ঞাতব্য
সংঘের নয়টি গুণ কি কি?
১. বুদ্ধের‌ শ্রাবক সংঘ সুপথে প্রতিপন্ন
২. ঋজু আয´ অষ্টাঙ্গিক মাগে´ প্রতিপন্ন
৩. ন্যায়‌বা নিবা´ণ পথ প্রতিপন্ন
৪. যথাথ´
৫. উত্তম ও উপযুক্ত পথ প্রতিপন্ন
৬. ভগবানের শ্রাবক সংঘ যুগ্ম হিসাবে চারি যুগ্ম‌ এবং
পুদ্গল হিসেবে আট আয´ পুদ্গলই চারি প্রত্যয় দান-
আহুতি লাভের যোগ্য
৭‍ . দূর দেশ থেকে আগত অতি আদরের কুটুম্বের মত খাদ্য ভোজ্য‌ দ্বারা সেবার যোগ্য
৮. অঞ্জলিপুটে নতশিরে বন্দনা করবার যোগ্য।.
৯‍. সমস্ত দেব নরের সব´শ্রেষ্ঠ পূণ্যক্ষেত্র।
ত্রিরত্ন বন্দনা: 
১. যিনি শ্রেষ্ঠ‌ বোধিমূলে উপবিষ্ট হয়ে মহাপরাক্রমশীল 
মারকে পরাজিত করে সম্বোধি লাভ করেছেন সেই অনন্তজ্ঞানী বুদ্ধকে বন্দনা করছি। 
২‍‌ অষ্টাঙ্গবিশিষ্ট,আয´পথ, জনগণের মোক্ষপুরী প্রবেশের সোজা রাস্তাস্বরূপ,শান্তিকর, শ্রেষ্ঠ যে ধম´ নিবা´ণে নিয়ে যায় সেই ধম´কে বন্দনা করছি। 
৩. যে বিশুদ্ধ সংঘ দান গ্রহণের উত্তম পাত্র, শান্তেন্দ্রিয়
সব´পাপমুক্ত, বহুগুণে সমন্বিত ও তৃষ্ণাক্ষয়কারী সেই সংঘকে বন্দনা‌ করছি।
শীল 
পঞ্চশীল কাকে বলে ?
ভগবান তথাগতের প্রকাশিত গৃহীদিগের নিত্যপ্রতিপাল্য পঞ্চসারনীতিকে পঞ্চশীল বলা হয়।
পঞ্চশীল প্রাথ´না‌‌ কিভাবে করতে হয়?
বুদ্ধ বন্দনা করে ভিক্ষুর সামনে গিয়ে তাঁকে বন্দনা‌ করে পঞ্চশীল প্রাথ´না করতে হয়। 
                            পঞ্চশীল
১( আমি) প্রাণীহত্যা থেকে বিরত‌ থাকব এই শিক্ষাপদ লাভ করিতেছি। 
২. অদত্ত দ্রব্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকব এই শিক্ষাপদ লাভ করছি।.
৩. অবৈধ কামাাচার থেকে বিরত থাকব এই শিক্ষাপদ
লাভ করছি।
৪‍ মিথ্যাভাষণ থেকে বিরত‌ থাকব এই শিক্ষাপদ লাভ.করছি।
৫‍ সুরামেরেয়‌ মাদকদ্রব্য সেবন থেকে বিরত থাকব 
এই শিক্ষাপদ লাভ করছি।
পঞ্চশীল ও অষ্টশীলের পাথ´ক্য:
পঞ্চশীলের তৃতীয় শীল-- অবৈধ কামাচার থেকে বিরত থাকব। অষ্টশীলের তৃতীয় শীল ব্রহ্মচয´ পালন করব এই শিক্ষাপদ লাভ করছি।
অষ্টশীলের অতিরিক্ত ৩ টি শীল নিম্নরূপ:
৬. বিকালে ভোজন থেকে বিরত থাকব.
৭. নৃত্যগীত, বাদ্যযণ্ত্র ,তামাশাদশ´ন ইত্যাদি থেকে বিরতি
৮. মালাগন্ধ, বিলেপন, ধারণ,মণ্ডন,বিভূষণাদি ইত্যাদি
থেকে বিরতি
দশশীলের অতিরক্ত দুটি শীল নিম্নরূপ:
৯‍. উচ্চাসন,মহাশয়ন থেকে বিরতি
১০. স্বণ´ রৌপাদি গ্রহণ থেকে বিরতি
বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বের পাথ´ক্য:
বুদ্ধ হলেন সব´জ্ঞ, সব´দশী´, জন্ম মৃত্যুর উদ্ঘাটক, এবং সব´তৃষ্ণা ক্ষয়কারী অহ´ৎ। 
বোধিসত্ত্ব হলেন ভবিষ্যতে বুদ্ধ হবার একান্ত বাসনায় জন্ম জন্মান্তরের সাধনা ও সুষ্ঠু কম´ নিয়ণ্ত্রণের উৎকৃষ্ট পন্থা অবলম্বনকারী।
কম´বাদ কাকে বলে?
কম´ই  হল বৌদ্ধধমে´র মূল ভিত্তি। যে যেমন কম´ করবে তাকে তেমন ফল ভোগ করতে হবে। এটিই হল কম´বাদ।
চতুরায´সত্য:
চারটি‌ আয´সত্য‌ হল (১) দু:খ আয´সত্য (২) দু:খ সমুদয় আয´সত্য (৩) দু:খ নিরোধ আয´সত্য (৪) দু:খ
 নিরোধের উপায় আয´সত্য।
আয´ অষ্টাঙ্গিক মাগ´ বলতে কি বোঝায়?
আয´ অষ্টাঙ্গিক মাগ´ হল দু:খ মুক্তির উপায়। এগুলির 
মধ্যে‌ রয়েছে সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক আজীব, সম্যক বাক্য, সম্যক কম্মা´ন্ত, সম্যক ব্যায়াম, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি।.
নিবা´ণ কাকে বলে?
বৌদ্ধ ধমে´র চরম লক্ষ্য নিবা´ণ। নিবা´ণ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অথ´ হল নিবা´পিত হওয়া। যে ধম´ প্রত্যক্ষ করলে মানুষের স্বকীয় তৃষ্ণা বন্ধন একেবারে
ছিন্ন হয় তাকে নিবা´ণ বলে।
উপোসথ শব্দের অথ´ কি?
পব´দিন অথা´ৎ অমাবস্যা, পূণি´মা ও অষ্টমী তিথিতে উপোসথ গ্রহণ বৌদ্ধদের একটা প্রচলিত নীতি।

,,,,,,  
,,,,,,,,

সুমনপাল ভিক্ষু
বিদর্শন শিক্ষা কেন্দ্র 
কোলকাতা

মহাপন্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন

                                                                     সুমনপাল ভিক্ষু


মহাপন্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার বিরল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। দেশ ও কালের সীমানা অতিক্রম করে তাঁর মহান পান্ডিত্যের খ্যাতি চতুর্দিকে পরিব্যাপ্ত হয়েছে। অন্তরে সঞ্চারিত জ্ঞান তৃষ্ঞার তৃপ্তি সাধনের উদ্দেশ্যে সুদীর্ঘ এবং কঠোর শ্রম সাপেক্ষ ভ্রমণ তিনি মাথা পেতে গ্রহণ করেছিলেন। কখনও তিনি দুর্গম গিরি, কখনও কান্তার মরু অতিক্রম করেছেন কিন্তু কখনও কোনো ক্লান্তি তাঁর যাত্রা পথে অন্তরায় সৃষ্টি করেনি। তিনি বৌদ্ধ পূর্বসুরীদের সেই পথেই অগ্রসর হয়েছিলেন যে পথে জ্ঞানের সন্ধানে আচার্য কোন্ডিয় গিয়েছিলেন চম্পা (দঃ পূর্ব এশিয়া), আচার্য কুমার জীব গিয়েছিলেন সুদুর চীন এবং আচার্য অতীশ দীপঙ্কর গিয়েছিলেন ভোট (তিব্বত) দেশো বস্তুতঃ তিনি ছিলেন একজন মহান জ্ঞান তাপস এবং বিশ্ব নাগরিক। এই পৃথিবীতে যেন তাঁর জন্ম হয়েছিল দেশ-দেশান্তরে ভ্রমণের জন্য এবং সেই সঙ্গে জ্ঞান তৃষ্ঞা পূরণের জন্য।

পারিবারিক ঐতিয্য

১৮৯৩ খ্রীঃ ৯ এপ্রিল তিনি অর্থাৎ রাহুল সাংকৃত্যায়ণ এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার প্রদত্ত নাম ছিল কেদারনাথ পান্ডে। তাঁর পিতার নাম ছিল গোবর্ধন পান্ডে এবং মাতা কুলবন্তী দেবী। উত্তর প্রদেশের অন্তর্গত আজীমগড় জেলার পান্ধা গ্রামের মাতামহের গৃহে তাঁর জন্ম হয়। তবে যে গ্রামে তাঁর মাতা-পিতা বসবাস করতেন সেই গ্রামের নাম ছিল কনাইলা। তিনি তাঁর বাল্যশিক্ষা শুরু করেন ‘রাতী কী সরাই’ নামক বিদ্যালয়ে। পরবর্তীকালে তিনি নিজামবাদ উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন। এই বিদ্যালয়ের প্রধান ভাষা ছিল উর্দু। অতঃ তিনি কাশীতে সংস্কৃত ব্যাকরণ ও সাহিত্যসহ দর্শন শাস্ত্রে বুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও ৩০টি ভাষা, বিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস, সমাজবিদ্যা, দর্শনশাস্ত্র এবং সাহিত্যে বিশেষ দক্ষতা লাভ করেছিলেন।

 

জ্ঞানার্জনের প্রতি তাঁর অতৃপ্ত তাঁর অতৃপ্ত বাসনা তাঁকে স্রোতের টানে নিয়ে হাজির করেছিলেন গুনীজনের সান্নিধ্যে। এদের মধ্যে ছিলেন আচার্য ধর্মপাল, স্বামী ভারতীকৃষ্ঞ তীর্থ প্রমুখ গুণীজন। অবাক করার বিষয় এই যে, রাহুল সাংসৃত্যায়নের অভ্যন্তরে নিহিত ছিল বিশেষ গুণের সমাহার।

একদিকে যেমন পর্যটন স্পৃহা তাঁর দেহের শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হয়েছিল অপরদিকে জ্ঞানান্বেষণ তাঁর সমগ্র অন্তর জুড়ে ক্ষুধা-তৃষ্ঞাসম বিরাজমান ছিল। বস্তুতঃ তাঁকে দুই অর্থে পর্যটক নামে অভিহিত করা যেতে পারে, প্রথমতঃ তিনি ভ্রমণ করতেন মনোজগতে; দ্বিতীয়ত, পার্থিব জগতে।

পর্যটনের বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি হিমালয় অজ্ঞালের বিভিন্ন অংশে পরিভ্রমণ করেছেন। তিনি মনে করতেন হিমালয়’এর মহত্ব তাঁর জীবনের সকল প্রেরণার একমাত্র উৎসস্থল। হিমালয়ের মায়া তিনি কখনই পরিত্যাগ করতে পারেননি। হিমালয় তাঁকে বারংবার আহ্বান করেছে। বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে হিমালয়ের ন্যায় তাঁর জীবন ছিল মহান এবং গভীর জ্ঞান ভান্ডারে সমৃদ্ধ।

মাত্র ১১ বৎসর বয়সে কেদারনাথ পান্ডে ওরফে রাহুল সাংকৃত্যায়ন পরিনয় বন্ধনে আবদ্ধ হয়। যদিও এই বাল্যবিবাহ নামক সামাজিক পুতিগন্ধময় প্রথাকে তিনি কোনভাবেই সমর্থন করেননি। পরবর্তীকালে তাঁকে এই সকল সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করতে বাধ্য করেছিল।

অধ্যাত্ম সাধনা

কেদারনাথ কাশী ভ্রমণের অভিপ্রায়ে প্রথম গৃহত্যাগ করলেও তাঁর এই যাত্রা কোনভাবেই ফলাদায়ী হয়নি ফলে একপর্যায় কপর্দক শূণ্য হয়ে একপ্রকার বাধ্য হয়ে তিনি পুনঃ স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। এই ঘটনার কিছু দিন পরে তিনি পুণঃ গৃহত্যাগ করে কোলকাতার উদ্দেশ্যে মাত্রা করেন। এ মাত্রায় তিনি কোলকাতায় কিছু দিন অবস্থান করার পরে হরিদ্বার, হৃষিকেশ, গঙ্গোত্রী, যমুণেত্রী, কেদারনাথ, গৌরীকুন্ড প্রভৃতি স্থানে ভ্রমণ করে অবশেষে কাশী উপস্থিত হন।

এখানে তিনি সন্ন্যাসীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে সংস্কৃত ভাষা চর্চার প্রতি গভীর ভাবে মনোনিবেশ করেন। ১৯১৩ খ্রীঃ তিনি পুরী দর্শন করে রামেশ্বরম, তিরুপতি, পুনা, মুম্বাই, নাসিক সহ দক্ষিন ভারত, পূর্ব ভারত ও পশ্চিম ভারতের নগর সমূহ পরিভ্রমণ করেন। এই সময় কেদারনাথের জীবনে এক অদ্ভূত পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। এখন তাঁর অভ্যন্তরে ধ্বনিত হতে থাকে বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ। এই সময়ে তিনি ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার প্রাচীন বিধি বিধানের বিরুদ্ধে, ধর্মীয় গোঁড়ামী-কুসংস্কার’এর বিরুদ্ধে, অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে প্রবলভাবে সোচ্চার হয়ে ওঠেন।

একসময় তিনি বৈষ্ঞব মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে উক্ত ধর্মের দীক্ষা গ্রহণ করলে তাঁর পূর্ব নাম কেদারনাথ পান্ডের পরিবর্তে রামোদর দাস নাম গ্রহণ করেন। অতঃ তিনি একসময় আর্য সমাজ প্রচারক রূপে খ্যাত হন। প্রচারক হিসাবে তিনি লাহোর, রাওয়ালপিন্ডি এবং উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন ও পরিভ্রমণ করেন। এই সময়ে বৌদ্ধ দর্শন এবং জীবনে বৌদ্ধদর্শনের বাস্তব প্রয়োগ তাঁকে ভয়ানক ভাবে আকৃষ্ট করলে তিনি তখন হৃদয়ের গভীর নিষ্ঠা নিয়ে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। অতঃ তাঁর নতুন নামকরণ হয় ‘রাহুল সাংকৃত্যায়ন’। পরবর্তীকালে তিনি এই নামে পরিচিত হন ও খ্যাতি লাভ করেন।

এত্বদ সত্বেও তিনি তাঁর মনের উদ্বেগ কাটিয়ে উঠতে পারেন নি কারণ ভারতীয় সমাজের সামাজিক পরিকাঠামো তাঁকে প্রবলভাবে পীড়া দিয়েছিল। এক সময় তিনি একজন একনিষ্ট মার্কসবাদী ভক্তে পরিণত হন। তিনি এ কথা স্বীকার করেছিলেন যে নতুন পরিস্থিতিতে নতুন ভাবনাকে তিনি অন্তর দ্বারা গ্রহণ করেছিলেন। তবে একথা বলা কঠিন যে এই সময় তাঁর সমতা গ্রহন বাস্তবিক অর্থে সঠিক ছিল কিনা তা মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। তবে যে কথাটি দ্বিধাহীন কন্ঠে উচ্চারণ করা যেতে পারে তিনি ছিলেন যথার্থই একজন সত্যসন্ধানী পরিব্রাজক।

স্বাধীনতা সংগ্রামী

১৯১৯ খ্রীঃ তৎকালীন ইংরেজ সরকার লাহোরে সামরিক আইন জারী করলে তিনি ভারতের জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেন। ফলে তিনি রাজনৈতিক বন্দী রূপে বক্সার জেলে আটক হন। মহান অক্টোবর বিপ্লব তাঁর মনে অসীম সাহসের সঞ্চার করেছিল এবং সেই সময় তাঁর মনের চিন্তাধারা ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হতে থাকলে তিনি কার্ল মাক্সের মতবাদের প্রতি প্রবল ভাবে আকৃষ্ট হয়ে ভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টির পার্টিজান কর্মীরূপে বিহার, উত্তরপ্রদেশের গ্রামাঞ্চলে পরিভ্রমণ করতে থাকেন। অতঃ তিনি বন্দী দশা মুক্তি লাভ করে বিহারের হাপড়া জেলার কংগ্রেস কমিটির সম্পাদকপদে আসীন হন।

বেশ কিছুদিন পরে তিনি ঐ কমিটির সম্পাদকের পদ পরিত্যাগ পূর্বক নেপালে গমন এবং সে দেশে কিছুকাল অবস্থান করেন। সেই সময় তিনি সেখানে বেশ কিছু লামার সান্নিধ্য লাভ করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন মহাবুন্ডায় অবস্থিত কতিশয় চীনা লামাও। সেই সময় রাহুল সাংকৃত্যায়ন অতীন্দ্রিয় দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হন।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তের পর ইংরেজ সরকার কর্তৃক তাঁকে রাজদ্রোহের অভিযোগে আটক করে হাজারিবাগ জেলে বন্দী করে রাখা হয়। কারণ তিনি একসময় কংগ্রেস পরিষদীয় দলের সম্পাদকের পদে আসীন ছিলেন। এখানেই তাঁর সঙ্গে স্বামী ভারতী কৃষ্ঞতীর্থের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। ইত্যবৎসরে তিনি বীজগণিত এবং আলোক বিদ্যার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং জ্যোর্তিবিদ্যা সম্পর্কিত গ্রন্থ রচনা করেন।

জেলজীবন অতিবাহিত হওয়ার পরে তিনি হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য সাধনের কাজে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে নিয়োজিত করেন। এছাড়াও তিনি সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণের কাজেও নিজেকে সমর্থন করেছিলেন। ১৯২৬ খ্রীঃ তাঁর সঙ্গে ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদের সাক্ষাত্ ঘটে। ড. প্রসাদ তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্ত ইত্যাদি পাঠ করে এতটাই মুগ্ধ হন যে তিনি উক্ত বক্তৃতামালা মুদ্রিত আকারে প্রকাশের ব্যবস্থা করে দেন।

কৃষক আন্দোলন

১৯৩৪ খ্রীঃ বিহারে সমাজবাদী পার্টি গঠিত হয়। তিনি এই সংগঠনের সম্পাদকপদে যুক্ত হন। পরবর্তীকালে তিনি বিহার কিষাণ সভা ও বিহার কমিউনিষ্ট পার্টি গঠন করেন। কমিউনিষ্ট পার্টি গঠনের মূল কারণ ছিল কংগ্রেসের সঙ্গে মতাদর্শগত মতবিরোধ। ১৯৪৭ খ্রীঃ পর্যন্ত তিনি একান্ত ভাবে কমিউনিষ্ট সংগঠনের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন।

১৯৩৯ খ্রীঃ তিনি কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন এবং স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী সঙ্গে একত্রিত হয়ে কৃষ্ঞান সভার পতাকাতলে কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করেন। সেই বছরেই তিনি আড়াই বৎসরকাল ব্যাপী কারাবাস ভোগ করেন। কারাবাসের সময়কালে তুলনামূলক দর্শন (Comparative Philosophy) ‘দর্শন দিগ্‌দর্শন’ নামক এক অসামান্য গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর জীবনের মহানব্রত ছিল দেশবাসীর উন্নয়ন। তিনি মনে প্রানে বিশ্বাস করতেন যে ভারতবর্ষকে যথার্থ ভাবে উন্নত করার একমাত্র পথ হল এই দেশকে পরাধীনতার শৃংখল হতে মুক্ত করা। আর এরজন্য প্রবোজন সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন।

 

শ্রীলংকা এবং তিব্বত পর্যটন

১৯২৭ খ্রীঃ রাহুল সাংকৃত্যায়ন শ্রীলংকা গমন করেন। এই দেশে কিছুকাল অবস্থান কালে তিনি গভীর উৎসাহের সঙ্গে বৌদ্ধশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন এবং উক্ত দেশ হতে তিনি ত্রিপিটকাচার্য উপাধি লাভ করেন। অতঃ তিনি ভিক্ষুধর্মে দীক্ষিত হয়ে আচার্যের নিকট হতে রাহুল সাংকৃত্যায়ন নামে ভূষিত হন। পরবর্তীকালে তিনি বহুবার শ্রীলংকা গমন করেছিলেন।

তিনি বেশ কয়েক বৎসর তিব্বত ভ্রমণ করেন। প্রথমবার তিনি তিব্বতে যান ১৯২৯ খ্রীঃ, দ্বিতীয়বার ১৯৩৪ খ্রীঃ, তৃতীয়বার ১৯২৬ খ্রীঃ এবং অন্তিম সময় ১৯৩৮ খ্রীঃ। তিনি তিব্বত যাত্রাকে ভিন্ন দৃষ্টিতে মূল্যায়ণ করেছিলেন। তাঁর মতে এই দেশ ভ্রমণ অত্যন্ত জটিল তথাপি ফলপ্রসু। তিনি তাঁর তিব্বত যাত্রা হতে প্রত্যাবর্তন কালে অতি মূল্যবান তথা দুষ্প্রাপ্য পুঁথি ভারতে আনয়ন করেছিলেন। এই সকল পুঁথিপত্র বর্তমানে নেপাল ও নালন্দায় সংরক্ষিত রয়েছে। প্রসঙ্গত মনে রাখা প্রয়োজন যে ৭ম শতাব্দীতে পৃথীবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় ‘নালন্দা’ বখতিয়ার খলজি নামক তুর্কী মুসলমান শাসক দ্বারা সম্পূর্ণ ভাবে বিনষ্ট হয়েছিল।

রাহুল সাংকৃত্যায়ন ১৯৩১-১৯৩৮ খ্রীঃ সময়কালে এশিয়া এবং ইউরোপের বহুদেশ ভ্রমণ করেছিলেন।

 

রুশদেশ ভ্রমণ

১৯৩৫ খ্রীঃ রাহুল সাংকৃত্যায়ন সর্বপ্রধম রূশদেশ (তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন) গমন করেন। পুনঃরায় ২ বৎসর পরে তিনি রুশদেশে যান। এই সময় তিনি লেনিনগ্রাভ শহরে ২ বৎসর অবস্থানরত ছিলেন। লেনিনগ্রাভ শহরে অবস্থানকালে তিনি ‘ওরিয়েন্টাল ইনষ্টিটিউটে’ সংস্কৃত ভাষার শিক্ষকরূপে কর্মরত ছিলেন। সেই সময় ‘ইলেনা নরভার টোভনা’ নামক এক রুশ মহিলা ‘ইন্দো-টিবেটান ষ্টাডিজ’এর সেক্রেটারী পদে নিযুক্ত ছিলেন। পরবর্তীকালে রাহুল সাংকৃত্যায়ন তাঁর সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৯৩৮ খ্রীঃ তাদের একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। তাঁর নামকরণ করা হয় ‘লগোর’। তিনি সেই বৎসর’ই স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। নবজাতকশিশু এবং মাতা রুশদেশেই থেকে যান।

রাহুল সাংকৃত্যায়ন ১৯৪৫ খ্রীঃ পুনঃ রুশদেশে গমন করেন। তিনি এই সময় লেনিনগ্রাভের কোন এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনাকার্যে যুক্ত ছিলেন। তথায় তাঁর সঙ্গে বহু মনীষী এবং দার্শনিকের সাক্ষাৎ ঘটেছিল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন সারভেসিক, বারনিকোভ এবং কলিয়ানোভ প্রমুখ। সেই সময় মস্কো শহরে ড. টলস্টোভ নামক এক প্রখ্যাত ঐতিহাসিকের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে এবং তাঁর অনুপ্রেরণায় তিনি এশিয়া সোভিয়েত বিষয় সম্পর্কিত গবেষণাধর্মী অধ্যয়ন করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি উক্ত গবেষনার পরিনাম রূপে ‘মধ্য এশিয়ার ইতিহাস’ নামক গ্রন্থ রচনা করেন এবং ‘সাহিত্য আকাডেমী’ পুরস্কার লাভ করে ছিলেন। বস্তুতঃ তিনি এই সময়কালে ভারতবর্ষ ও তার পার্শ্ববর্তী বহু দেশের ভূগোল এবং ইতিহাস সম্পর্কিত অনেক সৃজনশীল গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

তিনি ১৯৪৭ খ্রীঃ’র জুলাই মাসে শেষবারের ন্যায় রুশদেশ ত্যাগ করে ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন। এই সময় তাঁর সঙ্গে তাঁর স্ত্রী-পুত্রের বিচ্ছেদ ঘটে যদিও এরপরেও তিনি মস্কো শহরে চিকিৎসার জন্য বেশ কিছু সময় অতিবাহিত করেছিলেন কিন্তু তাদের সঙ্গে আর তাঁর সাক্ষাৎ সম্ভব হয় নি।

স্বদেশে প্রত্যাবর্তন

যখন তিনি স্বাধীন ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন তখন তিনি দেখতে পান সমগ্রদেশে সাম্প্রদায়িক নাগপাশে জর্জরিত। তিনি তখন সাম্প্রদায়িক মিলনের পথের সন্ধানে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৪৭ খ্রীঃ তিনি মুম্বাই শহরে অনুষ্ঠিত হিন্দি সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতির আসন অলংকৃত করে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির আহ্বান জানান। কিন্তু এক সময় মতাদর্শগত মতপার্থক্যের কারণে তিনি সক্রিয় রাজনীতি হতে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। এরপর তাঁর জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। শুরু হয় এক নতুন পথে হাঁটা।

জীবনের সিংহভাগ সময় তিনি অতিবাহিত করেন কখনও দেশ পর্যটন করে আবার কখনও নেপাল, চীন, শ্রীলংকায় শিক্ষকতা বরত্তির কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে। অতঃ জীবনের অবশিষ্ট অংশ তিনি পুরোপুরি ব্যয় করেন কখনও বা ইতিহাস সম্পর্কিত গ্রন্থ প্রকাশ করে আবার কখনও বা ঐতিহাসিক ও ভারত সংস্কৃতি মূলক নিবন্ধগ্রন্থ ইত্যাদি রচনা করেন। এক সময় ভারতীয় সংবিধানকে হিন্দি ভাষায় রূপদানের প্রশ্নে তাঁর প্রতি ভার ন্যাস্ত করা হয় এবং সেই কাজ তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছিলেন।

হিমালয়ের প্রতি অকৃত্তিম ভালোবাসা তাঁকে কালিম্পং টেনে নিয়ে আসে। এখানে তাঁর বহুকালের বন্ধু জর্জ বোরিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে এবং কমলা নামক রমণীর সঙ্গে পরিনয় সূত্রে আবদ্ধ হন। কমলা ছিলেন তাঁর তৃতীয় পত্নী।

১৯৫০ খ্রীঃ তিনি মৌসুরীর ‘হ্যাপি ভ্যালি’ তে একটি গৃহ ক্রয় করেন। এখানে তিনি ভীষণভাবে লেখা’র কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখেন। তাঁর কন্যা জয়া ১৯৫৩ খ্রীঃ জন্মগ্রহন করেন এবং পুত্র হেতা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৫ খ্রীঃ। রাহুল সাংকৃত্যায়ন ১৯৫৬ খ্রীঃ সপরিবারে নেপাল ভ্রমণ করেন। ১৯৫৮ খ্রীঃ তিনি গণতান্ত্রিক চীন গমন করেন এবং সেখানেই তিনি প্রথমবার হৃদরোগে আক্রান্ত হন।

রাহুল সাংকৃত্যায়ন ১৯৫৯ খ্রীঃ শ্রীলংকার বিদ্যালংকার পরিবেন এর দর্শন বিভাগের বিভাগীয় অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। শ্রীলংকা গমনের পূর্বে তিনি তাঁর স্ত্রী-পুত্র এবং কন্যাকে কালিম্পং এর গৃহে স্থানান্তরিত করে যান।

১৯৬১ খ্রীঃ তিনি শ্রীলংকায় পুনঃ অসুস্থ হয়ে পড়েন। অতঃ তিনি সরাসরি শ্রীলংকা হতে দার্জিলিং চলে আসেন। তাঁর ক্লান্তিহীন অবিরাম পরিশ্রম তাঁর শরীর আর গ্রহণ করতে পারল না। সেই বৎসর ডিসেম্বর মাসে তিনি পুণঃ হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তখন তাঁকে চিকিৎসার নিমিত্তে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। অবস্থার অবনতি ঘটলে তাঁকে মস্কো নিয়ে যাওয়া হয় চিকিৎসার জন্য। কিন্তু এত্বদ স্বত্ত্বেও সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল এবং তাকে আর কোন ভাবেই সুস্থ করা সম্ভব হল না। ১৯৬৩ খ্রীঃ মার্চ’এ তাঁকে ফিরিয়ে আনা হয় এবং ১৯৬৩ খ্রীঃ ১৪ এপ্রিল তিনি তাঁর প্রিয় শহর কালিম্পং’এ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

সাহিত্যে সৃজনশীল অবদান :

যদিও তিনি সর্বদা পর্যটন কার্যে নিয়োজিত ছিলেন তথাপি তিনি কোন না কোন ভাবে লেখালেখির কার্যে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। ১৯২০- ১৯৬১ খ্রীঃ পর্যন্ত তিনি সাহিত্য চর্চার কাজে মগ্ন ছিলেন। যতদিন না তিনি স্মৃতিভ্রম ব্যাধিতে আক্রান্ত না হয়েছেন ততদিন তিনি কোন না কোনো রচনাকার্যে ব্যপৃত থেকেছেন। এই কাল খন্ডের মধ্যে তিনি রচনা করেছেন একশত খন্ড পুস্তক। এই পুস্তক সমূহের মধ্যে ছিল উপন্যাস, ছোটগল্প, তাঁর নিজের জীবনী সহ অন্যজনের জীবনী। জীবনী গ্রন্থের সংখ্যা ছিল সুবৃহৎ ৫ খন্ড; ২০টির অধিক ভ্রমণ বৃন্তান্ত, ৮ খন্ড রচনা সংগ্রহ ভোজপুরী ভাষায় ৮টি নাটক এবং ৩টি দর্শন শাস্ত্র বিষয়ক নিবন্ধ। তাঁর রচিত উপন্যাস সমূহের মধ্যে ‘সিংহ সেনাপতি’ এবং ‘জয় মৌধেয়’ উল্লেখ্যনীয়। ‘ভোলগা থেকে গঙ্গা’ এই কালজয়ী গল্প সমূহের সময়কাল বৈদিক পূর্বযুগ হতে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত। এই গ্রন্থটি পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে।

রাহুল সাংকৃত্যায়ন কর্তৃক রচিত গ্রন্থপুঞ্জ কেবলমাত্র মৌলিক রচনার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। তদুপরি তাঁর রচনার ধারাকে তিনি ব্যাপ্ত করে দিয়েছেন বৈচিত্রের মধ্যে। এই বৈচিত্রময় সাহিত্যের মধ্যে রয়েছে দর্শন, ইতিহাস, সমাজবিদ্যা, নৃতত্ত্ব, ভাষা, ভ্রমণ কাহিনী, ভারততত্ত্ব, শিল্প-বিজ্ঞান, অভিধান, বৌদ্ধসাহিত্য, লোকসাহিত্য এবং আরও বহু বিভিন্ন ধর্মী রচনা।

ভারতীয় সাহিত্যে রাহুল সাংকৃত্যায়ন’এর উল্লেখনীয় অবদান হল সহজবোধ্য হিন্দি ভাষায় প্রাচীন সাহিত্যের সহজ সরল অনুবাদ। চিরায়ত পালি ভাষায় রচিত প্রাচীন বৌদ্ধ পুঁথি, সিংহলী এবং তিব্বতী গ্রন্থ তিনি উৎসুক পাঠক সমাজ ও গবেষকের কাছে সহজলভ্য এবং সহজবোধ্য করে দিয়েছেন। এই সকল রচনা তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন। সর্বোপরি তাঁর রচনার ভাষা ছিল সহজ ও সরল। সাহিত্যের এমন কোন অঙ্গন নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি। সুতরাং এই অর্থে রাহুল সাংকৃত্যায়ন হলেন বিশ্ব নাগরিক এবং যার মূল্যায়ন কোনো অর্থেই সম্ভব নয়।

 ১২.০২.২০২৪

 

বড়ুয়া বেকারির গড়ে ওঠার সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত

 

                                                                                                                                  ভিক্ষু সুমনপাল 

১৯২৭- ২৮ সাল।  কোলকাতায় তখন গ্রেট ইস্টার্ন খ্যাতির মধ্যগগনে। চৌরঙ্গির উপর ফারপো'স সারাদিন ভাল খাবারের শেষ কথা। পার্কস্ট্রিটে মি. ফ্লুরির টি রুমে লোকের ভিড়। কেকে- পাউরুটি এতদিনে ঢুকে পড়েছে বাঙালির আনন্দমহলে, বলতে হয় চাহিদা গগনচুম্বী। ঠিক এই সময়ে মনোরঞ্জন বড়ুয়া খুললেন বেকারি, সম্ভবত প্রথম বাঙালি বেকারি।

চট্টগ্রাম থেকে আসার পর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মনোরঞ্জন বড়ুয়া পাড়ায় পাড়ায় টিনের ট্রাকে করে কেক বিক্রি করতেন। কিছুদিন পরে পয়সা জমিয়ে নিজেই খুললেন বেকারি, বৌবাজারের কাছে গোকুল বড়াল স্ট্রিট-এ। এর বছর কয়েকের মধ্যেই কেকের চাহিদা বাড়াতে প্রয়োজন হল বড় জায়গার, বড় বেকারির। নতুন বেকারি হল মৌলালির কাছে ১২৩এ ধর্মতলা স্ট্রিট-এ (এখনকার লেলিন সরণি)। প্রথমে তৈরি হত পাউরুটি, প্যাটিস আর নানারকম ফ্রুট কেক। পাড়ায় পাড়ায় বিক্রি হতে লাগল বড়ুয়ার টিফিন কেক। মহামেডান স্পোর্টিং বাদে ময়দানের সব ক্লাবের ক্যান্টিনে পাওয়া যেত বড়ুয়ার কেক। এছাড়াও ছিল মিলিটারিতে আর নানা হাসপাতালে সাপ্লাই। এইসময় বড়ুয়ার কেক হয়ে ওঠে মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনের অঙ্গ। মনোরঞ্জন বড়ুয়া ১৯৮৭- তে মারা গেলেও তার ছেলেরা ও ভ্রাতুষ্পুত্ররা, নাতিরা আজও বেকারি চালিয়ে যাচ্ছেন। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বড়ুয়া বেকারি আজও রয়েছে বড়ুয়ার পাউরুটি ও ফ্রুট কেকের চাহিদা। বিদেশিদের আধিপত্যের সঙ্গে সঙ্গে এদেশে আসে বড়দিন ও ক্রিসমাসের উৎসব। বিদেশিরা যেমন মেতে ওঠে বাঙালির দূর্গোৎসবে, বাঙালিরা তেমনি আপন করে নেয় বিদেশি ক্রিসমাস।

শুরু হয় হয় বাঙালির যিশুপূজো। ক্রিসমাসে সেজে উঠত কোলকাতা আর দোকানে দোকানে ভরে উঠত কেক, মাফিনের স্টক। নিউমার্কেট বা সাহেব পাড়ায় দোকান তো ছিলই, বাঙালি পাড়ায় টিনের ট্রাঙ্কে ফেরিওয়ালার মাথায় কিংবা চায়ের দোকানে  ছড়িয়ে পড়ল সাহেবের কেক। এতদিনে কেকে, মাফিন, প্যাটিস, ব্রাউনি ইত্যাদি আর পাউরুটির নেশা ধরে ফেলেছে আপামর কোলকাতাবাসী - বাঙালি অবাঙালি সবাই। ছোট ছোট অসংখ্য বেকারি গজিয়ে উঠতে লাগল চারিদিকে। বড়ুয়া, ফেরাজিনি, ফেরিনি, এরিয়ান, ফিলিপস - এর কেক ঢুকে পড় বাঙালির আনন্দমহলে।  ৬০-এর  দশকে বন্ধ হল ফারাপো' স আর ফ্লুরি'স এর হল হাতবদল।

বড়ুয়া বেকারীর কর্ণধারগণ: শ্রী হরিধন বড়ুয়া কৃষিবিদ্যাকে জীবন জীবিকার প্রধান অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করে পরিবারের দৈনন্দিন চাহিদার যোগান দিয়েছিলেন। বড় পরিবার বলে আশানুরূপ সুখস্বাচ্ছন্দ্য আনয়নের কষ্ট দেখে জ্যেষ্ঠ পুত্র লালন বড়ুয়ার কর্মজীবনের সন্ধানে মায়ানমার পাড়ি জমায়। সেখান থেকে তিনি পিতামাতাকে সাহায্য করতে থাকেন। দ্বিতীয় পুত্র মনোরঞ্জন বড়ুয়া পারিবারিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর জন্য জন্মভূমি ছেড়ে কোলকাতা যাত্রা করেন। কোলকাতা তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের প্রধান নগরী হিসেবে খ্যাত ছিল। বিশাল নগরীতে এসে তিনি তাঁর নিজস্ব বুদ্ধি এবং দূরদৃষ্টি দ্বারা কর্মজীবনে চাকুরীকে প্রাধান্য না দিয়ে ব্যবসা জীবনকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে     'বড়ুয়া বেকারি প্রাইভেট লিমিটেড নামক' একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেন। বাঙালি বৌদ্ধ সমাজের মধ্যে এটিই সর্বপ্রথম বেকারী শিল্প। কারখানার গোড়াপত্তন হয় কোলকাতার ৭নং শাঁখারি টোলায়।  ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ধর্মতলা স্ট্রীটে (বর্তমান লেলিন সরণি) বেকারী স্থানান্তরিত করা হয়। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মনোরঞ্জন বড়ুয়া বেকারী প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পাটনায় 'বড়ুয়া ডেইরী' এবং বরাহনগরে 'বেঙ্গল কাটারী' নামক দুটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। তিনিই প্রতিষ্ঠানই তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত এবং বড়ুয়া বেকারী প্রধান। তখনকার দিনে বাঙালি বৌদ্ধদের মধ্যে কয়েকটি বেকারী ছিল অবিভক্ত ভারতে এটি ছিল প্রধান। ভাল রুটি এবং কেক বলতে বড়ুয়া বেকারী'র রুটি এবং কেক বোঝাত। এখনও সেই ধারা অব্যাহত আছে। নির্ভেজাল ও রুচিশীল রুটি এবং কেক তৈরির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। চাহিদা বেড়ে যায়। শিল্পীর সেই গৃহকোণের কিশলয় মহীরুহে পরিণত হতে লাগল। তখন প্রয়োজন ছিল সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ, বিশ্বাসী এবং সুদক্ষ পরিচালক। শ্রী মনোরঞ্জন বড়ুয়ার একার পক্ষে অতবড় বেকারীর কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভবপর হচ্ছে না দেখে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মনোরঞ্জন বড়ুয়া আপন কনিষ্ঠ ভ্রাতা প্রিয়দর্শী বড়ুয়াকে আহ্বান জানালেন। তিনি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার আহ্বান উপেক্ষা করতে না পেরে জন্মভূমির মায়া ছেড়ে ছুটে গেলেন বিশাল ‘বড়ুয়া বেকারী'র কর্মকাণ্ডে। প্রিয়দর্শী বড়ুয়া বেকারীর সকল কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার পরিকল্পনাকে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন বলে তিনি তাঁর অতি প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেন। কয়েক বছর পরে অন্যান্য ভ্রাতাদের মধ্যে শ্রী অবনীরঞ্জন বড়ুয়া এবং শ্রী প্রিয়ব্রত বড়ুয়াও যোগদান করেন বেকারী'র কার্যক্রমে। সেখানে নতুন প্রতিষ্ঠান করা হয় 'বড়ুয়া আর্ট প্রেস' নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান। শ্রী অবনীরঞ্জন বড়ুয়া ছিলেন এর প্রধান পরিচালক। তিনি তা দেখাশুনা করতেন। সময়ে সময়ে বেকারীর কাজকর্মও দেখাশুনা করতেন। অগ্গমহাপণ্ডিত প্রজ্ঞালোক মহাস্থবিরের নামে প্রতিষ্ঠিত ‘প্রজ্ঞালোক প্রকাশনা'র বহু অমূল্য গ্রন্থ এই প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। এদিকে তরুণ কর্মী প্রিয়ব্রত বড়ুয়া ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কোলকাতা বিদ্যাসগর কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বি.এ. পাশ করে বেকারীর দায়দায়িত্বে নিজেকে উৎসর্গীকৃত করেছিলেন। যদিও তিনি সর্বকনিষ্ঠ কিন্তু এই বেকারীর সার্বিক উন্নতির পিছনে তাঁর শ্রম ও অবদান ছিল সর্বজন স্বীকৃত। তিনি যতদিন কর্মক্ষম ছিলেন তাঁর কল্যাণস্পর্শে বড়ুয়া বেকারী ধন্য হয়েছে। সকলের আগে এসে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ থেকে আরম্ভ করে উৎপাদনের কার্যক্রমের তদারক করা ছিল তাঁর দৈনন্দিন কর্মসূচি। এই প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য শারীরিক, মানসিক সবদিক থেকে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর এই কর্মনিষ্ঠার কথা বেকারীর অন্যান্য পরিবারের সদস্যগণ অকপটে স্বীকার করে থাকেন। প্রিয়দর্শী বড়ুয়া হিসাবাদি দেখাশুনা করতেন, ব্যাঙ্কে দৈনিক টাকা পয়সা আনা নেওয়া তিনি করতেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় টাকা পয়সার লেনদেন করা - প্রিয়দর্শী বড়ুয়া সেই কঠিন দায়িত্ব পালন করতেন। সংরক্ষণের ব্যাপারেও তিনি খুবই সচেতন ছিলেন। অশীতিপর বয়সেও তিনি রীতিমত বেকারীতে আসা যাওয়া করতেন। বাঙালি বৌদ্ধ সমাজের তৎকালীন একমাত্র ঠিকানা ছিল বড়ুয়া বেকারী। তাঁর এই সৃষ্টির পিছনে ছিল নিরলস সাধনা ও পরিশ্রম। একজন শিল্পী তার তুলি ও রঙের সাহায্যে বহু শিল্পকর্মকে রূপ দেয়। আর বেকারীর শিল্পীরা বেকারীজাত জিনিস- কেক, পেস্ট্রি প্রভৃতিতে কি অপূর্ব রূপায়িত করতেন- তা সত্যই বিস্ময়কর। শিল্পীরা আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে কত সুন্দর শিল্পকর্ম করতেন- কোনও কেকে দেখা যায় সাহেব-মেম নৃত্যরত, কোনটায় দেখা যায় পিয়ানো, ফুটবল মাঠ ইত্যাদি। যাঁরা একখণ্ড কেকের উপর এই সব শিল্পকর্ম করে থাকেন সত্যই শিল্পী হিসেবে নমস্য (স্মারকগ্রন্থ, কলিকাতা ২০০৫, পৃ. ১০-১১) শৈল্পিক চেতনা বড়ুয়া বেকারীকে সর্বস্তরের মানুষের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে সক্ষম হয়েছিল যার প্রত্যক্ষ ফলস্বরূপ তৎকালীন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বুলগানিন বড়ুয়া বেকারীর কেক খেয়ে এতই প্রীত হয়েছিলেন যে তিনি বেকারীর কেক এর প্রশংসাপত্র দিয়েছিলেন। স্বাস্থ্যসম্মত রুটি এবং কেক তৈরির জন্যে উন্নত ধরনের নানারকম সরঞ্জাম তিনি Germany, Holland, England প্রভৃতি দেশ থেকে আমদানী করে বেকারীকে নবরূপে সাজিয়ে তোলেন। তখন থেকে হাতে তৈরির পরিবর্তে, কাঠের আগুনে রুটি Bake করবে পরিবর্তে steam এর দ্বারা তৈরি করা হত। বেকারী শিল্পের উন্নতির জন্য তাঁদের নব নব পদক্ষেপ সত্যই প্রশংসার দাবী রাখে। যতদিন কাজ করার মতন ক্ষমতা ছিল অবনীরঞ্জন বড়ুয়া, প্রিয়দর্শী বড়ুয়া এবং প্রিয়ব্রত বড়ুয়া এই বেকারীর উন্নতির জন্যে যথেষ্ট ত্যাগ এবং পরিশ্রম করেছেন। তৎকালীন Fort William এর Colonel কিংবা Medical College এর Super তথা সরকারী বেসরকারী অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক ছিল। রোগী এবং সৈনিকদের জন্যে বেকারী থেকে রুটি বরাদ্দ ছিল। বর্তমান নিজ সন্তান এবং ভ্রাতুষ্পুত্ররা, নাতিরা বেকারীর হাল ধরে রেখেছেন। যেকোন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান তিন প্রজন্ম ধরে চলমান থাকলে সেটা সফল প্রতিষ্ঠান এবং কুশলী কর্ণধারগণের দূরদৃষ্টিতা অনস্বীকার্য। বাঙালি বৌদ্ধদের অনেক আশ্রয়হীন তরুণ, স্বদেশ থেকে কর্মজীবনের সন্ধানে কোলকাতা মহানগরীতে ছুটে এসেছে--সবার একমাত্র ঠিকানা এবং আশ্রয়স্থল ছিল ‘বড়ুয়া বেকারী'। অনেককে দিয়েছেন কর্মসংস্থান, অনেক জ্ঞানান্বেষী ছাত্রদেরকে দিয়েছেন উচ্চ শিক্ষার সহায়তা এবং অনেকে বেকারীতে থেকে শিল্পকর্মের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে নিজেরাই পরবর্তী সময়ে বিশালাকার বেকারী প্রতিষ্ঠা করে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন যেমন লব্ধপ্রতিষ্ঠ ব্যবসায়ী প্রিন্স বেকারীর স্বত্বাধিকারী শ্রী অর্জুন দাশ গুপ্ত অন্যতম। শতাব্দীকাল বাঙালি বৌদ্ধদের ঐতিহ্য সুনাম এবং সুখ্যাতির অন্যতম প্রতিষ্ঠান বড়ুয়া বেকারী আরো সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাক এটাই আন্তরিক প্রত্যাশা। ভারত-বাংলায় এখনও সর্বসাধারণের সবচেয়ে পরিচিত একটি নাম ‘বড়ুয়া বেকারী'।

-
সূত্র : সরকারী আর্কাইভ ও বিভিন্ন  পত্র পত্রিকা থেকে তত্ত্ব-উপাত্ত সংগ্রহ করে প্রণীত ক্ষুদ্র নিবন্ধ। 

মাতৃত্ব বিভিন্ন ধর্মে

 

                                                                                                                            সুমনপাল ভিক্ষু

বৌদ্ধ ধর্মে মাতৃত্ব:

বৌদ্ধধর্মে মাতৃত্বকে অতি শ্রদ্ধার ও দায়িত্বের আসনে বসানো হয়েছে। যদি একজন নারী একজন মা হিসেবে তার উপর অর্পিত দায়িত্বকে পারিবারিক জীবনে সঠিকভাবে নির্বাহ করতে পারে তাহলে সে সেই দায়িত্ব পালনে যে আন্তরিকতা প্রদর্শন করবে সেই অনুপাতে সে শ্রদ্ধা ও সম্মান দাবী করতে পারবে। সন্তানের মা হিসেবে একজন নারীর দায়িত্বপূর্ণ ও শ্রদ্ধাপূর্ণ অবস্থানের উপর গুরুত্ব আরোপ করে বুদ্ধ সমাজে নারীর মর্যাদাকে বৃদ্ধি করেছেন। মা যদি তাঁর ভূমিকা ভালোভাবে ও সঠিকভাবে পালন করে থাকেন তাহলে একজন মানুষের কাছে তাঁর নিজের মায়ের তুল্য শ্রদ্ধেয় ও সম্মানীয় কেউ হন না। এমন মা এবং মাতৃভূমিকে স্বর্গের জীবনের থেকেও বেশী মূল্য দেওয়া হয়েছে। (জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী)।
যে বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তা হল এই যে বৌদ্ধধর্মে যখন মাতাপিতাকে একসঙ্গে বোঝান হয়েছে তখন মাতাকেই প্রথম উল্লেখ করা হয়েছে। এই মর্যাদা পিতাকে দেওয়া হয়নি কারণ সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে পিতার ভূমিকা অপ্রধান। এর থেকে মাতৃত্বের উচ্চ মূল্য ও দায়িত্ব সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। বৌদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গিতে একজন ভালো মায়ের একজন ভালো স্ত্রী হওয়াও প্রয়োজন। যদি স্বামী তাঁর কর্তব্য পালন না করেন তাহলে হয়তো তিনি অসহায় হয়ে পড়বেন কিন্তু প্রায়ই একজন ভালো ও যোগ্য স্ত্রী তাঁকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে ও সক্ষম হবেন কিছু অসংশোধনীয় ব্যতিক্রম ছাড়া।

এটি হল একজন নারীর প্রধান অস্ত্র। এই অস্ত্রটি তিনি লাভ করতে পারেন একজন মা হিসেবে তাঁর সহজাত নিবৃত্তি ক্ষমতা থেকে, কিন্তু তার জন্য যথাযথ অনুশীলন প্রয়োজন। (কিন্তু এটি হল মাতৃত্ব (ও পিতৃত্ব) এর প্রধান দায়িত্ব এটি হল এমন কাঠামো যার উপর অবশিষ্টগুলি নির্ভরশীল)। তাঁর উপদেশগুলির মধ্যে দিয়ে বুদ্ধ মা ও তার ঘনিষ্ট সম্পর্কের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এই অর্থে মাকে শ্রেষ্ঠ বন্ধু, শ্রেষ্ঠ আত্মীয় শ্রেষ্ঠ গুরুজন বলা হয়েছে। (ধর্মপদ গাথা ৪৩, সুত্তনিপাত গাথা ২৯৬ ইত্যাদি)।

মায়ের রক্ষাকবচ না থাকলে সন্তানের জীবন নানাভাবে বিপন্ন হয়ে পড়বে কারণ অন্য কেউই সন্তানকে মায়ের ভালোবাসা দিতে পারবে না। একথা খুব ভালোভাবে জেনে বুদ্ধ মেত্তা সুত্তে তাঁর সুপরিচিত উপমাটি ব্যবহার করেছেন, “সেই মায়ের মত যিনি নিজের প্রাণের বিনিময়েও তাঁর একমাত্র সন্তানের জীবন রক্ষা করেন – মাতা যথা নিয়ং পুস্তং আর্যুগা একপুপ্ত অনুরাখে, (সুত্তনিপাত- গাথা-১৪৯)। জাতক কাহিনী (Cowel's Eng Tr. 5 p. 45 ) তে নিম্নলিখিত পঙক্তিগুলি পাওয়া যায়. “একজন মা তাঁর শিশু সন্তানের দিকে তাকিয়ে পবিত্র আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন”।

বুদ্ধ মাতৃত্বকে এই অনন্য মর্যদা দান করেছেন কারণ মানবিক সম্পর্কগুলি সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞান ও বোধ ছিল। একবার একজন দেবতা তাঁর কাছে এসে নিম্নলিখিত প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করলেন, পরিবারে শ্রেষ্ঠ বন্ধু কে? - “কিং সু মিত্তং সকে ঘরে?” অত্যন্ত দ্বিধাহীনভাবে বুদ্ধ উত্তর দিলেন, “মা হলেন পরিবারে সবচেয়ে বড় বন্ধু”- মাতা মিত্তং সকে ঘরে, (সংযুক্ত নিকায়, ১, পৃ-৩৭)। এই বিবৃতির মধ্যে সমস্ত দর্শন নিহিত রয়েছে।

এই পর্যন্ত এই আলোচনায় মাতৃত্বের সদর্থক ও বাঞ্ছিত বৈশিষ্ট্যগুলির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, এটি হল একটি সাধারণ অবস্থান যা একজন মায়ের কাছ থেকে আশা করা হয়। কিন্তু যখন একজন মা স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তাঁর এই কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হন তাহলে তা তাঁর ধ্বংসের কারণ হবে কারণ এই পৃথিবীতে আর কেউই এই ক্ষেত্রে মাতার বিকল্প হতে পারে না। আজকের যুগে মাতৃত্বের এই অন্ধকার দিকটি বিরল নয়।

এর ফলে মায়ের দ্বারা একজন সন্তানের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে। প্রথমত শিষ্যটি তার প্রধান শিক্ষক ও রক্ষককে হারাবে। আধুনিক সমাজে মানবিক মূল্যবোধ কমে যাওয়ার ফলে যে অবনতি ঘটেছে তাতে এই দুঃখজনক পরিস্থিতি মোটেই কাম্য নয়। পবিত্র মাতৃত্বও নিষ্কলঙ্ক থাকতে পারেনি। যখন একজন শিশু তার মায়ের অবহেলা এবং দুর্ব্যবহারের শিকার হয় তখন তার পক্ষে আর কোন কিছুই এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হতে পারে না। প্রায়শই যে তার নিজের পিতাসহ অন্যান্য সমস্ত মানুষের কাছ থেকে একই আচরণ পেয়ে থাকে।

শিক্ষার যদি দুর্বল চরিত্রের হয় তাহলে সে নির্বোধও সমাজের কাছে বোঝা হবে আর সে যদি দৃঢ় চরিত্রের হয় তাহলে সে বিদ্রোহী এমনকি অপরাধী হবে, সর্বত্র সে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে চাইবে এবং সকলের সমস্যা তৈরী করবে। সে সমাজে সঠিকভাবে মানিয়ে নিতে পারবে না এবং উপযুক্ত বোধ ও সাহসের সঙ্গে জীবনের সমস্যার মোকাবিলা করতে পারবে না। তার প্রতিভা বিনষ্ট হবে যেহেতু তাদের বিকাশের সুযোগ হারিয়ে যাবে। তার জীবন দুঃখময় হয়ে উঠবে। এই সমস্ত কিছুর কারণ হল মাতৃত্ব সমাজ ও পরিবারের প্রতি তার কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হয়েছে । যদিও বাবা সাধারণত প্রধান উপার্জনকারী কিন্তু সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে মায়ের ভূমিকা বেশী গুরুত্বপূর্ণ।
শিশুর পরিপূর্ণ ও সুস্থ বিকাশ পরিবারিক শাস্তি, পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক সহযোগিতা প্রধানতঃ মায়ের দক্ষতার উপর নির্ভর করে। এই কারণে তাঁর-প্রধান মনোযোগ থাকা উচিত পবিত্র মাতৃত্বের প্রতীক হিসেবে তাঁর অবস্থানকে সুরক্ষিত রাখা। সিংহলী গ্রামবাসীদের মধ্যে জনপ্রিয় একটি প্রবাদে বলা হয়েছে, “যদি না ভালো হয় তাহলে মেয়ে অবশ্যই ভালো হবে ঠিক যেভাবে পেষক যন্ত্রটি ভালো অবস্থায় থাকলে হলুদ গুঁড়ো তার গুণ বজায় রাখে।”
অন্য একটি লোক প্রবাদে বলা হয়েছে, “যদি মা হারিয়ে যায় তাহলে বাবার কাছ থেকে কি আশা করা যায়? এখানে দেখা যাবে যে কেমন করে ঐতিহ্যশালী লোক প্রজ্ঞা বুদ্ধের বাস্তবধর্মী প্রজ্ঞার সঙ্গে মেলে। খারাপ মায়েদের হাতে অবাঞ্ছিত সন্তান এর সমস্যা ছাড়াও আরও কিছু মা রয়েছে যারা নিজের সন্তানদের মধ্যেই কোন বিশেষ এক জনকে প্রিয় বলে মনে করেন। এতে সকলেরই সমস্যা হয় বিশেষ করে অন্যান্য ভাই বোনদের। এটি অনৈক্যের একটি সাধারণ উৎস যা সকলের পক্ষেই ক্ষতিকর, এতে কারোরই মঙ্গল হয় না। একজন মায়ের ভালবাসা সমস্ত সন্তানদের জন্যই সমান হওয়া উচিত। উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুদ্ধের মাতৃত্বকে উচ্চ আসনে স্থাপনের যথার্থতা সহজেই প্রমাণিত হয় এবং এই কারণেই তিনি সমস্ত মায়েদের একত্রে শ্রদ্ধার সঙ্গে ‘মাতৃগাম' বলে সম্বোধন করেছেন।

হিন্দুধর্মে মা:

হিন্দুধর্ম অনুসারে ঈশ্বর এই জগৎ সৃষ্টি, পালন ও ধ্বংস করেন কিন্তু যে ক্ষমতার দ্বারা এই কাজগুলি করা হয় তাকে বলা হয় শক্তি, বা স্বর্গীয় মা। এটি মাতৃপূজার উৎস এবং এর অর্থ হল মানুষরূপী মা-ও স্বর্গীয় মায়ের মত শ্রদ্ধা ও পূজার যোগ্য। 'মাতৃদেব ভব' প্রবাদটি সেই নীতির কথা বলে যা পার্থিব বা জৈবিক মায়ের দৃশ্যতঃ অসীম ক্ষমতার কথা বলে, এটি হল সেই ক্ষমতা যা ঈশ্বরত্বের সঙ্গে সমান।

হিন্দুধর্মে, মা হলেন এমন চরিত্র যিনি সবচেয়ে বেশী মর্যাদাপূর্ণ এবং যাঁকে সবচেয়ে বেশী শ্রদ্ধা ও সেবার যোগ্য বলে মনে করা হয়। ধর্ম শাস্ত্র অনুসারে তিনি পূজার যোগ্য পাঁচজন মায়ের অন্যতম। অসংখ্য স্তোত্র ও গাথায় নিজের সন্তানের প্রতি তাঁর ভালবাসাকে প্রশংসা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে মা হলেন সন্তানের প্রতি ভালোবাসা, ত্যাগ, সহ্যশক্তি এবং নিঃস্বার্থ সেবার প্রতি মূর্তি।

যুগে যুগে হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের পৃষ্ঠাগুলিতে মায়েদের অসাধারণ যে উদাহরণ পাওয়া গিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে নারী বিশেষতঃ মাকে বিভিন্ন ধরণের সম্পর্কের মধ্যে একটি অতি উচ্চ আসন দেওয়া হয়েছে। কেন না, একজন শিশু, তরুণ, বিবাহিত গৃহী ব্যাক্তি এমনকি রাজা হিসেবে মায়ের আচরণ মা-ই প্রথম গুরু এই প্রবাদটিকে মান্যতা দান করে। নিঃসন্দেহে তিনিই হলেন প্রথম ঈশ্বর। দৃষ্টান্তের মাধ্যমে তিনি শিখিয়েছিলেন মায়ের আশীর্বাদ-সাফল্য লাভের ক্ষেত্রে অপরিহার্য। সকালে উঠেই তাঁর প্রথম কাজ ছিল মায়ের আশীর্বাদ প্রার্থনা করা। মঙ্গলে যাওয়ার আগে তাঁর মায়ের শুভকামনা ও আশীর্বাদের প্রয়োজন ছিল। নির্বাসন থেকে ফিরে এসে তাঁর প্রথম কাজটি ছিল তাঁর মায়েদের চরণ বন্দনা করা। মায়ের সামান্য উপস্থিতি সন্তানকে সুরক্ষা দান করে; বিপরীতটি ঘটলে সে পরিপূর্ণতা থেকে বঞ্চিত হয়। সত্যিই মনুষ্যরূপী ভগবান রামের দৃষ্টান্ত পৃথিবীকে এই শিক্ষা দেয় যে শান্তির ও আশীর্বাদের উৎস হল মায়ের চরণতল। যেহেতু মায়ের গর্ভে থাকাকালীনই সে ভগবান বিষ্ণুর ভক্ত হয়ে উঠেছিল। মহা শিবপুরাণে বলা হয়েছে কেমন করে ভগবান শিব অভিমন্যু নামে এক শিশুর অনুরোধ রেখেছিলেন যাকে তার মা ‘পঞ্চক্ষর মন্ত্র' দ্বারা ভক্তি শিক্ষা দিয়েছিলেন। ধর্মশাস্ত্রগুলিতে এমন অনেক ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে সন্তানের প্রতিপালনে মায়ের কার্যকরী ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। তাঁর স্থান কেউই গ্রহণ করতে পারবে না। ধর্মশাস্ত্র থেকে নেওয়া নিম্নলিখিত উদ্ধৃতিটিতে শিক্ষক হিসেবে মায়ের ভূমিকাকে যথার্থভাবে তুলে ধরে হয়েছেঃ “প্রাপ্য শ্রদ্ধার ভিত্তিতে বিচার করলে একজন শিক্ষক একজন বক্তৃতা কারকের থেকে দশগুণ বেশী শ্রদ্ধেয় একজন পিতা একজন শিক্ষকের থেকে একশ গুণ বেশী শ্রদ্ধেয়, একজন মাতা একজন পিতার থেকে হাজার গুণ বেশী শ্রদ্ধেয়”।

যেহেতু মাতৃ দিবস পার্থিব মাকে এই মাসে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, তাই মায়ের অবদান নিয়ে চিন্তা করা যথেষ্ট প্রয়োজন যেহেতু সাতজন্মে কেউই তার পিতামাতার ঋণ পরিশোধ করতে পারে না ।

ইসলাম ধর্মে মাতৃত্ব:

ইসলাম ধর্মে নারীকে বেশী ক্ষমতা দান করা হয়েছে এবং তাদের অধিকারও পুরুষদের তুলনায় বেশী। মায়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন যেহেতু ইসলাম ধর্মে মায়ের অত্যন্ত মূল্যবান ও মর্যাদাপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাদের অবদানকে প্রশংসা করা হয়েছে এবং স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। একবার একজন ব্যক্তি পয়গম্বর মহম্মদকে মায়ের মর্যাদা সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন ‘মায়ের পদতলে স্বর্গ রয়েছে।'

অন্য কথায় বলতে গেলে যারা মাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করে তাদের জন্য স্বর্গের দ্বার উন্মুক্ত হয়। সমগ্র পরিবারেই মা অত্যন্ত শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর কথা মান্য করতে হবে। পবিত্র কোরানে এমন অনেক গাথা/আয়াত রয়েছে যেখানে মায়ের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। পবিত্র পয়গম্বর মায়ের উপর ভালোত্ব অর্পণ করেছেন। একজন মানুষ কার সঙ্গে ভালো আচরণ করা উচিত এই প্রশ্ন নিয়ে পয়গম্বরের কাছে এলে তিনি তাকে মায়ের প্রতি ভালো হওয়ার ও আচরণ করার পরামর্শ দিলেন। লোকটি তিনবার একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে পয়গম্বর তাকে একই উত্তর দিলেন। চতুর্থবার পয়গম্বর তাঁকে বাবার প্রতি ভালো আচরণ করতে বললেন। এতে ইসলাম ধর্মে মায়ের মর্যাদা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। ঈশ্বরের পয়গম্বর মন্তব্য করেছেন, “একজন ব্যক্তি তার বাবা-মাকে আঘাত দিলে তা হবে সবচেয়ে ভয়ানক পাপগুলির অন্যতম"।

মায়ের সম্পর্কে পবিত্র কোরান:

আল্লাহ পবিত্র কোরানে মাত্র দুজন মহিলার নামোল্লেখ করেছেন; হযরত ঈশার মা মরিয়ম ও হযরত মুসার মা।পবিত্র কোরানে উল্লেখ রয়েছে যে ঈশার জন্মের পর মানুষ মরিয়মকে কুকথা বলেছিল। এক সময়ে তিনি মরে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে দুঃখ করতে বারণ করেছিলেন। তারপর তাঁকে খেজুর ও জল দেওয়া হয়েছিল। তবে তাঁকে পরপর তিনদিন কথা না বলে থাকতে বলা হয়েছিল। তিনদিন পর শিশুটি কথা বলতে শুরু করলে প্রমাণিত হল যে হযরত ঈশা এক অলৌকিক শিশু। (১৯: ২৩-২৬)।
অপর ঘটনাটি হযরত মুসার মায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত যিনি তাঁর সন্তানকে নদীতে ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন যদিও তাঁকে একই সঙ্গে নিশ্চয়তা দান করা হয়েছিল যে তাঁর সন্তান তাঁর কাছেই ফিরে আসবে। ফিরওয়ানের স্ত্রী শিশুটিকে নদী থেকে তুলেছিল কিন্তু শিশুটি তার পালিতা মায়ের স্তন্য পান করতে চায়নি। তাই হযরত মুসার বোন তাকে পরামর্শ দিল তার মাকে দিয়ে চেষ্টা করতে। এর ফলে মা ও সন্তানের পুনর্মিলন ঘটল। (সুরা তাহা ৩৭-৪০, ও সুরাহ কাসাস ৭-১৩)। নীচে পিতামাতা (মা) সম্পর্কে পবিত্র কোরানের গাথা(আয়াত)গুলি উল্লেখ করা হল।

“পিতামাতার প্রতি করুণা প্রদর্শন করুন; যদি তাঁদের কেউ বৃদ্ধ হন তাহলে কখনও তাঁদের সামনে উফ্‌ বলবেন না, সর্বদা দয়ালু বাক্যই বলবেন। তাদের নম্রতা ও কোমলতার সঙ্গে যত্ন করবেন। কখনও তাঁদের বকবেন না। প্রার্থনা করবেন, 'ঈশ্বর' এঁদের প্রতি দয়ালু হোল, ঠিক যেভাবে তাঁরা আমার শৈশবে আমাকে দয়া ও স্নেহের সঙ্গে আমাকে বড় করেছেন।” (সুরা বণী ঈসরায়েল ২৩-২৪)।

মায়ের গুণ:

সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা অতুলনীয়। সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা অতুলনীয়। সন্তান বাধ্য বা অবাধ্য, বৃদ্ধ বা যুবক, অসুস্থ বা স্বাস্থ্যবান যেমনই হোক না কেন মায়ের ভালোবাসা সবসময় সমান থাকে। একজন মা বিভিন্নভাবে সন্তানের প্রতি তাঁর ভালোবাসাকে প্রকাশ করেন, কখনও কখনও তিনি তাঁর সন্তানকে বকেন এবং তা শুধু এই কারণে তিনি তাঁর সন্তানের প্রতি অত্যন্ত যত্নশীল এবং তিনি চান না যে তারা কোন বিশৃঙ্খল কাজকর্মের মধ্যে জড়িয়ে পরুক। তবে, এই কারণে সন্তানরা মায়ের কারণে বাড়িতে থাকতে পছন্দ করে। পবিত্র কোরানে বলা হয়েছে, “ঈশ্বরকে পূজা কর এবং পিতামাতার প্রতি দয়ালু হও।”

অন্য কথায় বলা যায় পিতামাতা যদি বকেন বা মারেনও তাহলেও আমাদের তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যাবহার করা উচিত নয়। অনেক সন্তান তাদের নিজেদের আনন্দকে মায়ের সুখের চেয়ে উপরে স্থান দেয়। এত কষ্ট ও ত্যাগের পর এই তাঁদের পুরস্কার! আত্মত্যাগ ও নিষ্ঠা সন্তানের জন্য মায়ের আত্মত্যাগ অতুলনীয়; সন্তানকে ঠিকমত রাখার জন্য তিনি তাঁর নিদ্রাও ত্যাগ করেন। একজন ভালো মা তাঁর সন্তানের শারীরিক ও মানসিক প্রয়োজনকে নিজের প্রয়োজনের উপরে স্থান দেন। অন্য কোন সম্পর্কের মানুষই মায়ের মত সন্তানের শান্তির জন্য নিজের শান্তিকে বিসর্জন দেয় না। এই কারণে ইসলাম ধর্মে নারীদের বাড়িতে থেকে সন্তান প্রতিপালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কোরানে বলা হয়েছে, “মানুষকে বলেছি পিতামাতার প্রতি দয়ালু হতে; মা অনেক কষ্ট করে তাকে জন্ম দিয়েছেন ও দু'বছর ধরে স্তন্য দান করেছেন। আমার প্রতি ও পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও, আমিই হলাম অন্তিম গন্তব্য।” [পবিত্র কোরান ৩১:১৪] তবে এই গাথাটি সম্পর্কে শেখ আবদুর রহমান আস-সাদের বক্তব্য নিম্নরূপ —
“পিতামাতার প্রতি দয়ালু হও; তাঁদের জন্য ভালোবাসা, স্নেহ ও ভক্তি কর কাজে ও কথায়, তাদের সঙ্গে কোমল আচরণ কর এবং কখনও মৌখিক বা শারীরিকভাবে তাদের আঘাত কোরো না। তারপর আল্লাহ ব্যাখ্যা করলেন কেন আমাদের পিতামাতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা উচিত। তিনি বলেন, ‘গর্ভে সন্তানের নড়াচড়ার প্রথম মুহূর্তগুলি থেকে প্রসবের সময়কার তীব্র যন্ত্রনা ভোগ করা পর্যন্ত একজন মা অবিরত কষ্ট ও দুর্দশা অনুভব করে থাকেন। দু'বছর বয়সে পর্যন্ত স্তন্যপান করানো সময়ে মা তাঁর সন্তানের যত্ন করে থাকেন। তাহলে মা এই এত বছর দুঃখ, কষ্ট সহ্য করার পর ভালোবাসা ও যত্ন দেওয়ার পর আমরা কি মা আমাদের জন্য যা করেছেন তার জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে পারি না বা তাঁদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে পারি না" ?

জীবনে মায়ের ভূমিকা:

যদি একটি শিশু জন্মায় তখন সে বাইরের পৃথিবীর সম্পর্কে অচেতন থাকে। তাকে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে মা একটি প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকেন। সন্তানের জীবন সম্পূর্ণভাবে তার মায়ের উপর নির্ভরশীল থাকে। তার মতামত, তার আচরণ, ধর্ম ও অন্যান্য বিষয়ে তার ধারণা, তার লক্ষ্য সবই তার মায়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়। পরে পরিণত হবার পর তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয় কিন্তু প্রথমে সে যা শিখেছিল তা তার মনে গভীর ছাপ ফেলে যায়।

একজন মানুষ পয়গম্বরের কাছে এসে প্রশ্ন করল, “ও ঈশ্বরের বার্তাবাহক। মানুষের মধ্যে কে আমার ভালো ব্যবহারের যোগ্য? তখন পয়গম্বর উত্তর দিলেন, তোমার মা। তখন লোকটি জিজ্ঞাসা করল, “তারপর কে?” পয়গম্বর উত্তর দিলেন, তোমার মা। লোকটি আবার প্রশ্ন করল, ‘তারপর কে?' পয়গম্বর উত্তর দিলেন, “তারপর তোমার মা। (বুখারি, মুসলিম)এই হাদিসে পয়গম্বর ‘তোমার মা' কথাটি তিনবার বলে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিলেন যে বাবার চেয়ে মায়ের গুরুত্ব বেশী।

সন্তানের পক্ষে দৃষ্টান্ত স্বরূপ:

মা যেহেতু সন্তানের বড় হওয়ায় একটি প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেন তাই তিনি প্রভূত সম্মান লাভ করেন। তাঁর অভ্যাস, আচরণ, জীবনযাপন এবং তাঁর থেকে সন্তান যা লক্ষ্য করে তার সবকিছুই সন্তানের উপর প্রভাব ফেলে। একটি বিখ্যাত উদ্ধৃতিতে বলা হয়েছে, ‘একজন মা একশজন শিক্ষকের থেকেও ভালো, এর অর্থ হল এই সন্তানের উপর মায়েদের নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত শক্তিশালী হয়। এই কারণে মায়েদের উপর সন্তানদের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। কখনও কখনও এটি মায়েদের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে।
ইসলাম মাতৃত্ব কতটা শ্রদ্ধা করে এবং সন্তান প্রতিপালনে মায়ের ভূমিকা কতখানি। সব মিলিয়ে আমরা বলতে পারি মা হল সম্পূর্ণ পরিবারের অভিভাবক। তাই সন্তানের কর্তব্য মাকে শ্রদ্ধা করা। তাই আল্লাহর বার্তাবাহকের হাদিসে বলা হয়েছে, তোমার মায়ের প্রতি দয়ালু হও।

বাইবেলে মাতৃত্ব:

বাইবেলের সর্ব মাতৃত্বকে অত্যন্ত মহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শিশুদের সর্বদা একটি আশীর্বাদ ‘ঈশ্বরের ঐতিহ্য --তাঁর কাছ থেকে পাওয়া” পুরস্কার হিসেবে দেখা হয়েছে।” (উপদেশ ১১৩ : ৫-৯)” i)” মাতৃত্বকেও একটি আশীর্বাদ স্বরূপ দেখা হয়েছে—যদিও একটি মঞ্জুর করার অধিকার একমাত্র ঈশ্বরেরই রয়েছে। এই আশীর্বাদের মধ্যে অনেক দায়িত্বও নিহিত থাকে। এর উদ্দেশ্য হল সুখ নিয়ে আসা (উপদেশ ১১৩ : ৫-৯)।
বাইবেল এই শিক্ষাদান করে যে ঈশ্বরই হলেন সেই সত্তা যিনি শিশুদের পরিবারের মধ্যে নিয়ে আসেন (উপদেশ ১১৩ : ৫-৯)। ঈশ্বর প্রায়শই অপ্রত্যাশিত প্রার্থীদের মাতৃত্বদান করেন এবং তাঁর করুণার বিস্ময়কর প্রকৃতি প্রমাণ করেন। যীশুর বংশের অনেক স্থানে ঈশ্বর হস্তক্ষেপ করে বন্ধ্যা রমণীকেও সন্তান দান করেছেন। যেমন আব্রাহামের স্ত্রী সারাহ, আইজ্যাকের স্ত্রী রেবেকা, স্যামুয়েলের মা হানা, জনের মা এলিজাবেথ এবং অবশ্যই যীশুর কুমারী মা মেরি।

বাইবেলে মায়েদের জন্য উপদেশ:

মাতৃত্ব হল একটি দায়িত্ব ও ঈশ্বরের আহ্বান তাঁকে মহিমান্বিত করার ও তাঁর সেবা করার অন্যতম উপায়। বাইবেল এই শিক্ষাদান করে যে মায়েদের ঈশ্বরে বিশ্বাসী হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন কারণ তাঁরাই সন্তানদের ঈশ্বরকে ভালোবাসতে শেখান। এতে সেই সমস্ত মায়েদের দৃষ্টান্ত রয়েছে যারা তাদের সন্তানদের উপর দু'রকম প্রভাবই রেখেছেন এবং এটি নির্ভর করে মায়ের জীবনযাপন শৈলী ও সন্তান প্রতিপালন পদ্ধতির উপর। ধর্মগ্রন্থগুলি থেকে জানা যায় যে, মায়ের সন্তানদের যীশুর দিকে চালিত করেন তাদের জন্য প্রার্থনা করে বিশ্বাস ও চরিত্র তৈরী করে, এবং তাঁদের প্রজ্ঞার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে (Proverbs 1:9, 29:15)।

ঈশ্বর প্রতীম মাতৃত্ব যা অর্জন করতে পারে সে বিষয়ে বাইবেল অনেক আশা দেখিয়েছে, তার কারণ হল এই যে চরিত্রবান সন্তানেরা সমাজ ও ঈশ্বরের রাজত্বের সম্পদে পরিণত হয়। Proverbs 22:6 এ সাধারণ নীতিটি বলা হয়েছে যে, “যদি আমরা আমাদের সন্তানদের কোন পথে যাওয়া উচিত সে বিষয়ে শিক্ষাদান করি তাহলে বৃদ্ধ হলেও তারা কখনও সে পথ থেকে বিচ্যুত হবে না।”

ঐতিহাসিক দৃষ্টান্তগুলির বিবেচনা:

লোইস ও ইউরিনস (2 Tim 1:5) পল বলেছেন যে টিমথির যে আন্তরিক বিশ্বাস ছিল সেটি সে পেয়েছিল তার দিমি লোইস ও মা ইউনিসের কাছ থেকে। মনে হয় যে যদিও ঈশ্বর তুল্য মানুষদের টিমথিকে যেভাবে মানুষ করা হয়েছিল তার ঘাটতি ছিল, এই সমস্ত মহিলাদের প্রভাব তাকে ধর্মপ্রচারক ও নেতা হতে সাহায্য করেছিল যা সমগ্র প্রাচীন গীর্জারই উপকারে এসেছিল। মনিকা (৩৩১ খ্রী:৩৮৭ খ্রী:)র তাঁর ছেলে অগাস্টিনের জীবনের উপর গভীর প্রভাব ছিল। একথা বলা থাকে যে স্বামীর সমর্থন ছাড়াই মনিকার উদাহরণ ও তাঁর প্রার্থনা শেষ পর্যন্ত অগাস্টিনকে ঈশ্বরের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি তাঁর মাকে বলেছিলেন, "অন্যান্য মায়েরা তাদের ছেলের পার্থিব মৃত্যুর জন্য যে চোখের জল ফেলে আমার আধ্যাত্মিক মৃত্যুর জন্য তার থেকে বেশী চোখের জল ফেলো। হিপ্পোর অগাস্টিন প্রাচীন গীর্জার অন্যতম অগ্রগণ্য ঈশ্বরতত্ত্ববিদ হয়েছিলেন।

বাইবেল অনুসারে একজন খ্রীষ্টান মায়ের কেমন হওয়া উচিত? বাইবেলে প্রথম যে মায়ের উল্লেখ পাওয়া যায় তিনি অবশ্যই হলেন ইভ। Genesis 3:20 -এ বলা হয়েছে, “মানুষ তার স্ত্রীর নাম ইভ রেখেছিল, কারণ সে হবে সমস্ত জীবিত প্রাণীর মা।” ‘ইভ' শব্দর অর্থ হল জীবন বা জীবিত; 'মা' হল হিব্রু 'em'। ওল্ড টেস্টামেন্টে 'em' কে মা অনুবাদ করা হয়েছে ২১৮ বার। কিন্তু এর সঙ্গে বিভাগ বা বিচ্ছেদের ইঙ্গিতও রয়েছে। (দেখুন Ezekiel এ বিচ্ছেদ 21:21 ) । এটি বোঝায় একটি পরিচর্যাকারী উৎস যেখান থেকে একই ধরণের চরিত্ররা উৎপন্ন হয়। ইংরাজীতে এটি দেখা যায়। ‘মাতৃভূমি’ ‘মাতৃত্ব’ ইত্যাদি শব্দের মধ্যে।
বাইবেলের বিশ্ব দর্শনে পিতামাতার উদ্দেশ্য হল সন্তানদের এমনভাবে বড় করা যাতে তারা ঈশ্বরকে অনুসরণ করে । এই উদ্দেশ্যে ঈশ্বর পরিবারকেই প্রাথমিক একক হিসেবে তৈরী করেছেন যেখানে সন্তানরা যত্ন, ভালোবাসা, শিক্ষা এবং ক্ষমতা পায়। এর জন্য দয়া ও শৃঙ্খলা দুটিরই প্রয়োজন হয়। স্ত্রী এবং মা হওয়ার মধ্যে অনেক উদ্বেগ লুকিয়ে থাকে। তাঁকে দয়ালু হতে হবে আবার একই সঙ্গে বাইবেলের প্রত্যাশা পূরণ করতে হবে এবং তাঁকে অবশ্যই জানতে কখন তাঁর সন্তানদের স্বাবলম্বী হবার সুযোগ দিতে হবে।
অধিকাংশ খ্রীষ্টান মা-ই এই বিষয়ে একমত হবেন যে সন্তানকে রক্ষা করার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি এবং তাকে সাবালকত্বে পৌঁছতে সাহায্য করা এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত কঠিন কাজ। মায়েদের তাঁদের সন্তানদের প্রতি ভালোবাসার কথা (Times 2: 4 ) তাদের প্রতি শ্রদ্ধা অনুভব করা তাদের অনুমোদন করা এবং তাদের প্রতি করুণার মনোভাব বজায় রাখার কথা মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে মায়েদের তাদের সন্তানদের এমনভাবে শিক্ষা দিতে হবে যাতে করে তারা ঈশ্বরের মত জীবন ( Psalm 78: 5-6 ) যাপন করতে পারে এবং কেমন ব্যক্তিগতভাবে তারা ঈশ্বরের রাজত্বে (Pranerb 22:6) অবদান রাখতে পারে তা শিখতে পারে।

শিশুরা সর্বদা এই কাজটি সহজ করে দেয় না। Deuteronomy 1 : 18-21 বলেছেন যে যদি একজন ইজরায়েলি শিশু তার বাবা মায়ের বিরুদ্ধে এমন বিদ্রোহী হয় যাতে করে তাদের নিজেদের এবং অন্যান্যদের জীবন বিপন্ন হয় তাহলে বাবা মায়ের দায়িত্ব হল তাকে কর্তৃপক্ষের কাছে সমর্পণ করা।
যদি তার অপরাধ অত্যন্ত গুরুতর হয় তাহলে দেশের শাসক তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিব্য করতে পারে। এই আইন নিঃসন্দেহে অবিশ্বাস্য রকম কঠিন যেহেতু একজন মায়ের প্রাথমিক প্রবৃত্তিই হল তার সন্তানকে রক্ষা করা এবং এমন কোন দৃষ্টান্ত নেই যে স্থানে। দেখা গিয়েছে এই আইনটি কখনও ব্যবহৃত হয়েছে। যীশু লুক ১৩ : ৩৪ এ মাতৃ সুলভ মনোবেদনার কথা বলেছেন যখন তিনি মন্তব্য করেছেন, জেরুযালেম ও জেরুসালেম। যে নগর ঈশ্বরের বার্তাবাহকদের হত্যা করে এবং যাদের এখানে পাঠানো হয় তাদের উদ্দেশ্যে পাথর ছোঁড়ে। কতবারই না আমি তোমার সন্তানদের রক্ষা করেছি যেমন করে একটি মুরগী তার সন্তানদের তা ডানার তলায় রক্ষা করে। “একজন খ্রীষ্টান মায়ের দায়িত্বের অংশ হল সন্তানরা না চাইলেও ঈশ্বরের পবিত্রতার ও চরিত্রের মূর্ত প্রতীক হওয়া এবং তা ব্যাখ্যা করা। (Deuteronomy ৬ : ৪-৭)। এটা জানা অত্যন্ত সত্যিই যীশুখ্রীষ্টকে বিদ্রোহী শিশুদের সামলাতে হয়েছিল। খ্রীষ্টান মাতৃত্বের অপর একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হল মা একই সঙ্গে জীবনদাত্রী এবং বিচ্ছেদের স্থান। Genesis 3 : 20এ প্রথম মা ইভকে জীবনের উৎস হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। জেনেসিস ১৭ : ১৬এ ঈশ্বর আব্রাহামের কাছে শপথ করেছিলেন যে ইভের সন্তানেরা পৃথিবীকে পূর্ণ করবে যার জন্য তাদের প্রয়োজন হবে তাকে ত্যাগ করার এবং সন্তানদের অন্তর্ভুক্ত হবে সকলে যারা যীশুকে অনুসরণ করে নিঃসন্দেহে একটি বৈচিত্রপূর্ণ ও বিশাল গোষ্ঠী। একইভাবে, মায়েদের একথা মনে রাখতে হবে যে, মাতৃত্বের উদ্দেশ্য হল শক্তিশালী ও স্বাধীন পূর্ণবয়স্ক মানুষের বিনাশ ঘটান (জেনেসিস ২:২৪)। যদি পূর্ণবয়স্ক সন্তান মায়ের কাছাকাছিও বাস করে তাহলেও মাকে সেই সন্তানকে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ হিসেবে স্বাধীনভাবে বাঁচার সুযোগ দিতে হবে। তিনি তাঁর মায়ের প্রজ্ঞাকে মর্যাদা দেবেন (Proverbs 31:2) কিন্তু একই সঙ্গে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেবেন—এমনকি সেই সিদ্ধান্তগুলিও যেগুলি তাঁর মা বুঝবেন না বা একমত হবেন না। (Mark 3:20- 21,31)
ঈশ্বর আশা করেন যে মাতৃত্বের উদ্বেগ মোকাবিলার জন্য খ্রীষ্টান মায়েদের দুটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য থাকবে। প্রথমটি অনুমান করা হয়েছে Proverb ১ : ৮-৯এর আমার পুত্র, তোমার বাবার নির্দেশ শোনো এবং মায়ের শিক্ষাকে পরিত্যাগ কোরো না, কারণ তারা তোমার মাথার জন্য একটি সুন্দর মালা এবং গলার জন্য হার। সন্তানকে মায়ের প্রজ্ঞার উপর বিশ্বাস করতে হলে মাকে প্রকৃতই জ্ঞানী হতে হবে। মায়েদের ঈশ্বরকে অনুসরণ করার প্রয়োজন আছে এবং পিটার ১ : ৩ এর উপর বিশ্বাস করতে হবে যেখানে বলা হয়েছে” তাঁর স্বর্গীয় ক্ষমতা আমাদের সেই সমস্ত জিনিস দিয়েছে যা জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত, তার জ্ঞানের মাধ্যমে যারা আমাদের তাদের নিজেদের মাহাত্য ও শ্রেষ্ঠত্বের সঙ্গে পরিচিত করিয়েছে। কিন্তু খ্রীষ্টান মায়েদের এঁফেসিয়ান্স ( ৬ : ৪) দ্বন্দ্ব মনে রাখতে হবে; পিতারা, আপনাদের সন্তানদের ক্রুদ্ধ করবেন না বরং তাদের শৃঙ্খলা পরায়ন করুন এবং ঈশ্বর নির্দেশ মানতে শেখান। যখন স্নেহ ও শ্রদ্ধা ছাড়া কোন কিছু দেওয়া হয় তখন শৃঙ্খলা ও প্রশিক্ষণ অত্যন্ত অবহেলিত হয়। এই দুটি যোগ করুন এবং আপনি এঁফেসিয়ান্স ৪ : ১৫ কে পাবেন যিনি ভালোবাসায় সত্য কথা বলবেন।

বাইবেল শুধুমাত্র জন্মদাত্রী মায়ের জন্যই মাতৃত্বকে সংরক্ষণ করে রাখেনি। Judges 5:7 পয়গম্বর, এবং বিচারক জেবারকে ইজরায়েল মা' হিসেবে সনাক্ত করছে আবার একইসঙ্গে তিনি ‘ইজরায়েলেরও মা'। তিনি প্রজ্ঞাদান করেছিলেন (Judges 4 : 5 ) এবং ঈশ্বরের নেতৃত্বে ইজরায়েলকে দেখিয়েছিলেন তার কোন পথে যাবে (গাথা ৬)। তিনি তাঁর ‘সাবালক সন্তানকে তাঁর সর্বদা উপস্থিতি ছাড়া নিজে থেকে ঈশ্বরকে অনুসরণ করতে শিখিয়েছিলেন (গাথা ৮-৯)। ডেবোরার প্রজ্ঞা ও পথনির্দেশের ফলে ইজরায়েল শাস্তি একটি বিরল পর্ব লাভ করেছিল (Judges 5:31 ) । সমস্ত নারীই ডেবোরার উৎসাহ ও পরিচর্যার দৃষ্টান্তকে অনুসরণ করতে পারেন এবং তাঁদের চারপাশে যাঁরা রয়েছেন তাদের একটি পরিণত, ফলপ্রদ ও ঈশ্বরকে সম্মান করা জীবনযাপন করতে প্রশিক্ষণ দিতে পারেন।

তবে একজন নারীর একমাত্র দায়িত্ব মাতৃত্ব নয়। তিনি ঈশ্বরেরও সন্তান (রোমানস ৮-১৪), সম্ভবত একজন শ্রদ্ধাশীল নারী (এফাসিয়েন্স ৫ : ৩৩), এবং স্থানীয় গীর্জার একটি অপরিহার্য অংশ (১ কেরিন্থিয়ান ১২ : ৪-৩১)। এই সমস্ত সম্পর্কের প্রতিটির ক্ষেত্রে একজন মহিলা সহায়তা প্রশিক্ষণ ও অপরের ক্ষমতায়নের মধ্যে দিয়ে খ্রীষ্টীয় মাতৃত্বকে প্রদর্শন করতে পারেন যাতে করে ঈশ্বরের রাজত্বে তারা নিজস্ব অবদান রাখতে পারে।

ইহুদী ধর্মে মাতৃত্ব:

জোনাথন স্যাক্স (জন্ম ১৯৪৭) হলেন একজন রক্ষণশীল ইহুদী কবির যিনি কেম্ব্রিজে নীতি বিজ্ঞান পড়েছিলেন এবং পরে সেখানেও অক্সফোর্ডের নিউ কলেজে গবেষণা করেছিলেন। তিনি মিডলসেন্স পলিটেকনিকে ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত নীতি দর্শন বিষয়ে বক্তৃতা দিয়েছিলেন এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে গিয়ে এবং ইহলৌকিক অতীন্দ্রিয়বাদী গোষ্ঠী লুবাভিচ হাসিডিমের সাক্ষাৎ করে তিনি একজন রাব্বি হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালে জিউম কলেজে তিনি রাব্বি হিসেবে মনোনীত হন এবং তারপর থেকে তিনি সেখানে মনোনীত হন এবং তারপর থেকে তিনি সেখানে অধ্যাপনা করে আসছেন। গত এগার বছর ধরে তিনি অবিরাম ইহুদী ছাত্রজীবনের সঙ্গে যুক্ত আছেন।

নারীর বা পুরুষের একটি ভূমিকা সম্পর্কে বলতে গেলে আধুনিককালে প্রতিক্রিয়াশীল বলে মনে হয়। আমরা জানি যে ভূমিকা নামক বস্তু আছে এবং এর সঙ্গে যুক্ত আছে কিছু নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতা। আমরা মেনে নিই যে একজন রাজনৈতিক নেতা, একজন ডাক্তার একজন বিজ্ঞানী বা একজন ধর্মীয় নেতার নির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে এবং এই কারণে তাদের একটি নির্দিষ্ট সামারিক পরিস্থিতিতে একটি নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করতে হয়। যেটি আশ্চর্যজনক এবং ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন তা হল এই যে একজন পুরুষকে পুরুষের ভূমিকা এবং একজন নারীকে নারীর ভূমিকা পালন করতে হবে পারে। এর মধ্যে অদ্ভুত বিষয়টি কোথায় ?

অদ্ভুত বিষয়টি নিহিত রয়েছে এই ধারনার মধ্যে যে ভূমিকা পছন্দ করে নেওয়া যেতে পারে। সম্ভবতঃ এই বিষয়টি যে সমস্ত বিষয় বিংশ শতাব্দীর নৈতিক বিপ্লবের বৈশিষ্ঠ্য তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে মানুষের স্বাধীনতা বিস্তৃত হয় সেই স্বাধীনতার মধ্যে যা হল আমাদের দায়বদ্ধতা ও বাধ্যবাধকতা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা। অল্প কথায় আমাদের ভূমিকা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতায়। যেহেতু আমরা পুরুষ হব না নারী হব তা নির্বাচনে আমাদের কোন স্বাধীনতা ছিল না তাহলে আমাদের এদের মধ্যে কোনটি হওয়ার মধ্যে কেন নৈতিক ও ধর্মীয় তাৎপৰ্য্য লুকিয়ে থাকবে।
অবশ্যই চেতনা উপকারী এবং অনেক দিক থেকে মুক্তিদানকারী। বিশেষত জাতিগত সহিষ্ণুতার ক্ষেত্রে এটি একটি মৌলিক সত্যকে উন্মোচন করেছে। একজন মানুষ কালো না ফর্সা হবে তা ঠিক করার বিষয়ে তার কোন স্বাধীনতা নেই। তাহলে কেন তার রং বা দেশ নৈতিক পার্থক্য তৈরী করবে? সঠিকভাবেই আমরা এই সিদ্ধান্ত উপনীত হই যে এটি কোন পার্থক্য করে না।

কিন্তু একটি নির্দিষ্ট স্থানে এসে এই যুক্তিগুলি ভেঙে যায় অথবা আমাদের অন্তত কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলে। একটি শিশু জন্ম নেবে কিনা তা স্থির করার ক্ষমতা শিশুটির থাকে না। অতএব যুক্তি সঙ্গতভাবে বাবা মায়ের প্রতি তার বিশেষ কোন কর্তব্য নেই। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক দুর্ঘটনা প্রসূত, তার নিজের তৈরী নয় তাই এই সম্পর্ক তার উপর বিশেষ কোন দাবী করতে পারে না। একথা স্বীকার করতেই হবে যে এমন অনেক মানুষ রয়েছে যারা এই যুক্তিটিকে বহুদূর নিয়ে যাবে এবং দাবী করবে যে পরিবার হল একটি স্বৈরতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং শিশুদের মুক্তি দেওয়া উচিত। কিন্তু অনেকের কাছেই এটি হবে এমন কিছুকে অস্বীকার করা যাকে আমরা অত্যন্ত মূল্যবান বলে মনে করি- মানুষের ভালোবাসা ও পারস্পরিক দায়বদ্ধতার কেন্দ্র হিসেবে পরিবারের অবস্থান, যেখানে একটি শিশু বিশ্বাস করতে, সাড়া দিতে শেখে এবং নৈতিক দায়ি দায়িত্বশীল একটি মানুষ হয়ে ওঠে।

ইহুদী ধর্ম, বিশ্বাস করেছে এবং বিশ্বাস করে চলেছে ধর্মীয় জীবনের মধ্যে নারী ও পুরুষের সুস্পষ্ট ও পৃথক ভূমিকা রয়েছে। সমানভাবে একটি আধুনিক ও বহুত্ববাদী সমাজের একজন সম্পূর্ণ অংশগ্রহণকারী হিসেবে একজন ইহুদী অনুভব করে যে তাকে তার সময়ের নৈতিক চেতনার প্রতিটি আন্দোলনেই সাড়া দিতে হবে। তাকে অবশ্যই প্রতিটি অগ্রগতিকে স্বাগত জানাতে হবে, প্রতিটি পশ্চাদমুখীনতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে এবং সে যেটাকে বিভ্রান্তি বলে মনে করে তা নির্ণয়ের জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করতে হবে। তার ইতিহাস ও ঐতিহ্য তাকে নৈতিক বিতর্কের এক সমৃদ্ধশালী উৎস দান করে যা এক সহস্রাব্দ পিছিয়ে চলে যায়। একইভাবে এগুলি তার মধ্যে মোকাবিলা থেকে পিছিয়ে আসার এক অনিচ্ছার জন্ম দেয়, তা নিজের থেকেই হোক বা বৃহত্তর সমাজের থেকেই হোক।

তাই সে নারীর ভূমিকার বর্ণনার ক্ষেত্রে যে প্রশ্নচিহ্ন থাকে তার থেকে মুক্ত হতে পারে না এবং প্রকৃতপক্ষে এটি সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ইহুদী সম্প্রদায়ের মধ্যে এক ব্যাপক আত্ম অনুসন্ধানের জন্ম দিয়েছে। এই অনুসন্ধানের ইহুদী ধর্ম জীবনের বিষয়গুলির মধ্যে দিয়ে তার দায়বদ্ধতার কেন্দ্র পর্যন্ত একটি পথ গ্রহণের প্রয়োজন আছে। এটি একটি যাত্রা যেখানে থেকে অনেক ইহুদি তাদের বিশ্বাসের এক নতুন বোধ নিয়ে বেরিয়ে এসেছেন এবং এই বিশ্বাসটি এখানে গ্রহণ করা উচিত।