গ্রন্থ : বড়ুয়া জাতির আত্ম পরিচয়।
লেখক : রক্তিম বড়ুয়া ।
পৃষ্ঠা সংখ্যা : I-XX ও ৪৮৪।
ভাষা: বাংলা।
মূল্য : চারশত টাকা মাত্র। প্রকাশক : আমরা মারমাগ্রী, একটি সংগঠন, চট্টগ্রাম। প্রকাশকাল : ২৫৬৩ বুদ্ধাব্দ, ডিসেম্বর, ২০১৯।
ভারতীয় উপমহাদেশে নানাবিধ গণতন্ত্র জাতিসত্তা মধ্যে অন্যতম হল 'বড়ুয়া' তবে আজ হতে প্রায় ১৫০- ২০০ বৎসর পূর্বে ও বড়ুয়া শব্দটি ছিল শুধুমাত্র উপাধি। বর্তমানেও 'বড়ুয়া' জাতিসত্তায় বড়ুয়া, চৌধুরী, তালুকদার, মুৎসুদ্দি সিংহ এরূপ নানাবিধ পদবী তথা উপাধি পরিলক্ষিত হয়। তবে আরও পূর্বে সিং, প্রু, মেঙ ইত্যাদি উপাধিও বিদ্যামান ছিল। তবে রাজনৈতিক জটিলতার কারণে তথা উক্ত পরিস্থিতি হতে পরিতাপের নিমিত্তে সম্ভবত উক্ত উপাধিটিকে (বড়ুয়া) জাতিসত্তায় বহুল পরিমাণে ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয়েছিল বলে মনে করা হয়। আবার রাজবংশী (রা.), ভূইয়া, মগ বা মারমাগ্রী 'বড়ুয়া' জাতিসত্তার অপর নাম। লেখক রক্তিম বড়ুয়া তার সম্পূর্ণ গ্রন্থে অনেক ক্ষেত্রে জাতিগত অর্থে 'মারমাগ্রী বা বড়ুয়া' একই অর্থের সমার্থক রূপে ব্যবহার করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখনীয় যে, এই জাতিসত্তা শাক্য বংশোদ্ভূত। রাজ্য বিস্তারের কারণে অথবা নিজ জাতিসত্তার অস্তিত্ব সংকট হতে পরিত্রাণের অভিপ্রায়ে তারা প্রথমে মগধ অঞ্চল (বর্তমান ভারতের বিহার রাজ্যের একটি অঞ্চল) এবং কালক্রমে আরাকান অঞ্চলে উপস্থিত হয় তথা চন্দ্রবংশ নামে পরিচিত হল। চন্দ্রবংশীয় রাজবংশের দুই উল্লেখনীয় রাজা ছিলেন বাহুবলী। এবং রঘুপতি। উভয়েই ছিলেন সহোদর ভ্রাতা। কথিত আছে যে রাজা বাহুবলীর বংশ ‘বড়ুয়া' এবং রাজা রঘুপতির বংশ 'মারমা ও রাখাইন' জাতিসত্তা রূপে পরিচিত লাভ করে। মধ্যযুগে এই তিনটি জাতিসত্তা 'মগ' নামে সমাদৃত হয়। এই মগ বংশোদ্ভূত শাসকগোষ্ঠী সম্মিলিতভাবে আরাকান ও তার পার্শ্ববর্তী ১২টি নগরে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। তবে মধ্যযুগের শেষার্ধে ভারতীয় উপমহাদেশে ক্রমাগত যুদ্ধ এবং বহিরাগত জনগোষ্ঠীর আক্রমন ইত্যাদি কারণে মগরাজ্য বিলুপ্ত হয় পড়ে ও আরাকান অঞ্চল বার্মার (বর্তমান মায়ানমার) শাসকগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণভুক্ত হয়ে পড়ে। ভারতীয় উপমহাদেশে ইউরোপীয় বণিকদের আগমন তথা বৃটিশ শাসনকালে বড়ুয়া জাতিসত্তাকে একটি পৃথক জাতি তথা স্বতন্ত্র জাতিসত্তা রূপেই গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে (১৯৪৭-১৯৭১ খ্রীঃ) ভারত, বাংলাদেশ ইত্যাদি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের উৎপত্তির পরবর্তী সময়ে বড়ুয়া জাতিসত্তার ইতিহাসকে বিকৃত করে তাদের বাঙালি হিসেবে পরিচয় প্রদানের প্রচেষ্টা চলছে। আলোচ্য গ্রন্থে 'বড়ুয়া' যে একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তা তার একটি সুনির্দিষ্ট রূপরেখা প্রদান করা হয়েছে। সর্বোপরি লেখক বড়ুয়া জাতিসত্তার অপর দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় 'মগ' তথা ‘মারমাগ্রী’কেও পুনঃ পুনঃ আলোচনার মাধ্যমে গুরুত্ব প্রদান করেছেন।
বড়ুয়া জাতির আত্মপরিচয় ( রক্তিম বড়ুয়া) গ্রন্থটি ৯টি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রথম অধ্যায়ে লেখক প্রাককথনে রাষ্ট্র জাতিসত্তা, জাতীয়তাবাদ, সম্প্রদায়, বর্ণ, গোত্র ইত্যাদি বিষয়গুলিকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলোচনা করেছেন এবং এই অধ্যায়ে পৃ: ১২ তে তিনি প্রশ্ন রেখেছেন—.... আমাদের জাতিসত্তার পরিচয় কি নেই? মারমা, রাখাইন, চাকমা নিজেদের সন্তানকে কি পরিচয় দিবে? তারা মারমা বা বাঙালী? বড়ুয়া বা বাঙালী? তিনি আরও বলেছেন *জাতিসত্তার পরিচয় প্রদানে শুধু ভাষা নয় ভৌগোলিক ও নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও মূল্য' (পৃ: ১৩)। এই ....বড়ুয়া জাতির ইতিহাস অনুসন্ধান এবং স্বতন্ত্র জাতিসত্তার আত্মপ্রকাশই হল এই গবেষণার মূল লক্ষ্য' (পৃ: ১৬)। লেখক এই গ্রন্থে 'বড়ুয়া বা মারমাগ্রী' জাতির ইতিহাস প্রসঙ্গে গবেষণার যৌক্তিকতা এবং তার সীমাবদ্ধতার বিষয় প্রসঙ্গেও যথে াচিতভাবে আলোচনা করেছেন।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে মগ জাতি, মগ জাতির উৎপত্তি সংক্রান্ত তত্ত্ব এবং মগদের শ্রেণীবিন্যাস। আলোচনার বিষয়বস্তু প্রথম অধ্যায়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই আলোচনা করা হয়েছে। মগ জাতি সম্পর্কিত আলোচনায় উঠে এসেছে 'মগের মুল্লুক' নামক বাংলা ঘৃণিত প্রবাদ বাক্য তথা গঙ্গার অন্য তীরে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত মঙ্গোলীয় আরাকানী জনগোষ্ঠীর কথা। লেখক এই প্রসঙ্গে বিভিন্ন ঐতিহাসিকগণের গ্রন্থ ইত্যাদি 'মগ' শব্দের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ব্যবহার করেছেন। মগ জাতির উৎপত্তি সংক্রান্ত তত্ত্বে (পৃ: ৩০-৩৭) আলোচিত হয়েছে বেশকিছু মূল্যবান তত্ত্ব এবং সেগুলি হল— ক. মগী তত্ত্ব, খ. দস্যু তত্ত্ব, গ. মিশ্রিত জাতি তত্ত্ব, ঘ. আঞ্চলিকতা তত্ত্ব এবং ঙ. মগধ তত্ত্ব।
মগদের শ্রেণী বিন্যাস প্রসঙ্গে লেখক 'ইষ্ট বেঙ্গল জেলা গেজেট' (১৯০৮ খ্রী: পূ: ৬০-৬১) প্রদত্ত তত্ত্ব উল্লেখ করে আলোচনা করেছেন যে চট্টগ্রামের মগ জাতি তিন অংশে বিভক্ত (পৃ:৩৭-৩৯) এবং এদের সিংহভাগই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। উক্ত অধ্যায়ের (পৃ:৪৫) অন্তিমে একটি শ্লোক প্রদান করেছেন (টীকা-১)। ফলে 'মগ' জাতির বর্ণিতত্ত্বটিও আলোচিত হয়েছে। অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ বর্ণের ব্রাহ্মণই হল মগ। গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ের আলোচনার বিষয়বস্তুতে মারমা, রাখাইন এবং বড়ুয়া বা মারমাগ্রী মগদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি প্রসঙ্গে বর্তমান বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত বৌদ্ধ মারমা জাতির উদ্ভব, ভাষা, আংশিক ইতিহাস ব্যক্ত করেছেন। রাখাইন জাতি (৩.৩) প্রসঙ্গে লেখক বলেছেন— 'রাখাইনদের হাজার বছরের পুরাতন এক সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে আদি ব্রাহ্মীলিপিতে প্রথম লিখিত আকারে পালি ভাষায় 'আরাখা' অর্থাৎ রক্ষ বা রক্ষিতা অথবা রক্ষক শব্দ হতে রাখাইন (পৃ:৫৩ ) শব্দের উৎপত্তি গ্রন্থে (পৃ: ৫৪-৫৫) রাখাইন জাতির যুদ্ধাভিযান, ১৭৮৪ খ্রীঃ বর্মীরাজ কর্তৃক আরাকান দখল, বৃটিশ শাসনকালে রাখাইন জাতির পুনর্বাসন ইত্যাদি বিষয়গুলি তথ্যসমৃদ্ধভাবে আলোচনা করেছেন। তিনি আরও বলেছেন উত্তর ভারতের আদি ব্রাহ্মী লিপি হতে রাখাইন বর্ণমালার (পৃ:৫৫) উৎপত্তি।
বড়ুয়া বা মারমাগ্রী জাতি প্রসঙ্গে 'বড়ুয়া' শব্দের প্রকৃত বুৎপত্তিগত অর্থ (পৃ: ৫৬-৫৭) অত্যন্ত সুন্দর ভাবে বিবৃত হয়েছে। যেমন— চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের পদবী ও অহমিয়া হিন্দু তথা উক্ত অঞ্চলের কোন কোন মুসলমানদের পদবী বড়ুয়া (পৃ: ৫৬)- বড় বড় + উয়া (বড় ঘর অর্থে বড়ুয়া)। মারমাগ্রী শব্দের অর্থ এবং ইতিহাস আলোচনা হয়েছে। লেখক অত্যন্ত সুন্দর এবং যুক্তিপূর্ণভাবে মারমাগ্রী (বড়ুয়া) প্রসঙ্গে বলেছেন— 'ম্রোহ্মা' অর্থাৎ ব্রহ্মবাসী এবং ওয়াগ্রী মানে বড়। অর্থাৎ ব্রহ্মবাসীর চেয়ে মগধাগতরা বড়; গ্রন্থের (পৃ: ৬২) আলোচনায় উঠে এসেছে বড় য়া, মারমা এবং রাখাইনরা পূর্বে একই জনগোষ্ঠী ছিল কিন্তু পরবর্তীতে তারা বিভক্ত হয়ে যায় এবং পৃথক জাতি গোষ্ঠীতে পরিণত হয় (মারমাগ্রী রাজোয়াং শ্রীমৎ বিমলাচরণ মহাথের)। গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়ের বিষয়বস্তু হল বড়ুয়া বা মারমাগ্রী জাতির উৎপত্তি সম্পর্কিত মতবাদ এবং যুক্তি খণ্ডন। গ্রন্থের (পৃ: ৬৭) এই অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে বড়ুয়া বা মারমাগ্রী জাতির উৎপত্তি সম্পকির্ত মতবাদ। বড়ুয়া'গণ জাতিতে বাঙালী নয়— এই প্রসঙ্গটি ও অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যেমন— (১) যারা বিশ্বাস করেন এই বড়ুয়া জাতি বাঙালি তারা আদৌ এই জাতি কোন সুনির্দিষ্ট বংশের উত্তরাধিকারী তার প্রমাণ দিতে পারেন নি। কারণ তারা যদি পাল বংশের উত্তরসূরী হয় তবে তাদের নামের শেষে বড়ুয়া না লিখে পালই লিখত (পৃ: ৭৩)। (২) চট্টগ্রাম সুদূর অতীতে যে আরাকানেরই একটি অংশ ছিল সে বিষয়ে এই তত্ত্বের ধারণাকারীরা (বড়ুয়া'রা জাতিতে বাঙালী) অবগত নন। (৩) মারমাগ্রী বা বড়ুয়া'রা ত্রিপুরা হতে আগত তত্ত্বে দেখা যায় রাজমালা'য় বর্ণিত রাজাদের বড়ুয়া উপাধি থেকেই বড়ুয়াদের ত্রিপুরা থেকে এসেছে এরূপ ধারণার উৎপত্তি হয়।... তারাও যে আমাদের মত (মারমাগ্রী বা বড়ুয়া) একই জাতির তার হদিস রাজমালা কিংবা ত্রিপুরার অন্য কোন গ্রন্থে বিবরণ নেই (পৃ:৭৫)। লেখক তত্ত্বগতভাবে প্রমাণ করেছেন যে মারমাগ্রী বা বড়ুয়া'রা আরাকান আগত। গ্রন্থের পঞ্চম অধ্যায়ের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল বড়ুয়া বা মারমাগ্রীরা। মগধ-আরাকানী বংশোদ্ভূত। এই অধ্যায়ের প্রারম্ভে চট্টগ্রামের ভৌগোলিক ইতিহাস প্রায় সংক্ষিপ্তাকারে আলোচিত হয়েছে। লেখক 'রাজোয়াং' নামক গ্রন্থের তত্ত্ব প্রদান করে বলেছেন—..... পৃথিবী সৃষ্টির পর প্রথম রাজা মহাসম্মত জম্বুদ্বীপের মজঝিম প্রদেশের সাথে সংযোগ স্থাপনের লক্ষে আরাকান নগর প্রতিষ্ঠা করেন' (পৃ: ৮২)।
পাগান সাম্রাজ্যভুক্ত আরাকান ও চট্টগ্রাম এবং তার পরবর্তী ইতিহাস সবিস্তারে আলোচনা করেছেন। তবে পাগান সাম্রাজ্যের উৎপত্তি এবং কোন রাজবংশ কীভাবে পাগান সাম্রাজ্য সৃষ্টি করল সেই বিষয়টি লেখক উল্লেখ করেন নি। ফলে এই বিষয়ে একটি অসামঞ্জস্যতা তৈরী হয়। যাই হোক এই অংশে লেখক (১০৫৭-১৭২৫ খ্রীঃ) বিভিন্ন রাজবংশের শাসন, মোগল যুগে চট্টগ্রাম ও আরাকানের মোগল সাম্রাজ্যভুক্তি তথা চট্টগ্রামের তৎকালীন কর্মরত দেওয়ানগণের সুদীর্ঘ নরসিংহ রায় হতে রামসিংহ (১৬৬৬ হতে ১৭৬০ খ্রীঃ) রচনা করে পাঠককূলের অনুসন্ধিৎসা বৃদ্ধি করেছেন। এছাড়া তিনি উক্ত অঞ্চলের তৎকালীন সময়কালের (মুঘল শাসনকালে, ফৌজদারগণের বকশি) মির্জা খলিল হতে নূরদ্দিন মোহাম্মদ (১৬৬৯ খ্রীঃ হতে ১৭১৩ খ্রীঃ) সম্পর্কিত তথ্যও প্রদান করেছেন। তবে সুলতানী যুগ হতে মোগল যুগ পর্যন্ত চট্টগ্রাম তথা আরাকান অঞ্চলের মগ জাতির জনজীবন কীরূপ ছিল তার উল্লেখ করেন নি। ফলে বিষয়বস্তুর ভাব প্রখরভাবে পরিস্ফুট হয়নি। গ্রন্থের (পৃ: ৮৯) পঞ্চম অধ্যায়ে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর শাসন কালে (১৮৫৭ খ্রীঃ) সিপাহী বিদ্রোহে চট্টগ্রামের সিপাহীদের বিদ্রোহ আলোচিত হয়েছে। তবে উক্ত বিদ্রোহে মগদের অংশগ্রহণ সম্পর্কিত কোন তথ্যই লেখক উল্লেখ করেন নি। চট্টগ্রামের ভাষা প্রসঙ্গে লেখক অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণভাবে উল্লেখ করেছেন যে এই ভাষা কোনরূপে উপভাষা নয় (পৃ: ৯১) বরং একটি পৃথক ভাষা। লেখক উক্ত প্রসঙ্গে আরও বলেছেন— .... ভাষাগত পার্থক্য জাতিসত্তাতে বৈচিত্র্য আনে বক্তব্যটিকে উল্টে দিয়ে যদি বলি, জাতিসত্তার বৈচিত্র্য ভাষায় পার্থক্য গড়ে। তবে কি ভুল হবে? (পৃ: ৯৫)'।
উক্ত (পৃ: ৯৫) আলোচনায় তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, '... প্রাচীনকালে এই অঞ্চলে (বিষয়বস্তু চট্টগ্রাম নামকরণে আরাকানী প্রভাব) অঞ্চলে আরাকানী শাসন থাকার কারণে এখানে অসংখ্য বৌদ্ধ চৈত্য অবস্থিত ছিল বলে এ স্থানের নাম হয় চৈত্যগ্রাম... পরবর্তীকালে চৈত্যগ্রাম নাম বিবর্তিত হয়ে চট্টগ্রাম রূপে প্রাপ্ত হয়।' তবে তিনি আরও বলেছেন যে চিৎ-তৌৎ-গৌং হতে চট্টগ্রাম, চাটিকিয়াং হতে চট্টগ্রাম ইত্যাদি। তবে এই নামকরণ প্রসঙ্গে তিনি নানাবিধ ঐতিহাসিক তথ্য উল্লেখ করেছেন। ফলে চট্টগ্রামের নামকরণ প্রসঙ্গে এই সুস্পষ্ট ধারণা পাঠকগণের সম্মুখে দর্পণের প্রতিবিম্বের ন্যায় উদ্ভাষিত হয়েছে। গ্রন্থের এই অধ্যায়ে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল লেখক পাঠকের সম্মুখে উপস্থাপন করেছেন, সেটি হল চট্টগ্রামের বড়ুয়া বা মারমাগ্রী বৌদ্ধদের পদবীর ইতিবৃত্ত'। এখানে (পৃ: ১০৭-১১৯) বড়ুয়া (মারমাগ্রী) জাতিসত্তার বহুবিধ পাবৌর ইতিহাস এবং বিবর্তন অত্যন্ত তথ্যবহুল ভাবে লেখক আলোচনা করেছেন। এই প্রসঙ্গে লেখক আরও তথ্য প্রদান করেছেন। আরবা এবং রাখাইনদের মতে, ‘বড়ুয়া' শব্দটি এসেছে 'বো-রোয়া' থেকে। 'বো' শব্দের অর্থ 'গৌন্য' এবং 'রোয়া' অর্থে গ্রাম। অর্থাৎ সম্পূর্ণ অর্থে সেনানিবাস।
পঞ্চম অধ্যায়ের সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু দীর্ঘায়িত এবং বিভিন্ন ক্রমান্বয়ে বিভক্ত উক্ত অধ্যায়ের (পৃ: ১২০-২১৫) এই অংশের বিষয়বস্তু আবার ৪ টি পর্বে বিভক্ত। যেমন— মারমাগ্রী বা বড়ুয়াদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে (৫.৩) রয়েছে উক্ত জাতি গোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা। দ্বিতীয় পর্বে আলোচিত হয়েছে 'প্রত্নতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞানে বড়ুয়া বা মারমাগ্রী জাতি'। তৃতীয় পর্বে ব্যাহ্যাত হয়েছে 'ভাষাতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞান' এবং চতুর্থ পর্বে আলোচিত হয়েছে 'কলা নৃবিজ্ঞান' । এই চারটি পর্ব অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এই অধ্যায়টি সম্পূর্ণভাবে অধ্যয়ন এবং উপলব্ধি না করলে পূর্বোক্ত ৪ টি অধ্যায়ের বিষয়বস্তু সমূহকে ক্লান্তিকর বলে মনে হবে। এই অধ্যায়ের লেখক মূল নির্মাণ সম্পূর্ণরূপে পাঠক কুলের সম্মুখে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পরিবেশন করেছেন বিষয় বস্তু নিষ্ঠতর হলেও ক্লান্তিকর নয় বরং অমৃত রসে পরিপূর্ণ। এই গ্রন্থের ষষ্ঠ অধ্যায়ের বিষয়বস্তুর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল 'বড়ুয়া বা মারমাগ্রীদের' প্রকৃত ইতিহাস। উক্ত আলোচনায় (পৃ: ২২৭-২৩৫) লেখক উপস্থাপন করেছেন মগধ ও মগধ অঞ্চলে মগ জাতি গোষ্ঠীর আর্বিভাব সহ মগধ সাম্রাজ্য তথা মগধ অঞ্চলের মগদের নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা। লেখক এই অধ্যায়ে (পৃ: ২২৯) সুস্পষ্টভাবে বলেছেন— ‘বড়ুয়া বা মারমাগ্রী মগদের সম্পর্কে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, পূর্বে এরা ভারতের মগধ বা বিহার অঞ্চল থেকেই এসেছিল। মগধ থেকে এসেছিল বলেই তাদের নাম 'মগ' হয়। অতঃপর (পৃ: ২৩০-২৩৩) আলোচিত হয়েছে মগধ সাম্রাজ্যোর প্রতিষ্ঠার ইতিহাস। এই স্থানে লেখক মহাভারত ও হিন্দু পুরাণের কল্পনাশ্রয়ী তথ্যগুলি ব্যবহার করেছেন। ফলে এই অংশের তথ্যগুলি সম্পর্কে প্রশ্ন চিহ্ন থেকেই যায়। মগধের প্রাথমিক জাতিগোষ্ঠী (পৃ: ২৩৩) প্রসঙ্গে লেখক ড. মগপাপ বড়া'র প্রবন্ধের (বৌদ্ধদের শেকড় অন্বেষণ : একটি নৃতাত্ত্বিক পর্যালোচনা) কিছু অংশ ব্যবহার করেছেন, যেমন— বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ ও জৈনধর্মের প্রবর্তক মহাবীর বর্ধমান ছিলেন আলপীয় নরগোষ্ঠীর তবে লেখক আলপীয় নরগোষ্ঠী সম্পর্কিত কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রদান করেন নি। ষষ্ঠ অধ্যায়ের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং তথ্য বহুল বিষয় হল (পৃ: ২০৭) আরাকান রাজত্বকাল। লেখক এখানে খ্রীঃ পূর্ব তথা খ্রীঃ সময়কালের রাজা ও তাদের শাসনকালের তালিকা প্রদান করেছেন। যেমন—— প্রথম ধান্যবতীর যুগ (৩৩২৫-১৫০০ খ্রীঃ পূর্ব), দ্বিতীয় ধান্যবতীর যুগ (১৫০০-৫৮০ খ্রীঃ পূর্ব) এবং তৃতীয় ধান্যবতীর যুগ (৩২০-৯৬৪ খ্রীঃ)। এইভাবে ক্রমান্বয়ে শিলালিপি ও প্রাচীন গ্রন্থ 'রাজোয়াং' অনুসারে রাজন্যবর্গের তালিকা অত্যন্ত সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। ফলে জিজ্ঞাসু পাঠককুলের অনুসন্ধিৎসা এতে বৃদ্ধি পাবে বলে প্রতীয়মান হয়।
লেখক পুনঃ বলেছেন, আনন্দচন্দ্রের লিপিতে (পৃ: ২৪৩) বর্ণিত বাহুবলীর চন্দ্রবংশ আর রাজোয়াং গ্রন্থে বর্ণিত মাহা তাইং চেন্দ্রা'র চন্দ্রবংশ অভিন্ন তবে ধারাবাহিক বংশলতিকা উদ্ধার হয় নি। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ইউসিউই জেন দুটি বংশলতিকাই যে একই বংশের সেটির প্রমাণ দিয়েছেন (পৃ: ২৪৪-২৪৮)। এই তথ্যের মাধ্যমে পাঠক মগ জনগোষ্ঠীর সুপ্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কিত একটি পূর্ণাঙ্গ তথ্য উপনীত হতে সক্ষম হবে। গ্রন্থের (পৃ: ২৫১, অধ্যায় ক্রম- ষষ্ঠ) এই স্থানে লেখক বড়ুয়া তথা মারমাগ্রী জাতিগোষ্ঠীর ভীতের সম্পর্কিত ঐতিহাসিক তথ্য পুনঃ ব্যক্ত করেছেন এবং ঘটনাক্রম অনুসারে এই বিষয়টির ব্যাখ্যা অত্যন্ত সযত্নে পাঠককুলের সম্মুখে উপস্থাপন করেছেন। এই তথ্য প্রদানের ফলে বড়ুয়া তথা মারমাগ্রী এক এবং অভিন্ন তা দৃষ্ট হয়। বাংলার চন্দ্রবংশের শাসন (৬.৪, পৃঃ ২৫৫) প্রসঙ্গে লেখক উল্লেখ করেছেন যে, 'পূর্বেই উল্লেখ করেছি, বাংলার প্রায় ১২ টি নগর আরাকানি চন্দ্রবংশ শাসন করেছে। তবে এ বিষয়ে আরাকানে প্রাপ্ত চন্দ্রবংশীয় শিলালিপি সমূহে উল্লেখ থাকলেও বাংলাদেশে এ সম্পর্কিত কোন কোন সরাসরি প্রমাণ মেলে না। ...তবে তিব্বতী পরিব্রাজক লামা তারনাথের ভ্রমণ কাহিনীতে দেখা যায় পূর্ব বঙ্গে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শতক পর্যন্ত চন্দ্রবংশের শাসন (পৃ: ২৫৭) ছিল।' 'চট্টগ্রামের মগের ইতিহাস' বর্ণনায় ড. রামচন্দ্র বড়ুয়া বলেছেন— 'মগ কোন জাতীয় লোক এবং তাহারা চট্টগ্রামে কোথা হইতে আগমন করেন, তাহার বিবরণ ব্রহ্মার ইতিহাসে কিয়ৎ পরিমাণে জানা যাইতে পারে। ঐ ইতিহাসে বর্ণিত হইয়াছে, দক্ষিণ বেহার বা মগধ দেশীয় লোকেরাই মগ নামে পরিচিত। তাহারা রাজগৃহ ও পাটনা নগরের মগধরাজ জরাসন্ধ বংশজাত বলিয়া রাজবংশীয় নামে অভিহিত এবং আর্য (ক্ষত্রিয়) বংশ হইতে উৎপন্ন। সম্ভবত বেহারে হিন্দুধর্ম প্রবল হওয়াতে তাহারা চট্টগ্রামে (তৎকালীন আরাকান) আগমন (পৃ: ২৬১) করিয়া ছিলেন। বৌদ্ধদের উপর বিধর্মীদের আক্রমণ, ধর্মান্তর ও দেশত্যাগ (৬.৫, পৃ: ২৬৭) প্রসঙ্গে লেখক বলেছেন, ' ... সেনবংশ তখন বঙ্গের অধিপতি। তুর্কী আক্রমণ সেনদেরও পরাজিত করেছে। এই সময় থেরবাদীরা আরাকান অন্বেষণে, এতদ প্রাচীন আরাকানের বর্তমান চট্টগ্রাম অঞ্চলে চলে আসে।' তবে লেখক নানাবিধ ঘটনাক্রম পর্যালোচনা করে (পৃ: ২৬৭-২৭৬) এই সিদ্ধান্তে উপনীত যে আরাকান অঞ্চলে বড়ুয়া তথা মারমাগ্রীদের আগমন কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এ পশ্চাতের ইতিহাস ক্রম সুদীর্ঘতর। যেমন— ১. বৌদ্ধধর্মে মহাযানবাদ হতে সহজ মানের উত্থান। ২. পুষ্যমিত্র শুঙ্গ দ্বারা ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রচার এবং প্রসার। ৩. বৌদ্ধধর্মে ব্রাহ্মণ্যবাদের অনুপ্রবেশ এবং তথাকথিত দেব-দেবীর উদ্ভব। ৪. বঙ্গদেশে হিন্দু-বৌদ্ধভাবে গঠিত নব্যধর্মের উন্মেষ। ৫. তুর্কী মুসলমানদের আক্রমণ এবং বৌদ্ধধর্মের পতন। এই তথ্যের মাধ্যমে লেখক ক্রমান্বয়ে চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সৃজিত থেরবাদ (বড়ুয়া বৌদ্ধধর্মাবলম্বী) এবং যাদের পূর্বপুরুষগণ সুদূর মগধ হতে কীভাবে এবং কেন নিজেদের তদানীন্তন আরাকান অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত করল তার একটি সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রদান করেছেন। অতঃপর লেখক আসামের বড়ুয়া, ত্রিপুরার বড়ুয়া'র একটি বিপরীত রূপরেখা পাঠককুলের সম্মুখে উপস্থাপন করেছেন। উভয় অঞ্চলের বড়ুয়া পদবীধারী জনগোষ্ঠীর বড়ুয়া পদবী হলেও আসামের বড়ুয়াগণ ধর্মগতভাবে হিন্দু, অর্থাৎ অবৌদ্ধ। সুশীল পাঠককুল এই তথ্যের মাধ্যমেই অনুধাবন করতে পারবেন যে সকল বড়ুয়াই বৌদ্ধ নয় কেউ কেউ হয় ।
অতঃপর লেখক ক্রমান্বয়ে বারো ভূঁইয়া এবং তাদের সঙ্গে মগদের অভিযান, আরাকান সাম্রাজ্যের বিশৃঙ্খলা, বড় য়া উপাধি গ্রহণের সমকাল ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির প্রতি আলোকপাত করতে সচেষ্ট হয়েছেন। বিষয়সমূহের উপস্থাপন তথ্যবহুল এবং যুক্তিবোধের আলোকমার্গ দ্বারা সজ্জিত। এতে জিজ্ঞাসু পাঠক কৌতুহলাবিষ্ট অবশ্যই হবেন। তবে এই অধ্যায়ে মগধেশ্বরী নিয়ে কিছু গান (পৃ: ৩১৯) গুরুত্বপূর্ণ হলেও আলোচনা ক্রমের ছন্দপতন ঘটিয়েছে। এই অংশটি পঞ্চম অধ্যায়ের মগধেশ্বরী (পৃ: ১৮২) বিষয়টির সঙ্গে সংযুক্ত হলে ভালো হত। লেখক সপ্তর এই বিষয়টিকে আরো বেশি গুরুত্ব প্রদান করলে ঋদ্ধ হত পাঠককুল। পাকিস্তান (পূর্ব) ও স্বাধীন বাংলাদেশে বড়ুয়া বা মারমাগ্রীদের অবস্থান (পৃ: ৩৮২-৩৮৬) বিষয়টি লেখক আরও বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করতে হয়ত ভালো করতেন। কারণ বর্তমানে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতরও বটে। সপ্তম অধ্যায় (পরিশিষ্ট বিষয়ক আলোচনা) এ আলোচিত হয়েছে মগ বা মারমাগ্রী বিষয়ে কতিপয় ভ্রান্ত ধারণা এবং তা নিরসনে গবেষণার সিদ্ধান্ত সমূহ তথা অন্যান্য বিষয় সমূহের পুনঃ আলোচনা। এই অধ্যায়ের সর্বশেষ উল্লেখ্যনীয় বিষয়টি হল '...বড়ুয়া থাকতে জাতি হিসেবে মারমাগ্রী (পদবী নয়) পরিচয় কেন গুরুত্বপূর্ণ?' ইত্যাদি। এই অধ্যায়ে লেখক বলেছেন, '...বস্তুত (পৃ: ৪০১) আমরা রাখাইন- চাকমাদের ন্যায় জাতিসত্তায় বাঙালী না হলেও আমরা বর্তমানে বাংলাভাষী এবং জাতিসত্তায় বড়ুয়া বা মারমাগ্রী।' তিনি আরও বলেছেন, মারমাগ্রী বা বড়ুয়া মগ হচ্ছে সম্ভ্রান্ত ও শ্রেষ্ঠ অর্থবোধক, যারা শাক্যবংশীয় এবং বৌদ্ধধর্মের প্রাণকেন্দ্র মগধ আগত জাতিসত্তা।' লেখকের উপরিউক্ত অভিমতের সার সংকলন হল এইরূপে— (ক) মারমাগ্রী পরিচয়টুকু জাতিসত্তার পরিচয় মাত্র, জাতীয়তার পরিচয় নয়। (খ) মগেরা ধার্মিক এবং সভ্যজাতি। (গ) বাঙালীদের নিকট বড়ুয়াগণ 'মগ' নামেই পরিচিত, বাঙালী নয়। সুতরাং বড়ুয়া একটি স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠী।
সপ্তম অধ্যায়ে লেখক 'মগ বা মারমাগ্রী' পরিচয়ের প্রয়োজনীয়তাকে সম্পূর্ণ রূাপে নসাৎ করেছেন। কারণ চট্টগ্রামের বেশ কিছু অঞ্চলের বড়ুয়াগণ কোন এক অজ্ঞাত কারণে অদ্ভুত সকল দেব-দেবীর পূজা এবং মারমাগ্রী সাধো বহন করছে। এর অর্থ ভিন্নরূপে হয়, যেমন— (ক) নিজেকে বার্মিজ প্রতিপন্ন করা। (খ) রাজনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করা। (গ) বৌদ্ধ ধর্মের আড়ালে পুনঃ তন্ত্রযান প্রতিষ্ঠা করা। (ঘ) স্ব-বিরোধী মনোভাব গ্রহণ তথা বড়ুয়া বা মারমাগ্রী জাতিসত্তাকে বিসর্জন দেওয়া। গ্রন্থের (পৃ: ৪০৯) এই অধ্যায়ে লেখক পুনঃ বলেছেন— '...নিপীড়িত জাতির মুক্তির অর্থ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে লেনিনের মতে দ্বিবিধ রূপান্তর । যথা (১) জাতি সমূহের পরিপূর্ণ সমাধিকার। এ নিয়ে তর্ক নেই এবং তা কেবল রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঘটনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং (২) রাজনৈতিক বিচ্ছেদের স্বাধীনতা, এটা রাষ্ট্রের সীমানার সঙ্গে যুক্ত। কেবল এটি নিয়ে তর্ক। আমরা প্রথমটি চাই। অর্থাৎ সরকারীভাবে আমাদের জাতিসত্তার পরিচয়ের স্বীকৃত দেওয়া হউক।' লেখকের এই ভাবনা যুক্তিপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক। কারণ একটি বৃহত্তর জাতিসত্তা তার ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য-শিক্ষা এবং ধর্মমোহ দ্বারা অপর ক্ষুদ্র জাতিসত্তাকে আকৃষ্ট করে এবং ক্রমে নানাভাবে সেই সংস্কৃতিকে অবদমিত তথা বিনষ্ট করে সেই বিজিত জাতির ভূমিতে নিজ সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত করে এবং এইটি ইতিহাস সত্য (জাতিসত্তা প্রসঙ্গে, লিউ চূন, পৃ: ১০১)।
গ্রন্থের অষ্টম অধ্যায়'টি হল 'সংযুক্তি' অধ্যায়। এই অধ্যায়ের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়গুলি হল বিক্রমপুর, পালবংশের ইতিবৃত্ত এবং অতীশ দীপঙ্কর সম্পর্কিত ধারণা। তবে এই বিষয়গুলির ইতিহাস অত্যন্ত সুদীর্ঘ। সুতরাং স্থানীয়ভাবে ‘বড়ুয়া (মারমাগ্রী)' জাতিসত্তার সঙ্গে এই আলোচনা সামঞ্জস্য তথা সঙ্গতি পূর্ণ নয়। এই তিনটি অধ্যায় এই গ্রন্থে আলোচিত না হলেও বোধকরি কোন রূপে সমস্যা হত না। লেখকের উচিত এই বিষয়টি পুনঃবিবেচনা করা । এই অধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণমূলক আলোচনাটি হল 'আরাকানের বৈশালী এবং বংশলতিকা” (পৃঃ ৪২৮- ৪৪১) বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। উৎসাহী পাঠক এই তথ্যের মাধ্যমে তার অনুসন্ধিৎসা নিরসন করতে সক্ষম হবেন। গ্রন্থে (পৃ: ৪৪৩) একটি উল্লেখনীয় সংযোজন হল মহাপণ্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের লিখিত বড়ুয়া জাতির উৎপত্তি সম্পর্কিত একটি নিবন্ধ 'সৌগত' পত্রিকার নবম অধ্যায়ে লেখক (পৃ: ৪৪৯-৪৮৪) বিভিন্ন প্রাচীন মানচিত্র, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, প্রাচীন আরাকানী বৌদ্ধরাজাদের নির্মিত চৈত্য ও স্থাপনার ছবি, মগ রাজাদের ছবি, বড়ুয়া বা মারমাগ্রীদের সমাজ ও সংস্কৃতিগত ছবি ইত্যাদি সংযুক্ত করে সমগ্র গ্রন্থের প্রাসঙ্গিকতাকে পরিপূর্ণভাবে সম্পূর্ণ করেছেন। ফলে পাঠককুল এইগুলি সম্যকরূপে পর্যবেক্ষণ করে সেগুলি হতে রসদ সংগ্রহ করতে সক্ষম হবেন। পরিশেষে এই কথাগুলি উল্লেখ করা না হলে হয়ত সত্যের অসলাস করা হবে। লেখক রক্তিম বড়ুয়া লিখিত বহুলব্দ গবেষণার ফসল 'বড়ুয়া জাতির আত্মপরিচয়' নামক গ্রন্থটি (প্রকাশকাল ২০১৩) সুবিপুল (পৃ: সংখ্যা ৪৮৪ বা কিছু অধিক) হলেও সুখপাঠ্য এবং তথ্যবহুল। তবে এই সমাদৃত গ্রন্থে কিছু মুদ্রণজনিত প্রমাদ পরিলক্ষিত। লেখকের এই বিষয়ে একটু সচেতন হওয়া উচিত ছিল। গ্রন্থটির প্রচ্ছদ সম্পর্কে আরও বিচার-বিশ্লেষণ করলে হয়ত ভালো হত তবে। যাই হোক লেখক রক্তিম যেভাবে এই সাধ্য কাজটি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পূর্ণ করেছেন এবং তাতে আমি যারপরনাই উচ্ছ্বসিত হয়েছি। সর্বোপরি আমি শ্রীযুক্ত রক্তিম বড়ুয়া প্রণীত 'বড়ুয়া জাতির আত্মপরিচয়' গ্রন্থটির বহুল প্রচার এবং সাফল্য কামনা করছি।
সুমনপাল ভিক্ষু
অতিথি প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, নবগ্রাম হীরালাল পাল কলেজ, কোন্নগর, হুগলী।
No comments:
Post a Comment