Tuesday, October 21, 2025

মাগধী ভাষাই পালি ভাষা/ভূমিকা

 সুমনপাল ভিক্ষু


বিহারী ভাষাসমূহ বা নেপালের তরাই অঞ্চলে বিহারের কথিত পূর্ব ইন্দো আর্য ভাষাগুলি। তিনটি প্রধান ভাষা রয়েছে: পূর্বে মৈথিলি (তিরহুতিয়া এবং মাগধী এবং পশ্চিমে ভোজপুরী হয়ে ছোটনাগপুরের দক্ষিণ অর্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রাচীন মিথিলা (তিরহুত)-এ কথিত মৈথিলি প্রাচীনকাল থেকেই পণ্ডিতদের ব্যবহৃত ভাষারূপে সমাদৃত এবং এখনও এর অনেকগুলি ভাষাতাত্ত্বিক রূপ রয়েছে। এটি একমাত্র বিহারী ভাষা যার একটি প্রকৃত সাহিত্য রয়েছে এবং ১৯৪৭ এর পর থেকেই এই ভাষার প্রতি আগ্রহ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। মাগধীকে মাগধি প্রাকৃতের বর্তমান প্রতিনিধিরূপে গণ্য করা হয়। বিহারী ভাষাগুলি ভাষাতাত্ত্বিকভাবে বাংলার সঙ্গে সম্পর্কিত কিন্তু সাংস্কৃতিক দিক থেকে এটিকে হিন্দীর সঙ্গে অভিন্ন মনে করা হয়। অধিকাংশ শিক্ষিত বিহারী ভাষাভাষী বাংলা ও হিন্দী জানেন।

মাগধী দক্ষিণ বিহারের মগধ অঞ্চলে কথিত হয়। এর কেন্দ্রস্থল হল সংস্কৃতির পাটনা। জেহানাবাদ, নালন্দা, গয়া, নওয়াদা এবং শেখরপুরা জেলা এবং মাগধী সংস্কৃতির কেন্দ্র হল পাটনা (পূর্বতন পাটলিপুত্র), এবং গয়া, পশ্চিমে, পশ্চিম পাটনা, আরওয়াল, ও আওরঙ্গবাদ জেলায় শোন নদীর ওপর তীরে মাগধী ও ভোজপুরীর সংমিশ্রণ দেখা যায়। গঙ্গার অপর পাড়ে মৈথিলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত কয়েকটি ভাষা কথিত হয়। পূর্বদিকে লক্ষ্মীসরাই ও জামুই জেলায় অঙ্গিকার সঙ্গে মাগধী মিশ্রিত হয়।

পালি মাগধী নামেও পরিচিত পালি ভাষা ভারতীয় উপমহাদেশের একটি ধ্রুপদী মধ্য-আর্য ভাষা। এটিকে ব্যাপকভাবে অধ্যয়ন করা হয় কারণ এটি বৌদ্ধ পালি বৌদ্ধ সাহিত্য বা ত্রিপিটক এবং থেরবাদী বৌদ্ধধর্মের পবিত্র ভাষা। পালিকে ভারত সরকার একটি ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দিয়েছে।

পালি শব্দটিকে থেরবাদী বৌদ্ধ সাহিত্যের ভাষার নাম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। মনে হয় এই শব্দটির উৎপত্তি হয়েছিল বৌদ্ধ ঐতিহ্য থেকে যেখানে পালিকে পৃথক করা হয়েছিল সেই ভাষা বা মাতৃভাষায় অনুবাদ থেকে
যেটি এটিকে পুঁথিতে অনুসরণ করেছিল। K.R. Nourman বলেন এর আবির্ভাবের ভিত্তি ছিল পালি ভাষা এই যৌগটিকে বোঝার ভ্রান্তি থেকে যেখানে পালিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে একটি বিশেষ ভাষার নাম হিসেবে।

পালি নামটি বৌদ্ধ সাহিত্যে আবির্ভূত হয় না এবং বৌদ্ধ সাহিত্যে এটিকেও পরিবর্তে কখনও তাঁতি শব্দটিকে ব্যবহার করা হয়েছে যার অর্থ শিকল বা বংশ। মনে হয় এই নামটি খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শুরুতে শ্রীলঙ্কায় আবির্ভূত হয়েছিল যখন রাজভাষা ও সাহিত্যের ভাষারূপে পালি ভাষার পূর্ণজাগরণ ঘটে।

সে অর্থে পালি ভাষার নামটি সমস্ত যুগের পণ্ডিতদের মধ্যে কিছু বিতর্কের সৃষ্টি করেছে, নামটি বানানেরও পার্থক্য রয়েছে, এটিকে দীর্ঘ হ্রস্ব উভয়ের সঙ্গে এবং পালির সঙ্গে মগধের প্রাচীন রাজত্বে কথিত ভাষার সম্পর্ক নিয়ে বিভ্রান্তই রয়েই গেছে যেটিকে আধুনিক বিহারে সনাক্ত করা হয়েছে। থেরবাদী ভাষ্য থেকে শুরু হয়ে পালিকে মাগধীর সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করা হয়েছে যেটি মগধ রাজ্যের ভাষা ছিল। আবার এই ভাষাটিকে সেই ভাষারূপে মনে করা হয়েছে যেটিকে বুদ্ধ তাঁর জীবদ্দশায় ব্যবহার করেছিলে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ প্রাচ্যতত্ত্ববিদ Robert Caesars Childers দাবী করেছেন যে পালি ভাষার প্রকৃত বা ভৌগোলিক নাম হল মাগধী প্রাকৃত এবং যেহেতু পালি শব্দের অর্থ 'পঙক্তি বা সারি', প্রাচীন বৌদ্ধরা শব্দটির অর্থ বাড়িয়ে করেছিলেন 'এক সারি বই' তাই পালি ভাষা শব্দটির অর্থ হল 'বইয়ের বা পুস্তকের ভাষা'।

তবে আধুনিক পণ্ডিতেরা পালি ভাষাকে মোটামুটিভাবে খ্রী. পূর্ব তৃতীয় শতক থেকে অনেকগুলি প্রাকৃত ভাষার সংমিশ্রণ বলে মনে করেছেন যেটির আংশিক সংস্কৃতভবন ঘটেছে। মধ্য ইন্দো-আর্য ভাষার কোন প্রামাণ্য কথ্য ভাষা নেই যার মধ্যে পালির সব কটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বর্তমান যুগে পালিকে মাগধী প্রাকৃত নামে পরিচিত ভাষার লিপির সঙ্গে এবং অন্যান্য রচনাংশ ও ভাষার সঙ্গে তুলনা করা সম্ভব হয়েছে যদিও বর্তমানে অস্তিত্বশীল কোন সূত্র থেকেই প্রাক্ অশোকীয় মাগধীর প্রমাণ মেলেনি, বর্তমানের প্রাপ্ত সূত্রগুলি থেকে এই ইঙ্গিত মেলে যে পালি ঐ ভাষার মত নয়।

আধুনিক পণ্ডিতেরা পালি ভাষাকে সাধারণত পূর্ব পশ্চিমের একটি কথ্য ভাষা থেকে উৎপন্ন হয়েছে বলে মনে করেন। পালি ভাষার সৌরাষ্ট্রের গিরনারের পশ্চিম অশোকীয় আদেশনামা এবং হাতীগুম্ফা লিপিতে প্রাপ্ত মধ্য পশ্চিম প্রাকৃতের কিছু মিল রয়েছে। এই সাদৃশ্যের জন্য পণ্ডিতেরা পালি ভাষাকে পশ্চিম ভারতের এই অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত বলে মনে করেছেন। তবে যাইহোক পালির মধ্যে কিছু পূর্বভারতীয় ভাষার বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেগুলিকে মাগধীয় বলে মনে করা হয়েছে।

পালি এটি মধ্য ইন্দো-আর্য ভাষারূপে সেটির কথ্যরূপের জন্য তার উৎপত্তির সময়ের থেকেও বেশী করে ধ্রুপদী সংস্কৃত থেকে পৃথক ত্রুটির অনেকগুলি রূপগত ও আভিধানিক অর্থগত বৈশিষ্ট্য থেকে প্রমাণিত হয় এটিতে ঋবৈদিক সংস্কৃতের প্রত্যক্ষ ধারবাহিকতা নেই। এর পরিবর্তে এটি এক বা একাধিক উপভাষা থেকে উৎপন্ন যেগুলি অনেক সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও সংস্কৃত থেকে পৃথক।

থেরবাদী ভাষ্যে পালি ভাষাকে 'মাগধী' বা মগধের ভাষা বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এই অভিন্নতা প্রথম আবির্ভূত হয়েছিল ভাষ্যগুলিতে এবং এটি মৌর্য সাম্রাজ্যের সঙ্গে নিজেদের আরও ঘনিষ্ট করার জন্য বৌদ্ধদের একটি প্রচেষ্টা হতে পারে।

তবে বুদ্ধের শিক্ষাগুলির মধ্যে মাত্রা কয়েকটি মগধ রাজ্যের ঐতিহাসিক এলাকার মধ্যে প্রদান করা হয়েছিল। পণ্ডিতগণ মনে করেন সম্ভবত তিনি মধ্য ইন্দো আর্য ভাষার ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত কয়েকটি উপভাষায় তাঁর উপদেশ দিতেন, যেগুলির যথেষ্ট বিধানে পারস্পরিক বোধগম্যতা ছিল।

মহাবংশের মত ইতিবৃত্তে লিপিবদ্ধ থেরবাদী ঐতিহ্যতে বলা হয়েছে ত্রিপিটক প্রথম লিপিবদ্ধ হয় খ্রী.পূর্ব প্রথম শতকে। পূর্ববর্তী ঐতিহ্যের কথ্য সংরক্ষণ থেকে যেখানে বলা হয়েছে যে এই লিপিবদ্ধকরণ ঘটেছিল সংঘের উপর দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ এবং বিরোধী ঐতিহ্য অভয়গিরি বিহারের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে। এই বিবরণ সাধারণভাবে পণ্ডিতগণের দ্বারা স্বীকৃত হয়েছে যদিও এই ইঙ্গিত রয়েছে যে পালি তার পূর্বেই লিখিতরূপ লাভ করতে শুরু করেছিল। পণ্ডিতগণ মনে করেন যে ইতিহাসের এই সময়ের পূর্বেই পালি সম্ভবত সংস্কৃতের মধ্যে কিছু আত্মীকরণ ঘটেছিল যেমন মধ্য ইন্দো-ব্রাহ্মণের আরও পরিচিত সংস্কৃত ব্রাহ্মণে পরিণতি লাভ যার সঙ্গে সমসাময়িক ব্রাহ্মণেরা নিজেদের অভিন্ন বলে মনে করতেন।

শ্রীলঙ্কায় পালি খ্রীষ্টীয় ৪র্থ বা ৫ম শতকের শেষে অবনতির এটি পর্বে প্রবেশ করেছিল (যেহেতু সংস্কৃত প্রাধান্য লাভ করেছিল এবং বৌদ্ধধর্মের অনুগামীরা উপমহাদেশের একটি ক্ষুদ্র অংশে পরিণত হয়েছিল)। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উদ্ধার পেয়েছিল। বুদ্ধঘোষের রচনা ছিল বৌদ্ধ চিন্তার বাহন রূপে পালির এই পুনরভ্যুত্থানের কারণ। বিসুদ্ধিমগ্ন এবং অন্যান্য ভাষ্য যা বুদ্ধঘোষ সংকলন করেছিলেন তা সিংহলীয় ভাষ্যের ঐতিহ্য বিধিবদ্ধ ও একত্রীকরণ করেছিল খ্রী.পূর্ব তৃতীয় শতক থেকে।

মাত্র কয়েকটি সম্ভাব্য ব্যতিক্রম ব্যতীত আজকে জানা পালি রচনার প্রায় সমস্তটাই শ্রীলঙ্কার অনুরাধাপুরের মহাবিহার থেকে পাওয়া গিয়েছে বলে মনে করা হয়। যদিও ভারতবর্ষের মূল ভূখণ্ডের থেরবাদী সাহিত্যের প্রমাণ খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকেও পাওয়া যায়, কিন্তু এই ঐতিহ্যের কোন রচনা আবিষ্কার করা যায়নি। কিছু কিছু রচনা (যেমন মিলিন্দপঞহ) শ্রীলঙ্কায় পৌঁছানোর পূর্বে ভারতবর্ষে রচিত হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু সেই রচনার টিকে যাওয়া সংস্করণগুলি সংরক্ষিত হয়েছে শ্রীলঙ্কার মহাবিহার দ্বারা এবং এগুলি ভাগ হয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার থেরবাদী বিহারগুলির সঙ্গে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূল ভূখণ্ডে প্রাপ্ত পালি ভাষার পূর্ববর্তী লিপিগুলি হল খ্রীষ্টীয় প্রথম সহস্রাব্দের এর কয়েকটি সম্ভবত খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর। বর্তমান ব্রহ্মদেশ, লাওস, কাম্বোডিয়া, ও থাইল্যান্ডে প্রাপ্ত লিপিগুলি শ্রীলঙ্কা নয় দক্ষিণ ভারত থেকে বিস্তৃত হয়ে থাকবে। খ্রীষ্টীয় একাদশ শতকে পাগানের চতুর্পাশ্বস্থ অঞ্চলে একটি তথাকথিত পালি পূণর্জাগরণ শুরু হয় যা ক্রমশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূল ভূখণ্ডের অবশিষ্ট অংশে ছড়িয়ে পড়ে কারণ রাজবংশগুলি অনুরাধাপুরের মহাবিহার থেকে উদ্ভুত ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলির পৃষ্ঠপোষকতা করত। এছাড়াও এই যুগের বৈশিষ্ট্য ছিল সংস্কৃত রীতিনীতি ও কাব্যরূপ গ্রহণ যেগুলি পূর্ববর্তী পালি সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ছিল না। এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল খ্রীষ্টীয় ৫ম শতকেই কিন্তু এটি তীব্রতর হয় খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথম দিকে যখন সংস্কৃতের উপর ভিত্তি করা কাব্যতত্ত্ব ও রচনা জনপ্রিয় হতে শুরু করে। এই পর্বের একটি মাইলফলক হল চতুর্দশ শতকে সুবোধালঙ্কারের প্রকাশনা, এই গ্রন্থগুলি রচনার কৃতিত্ব দেওয়া হয় সংঘরক্ষিত মহাস্বামীকে এবং এটি সংস্কৃত কাব্যদর্শনকে অনুসরণ করে রচিত। পিটার মেসফিল্ড ইন্দো-চৈনিক পালি বা খম পালি নামে পরিচিত পালি এক ধরণের রূপের উপর অনেক গবেষণা করেছিলেন। এখনও পর্যন্ত এটিকে পালির একটি ক্ষয়িষ্ণু রূপ বলে মনে করা হয়। কিন্তু মেসফিল্ড মন্তব্য করেছেন আরো প্রচুর গ্রন্থের আরো পরীক্ষা করলে সম্ভবত দেখা যাবে যে এটি অভ্যন্তরীণ দিক থেকে সঙ্গতিপূর্ণ পালি উপভাষা। এই পরিবর্তনের কারণ হল এই যে এই লিপিতে কয়েকটি অক্ষরের সমষ্টিকে লেখা কঠিন। মেসফিল্ড আরো বলেন যে শ্রীলঙ্কায় থেরবাদী বৌদ্ধধর্মের তৃতীয় পুনঃপ্রবর্তনের (শ্যামদেশীয় সম্প্রদায়) সঙ্গে সঙ্গে থাইল্যাণ্ডের অনেক রচনাও গ্রহণ করা হয়। মনে হয় যে শ্রীলঙ্কায় ভিক্ষুধর্মে দীক্ষা গ্রহণের পদ্ধতি বিলুপ্ত হয়, একই সঙ্গে অনেক গ্রন্থও হারিয়ে যায়। অতএব শ্রীলঙ্কার পালি বৌদ্ধ সাহিত্য সম্ভার প্রথমে ইন্দো-চৈনিক পালিতে এবং তারপর আবার পালি ভাষায় অনূদিত হয়।

মহাবিহারের ভিক্ষুদের সংখ্যা ও প্রভাব বৃদ্ধি সত্ত্বেও পালি অধ্যয়নের পুর্নজাগরণের ফলে এই ভাষায় এমন নতুন কোন সাহিত্যগ্রন্থ রচিত হয়নি যা বর্তমানে অস্তিত্বশীল। এই যুগে শ্রীলঙ্কার এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূল ভূখণ্ডের রাজদরবারের চিঠিপত্রের আদানপ্রদান ঘটত পালি ভাষায় এবং সিংহল, ব্রহ্মদেশ, এবং অন্যান্য ভাষা ব্যবহারকারীদের উদ্দেশ্য করে ব্যাকরণ রচিত হত। থেরবাদী বৌদ্ধ সাহিত্যের ভাষারূপে পালির আবির্ভাব ঘটেছিল এযুগেই। যদিও সাধারণভাবে পালিকে একটি প্রাচীন ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয় প্রাচীনতম যুগের কোন লিপি উৎকীরণবিদ্যা বা পুঁথিগত প্রমাণ আর টিকে নেই। পালির সর্বপ্রাচীন যে নমুনা আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলি হল লিপি সেগুলি খ্রীষ্টীয় ৫ম থেকে ৮ম শতক পর্যন্ত খোদিত হয়েছিল বলে মনে করা হয় এবং এগুলির অবস্থান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূল ভূখণ্ডে বিশেষত মধ্য শ্যাম ও নিম্নব্রহ্মে। এই লিপিগুলির মধ্যে প্রধানত রয়েছে পালি বৌদ্ধ সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত অংশ এবং মূল বৌদ্ধ সাহিত্য ব্যতীত রচনা যার মধ্যে রয়েছে 'হয়ে ধম্মা হেতু' গাথার অনেকগুলি দৃষ্টান্ত।

সর্বপ্রাচীন পালি পুঁথি আবিষ্কৃত হয়েছিল নেপালে এবং এটি আবিষ্কৃত হয়েছিল খ্রীষ্টীয় নবম শতকে। এটি ছিল চারটি তাল পাতার ভাঁজ করা কাগজের

বইরূপে, যেখানে ব্যবহৃত হয়েছিল একটি পরিবর্তনশীল লিপি যেটি পাওয়া গিয়েছিল গুপ্ত লিপি থেকে যার দ্বারা চুলবন্ধের একটি খণ্ডিত অংশ রচিত হয়েছিল। শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্বপ্রাচীন জ্ঞাত পুঁথিগুলি রচিত হয়েছিল ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতকে যদিও এর মাত্র কয়েকটি দৃষ্টান্ত টিঁকে আছে। ৪০০ বছরের থেকে বেশী প্রাচীন খুব কম সংখ্যক পুঁথিই টিকে আছে এবং চারটি নিকায়ের সম্পূর্ণ পুঁথি পাওয়া যায় কেবল খ্রিষ্টীয় ১৭শ থেকে পরবর্তী সময়ের।

পাশ্চাত্য সাহিত্যে পালির উল্লেখ পাওয়া যায় Sumon De la Loubere-র সিয়াম রাজত্বের ভ্রমণ বৃত্তান্তে। এই ভাষার এটি পুরাতন ব্যাকরণ ও অভিধান প্রকাশ করেছিলেন মেথডিস্ট প্রচারক বেঞ্জামিন ক্লাউ ১৮২৪ সালে এবং এর একটি প্রাথমিক অধ্যয়ন প্রকাশ করেছিলেন ১৮২৬ সালে Engene Burnouf ও Chrustian Lessen। প্রথম আধুনিক পালি-ইংরাজী অভিধান ১৮৭২ সালে ও ১৮৭৫ সালে প্রকাশ করেছিলেন Robert Childers পালি টেক্সট সোসাইটি স্থাপিত হবার পর ইংরাজী পালি অধ্যয়ন দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং Childer এর অভিধান পুরনো হয়ে যায়। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম দিকে নতুন একটি অভিধান রচনার পরিকল্পনা গৃহীত হয় কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ইত্যাদি কারণে, বিলম্ব হওয়ায় কাজটি ১৯২৫ সালের পূর্বে বাস্তবায়িত হয়নি।

T.W. Rhys Davids তাঁর গ্রন্থ Budhist India এবং Wilhelm Geiger তাঁর গ্রন্থ Pali Literature and Language-এ ইঙ্গিত দিয়েছেন পালি সেই সমস্ত মানুষদের সাধারণ ভাষারূপে উৎপন্ন হয়ে থাকতে পারে যারা উত্তরভারতে বিভিন্ন উপভাষা ব্যবহার করত এবং সেগুলি বুদ্ধের সময়ে প্রচলিত ছিল এবং তাঁর দ্বারা ব্যবহৃত হত। অপর একজন পণ্ডিত মন্তব্য করেছেন সে সময়ে এটি ছিল পরিমার্জিত ও সুন্দর একটি দেশীয় ভাষা যেটি সমস্ত সাধারণ ভাষাভাষী মানুষ ব্যবহার করত। আধুনিক পণ্ডিতগণ এই বিষয়ে কোন সহমতে উপনীত হতে পারেন নি; এ বিষয়ে অনেকগুলি পরস্পরবিরোধী তত্ত্ব রয়েছে যেগুলির প্রতিটিরই অনেক সমর্থক ও সমালোচক রয়েছে। বুদ্ধের পরিনির্বাণের পর পালি বুদ্ধের ভাষা থেকে ও বৌদ্ধদের মধ্যে থেকে বিবর্তিত হয়ে থাকতে পারে একটি নতুন কৃত্রিম ভাষারূপে। R. C. Childers যিনি এই তত্ত্বের সমর্থক রয়ে গিয়েছিলেন যে পালি ছিল প্রাচীন মাগধী লিখেছেন, 'যদি গৌতম কখনও ধর্মপ্রচার না করতেন তাহলে মাগধী হিন্দুস্থানের অন্য অনেক দেশীয় ভাষার থেকে পৃথক হত বলে মনে হয় না, কেবল হয়ত এর একটি অর্ন্তনিহিত শক্তি ও সৌন্দর্য থাকত যেটি এটিকে প্রাকৃতদের মধ্যে এক ধরণের টাস্ক্যান বানিয়েছে।

K. R. Norman এর মতে, বৌদ্ধ সাহিত্যের বিভিন্ন রচনার মধ্যে পার্থক্য থেকে বোঝা যায় এর মধ্যে একাধিক উপভাষার উপাদান রয়েছে। তিনি এই মতও প্রকাশ করেছেন যে সম্ভবত উত্তর ভারতের বিহারগুলিতে স্থানীয় উপভাষায় উপাদানগুলি পৃথকভাবে সংরক্ষিত ছিল। সম্ভবত প্রথমদিকে এই উপাদনগুলিকে অন্যান্য জায়গায় স্থানান্তরণের জন্য কোন অনুবাদেরই প্রয়োজন ছিল না। অশোকের সময়কাল নাগাদ অধিকতর ভাষাতাত্ত্বিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় এবং সমস্ত উপাদানকে একত্রিত করার জন্য প্রচেষ্টা করা হয়। এমন হতে পারে যে পালির খুব কাছাকাছি একটি ভাষা এই প্রক্রিয়ার ফলে আবির্ভূত হয়, বিভিন্ন উপভাষার মাঝামাঝিরূপে এবং এই ভাষাতেই সমস্ত প্রাচীন উপাদান সংরক্ষিত হয়েছে। এই ভাষাটিই তারপর থেকে পূর্বের বৌদ্ধদের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী ভাষারূপে কাজ করতে থাকে। এই পর্বের পর ভাষাটির সামান্য সংস্কৃত প্রভাবিত ঘটে থাকে।

পাণ্ডিত্যের বর্তমান অবস্থার সংক্ষিপ্তসার প্রসঙ্গে ভিক্ষু বোধি মন্তব্য করেছেন যে ঐ ভাষাটি 'সেই ভাষাটির সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কিত (বা আরও বেশী করে বিভিন্ন স্থানীয় কথ্য ভাষা) যে ভাষা বুদ্ধ স্বয়ং কথা বলতেন। তিনি আরো লিখেছেন পণ্ডিতগণ এই ভাষাটি একটি সংকর ভাষা বলে মনে করেন যার মধ্যে খ্রী.পূ. ৩য় শতকের কাছাকাছি প্রাকৃত ভাষার অনেক বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে, যার কারণ হল পরবর্তীকালের আংশিক সংস্কৃতায়ন। যদিও ভাষাটি বুদ্ধ স্বয়ং যে ভাষায় কথা বলে থাকতেন তার সঙ্গে অভিন্ন নয়, এটি সেই বিশাল ভাষা পরিবারের অন্তর্গত যেগুলি তিনি ব্যবহার করে থাকবেন এবং যেগুলির উদ্ভব অভিন্ন ধারণাগত ছাঁচ থেকে। এইভাবে এই ভাষাটি সেই ভাবনা জগতের প্রতিনিধিত্ব করে যা বুদ্ধ উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছিলেন সেই বৃহত্তর ভারতীয় সংস্কৃতি থেকে যার মধ্যে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন যাতে তার শব্দগুলি সেই ভাবনা জগতের সূক্ষ্ম তারতম্যগুলিকে খুঁজে নিতে পারে।'

-ভিক্ষু বোধি

A. K. Warder এর মতে, পালি ভাষা একটি প্রাকৃত ভাষা যা পশ্চিম ভারতের একটি অঞ্চলে ব্যবহৃত হত। Warder পালিকে ভারতবর্ষের অবন্তী জনপদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মনে করেছেন যেটি স্থবির নিকায়ের কেন্দ্র ছিল। বৌদ্ধ সংঘের প্রাথমিক বিভাজনের পর স্থবির নিকায় পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারত এবং মহাসাংঘিক নিকায় মধ্য ও পূর্ব ভারতে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে! সৌরাষ্ট্রীয় লিপির উদাহরণ দিয়ে Akira Hirakawa এবং Paul Groner পালিকে পশ্চিম ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন ও স্থবির নিকায়ের যেটি ভাষাতাত্ত্বিকভাবে পালি ভাষার সবচেয়ে নিকটবর্তী।

যদিও ব্রাহ্মণ্যবাদী ঐতিহ্যে সংস্কৃতকে মনে করা হত দেবতাদের দ্বারা ব্যবহৃত একটি অপরিবর্তনীয় ভাষা যেখানে প্রতিটি শব্দের একটি অর্ন্তনিহিত তাৎপর্য্য রয়েছে, প্রাচীন বৌদ্ধ ঐতিহ্যে কোন ভাষা সম্পর্কে এই মতকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সেখানে শব্দ হল কেবল প্রথাগত ও ক্ষণস্থায়ী চিহ্ন। ভাষার এই ধারণা স্বাভাবিকভাবেই পালির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয় এবং সংস্কৃতের পরিবর্তে এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটির অবদান থাকতে পারে। তবে, পালি ভাষ্যগুলির একটি সংকলনের পূর্বেই অজ্ঞাতানামা লেখকেরা পালিকে স্বাভাবিক ভাষা, সমস্তপ্রাণীর মূল ভাষারূপে বর্ণনা করেছেন।

পাশ্চাত্যের অলৌকিক ঐহিহ্যে প্রাচীন মিশরীয়, হিব্রু বা ল্যাটিন ভাষার মতই পালি আবৃত্তিরও অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে বলে মনে করা হত (যার কারণ ছিল তাদের অর্থ, আবৃত্তিকারের চরিত্র, বা ভাষার গুণাবলী) এবং বৌদ্ধ সাহিত্যের প্রাথমিক স্তরে দেখা যায় যে পালি সারণি মন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হত যেমন সর্পাঘাত থেকে নিরাময়ের ক্ষেত্রে। থেরবাদী সংস্কৃতির অনেক মানুষ এখনও বিশ্বাস করে যে পালি ভাষায় প্রতিজ্ঞাপাঠ গ্রহণের একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে এবং শ্রীলঙ্কায় একথা বিশ্বাস করা হয় যে অঙ্গুলিমালের প্রতিজ্ঞা শপথ সন্তান জন্মাদানের যন্ত্রণাকে হ্রাস করে। থাইল্যাণ্ডে অভিধম্মপিটকে একটি অংশকে জপ করাকে সদ্যমৃতদের ক্ষেত্রে উপকারী বলে মনে করা হয় এবং এই উৎসবটি কারও মৃত্যুর পর সাতটি কর্মদিবস ধরে চলে। পরবর্তী রচনায় এমন কিছু নেই যা এই বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং এই প্রথার উদ্ভব অস্পষ্ট।

ভারতবর্ষের মূল ভূখণ্ডে একটি সাহিত্যিক ভাষারূপে পালির মৃত্যু হয়েছিল চতুর্দশ শতকেই কিন্তু অন্যত্র এটি টিকে ছিল অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত। এখনও পালি ভাষা অধ্যয়ন করা হয় প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র পাঠ করার জন্য এবং এটি আচার অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রায়ই জপ করা হয়। পালি ইতিবৃত্ত, চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থ এবং লিপি ইত্যাদি ধর্মনিরপেক্ষ সাহিতেরও যথেষ্ট ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। পালি জ্ঞানের মহান কেন্দ্রগুলি রয়েছে শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার থেরবাদী দেশসমূহে মায়ানমার, থাইল্যাণ্ড, লাওস ও কাম্বোডিয়া। ঊনবিংশ শতক থেকে ভারতবর্ষে পালি চর্চার বিভিন্ন কেন্দ্র এই ভাষা ও তার সাহিত্য সম্পর্কে একটি চেতনা সৃষ্টি করেছে। এগুলির মধ্যে রয়েছে অনাগারিক ধর্মপাল প্রতিষ্ঠিত মহাবোধি সোসাইটি।

১৮৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই ইউরোপে পালি টেক্সট

সোসাইটি ইউরোপীয় পণ্ডিতদের মধ্যে পালি ভাষা অধ্যয়নে আগ্রহের সঞ্চার করেছে। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠান রোমক হরফে বিভিন্ন পালি সংস্করণ প্রকাশ করেছে এবং এর সঙ্গে এই উৎসগুলির ইংরাজী অনুবাদও। ১৮৬৯ সালে পালি টেক্সট সোসাইটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য Robert Caesar Childers-এর গবেষণাকে ভিত্তি করে প্রথম পালি অভিধানটি প্রকাশিত হয়। একটি ইংরাজীতে অনূদিত প্রথম পালি রচনা এবং এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৭২ সালে। Childers এর অভিধান পরে ১৮৭৬ সালে Volney পুরস্কার লাভ করে।

পালি টেক্সট সোসাইটি আংশিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঊনবিংশ শতকের দ্বিয়ার্ধে যুক্ত ইংল্যাণ্ড ও যুক্তরাজ্যে ভারততত্ত্বের জন্য বরাদ্দ সেই অত্যন্ত স্বল্প পরিমাণ অর্থ সাহায্যের ক্ষতি পূরণ করার জন্য; এটি অত্যন্ত সামঞ্জস্যহীন যে যুক্তরাজ্যের সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষা চর্চায় জার্মানী, রাশিয়া এমনকি ডেনমার্কের মত অগ্রসর ছিল না। শ্রীলঙ্কা ও ব্রহ্মদেশের সাবেক ঔপনিবেশের অনুপ্রেরণা ছাড়াই Danish Royal Liberary-র মত প্রতিষ্ঠান পালি পুঁথির একটি প্রধান সংগ্রহ, এবং পালি চর্চার একটি প্রধান ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছে।

Paisaci হল ধ্রুপদী ভারতবর্ষের একটি প্রধানত অপ্রমাণিক সাহিত্যিক ভাষা যার উল্লেখ প্রাচীন প্রাকৃত ও সংস্কৃত ব্যাকরণে দেখা যায়। এটিকে প্রাকৃত ভাষাগুলির সঙ্গে একটি গোষ্ঠীতে দেখা যায়, যার জন্য এটির কিছু ভাষাতাত্ত্বিক সাদৃশ্য রয়েছে, কিন্তু প্রথম পর্বের বৈয়াকরণিকরা এটিকে কথ্য ভাষা বলে বিবেচনা করেন নি কারণ এটিকে একটি বিশুদ্ধ সাহিত্যিক ভাষারূপে মনে করা হত।

দণ্ডির 'কাব্যশাস্ত্র' এর মত সংস্কৃত। কাব্যশাস্ত্রের কিছু রচনায় এটি 'ভূতভাষা' নামে পরিচিত, এটি একটি শিরোপা যার অর্থ হতে পারে 'মৃত ভাষা' (অর্থাৎ যে ভাষার জীবিত কোন ব্যবহারকারী নেই) বা 'ভূত' শব্দের অর্থ অতীত তাই এই ভূতভাষা শব্দটির অর্থ হল যে ভাষায় অতীতে কথা বলা হত। এই ব্যাখ্যার স্বপক্ষে যে প্রমাণ পাওয়া যায় তা হল এই পৈশাচি ভাষা সাহিত্য হল খণ্ডিত এবং অত্যন্ত বিরল, কিন্তু অতীতের কোন সময়ে এটি সাধারণ থাকতে পারে।

ত্রয়োদশ শতকের তিব্বতীয় ঐতিহাসিক Buton Renchien Drub মন্তব্য করেছেন প্রাচীন বৌদ্ধ সম্প্রদায়গুলি পৃথক ছিল তাদের ভাষার নির্বাচন দিয়ে: মহাসাংঘিকগণ প্রাকৃত ব্যবহার করেন, সর্বাস্তিবাদীগণ সংস্কৃত ব্যবহার করেন।

স্থবিরবাদীগণ পৈশাচি ব্যবহার করেন এবং সম্মিতিয়গণ অপভ্রংশ ব্যবহার করেন। এই পর্যবেক্ষণের ফলে কয়েকজন পণ্ডিত পালি ও পৈশাচীর মধ্যে তাত্ত্বিক যোগসূত্র অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন; Sten Konow এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে এটি দক্ষিণ ভারতে দ্রাবিড়ীয় মানুষদের দ্বারা ব্যবহৃত একটি ইন্দো-আর্য ভাষা হতে পারে এবং আলফ্রেড মাস্টার পালি রূপমূলতত্ত্ব এবং টিঁকে যাওয়া খণ্ডিতাংশের অনেক সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছেন।

অর্ধমাগধী প্রাকৃত ছিল একটি মধ্য ইন্দো আর্য ভাষা এবং একটি নাট্যগুণসম্পন্ন প্রাকৃত যেটি আধুনিক বিহার ও পূর্ব উত্তর প্রদেশে কথিত হত এবং কয়েকটি প্রাচীন বৌদ্ধ ও জৈন নাটকে ব্যবহৃত হয়েছিল। প্রথমে এটিকে মাগধী প্রাকৃতের একটি পূর্বসূরী বলে মনে করা হত, তাই এটির নামকরণ হয়েছিল অর্ধমাগধী। জৈন পণ্ডিতেরা ব্যাপকভাবে অর্ধমাগধীর ব্যবহার করতেন এবং এটি জৈন আগমে সংরক্ষিত রয়েছে।

অর্ধমাগধীর সঙ্গে পরবর্তীকালের মাগধী প্রাকৃতের যা পার্থক্য পালিরও তাই পার্থক্য এবং প্রায়শই এটিকে পালির সঙ্গে যুক্ত বলে মনে করা হত এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে যে পালি ভাষায় একটি প্রাচীন মাগধী উপভাষায় বুদ্ধের শিক্ষা লিপিবদ্ধ হয়েছিল।

মাগধী প্রাকৃত একটি মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষা যেটি বর্তমান বিহার ও পূর্ব উত্তর প্রদেশে কথিত হত। এটির ব্যবহার পরবর্তীকালে দক্ষিণ পূর্ব থেকে ছড়িয়ে পড়ে এবং আধুনিক বাংলা, ওড়িশা ও আসামের কিছু অংশ এর অন্তর্ভুক্ত হয় এবং এটি দেশীয় সংলাপের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য কোন কোন মাগধী নাটকে ব্যবহৃত হয়। মাগধী প্রাকৃতের সংরক্ষিত উদাহরণ বুদ্ধের জীবদ্দশার বেশ কয়েক শতক পরবর্তীকালের এবং এর অন্তর্ভুক্ত হল লিপি যেগুলি রচনার কৃতিত্ব অশোক মৌর্যকে দেওয়া হয়।

মাগধী প্রাকৃত ও পালির সংরক্ষিত দৃষ্টান্তের মধ্যে পরিলক্ষিত পার্থক্যের কারণে পণ্ডিতেরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে পালি একটি মধ্য ভারতীয় ভাষার উত্তর পশ্চিম উপভাষার আঞ্চলিক ভাষা, এটি বুদ্ধের সময়কালে মগধ অঞ্চলে কথিত একটি নিরবিচ্ছিন্ন ভাষা নয়।

পালি ভাষার প্রায় প্রতিটি শব্দের অন্য মধ্য ইন্দো-আর্য ভাষাসমূহ বা প্রাকৃতের সমধাতুজ শব্দ রয়েছে। বৈদিক সংস্কৃতের এর সম্পর্ক কম প্রত্যক্ষ ও আরও জটিল; প্রাকৃত ভাষাগুলির জন্ম হয়েছে প্রাচীন ইন্দো আর্য ভাষাগুলি থেকে। ঐতিহাসিক দিক থেকে পালি ও সংস্কৃতের পারস্পরিক প্রভাব উভয় দিকেই অনুভূত হয়েছে। পরবর্তীকালের সংস্কৃত রচনার সঙ্গে তুলনা করে পালি ভাষার সংস্কৃত সদৃশতাকে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে-এগুলি সংস্কৃত ভাষা জীবন্ত ভাষারূপে শেষ হবার বহু শতক পর রচিত হয়েছিল এবং এটি প্রভাবিত হয়েছিল মধ্য ভারতীয় ভাষার বিকাশ এবং যার অন্তর্গত ছিল মধ্য ভারতীয় শব্দ থেকে সরাসরি ঋণগ্রহণ; অপরদিকে পরবর্তীকালের পালি পরিভাষার

অনেকটা গৃহীত হয়েছে সংস্কৃত ভাষার সমজাতীয় বিভাগের শব্দভাণ্ডার থেকে, হয় সরাসরি নয়ত কিছু ধ্বনিতত্ত্বগত গ্রহণের মধ্যে দিয়ে। 

বৌদ্ধযুগে পালি স্থানীয় ভাষা থেকে কিছু শব্দ ঋণ গ্রহণ করেছে যেখানে পালি ব্যবহৃত হত। এই ব্যবহার পরবর্তীকালের রচনা থেকে সুত্তপিটকে পালির থেকে পৃথক যেমন বৌদ্ধসাহিত্য রচনা বিষয়ক পালি ভাষ্য এবং লোককাহিনী (যেমন জাতক কাহিনীর উপর ভাষ্য) এবং তুলনামূলক আলোচনা এবং গ্রন্থের কালনির্ধারণ ঐ ধরনের ঋণ শব্দের ভিত্তিতে। এখন এটি একটি নিজেই একটি বিশেষ জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র।

পালি কেবল বুদ্ধের শিক্ষা প্রচরের জন্যই ব্যবহৃত হত না এবং এটি বোঝা যায় এই ভাষায় রচিত অনেকগুলি ধর্ম নিরপেক্ষ গ্রন্থ থেকে যেমন চিকিৎসা বিজ্ঞান, সংক্রান্ত গ্রন্থ। তবে, এই ভাষায় পাণ্ডিত্যপূর্ণ আগ্রহ নিবদ্ধ হয়েছে ধর্মীয় ও দার্শনিক সাহিত্যে, কারণ এটি বৌদ্ধধর্মের একটি পর্যায়ের বিকাশের সামনে একটি অনন্য বাতায়ন উন্মুক্ত করে।

পালি একটি অত্যন্ত বিভক্তিযুক্ত ভাষা যেখানে প্রায় প্রতিটি শব্দে মূল অর্থ প্রকাশক মূল ছাড়াও এক বা একাধিক সংযোজক রয়েছে (সাধারণত পরসর্গ) যেটি কোনভাবে অর্থটিকে পরিবর্তিত করে। বিশেষ্যগুলি লিঙ্গ, বচন এবং কারকের জন্য; বাচিক বিভক্তি ব্যক্তি, বচন, কাল ও ভাব সম্পর্কে তথ্যদান করে।

পালি বিশেষ্যের তিনটি লিঙ্গ (পুং, স্ত্রী ও ক্লীব) এবং দুটি বচন রয়েছে (একবচন ও বহুবচন)। বিশেষ্য ও নীতিগতভাবে আটটি কারক প্রদর্শন করে যেমন কর্তৃকারক, কর্মকারক, করণকারক, সম্প্রদান কারক ও অধিকরণ কারক, তবে অনেক ক্ষেত্রে এই কারণগুলির এক বা একাধিক রূপগতভাবে অভিন্ন, এটি বিশেষভাবে সত্য সম্বন্ধপদ ও সম্প্রদান কারকের ক্ষেত্রে।

পালি ও সংস্কৃত অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত এবং এই দুই ভাষার সাধারণ বৈশিষ্টগুলি তারা সকলে চিনতে পারেন যারা দুটি ভাষার সঙ্গেই পরিচিত। পালি ও সংস্কৃত Word Stem এর একটি বড় অংশ রূপে দিক থেকে অভিন্ন কেবল তে পার্থক্য রয়েছে।

একপ্রস্থ ধ্বনিতাত্ত্বিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সংস্কৃত কারিগরী পরিভাষা পালি ভাষায় পরিবর্তিত হয়েছে। এই পরিবর্তন সেই ধ্বনিতত্ত্বগত উপপ্রস্থকে নকল করে যা প্রোটো পালিতে ঘটেছে। এই সমস্ত পরিবর্তনের কারণে এই কথা বলা সর্বদা সম্ভবপর হয় না যে একটি প্রদত্ত পালি শব্দ প্রাকৃত শব্দভাণ্ডারের একটি অংশ নাকি সংস্কৃত থেকে গৃহীত একটি পরিবর্তিত ঋণ শব্দ। একটি পালি শব্দের সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত একটি সংস্কৃত শব্দের অস্তিত্ব পালি শব্দের উৎপত্তিতত্ত্বের নিশ্চিত প্রমাণ নয় যেহেতু কোন কোন ক্ষেত্রে কৃত্রিম সংস্কৃত শব্দ প্রাকৃত শব্দগুলি থেকে back formation-এর মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিল।

নিম্নলিখিত ধ্বনিতত্ত্বগত প্রক্রিয়াগুলি সেই ঐতিহাসিক পরিবর্তনের বিশদ বিবরণ নয় যেগুলির মাধ্যমে প্রাচীন ভারতীয় পূর্বপুরুষ থেকে পালি ভাষার উৎপত্তি হয়েছিল। এবং এটি সংস্কৃত ও পালির সবচেয়ে সাধারণ ধ্বনিতাত্ত্বিক সমীকরণের একটি সংক্ষিপ্তসার, এর মধ্যে সম্পূর্ণতার কোন দাবী নেই।

সম্রাট অশোক অন্তত তিনটি স্থানীয় প্রাকৃত ভাষায় তার ব্রাহ্মীলিপিতে তাঁর আদেশনামা খোদাই করেছিলেন যেগুলির সঙ্গে পালির ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য রয়েছে। ঐতিহাসিক দিক থেকে বিশ্বাস করা হয় পালি বৌদ্ধ সাহিত্যের প্রথম লিপিবদ্ধকরণ ঘটেছিল শ্রীলঙ্কায়, যার ভিত্তি ছিল একটি ভূতপূর্ব মৌখিক ঐতিহ্য। শ্রীলঙ্কার পালি ইতিবৃত্ত মহাবংশ থেকে জানা যায় খ্রী.পূ. ১০০ অব্দে রাজা বট্টগামনীর রাজত্বকালে সে দেশে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বৌদ্ধ সাহিত্য লিপিবদ্ধ করে। খরোষ্ঠি আবুগিডা পাঠোদ্ধার করতে যেমস প্রিন্সেপ গ্রীক লিখন এবং খরোষ্টি লিপিতে ব্যবহৃত পালি যুক্ত দ্বিভাষাকি মুদ্রা ব্যবহার করেন। গান্ধারীয় বৌদ্ধ রচনা আবিষ্কৃত হওয়ার পর এই লিপিটি প্রাচীন বৌদ্ধধর্ম অধ্যয়নে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।

লিখিত পালির সঞ্চারণ বর্ণমালাভিত্তিক মূল্যের একটি বিশ্বব্যাপী ব্যবস্থা রক্ষা করেছে, কিন্তু ঐ মূল্যগুলিকে বিভিন্ন লিপির মাধ্যমে প্রকাশ করেছে। ১৮৪০-এ রাজা মংকুট একটি আরিয়াকা লিপি উদ্ভাবন করেন। এটি গ্রীক ও ব্রহ্মদেশীয় খম লিপি থেকে পালি ভাষায় লিপ্যান্তরের একটি বিশ্ববাপী মাধ্যম রূপে গৃহীত হয় এবং এর উদ্দেশ্য ছিল খম থাই ও তাই থামসহ অন্যান্য অস্তিত্বশীল স্থানীয় লিপিগুলির স্থান দখল করা। তবে লিপিটির ব্যবহার জনপ্রিয় হয়নি। থেরবাদী বৌদ্ধধর্ম যে সমস্ত অঞ্চলে অনুশীলন করা হয় সেখানে পালি ভাষা লিপ্যান্তরের জন্য পৃথক বর্ণমালা ব্যবহৃত হয়।

ভারত: দেবনাগরী, অহম লিপি

বাংলাদেশ: বাংলা, চাক্কা

শ্রীলঙ্কা: সিংহলা

মায়ানমার: মন-ব্রহ্মদেশীয়, লিক-তাই

কাম্বোডিয়া: খমের

থাইল্যাণ্ড: থাই (১৮৯৩ থেকে, ঐতিহাসিক দিক থেকে তাই থাম, খম থাই, এবং আরিয়াকা লিপি।
লাও: লাও (১৯৩০ থেকে, ঐতিহাসিক দিক থেকে তাই থাম)।

পালি বিভিন্ন পরিমাণে দক্ষিণপূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার ভাষাগুলিকে প্রভাবিত করেছে, এদের মধ্যে রয়েছে ব্রহ্মদেশীয়, খমের, এবং লাও, সিংহলা এবং থাই। কাম্বোডিয়াতে ত্রয়োদশ শতকে মর্যাদার ভাষারূপে পালি সংস্কৃতের স্থান অধিকার করে এবং একটি সেখানে থেরবাদী বৌদ্ধধর্মের প্রসারের সঙ্গে সমঃপতিত হয়। ১৯০০ শতক ধরে Chuoon Nath পালি মূল ব্যবহার করেছিলেন 'ট্রেন' এর মত আধুনিক বিষয় বর্ণনার জন্য খমের neologism ব্যবহার করতে। একইভাবে বিংশ শতকে থাইল্যাণ্ডে ও লাওসে জিৎ ভূমিসেক ও বজিরাবুধসহ স্থানীয় পণ্ডিতগণ পালি মূল ব্যবহার করে নতুন শব্দ তৈরি করেছিলেন যা বিদেশী ধারণা এবং কারিগরি উদ্ভাবনা বর্ণনা করত।

মায়ানমারে ব্রহ্মদেশীয় ভাষা প্রাচীন ব্রহ্মদেশীয় রূপে তার প্রাথমিক পর্যায় থেকেই পালি থেকে হাজার হাজার শব্দ তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণ করেছে বিশেষত ধর্ম, সরকার, কলা ও বিজ্ঞান বিষয়ে, অপরদিকে সংস্কৃত ভাষা থেকে ঋণ গ্রহণ সীমাবদ্ধ ছিল বিশেষ বিশেষ বিষয় যেমন জ্যোতিষশাস্ত্র, জ্যোতিবিজ্ঞান এবং চিকিৎসাশাস্ত্র। ব্রহ্মদেশীয় ভাষায় প্রথম দশটি পূরণবাচক সংখ্যা সরাসরি পালি থেকে ধার করা হয়েছে। ব্রহ্মদেশীয় ভাষার বিংশ শতকেও নতুন বর্মী শব্দ তৈরির জন্য পালি মূলের ব্যবহার ও তাদের নব প্রয়োগের একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে; পালি বর্মী ব্যাকরণের গঠনকেও প্রভাবিত করেছে বিশেষত বর্মী সাহিত্যের ভাষাকে। ত্রয়োদশ শতকের মধ্যে পালি ভাষায় প্রথম পুরুষের সর্বনাম পালি ব্যাকরণের অন্তর্গত হয়ে উঠেছে, যেটি পালি বাক্যগঠনরীতি অনুসরণ করে বিশ্লেষক রূপান্তরিত করেছে। ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত বর্মী গদ্যরচনা পালি রচনার দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিল বিশেষত নিস্সয়া রচনাগুলির দ্বারা যেগুলি প্রথম আবির্ভূত হয়েছিল পঞ্চদশ শতকে।

শ্রীলঙ্কায় অনুরাধাপুর পর্ব থেকে পালি সিংহলী ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে বিশেষত সাহিত্যের ক্ষেত্রে এর উদাহরণ হল দ্বীপবংশ ও মহাবংশ ইতিবৃত্ত যার দুটিই পালি গাথায় রচিত হয়েছিল।

অনুরাধাপুরের পর্বের পর সংস্কৃত সিংহলীয় ভাষার বিকাশে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

আমার নিজস্ব বিচার মতে- "পালি সাহিত্যের তথা ভাষার মাগধী ভাষার রূপতাত্ত্বিক, ধ্বনিতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিক প্রচুর মিল পরিলক্ষিত হয়। ললিত বিস্তর অনুসারে বুদ্ধ ৬৪ প্রকার লিপি শিক্ষা জানতেন। ৬৪টি প্রাচীন ভারতীয় লিপির এই তালিকায় এক সংস্করণ একটি ভারতীয় বৌদ্ধ গ্রন্থের চীনা অনুবাদে পাওয়া যায় এবং এই অনুবাদটি ৩০৮ খৃষ্টাব্দের বলে মনে করা হয়। মাগধী ভাষাই পালি ভাষা এই গ্রন্থে নামকরণ যথার্থ-সার্থক বলে মনে করি। ষোড়শ মহাজনপদে মগধ ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী শৌর্যে বীর্যে-ভাষা সংস্কৃতিতে উন্নত। সেই হেতু বুদ্ধের সময়কাল হতেই এই মাগধী তথা পালি ভাষা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং এই ভাষার গ্রহণযো্যতা লাভ করে। আজকে যেমন আমরা ভারতের ১৬টি ভাষা পাই এবং ৬৩০টি উপভাষা পাই। ঠিক তদ্রূপ সেই মগধের শৌর্যবীর্যতার কারণে এই মাগধী ভাষা কম প্রভাব বিস্তার করেনি। বুদ্ধ অবশ্য সব আঞ্চলিক ভাষাও অন্ত্যেজশ্রেণীর ভাষাকে প্রাধান্য দিতেন এবং চুলবগ্নে উল্লেখ আছে ভিক্ষুদের সাধারণ মানুষের ভাষায় উপদেশ প্রদান ধর্মপ্রচার করতে বলেছেন। যেহেতু বুদ্ধ ও বৌদ্ধ সংঘ মগধ তথা কাশী-কোশল থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল সেহেতু ভিক্ষুরা মাগধী ও কাশী অঞ্চলের ভাষাই বেশী কথোকথন করতেন। বিম্বিসার রাজা কাশী যৌতুক হিসেবে মহাকোশলের থেকে পেয়েছিলেন সেই হেতু সেখানে মাগধী ভাষার প্রভাব পড়েছে এই সুনিশ্চিত বলে বলা যায়।”

"বিশেষত মৌর্য সম্রাজ্যের সূচনা হয় তখন মগধ ছিল সমগ্র ভারতের

রাজধানী। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সময় অখণ্ড ভারতের রূপ লাভ করলেও স্থায়ী হয়নি। কিন্তু সম্রাট অশোকের সময়কালেই মগধ ভারতবর্ষের রাজধানী এবং অখণ্ড ভারতবর্ষ সম্রাট অশোক তৈরি করেছিলেন। সেই হেতু সম্রাট অশোককে অখণ্ড ভারতের জাতির জনক বলা যায়। এবং অশোক যেখানে গেছেন সেখানকার ভাষাকে প্রাধান্য দিতেন এবং সেই অঞ্চলের ভাষাতেই শিলালেখ লিখেছেন। তার মধ্যে অবশ্য মাগধী ভাষার রূপ কিছুটা হলেও লক্ষ্য করা যায়। সেই সময়ের শিলালেখগুলোকে অশোকান প্রাকৃত বা অশোকের ব্রাহ্মী। অশোকের শিলালিপি বলে ঐতিহাসিকরা পণ্ডিতরা তাঁদের লেখনীতে ফুটিয়ে তুলেছেন। যেহেতু অশোক মগধ সাম্রাজ্যের অধীশ্বর সেই হেতু মাগধী ভাষাই পালি ভাষা হিসেবে নিঃসন্দেহে বলতে পারি। এখনও পর্যন্ত বর্তমান বিহার কাশী, কোলন বেনারস অঞ্চলের অনেক ভাষার সঙ্গে পালি বৌদ্ধ সাহিত্যের

৯০ শতাংশ মিল পাওয়া যায় এবং যাবে। এবং আচার্য বুদ্ধঘোষের রচিত অর্থকথার ভাষাও মগধ অঞ্চলের সঙ্গে অভিন্ন মিল পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলতে পারি মাগধী ভাষাই পালি ভাষা।" 

"বুদ্ধঘোষ যখন সিংহলে যাত্রা করছেন তখন সমুদ্র পথে আচার্য বুদ্ধঘোষের সঙ্গে সাক্ষাত হয় তখন একে অপরের কথোপকথন থেকে জানা যায়, আচার্য বুদ্ধঘোষ সিংহলে যাচ্ছে ত্রিপিটক সম্পূর্ণ মাগধী ভাষা অনুবাদ করতে। অর্থাৎ ভারতবর্ষ থেকে মাগধী বা পালি সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গিয়েছিলো তার কোন হরফ ও রক্ষিত হয়নি। আচার্য বুদ্ধঘোষ সিংহলে গিয়ে সম্পূর্ণ ত্রিপিটক সিংহল থেকে মাগধী বা পালি ভাষায় অনুবাদ করেন'। তাঁর জীবনীগ্রন্থ আচার্য বুদ্ধঘোষোৎপত্তি এবং চুলবংশে থেকে জানা যায় তিনি সিংহলী থেকেই মাগধী ভাষায় বা পালি ভাষায় ত্রিপিটক অনুবাদ এবং অট্ট কথা পালি তথা মাগধী ভাষার অনুবাদ করেছিলেন। এর থেকে নিঃসন্দেহে বলা যায় মাগধী ভাষাই পালি ভাষা।"

এই গ্রন্থে ড. আচার্য সংঘরাজ সত্যপাল মহাথের সেই কথারই সারতত্ত্ব পরিবেশন করেছেন। সুতরাং ভন্তের কথা অবতারণা করেই বলা যায় ভন্তের চিন্তা চেতনা ও গবেষণা যথার্থই হয়েছে। ভন্তের প্রয়াণের আগে আমাকে এই গ্রন্থ প্রকাশের ভার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। আমি ভন্তেকে কথা দিয়েছিলাম আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব। এবং ভন্তে আমাকে আরো বলেছিলেন এই গ্রন্থটি আমার অনুজ ভ্রাতা-ভগিনির করকমলে তুলে দিতে চাই, সেহেতু এই গ্রন্থটি আমি সম্পাদনা করলেও পর উৎসর্গ ভন্তের মনোস্কামনা অনুযায়ী তাঁর ভ্রাতা ভগিনীর উৎসর্গ দান তুলে ধরলাম। এই গ্রন্থ সম্পাদনা করতে গিয়ে অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি থাকতে পারে, পাঠক সমাজের সদয় দৃষ্টি কামনা করছি। গ্রন্থটি মূদ্রণে কর্ণধার ও সহায়কবৃন্দদের ধন্যবাদ জানাই। এবং আন্তর্জাতিক সাধনা কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক শ্রী আশিষ বড়ুয়া মহোদয়কে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই আমাকে এই কাজের ভার অর্পণ করার জন্য। অলং ইতি বিত্থারেন।

প্রবারণা পূর্ণিমা
২৫৬৯ বুদ্ধাব্দ
২০২৫ ইং

সুমনপাল ভিক্ষু
অতিথি অধ্যাপক
পালি বিভাগ ও
বৌদ্ধবিদ্যা অধ্যয়ন বিভাগ,
কলিকাতা বিদ্যালয়
পালি বিভাগ,
সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়

ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্ম


সুমনপাল ভিক্ষু

ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্মের সংজ্ঞা দেওয়া সহজ নয় এবং আমরা এর যাই সংজ্ঞাই দিই না কেন তা একটি মানুষের ক্ষেত্রে যথাযথ হলেও অন্য অনেকের ক্ষেত্রে নাও হতে পারে। একটি কথা যা আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি তা হল এই যে ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধগণ হল বিভিন্ন প্রকারের একটি গুচ্ছ। ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্মে মানুষ যোগ দিচ্ছে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের থেকে খ্রীষ্টধর্ম থেকে ইহুদীধর্ম, নাস্তিক্যবাদ থেকে নিরীশ্বরবাদ এবং বিভিন্ন ধরণের প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধধর্ম নিকায়গুলি থেকে।

অন্যান্য অনেক সমতুল্য ঐতিহ্য থেকে নিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্ম একটি নতুন সম্প্রদায় এবং এই সম্প্রদায়ের কোন এক প্রকার ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধরা স্টাপেন ব্যাচালার-এর প্রজাতি নয়। সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধরাই স্টাপেন ব্যাচালারকে জানে না, এবং যদি অনেকেই জানে তারা সকলে তাঁর সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের সমস্ত বিষয়ে একমত নয়। সকলে এই পদ্ধতিতে আচার অনুষ্ঠান পালন করে না, বা সুত্তগুলিকে একইভাবে দেখেও না, এবং অনেকে স্বয়ং গৌতম সম্পর্কেও একমত নয়। ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধরা বৌদ্ধধর্মের গৌরবময় ও বর্ণনাময় ইতিহাসকে মুছে ফেলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না, তাঁরা ঐতিহ্যকে আচার অনুষ্ঠান ও বিলাসকে ধ্বংসও করতে চান না। অধিকাংশ ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধই প্রাচীন বৌদ্ধধর্মকে ভুল এবং ধর্ম নিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্মকে ঠিক বলে মনে করেন, আবার নাও করেন।

 ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্ম এমন, একথা বলা সম্ভব। একই ছাঁচে এত বস্তু তৈরী করলে যে তাতে নেক ধর্ম নিরপেক্ষ বৌদ্ধরই স্থান হবে না। তবে কিছু কিছু বিষয়ে মিল রয়েছে। কিন্তু তবু এগুলো সমস্ত ধর্ম নিরপেক্ষ বৌদ্ধের ক্ষেত্রে প্রয়োগ হতেও পারে নাও হতে পারে। অনেক ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধগণ বৌদ্ধধর্মকে কেবল একটি আচার অনুষ্ঠান পালনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন। অনেক ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধ সুত্তগুলির বিষয়ে নির্বিকারাচারবাদী না হলেও বুদ্ধের শিক্ষা সম্পর্ক গভীরভাবে শ্রদ্ধাশীল। আবার অনেক ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধ চারটি আর্য সত্য, অষ্টাঙ্গিক মার্গ এই দুটি থেকে অন্যতম নৈতিকতা এবং সেই করুণাকে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক কেমনভাবে সংজ্ঞায়িত করেন বা এবং আচার অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন তার মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই বিষয়ে পরস্পরের সঙ্গে অনেক সুস্থ আলোচনা ও মতপার্থক্য হয়েছে। অনেক ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধ উৎসাহ ভরে দক্ষতার সঙ্গে এবং সন্দেহের দৃষ্টিতে সুত্তগুলির অনুবাদকে বিচার করেন। তবে সুত্তগুলি নিয়ে অনেক মতৈক্য ও মতপার্থক্য রয়েছে। অবার অনেক ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধরা সুত্ত, বৌদ্ধ ইতিহাস এমনকি বুদ্ধকেও গুরুত্ব দেন না। তারা কেবল অনুশীলন চান; কী করবেন তা জানতে চান।

তারা কী বিশ্বাস করে? বিশ্বাসের ক্ষেত্রে অনেক বৌদ্ধ যদিও তারা ধ্যান এবং মনোযোগ নিয়ে অনেক কাজ করে থাকেন সেই বিন্দুতে পৌঁছান যেখানে তাঁরা তাঁদের নিজেদের বিশ্বাসকে ভালোভাবে আবিষ্কার করতে, ব্যবচ্ছেদ করতে এবং যথাযথ ক্ষেত্রে পরিত্যাগ করতে চেয়েছেন। বিশ্বাস হল একটি ধারণামাত্র যাকে একজন আঁকড়ে থাকে কোন ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য প্রমাণসহ আবার কোন ক্ষেত্রে কোন প্রমাণ ছাড়াই। আমাদের সকলেরই বিশ্বাস রয়েছে, এইভাবেই মানুষ বিশ্ব সম্পর্কে ধারণা গড়ে তোলে। কিন্তু এই বৌদ্ধ অনুশীলন তাদের বুঝতে সাহায্য করার ক্ষেত্রে বিস্ময়কর। কোন ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধরা মনে করেন বুদ্ধ ছিলেন একটি ঐতিহাসিক চরিত্র এবং তার প্রামাণিকতা তাঁদের অনুশীলনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। অবৌদ্ধরা ধর্মনিরপেক্ষ গৌতমকে ঐতিহাসিক চরিত্র বলে মনে করেন না, তাঁরা গৌতমকে কাল্পনিক চরিত্র এবং তাঁর শিক্ষাকে প্রজ্ঞা পরিপূর্ণ বলে মনে করেন যদিও তাঁদের মধ্যে এর মধ্যে কিছু কিছু অর্থহীন। অনেক ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধরা কখনও গৌতমকে নিয়ে কখনও চিন্তাই করেননি এবং তিনি ঐতিহাসিক চরিত্র হোন বা না হোন তাতে তাদের কিছু আসে যায় না। আবার কোন কোন ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধরা কিছু কিছু আচার অনুষ্ঠান পালন করেন যা তাঁরা ঐতিহাশালী বৌদ্ধধর্ম থেকে শিখেছিলেন আবার কেউ কেউ এই আচার অনুষ্ঠানগুলিকে বর্জন করে থাকেন। আবার কোন কোন ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধরা মনে করেন সব শিক্ষাকেই বিজ্ঞানের কষ্টি পাথরে যাচাই করে নেওয়া উচিত। জীবনের পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা উচিত, এবং যে সুত্তগুলিকে জীবনে অনুশীলন করা সম্ভব নয়, সেগুলিকে বর্জন করা উচিত। এমন অনেক ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধরা পুনর্জন্মে বিশ্বাস করেন, আবার অনেকে করেন না।

এমন অনেক ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধরা মনে করেন আমরা প্রজ্ঞার একটি নির্দিষ্ট অবস্থায় পৌঁছে দুঃখের বিনাশ ঘটাতে পারি আবার অনেকে তা মন করেন না। এমন অনেক ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধরা মনে করেন বোধিজ্ঞান হল জাগ্রত থাকার মুহূর্ত। বর্তমানে মনোযোগকে নিবদ্ধ রাখা এবং এর জন্য মানসিক কোন অলঙ্করণ ঘটে না। আবার অনেক ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধরা মনে করেন নিজেকে কোন রকমের বৌদ্ধ বলা বৌদ্ধ সুলভ নয়।

যে বিষয়ে মিল পাই তা হল সকলের বৌদ্ধধর্মে ও তার অনুশীলনে আগ্রহ রয়েছে এবং সকলে কম দুঃখ পেতে চাই বা একেবারেই চাই না। এটা স্বীকার করতে হয় যে কোন একটি স্তরে বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে শিখছি, সেটা কেবল মননশীলতা বিষয়ে আকর্ষণ হলেও। ধর্মনিরপেক্ষকথাটি বিতর্কিত যেটি বিভিন্ন ধরনের সংজ্ঞা লাভ করছে। কখনও ধর্মনিরপেক্ষ বলতে বোঝান হয় ধর্মহীনতা বা অপ্রাকৃতের বিপরীত, এই পৃথিবী সংক্রান্ত, এবং এই জীবন সংক্রান্ত, বা সমস্ত ধরনের ঐতিহ্য ও ধর্মের অনুগামী বা কোন বিশেষ ধর্মকে মেনে না চলা।

এছাড়াও আরো অনেক বৌদ্ধ গোষ্ঠী রয়েছে প্রাকৃতিক বৌদ্ধধর্ম, বাস্তববাদী বৌদ্ধধর্ম। এইসব নামগুলি কেবলমাত্র ছাপ নয়। এগুলি একটি প্রথাগত স্তরে সাহায্য করে, কিন্তু এগুলিকে নিয়ে এক করা বা আঁকড়ে ধরা উচিত নয়। যদি নিজেকে বাস্তববাদী বৌদ্ধ বলতে স্বচ্ছন্দবোধ করেন এবং যদিও ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধ কথাটি কাউকে আকর্ষণ করে তাহলে তাই হয় যদি নিজেকে যেন অনুশীলনকারী বলেন এবং এই সাইবার বিষয়বস্তু উপভোগ করেন তাহলে তো চমৎকার। যে সুত্তগুলিকে পছন্দ করি সেগুলি থেকে একটি শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা হলে মতামতের গোলকধাঁধায় আটক হবেন না, ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধগণ এই সমস্ত বিষয় বিশ্বাস করবেন তখনই এমন একজনের সাক্ষাৎ লাভ করেন, যিনি এগুলিকে বিশ্বাস করেন না। যদি কোন বিশেষ পদ্ধতিতে ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধদের সংজ্ঞা দেন তাহলে এমন করে সাক্ষাৎ পাবেন যিনি অন্যভাবে এর সংজ্ঞা দেন। বরং এরকম করে বলা ভাল আমার এবং আমার অনুশীলনের ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্ম হল বা একথা বলা আমি নিজেকে একজন ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধ বলি কারণ আপনি চাইলে নিজের সংজ্ঞা দিতে পারি, কিন্তু অন্যের সংজ্ঞা দেবার ব্যাপারে সতর্ক হব। কোন সংজ্ঞা আপনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং সেই ছাপকে আপনি কত আঁটসাটভাবে পাবেন সেই দিকে নজর দিন।

ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধদের (অন্যান্য সমস্ত বৌদ্ধদের মতই) মধ্যে অসংখ্য পার্থক্য রয়েছে। আমাদের সবার মধ্যে মিল হল এই আমরা সকলেই দুঃখ পাই এবং আমরা সকলেই এই দুঃখের অবসান ঘটাতে চাই। আমরা এই ভিত্তি থেকে শুরু করি, পরস্পরের প্রতি করুণা অনুভব করি। স্বাস্থ্যকর মতপার্থক্য উপভোগ করি, তথ্যের আদানপ্রদান করি এবং এই অনুশীলনের উপকারিতাকে উপভোগ করি। ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্ম হল বৌদ্ধধর্মের মধ্যে একটি নতুনভাবে উদিত হওয়া মূলত গৃহীদের একটি অন্দোলন। বিভিন্ন বৌদ্ধ আধুনিকতা যেগুলি আধুনিক চিন্তার আলোকে ঐতিহ্যশালী বৌদ্ধ ভাবনা ও অনুশীলনকে পরিবর্তন করতে চেষ্টা করে তাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ধর্মের মূল উপাদানগুলির পূর্ণ বিন্যাসের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্মের ভিত্তি নিহিত রয়েছে। এই উদ্দেশ্যে এটি ঐতিহাসিক সিদ্ধার্থ গৌতম বা বুদ্ধের মূল শিক্ষাগুলিকে পুনরাবিষ্কার করতে চায় কিন্তু একথা প্রকাশ করতে চায় না বুদ্ধ কী বুঝিয়েছিলেন। বরং একটি প্রাচীন পালি সাহিত্যের উপদেশগুলিকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করে যা বুদ্ধের নিজস্ব ঐতিহাসিক প্রসঙ্গে (খ্রীঃ পূঃ ৫ম শতকের গাঙ্গেয় সমভূমির সংস্কৃতি) তাদের অর্থকে প্রকাশ করে আবার একই সঙ্গে আমাদের সমকালে বসবাসরত মানুষদের জীবনে তাদের মূল্য ও প্রাসঙ্গিকতাকে প্রমাণ করে। এই ব্যাখ্যার দুটি দিকই আক্ষরিক অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ, কারণ তারা ল্যাটিন মূল শব্দ saculum এর কথা আমাদের মনে করায় যার অর্থ হল একটি বিশেষ যুগ বা প্রজন্ম। এই আন্দোলনের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি Stephen Bachelar-এর Confession of a Buddhist Athiest-এ সম্ভবত সবচেয়ে ভালোভাবে বিবৃত হয়েছে ।

ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্মে এই প্রস্তাব করা হয় যে আমরা ভারতবর্ষের অধিবিদ্যা বিষয়ক বিশ্বাসকে পিছনে ফেলে আসি। এই সংস্কৃতি মানুষের জীবনকে অমোচনীয় এক দুঃখের জগৎ হিসেবে মনে করে, যার থেকে মুক্তি হিসেবে একজন মানুষ মনুষ্যলোকের বাইরে আশ্রয় খোঁজে এটি সেই দৃষ্টিভঙ্গি যা সমস্ত ধর্মের বৌদ্ধধর্ম এবং হিন্দুধর্ম ও জৈনধর্মের মধ্যে দেখা যায়। অপরদিকে ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্ম বুদ্ধের শিক্ষাকে এই জীবন ও জগতে মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধ করার জন্য প্রয়োগ করে। এই অধিবিদ্যা উত্তর অবস্থানকে গ্রহণ করে একটি বৌদ্ধ কঠোরতার অস্তিত্বশীল ধর্মীয়রূপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, যা বুদ্ধের পারিনির্বাণের পর থেকে বিবর্তিত হয়ে এসেছে। এর পরিবর্তে এটি নিজেকে আজকের অধিবিদ্যা উত্তর দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করেছে এবং নিজেকে বৈপ্লবিক খ্রীষ্টীয় ঈশ্বরতত্ত্বের সঙ্গে একই রাস্তায় আবিষ্কার করেছে যার দৃষ্টান্ত Don Cuput Gainni Vattimo ইত্যাদি ভাবুকদের রচনায় পাওয়া যায়।

একইভাবে ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্ম ক্ষমতার কর্তৃত্বপূর্ণ গঠনকে বাতিল করে থাকে এবং পাশাপাশি গোঁড়া বৌদ্ধ বিশ্বাসের অধিবিদ্যা বৈধতা দান করেছে। এটি ধ্যান অনুশীলনের বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা দানের উপর ভিত্তি করা আধ্যাত্মিক ধারণাকে প্রশ্ন করে আবার এই ধারণাকেও প্রশ্ন করে যে বৌদ্ধ অনুশীলন হল মূলত কোন শিক্ষক বা সম্প্রদায় দ্বারা অনুমোদিত কিছু ধ্যান কৌশল বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন গুরুত্ব দেয় যা স্বাধীনতাকে উৎসাহিত করে এবং একজনের মানবতার প্রতিটি বৈশিষ্ট্যকে অর্ন্তভুক্ত করে যার আদর্শ হল আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ। এই ধরনের মানসিকতা ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত প্রয়োজনের প্রতি বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। সমস্ত সময় ও স্থানে কেবল কোন প্রকৃত পথ বা আলোকপ্রাপ্তির উপর গুরুত্ব দেয় না।

ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্ম একটি জনপ্রিয় শব্দগুচ্ছ পরিণত হয়েছে প্রকাশনা, সাক্ষাৎকার, ব্লক এবং বডকাস্ট এটিতে পরিপূর্ণ সেখানে এই শব্দগুচ্ছের এবং কখনও কখনও এটির ব্যবহারকারীদের প্রশংসা বা সমালোচনা করা হয়েছে। তাই ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্ম কাকে বলে? এটি কি জনপ্রিয় হয়েছে? এটির কি প্রয়োজন আছে? এটিকে কি বাধা দেওয়া উচিত? এটি কী করবে? এটি কী সারাবে? এই সম্মেলনে আমরা এই বিষয়ে আলোচনা করার জন্যই উপস্থিত হয়েছি।

এই শব্দগুচ্ছটি বিদীর্ণ ও নিন্দিত উভয়ই প্রসঙ্গের উপর নির্ভর করে ধর্মনিরপেক্ষবলতে কী বোঝায় তা নিচে আলোচনা করা হল

১) গোঁড়া র্ধমের বিপরীত শব্দরূপে অর্থাৎ উদারপন্থী সহিষ্ণুঅথবা এমনকি বহুত্ববাদী।

২) ঐতিহ্যের বন্ধনে আবদ্ধ নয়, স্পষ্টতই মৌলবাদী নয়।

৩) একেবারেই আক্ষরিক অর্থে এই শতকের

৪) সন্ন্যাস বর্হিভূত বা বিহারের অংশ নয়রূপে।

৫) বিশ্বের সম্পর্ক ঐক্যবদ্ধ মতাদর্শরূপে নয়।

৬) অধিবিদ্যাবিষয়ক নয় নিশ্চিতভাবে এই পৃথিবী সম্পর্কিত।

৭) ধার্মিক নয়।

 যদি আমরা এই সবকটি ধারণাকে একত্রে বিবেচনা করি তাহলে আমরা একটি মিশ্রণে উপনীত হব যা পাশ্চাত্য জগতের বৌদ্ধ আন্দোলনের ফলাফল থেকে খুব বেশি পৃথক নয়। এছাড়াও কিছু স্পষ্টত গোড়া, ঐতিহ্যবাদী, অধিবিদ্যাকেন্দ্রিক, ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতাবাদী বৌদ্ধ ও থাকতে পারে কিন্তু বহু নারী ও পুরুষ এই ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের অন্তত একটিকে পোষণ করে। এছাড়াও ধর্মনিরপেক্ষতার বিকাশ একেবারেই কেবল পাশ্চাত্যের বিষয় নয়, আমাদের অনেকেই বিপস্যনা নবিংশ শতকের শেষে ও বিংশশতকের প্রথমে ব্রহ্মদেশে আবির্ভূত হয়েছিল এবং বৌদ্ধধর্মের অন্যতম কেন্দ্রস্থলে এটি সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপনিবেশিকতা উত্তর এবং মূলত ধর্মনিরপেক্ষ প্রক্রিয়া। প্রাচ্যদেশীয় ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যান্য দৃষ্টান্তও রয়েছে যেমন ধর্মপালের প্রতিবাদী বৌদ্ধধর্ম, শ্রীলঙ্কার সর্বোদয় আন্দোলন, জাপানের সোকা গাকাই, ভারতের আম্বেকদারবাদী বৌদ্ধরা, থাইল্যাণ্ডের ইয়ং বুদ্ধিষ্ট অ্যাসোসিয়েশন।

সমসাময়িক পাশ্চাত্য বৌদ্ধধর্ম এবং এটির প্রায়ই সন্ন্যাস বর্হির্ভূত, উপাদান, কেন্দ্র, আন্দোলন এবং প্রকাশনার দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা এটি লক্ষ করতে পারি যে ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্ম ইতিমধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে পাশ্চাত্যে বৌদ্ধ স্থানান্তরণের অধিকাংশটাই ধর্মনিরপেক্ষ প্রসঙ্গে ঘটছে এবং বৌদ্ধশিক্ষাকে ধর্মনিরপেক্ষ বানানোর এই প্রক্রিয়া বেশ কিছু সময় ধরে চলছে। হ্যাঁ, কিনা তা প্রশ্ন নয় প্রশ্ন হল কেন এবং কী উদ্দেশ্যে? এই বিকাশ বুদ্ধের দর্শনের সঙ্গে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ, যে শক্তি এই আন্দোলন পরিচালনা করছে তার সম্পর্কে কতটা সৎ বা সচেতন আমরা ইতিহাস এবং সংস্কৃতিক গোঁড়ামির সম্পর্কে কতটা ভাবি বা আত্মসমালোচনা করি। শিক্ষার সম্ভাবনা সম্পর্কে কতটা অতীত, ঐতিহ্যের ব্যাখ্যা সম্পর্কে কতটা সর্তক এবং কি বাজী রাখা হয়েছে তা কতটা স্পষ্ট? এই আলোচনার শিরোনাম হিসেবে এবং মনোবিশ্লেষণ সম্পর্কে Karl Knana-এর বিবৃতিকে কিছুটা পরিবর্তন করেছি। বুদ্ধের একজন শিষ্য এবং সমসাময়িক বৌদ্ধদের কাছে ভাষণ দেওয়া একজন সমসাময়িক বৌদ্ধ হিসেবে ক্রম উদ্ভুত হওয়া ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্মের নামে যা কিছু ভাল বা খারাপ ঘটছে সে বিষয়ে মতামত উপস্থাপন করা যাক। যেহেতু এটি ইতিমধ্যেই ঘটছে এবং এই বিষয়ে কিছু তালিকাও সংযোজন করা উচিত।

খারাপটা দিয়েই শুরু করা যাক। এর মধ্যে কিছু বিশ্লেষ মানসিকতা নিয়ে চিন্তিত যেগুলি আকাঙ্ক্ষা ভবিষ্যতে ভুলবশতধর্মনিরপেক্ষবৌদ্ধধর্ম দ্বারা অনুমোদিত হবে

প্রথমটি হল সুবিধাজনক ও সহজ বৌদ্ধধর্ম এটি হল ভালো থাকার উপায় এটি পাশ্চাত্যের মূল্যবোধ, বর্তমান বিশ্বাস এবং গড়ে ওঠা স্পর্শকাতরতাকে কোনরকম ভীতি প্রদর্শন করে না। এটি কোন আঘাত করে না, এটি কোন প্রচেষ্টা, পরিবর্তন, কোন গভীর চিন্তা করে কিছুর মোকাবিলা দাবী করে না। এর বার্তা অত্যন্ত সরল। যদি ভাল লাগে তাহলে এটি মন্দ নয় এবং এর থেকে কোন সমস্যা তৈরী করা উচিত নয়।

দ্বিতীয় প্রকার হল সুন্দর বৌদ্ধধর্ম। এটি ধর্মের অত্যন্ত সহজ রূপ, উপরের সুবিধাজনক বৌদ্ধধর্মের জীবন শৈলীপ্রকার। এটি অত্যন্ত জনপ্রিয়, এর অনেক বিশ্বাসযোগ্য যুক্তি রয়েছে এবং এর মূল সুরটি স্বস্তিদায়ক কঠিন রচনাগুলি পড়ার দরকার নেই, কঠিন প্রচেষ্টা করার, বা মতামতকে পরীক্ষা করার বা সবকিছু ত্যাগ করার ও দরকার নেই। কেবল দয়ালু সৌজন্যপূর্ণ এবং সামান্য একটু বেশী মনোযোগী হতে হবে।

তৃতীয় প্রকারটি হল যুক্তিবাদী বৌদ্ধধর্ম। এটি বৌদ্ধ শিক্ষাকে সমস্ত আধুনিক ভাবনার আলোকে যাচাই করে যেগুলি নিজেদের বৈধ, স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যকররূপে দাবী করে। এটি বিজ্ঞানের যে কোন নতুন আবিষ্কার দ্বারা শিক্ষাগুলিকে সমর্থন করতে চেষ্টা করে। যেমন যুক্তিবাদ, যুক্তিবাদী ইতিবাচকতা, আচরণগত স্নায়ুবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিষয়ক মনস্তত্ব ইত্যাদি। এটির মূল বার্তা হল এই, “যদি আমরা এটি পরিমাপের দ্বারা প্রমাণ করতে না পারি তাহলে এটি সত্যি সত্যি ঘটছে না। এটির বৈধতা প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের কাছে যথেষ্ট প্রমাণ নেই। এর সবচেয়ে খারাপ প্রকার হল Scientism এটি বৈজ্ঞানিক অনুশীলনের প্রয়োগ নয়, বরং একটি আদর্শ এবং ধর্মের বিকল্প। আজ সকলের অন্যতম বক্তা উইনস্টান হিগিনস এটি সম্পর্কে ব্যাপক ও নিখুঁতভাবে আলোচনা করেছেন। বৌদ্ধধর্মের বিজ্ঞানের সঙ্গে নৈকট্যকে অত্যন্ত মূল্য দিই এবং বৌদ্ধ ভাবনা ও অনুশীলনকে ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মবর্হিভূত জ্ঞানের ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করা ও তার দ্বারা প্রভাবিত হওয়াকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিই। কিন্তু তবু এই সমস্ত জনপ্রিয় ধ্যান ধারণাকে সেই সমস্ত প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রে জীবনের বৌদ্ধ শিক্ষার বৈধতা হিসেবে গ্রহণ করতে অনেক দ্বিধাবোধ করি। বৌদ্ধধর্ম, বেশ, কিন্তু আমাদের কাছে এটি প্রমাণ করার মত যথেষ্ট তথ্য নেই যে এই বস্তুটি মস্তিষ্কে প্রভাববিস্তার করে।ত্রিশ বছর ধ্যান করে মনের অজ্ঞতার উৎপত্তি ও বিলোপোর দিকে লক্ষ রেখে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, যে প্রকৃত পক্ষে স্নায়ুবিক পরিবর্তনের প্রমাণ পাওয়ার জন্য উদ্দীপিত হওয়া প্রয়োজন। অবৈজ্ঞানিক ব্যক্তিগত ও কাহিনীগত প্রমাণকে অত্যন্ত গম্ভীরভাবে প্রত্যাখ্যান এবং বিজ্ঞানের নিঃশংসয়ে একথা প্রমাণ করার জন্য অপেক্ষা কথা যে কিছু একটা ঘটেছে পদ্ধতিগত কঠোরতা প্রকারভেদ যেটি সম্ভবত সমস্ত মানুষদের দ্বারা নক্সা করা যাদের আরও ভালো কিছু করার মত কল্পনাশক্তির অভাব রয়েছে। বিজ্ঞান যদি নিজের জন্য এটি দাবী করে তবে তাই হোক। কিন্তু এটিকে কেবলমাত্র নিজের ভালো থাকার লক্ষণ এবং মস্তিষ্কের পরিবর্তনের লক্ষণ হিসেবে না পেয়ে এবং সমগ্র বৌদ্ধ প্রজ্ঞার পরশপাথর হিসেবে পেয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ি এবং যতক্ষণ না আমরা পরীক্ষার মাধ্যমে এটি প্রমাণ করতে না পারছি, সবচেয়ে বৈধ অনুমান হল এই যে বৌদ্ধধর্ম ও ধ্যানের স্বাস্থ্যকর ফলাফল হল সমস্ত পালি টেক্সট সোসাইটির একটি কাজ।

বৌদ্ধশিক্ষার প্রতি সর্বশেষ একটি মনোভাব হল ফ্ল্যাটল্যান্ড বৌদ্ধধর্ম। এগুলি হল অধিবিদ্যা উত্তর সময় এবং ধর্মে কোন আধ্যাত্মিক প্রবণতার সমালোচকরা খুব দ্রুত ধার্মিক মানুষদের এবং তাদের প্রতিষ্ঠানের দ্বারা ধর্মের নামে গত শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া বিপদ ও ক্ষতির দিকে আঙ্গুলি নির্দেশ করবেন। সমস্ত অভিজ্ঞতার অতীত একটি বাস্তবতা বিষয়ে যথার্থই উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত, সমস্ত অবভাসের বাইরে দুধের গোপন কৃষ্ণতা সম্পর্কেযেমন করে একজন কবি বলেছেন। তবে, অধিবিদ্যা ছাড়াও আরো অসাধারণ বস্তুও রয়েছে। সমলোচকরা সহজেই অতিপ্রাকৃত ও আধ্যাত্মিকের পার্থক্যকে লক্ষ করতে ব্যর্থ হন, এমন একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা যাতে আমি বিস্ময় মিশ্রিত মুগ্ধতা অনুভব করেছি, এমন কিছুর সঙ্গে সংযোগ অনুভব করেছি যা পরিধির বাইরে, সেটি আমাকে প্রকৃতই পরিবর্তন করতে পারে একটি অধিবিদ্যাবিষয়ক বিবৃতি, অতীন্দ্রিয় বিশ্বাস, বা একটি কর্তব্যজ্ঞান ভিত্তিক নিরুঙ্কুশ অবস্থান। প্রথমটির মূল্য হ্রাস করা বা পুরোপুরি ছুঁড়ে ফেলা এবং দ্বিতীয়টি প্রতিরোধ করা সেই একধরনের ফ্ল্যাটল্যান্ড বৌদ্ধধর্ম সৃষ্টি করে যার কথা বলা হয়েছে।

যদি আমার ঘ্রাণশক্তি খুব ভালো থাকে এবং যদি আমি কেউ পেঁয়াজ কাটলে ঘ্রাণ নিতে পারি তাহলে যার ঘ্রাণশক্তি ভালো নয়, তার কাছে এটি একটি অতীন্দ্রিয় বা অলৌকিক অভিজ্ঞতা হতে পারে। আমার কাছে এটি অলৌকিক নয়, পেঁয়াজের গন্ধ মাত্র। আমি জানি তা প্রমাণ করতে পারব না, কিন্তু তা আমি জানি। এটি সেই পুরোন গল্প যেখানে কচ্ছপ মাছকে তার শুকনো জায়গায় বেড়াতে যাবার গল্প বলছে তার হাঁটা মৃদুমন্দ বাতাস, সন্ধ্যার সূর্য, পুষ্পিত বৃক্ষের সুঘ্রাণ, এবং মাছ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে তার অভিজ্ঞতায় যা কিছু ভিজে, ঠান্ডা বা তরল নয় তা অভাবনীয় যে শুকনো জমি, বাতাস এবং পুষ্পিত বৃক্ষের নীচ দিয়ে হাঁটা কল্পনামাত্র। যদিও ভদ্র অজ্ঞেয়বাদী অলৌকিক বিষয় সম্পর্কে উন্মুক্ত থাকেন, blattand বৌদ্ধ অলৌকিকতার সম্ভাবনাকেও অস্বীকার করেন এবং তাঁর অভিজ্ঞতার ঠিক বাইরে যা রয়েছে তার যথার্থতা বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। এটি রূপকথার গল্প। আমরা অলৌকিকতাকে ত্যাগ করে বাস্তবে ফিরে আসি, ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্মের ভালো দিকগুলি নিয়ে। সাম্প্রতিক বিকাশের অন্যতম আনন্দের বিষয় এই যে আরো বেশী সংখ্যক মানুষ শিক্ষার সুফল লাভ করছেন এবং প্রাচীন রচনাগুলি পাঠ করার সুযোগ পাচ্ছেন। এটি খুব ভালো সময়। সব মিলিয়ে বৌদ্ধশিক্ষার সম্পদ সেই মানুষদের থেকে বেশী রয়েছে যাঁরা পড়িয়েছিলেন। এটি খুব ভালো, যা পাওয়া যায় তার বিষয়ে আমি সর্বদা ধর্মনিরপেক্ষ।

 বিভিন্ন বৌদ্ধ ঐতিহ্যের মধ্যে বৌদ্ধ শিক্ষাকে প্রতির্নিদেশ দেওয়া দেখে অত্যন্ত আনন্দিত বোধ করি। বিভিন্ন ঐতিহ্যের প্রতিনিধিরা তাঁদের দ্বীপে পাহাড় এবং সাংস্কৃতিক, ভাষাগত ও দর্শনগত ব্যবধানের আড়ালে থেকে যেতেন। বৌদ্ধরা পরস্পরের সম্পর্কে নানারকম মত পোষণ করলেও বাক্যালাপ করতেন না। যদি কোনভাবে তারা পরস্পরের সাক্ষাৎ পেতেন তাহলে তাঁরা তাদের নিজস্ব সম্প্রদায়ের অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সেই ব্যক্তির অবস্থান নির্দেশ করেই খুশি থাকতেন, তারপর দেখতেন তাঁদের নিজস্ব গ্রন্থে সেই বিশেষ সম্প্রদায়টি সম্পর্কে কী লিপিবদ্ধ রয়েছে, তারপর সেই সম্প্রদায়ের তথাকথিত ভ্রান্তি মতাদর্শের কথা চিন্তা করে কম্পিত হতেন এবং তারপর আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। যদিও তাঁরা ভিন্ন রঙের পোশাক পরিহিত তাঁদের সেই বৌদ্ধব্যক্তির কাছে গিয়ে ব্যাপারটি অনুসন্ধান করতে পারতেন তবু তাঁরা অধিকাংশক্ষেত্রেই তাঁদের গ্রন্থগুলি থেকে তাঁদের সম্পর্কে জানতে পছন্দ করতেন— “প্রাচীন বৌদ্ধধর্মের অনুসারী... নিশ্চয়ই একজন বৈভাষিক... গত ১৫০০ বছর ধরে তাদের অস্তিত্ব রয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন সম্প্রদায়গুলির প্রতিটি পাশ্চাত্যে এসে পৌঁছে এর অনেক পরিবর্তন ঘটেছেতাঁদের একই ধরনের সাংস্কৃতিক সমস্যা রয়েছেপাশ্চাত্য শিষ্যরা এবং তাদের অনেকেই সত্যিই পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা করতে শুরু করেছে এবং বৌদ্ধরা নিজের ঐতিহ্যগত বেড়ার আড়ালে এবং তাদের নিজস্ব শক্তির দিকে তাকাতে শুরু করেছে। এটি অনেক বড় একটি আর্শীবাদ এবং পাশ্চাত্যের ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের এর আংশিক কৃতিত্ব প্রাপ্য, যেটি একধরনের নিরপেক্ষ মিলনভূমি দান করেছে।

 বৌদ্ধ অনুশীলন এবং মনের ধারণাকে জ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়তে দেখে নিজেকে উত্তেজিত বোধ করা বর্তমান সময়ে মনোযোগ মূল ধারার মনস্তত্বের একটি অত্যন্ত পরিচিত শব্দে পরিণত হয়েছেকরুণার অনুশীলনের শিক্ষা সক্রিয়ভাবে দেওয়া হচ্ছে এবং আটলান্টিকের উভয় তীরে বিভিন্ন ধর্মবর্হিভূত ক্ষেত্রে গবেষণা করা হচ্ছে পণ্ডিত দার্শনিকরা নৈব্যক্তিকতা ও মনোবিশ্লেষক সম্প্রদায়ের শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করছেন বৌদ্ধ এবং ধ্যানানুশীলনের প্রায়োগিক রূপ সংক্রান্ত তথ্যের আদানপ্রদান চিকিৎসা সংক্রান্ত স্বাস্থ্যসেবামূলক প্রতিষ্ঠান বিষয়ে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। এটি ধর্মনিরপেক্ষ সমাজে বৌদ্ধ ভাবনা ও অনুশীলনের বিভিন্ন মিশ্রিত হতে এবং এমনকি দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হতে দেখে অত্যন্ত উত্তেজনা বোধ করছি। যদিও এই প্রভাবগুলির এবং প্রয়োগগুলির কোন কোনটিকে প্রসঙ্গ বর্হিভূত মনে হতে পারে, সেগুলি বৌদ্ধ শিক্ষার সঙ্গে যোগাযোগের একটি বিস্তৃততর পথকে উন্মুক্ত করতে পারে যেটি চিকিৎসা বিষয়ক মনোযোগ থেকে শুরু হয়, তা বৌদ্ধ মনস্তত্ত্বে আগ্রহে উন্নীত হতে পারে এবং মন ও তার বিকাশের বৌদ্ধধারণা সম্পর্কে গভীরতর জ্ঞান বিদ্যাবিষয়ক চেতনা লাভ করতে পারে।

ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্মের জন্য ইচ্ছার তালিকাটি অত্যন্ত দীর্ঘ এই তালিকার পিঠে দেখছি সেটা ভাগ করে নিতে পারলে সুবিধা

প্রথমত, আমরা বৌদ্ধ রচনাগুলিকে ভালো করে বুঝতে পারি না। কোন জিনিসকে ছুঁড়ে না ফেলে উচিত সেখানে কী আছে তা বোঝা। এবং একথা বিশ্বাস করি না যে সেই মৌখিক ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিতি রয়েছে যার মধ্যে এই স্থানান্তরণগুলি প্রোথিত রয়েছে কেবল এটুকু জানতে পারি বৌদ্ধ রচনাগুলির সম্পর্কে আরো বেশী করে  জানতে এবং সেগুলির দেশনার পরিস্থিতি সম্পর্কে আরো বেশী করে ভাবতে হবে। ভাষাতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক অধ্যয়নে মনোনিবেশ করার প্রয়োজন রয়েছে বিশেষ করে তাতে নিয়োজিত হবার প্রয়োজন রয়েছে যাকে সাংস্কৃতিক অনুবাদনামে উল্লেখ করতে পারি। একটি ভাষা থেকে অন্য ভাষায় গ্রন্থ অনুবাদ করাই যথেষ্ট নয়। বৌদ্ধধর্ম দেখতে গেলে বা লক্ষ করলে দেখা যায় মানুষ অতি সহজেই সংস্কৃত, তিব্বতীয় জাপানী শব্দগুলির ইংরাজী সমার্থক শব্দগুলিকে সহজেই মাথায় রাখতে পারে কিন্তু এই শব্দগুলির তাৎপর্যকে তাদের প্রকৃত অভিজ্ঞতার সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারে না। যিনি সম্প্রতি তাঁর একটি অর্ন্তদৃষ্টিকে জানেন, এ সমস্ত বছরে দুঃখে সম্পর্কে আলোচনা শুনে সত্যিই বুঝতে পারিনি আসলে আমাদের ক্রোধ এক ধরনের দুঃখ বলে উল্লেখ করেছিলেন হয়তো বৌদ্ধ ধারণাগুলির সঙ্গে তাঁর প্রকৃত মনস্তাত্ত্বিক অভিজ্ঞতার সংযোগের সমস্যার মুখোমুখি হওয়া একমাত্র ব্যক্তি নন।

দুটি অনুবাদের প্রয়োজন রয়েছে একটি বৌদ্ধ মূল ভাষা থেকে আমাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় এবং অপরটি হল বৌদ্ধরা সচরাচর ভাষায় যেভাবে কথা বলা এবং যেমন করে চিন্তা করি এবং নিজেদের বুঝি। যে বৌদ্ধশিক্ষার খণ্ডাংশ লাভ করেছি তার দ্বারা নিজেদের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে চিন্তা একেবারেই প্রভাবিত না হতে পারে। ইংরাজীতে অনূদিত হওয়া সত্ত্বেও এই টুকরোগুলি কোনভাবে মনের বৌদ্ধ অংশে থেকে যায় এবং সেখানে বোধ বা অভিজ্ঞতাকে কোনরকম পরিবর্তন করতে না পেরে কেবল থেকে যায়। একজন ব্যক্তি হিসেবে নিজের করা অধিকাংশ অনুবাদই এই দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। মানুষকে দেখাতে চেষ্টা করা হয়। নিকায়গুলি কী বলছে কিন্তু তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার ভাষায়। এটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও ফলপ্রসু পদ্ধতি তবে এর জন্য প্রয়োজন প্রাচীন রচনাগুলিকে আরও ভালোভাবে বোঝা এবং সেগুলো কোন প্রসঙ্গে উৎপন্ন হয়েছে তা আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করা। এখানে জন পিপকের সঙ্গে একমত, যিনি আজ সকালে বৌদ্ধ ইতিহাসের অধ্যয়ন এবং শিক্ষাগুলির প্রাসঙ্গিকীরণের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। বৌদ্ধধর্মের পাশ্চাত্যে স্বাভাবিকরণের পুরোপুরি পক্ষে কিন্তু সেটিকে তার উৎপত্তি থেকে প্রাসঙ্গিকীরণ করার পর অনুগ্রহ করে তা যেন করা হয়কোন জিনিসটির স্বাভাবিকীরণ করছি তা যদি না বুঝি তাহলে এমন কিছুকে স্বাভাবিকরণ করব যা তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

যে পরিমাণে বৌদ্ধশিক্ষা পাওয়া যাচ্ছে এবং যে পরিমাণে শিক্ষা বর্তমানে দেওয়া হচ্ছে তার মধ্যে সামঞ্জস্য নেই। প্রায়শই মানুষকে বোঝাতে পারি না তাদের দেওয়ার মত কী আছে যা তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ বোধলাভের জন্য প্রয়োজনীয় উপায়ও দিতে পারি না। আরো বিস্তৃততর ক্ষেত্রে একথা স্বীকার করার প্রয়োজন রয়েছে যে এই শিক্ষাগুলিকে গ্রহণ করতে শুরু করেছি মাত্র এবং পাশ্চাত্যে বৌদ্ধধর্মের কেবলমাত্র সূচনা হয়েছে মাত্র। এমনকি এখনও পর্যন্ত যতটুকু লাভ করেছি তার থেকে বুঝতে পারি যে এই সম্পদ অত্যন্ত ক্ষমতাশালী, আকর্ষণীয় এবং অনেক বেশী পরিশ্রম ও মনোযোগ দাবী করে। যদি আরো গভীরভাবে অনুসন্ধান করি তাহলে এই সম্পদ আরো বেশী করে খুঁজে পাব নিঃসন্দেহে, এই যে নিকায়গুলির অবদানকে ইউরোপে আরো বেশী করে প্রশংসিত হতে দেখতে পাব। প্রাচীন বৌদ্ধ ধ্যানমূলক মনঃস্তত্ব ও জ্ঞানবিদ্যার গভীর অধ্যয়ন পাশ্চাত্য মনোবিজ্ঞান ও মনঃ চিকিৎসার ক্ষেত্রে অত্যন্ত মূল্যবান হতে পারে। এখনও মনের প্রশিক্ষণের বৌদ্ধ ধারণাকে অনুসরণ করে আরো ইতিবাচক মনোবিজ্ঞানের জন্য আশাবাদী রোগমূলক বিষয়ে অনেক গবেষণাও এবং এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ভাল থাকা, সন্তুষ্টি, করুণা এবং অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতার প্রকৃতি সম্পর্কে গবেষণার খামতি রয়েছে। অবশ্যই মননশীল অনুশীলনের প্রয়োগ সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং এই অনুশীলনের দ্বারা মনের ক্রিয়ার উন্নতিসাধন সম্পর্কে সচেতন হওয়া সম্পূর্ণ পৃথক দুটি বস্তু। মননশীলতা বর্তমানে অত্যন্ত বর্ধনশীল একটি ক্ষেত্র কিন্তু ১৩০ বছরের পুরনো মনোবিজ্ঞান মননশীলতার বৌদ্ধ ধারণার অবাধ্যতার সঙ্গে কতটা লড়াই করছে তা দেখা যায় যদি মনোবিজ্ঞানের মননশীলতার একটি প্রায়োগিক সংজ্ঞায় পৌঁছানোর জন্য হতাশাজনক প্রচেষ্টার কথা বিবেচনা করি। কখনও কখনও মনোবিজ্ঞানের মানদণ্ডগুলিকে সত্যি সম্পর্কে বৌদ্ধ ধারণার জটিলতাকে অপরের কাছে পৌঁছে দেবার তুলনায় কোন কিছুকে পরীক্ষা, প্রমাণ ও বিক্রি করার ক্ষেত্রে বেশী উপযুক্ত বলে মনে হয়। পল প্রসম্যানের মত কিছু গবেষক এই ক্ষেত্রে বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন যার শুরু হয়েছে মননশীল স্তরের যেটা বিচার বিশ্লেষণ করা তাঁর সঙ্গে অন্যান্যরাও এই বিষয়ে সতর্ক করছেন যে মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মননশীলতার আধুনিক ধারণার সব কিছুই যে ঠিকঠাক রয়েছে তা নয়।

দর্শনের ক্ষেত্রে সরাসরি ভাবনামূলক ঐতিহ্য থেকে বৌদ্ধ জ্ঞানবিদ্যা ও তার মন সম্পর্কে বোধ বিষয়ক অধিকতর গুরুত্ব অনুসন্ধান উৎপন্ন হবে বলে আশা করি। এটি কঠিন কাজ হবে কারণ এর অর্থ হল ভাবনার একটি প্রকারে নিয়োজিত হওয়া যা পাশ্চাত্যের দার্শনিক ঐতিহ্য থেকে অনেক ভিন্নপথে বিকশিত হয়েছে। কিন্তু সেগুলির সবই রয়েছে, কেবল সেগুলি তুলে নেওয়া এবং এদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ার অপেক্ষা। সবচেয়ে জোরদার ইচ্ছাটি হল সাহিত্য সমালোচনার অভ্যাসগুলির সাহায্যে নিকায় এবং অভ্যাস অন্যান্য প্রাচীন বৌদ্ধ রচনাগুলির অধ্যয়ন, পাঠভিত্তিক বিশ্লেষণ ব্যাখ্যাবিজ্ঞান এবং আখ্যানবিদ্যা, সাহিত্য সমালোচনার যাবতীয় অধ্যয়ন। বৌদ্ধজগতের ফ্র্যাঙ্ক কারমড, নরগ্রপ ফ্রাই এবং রবাট অন্টাবের মতো মানুষের অভাব রয়েছে। বৌদ্ধ রচনার ক্ষেত্রে এ বিষয়ে অনেক কিছু করতে হবে। একজন সাহিত্য সমালোচকের দৃষ্টি নিয়ে রচনাগুলিকে পরীক্ষা করব আরো সতর্কভাবে এবং বিক্রি করার মতো কোনরকম ঈশ্বরতত্ত্ববিষয়ক (বা শৈল্পিক) দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়াই এবং একমাত্র উদ্দেশ্য হবে কাহিনীগুলিকে কী ঘটছে তা বোঝা। কেমন করে উপমাটি নির্মিত হয়েছে। কার স্বর কথা বলছে? বক্তার দৃষ্টিভঙ্গি এবং লক্ষ্য কী? শ্রোতা কে? এই উপদেশগুলির প্রাসঙ্গিকতা বা পরিবেশ কী?

 কোন একটি রচনা পাঠ করা একটি শিল্প, আরো বেশী করে যদি সেটি ২০০০ বছর বা আরও বেশী প্রাচীন হয়। সমস্ত শিক্ষক বন্ধুরা অভিযোগ করেন যে তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও একটি সহজ রচনার ব্যাখ্যা করতে একেবারেই অপারগ। অনলাইন সংস্কৃতি ব্যাখ্যার দিক থেকে সমস্যায় পড়ে এবং লিখিত কোন বিষয় থেকে অর্থ বের করতে এটির সাফল্য অত্যন্ত কম। এটি এমন একটি দক্ষতা যা তথ্যের ডাউনলোড করার থেকে বেশী কিছু। এবং যেহেতু এই গুরুত্বপূর্ণ মোড় যার গতি ডিজিটলি যুগে আরও বৃষ্টি পেয়েছে এবং সবার উপরে আরো চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই দক্ষতাটি একজন বিশেষজ্ঞর জ্ঞানে পরিণত হয়েছে।

যদি ধর্মশাস্ত্রের শিক্ষার এই জ্ঞানলাভ করতে চাই তাহলে কোনভাবে এর মধ্যে প্রবেশ করতে হবে এবং এখানেই সাহিত্যিক পাণ্ডিত্য আখ্যানবিদ্যা এবং পাঠ্যাংশ বিষয়ক বিশ্লেষণের প্রয়োগ ঘটবে। এই বক্তৃতায় স্টিফেন ব্যাচেলর চারটি আচ সত্যকে গুরুত্ব দিয়েছেন এবং এগুলিকে চারটি কাজ নামে পূর্ণগঠন করেছেন। Ahie in Wonder-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন যেখানে অ্যালিস একটি বোতল খুঁজে পায় যার মধ্যে রহস্যময় কোন পদার্থ ছিল। বোতলের লেবেলে লেখা ছিল না তার মধ্যে কী আছে কেবল লেখা ছিল আমাকে পান কর, জ্ঞানভির থের বলেন, “একইভাবে আমদের ঐ চারটি আর্য সত্যকে দেখাতে হবে আদৌ সত্য হিসেবে নয়, কাজ হিসেবে। বৌদ্ধ বোতলের প্রথমটি বলে আমাকে বোঝো, দ্বিতীয়টি বলে আমাকে ত্যাগ করো, তৃতীয়টি উৎসাহ দেয় আমাকে উপলব্ধি করো, এবং চতুর্থটি বলে আমাকে বিকশিত করো। এই চারটি কাজে ফিরে যাওয়া প্রয়োজন নিরাপদ সত্যহিসেবে নয়, বরং আবেদন এবং প্রকৃত কর্তব্য হিসেবে।

যদি ধর্মনিরপেক্ষে বৌদ্ধরা ধর্মনিরেপক্ষর থেকে বেশী কিছু হতে চায় তাহলে তাদের প্রয়োজন বৌদ্ধ ঐতিহ্যের মধ্যে খোঁজা এবং পৃথক করা যথাসম্ভব কম পূর্ববিচারের সঙ্গে এর অর্থ হল কম্ম বিপাক পুনর্ভ, লোকোত্তরের মর্যাদা এবং জ্ঞান ইত্যাদি চেষ্টা করা এবং তাদের কোনভাবে বাতিল করে না দেওয়া এই কারণে এগুলি প্রাশ্চাত্যের মূল্যবোধ ও সাম্প্রতিক বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, এই প্রস্থ শিক্ষা রয়েছে যার বিষয়বস্তু হল বোধ ও লোকোত্তর জগৎ (অতীন্দ্রিয় জগৎ)। এই শিক্ষাগুলি জোরালোভাবে ধ্যানানুশীলনের মাধ্যমে অতীন্দ্রিয় উপলব্ধির উপর গুরুত্ব দেয়। আমি লক্ষ্য করেছি কয়েকজন ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধ বুদ্ধের শিক্ষার এই বিষয়টিকে স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করেন এবং এই প্রশ্নটি অন্তত বৈধ বলে বিবেচিত হোক যেটি এই উপলব্ধির সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক। যদি উপলব্ধির সম্ভাবনাকে পরিত্যাগ করি তাহলে বুদ্ধের শিক্ষাকে সমালোচনামূলক মানবতাবাদের আরেকটি প্রকারে পরিণত করব এবং তাই ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্ম বুদ্ধের বার্তার কাছে তার প্রায় শত্রুতে পরিণত হবে।

একদিকে স্বীয় পছন্দ নিয়ে সুবিধামত তৈরী করা একটি বৌদ্ধধর্ম এবং অপরদিকে প্রচলিত পরস্পরার একজন ঐতিহ্যশালী বিশ্বাস প্রবণ হওয়ার মাঝামাঝি বিকল্প পথ কী রয়েছে? নিজের পছন্দমতো চলা এবং দৃঢ়ভাবে গোঁড়ামির পথে চলা এই দুইয়ের মাঝে রয়েছে প্রাচীন পাশ্চাত্য আলোকপ্রাপ্তি প্রফুল্ল। এর অর্থ হল বুদ্ধের শিক্ষার ব্যাখ্যায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিশুদ্ধত্বের দাবীর বাইরে বের হয়ে যাওয়া এবং আরো সাধারণতভাবে তাদের নিজস্ব ইতিহাসকে কল্পকাহিনী বানানো এবং এই সমস্ত ঐতিহ্যকে ভুল প্রমাণ করার সবল প্রবণতার উর্ধে উঠে যুক্তিপূর্ণ বৌদ্ধ ধর্ম দিয়ে শুরু করা। একটি সচেতন ধর্ম নিরপেক্ষ বৌদ্ধ দৃষ্টিকোণ এই ঐতিহাগুলির কয়েকটিকে তাদের নিজস্ব অতীত ইতিহাস অনুসন্ধানে সাহায্য করতে পারে।

যদি ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্ম পুরনো কল্পকাহিনীকে পরিষ্কার করার ভালো করা নতুন কল্পকাহিনী থেকে বেশী কিছু হয় তাহলে তার প্রয়োজন হবে নিজের ইতিহাস ও আত্মপ্রতিকৃতির দিকে তাকানো, এটিই তার বিশেষ উদ্দেশ্য। ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে আমরা কী নিরাময় করতে যাচ্ছি? একটি অংশ আশা করে যে ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্ম ধার্মিক হওয়ার মাপকাঠিটিকে ত্যাগ করবে না। যদি তারা ধর্মের পরিধি ছেড়ে বের হয়ে আসে তাহলে গোঁড়া ঐতিহ্যবাদী ও মৌলবাদীদেরই জয় হবে। বৌদ্ধধর্মকে ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্মের নেতা হিসেবে সমালোচনামূলক সচেতন ও আলোকপ্রাপ্ত।

সহায়ক গ্রন্থসূচী:

১) Bachelor, Stephen (2015). After Buddhism Rethinking the Dharma for a Secular Agem. Yale University Press. ISBN 030020518X.

২) Bachelor Stephen (1998). Buddhism without Beliefs. Rinerhead Books. ISBN-57322656-4.

৩) Ward, Tin (1995). What the Buddha Never Tanght, what the Buddha Neur Tanght Celestual Arts. ISBN 0-89087-687-8.

৪) Rasheta, Noah (2016). Secular Buddhism. Blurb.

৫) Harris, Sam (2014). Waking Up A Guide to Spirituality Without Rehgion, Semon and Sehuster. ISBN 978-1451636017.

৬) Wright, Robert (2017). Why Buddhism is True: The Science and Philosophy of Meditation and Enlightenment, Simon and Schuster. ISBN-9781439195468.