সুমনপাল ভিক্ষু
কেউ সহজ মানুষ চিনতে পারে না।
শোক পার হয়ে নিমিষে, যায় সহজের দেশে,
অনা'সে দেখতে পায় সে কারখানে,
যা দেখতে এক্ষণেতে করছ বাসনা।।
বাউল তত্ত্বের উৎপত্তি এবং বিকাশ সম্পর্কে বহুধ অভিমত প্রচলিত আছে। অধ্যাপক সুজিত কুমার মন্ডলের মতে ' বাউল দর্শন প্রাচীন ভারতের চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনজাত।
সকল মানুষকে ভালবাসার মন্ত্র হল বাউলের দর্শন। সাম্যবাদী,
সংসার মুক্ত বঙ্গদেশের এক সাধক সম্প্রদায়
'বাউল' পদবিতে ভূষিত। অপরদিকে ড. নাগেন্দ্র নাথ উপাধ্যায় বলেছেন,
"সাংখ্য যোগতন্ত্র, বৌদ্ধ সহজিয়া ও বৈষ্ণব মতের সমন্বয়ে বাউল তত্ত্বের উদ্ভব। বাউল সম্পূর্ণভাবে বাংলার লোকজীবন হতে উৎসারিত। 'মানুষ তত্ব' হল বাউল সাধনতত্ত্বের মূল লক্ষ্য।
থাকতে বাতি উজ্জ্বলময়
দেখ না যার বাসনা হৃদয়ে,
লালন বলে, কখন কোন সময়
ওরে অন্ধকার হয় বসতি।।
বাউল সম্প্রদায়ের ইতিহাস সম্পর্কিত বিষয়গুলিকে
অবলোকন করলে দেখা যায় যে বঙ্গদেশে মধ্যযুগে বৌদ্ধ সহজমানের একটি অপভ্রংশ রূপ হতে বাউল ভাবনা বিকশিত হয়েছিল। কারণ মধ্যযুগে বঙ্গদেশে উদ্ভূত অন্যান্য সাধক সম্প্রদায়ের
ন্যায় বাউল সম্প্রদায়ের ম্যায় বাউল সম্প্রদায়
ও অপ্রতক্ষ্যভাবে সমাজ সমর্পকের বাইরে, অনেক ক্ষেত্রেই
তারা ছিল ভূমিহীন কৃষক বা সামাজিক ভাবে বহিষ্কৃত একদল অবহেলিত মানুষ অথবা ধর্মান্তরিত ব্যক্তিজন।
হেরি না যা বর্তমানে
কেমনে ধরিব তারে।।
অর্থাৎ সামাজিক ধমোহপাদনে
তাদের কোন অংশ নেই; নেই কোন রূপ সামজিক দায়- দায়িত্ব অমরা বন্ধন। যার কারণে সমাজকে তারা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। অবশ্য এই প্রত্যাখানের পেছনে গভীর দুংখ বোধ বা ব্রামহণ্য বাদের নির্মম উৎপীড়ন।
বিবিদের নাই মুসলমানী
পৈতা যার সেও বাওণী
বোঝো রে ভাই দিব্যজ্ঞানী।।
'বাউল' শব্দটির বুৎপত্তিগত
অর্থ দিয়ে পন্ডিত বর্গের মধ্যে বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন। সাধারণতভাবে
'বাউল' শব্দের অর্থ উদাসী ভাব। আবার অনেকের মতে সংসকৃত ব্যাকুল এবং বাতুর শব্দ হতে 'বাউল' শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। ব্যাকুল বা বাতুর শব্দের শাব্দিক অর্থ হল উন্মাদ বা পাগল। ড. ব্রজেন্দ্র লাল শীলের মডে ধাউল শব্দ হতে বাউল শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। আরবি 'ধাউলিয়া' শব্দ থেকে ধাউল শব্দটি উদ্ভূত।
মধ্যযুগিন
কবি মাশাধর বসুর ' শ্রী কৃষ্ণ বিজয়' কাব্য সর্বপ্রকাশ
'বাউল' শব্দের সন্ধান পাওয়া যায়
মুকল মাথার চুল নাংটা যেন বাউল
রাক্ষসে রাক্ষসে বুলে রণে।
আবার চৈতন্য চরিতামৃত কাব্যে বাউল শব্দের ব্যবহার দেখা যায়।
বাউলে কহিও লোকে হইল আউল,
বাউলেরে কহিও হাটে না বিকায় চাউল।।
বাউল মতকে জানা বা অবগত করার বিষয়ে কোন লিখিত পুথিঁ, গ্রন্থ বা দলিল পাওয়া যায় না। কবি লোবন দাসের ' বৃহৎ নিগম' গ্রন্থ এবং পঞ্চানন দাস' এর বেশ কিছু পুথিঁ ও বৈষ্ণব সহজিয়া সাহিত্য বাউল ভাব এর সন্ধান পাওয়া যায়, তবে লোবন দাস' এর ' বৃহৎ নিগম' গ্রন্থটিকেই বাউল তত্ত্বের প্রামাণ্য
দলিল রূপে গণ্য করা হল।
বাউলমতের আচরণগত বক্তব্য তাদের গূঢ় সাধন পদ্ধতি এবং গানের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। বহুধা বিভক্ত মত এবং আধ্যাত্নিক
পথের সংমিশ্রণে
এই সাধন তত্ত্বটি বিকশিত হয়েছে।
গরুরূপ বালক দিচ্ছে যার অন্তরে
ও তার কিসের আবার ভজন সাধন লোক জনিত করে।।
বাউলদের সাধনায় গুরুর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গুরু ব্যতীত বাউল সাধন অপূর্ণ হয়।' ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা'''' সিদ্ধ হয় তার।'
বাউলদের সাধন নালায় সীমাহীনতা - অসীম হীনতার সম্পর্ক প্রবলতর ভাবে দৃষ্ট হয়। প্রেম এবং দেহতত্ত্বই হল বাউল সাধনার মূল পদ্ধতি। লালন শাহের শিষ্য দুদ্দু শাহ একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত করেছেন তাঁর গানের মাধ্যমে -
কেন কুপমন্ডুক হও রে ভাই
হিসেব করে বোঝ সবাই
খোদার সত্তার কোথাও খোঁজ নাই,
অধীন দুদ্দু ভেবে বলে।
বাউল প্রসঙ্গে সুবিখ্যাত
গবেষক উপেন্দ্রনাথ
ভট্টাচার্যের অভিমত হল, বাউলদের প্রেম প্রকৃতি পুরুষ এবং মিলনাত্মক। প্রাকৃতিক
দেহোহ পত্র আকর্ষণ হতে উদ্ভূত। দেহের উর্ধগত এক আত্মবিস্মৃতিময় অনুভূতি। এই বিষয়টি একান্তই মানবিক। দেহের বাহিরে বাউল দের কোনরূপ সাধনা নেই। বহু বাউল গানে এর উল্লেখ এবং আভাস পাওয়া যায়। যেমন-
বলব কিসে প্রেমের কথা
কাম হইল প্রেমের লতা
কাম ছাড়া প্রেম যথা তথা
নাইরে আগমন।।
বাউল মতে মানব দেহই হল সকল অাধ্যাত্নের
মূল তত্ত্ব এবং সত্যের ভিত্তি অর্থাৎ এক অর্থে মানব দেহ সকল জ্ঞান তথা কর্মের উৎস, দেহ হল বৃন্দাবন,
দেহ হল মক্কা-মদিনা। মানবাত্মার অভ্যন্তরেই
পরমাত্মা লীন হয়ে আছে। বাউলদের অভিমত হল যেহেতু নিজের মধ্যেই পরমসত্ত্বার অধিষ্ঠান,
তাই সর্বপ্রথম
নিজেকে জাগতে হবে। নতুবা বৃথা এই মানব জন্ম।
'মানব ধর্ম', গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন -
মানুষের দেবতা মানুষের মনের মানুষ, জ্ঞানে কর্মে ভাবে যে পরিমাণে সত্য হই সেই পরিমাণেই সেই মনের মানুষকে পাই অন্তরে বিকার ঘটলে সেই আমার আক্ষা মনের মানুষকে মনের মধ্যে দেখতে পাই সে। মানুষের যতকিছু দুর্গতি আছে সেই আপন মনের মানুষকে হারিয়ে, তাকে বাইরের উপকরণে খুঁজতে গিয়ে অর্থাৎ আপনকে পর করে দিয়ে। সেই বাহিরে বিক্ষিপ্ত
আপন হারা মানুষের বিলাপ গান একদিন শুনেছিলাম পথিক ভিখারির মুখে-
"আমি কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যে রে"
বাউল'রা মনে করেন যে প্রেমরস মিশ্রিত অপরোক্ষ অনুভূতি বা সত্তার মাধ্যমেই লাভ করা সম্ভব। ঐকান্তিক সাধনার মাধ্যমে বাউলরা জগতের এমন এক স্থানে উপনীত হন যে সেখানে পরম সত্ত্বার উপলব্ধি ব্যতীত আর কিছুই থাকে না। বাউলরা এই অবস্থার নাম দিয়েছেন লোকত্তীর্ণ
স্থায়ী আনন্দ।
সহজ মানুষের ধারা
ধারা ধরতে হবে জ্যান্ত মরা পাগল পারা,
তায় ধরতে গেলে মরে পড়ে নয়ন সুদে রত্ত।
অসীম এবং সসীম মিলনের এই চূড়ান্ত অবস্থাকে বৈষ্ণবরা কৃষ্ণের নিকট শ্রী ধারার আত্নদর্শন।
অপরদিকে সুফি মতে এই অবস্থার নাম 'কামাফিল্লাহ'। এই প্রসঙ্গে লালন শাহ বলেছেন-
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়
ধরতে পারলে মন বেড়ী দিতাম তাহার পায়।
লালনের এই অভিমতের সঙ্গে গ্রীক ভাববাদী দার্শনিক প্লেটোর অভিমতের সাদৃশ্য পাওয়া যায়। দার্শনিক প্লেটোর মতে জড় দেহ হল আত্নার পিন্জর, রবীন্দ্রনাথের অভিমতও এই প্রসঙ্গে বেশ সামঞ্জস্য
পূর্ণ-
সীমার মাঝে অসীম তুমি
বাজাও আপন সুরে
আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ।
লোকগীতি এবং বাউল তত্ত্ব একে অপরের পরিপূরক। কারণ এক অর্থে লোকগীতি জীবন জীবিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
চারণ কবিরা মূলত ছিল লোকগানের স্রষ্টা এবং পরবর্তী সময় এই গানের মধ্যে নিহিত হয়ে যায় বাউল তত্ত্বের আদিরস। যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে দূরে সরিয়ে রেখে মিলনাত্নক
বিষয়কেই গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।
এমন মানব জমিন রইল পতিত
আবাদ করলে ফলতে সোনা
মনরে কৃষিকাজ জান না।।