স্যার কে যেমন দেখা আমার
Sunday, August 10, 2025
স্যার কে যেমন দেখা আমার
ভূমিকা, দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান মহাস্থবির
ভূমিকা
ওই মহামানব আসে।
দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে
মর্তধূলির ঘাসে ঘাসে ।।
সুরলোকে বেজে ওঠে শঙ্খ,
নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক
এল মহাজম্মের লগ্ন।
আজি অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত
ধূলিতলে হয়ে গেল ভগ্ন।
উদয় শিখের ভাগে 'মাভৈঃ মাভৈঃ`
নবজীবনের আশ্বাসে।
'জয় জয় জয় রে মানব-অভ্যুদয়'
মন্দ্রি-উঠিল মহাকাশে। -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
জ্ঞানতাপস দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান মহাস্হবির অঙ্গদেশরে বৌদ্ধ জগতের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং নিরবসাধক হিসেবে পরিচিত। তিনি একধারে জ্ঞানতপস্বী, সদা ব্রহ্মচারী, বিদ্যোৎসাহী এবং বৌদ্ধপন্ডিত ছিলেন। বৌদ্ধজাতির বিকাশের জন্য মননশীল কাজ করেও যিনি কখনই প্রচারের আলোতে উপস্থিত হন নি বা প্রচারের আলোতে না থেকেও তিনি স্বীয় জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। এক কথায় নিরলস চেষ্টা আর ধর্মীয় ভাবনার মাধ্যমে এবং ব্রহ্মচর্য সমন্বয়ে তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন বুদ্ধ শাসনের এক অকল্পনীয় ইতিহাস।
যো হবে দহরো ভিক্খু, যুঞ্জতি বুদ্ধসাসনে।
সো ইমং লোকং পভাসেতি, অব্ভা মুত্তো ব চন্দিমা। ৩৮২৷৷ -ধম্মপদ, ভিক্খু বগ্গো ।।
যে ভিক্ষু তাঁর সামান্য (ক্ষুদ্র) আয়ুতেই ভগবান বুদ্ধের উপদেশকে হৃদয়ঙ্গম করে নেন, তিনি এই সংসারে তাঁর প্রিয় আধ্যাত্মিক জ্ঞানপ্রকাশ ঠিক সেইভাবে প্রকাশিত করেন, যেমন ইমেল লেখচিত্র নাকি মেসেজ মেঘযুক্ত চন্দ্রমা গগনে প্রকাশিত হয়।
ধর্মপদের এই বাক্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেইঅর্থে তিনি ছিলেন মেঘযুক্ত আকাশে চন্দ্রের ন্যায় উজ্জ্বল।
প্রশ্ন হল, এমন একজন মহাতাপস'কে নিয়ে আমি কী লিখব? যতই তিনি বিস্মৃতির আড়ালে থাকুন, আমি মনে প্রাণে এও বিশ্বাস করি তাঁর মহান কৃতী তাঁকে জীবন্ত করে রাখবে মাটির পৃথিবীতে কেননা যে বা যারা তারা কৃপালাভে ধন্য হয়েছেন, তারা এই মহান জ্ঞান তাপস দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান মহাস্থবিরের প্রতি থাকবেন কৃতজ্ঞা কোনো কিছুর বিনিময়েই তারা অকৃতজ্ঞ হবেন না।
সুপ্পবুদ্ধং পবুজ্ঝন্তি, সদা গোতমসাবকা
যেসং দিবা চ রত্তো চ, নিচ্চং বুদ্ধগতা সতি ॥২০১৬ ৷৷
যে সাধকের স্মৃতি দিবারাত্রি (২৪ ঘন্টা) বুদ্ধবিষয়ক হয়ে থাকেন, সে অর্থাৎ তিনি গৌতম (বুদ্ধ) শিষ্য সদৈব সাবধান(=প্রবুদ্ধ) হরে বিচরণ করেন (পকিন্নক বগ্গো)।
শেষ পর্যন্ত হলোও তাই। অল্পকারের তমিশ্রা ভেদ করে বিস্মৃতির আড়াল ভেঙ্গে এক অনাস্বাদিত প্রাপ্তির আলোর ঝর্ণায় স্নাত হলেন মহান জ্ঞানতপস্বী দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান মহাস্থবির। এই মহান প্রজ্ঞাবীর, সদাসর্বদা পুরস্কার- তিরস্কার-প্রত্যাশার বাইরে থেকে নিরলস ভাবে সাধনা সম্পূর্ণ করে বুদ্ধ শাসন ও বৌদ্ধ জাতির মর্যাদা রক্ষা করেছেন, গৌরব বৃদ্ধি করেছেন।
তিনি কখনই ব্যক্তি পূজার পক্ষপাত দুষ্ট হন নি, কেননা বৌদ্ধধর্মে ব্যক্তি-সত্তা' বা 'আমি' বলে কোনও কিছুকেই স্বীকার করা হয় না। তবে হয় বৈ কি, পুদ্গল'ই হল এই 'আমি'। কিন্তু এই পুদ্গলের বা 'আমি'র কোনও আসল সত্তা নেই, পঞ্চস্কন্ধকে অবলম্বন করে তার একটা ব্যবহারিক সত্তা মাত্র প্রতীত হয়। আসলে এই 'আমি' বা ব্যক্তিসত্ত্বার পিছনে কোনও আত্মা নেই, এই আমি আসলে 'নাম-রূপ' ছাড়া আর কিছুই নয়। নাম-রূপ হল জড় ও চেতন স্কন্ধ সমূহের সমবায়ে, প্রতিভাত লোকব্যবহারের উপযোগী একটা তৎকালীক সত্তা-প্রতীতি মাত্র। সুতরাং এই অর্থে তিনি ছিলেন 'আমিত্ব' বিহীন নিরব সাধক।
আমরা জানি বা না জানি, তিনি কখনই জীবন যুদ্ধে ভেঙে পড়েননি। কখনও বিমুখ হন নি তাঁর পথ ও সিদ্ধান্ত থেকে। কিন্তু তবুও তিনি সমৃদ্ধ করেছেন বৌদ্ধ জাতি এবং সমাজকে।
পামোজ্জ বহুলো ভিক্খু, পসন্নো বুদ্ধসাসনে।
অধিগচ্ছে পদং সন্তং, সঙ্খারূপ সমং সুখং ॥৩৮১।।
যে ভিক্ষু (ধর্মশ্রবণ পূর্বক) অত্যধিক হর্ষযুক্ত হন, যিনি বুদ্ধোপদেশ'এ শ্রদ্ধাশীল হন, তিনি শান্ত, সংস্কারকে উপশমনকারী সুখকর পদ। (নির্বাণ) শাভ করেন (ভিক্খু বগ্গো পঞ্চবীসতিমো)।
১৯ শতক' এর অন্তিম লগ্নে তৎকালীন অবিভক্ত বঙ্গদেশের (বর্তমান বাংলাদেশ) সুপ্রাচীন চৈত্যভূমি (চট্টগ্রাম)র এক প্রসিদ্ধ বুদ্ধ পল্লী (সাতবাড়ীয়া গ্রাম) তে এই মহান কর্মযোগী তথা জ্ঞানতাপস দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান মহাস্থবির জন্মগ্রহণ করেন। এই সময়কাল ছিল বৌদ্ধধর্মের পুনঃ জাগরণের কাল। মাত্র ১২ বৎসর বয়সকাল তিনি সদ্ধম্ম হিতৈষী পুণ্য পুরুষ শ্রীমং ধর্মবংশ মহাস্থবি স্নেহ -সান্নিধ্য লাভ করে বুদ্ধ শাসনে নিজেকে গড়ে তোলার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বাস্তবিক অর্থে একজন জ্ঞানতাপস। বুদ্ধ শিক্ষায় জ্ঞানার্জন'ই ছিল তাঁর একমাত্র সাধনা।
যম্হি সচ্চং চ ধন্মো চ, অহিংসা সংযমো দমো।
সবে বন্তমলো ধীরো, 'থেরো' ইতি পবুচ্চতি। ২৬১৷৷
যে সাধক পুরুষে সত্য, অহিংসা, শীল তথা ইন্দ্রিয় সংযম বিদ্যমান, তিনি'ই বিকাশরহিত (নির্মল), ধৈর্যশালী এবং 'স্হবির পদে শোভিত হন।
১৯২৯ খ্রীষ্টাবেরে ৩১ ডিসেম্বর , তিনি উপসম্পদা লাভ করেন এবং ভিক্ষু দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান' নামে অভিহিত হন। ভদন্ত দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান মহাস্থবির ছিলেন পশ্চাৎপদ বৌদ্ধ জাতিকে আধুনিক বিদ্যা শিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রশ্নে সদা খড়গ হস্ত। তাঁর মহান কর্মযজ্ঞ'কে বিশ্লেষণ করলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'লোকহিত' প্রবন্ধের কথা উঠে আসে। 'আমরা পরের উপর করব মনে করলেই উপকার করতে পারি না। উপকার করবার অধিকার থাকা চাই। যে বড়ো সে ছোটোর অধিকার অতি সহজে করতে পারে কিন্তু ছোটোর উপকার করতে হলে কেবল বড়ো হলে চলবে না, ছোটো হতে হবে, ছোটোর সমান হতে হবে। মানুষ কোনোদিন কোনো যথার্থ হিতকে ভিক্ষারূপে গ্রহণ করবে না, 'ঝানরূপেও নয়, কেবলমাত্র প্রাপ্য বলে গ্রহণ করতে পারবো'।
তিনি সকল সময় বিহার এবৎ বৌদ্ধ সমিতির নানাবিধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আন্তরিকভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। এই অর্থে তিনি ছিলেন একজন কর্মযোগী পুরুষ। জ্ঞান তপস্বী দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান মহাস্হবির নানাবিধ বিদ্যাচর্চা এবং তুলনামূলক শাস্ত্র অনুশীলনে সর্বদা নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতেন। তিনি বাংলা, পালি, সংস্কৃত, ইংরেজী ব্যতীত তিব্বতী ভাষায়ও সুপণ্ডিত ছিলেন।
মায়ানমার' এর স্বাধীনতা লাভের পর তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উ. নু'এর ব্যবস্থাপনায় ষষ্ট বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতি আয়োজন করা হয়। উক্ত মহাসঙ্গীতি'তে ভন্তে শ্রীজ্ঞান মহাস্থবির আমন্ত্রিত অতিথিরূপে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই বিষয়টি পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) বৌদ্ধ জাতির নিকট অত্যন্ত শ্লাঘার বিষয়।
ধম্মারামো ধম্মরতো, ধম্মং অনুবিচিন্তয়ং।
ধম্মং অনুস্সরং ভিক্খু, সদ্ধম্মো ন পরিহায়তি।। ৩৬৪।।
যে ভিক্ষু নিরন্তর ধর্মাচরণে নিয়োজিত থাকেন, ধর্মচিন্তন'রত থাকেন, ধর্মকে মনণ করেন, ধর্মকে অনুস্মরণ এবং অনুগমন করতে থাকেন, এইরূপে সাধক কখনই ভিক্ষুধর্ম হতে চ্যুত হন না।
তিনি ছিলেন অসীম সাহসী বীর্যবান এবং সিংহ বিক্রম পুরুষ। নিজের প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে সদ্ধম্ম এবং বৌদ্ধ জাতিকে বারংবার নানাবিধ বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলে। ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দে মুক্তি যুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য।
ভগবান বুদ্ধ যেমন ভিক্ষুসংঘ স্থাপন করে অজ্ঞানীকে জ্ঞাণাহরণে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, বিশেষতঃ বিদর্শন-সাধনা পদ্ধতি প্রদান করে জীবন মুক্তির পথ উমুক্ত করে দিয়েছিলেন। সেই মহান আদর্শের একজন সুযোগ্য উত্তরসূরী ছিলেন কর্মযোগী দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান মহাস্থবির। তিনি তাঁর আচার্য ধর্মবংশ মহাস্থবির'এর জন-হিতৈষী কর্মযজ্ঞকে একনিষ্ঠ শিষ্যরূপে জীবনের অন্তিমলগ্ন পর্যন্ত ধারণ করেছিলেন। বিদ্যোৎসাহী এবং প্রজ্ঞাবান মহাতাপস দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান মহাস্থবির বৌদ্ধ সমাজ ও জাতির উন্নতি বিধানে সদা জাগ্রত ছিলেন । তিনি মনে করতেন, সে জাতি ধর্মশিক্ষার পাশা-পাশি প্রাশাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত নয়, সে জাতির কখনই আত্নপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।
সো করোহি দীপমত্তনো, খিপ্পং বায়ম পন্ডিতো ভব।
নিদন্তমলো অনঙ্গনো, ন পুন জাতিজরং উপেহিসি ॥ ২৩৮৷৷
অতএব তুমি স্বয়ৎ তোমার একটি দীপ (শরণ স্হল) নির্মান কর। °°°° সকল কার্য বুদ্ধিমত্তা পূর্বক সস্পন্ন কর। এইভাবে, তুমি নির্মল এবং নিঃশ্বাস হয়ে জন্ম-জরা'র জল হতে মুক্তিলাভ করবে (মলবগ্গো,ধম্মপদ)।
ভদন্ত দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান মহাস্থবির ছিলেন একজন ত্যাগদীপ্ত মহাপুণ্যবান সাধক ছিলেন মূল অর্থে ত্যাগের মহিমায় সম্পৃক্ত একজন বিরল ব্যক্তিত্ব। সংকীর্ণতা, আত্ন-অহংকার, আত্মাভিমান এবং আমিত্ব ভাব কখনই তাঁকে পরাভূত করতে পারে নি। তাই তিনি হয়ে উঠেছিলেন ত্যাগব্রতী পুণ্য পুরুষ। তাঁর ন্যায় উদারচেতা, অসাধারণ প্রতিভাশীল তথা সাহসী কর্মবীর বর্তমান সময়কালে অত্যন্ত দুর্লভ। কেননা, যে জাতি নিজের আত্মপরিচয়, ইতিহাস জানে না সে জাতি সত্যই বড় দূর্ভাগা। অর্থাৎ অতীতকে ভুলে যাওয়া সঠিক নয়, অতীত হতে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।
"জ্ঞানের দুর্গম উর্জে উঠেছে সমুচ্চ মহিযায় যাত্রী তুমি,
যেথা প্রসারিত এর দৃষ্টির সীমায় সধনা শিক্ষার শ্রেণী "
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান মহাস্থবিরের সহোদরের মেয়ে ঘরে নাতি সৌনাভ বড়ুয়ার উদ্ধৃতি বা তাঁর দেখা এবং মহাস্থবির মহোদয়ের আশীর্বাদ লাভ করেছিলেন তা উপস্থাপন করলাম-
"দাদু ভান্তের আশীর্বাদ" -১৯৮০ সালের গোড়ার কথা। তখন আমি স্কুলে পড়ি, বয়স হবে বড়জোর দশ। শহর কলকাতার ভিড়ভাট্টা, ট্রাম আর বাসের ধোঁয়ার মধ্যেও আমাদের জীবনে কিছু ছোট ছোট দ্বীপের মতো মুহূর্ত থাকত—যেগুলো আজও স্মৃতির বাতিঘর হয়ে জ্বলছে।
সেদিন ক্লাস শেষে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে আমি সোজা চলে গিয়েছিলাম এন্টালির এক পুরোনো বাড়িতে—যেটি আমরা "পাখি দাদুর বাড়ি" বলে চিনতাম। এই নামকরণের কারণ ছিল স্পষ্ট—সেই বাড়ির বারান্দায় সারি সারি খাঁচা, তার ভিতর ময়না, বদ্রী, টিয়া, এবং আরও কত না রকম পাখি! তাদের কিচিরমিচিরে পুরো বাড়িটা যেন একটা ছোট্ট চিড়িয়াখানা। এই বাড়িতে সেদিন এসেছিলেন একজন বিশেষ অতিথি—আমার মায়ের জ্যাঠা, অর্থাৎ আমার দাদুর (মায়ের বাবা) দাদা। মা তাঁকে বলতেন "জ্যাঠা ভান্তে", আর আমরা, নতুন প্রজন্মের নাতি-নাতনিরা, বলতাম "দাদু ভান্তে"। তাঁর ভিক্ষু নাম ভদন্ত দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান মহাস্থবির। তিনি এসেছিলেন বাংলাদেশ থেকে, কয়েক দিনের পরিব্রাজনে। সেই সময় বাংলাদেশের ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম থেকে কেউ আসতেন মানেই অনেকটা দূরদেশ থেকে আগত কেউ—পার্থক্য শুধু ভৌগোলিক নয়, সাংস্কৃতিকও।
আমি যখন পৌঁছই, তখন তিনি বারান্দার কোণে বসে ছিলেন। এক হাতে একটি পাতলা কাঠের পুঁথি, আর অন্য হাতে মালা। তাঁর বসার ভঙ্গিমা, তাঁর চোখের গভীরতা, তাঁর শরীরী ভাষায় এমন কিছু ছিল—যা আজ বুঝতে পারি, তখনও অনুভব করেছিলাম। আমি একটু সংকোচ নিয়ে সামনে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। তিনি ধীরে, স্নেহভরে আমার মাথায় হাত রাখলেন। সেই আশীর্বাদের মুহূর্তটা আজও ভুলিনি। এক আশ্চর্য প্রশান্তি নেমে এসেছিল। যেন মন-প্রাণ জুড়িয়ে যাওয়া এক আলো আমাকে ঘিরে ফেলেছিল।
ভন্তে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান মহাস্থবির তখনও আমাদের পরিবারে এক শ্রদ্ধেয় আত্মীয় হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তবে পরে জেনেছি—তিনি শুধুমাত্র একজন পারিবারিক আত্মীয় নন, বরং বাংলার বৌদ্ধ ইতিহাসে এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। মা বলেছিলেন, তিনি ছিলেন বাংলার প্রথম স্নাতক বৌদ্ধ ভিক্ষুদের অন্যতম, এবং পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বৌদ্ধ সমাজে অত্যন্ত সম্মানিত। তাঁর ধর্মীয় ভাষণ, লেখা, এবং জীবনযাপন এতটাই গভীর ও নিরহংকার ছিল যে বহু বৌদ্ধ অনুগামী তাঁকে শিক্ষকতুল্য মনে করতেন। তিনি যেদিন এলেন, আমাদের পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের মধ্যে একধরনের নীরব উৎসাহ দেখেছিলাম। কেউ পুজোর মতো ফল, বাতাসা আর পান সাজিয়ে এনেছিলেন। কেউ বলছিলেন—“ভন্তে দাদা এসেছেন, আজ বাড়িটা যেন আশীর্বাদময় হয়ে উঠেছে।” তাঁর কণ্ঠে ছিল এক মৃদুতা, এক নিঃশব্দ শিক্ষার ধারা। তিনি বেশি কথা বলতেন না, কিন্তু চোখে মুখে এক অদ্ভুত গাম্ভীর্য ছিল, যেন কোনো গভীর শান্ত মহাসাগরের প্রান্তে বসে আছেন। সেই সময় আমি হয়তো বুঝিনি, কিন্তু এখন বুঝি—এমন মানুষরা জীবনে একবার আসেন, এবং চিরস্থায়ী ছাপ রেখে যান।
সেই দিনটি আমি আরও একটি কারণে মনে রাখি। তিনি আমার মায়ের জন্য একটি ছোট্ট নোট লিখে রেখেছিলেন। আজও মনে আছে, ছোট্ট একটি প্যাডে লিখেছিলেন—একটা শুভকামনার বার্তা, সম্ভবত কোনও ধর্মীয় উদ্ধৃতি। আমি তখন সেটি পড়তে পারিনি। কিন্তু তাঁর হাতের লেখা দেখে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। যেন ঝরে পড়া মুক্তোর সারি—প্রতিটি অক্ষর নিখুঁত, পরিপাটি, ছন্দময়। তার পাশে আমার নিজের বাংলা লেখা ছিল ছেঁড়াখোঁড়া, অসমান আর বেসুরো। মনে পড়ে, শিশু মনের মধ্যে একটা চাপা লজ্জা কাজ করেছিল—লেখা এমনও হয়?
আজ ২০২৫ সাল। প্রায় অর্ধশতাব্দী কেটে গেছে সেই স্মৃতিময় বিকেলটির পর। সেই বাড়ি নেই, পাখিগুলো নেই, পাখি দাদুও আর নেই। কিন্তু এখনও কখনও কোনো বিহারে প্রণাম দিতে গেলে, বা কখনও কোথাও শান্তভাবে বসে থাকলে হঠাৎ করেই মনে পড়ে যায়—দাদু ভন্তের সেই আশীর্বাদের মুহূর্ত। পরে শুনেছি, তাঁর অনুগামীরা তাঁকে গুরুজী বলেই ডাকতেন। তিনি বহু উপদেশ ও ধর্মপাঠ দিয়েছিলেন বৌদ্ধ মহলে, কিন্তু কখনও প্রচারে আসেননি। তাঁর নাম এখনও বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বৌদ্ধ মহলে সশ্রদ্ধ চেতনায় উচ্চারিত হয়।
আজ এই স্মৃতিচারণ শুধু একটি ব্যক্তিগত মুহূর্তের নস্টালজিয়া নয়—এটা একটি প্রজন্মান্তরের সেতুবন্ধ। আমার শৈশবের এক নিঃশব্দ দীপ্তি, এক আশীর্বাদ, যা সময়ের পরতে পরতে আমার জীবনে আলো ফেলে গেছে। তিনি শুধুমাত্র একজন সাধু পুরুষ ছিলেন না, তিনি আমাদের পরিবারের অহংকার। আমাদের দাদু ভান্তে, মা’র জ্যাঠা ভান্তে—যাঁর হাতের ছোঁয়া আমার ভেতরে চিরকাল থেকে যাবে।"
তাঁর ন্যায় মহাতাপস ১৯ শতকের অন্তিম ক্ষণে বঙ্গদেশের বৌদ্ধ জগতে জন্মগ্রহণ করে নি এবং শীঘ্রই যে জন্ম নেবে তাও আমার মনে হয়না। কারণ তিনি ছিলেন বৌদ্ধবিদ্যা বিশারাদ।' জ্ঞানতাপস দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান মহাস্থবির ১৯৮০ খ্রীষ্টাব্দে, ২৩ নভেম্বর আকস্মিকভাবে কালকবলিত হন। তাঁর এই প্রয়াণে বৌদ্ধসমাজের এক মহানক্ষত্র নির্বাপিত হয়। 'সব মরণ নয় সমান,' এই কথটির উৎপত্তিগত অর্থ হল 'সকল মৃত্যু সমান নয়'। কোনও কোনও মৃত্যু বুনো হাঁসের পালকের থেকে হালকা আর কোনও কোনও মৃত্যু হিমালয় পর্বতের থেকেও ভারী। ইতিহাস ও তো এই কথাই বলে।
তাঁর কথা আমার স্পষ্ট মনে নেই, ১৯৮০ সালের মে মাসে পাঁচ বছর বয়স, আমার বাবা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে সেই একবার দর্শন লাভ করেছিলাম। আশীর্বাদ পেয়েছিলাম, বাবা ছোট বেলায় আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন পরিচয় করাতেন। তাঁর বুদ্ধ বন্দনা "দীপন" বইটি আমার বাবাকে দিয়েছিলেন।
কবি মোহিতলাল মজুমদার বলেছেন, 'জীবনের ফুল বড় হয়ে ফোটে মরণের উদ্যানে'। আর এটাই হল ব্রহ্মচর্য এবং পুণ্য জীবনের সারতত্ত্ব অন্যভাবে বলতে হয় :
পৃথিবীর ওই অধীরতা
থেমে যায়- আমাদেরে হৃদয়ের ব্যাথা
দূরের ধুলোর পথ ছেড়ে
স্বপ্নেরে-ধ্যানেরে
কাছে ডেকে লয়;
উজ্জ্বল আলোর দিন নিভে যায়,
মানুষেরো আয়ু শেষ হয়।
,,,,,,,সময়ের হাত এসে মুছে ফেলে আর সব-
নক্ষত্রেরো আয়ু শেষ হয়! -জীবনানন্দ দাশ।
ড জিনবোধি ভিক্ষু মহোদয় রচিত জ্ঞানতাপস দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান মহাস্থবিরের জীবনি গ্রন্থ রচনা সত্যিকার অর্থেই সময়ের দাবি রাখে। ভবিষ্যত প্রজন্মের সমাজ সদ্ধম্ম রক্ষায় সুচিন্তিত ও পরিশীলিত সংস্কৃতির রক্ষায় মুখ্য ভূমিকা রাখুক এই প্রত্যাশা কামনা কলছি।
অলং ইতি বিখারেণ।
সুমনপাল ভিক্ষু
অতিথি অধ্যাপক
পালি বিভাগ ও বৌদ্ধ বিদ্যা অধ্যয়ন বিভাগ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, পালি বিভাগ, সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়, কোলকাতা।
২৫৬৯ বুদ্ধাব্দ
২০২৫ ইংরেজি
মধু পূর্ণিমা
কোলকাতা
Sunday, July 20, 2025
ভগবান বুদ্ধের আলোকে বিবেকানন্দ: একটি আলোচনা
ভগবান বুদ্ধের আলোকে বিবেকানন্দ:
সুমনপাল ভিক্ষু
"কি পনানন্দ ভিক্ষুসংখ্যা মযি পচ্চাসীসতি?
দেসিতো আনন্দ ময়া ধম্মো অনন্তরং অবাহিরং করিত্বা নতমানন্দ তথাগতস ধম্মেসু আজরিয়মুটিব। ....অহং খো... এতরহি জিন্নো বুদ্ধো অসীতিকো মে বমোবত্ততি। সেয্যাথাপি আনন্দ জজ্জরসংকটং ... তস্মতিহানন্দ অত্তদীপা বিহরথ অত্তসরণা ন অনঞসরণা, ধম্মদীপা ধম্মসরণা ন অনসরণা।" অর্থাৎ, “হে আনন্দ, ভিক্ষুসংঘ, আমার নিকট হতে আর কী আশা করেন? আমি ধর্ম অনন্তর-অব্যাহ করে (নিঃশেষ) উপদেশ প্রদান করেছি। তথাগতের ধর্মে আচার্যমুষ্টি নেই।... আমি এখন জীর্ণ বৃদ্ধ হয়েছি.... ৮০ বর্ষ আমার আয়ু হয়েছে...... যেমন জরাজীর্ণ শকট... অতএব আনন্দ, আত্মদীপ হয়ে আত্মশরণ, অনন্যশরণ, ধর্মদীপ, ধর্মশরণ, অনন্যশরণ হয়ে তোমরা বিচরণ কর।" মহাপরিনিব্বান সুত্ত, পৃ. ৯১।
উনিশ শতকে বঙ্গদেশের শিক্ষিত সমাজে প্রাচ্য সংস্কৃতির প্রভাবে যে সমাজ সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল তাকে আমরা কেতাবী ভাষায় বলি 'রেনেসাস অফ বেঙ্গল' বা বঙ্গীয় নবজাগরণ। কিন্তু এখানে প্রশ্ন আসতেই পরে যে বিবেকানন্দের কর্মজীবনের সঙ্গে 'বঙ্গীয় নবজাগরণ'এর সম্পর্কই বা কী? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের ভারতবর্ষের আধ্যাত্ত্বিকতার প্রসঙ্গটি অবশ্যই অবলোকন করা প্রয়োজন নতুবা আলোচনার বিষয়টিকে বিন্যস্ত করা নেহাত অসম্ভব হয়ে উঠবে।
তবে একটি কথা এখানে স্পষ্ট অর্থে বলা দরকার যে এই আলোচনায় বিবেকানন্দ সম্পর্কে নতুন কিছু বিষয় আবিষ্কারের চেষ্টা বিন্দুমাত্র করিনি কিংবা উক্ত বিষয়ক আলোচনার পরিধিকে বর্ধিত করারও উদ্যোগ নিইনি। কারণ আমার সীমিত জ্ঞানে তা করা কোনো ভাবেই সম্ভবও নয় এবং এ আলোচনায় সীমিত পরিসরে সে চেষ্টা করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আমি শুধু বিবেকানন্দের আলোকে বুদ্ধ বিষয়টিকে সুসম্বদ্ধভাবে এক সুতোয় গেঁথে সাধারণ পাঠকের উপযোগী করে পরিবেশন করার চেষ্টা করেছি এই মাত্র। তবে এ কাজ করতে গিয়ে কোথাও যদি বৌদ্ধ ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়গুলি উপস্থাপিত করে থাকি, তাহলে পাঠকদের কাছে আমার অনুরোধ উক্ত বিষয়টিকে আমি আলোচনার আঙ্গিক রূপেই গ্রহণ করেছি, কোনো ঐতিহাসিক আবিষ্কার হিসেবে নয়।
প্রসঙ্গত মর্মে বলা প্রয়োজন, বহু প্রাচীনকাল হতে ভারতবর্ষে ধ্যান করার বিষয়টি প্রচলিত রয়েছে। সিন্ধু সভ্যতার যুগেও ধ্যানের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। হরপ্পা-মহোঞ্জাদারো হতে প্রাপ্ত কিছু শিলমোহরে আমরা ধ্যানী যোগীর চিত্র পাই। অধ্যাপক হুইটনী, মার্টিন হগ্ এবং ম্যাক্সমুলার প্রমুখ পণ্ডিতগণ ভারতীয় সাধকদের এই ধ্যান পদ্ধতিকে অনার্য ধর্মাচরণ পদ্ধতি বলে উল্লেখ করেছেন। প্রথম দিকে আর্য জাতির মধ্যে ধ্যানের বিষয়টি পরিলক্ষিত না হলেও পরবর্তী পর্যায়ে তারাও এই অনার্যরীতি গ্রহণ করেছিল। রামায়ণ এবং মহাভারতে ধ্যানের কথা আছে। মহাভারতে ধ্যানের অনুষঙ্গিকতা যেমন, উপবাস, অনিন্দ্রা এবং কৃচ্ছসাধনারও উল্লেখ পাওয়া যায়। বৌদ্ধ গ্রন্থ মহাবর্গ, মহাবস্তু, ললিত বিস্তর তথা বুদ্ধচরিত'এ বুদ্ধের ধ্যান সম্পর্কিত তত্ত্ব পরিলক্ষিত হয়। তবে সেই ধ্যান বা তপস্যার (বুদ্ধ) বিষয়টি ছিল নিগূঢ় তত্ত্বের সন্ধান। প্রাচীনকালে ধ্যান বিষয়টি শুধুমাত্র কৃষ্ণসাধনার মাধ্যমেই সম্পাদিত হতো। এটাই ছিল ভারতবর্ষের চিরন্তন রীতি। কৃষ্ণসাধনা ছিল নানাবিধ। দীর্ঘনিকায়'এর 'মহাসীহনাদ সূত্রে' তৎকালীন কৃষ্ণসাধনের রীতি সম্পর্কিত বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। জৈন এবং শৈব সাধকদের মধ্যে এই ধ্যানের প্রাধান্য দেখতে পাওয়া যায়। সিদ্ধার্থ (পরবর্তী সময়ে বুদ্ধ) প্রথম দিকে এই পদ্ধতি গ্রহণ করলেও পরবর্তী পর্যায়ে তা বর্জন করে আবিস্কার করলেন 'মধ্যমপথ' (মজঝিমপটিপদা)। শুধুমাত্র ধ্যানে নয়, জীবনের সর্ব বিষয়ে তিনি এই 'মধ্যমপথ'কে প্রযোজ্য বললেন। এই সত্য উত্তরকালে মানবজীবনে এক নতুন দিকদর্শনের আঙ্গিক নির্মাণ করেছিল। ভারতীয় আধ্যাত্মিক সাধনায় বুদ্ধের এই অবদান অনস্বীকার্য।
Here
in lies the Buddhist rejection of the whole ascetice tradition that sems to
have persisted in Indian religiosity since Vedic times. (Theravada Meditation
winston L. King).
বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শনের চরম এবং পরম লক্ষ্য হল নির্বাণ। চতুরার্যসত্য হল দুঃখ নিরোধের জন্য বুদ্ধের প্রদর্শিত মার্গ। সেই মার্গ বা পথ ধরে আটটি নীতি মেনে চললে 'আসব'-এর (হীনতা) ক্ষয় হবে। আর 'আসব' না থাকলে অবিদ্যও (অজ্ঞানতা) থাকবে না। কলুষও থাকবে না। মানুষ তখন শুদ্ধ, পবিত্র। এই পবিত্র চিত্তে অর্হত্ব প্রাপ্তির পর নির্বাণ লাভ। সেই হিসেবে অর্হত্ব প্রাপ্তির পর যে মৃত্যু তাকেই আমরা নির্বাণ বলে বুঝি। বুদ্ধ স্বয়ং বুদ্ধত্বলাভের পর অর্হত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন। মহাপরিনির্বাণেই তিনি নির্বাণ প্রাপ্ত হলেন। বুদ্ধ বলেছেন, 'প্রদীপ নিভে গেলে আর জ্বলবে না। অর্হত্ব ও সেইরূপ নির্বাণের পর আর জন্মলাভ করবে না (সংযুত্তনিকায়)। নির্বাণেই নাম-রূপের সমাপ্তি। পুনর্জন্ম আর হবার নয় এবং মানুষ দুঃখ থেকে চিরতরে মুক্ত হবে।
'অরিয়-পরিয়সন' সূত্রে বুদ্ধ বলেছেন, 'সত্যের সন্ধানে গৃহ্যাগ করে নানা কিছু উপলব্ধির মাধ্যমে তিনি দুটি সত্যের সন্ধান পেয়েছিলেন। প্রথমটি হল, প্রতীত্যসমুৎপাদ এবং দ্বিতীয়টি হল নির্বাণ। এই সকল জ্ঞান প্রাপ্তিই বুদ্ধত্বলাভ। অর্থাৎ তিনি জ্ঞানী বা সর্বজ্ঞ।
'অত্তা হি অত্তনো নাথো, কো হি নাথো পরো সিয়া।
অত্তনা হি সুদন্তেন,
নাথং লভতি দুল্লভং।।১৬০।।
অর্থাৎ, মানুষ স্বয়ংই নিজের ত্রাণকর্তা (উদারক) অপরকে তার ত্রাণকর্তা হতে পারে। রূপে দমন করে নেওয়ার পরই সে মানুষ দুর্লভ নাথ (নির্বাণ) কে লাভ করতে পারে। সর্বপ্রথম নিজেকে উত্তম ধম্মপদ। পৃষ্ঠা ৪৬।
বুদ্ধ কর্মের সার মানসিক সংকল্প অথবা কর্ম সম্পাদনের মানসিক নির্ণয় মনে করতেন যাকে 'চেতনা' বলা হয়। 'হে ভিক্ষুগণ,
আমি চেতনাকে কর্ম বলেছি, চেতনা-পূর্বক কর্ম সম্পাদিত হয়। শরীর দ্বারা বাণী দ্বারা মন দ্বারা।'
(সংযুত্ত নিকায়, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৩৯, ৪০) অঙ্গুত্তর নিকায়, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১৫৭। অভিধর্ম কোশেও কর্মের পরিভাষাকে 'চেতনা' এবং 'চেতয়িত্বাকরণ' বলা হয়েছে। (অভিধর্ম কোশ, ৪.১) আচার্য নাগার্জুন বলেছেন-
"চেতনা চেতয়িত্বা চ কর্মোক্তং পরমর্ষিন।
তস্যানেকবিধো ভেদঃ কর্মনঃ পরিকীর্তিতঃ।।
তত্র যচ্চেতনেত্যুক্তং কর্ম তন্মানসং স্মৃতম্।
চেতয়িত্বা চ যভূক্তং তত্ত্ব কায়িকবাচিকম্।।" মধ্যমক, ১৭.২-৩।
এই প্রসঙ্গে চেতনার অর্থ সংকল্প অথবা কর্মের মানসিক নির্ণয় রূপে গ্রহণ করা উচিত। একথা স্পষ্ট যে কর্মের বিষয়ে ভগবান তথাগতের (বুদ্ধ) সিদ্ধান্ত নিগ্রন্থ মত হতে সম্পূর্ণ রূপে ভিন্ন ছিল কারণ নিগ্রন্থ কর্মকে পৌগলিক মনে করতেন।
শুধু নিগ্রন্থ মতই নয়, বেদানুসারী মত হতেও এই বিষয়ে বৌদ্ধ সিদ্ধান্তেরও মত-পার্থক্য ছিল। বৈদিক মতে কর্মকে জীবরূপীকর্তার বিষয় এবং তা হতে উৎপন্ন অদৃষ্ট শক্তি রূপে গ্রহণ করা হয়, কিন্তু প্রাচীন বৌদ্ধ সন্দর্ভে কর্মকে কোন অনুবর্তমান কর্তার ধর্ম রূপে স্বীকার করা হয় নি। সংযুত্ত নিকায় এর এই বাক্যটি এ প্রসঙ্গে অতীব গুরুত্বপূর্ণ 'কর্ম অনাত্মকৃত'। 'না এই শরীর তোমার, না অপরের শুধুমাত্র পুরাতন কর্মই সম্পাদিত হয়।' 'জীব এবং শরীরকে এক রূপে স্বীকার করলে ব্রহ্মচর্যবাস হয় না, না তো ভিন্ন রূপে স্বীকার করলে।' না তো এইটি আত্মকৃত, না পরকৃত। হেতুর সহায়তায় উৎপন্ন হয় এবং হেতু অবশিষ্ট না থাকলে নিরূদ্ধ হয়ে যাবে।
সুতরাং বুদ্ধের সিদ্ধান্ত অনুসারে কর্ম এবং কর্মফল হল একটি অনাদি ও অবিচ্ছিন্ন পরম্পরা মাত্র যেখানে কর্মের সম্পাদন এবং তার পরিনাম, উভয়ই সমান প্রবাহের পতিত ঘটনামাত্র। এই মতে কোন অনুগত এবং স্থায়ী কর্তা তথা ভোক্তার বিষয়কে স্বীকার করা হয় না।
কর্মের মূল হল তৃষ্ণা, এবং তৃষ্ণা অবিদ্যার প্রতি নির্ভরশীল,
অপরদিকে সুখের অনুভব'এর প্রতি। সংযুত্ত নিকায় (খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১৭৮) তে বলা হয়েছে, হে ভিক্ষুগণ! সংসার হল অনাদি। অবিদ্যা দ্বারা আচ্ছন্ন এবং তৃষ্ণা। দ্বারা আবদ্ধ হয়ে এক জন্ম হতে অপর জন্মে প্রবাহিত হয়। আচার্য নাগার্জুন বলেছেন-
"পূর্বা প্রজ্ঞায়তে কোটির্নেত্যুবাচ মহামুনিঃ।
সংসারোহনবরাগ্রো হি নাস্যাদির্নাপি পশ্চিমম্।।"- মধ্যমক, ১১.১।
বিনয়'এর মহাবর্গ'তে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যে সারনাথে ভগবান তথাগতের (বুদ্ধ) ধর্মদেশনা শ্রবণ করে পঞ্চবর্গীয় সাধক তাঁর নিকট হতে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছিলেন। এইভাবে আর্য ভিক্ষু সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। বারাণসীর শ্রেষ্ঠী পুত্র যশ সহ অন্যান্য মিত্র তথা আত্মীয়বর্গ প্রব্রজ্যা গ্রহণ করলে তথাগত ব্যতীত ৬০ ভিক্ষু সংঘে অন্তর্ভুক্ত হয়। এই সকল ভিক্ষুগণকে বুদ্ধ ভারতবর্ষের বিভিন্ন জনপদে ধর্মপ্রচার এবং ভিক্ষু সংঘ স্থাপনের অনুমতি প্রদান করেছিলেন। রাজগৃহে মগধরাজ বিম্বিসার বুদ্ধের উপাসক হন এবং বেণুবন উদ্যান ভিক্ষুসংঘকে দান করেছিলেন। এইভাবে মহাপরিণির্বাণের সময়কাল পর্যন্ত ভগবান বুদ্ধ (৪৪ বর্ষ অবধি) ভারতবর্ষের জনপদ সমূহে উপদেশ প্রদান এবং সহস্র ভিক্ষু-ভিক্ষুণী,
উপাসক উপাসিকা তাঁর অনুগামী হয়েছিলেন।
তথাগতের সময়কালে অন্য পরিব্রাজকগণের ক্ষেত্রে সঞ্চালক গুরু অথবা তাঁর অবর্তমানে গণের নেতৃত্বের প্রশ্নে উত্তরাধিকার ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল কিন্তু ভগবান বুদ্ধ (তথাগত) তাঁর উত্তরাধিকার রূপে কোন ব্যক্তি বিশেষকে নির্বাচন না করে ধর্মানুশাসনকেই ভিক্ষুদের মার্গদর্শন রূপে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই অর্থে ভগবানের মহাপরিনির্বাণের পরে মগধ মহামাত্র বর্ষকার ভিক্ষু আনন্দকে প্রশ্ন করেছিলেন শাস্তা'র (বুদ্ধ) পরে সংঘের প্রতিশরণ কে। ভিক্ষু আনন্দ এর উত্তরে ধর্মকেই প্রতিশরণ বলেছিলেন। এক্ষেত্রে এই বিষয়টি স্পষ্টতর হয় যে প্রচলিত প্রথার (গুরুবাদ) বিরুদ্ধে তথাগত তাঁর শিষ্যের সংগঠনকে শাস্ত্রমূলক না করে বুদ্ধানুশাসন মূলক করেছিলেন।
ঐতিহাসিক তথা পণ্ডিতবর্গের মতানুসারে গণতন্ত্রের প্রশংসক হওয়ার কারণে বুদ্ধ তাঁর অবর্তমানে ভিক্ষু সংঘের নেতৃত্ব কোন ব্যক্তি'র হাতে সমর্পণ না করে তাতে 'ধর্ম-রাজ্য' এবং 'গণ-রাজ্য' স্থাপন করেছিলেন। তাঁরা এই সম্ভাবনার প্রতিও দৃষ্টিপাত করেছেন যে 'বিনয়'তে উল্লেখিত অনেক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং পারিভাষিক শব্দ বৌদ্ধ সংঘ তৎকালীন গণরাজ্যতে প্রচলিত বিধি-নিয়ম হতে গ্রহণ করেছিল। মগধের মহাপাত্র বর্ষকারকে তথাগত তাঁর মহাপরিনির্বাণ-এর কিছুদিন পূর্বে রাজগৃহে বলেছিলেন যে তিনি (বুদ্ধ) বজ্জিদের বৈশালী'র সারনন্দ চৈত্যে ৭ অপরিহানীয় ধর্মের উপদেশ প্রদান করেছিলেন। এই বিষয়টি থেকে স্পষ্টতর হয় যে মহাপরিনির্বাণ সূত্রে বজ্জিদের ৭ অপরিহানীয় ধর্মের উল্লেখ করে তিনি ভিক্ষু সংঘকে অনুরূপ ৭ অপরিহানীয় ধর্মের উপদেশ প্রদানের বিষয়টি দেখা যায় এবং যার ফলে সংঘ নিরন্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে এবং হানি'র সম্ভাবনা থাকবে না। প্রথম ৪ ধর্ম এইরূপ সংঘের সন্নিপাত-বহুলতা, সমগ্রতা, যথা-প্রজ্ঞপ্ত শিক্ষাপদের অসমুচ্ছেদ এবং স্থবির ভিক্ষুদের সৎকার। অবশিষ্ট ৩ ধর্ম হল তৃষ্ণার বশবর্তী না হওয়া, আরণ্যক শয়নাসনে সাপেক্ষ হওয়া এবং প্রত্যাতম-স্মৃতিকে উপস্থাপিত করা ইত্যাদি।
ভিক্ষু'র সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বৌদ্ধ বিহারের সমৃদ্ধির সঙ্গে ভিক্ষুসংঘে তথাগত (বুদ্ধ) কর্তৃক ভিক্ষু অনুশাসন পদ্ধতি প্রবর্তিত হয় তথা তাঁর এই নিয়ম বাক্যকে শিক্ষাপদ বলা হয় এবং তার সংগ্রহ হল ধর্ম-বিনয় অথবা বিনয় (বিনয় পিটক)। বিনয়'এর অর্থ হল অনুশাসনার্থ শিক্ষা। বিনয় পিটকে উল্লেখ রয়েছে যে বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের নির্দেশ প্রদান করছেন সমস্ত প্রাণীর মঙ্গলের জন্য একাকী পরিভ্রমণ করতে। "হে ভিক্ষুগণ! বহুজন হিতের জন্য বহুজন সুখের জন্য পরিভ্রমণ কর, দেব ও মনুষ্যের সুখ, মঙ্গলের জন্য দিকে দিকে বিচরণ কর। তোমাদের কোন দুজন এক পথে যেও না।" (বিনয় পিটক, ভূমিকা, পৃষ্টা-৪২)।
বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীয়তার বিষয়টি সমকালীন মন পরিষদের কথা মনে করিয়ে দেয়, অপর দিকে সংঘে বর্ণবাদী ব্যবস্থার প্রতি তিরস্কার নতুন নিরপেক্ষ সমাজ ব্যবস্থার প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করে। বস্তুতঃ ভগবান বুদ্ধ বর্ণ-ব্যবস্থার সিদ্ধান্তকে খণ্ডন করে সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষকে ভিক্ষু সংঘে স্থান প্রদান করে সমগ্র পৃথিবীতে সর্বপ্রথম এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।
"খন্তী পরমং তপো তিতিস্থা।
নিব্বানং পরমং বদন্তি বুদ্ধা।
নহি পব্বিজিতো পরূপধাতী
সমনো হোতি পরং বিহেঠয়ন্তো।।
সচিত্ত পরিযোদপনং এতং বুদ্ধান সাসনং।।
সব্বপাপস্স অকরণং কুসল উপসম্পদা।
অনুপবাদো অনূপঘাতো পাতিমোক্সে চ সংবরো।
মত্তঞতা চভতস্মি পন্তকচ সমনাসনং।।
অধিচিত্তে চ আযোগো এবং বুদ্ধান সাসনং।।"
দীঘনিকায়, ২, পৃষ্টা-৩৯।
অর্থাৎ, 'শান্তি এবং তিতিক্ষা হল পরম তপ, নির্বাণকে বুদ্ধ পরম তপ বলেছেন, প্রব্রজিত শ্রমণ অপরকে ক্ষতি এং দুঃখ প্রকান করে না। কোন পাপ না করা, পুণ্য সম্পাদিত করা এবং নিজ চিত্তকে নির্মল রাখা, এই হল বুদ্ধ শাসন। অপরের প্রতি নিন্দা না করা, হিংসা না করা, প্রাতিমোক্ষতে সংযম পালন করা, ভোজনের ক্ষেত্রে পরিমান অবগত করা, বিভিক্ত শয়নাসন সেবন করা এবং ধ্যানে মনযোগ প্রদান করা, এই হল বুদ্ধশাসন।
তথাগত বলেছেন, 'ধম্মো বো ভিক্সবে সমচ্চযেন সথা' এবং ভিক্ষু আনন্দ ভগবান তথাগতের মহাপরিনির্বাণের পরে বর্ষকারকে এই কথাই বলেছিলেন ধর্মই তাদের মূল শাস্তা। এইরূপ পরিস্থিতিতে সমগ্র ভিক্ষু সংঘকে একসূত্রে আবদ্ধ করার প্রশ্নে এবং তাদের মার্গ দর্শনের বিষয়ে ধর্ম-বিনয় সংগ্র অত্যন্ত আবশ্যক ছিল। (অরিজিনস্ অফ বুজ্জিজম্,
পৃষ্ঠা-৫৫৯)।
একথা সর্বজন বিদিত যে মহামতি অশোক'এর সময়কালে সদ্ধর্ম (বৌদ্ধ ধর্ম) ভারতবর্ষের গণ্ডী অতিক্রম করে বহিঃবিশ্বে তার প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। বংস সাহিত্যের ইতিহাস (শ্রীলংকা), দিব্যাবদান এবং চৈনিক বৌদ্ধ পরিব্রাজকদের যাত্রা বিবরণে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার প্রসার সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়।
পাল যুগে (১২ শতাব্দী সময়কাল) নালন্দা, বিক্রমশীলা, ওদন্তপুরী, সোমপুরী ইত্যাদি বৌদ্ধ বিহার গুলির খ্যাতি চরম শিখরে উন্নীত হয়েছিল তথা বৌদ্ধ ধর্ম তিব্বতে আসীন হয় এবং এক্ষেত্রে শান্তরক্ষিত, পদ্মসম্ভব এবং অতীশ দীপঙ্করের ভূমিকা অনস্বীকার্য। লামা তারনাথ-এর মতানুসারে পাল যুগে সদ্ধর্ম ভঙ্গল-ওডিবিশ, অপরান্তক জনপদ যুগের পতনের ফলে বঙ্গদেশ তথা উত্তর-পশ্চিম ভারত হতে বৌদ্ধ ধর্ম ক্রমশই অবলুপ্তির পথে অগ্রসর হয় এবং এর মূল কারণ ছিল রাজকীয় সমর্থন হ্রাস তথা উত্তর ভারতে তুর্কীবিজয় ইত্যাদি।
যাইহোক, উনিশ শতকে প্রাশ্চাত্য পণ্ডিতদের গবেষণার ফলে বঙ্গদেশে বৌদ্ধ নবজাগরণ শুরু হয়। এই সময় বঙ্গীয় শিক্ষিত সম্প্রদায়'এর মধ্যে বৌদ্ধধর্ম-দর্শনের চর্চা, অনুবাদ কার্য ইত্যাদির মধ্য দিয়ে 'র্যাডিক্যাল হিউম্যানিজম্'এর ভাবধারা গড়ে ওঠে। রাজা রামমোহন রায় গড়ে তোলেন ব্রাহ্মসমাজ,
ডিরোজিও'র নব্য-বঙ্গ আন্দোলন প্রভৃতির মাধ্যমে রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ,
ক্রমশই শঙ্কিত হয়ে ওঠে। এই সময় বঙ্গদেশে আবির্ভূত হলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত (স্বামী বিবেকানন্দ)।
মানুষই ছিল বিবেকানন্দের ধ্যানজ্ঞান, ভাবনা ছিল কীভাবে মানুষের দুঃখ-দারিদ্রের অবসান ঘটবে এবং তাদের জীবন শ্রীময় হয়ে উঠবে। তিনি মানুষ, যথার্থ মানুষ, ভাল মানুষ, সচেতন-শুভ্র-সুন্দর-শুদ্ধসত্ত্ব প্রমুক্ত মানুষ চান। তাই স্পষ্টভাষায় তিনি বলেছেন, 'জগতের সমুদয় ধনরাশির চেয়ে মানুষ বেশি মূল্যবান। মানব প্রকৃতির মহিমা কখনও ভুলো না।
বিবেকানন্দ অদ্বৈতবাদী ছিলেন না কি বেদান্ত বাদী ছিলেন এইটি আমার আলোচনার বিষয় বস্তু নয় কিন্তু তিনি যেভাবে শতধা বিভক্ত হিন্দু সমাজকে সংগঠিত করেছিলেন একথা অস্বীকার করা সম্ভব নয়। বিবেকানন্দের ব্যক্তিত্ব এবং চিন্তা প্রসঙ্গে ভগিনী নিবেদিতা 'দ্য মাষ্টার অ্যাজ আই স হিম' গ্রন্থে মোটামুটি ৫টি সূত্রের সাহায্যে স্বীয় বক্তব্যকে পেশ করেছেন। যেমন-
১। তিনটি অভিজ্ঞতা বিবেকানন্দের চরিত্রের পেছনে কাজ করেছে: ক. প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য অনুসন্ধিৎসা ও জ্ঞানদৃষ্টির রহস্য, খ. শ্রীরামকৃষ্ণদেবের জীবন, গ. ভারত সম্পর্কিত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।
২। বিবেকানন্দের বাণীর মধ্যে হিন্দুধর্ম পেয়েছে স্বীয় ভাবাদর্শের সংগঠন ও সামঞ্জস্য বিধান, আর পৃথিবী পেয়েছে এমন একটি ধর্ম যা সত্য সম্পর্কে অকুতোভয়।
৩। স্বামীজীর দুটি বাণীই প্রধান। প্রথমত, স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে ধর্মপথে অগ্রসর হবার অধিকার সকলেরই আছে। দ্বিতীয়ত,
মুক্তিই মানবজাতির প্রধান লক্ষ্য।
৪। বেদ-উপনিষদের বাণীর মধ্যে স্বামীজী এনেছেন আধুনিক স্বচ্ছতা ও বক্তব্যের তীক্ষ্ণতা এবং পারস্পারিক সঙ্গতি ও ঐক্য।
৫। স্বামীজী ধর্মকে জীবনমুখী করে তুলেছেন।
লগুনের একটি বক্তৃতায় বিবেকানন্দ বলেছিলেন,
"কাহারও মতে মত দিয়া বিশ লক্ষ দেবতা বিশ্বাস করা অপেক্ষা যুক্তি করিয়া নাস্তিক হওয়াও ভাল। আমরা চাই উন্নতি, বিকাশ, প্রত্যক্ষানুভূতি। কোন মত অবলম্বন করিয়াই মানুষ বড় হয় নাই। কোটি কোটি শাস্ত্র ও আমাদিগকে পবিত্র হইতে সাহায্য করে না। ঐরূপ হইবার একমাত্র শক্তি আমাদের ভিতরেই আছে। প্রত্যক্ষানুভূতিই আমাদিগকে পবিত্র হইতে সাহায্য করে, আর ঐ প্রত্যক্ষানুভূতি মননের ফল।
মানুষ চিন্তা করুক। মৃত্তিকাখণ্ড কখনও চিন্তা করে না, মানিয়া লওয়া যাক যে, মৃত্তিকা সবই বিশ্বাস করে, তথাপি উহা মৃত্তিকাই থাকিয়া যায়। একটি গরুকে যাহা ইচ্ছা বিশ্বাস করানো যাইতে পারে। কুকুর সর্বাপেক্ষা বিচার বিবেচনাধীন জন্তু। ইহারা কিন্তু যে কুকুর, গরু ও মৃত্তিকা,
তাহাই থাকিয়া যায়; কিছু উন্নতি করতে পারে না। কিন্তু মানুষের মহত্ত্ব এই যে, সে মননশীল জীব; পশুদিগের সহিত মানুষের ইহাই প্রভেদ। মানুষের এই মনন স্বভাবসিদ্ধ ধর্ম। অতএব আমাদিগকে অবশ্যই মনের চালনা করিতে হইবে। এই জন্যই আমি যুক্তিতে বিশ্বাস করি এবং যুক্তির অনুসরণ করি; শুধু লোকের কথায় বিশ্বাস করিয়া কি অনিষ্ট হয় তাহা বিশেষরূপে দেখিয়াছি।" (বাণী ও রচনা, ২য় খণ্ড ২৬৭-২৬৮)।
বিবেকানন্দ তাঁর ধর্মচিন্তার বিষয়টিকে কীভাবে অনুধাবন করেছিলেন তা 'মায়া ও মুক্তি' নামক বক্তৃতার (২২.১০ ১৮৯৬ তারিখে লণ্ডনে প্রদত্ত) মাধ্যমেই পরিস্ফুট হয়। এই বক্তৃতায় তিনি তাঁর বক্তব্যকে ৯টি অনুচ্ছেদে ব্যাখ্যা করেছেন।
১। জীবন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা।
২। এর সমস্যায় বৈজ্ঞানিকেরা কোন পথ অনুসরণ করেছেন।
৩। মনস্তাত্বিক আলোচনা সুখ, দুঃখ ও জীবন।
৪। পুরাণের গল্প উদ্ধৃত করে জীবন-রহসের বিশেষ দিকটি তুলে ধরা।
৫। সমাজতাত্ত্বিক আলোচনা সাধারণ মানুষ কিভাবে দুটি পক্ষে সমাধানের চেষ্টা করছে।
৬। বিভিন্ন ধর্ম এই রহস্য সমাধানে কোন্ সিদ্ধান্ত খুঁজে পেয়েছে।
৭। মানুষ কেন আনন্দ চায় আনন্দ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা-আনন্দের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা।
৮। আনন্দ ও মুক্তির তুলনামূলক আলোচনা।
৯। জীবন রহস্য সম্পর্কে বেদান্তের সমাধান।
বৌদ্ধধর্মই ইতিহাসে প্রথম বহিরাভিযানে নিজেকে নিয়োজিত করেছিল। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা যখন ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়লেন, তখন বৌদ্ধ ধর্ম সুনির্দিষ্টরূপেই দেখা দিল। এশিয়ার নানান দেশে বৌদ্ধ ধর্ম তো বটেই, নাগরিক সাধারণের ধর্ম হিসেবেও স্বীকৃতি পেল। ভগবান তথাগতের বাণী প্রচারের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন দেশ যেন নতুন করে জেগে উঠল। বৌদ্ধধর্মের বিজয়াভিযানে এশিয়ার দেশগুলি আত্মীয়তার সূত্রে আবদ্ধ হয়ে সামগ্রিকভাবে এক মহাজাতিতে পরিণত হয়েছিল। ভারত-প্রজ্ঞার আলোকে জীবন ধারণের উদ্দেশ্য ও উপায় ঐ দেশগুলি খুঁজে পেয়েছিল। ভারতবর্ষ থেকে যে নতুন আলোকতরঙ্গ (বৌদ্ধধর্ম) বাইরের দেশগুলিতে জীবনদায়ী বার্তা নিয়ে গেল তা বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতিতে প্রভাব বিস্তার করল। সংস্কৃতির মিশ্রণ হল এক-এক দেশে এক-এক রকম। তিব্বত, জাপান, চীন, শ্যামদেশে এরই নানারূপ দেখা দিল। বাইরের দেশগুলির পরিব্রাজকগণ যখন ভারতে আসতে লাগলেন এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠী যখন বৌদ্ধধর্মে স্থান পেতে লাগল, তখন বৌদ্ধ ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে অন্য সংস্কৃতির মিশ্রণ হয়ে ভারতীয়দের ওপরে তার প্রভাব পড়ল। বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে সমগ্র এশিয়াব্যাপী যে এক মহাজাতি গঠনের উদ্ধোধন হল, তারই প্রতিক্রিয়ার প্রভাবে ভারত যেন এক নতুন সংস্কৃতির বাহক হয়ে দাঁড়াল। শিল্প সাহিত্য দর্শন বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয় ভারতের নবজাগরণ ঘটল।
এই নবজাগরণের নবসংস্কৃতি পালযুগে নব উন্মেষশালিনী কার্য কুশলতার পথে অগ্রসর হল। নালন্দা, বিক্রমশিলা প্রভৃতি বৌদ্ধ বিহার গুলি তার উজ্জ্বল উদ্ধার।
প্রাশ্চাত্য বিদ্ধানদের ঔৎসুকতার ফলে ১৯ শতকে ভারতবাসী পুনঃ অবগত হতে শুরু করে যে এদেশের সর্বাপেক্ষা সুসংবাদ প্রাচীন ধর্ম হল 'বৌদ্ধ ধর্ম'। এই সময়কাল (১৯ শতক) হতে প্রাচীন পালি, সংস্কৃত, সিংহলী, চীনা, তিব্বতী এবং ধর্মী বৌদ্ধগ্রন্থ গুলি ভারতীয় এবং প্রাশ্চাত্য ভাষায় অনুবাদ হতে থাকে। এই অনুবাদ কার্যের প্রভাব তথা পুঁজিবাদী বুর্জোয়া সংস্কৃতির আগমণের কারণে ভারতের আর্য সামাজিক পরিকাঠামোর পরিবর্তন এবং মধ্যযুগীন ধর্মীয় আচার-আচরণ পদ্ধতির সংস্কার সাধন শুরু হয়। ব্রাহ্মসমাজ ও ইয়ংবেঙ্গল এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। শিক্ষা জগতে বিদ্যাসাগর,
রবীন্দ্রনাথ, চিত্র শিল্পের জগতে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নন্দলাল বসু, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বুদ্ধের আলোকে অহিংস বিপ্লবের এক বিস্ময়কর পরীক্ষা শুরু হল। এইভাবে বহু যুগের দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে ভারতভূমির নবজাগরণ ঘটলো।
'হীনং ধম্মং ন সেবেয্য, পমাদেন ন সংবসে।
মিচ্ছাদিস্টিং ন সেবেয্য, ন সিযা লোকবনো।।১৬৭।। ধম্মপদ, পৃষ্ঠা-৪৮।
কোনরূপ হীনধর্ম (লৌকিক পঞ্চ কামগুণ) কে আশ্রয় না করা উচিত নয়। উচিত নয় প্রদামযুক্ত কর্মে নিয়োজিত থাকা। নিজের ধার্মিক চিন্তার ক্ষেত্রে মিথ্যাদৃষ্টিকে আধার রূপে গ্রহণ করা উচিত নয়। মিথ্যা প্রশংসার প্রাপ্তি হেতু লোকে (পৃথিবী) সাংসারিক সম্পর্ক স্থাপন করা সঠিন নয়।
বিবেকানন্দ ধম্মপদের এই বিশ্লেষণটিকে অনুশীলন করে বলেছেন,
"ধর্ম হল মানুষের এক স্বাভাবিক প্রবণতা। মানব মনের নিজস্ব তাগিদ হল তার সত্তা'কে জানা। এই তাগিদই হল ধর্ম। ধর্ম আচার-অনুষ্ঠান,
রীতিনীতি নয়, এগুলি ধর্মের আঙ্গিক মাত্র।..... পৃথিবীর সব মন্দিরে দেবালয়ে ঘুরলেও দুনিয়ার ধর্মশাস্ত্র গোগ্রালে গিললেও, যাবতীয় পবিত্র নদীর জলধারায় নিজেকে ভাসিয়ে দিল ও আত্মোপলব্ধি ব্যতীত মানুষ নাস্তিক ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রকৃত ধর্ম হল মানুষের অন্তর্নিহিত দেবত্বের বিকাশ। বরঞ্চ পরীক্ষা করে দেখতে আহ্বান করছে এ ধর্ম।" সুতরাং এই অর্থে বিবেকানন্দের নীতিতত্ত্বের বিষয়টিকে এইভাবে সূত্রাকারে আবদ্ধ করতে পারি। যথা:
১। যে কর্মের দ্বারা আত্মভাবের বিকাশ হয়, তাহাই কর্ম। সদ্ দ্বারা অনাত্মভাবের বিকাশ হয় তাহাই অকর্ম।
২। অনন্ত শক্তিই ধর্ম।
৩। শক্তিই পুণ্য, দুর্বলতাই পাপ।
৪। শক্তিই জীবন, আর দুর্বলতাই মৃত্যু।
৫। শক্তিই সর্বসুখের আকর, অমৃতত্ব ও অনন্ত জীবন, দুর্বলতা নিরত্তর দুঃখ ও অশান্তি।
৬। যাহা কিছু বলপ্রদান করে তাহাই অনুসরণীয়। অন্যান্য বিষয়েও যেমন ধর্মে ও তদ্রুপ। যাহা তোমাকে দুর্বল করে, তাহা একে বারেই ত্যাজ্য।
৭। যাহা স্বার্থপর তাহাই নীতি বিরুদ্ধ, যাহা নিঃস্বার্থপর তাহাই নীতি সঙ্গত।
৮। সম্প্রসারণই জীবন সংকীর্ণতাই মৃত্যু; প্রেমই জীবন, দ্বেষই মৃত্য।
৯। জ্ঞানই জীবন, অজ্ঞনতাই মৃত্যু।
১০। যাহা কিছু উন্নতি পরিপন্থী বা অধঃপতনের সহায় তাহাই পাপ, আর যাহা কিছু উন্নত হইতে সাহায্য করে তাহাই পুণ্য। (বিবেকানন্দের সমাজ-দর্শন, পৃষ্ঠা-১৯৭-১৯৮)।
অন্যস্থলে তিনি ভারতের সম্মুখে উন্নতির পন্থা নির্দেশকালে বলেছেন, "ভারত আবার উঠিবে, কিন্তু জড়ের শক্তিতে নহে, চৈতন্যের শক্তিতে, বিনাশের বিজয় পতাকা লইয়া নহে, শান্তি ও প্রেমের পতাকা লইয়া সন্ন্যাসীর বেশ সহায়ে, অর্থের শক্তিতে নহে, ভিক্ষাপাত্রের শক্তিতে।"
সুতরাং আমরা সুস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে বিবেকানন্দের এই বক্তব্যের মধ্যে ভগবান তথাগতের (বুদ্ধ) সিদ্ধান্ত সুস্পষ্ট ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
"সুসুখং বত জীবাম, বেরিণেসু অবেরিনো।
বেরিণেসু মনুস্সসে,
বিহরাম অবেবিনো।।১৯৭।। ধম্মপাদ, পৃষ্ঠা ৫৬।
অর্থাৎ, শত্রু'র সাথে অশত্রুতা (মৈত্রী) ব্যবহারকারী সংস্কার এ সুখপূর্বক জীবিত থাকতে পারেন। আমরা বৈরীতার সঙ্গে মিত্রবদ্ ব্যবহার (আচরণ) করি।
বিবেকানন্দ ভারতীয় সমাজের দাসত্বের অমঙ্গলকে দূরীকরণের প্রশ্নে চেয়েছিলেন সমগ্র সমাজের সহযোগীতা "এখন ইতরজাতদের ন্যায্য অধিকার পেতে সাহায্য করলেই ভদ্রজাতের কল্যাণ। তা না হলে তোদের কল্যাণ নেই। এই জনসাধারণ যখন জেগে উঠবে, আর তাদের ওপর তোদের অত্যাচার বুঝতে পারবে-তখন তাদের ফুৎকারে তোরা কোথায় উড়ে যাবি! তারাই তোদের ভেতর সিভিলাইজেশন এনে দিয়েছে তারাই আবার তখন সব ভেঙ্গে দেবে। এই জন্য বলি, এইসব নীচজাতদের ভেতরে বিদ্যাজ্ঞান জ্ঞানদান করে এদের ঘুম ভাঙ্গাতে যত্নশীল। এরা যখন জাগবে-আর একদিন জাগাবে নিশ্চয়ই তখন তারাও তোদের কৃত উপকার বিস্মৃত হবে না, তোদের নিকট কৃতজ্ঞ হয়ে থাকবে।" (বাণী ও রচনা, ৯:১০৭)।
একবিংশ শতকের মানুষ পৃথিবীকে কোন পথে এগিয়ে দিচ্ছে? উনবিংশ শতকে উদ্ভাসিত হতে দেখা যায় জ্ঞানীদের যুগ। বিভিন্ন দেশে চিন্তাশীলেরা প্রধান হয়ে বিশ্বকে পথ নির্দেশ করছেন। মার্কস অবশ্য এক্ষেত্রে বিভিন্ন যুগের সমাজ সভ্যতার ক্রম বিবর্তণের ধারাকে লক্ষ্য করেছেন। তিনি উদাহরণ উপস্থাপন করে বলেছেন, 'ইউরোপে একাদশ শতকে কর্তৃত্বের নীতি বল বৎ ছিল কিন্তু অষ্টাদশ শতকে ব্যক্তি স্বাতন্তের নীতি।' বিভিন্ন যুগে কেন বিভিন্ন নীতি দেখা দেয় তার উত্তরে তিনি (মার্কস) পুনঃ প্রত্যাবর্তন করেছেন সেই উৎপাদন এবং বন্টন প্রণালীর ওপর। 'দ্য জার্মান আইডিওলজি' পুস্তকের ভূমিকায় তিনি বললেন, 'বিজ্ঞান-দর্শন-শিল্প-সাহিত্য-ধর্ম প্রভৃতি সবকিছুই এই উৎপাদন বন্টনের উপর নির্ভরশীল।'
এঙ্গেলস্ এই বিষয়টিকে (২১.০৯.১৮৯০' একটি পত্রে) এইভাবে ব্যাখ্যা করলেন, "ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা অনুসারে ইতিহাস নিয়ন্ত্রণে চরম শক্তি হল বাস্তবজীবনে উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনে।" কিন্তু বিবেকানন্দ নতুন পৃথিবী রূপায়ণের প্রশ্নে ৪টি সূত্র উপস্থাপন করেছেন-
১। মানব সমাজের অতীত ঐতিহ্যের বিশ্লেষণ ও উপলব্ধি।
২. বিভিন্নতার মধ্যে ঐক্যের সূত্র অনুসন্ধান।
৩। সমবেত প্রয়াস এবং
৪। বৈপরীত্যের মধ্যে সামঞ্জস্য।
রাষ্ট্রব্যবস্থায় ব্রাহ্মহ্মণ বা পুরোহিত প্রাধান্যের কুফলকে প্রত্যক্ষ করে বিবেকানন্দ ব্যথিত হয়ে বলেছেন,
"উন্নতির সময়ে পুরোহিতের যে তপস্যা, যে সংযম, যে ত্যাগ সত্যের অনুসন্ধানে সম্যক প্রযুক্ত ছিল, অবনতির পূর্বকালে তাহাই আবার কেবলমাত্র ভোগ্যসংগ্রহে বা আধিপত্য বিস্তারে সম্পূর্ণ ব্যয়িত। বিদ্যাহীন,
পুরুষকারহীন, পূর্বপুরুষদের নামধারী পুরোহিতকুল পৈতৃক অধিকার, পৈতৃক সম্মান, পৈতৃক আধিপত্য অক্ষুন্ন রাখিবার জন্য 'যেন-তেন প্রকারেণ চেষ্টা করেন।"(বাণী ও রচনা, ৬:২৩৩)।
তিনি আরও বলেছেন,
"পুরোহিত-শাসনে বংশজাত ভিত্তিতে ঘোর সংকীর্ণতা রাজত্বকরে তাঁদের ও তাঁদের বংশধরদের অধিকার রক্ষার জন্য চারিদিকে বেড়া দেওয়া থাকে, তাঁরা ব্যতীত বিদ্যা শিকার কারো অধিকার নেই, বিদ্যাদানেরও কারো অধিকার নেই।" মহাভারতে দ্রোণ কর্তৃক একলব্যকে প্রত্যাখ্যান ব্রাহ্মণ তন্দ্রের এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
ধম্মাপদ'এর ব্রাহ্মণবঙ্গো তে উৎকৃষ্ট ব্রাহ্মণ সম্পার্কিত বিশ্লেষণ এইভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে। যেমন-
'ন চাহং ব্রাহ্মণং ক্রমি, যোনিজং মত্তিসম্ভবং।
ভোবাদি নাম সো হোতি, সচে হোতি সকিঞ্চনো।
অকিঞ্চনং অনাদানং, তমহং ক্রমি ব্রাহ্মণং।। ৩৯৬।।
শুধুমাত্র ব্রাহ্মণযোনি যুক্ত মাতা হতে উৎপন্ন কোন মনুষ্যকে আমি ব্রাহ্মণ রূপে স্বীকার করি না, কারণ সে পরিগ্রহী হয়, ..... হ্যাঁ, যিনি অকিঞ্চন (অপরিগ্রহী) বা কারও নিকট হতে কিছু গ্রহণের অভিপ্রায় কখনই করেন না, এই রূপ ত্যাগীকেই আমি 'ব্রাহ্মণ' মনে করি।
'পরিব্রাজক' গ্রন্থে বিবেকানন্দের একটি উক্তি অত্যন্ত সুস্পষ্ট। "ভারতের উচ্চবর্ণেরা তোমরা ভূতকাল। বর্তমান কালে তোমাদের দেখছি বলে সে বোধ হচ্ছে ওটা অজীর্ণ জনিত দুঃস্বপ্ন। ভবিষ্যতে তোমরা শূন্য। তোমরা শূন্যে বিলীন হও, আর নতুন ভারত বেরুক। বেরুক লাঙল ধরে চাষার কুটীর ভেদ করে, জেলে, মালী, মুচি মেথরের মধ্য হতে। বেরুক মুদির দোকান হতে, হাট থেকে, বেরুক কারখানা থেকে।" এই উক্তিটি নানাদিক হতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ শ্রেণী বিহীন সমাজের যে রূপায়ণ তাঁর আকাঙ্খার বস্তু ছিল তাই মানব সমাজের "আমূল রূপান্তর" সাধন করে এই ছিল তাঁর সিদ্ধান্ত। তিনি তাই দুটি বিপ্লব এক সঙ্গে কামনা করেছিলেন। এক, বিশেষ সুবিধার অবসানে শ্রেণীবিহীন সাম্য সমাজ প্রতিষ্ঠা (শূদ্রগণের প্রাধান্যসহ) এবং দুই, সর্বব্যাপী আধ্যাত্মিক বিপ্লব সেই শ্রেণীবিহীন সাম্য সমাজের মানুষের পূর্ণ উদ্ধোধনের আয়োজন। বিবেকানন্দ সমাজ সভ্যতার ক্রমবিকাশকে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন তা হল-
১। ক্রমবিকাশবাদ (ও ক্রমসংকোচণ বাদ)।
২। বৃত্তাকারে বিবর্তন।
৩। সর্বব্যাপী অপরিবর্তনীয় আত্মবস্তর অস্তিত্ব।
৪। মানুষের চৈতন্য স্বরূপতা,
অনন্ত শক্তি বত্তা বিকাশের পার্থক্য।
৫। অনির্বচনীয় মায়ার অস্তিত্ব ইত্যাদি।
এখানে ২নং ধারাটি ভগবান বুদ্ধের 'প্রতীত্যসমুৎপাদ' এর সঙ্গে সামাঞ্জস্য পূর্ণ। খুদ্দকনিকায়'এ বলা হয়েছে-
"অনেকজাতিসংসারং সন্ধাবিস্সং অনিবিবসং, গহকারকং গবেসন্তো দুক্খা জাতি পুনপ্পুনং। গহকারক দিঠোসি পুন গেহং ন কাহসি, সব্বাতে ফাসুকা ভগ্গা গহকূটং বিসঙিখতং বিসংঙ্খারগতং চিত্তং তস্থানং খয়মজঝগা।" উদানং, পৃষ্ঠা-৩২।
বিচারপূর্বক বিবেকানন্দ দেখেছিলেন অধ্যাত্ম পথের দুটি অন্তরায় কাম ও কাঞ্চন। এবং অধ্যাত্ম সত্যের পথে যেতে হলে সংসারের পথ ছেড়ে এগোতে হবে, যেমন পূর্বদিকে চলতে হলে পশ্চিমদিক ছেড়ে ক্রমেই আমরা দূরে যাই। পরিশেষে তিনি দেখলেন এ পথের শেষ বাধা অহং বুদ্ধি। অহং বুদ্ধির মূল কারণ হল অজ্ঞানতা। আর এই অজ্ঞানতাকে পরিত্যাগের অর্থই হল মুক্তি।
"যাবদেব অনথায় ঞত্তং বালস জাথতি।
হস্তি বালস সুক্বংসং,
মুদ্ধমস বিপাতমং।।৭২ ধর্মপাদ, পৃষ্ঠা-২১।
অর্থাৎ, মূর্খ মনুষ্যের জ্ঞান মতই হোক না কেন, এই সকলই তার অনর্থের ক্ষেত্রে হয়। সেই জ্ঞান তার মস্তককে ছিন্ন করে তার শুদ্ধ (শুক্ল) অংশকে সমূলে উচ্ছেদ করে।
বিবেকানন্দ ওরফে নরেন্দ্রনাথ দত্তের বিদ্যাচর্যা,
পাণ্ডিত্য প্রসঙ্গে মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন,
"নরেন্দ্রনাথ সংস্কৃত, পালি ও ইংরেজী ভাষায় লিখিত নানা রকম শাস্ত্রগ্রন্থ আনাইয়া পাঠ করিত। কয়েকজন গুরুভাই এইরকম পড়াশুনার বিরোধী ছিল। একজন বলিল, যদি পড়াশুনাই করবি, তবে সাধু হয়ে এলি কেন সব? তোদের স্কুল কলেজ ছাড়তে কে বলেছিল?"
তবুও তাঁর যুক্তিবাদী মন তাঁকে যথেষ্ট বিপ্রত করে তুলেছিল। তাই তিনি শাস্ত্রের নানা নির্দেশ ও তার যুক্তির সত্যাসত্য নিয়ে সন্দেহ মুক্ত ছিলেন না। এই অবস্থায় তিনি প্রমদাদাস মিত্র সেই সময়কালের একজন বিখ্যাত শাস্ত্র বিশারদ) কে ৭ এবং ১৭ আগষ্ট, ১৮৮৯'এ দুটি পত্রে বেশ কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেন। তার কয়েকটি প্রশ্ন হল-
১। সত্যকাম জাবালি এবং জনশ্রুতির কোন উপাখ্যান ছান্দোগ্য উপনিষদ ব্যতীত বেদের অন্য কোন অংশে আছে কি না?
২। শঙ্করাচার্য বেদান্ত ভাষ্যে অধিকাংশ স্থলেই স্মৃতি উদ্ধৃত করিতে গেলেই মহাভারতের প্রমান প্রয়োগ করেন। কিন্তু বনপর্বে অভ্যন্তর উপাখ্যানে এবং উমা মহেশ্বর সংবাদে, তথা ভীস্মপর্বে যে গুণগত জাতিত্ব অতি স্পষ্টই প্রমাণিত, তৎসম্বন্ধে তাঁহার কোন পুস্তকে কোন কথা বলিয়াছেন কিনা?
৩। প্রথমেই বলা হইয়াছে ঈশ্বরের প্রমাণ বেদ এবং বেদ প্রামাণ্য। তাহলে, বেদান্ত সূত্রে বেদের কোন প্রমাণ কেন দেওয়া হয় নাই।
৪। ন্যায় মতে ঋষিরা আপ্ত এবং সর্বজ্ঞ। তাহারা তবে কেন সূর্যসিদ্ধান্তের দ্বারা সামান্য সামান্য জ্যোতিষিক তত্ত্বে অজ্ঞ বলিয়া প্রমাণিত হইতেছেন? যাঁহারা বলেন পৃথিবী ত্রিকোণ, বাসুকি পৃথিবীর ধারয়িতা ইত্যাদি তাহাদের বুদ্ধিকে ভবসাগর পারের একমাত্র আশ্রয় বলি কি প্রকারে?
৫। ঈশ্বর সৃষ্টিকার্যে যদি শুভাশুভ কর্মকে নির্দিষ্ট (অপেক্ষা) করেন, তবে তাঁহার উপাসনার লাভ কি?
৬। বেদ যদি নিত্য হয়, তবে ইহা পাথরের, ইহা কলিরধর্ম ইত্যাদি বচনের অর্থ ও সাফল্য কি?
৭। তন্ত্র বলেন কলিতে বেদমন্ত্র নিস্ফল, মহেশ্বরেরই বা কোন কথা মানিব। (বাণী ও রচনা, ৬:২২৮-২৩১)।
বৌদ্ধ ভারত শিরোনাম বক্তৃতায় বিবেকানন্দ বলেছেন "হিন্দু বিশ্বাস করে যে, বেদ প্রত্যক্ষভাবে ভগবানের শ্রীমুখ নিঃসৃত জ্ঞান।...ঐ গ্রন্থেই জগতের সবকিছু বিধৃত, তার বাইরে কিছু নেই। মানুষের যত কিছু নীতিজ্ঞান,
ভাল-মন্দ বিচার সবই এই গ্রন্থের অনুশাসনের উপর প্রতিষ্ঠিত। কারণ ঐশ্বরিক জ্ঞানের উর্ধে মানুষ উঠতে পারে না। ভারতীয় গোঁড়ামির এই হল মর্মকথা।" (বাণী ও রচনা, ১০:১৭০-১৭১)।
এরপর তিনি বলেছেন যে,
"..... গোঁড়ামি অবশ্যই অতি বিষয় বস্তু। কিন্তু যদি কোন হিন্দুকে কোন সামাজিক সংস্কার বিষয়ে আপনারা অনুরোধ করেন, যদি বলেন-এরূপ করা সংগত অথবা এরূপ করা সংগত নয়, তবে উত্তরে সে বললে এসব কি আমাদের প্রাচীন গ্রন্থাদিতে নির্দিষ্ট হয়েছে, "যদি না হয়ে থাকে, তবে ওসবের জন্য মাথা ব্যাথা নেই। কোন পরিবর্তনের পক্ষপাতি আমরা নই। এই হচ্ছে উৎকট গোঁড়ামি।
গোঁড়ামি ভারতবর্ষে ছিল। গোঁড়ামি ভিন্ন আর কি ছিল? ছিল বিছিন্ন ভাব ও জাতিবিভাগ।..... আমি নিজে অবশ্য জাতির বাইরে। সে বন্ধন আমি ছিন্ন করেছি।
সন্ন্যাসীরা অনাসক্ত ও মুক্ত মানবগোষ্ঠী। কোন নিয়মের অধীন নন। এমনকি বেদবিধি মেনে চলতেও তারা বাধ্য নন। বেদশীর্ষে তাদের স্থান।
বুদ্ধদেব জগতের ইতিহাসে স্বীকৃত মহাপুরুষ গণের অন্যতম। বস্তুর এদিক থেকে মাত্র দু'জন মহাপুরুষের নামই উল্লেখ করা যেতে পারে, যাঁদের সন্ধন্ধে শত্রু-মিত্র উভয়ই একমত একজন প্রাচীন বুদ্ধদেব, অপরজন হজরত মহাম্মদ। এদের উভয়ের সম্বন্ধেই আমরা সম্পূর্ণ নিঃসংশয়।
বুদ্ধদেবের শেষ অক্ষয় বাণী ছিল, 'কোন শাস্ত্র গ্রন্থের প্রামাণ্য,
তা সে যত প্রাচীন গ্রন্থই হোক, মেনে নিও না। শুধু পূর্ব পুরুষগণের উক্তি বলে কোন কথায় বিশ্বাস করো না। অথবা ১০ জন লোক বিশ্বাস করে বলেও কোন মতবাদ গ্রহণ করো না। প্রতিটি জিনিষ পরীক্ষা কর, যাচাই কর, তারপর বিশ্বাস কর। আর যদি কোন কিছু বহুজনের হিতকর হবে বলে মনে কর, তবে সকলের মধ্যে সেটি বিতরণ কর' এই শেষ বাণী উচ্চারণ করেই তিনি দেহত্যাগ করেছিলেন। আমি ভাবি আহা, তাঁর মহাশক্তির এক কনাও যদি আমার থাকতো! পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রজ্ঞানবান দার্শনিক তিনি। প্রবল ব্রাহ্মণ্য শক্তির অত্যাচারের কাছে কখনও তিনি মাথা নত করেননি। হিন্দু মতে মানুষের মধ্যে যে আত্ম বিরাজ করেন, সেই আত্মাকে তিনি স্বীকার করেন নি। বুদ্ধদেব আত্মা ও ব্রহ্ম দুইই অস্বীকার করেছেন। তিনি বলতেন কোন বস্তুর চিরস্থায়ীত্বের কোন প্রমাণ নেই। সবাই নিত্য পরিবর্তনের সমষ্টি মাত্র। ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে তারা (বৌদ্ধরা) কখনও তরবারির সাহায্য গ্রহণ করেননি। এক বৌদ্ধ ধর্ম ভিন্ন জগতের আর কোন ধর্মই রক্তপাত না করে এক পা অগ্রসর হতে সক্ষম হয়নি। মাত্র মস্তিস্কের শক্তি দিয়ে হাজার হাজার নরনারীকে ধর্মান্তর গ্রহণ করানো অপর কোন ধর্ম্মের পক্ষে সম্ভব হয়নি। না, কোথাও হয়নি, কোন যুগে হয়নি।" (বাণী ও রচনা, ১০:১৭০-১৮৯)।
বিবেকানন্দের অভিমত হল, 'খাঁটি চরিত্র',
'সত্যকার জীবন ও 'দেবমানবই' পথ দেখাবেন। অসংখ্য সম্মিলিত প্রয়াসে সমাজকে পরিবর্তন করতে হবে। শত, শত বুদ্ধ তৈরী করে ভারতের অগণিত পদদলিত মানুষকে উদ্ধার করতে হবে। তিনি বলেছেন, 'অনন্ত প্রেম ও করণাকে বুকে নিয়ে শত-শত বুদ্ধের আবির্ভাব প্রয়োজন। অনেক কাল আগে লক্ষ লক্ষ পদদলিতের পরিত্রাতারূপে বুদ্ধের মতো অসংখ্য বুদ্ধ ভারতে তৈরী হবে। তার ফলেই ভারত এগিয়ে যেতে পারবে, অন্য সবাইকে ভারত পথ দেখাবে। তাই তাঁর কণ্ঠে শোনা যায় 'এবার কেন্দ্র ভারতবর্ষ'। একি নিছক ভাববাদী কল্পনা?
উর্নিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের অর্ধাংশ জুড়ে বিবেকানন্দের প্রভাবে ভারতের আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বহু ত্যাগী মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল, একটি প্রবল তরঙ্গমালা ঔপনিবেশিক শাসকের বিরুদ্ধে সৃষ্টি হয়েছিল। তা হয়তো পূর্ণ পরিনতির দিকে এগিয়ে যেতে পারে নি। আবার হয়তো অদূর ভবিষ্যতে দরিদ্র পদদলিতদের জন্য অসংখ্য বুদ্ধের আবির্ভাব এই ভারতেই ঘটবে, যাঁরা তাঁদের মুক্তির পথ দেখাবেন। তাঁরাই প্রচলিত ব্যবস্থাটিকে ভেঙ্গে ফেলবেন, নতুন সমাজ গড়ে তুলবেন। (স্বামী বিবেকানন্দ মার্কসবাদীদের দৃষ্টিতে,
পৃষ্টা-৬১-৬২)।
শিক্ষার অন্যতম মূল উদ্দেশ্য হ'ল আর্থিক উন্নতি এবং ধন-উৎপাদনের দক্ষতা অর্জন। এপ্রশ্নে বিবেকানন্দ অত্যন্ত সরল অথচ যুগোপযোগী বক্তব্য প্রদান করেছেন। তিনি বলেছেন "তাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য কি? হয় কেরানীগিরি, না হয় একটা দুষ্ট উকীল হওয়া, না হয় কেরানীগিরিরই রূপান্তর একটা চাকরী এই তো, এতে তোদেরই বা কি হল? আর দেশেরই বা কি হল? একবার চোখ খুলে দেখ, স্বর্ণপ্রসু ভারতভূমিতে অন্নের জন্য কি হাহাকারটা উঠেছে, তোদের শিক্ষায় যে অভাব পূর্ণ হবে কি? কখনও নয়? প্রাশ্চাত্য বিজ্ঞানসহায়ে মাটি খুঁড়ে লেগে যা, অন্নের সংস্থার কর চাকরী করে নয়, নিজের চেষ্টায় পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সহায়তা নিয়ে।" (বিবেকানন্দের সমাজ-দর্শন, পৃষ্টা-১৭৫)।
এই অর্থে বিবেকানন্দ শুধুমাত্র ধর্মপ্রচার করতে চেয়েছেন তা নয় তিনি ভারতবর্ষের দারিদ্রের অভিশাপ, ব্রাহ্মণ্যবাদীর পৌরহিত্যরূপ,
পাপ এবং উচ্চবর্ণের শোষণ ইত্যাদি সমস্যাগুলির সর্বাগ্রে অবসান করতে চেয়েছেন "গরীবদের খাওয়াইতে হইবে, শিক্ষার বিস্তার করিতে হইবে। পৌরহিত্যরূপ পাপ দূরীভূত করিতে হইবে।"
আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি যে বুদ্ধই প্রথম মহামানব যিনি মানবজাতির কল্যাণ সাধনায় একটি সংসংবাদ ভিক্ষু সংঘ গঠন করেছিলেন। বুদ্ধ প্রতিষ্ঠিত সংঘের মূল উদ্দেশ্য ছিল ধর্ম, জনগণ এবং রাষ্ট্রশক্তির সমন্ময় সাধন। উত্তরকালে বিবেকানন্দও বুদ্ধের এই শিক্ষাকে গ্রহণ করে ১৮৯৭ সালের ১মে 'রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন' স্থাপন করেন। এই সংঘের ক্রোড়পত্রে এর কর্মনীতি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে এর উদ্দেশ্য হবে:
করা। ১। জনসাধারণের দৈহিক ও মানসিক মঙ্গলের জন্য জ্ঞান ও বিজ্ঞান শিক্ষা প্রদানের পক্ষে উপযুক্ত কর্মী তৈরী
২। শ্রমশিল্প ও চারুকলার উন্নতি করা ও সেজন্য উৎসাহ দেওয়া।
৩। সাধারণ বৈদান্তিক এবং অন্যান্য ধর্মীয় ভাবগুলি রামকৃষ্ণের জীবনে যে অর্থ লাভ করেছে, সেই অর্থে সেগুলির প্রবর্তন ও প্রচার করা।
এই কর্ম যজ্ঞের দুটি শাখা হবে। ১। অন্যের শিক্ষার জন্য আত্মনিয়োগ করবেন এরূপ সন্ন্যাসী ও সংসারী শিষ্যদের শিক্ষা প্রদানের জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত মঠ ও আশ্রম এবং ২। সর্বমানবিক কল্যাণের জন্য বিদেশে স্থাপিত আধ্যাত্মিক সাধনা কেন্দ্র।
তাঁর মত ছিল,
"শ্রেষ্ঠ সন্ন্যাসীরাই শ্রেষ্ঠ কর্মী হতে পারেন, কারণ তাঁহাদের কোনও বন্ধন নাই।"
ধর্মপদে বলা হয়েছে
"ন অত্তহেতু ন পরস্স হেতু, ন পুত্তমিচ্ছেন ধনংন রং।
ন ইচ্ছেয্য অধম্মেন সমিদ্দিমত্তনো,
স সীলবা পঞঞ বা ধম্মিকো সিয়া।।৮৪।।
অর্থাৎ যে মানুষ না তো নিজের ক্ষেত্রে,
না তো অপরের ক্ষেত্রে,
পুত্র ধন বা রাষ্ট্রের কামনা করেন না, না তো অধর্মাচরণপূর্বক নিজের সমৃদ্ধির কামনা করেন, এইরূপ পুরুষই ধার্মিক, শীলবান্ এবং প্রজ্ঞাবান্ হন।
বিবেকানন্দ ভগবান তথাগতের (বুদ্ধ) সদাচরণ পদ্ধতি কে পাথেয় করে সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন "অনন্তজ্ঞান, সব ত্যাগ। জগতের কল্যাণ অনন্ত প্রেম, অনন্ত কর্ম, আনন্ত জীবে, দয়া" চাই; আর "আমরা সন্ন্যাসী,
ভুক্তি, মুক্তি করা, আচন্ডালের কল্যাণ করা এই আমাদের ব্রত, তাতে মুক্তি আসে বা নরক আসে।"
বিবেকানন্দের মতে শাক্যমুনি স্বয়ং সন্ন্যাসী ছিলেন, এবং তাঁহার হৃদয় এত উদার ছিল যে, তিনি জাতিভেদ নামক সামাজিক ব্যবস্থাকে নসাৎ করে মূল সত্য ধর্মকে সমগ্র পৃথিবীর লোকের মধ্যে ছড়াইয়া দিয়েছিলেন তাঁর গৌরব। পৃথিবীতে ধর্মপ্রচারের তিনিই প্রথম প্রবর্তক;
শুধু তাই নয়, ধর্মান্তরিত প্রথম উদিত হইয়াছে। ইহাই করনের ভাব তাঁহারই মনে সকলের প্রতি বিশেষতঃ অজ্ঞান ও দরিদ্রগণের প্রতি অদ্ভুত সহানুভূতিতেই তাঁহার গৌরব প্রতিষ্ঠিত। তাঁহার কয়েকজন শিষ্য ব্রাহ্মণ ছিলেন। যে সময়ে বুদ্ধ শিক্ষা দিতে ছিলেন, সে সময়ে সংস্কৃত ভারতের কথ্য ভাষা ছিল না। বুদ্ধদেবের কোন কোন ব্রাহ্মণ শিষ্য তাঁহার উপদেশগুলি সংস্কৃতে অনুবাদ করিতে চান, তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলিয়াছেন আমি দরিদ্রের জন্য জনসাধারণের জন্য আসিয়াছি, আমি জনসাধারণের ভাষাতেই কথা বলিব।' আজ পর্যন্ত তাঁহার অধিকাংশ উপদেশ সেই সময়কার চলিত ভাষাতেই লিপিবদ্ধ।
যে ধর্মীয় সংঘর্ষ ভারতের ঐক্যকে বিঘ্নিত করতে যাচ্ছিল, বুদ্ধ সে সমস্যার সমাধান করলেন। আদর্শ মানব চিত্র কি হবে বুদ্ধদেব তা ব্যবহারিক ক্ষেত্রে নিয়ে এলেন। তিনি পুরুষকারের ওপর জোর দিয়ে মানুষকে করে তুললেন আত্মবিশ্বাসী। বর্তমান পাশ্চাত্য জাতির মতো ভোগ ও অধিকার নয়, ত্যাগ ও সেবাই যে ভারতীয় সমাজের মেরুদণ্ড এই কথাটি তিনি শুধু তুলেই ধরলেন না, ভারতীয় সমাজজীবনে সংক্রমিত করে দিয়ে গেলেন। ধর্ম যে মানুষরেই জন্য, মানুষই যে তার প্রাণবিন্দু,
মানুষকে অস্বীকার করে তত্ত্বসর্বস্ব হওয়াটা যে ধর্ম নয় এই বাণী প্রচারের মধ্যেই বুদ্ধদেবের তাৎপর্য। ধর্মকে তিনি দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে এক করে দেখতে চাইলেন; অলৌকিক বা রহস্যবিদ্যাকে তিনি ঘৃণা করলেন কারণ ঐগুলি ধার্মিকের লক্ষণ নয়, ধার্মিকের প্রমাণ তার চরিত্রে। কথ্যভাষায় (মালি) উপদেশ দিয়ে তিনি মানুষকে তত্ত্বভারাক্রান্ত হওয়া থেকে মুক্তি দিলেন। বুদ্ধদেবের ধর্মান্দোলনের মধ্যে দিয়ে ভারতাত্মা স্বকীয় শক্তিতে উঠে দাঁড়ালেন। (ইতিহাস চিন্তায় বিবেকানন্দ, পৃষ্টা-৮৪)।
সর্বধারণার প্রতি সমন্বয় জ্ঞাপনকারী বিবেকানন্দের পরিচয় তিনি ভগবান তথাগতের (বুদ্ধ) প্রতি একান্ত অণুগত। এই কারণে তাঁর অভিমত.... "আমি একমাত্র কর্ম বুঝি পরোপকার, বাকী সমস্ত কুকর্ম। তাই বুদ্ধের পদানত হই।"
বিবেকানন্দের অভিমতে বুদ্ধই একমাত্র কর্মযোগী। যিনি কর্মযোগের মূলশিক্ষাকে সম্পূর্ণ অর্থে কার্যে পরিণত করেছিলেন। তিনি ব্যতীত পৃথিবীর অন্যান্য মহাপুরুষের সকলেই বাহ্য প্রেরণার বশবর্তী হয়ে নিঃস্বার্থ কর্মে যুক্ত হয়েছিলেন। তাঁদের কেউ বা বলেছেন, তাঁরা ঈশ্বরের প্রেরিত দূত, আবার কেউ বলেছেন, তাঁরা ঈশ্বরের অংশ অথবা অবতার। শুধুমাত্র বুদ্ধই এই সকল বিষয় হতে মুক্ত কেননা তিনি কর্মফলে বিশ্বাসী। আর সেটাই মানব সমাজের মুক্তির মহামন্ত্র।
ধম্মপদে প্রকৃত আর্য সম্পর্কে বলা হয়েছে
"ন তেন অরিযো হোতি, যেন পানানি হিংসতি।
অহিংসা সব্বপানানং, অরিযো তি পবুচ্চতি।। ২৭০।।
অর্থাৎ যিনি প্রাণীকুলের প্রতি হিংসা করেন সে মনুষ্য 'আর্য' কি ভাবে হবেন। কেননা সকল প্রাণীর প্রতি লোকে অহিংসক বৃত্তি (মৈত্রীভাবনা) পোষণকারীকেই 'আর্য' বলা হয়।
(ক্যালিফোর্নিয়ার পাসাডানার শেক্সপিয়ার ক্লাবে স্বামী বিবেকানন্দের ভাষণ, ফেব্রুয়ারি ২, ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ)
১। মহান মানুষ গৌতম বুদ্ধ
মানুষ হিসাবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার জীবন সম্বন্ধে আপনাদের অধিকাংশ লোক জানেন।
২।তিনিই প্রথম বর্ণ ব্যবস্থা ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন – সেই অসাধারণ আন্দোলন!
৩। বুদ্ধ বলেছেনঃ আমি মানুষের মধ্য একজন মানুষ।
৪। অধ্যাবসী হয়ে নিজে নিজের মুক্তি অর্জন করো। তোমরা সবাই আমার মত একজন মানুষ। আমি তোমাদের মত ছাড়া অন্য কেউ নই। আজকে আমি যে মানুষ – নিজেই খেটে তাকে তৈরি করেছি। বুদ্ধের মৃত্যুর আগে তিনি এই কথা বলে গিয়েছেন।
৫। সবকিছুই পরীক্ষা–টেস্ট করে গ্রহণ কর। যদি দেখো তুমি যা গ্রহণ করেছ- সেগুলি অনেক মানুষের কল্যাণ হবে, তাহলে সেটিকে সবার মধ্যে বিলি করে দাও। এই কথাগুলি বলার পর শিক্ষকের মৃত্যু হয়।
৬। পৃথিবীর মধ্য গৌতম বুদ্ধর থেকে বড় যৌতিক দার্শনিক পৃথিবী দেখে নাই। তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ ও যৌক্তিকতার শিক্ষক। এই মানুষটি কখনোই খাম- খেয়ালী ব্রাহ্মণদের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। সে কখনোই মাথা নত করেননি!
৭। আপনারা জানেন তিনি আত্মাকে অস্বীকার করেছেন,
তিনি কখনো চিরস্থায়ী বলে কোন জিনিস বিশ্বাস করেননি।
৮। ভগবান নেই, আত্মা নেই, নিজের পায়ে দাঁড়াও,
ভালোর জন্য ভালো কাজ করো- শাস্তির ভয়ে অথবা অন্য কোথাও যাওয়ার জন্য নয়। যুক্তিযুক্ত হয়ে দাঁড়াও এবং কোন নিজের উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ কোরোনা।
অসাধারণ!অসাধারণ!
৯।শিক্ষককে একজন প্রশ্ন করে। “মানুষের কি থাকে?” শিক্ষক উত্তর দেন, সবকিছু সবকিছু- কিন্তু মানুষের মধ্যে কি আছে? শরীর নয়- আত্মা নয়। যা থাকার কেবলমাত্র চরিত্র। এই চরিত্র যুগ যুগ থাকবে।
১০। বিনা রক্ত ক্ষয়ে বৌদ্ধ ধর্ম ব্যতীত অন্য কোন ধর্ম এক পা-ও এগোতে পারেনি – কেবলমাত্র বুদ্ধি দিয়ে কোন ধর্ম এক লক্ষ
লোক ও নিজের ধর্মে পরিবর্তিত করতে পারেনি।
বিবেকানন্দের মতে ভারতবর্ষে যে সকল মঠ ইত্যাদি দেখা যায় সেগুলির প্রায় সিংহভাগই ছিল বৌদ্ধ বিহার। কেননা বুদ্ধের হাত ধরেই ভারতবর্ষে প্রকৃত সন্ন্যাস আশ্রমের বীজ প্রোথিত হয়েছিল। মনুষ্যজাতির মধ্যে তিনিই সর্ব প্রথম জগৎকে নীতি বিজ্ঞান সম্পর্কিত শিক্ষা প্রদান করেছিলেন।
বহুজনের হিতার্থে,
বহুজনের সুখার্থে তিনি অনাড়ম্বর জীবন-যাপন করতেন। মানুষকে ভালবাসার জন্যই তিনি তাঁদের ভালবাসতেন,
এছাড়া তাঁর কোন অন্য উদ্দেশ্য ছিল না। সর্বোপরি বুদ্ধের জন্মের পূর্বে এদেশে ছিল না কোন বিদ্যালয়,
মহাবিদ্যালয়। এছাড়া জনগণের সুচিকিৎসার জন্য হাসপাতাল,
পশু চিকিৎসালয় ইত্যাদির তো প্রশ্নই ওঠে না। স্থাপত্য বিদ্যার ও সেইভাবে কোন প্রসার ঘটেনি। এই সকল তাঁরই প্রত্যয়। তাঁর জন্মের পূর্বে যে সকল ধর্মতত্ত্ব ছিল, সেগুলি ছিল স্বল্পসংখ্যক কিছু মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন। বুদ্ধই সর্বপ্রথম মানব মুক্তির পথকে নির্দেশ করেছিলেন।
১৮৯৪ সালের ১৯ মার্চ বিবেকানন্দ আমেরিকা'র ডেট্রয়েট শহরেক বক্তৃতা প্রসঙ্গে (বুদ্ধ সম্পর্কিত) বলেছেন "তিনি কারও নিন্দে করেন নি। (নিজের জন্য কিছু দাবীও করেন নি। প্রত্যেককে নিজ নিজ চেষ্টায় মুক্তিলাভ করতে হবে, এটাই ছিল তাঁর বিশ্বাস এবং উপদেশ। পরিনির্বাণ শয্যায় তিনি বলেছিলেন,
"কাহারও উপর নির্ভর করিও না। নিজের মুক্তি নিজেই সম্পাদন কর।"
বিবেকানন্দের মতে বৌদ্ধধর্মে নিষ্কাম কর্মের ভাবই প্রবল। সেই সময়কালের অবিরত দার্শনিক সিদ্ধান্ত, জটিলতর অনুষ্ঠান পদ্ধতি, বিশেষ করে জাতিপ্রথার প্রতি তিনি অত্যন্ত বিরক্ত ছিলেন। তিনি এমন ধর্মপ্রচার করেছিলেন যেখানে সকামভাবের লেশমাত্র ছিল না। মানুষ মানুষে এবং মানুষে ও প্রাণীতে অসাম্যের বিরুদ্ধে বুদ্ধ ছিলেন মূর্ত প্রতিবাদ। তিনি বলতেন জগতের সকল প্রাণীই সমান।
বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধের মহান প্রবক্তা ছিলেন বুদ্ধ। তাঁর মূল কথাই ছিল আর্য-অনার্য নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষেরই অধিকার রয়েছে ধর্মের উপর, স্বাধীনতার উপর। তাই সে অধিকারের ক্ষেত্রে সকলকেই তিনি আহ্বান করেছিলেন। কেননা বাস্তব বুদ্ধি সম্পন্ন হতেই তিনি সকলকে উপদেশ দিতেন।
বুদ্ধকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রজ্ঞাবান দার্শনিক রূপে অভিহিত করে বিবেকানন্দ বলেছেন যে,
"তিন দেবদূত নন, দেবতা নন, দানবও নন, তিনি শুধুমাত্র একজন দৃঢ়চিত্ত প্রাজ্ঞব্যক্তি যাঁর মস্তিস্কের প্রতিটি কোশই নিখুঁত, পরিপুষ্ট এবং জীবনের অন্তিম মুহুর্ত পর্যন্ত সতেজ এবং ক্রিয়াশীল। কোন ভ্রান্তি নেই, নেই কোন মোহ, যা একঅর্থে বুদ্ধের প্রকৃত স্বরূপ। প্রবল ব্রাহ্মণ্যশক্তির কাছে তিনি কখনও মাথা নত করেন নি। সর্বত্রই তিনি ছিলেন সহজ ও স্বাভাবিক। সর্বত্রই সেই এক প্রাজ্ঞ মনীষী। এক বলিষ্ঠ পুরুষ।" বুদ্ধের যে বৈশিষ্ট্য বিবেকানন্দের মতে তাঁকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করেছিল, তা হল তাঁর দৃঢ়তা, মহত্ব এবং স্বচ্ছ চিন্তাশক্তি।
ধর্মের অনৈতিকতার মূলোচ্ছেদ করে অতিশয় স্পষ্ট সত্যকে বুদ্ধ প্রকাশ করেছিলেন। বিবেকানন্দের মতে বুদ্ধের সমস্ত উপদেশবলীর মধ্যে মানব মৈত্রীই অন্যতম। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে সাম্যের আচার্য। সুতরাং এই অর্থে বিবেকানন্দ বলতে চেয়েছেন-
"খুলে যাক্ রুদ্ধ দ্বার, চৌদিকে ঘোযুক শঙ্খধ্বনি ভারত অঙ্গনতলে আজি তব নব আগমনী।"
গ্রন্থঋণ
১। বিবিধ প্রসঙ্গ: বিষয় অজানা মানুষ বিবেকানন্দ,
সম্পাদনা, ড. বিষ্ণুপদ নন্দ, শিক্ষা বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৭।
২। অন্যচোখ স্বামী বিবেকানন্দ,
সুকৃতিরঞ্জন বিশ্বাস, ছিয়ানব্বই প্রকাশনী,
মসলন্দপুর, ২০১৮।
৩। ধম্মপদ, সম্পাদনা স্বামী দ্বারিকাদাস শাস্ত্রী, চৌখাম্বা সংস্কৃত সীরীজ অফিস, বারাণসী, ২০০৫।
৪। ইতিহাস চিন্তায় বিবেকানন্দ, স্বামী সোমেশ্বরানন্দ, শ্রদ্ধা প্রকাশনী রহড়া, ২০১১।
৫। স্বামী বিবেকানন্দ মার্কসবাদীদের দৃষ্টিতে,
এন বি এ, কলকাতা, ২০১২।
৬। বিবেকানন্দের সমাজ দর্শন, সান্ত্বনা দাশগুপ্ত,
উদ্ধোধন কার্যালয়,
কলকাতা, ২০০৯।
৭। বৌদ্ধধর্মের বিকাশের ইতিহাস, ড. গোবিন্দ চন্দ্র পান্ডে, নাগরী প্রচারিনী সভা, বারাণসী, ১৯৭১।