ভূমিকা
মূল লেখক ও সম্পাদক কেন এবং বিশাখা কাওয়াসাকি
বৌদ্ধধর্মে অনেক তীর্থ, মহাতীর্থ ও ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে। 'তীর্থ' শব্দের অর্থ হল 'পুণ্যস্থান'। সুতরাং যে স্থান দর্শন করলে পুণ্য অর্জন হয়, তাকে 'তীর্থস্থান' বলে, বুদ্ধের জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলীর স্মৃতি বিজড়িত স্থানসমূহকে বৌদ্ধ 'তীর্থস্থান' বলা হয়। এ সকল পবিত্র স্থানগুলোকে দু'ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- তীর্থ ও মহাতীর্থ। বুদ্ধের জীবনে নানা ঘটনাবহুল পবিত্র স্থানসমূহকে 'বৌদ্ধ তীর্থস্থান' বলা হয়। ঐতিহ্যমণ্ডিত স্মৃতিবহ এ সকল স্থানে বিহার, চৈত্য, স্তূপ প্রভৃতি নির্মিত হয়েছে। বৌদ্ধধর্মে এ সকল স্থানকে 'তীর্থ' বলা হয়। যেমন, কপিলাবস্তু, শ্রাবস্তী, লুম্বিনী, বৈশালী, রাজগৃহ, প্রভৃতি। বুদ্ধের জীবনের উল্লেখযোগ্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি বিজড়িত পবিত্র স্থানগুলোকে 'মহাতীর্থ' বলা হয়। তীর্থস্থানগুলো হল পবিত্রস্থান, পুণ্যস্থান, পুণ্যক্ষেত্র। ধর্মপালনের মত তীর্থদর্শনও গুরুত্বপূর্ণ। চিত্তশুদ্ধি ও মনের শুচিতার জন্য তীর্থদর্শন উত্তম। মনের প্রসারতা বৃদ্ধি পায়। বুদ্ধ যেসব স্থানে গিয়ে ধর্মপ্রচার করেছেন, সেসব স্থান তাঁর জীবিতকালে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। এগুলো পবিত্র তীর্থস্থানরূপে বিবেচিত।
বুদ্ধ লুম্বিনীতে জন্ম করেন, বুদ্ধগয়ায় বুদ্ধত্ব লাভ করেন, সারনাথে প্রথম ধর্মপ্রচার করেন এবং কুশীনগরে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। ভগবান বুদ্ধের উক্ত চারটি মহৎ ঘটনা এ চারটি স্থানে সংঘটিত হয়েছিল। তাই এ চারটি স্থানকে 'মহাতীর্থস্থান' বলা হয়। বুদ্ধ জীবনের বিশেষ ঘটনাবলির জন্য আরো চারটি স্থান বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। স্থানগুলো হলো- রাজগৃহ, বৈশালী, শ্রাবস্তী এবং সাংকাশ্য নগর। উপরি-উক্ত আটটি স্থান বৌদ্ধধর্মে 'অষ্টমহাতীর্থস্থান' নামে পরিচিত। বুদ্ধ ও বৌদ্ধধর্মের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো বৌদ্ধদের নিকট অতি পবিত্র পুণ্যভূমি। ঐতিহ্যমণ্ডিত স্মৃতিবহ এ সকল স্থানে বিহার, চৈত্য, স্তূপ, স্তম্ভ প্রভৃতি নির্মিত হয়েছে।
খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৩ অব্দে গৌতমবুদ্ধ বর্তমান নেপালের কপিলাবস্তুর লুম্বিনী কাননে জন্মগ্রহণ করেন। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেন। বুদ্ধত্ব লাভের পর সর্বপ্রাণীর কল্যাণের জন্য বিভিন্ন স্থানে বিচরণ করে তিনি ধর্ম প্রচার করেছেন।
ঐতিহাসিক স্থান
বৌদ্ধদের অনেক ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে। ঐতিহাসিক স্থানসমূহও সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। বুদ্ধ, বুদ্ধের শিষ্য, বৌদ্ধ রাজন্যবর্গ কিংবা প্রাচীন সভ্যতা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও শিল্পকলার নিদর্শনসম্পন্ন স্থানকে ঐতিহাসিক স্থান বলা হয়। যেমন- গান্ধার, মথুরা, সাঁচি, অজন্তা, ইলোরা, তক্ষশীলা, নালন্দা প্রভৃতি। ঐতিহাসিক স্থান হল অতীতের বৌদ্ধ রাজা-মহারাজা বা স্বনামধন্য মহাপুরুষের রেখে যাওয়া কীর্তি। এসব কীর্তি কালের আবর্তে ধ্বংস হয়ে হারিয়ে যায়। পরবর্তীতে প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকরা আবার তা আবিষ্কার করেন।
চার মহাতীর্থের মধ্যে লুম্বিনী প্রথম মহাতীর্থ। লুম্বিনী গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান। নেপালের দক্ষিণ সীমান্তের অন্তর্গত বুটন জেলার ভগবানপুর তহশিলের উত্তরে 'রুম্মিনদেই' নামক স্থানে অবস্থিত। শুদ্ধোদনের স্ত্রী রানি মহামায়া শ্বশুর বাড়ি থেকে পিত্রালয়ে যাবার পথে লুম্বিনী কাননে সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্ম হয়। রাজপুত্রের জন্মের কারণে লুম্বিনীর পরিচিতি বৃদ্ধি পায় এবং এটি 'মহাতীর্থ' হিসেবে বিখ্যাত হয়। লুম্বিনী মন্দিরের পাশেই আছে একটি অশোকস্তম্ভ।
স্তম্ভে উৎকীর্ণ লিপি পাঠে জানা যায়, এখানেই সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্ম হয় এবং মহারাজ অশোক এ স্তম্ভ স্থাপন করেছিলেন তাঁর রাজত্বের বিংশতিতম বর্ষে। এখানকার প্রধান দর্শনীয় বস্তু হল অশোক স্তম্ভ ও রুম্মিনদেই মন্দির। সম্রাট অশোক তাঁর রাজ্য অভিষেকের ২০ বছরে দ্বিতীয়বার লুম্বিনী আগমন করেন। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ অব্দে তিনি সিদ্ধার্থের জন্মস্থানকে চিরস্মরণীয় ও চিহ্নিত করার জন্য একটি স্তম্ভ স্থাপন করেন। ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে স্তম্ভটি আবিষ্কৃত হয়। এটি ‘অশোক গুপ্ত' নামে পরিচিত। অশ্বমূর্তি সিদ্ধার্থের সংসার ত্যাগের প্রতীক। স্তম্ভটি পরবর্তীকালে মাঝখানে ভেঙে গেলেও এর গায়ে যে শিলালিপি ছিল তা এখনো বর্তমান। শিলালিপিতে প্রাকৃত ভাষায় এরূপ খোদিত আছে - 'এ স্থানে শাক্যমুনি বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেন। স্তম্ভের গায়ে খোদিত অন্য অনুশাসনলিপি থেকে আরো জানা যায় যে, সম্রাট অশোক লুম্বিনী উদ্যান দর্শনের স্মারক এবং বুদ্ধের স্মৃতির প্রতি সম্মানার্থে এ স্থানকে করমুক্ত করেছিলেন।
'বুদ্ধগয়া' হচ্ছে চার মহাতীর্থের একটি শ্রেষ্ঠ 'তীর্থ'। এটি অন্যতম মহাতীর্থ। যার প্রাচীন নাম ছিল উরুবেলা বা উরুবিল্ব। সিদ্ধার্থ গৌতম এখানে বোধিবৃক্ষের নিচে বসে সাধনার মাধ্যমে শুভ বৈশাখী পূর্ণিমাতে বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন। তখন থেকে তিনি বুদ্ধ বা গৌতমবুদ্ধ নামে পরিচিত। তাই বুদ্ধগয়া জগতের বৌদ্ধদের জন্য সবচেয়ে পবিত্র ও পুণ্যময় স্থান। বুদ্ধগয়া ভারতের বিহার রাজ্যে অবস্থিত। প্রাচীন নৈরঞ্জনা নদীর কূল বেয়ে গেছে এবং সে নদীর বর্তমান নাম ফল্গু নদী। বুদ্ধগয়ার প্রধান আকর্ষণ হলো বিশাল সুউচ্চ চারকোণা বুদ্ধমন্দির এবং মন্দিরের গা ঘেঁষে বোধিবৃক্ষ ও বুদ্ধের বজ্রাসন। এ বোধিবৃক্ষ এক ঐতিহাসিক বৃক্ষ। সপ্তম শতকে হিউয়েন সাং ভারত পরিভ্রমণ করতে এসে বোধিবৃক্ষ ও বজ্রাসন দেখতে পান। এ বজ্রাসন একটি অখণ্ড পাথরে নির্মিত বলে বর্ণিত। বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে যে সমস্ত স্মৃতিসৌধ আছে তার মধ্যে বুদ্ধগয়ার এ মহাবোধি মন্দিরটি সবচেয়ে প্রাচীন। সম্রাট অশোকই সর্বপ্রথম এটা বড় করে নির্মাণ করেছিলেন। বিশ্বের ইতিহাসে বুদ্ধগয়ার এ মহাবোধি মন্দির এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে।
চার মহাতীর্থের একটি হচ্ছে সারনাথ। সারনাথের পূর্ব নাম ছিল ইসিপতন বা 'মৃগদাব'। গৌতম বুদ্ধ গয়ার বোধিবৃক্ষমূলে বুদ্ধত্ব লাভের পর জীবগণের মুক্তিলাভের জন্য প্রথম ধর্মপ্রচার করেন এই সারনাথে। সারনাথ বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য স্থান। ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের বারাণসী থেকে প্রায় ৭ কিলোমটিার দূরে বরুণা নদীর তীরে সারনাথ অবস্থিত। বুদ্ধগয়ায় জ্ঞানলাভের পর গৌতম বুদ্ধ সর্বপ্রথম যে পাঁচ শিষ্যের কাছে ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র দেশনা করেন তাঁদের পঞ্চবর্গীয় শিষ্য বলে। তাঁদের নাম হচ্ছে কৌণ্ডিন্য, বপ্প, ভদ্দীয়, মহানাম ও অশ্বজিৎ। বুদ্ধ তাদের নিকট প্রথম যে সূত্র দেশনা করেছিলেন তা ধর্মচক্র প্রবর্তন নামে খ্যাত। বুদ্ধ এখানে ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র ছাড়াও আদিচ্চ পরিযোসান সুত্ত, রথাভর সুত্ত, সচ্চবিভঙ্গ সুত্ত, পস সুত্ত, কুঠবিষ সুত্ত প্রভৃতি আরও অনেক সূত্র দেশনা করেছিলেন।
বুদ্ধ ভিক্ষুদের বিভিন্ন দিকে ধর্ম প্রচারের জন্য পাঠান। পরবর্তীকালে সারিপুত্র, মৌদগল্যায়ন মহাকচ্চায়ন প্রমুখ মহাশ্রাবক বাস করতেন। হিউয়েন সাঙের বিবরণ থেকে জানা যায় যে তাঁর সময় সারনাথের সঙ্ঘরাম আটভাগে বিভক্ত ছিল। বুদ্ধের পরিনির্বাণের পরেই সারনাথ ধীরে ধীরে বৃহৎ সংঘরামে পরিণত হয়। অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের অব্যবহিত পরেই সারনাথ পরিদর্শন করেছিলেন। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সৌজন্যে খননকার্যের ফলে এ স্থানে বহু ধবংসাবশেষ আবিস্কৃত হয়েছে। 'ধর্মচক্র প্রবর্তনের স্মারক হিসেবে সম্রাট অশোক এখানে একটি স্তূপ নির্মাণ করেন। স্তূপটি পাথরের তৈরি। এর উচ্চতা ছিল ১৪৫ ফুট এবং প্রস্থ ছিল ৯৪ ফুট। চিনা পরিব্রাজক শুয়াং জাঙ স্তূপটি দেখেছিলেন ।
তিনি মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন কুশীনগরে। বুদ্ধের সময়কালে স্থানটি মল্ল রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। বুদ্ধের জীবনের চারটি প্রধান ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল বলে এ চারটি স্থানকে মহাতীর্থস্থান বলে। কুশীনগর বৌদ্ধদের অন্যতম পবিত্র তীর্থভূমি। এখানে গৌতম বুদ্ধ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। প্রাচীনকালে কুশীনগর বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। যেমন, কুশীনারা, কুশীগ্রাম, কৃপাবর্তী ইত্যাদি। গুপ্ত সম্রাট কুমারগুপ্তের সময় হরিবল নামক এক বৌদ্ধ দাতা এখানে দীর্ঘ ২২ হাত লম্বা একটি শায়িত বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ করেন। এর মধ্যে একটি 'পরিনির্বাণ তাম্রপট' নামে তামার পাত দেখা যায়। সম্রাট অশোক এই স্থান পরিদর্শন করে বুদ্ধের পরিনির্বাণ স্থান নির্দিষ্ট করেন। চিনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েন কুশীনগর ভ্রমণ করেন। তিনি এখানে লোকবসতি বেশি দেখেননি বলে লিখে গেছেন।
শ্রাবস্তী হচ্ছে কোশল রাজ্যের এক সমৃদ্ধশালী নগরী। প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের শুরু খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে। এর আগেও যে প্রাচীন ভারতে রাজনৈতিক ইতিহাস ছিল না তা নয়, তবে সেই ইতিবৃত্তটি আজও তেমন স্পষ্ট নয়। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের দিকে প্রাচীন ভারতে ষোলোটি স্থানীয় রাজ্য গড়ে উঠেছিল। এই রাজ্যগুলির নাম বৌদ্ধগ্রন্থ অঙ্গুত্তর নিকয় তে পাওয়া যায়। বৌদ্ধসাহিত্যে এই রাজ্যগুলিকে ষোড়শ মহাজনপদ বলে অবহিত করা হয়েছে। এই ষোড়শ মহাজনপদগুলি হল: 'কাশী, কোশল, অঙ্গ, মগধ, বজ্জি, মল্ল, চেদি, বৎস, কুরু, পাঞ্চাল, মৎস, সুরসেনা, অস্মক, অবন্তী, গান্ধার এবং কম্বোজ। গঙ্গার উত্তরে ছিল কোশল রাজ্য। এই রাজ্যেরই এক সমৃদ্ধশালী নগরী ছিল শ্রাবস্তী। পালি ভাষায় শ্রাবস্তী হল সাবত্থি। বৌদ্ধ ঐতিহ্য বলে, সাবত্থি নগরীতে সাধু সাবত্থা বাস করতেন বলেই ঐ নাম। শ্রাবস্তী নগরীর নামসংক্রান্ত আরও একটি কাহিনি আছে। যেখানে শ্রাবস্তী নগরী গড়ে উঠেছিল সেখানেই এককালে একটি অতিথিশালা ছিল। অতিথিশালায় নানা রাজ্যের বণিকেরা সমবেত হত। বণিকেরা একে অন্যকে জিজ্ঞেস করত, কিম বানডাম আত্থি? (কী আছে সঙ্গে?) উত্তরে বলা হত, সব্বং অত্তি (আমাদের সব আছে)। এই সব্বং অত্তি শব্দ দুটো থেকেই হয়তো নগরীর নাম সাবত্থি বা শ্রাবস্তী হয়ে
গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে শ্রাবস্তী নগরীর সম্পর্ক ছিল নিবিড়। সদত্ত ছিলেন শ্রাবস্তী নগরীর একজন ধনী শ্রেষ্ঠী। সুদত্ত ব্যবসায়ের কাজে মগধের রাজধানী রাজগৃহ নগরীতে গিয়েছিলেন। ওই রাজগৃহে নগরীতেই সুদত্ত প্রথম বুদ্ধকে দেখেছিলেন। বুদ্ধের সঙ্গে কথা বলে সুদত্ত বুদ্ধের এক পরম ভক্তে পরিণত হয়। বুদ্ধকে একবার শ্রাবস্তী যাওয়ার অনুরোধ করেন সুদত্ত। বুদ্ধ রাজী হন।
কিছুকাল পরের কথা। বুদ্ধ শ্রাবস্তী আসছেন; সঙ্গে কয়েক হাজার শিষ্য। এত লোককে কোথায় থাকবার আয়োজন করা যায়। সুদত্ত চিন্তিত হয়ে পড়লেন। শ্রাবস্তী নগরীর বাইরে যুবরাজ জেত এর বিশাল একটি বাগান ছিল। সুদত্ত বাগানটি কিনতে চাইলে জেত প্রথমে রাজী হননি। পরে অবশ্য শর্তসাপেক্ষে রাজী হলেন—স্বর্ণমুদ্রায় সম্পূর্ণ বাগান ঢেকে দিতে হবে। সদুত্ত সম্মত হলেন। সুদত্ত গোশকট করে স্বর্ণমুদ্রা এনে বাগান ঢেকে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। সুদত্তর পরম বুদ্ধভক্তি দেখে জেত অভিভূত হয়ে পড়েন। তিনি সুদত্তকে বাগানখানি দান করলেন। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সুদত্ত জেত এর নামে বাগানে নাম রাখেন জেতবন।
বুদ্ধ শ্রাবস্তী এলেন। ধ্যান করলেন, দান করলেন; শ্রাবস্তী নগরীকে অমর করে রাখলেন। রাজকুমার জেত অসম্ভব ধনাঢ্য ছিলেন; তিনি বুদ্ধকে আঠারো কোটি স্বর্ণ মুদ্রা দান করেন।
সুদত্ত বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সুদত্ত অনাথদেরকে অন্ন (পিণ্ডক) দিতেন বলে তাঁকে অনাথপিণ্ডিক বলা হত। অনাথপিণ্ডিক নামটি বুদ্ধই দিয়েছিলেন।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব
তীর্থস্থান অতীত ইতিহাসের অনন্য সাক্ষী। তাই তীর্থস্থান ভ্রমণে ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়। বৌদ্ধ তীর্থস্থানসমূহ শুধু বৌদ্ধ ধর্মীয় নয় বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনারও প্রামাণ্য দলিল। বুদ্ধ এবং প্রাচীনকালের রাজন্যবর্গ, রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি এবং ধর্ম-দর্শনের নানা ঘটনা তীর্থস্থানসমূহের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেমন, বৌদ্ধতীর্থ সপ্তপর্ণী গুহায় প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ সঙ্গীতিতে মহাকশ্যপ স্থবিরের নেতৃত্বে এবং পাঁচশত পণ্ডিত অর্থৎ ভিক্ষুর উপস্থিতিতে প্রথম বুদ্ধবাণী সংগৃহীত হয়েছিল। জানা যায়, রাজা অজাতশত্রু প্রথম সঙ্গীতি অনুষ্ঠানে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। সুতরাং সপ্তপর্ণী গুহা ভ্রমণে ত্রিপিটক সংকলনের ইতিহাস জানা যায়। পণ্ডিতগণ প্রাচীন তীর্থস্থানগুলোকে অতীতের সভ্যধর্মচক্র প্রবর্তনের স্মারক হিসেবে সম্রাট অশোক এখানে একটি স্তূপ নির্মাণ করেন। স্তূপটি পাথরের তৈরি। এর উচ্চতা ছিল ১৪৫ ফুট এবং প্রস্থ ছিল ৯৪ ফুট। চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং স্তূপটি দেখেছিলেন। তা ও সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবে গণ্য করেন। প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারগুলো শুধু ধর্ম নয়, নানা শাস্ত্রের শিক্ষাকেন্দ্রও ছিল। বুদ্ধ শিষ্যরা ধর্ম শিক্ষার পাশাপাশি জ্যোতিষশাস্ত্র, আয়ুর্বেদ, গণিতশাস্ত্র, চিত্রকলা, ভাস্কর্য ইত্যাদিও শিক্ষা দিতেন। তক্ষশীলা, নালন্দা, বিক্রমশীলা, ওদন্তপুরী, প্রভৃতি প্রাচীন যুগের অন্যতম শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। এ শিক্ষাকেন্দ্র গুলোর ইতিহাস পাঠে।
তীর্থস্থানসমূহে প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির নানা উপাদান ছড়িয়ে আছে। যেমন, বিভিন্ন তীর্থস্থানের ধ্বংসাবশেষ থেকে বিহারের অবকাঠামো, স্তূপ, স্তম্ভ, ভিক্ষুদের ব্যবহারের দ্রব্যসামগ্রী, বুদ্ধ-বোধিসত্ত্ব ও বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি, প্রাচীন মুদ্রা, পোড়ামাটি ও পাথরের চিত্রফলক, অনুশাসনলিপি প্রভৃতি আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব প্রত্নসামগ্রী হতে প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। যেমন: অলঙ্কৃত ইষ্টক দ্বারা নির্মিত বিহারের অবকাঠামোতে সে যুগের উন্নত নির্মাণ শৈলীর পরিচয় পাওয়া যায়। আবিষ্কৃত মূর্তিগুলো মূল্যবান পাথরে নিখুঁতভাবে নির্মিত, যা প্রাচীনকালের উন্নত ভাস্কর্য শিল্পের স্বাক্ষর বহন করে। চিত্রফলকগুলোতে তৎকালীন ধর্মীয় ও সমাজজীবনের নানা কাহিনী অঙ্কিত আছে। স্তূপ ও স্তম্ভ শীর্ষে স্থাপিত অশ্ব ও সিংহ মূর্তিগুলোতে অপরূপ শৈল্পিক সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটেছে। এসব বিবেচনা করে বলা যায়, তীর্থস্থানের প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব অপরিসীম।
সুমনপাল ভিক্ষু
ReplyReply allForward |
No comments:
Post a Comment