সুমনপাল ভিক্ষু
একথা সুবিদিত যে পালি
দাঠাবংশের রচয়িতা ছিলেন ভদন্ত দ্বিতীয় ধর্মকীর্তি। এই গ্রন্থটি পাঁচটি অধ্যায় ও ৩৪১৫ টি স্তবক নিয়ে গঠিত যার
মধ্যে সাতটি গ্রন্থকার সম্বন্ধে মুখবন্ধ। প্রথম অধ্যায়ে বুদ্ধের জীবন সংক্ষেপে
পরিবেশিত হয়েছে। এটির প্রধান উদ্দেশ্য হল বুদ্ধের পবিত্র বাম দন্তের ঐতিহাসিক
ইতিবৃত্ত বর্ণনা করা। বুদ্ধের জীবন দ্বিতীয় অধ্যায়েও বর্ণিত হয়েছে। অবশিষ্ট অধ্যায়গুলি
সেই তথ্য পরিবেশন করে যে ভদন্ত মহান অরহন্ত পরাভু থের ভগবান বুদ্ধের চিতা থেকে
তুলে নিয়ে ব্রক্ষদত্ত নামক এক রাজাকে দান করেছিলেন এবং গুহাশিব নামে এক রাজা
রাজকীয় দম্পতি দান্তা ও হেমমালার মাধ্যমে একটি পবিত্র দন্ত ধাতু শ্রীলঙ্কায় প্রেরণ করেছিলেন।
দাঠাবংশের রচনাকালঃ
সকলেই বিশ্বাস করেন যে
দাঠাবংশ রচিত হয়েছিল লীলাবতী নামক এক রাণীর রাজত্বকালে যিনি জীবিত ছিলেন
পলোন্নারুব যুগে। রাণী লীলাবতী তিনবার সিংহাসন আরোহণ করেছিলেন।১ তাদের বিশ্বাস এই যে দাঠাবংশ
রচিত হয়েছিল শ্রীলঙ্কায় তাঁর তৃতীয়বারের
রাজত্বকালে।২ গ্রন্থের
একেবারেই শুরুতেই এই ইঙ্গিত দেত্তয়া হয়েছে যে এটি রচিত হয়েছিল পরাক্রম নামক এক
সেনাপতির আমণ্ত্রনে। মহাবংশে লিপিবদ্ধ আছে যে সেনাপতি পরাক্রম তৃতীয়বার রাণী লীলাবতীকে
সিংহাসনে বসিয়েছিলেন।৩
এই কারণে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো গেছে যে দাঠাবংশ রাণী লীলাবতীর তৃতীয়বারের রাজত্বে
রচিত হয়েছিল।
দাঠাবংশের রচনার সঙ্গে সম্পর্কিত
পরিস্থিতির ইঙ্গিত পাত্তয়া গেছে প্রথম অধ্যায়ের প্রথম থেকে চতুর্থ শতকে। এর অর্থ
নিম্নে প্রদত্ত হল- বিখ্যাত কালুন্নারি পরিবারের সন্তান সেনাপতি পরাক্রম যিনি বুদ্ধশাসনের
অগ্রগতি এবং সাধারণ মানুষের সেবায় আনন্দ লাভ করেন, রানী লীলাবতীকে শ্রীলঙ্কার
সিংহাসনে স্থাপন করেন। তাঁর জন্ম হয়েছিল পাণ্ড্যন গোষ্ঠীতে এবং তিনি ছিলেন নিবেদিত
প্রাণ এবং বাক্যে মনোরম ধর্মীয় আনুশাসনে আনুসারে কাজকার্ম করেন এবং সমস্ত প্রাণীর
মাতৃস্বরূপা। তিনি রাজা পরাক্রমবাহুর প্রধানা মহীষী ছিলেন, তাঁর জ্ঞান ছিল প্রভূত
ও তিনি ছিলেন উদার। সেনাপতি পরাক্রম মাধুরপেরুমল নামক রাজকুমারকে ভগবান বুদ্ধের
বাণী ও শিল্প প্রশিক্ষিত করেছিল। তিনি ভিক্ষুসংঘকে দীর্ঘদিন ধরে চারধরণের
প্রায়োজনীয় বস্তু নিরবিচ্ছিন্নভাবে সরবরাহ করেছিলেন। বুদ্ধশাসনকে দীর্ঘজীবী করবার
বাসনায়, কৃতজ্ঞ ও মনোযোগী হয়ে আমন্ত্রন জানিয়েছিলেন এবং সিংহলবাসী পণ্ডিতদের
দ্বারা দাঠাবংশকে মাগধী ভাষায় অনুবাদ করিয়েছিলেন।৪
এই বর্ণনা থেকে এটি যথেষ্ট স্পষ্ট যে
দাঠাবংশ রচিত হয়েছিল রানী লীলাবতীর কোনো একটি রাজত্বকালে। যেহেতু তিনি তিনবার
সিংহলের সিংহাসন আরোহণ করেছিলেন তাই দাঠাবংশে প্রদত্ত ঘটনাগুলি থেকে এ বিষয়ে
সিদ্ধান্ত করা সম্ভব নয় যে তাঁর কোন রাজত্বকালে গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল। অতএব
মহাবংশে প্রদত্ত তথ্যকে ব্যবহার করতে হবে। মহাবংশে বর্ণিত আছে রাণী লীলাবতী তাঁর
প্রথম রাজত্বকালে তিন বছর, দ্বিতীয়বার এক বছর এবং তৃতীয়বার সাতমাস রাজত্ব
করেছিলেন।৫ অতএব এটি
পরিষ্কার যে দাঠাবংশের শুরুতে রাণী
লীলাবতীর তৃতীয়বারের রাজত্বকালের উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা দৃঢ়ভাবে এই সিদ্ধান্ত
করতে পারি যে রাণী লীলাবতীর সাতমাস ব্যাপী তৃতীয় রাজত্বকালের সময়ই পরাক্রম দাঠাবংশ
রচনা করতে আমণ্ত্রন জানিয়েছিলেন। কেন? কারণ মহাবংশ থেকে এই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে
লীলাবতীর উত্তরসূরী পান্ডু নামক এক ব্যক্তি লীলাবতী ও তাঁর মন্ত্রী পরাক্রমকে
হত্যা করেছিলেন।
এই কারণে একদম শুরুতে কোন একজন সন্দেহ
প্রকাশ করতে পারে যে দাঠাবংশ রচনা মাত্র সাত মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ হতে পারে কিনা।
আমাদের ইতিহাসে এই প্রমাণ আছে যে আরও বৃহৎ গ্রন্থ যাতে আরও উচ্চমানের দার্শনিক
বিষয় রয়েছে আরও স্বল্প সময়ে রচিত হয়েছে। অতএব কোন একজন এই যুক্তি দেখাতে পারে যে
দাঠাবংশ মাত্র সাত মাস সময়ে রচিত হয়েছিল।
যাইহোক আমাদের একথা ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দিক থেকে
লীলাবতীর তৃতীয় রাজত্বকাল অত্যন্ত দুর্বল ছিল।
এই সময়ের মধ্যে এইদেশ নিরবিচ্ছিন্নভাবে
অনেকগুলি বৈদেশিক আক্রমণের মুখোমুখি হয়েছিল। একটি গ্রন্থের রচনাকাল নিরূপণের জন্য
প্রাচীন লেখকেরা দুটি পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকেন-একটি হল সেই বুদ্ধাব্দটি সনাক্ত
করা যে সময়ে গ্রন্থটির রচনা সম্পূর্ণ হয়েছিল। যদি গ্রন্থটি কোন রাজা বা রাণীর আমলে
রচিত হয়ে থাকে তাহলে সেই রাজত্বকালের সেই বিশেষ বছরটিকে চিহ্নিত করা। সেই আনুসারে
যদি গ্রন্থটি রাণী লীলাবতীর রাজত্বকালে সম্পূর্ণ হয়ে থাকে তাহলে লেখক নিঃসন্দেহে
সে কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করবেন।
গ্রন্থটি রাণী লীলাবতীর তৃতীয় রাজত্বকালে
রচিত হয়েছিল লেখক কর্তৃক এই বিষয়টি ঘোষণা করবার অবহেলা প্রমাণ করে দাঠাবংশ রাণী
লীলাবতীর রাজত্বকালে সংকলিত হয়নি। যদি তাই হয় তাহলে দাঠাবংশে অন্য কোন রাজার নাম
উল্লেখ করা নেই কেন? এই প্রশ্নটির উত্তর দেবার আগে আমাদের নিম্নলিখিত
পরিস্থিতিটিকে স্মরণে রাখতে হবে।পান্ডু নামের এক বিদেশী রাজা রাণী লীলাবতীও
মন্ত্রী পরাক্রমকে হত্যা করে সিংহাসন অধিকার করেন। তারপর মগ আক্রমণের এক
দুর্দশাপূর্ণ পর্বের সুত্রপাত হয়েছিল। অতএব এটি স্পষ্ট যে লেখক একজন ধ্বংসাত্বক
রাজপুত্রের রাজত্বকালের কোনরকম উল্লেখ তাঁর গ্রন্থে রাখতে অনিচ্ছুক। উপরের তথ্যের
ভিত্তিতে আমরা এই অনুমান করতে পারি যে দাঠাবংশ ১২১২ খ্রীঃ থেকে ১২১৫ খ্রীঃ এর
মধ্যে রাজা পাণ্ডুর রাজত্বকালে রচিত হয়েছিল। মন্ত্রী পরাক্রমের উল্লেখ থেকে অনুমান
করা যায় দাঠাবংশ কোন সিংহলীয় শাসকের রাজত্বকালে রচিত হয়নি।
দাঠাবংশের ঐতিহাসিকতাঃ
দাঠাবংশ ইঙ্গিত দেয় যে
বুদ্ধের পবিত্র দন্তধাতু শ্রীমহামেঘবণ্ণের রাজত্বকালে লঙ্কায় নিয়ে আসা হয়েছিল।৬ এই তথ্যটি মহাবংশ দ্বারাও
সমর্থিত হয়। এই সময় ভারতবর্ষের কলিঙ্গ গুহাশিব
ক্ষীরধারা নামে অপর একজন রাজার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন এবং তিনি তাঁর কন্যা ও
জামাতাকে যুদ্ধে তাঁর পরাজয় ঘটলে পবিত্র দন্তধাতু নিয়ে শ্রীলঙ্কার পথে অগ্রসর হতে
অনুরোধ জানিয়েছিলেন। দাঠাবংশ থেকে আরও জানা যায় যে তিনি তাঁর কন্যা ও জামাতাকে এই
মর্মে আশ্বস্ত করেছিলেন যে শ্রীলঙ্কার রাজা মহাসেন অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে
দন্তধাতুটিকে গ্রহণ করবেন।৭
আমরা এই তথ্যটি জানি না যে দুই রাজা গুহাশিব ও ক্ষীরধারার মধ্যে যুদ্ধ কতদিন
স্থায়ী হয়েছিল।
দাঠাবংশে বলা হয়েছে যে রাজামহাসেনের
মৃত্যুর নয় বছর পর দন্তধাতুটি শ্রীলঙ্কায় আনীত হয়।৮ যদিও রাজা মহাসেন অবগত ছিলেন যে পবিত্র দন্তধাতুটিকে শ্রীলঙ্কায় আনা হবে, তাঁর পুত্র তা
ছিলেন না। হয়ত এই কারণে তিনি যখন এটির আগমনের সংবাদ শুনেছিলেন তখন আশ্চর্য
হয়েছিলেন। দাঠাবংশের দুটি বিষয়ের উপর এখন আমাদের বিশেষ নজর কেন্দ্রীভূত হওয়া উচিত।
(১) রাজনৈতিক যোগাযোগ যা রাজা মহাসেন ও
কলিঙ্গের মধ্যে বর্তমান ছিল।
(২) রাজা মহাসেনের মৃত্যুর ব্যাপারে
রাজা গুহাশিবের অজ্ঞতা। দ্বিতীয় বিষয়টি সম্পর্কে
আমরা অনুমান করতে পারি যে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হত্তয়ার কারণে রাজা গুহাশিব রাজা
মহাসেন বা শ্রীলঙ্কা সম্পর্কে কোন খোঁজখবর রাখতে পারেননি অথবা শত্রুদের ক্ষতির হাত
থেকে নিজেদের রক্ষা করে রাজপুত্র দান্তা ও রাজকন্যা হেমলতা পবিত্র দন্তধাতুটিকে
শ্রীলঙ্কায় আনতে দীর্ঘ সময় নিয়েছিলেন। প্রথমটি সম্পর্কে বলা যায় খ্রীঃ পূঃ ৩য় ও
৪র্থ শতাব্দীতে শ্রীলঙ্কা ও ভারতবর্ষের মধ্যে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক যোগাযোগের প্রমাণ
রয়েছে।
চৈনিক ইতিবৃত্তে রাজা মহাসেনের
শ্রীমেঘবর্ণের সঙ্গে মগধের রাজা সমুদ্রগুপ্তের কূটনৈতিক যোগাযোগের ইঙ্গিত রয়েছে।
এটি বলা যেতে পারে মহাবোধির দিকে অগ্রসর হওয়া সেই সমস্ত শ্রীলঙ্কাবাসী তীর্থযাত্রীদের
দ্বারা তীর্থযাত্রীদের বিশ্রামাগার নির্মিত হয়েছিল। এই পর্বের সংস্কৃত ভাষায় রচিত
বুদ্ধগয়া লিপিতে সেই সমস্ত ভিক্ষুদের নাম পাওয়া যায় যাঁরা বুদ্ধগয়ায় বসবাস করতেন।
রাজা সমুদ্রগুপ্ত এত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন যে তিনি তাঁর এলাহাবাদ
প্রশস্তি লিপিতে শ্রীলঙ্কার উল্লেখ করেছেন।
এই বিষয়টি আমার এটি চিন্তা করতে সাহায্য
করে যে শ্রীমেঘবর্ণের আচরণ এই ইঙ্গিত করে রাজা মহাসেন এই বিষয়টি (পবিত্র দন্ত
ধাতুর আগমন) নিয়ে কি কি কর্মকান্ডের আয়োজন করতেন। এটি সুবিদিত যা রাজা মহাসেন তাঁর
যৌবন একজন ভারতীয় শিক্ষা সঙ্ঘমিত্রর অধীনে অধ্যয়ন করেছিলেন। রাজা মহাসেন মহাযান ধর্ম
গ্রহণ করেছিলেন এবং এই সম্পর্কের কারণে মহাবিহার গোষ্ঠীর উপর রাজা মহাসেন কর্তৃক
অনেক অবিচার সংঘটিত হয়েছিল। এটি সেই বিশেষ পক্ষপাতিত্বের কথা বলে যা রাজা মহাসেন
কর্তৃক অভয়গিরি গোষ্ঠীর প্রতি প্রদর্শিত হয়েছিল। যে বিষয়টি এই অনুমানকে সমর্থন করে
যে রাজা মহাসেন যখন জীবিত ছিলেন তখনই পবিত্র দন্তধাতুটি শ্রীলঙ্কায় পাঠানোর
কর্মসূচী নেওয়া হয়েছিল সেটি হল যে পবিত্র দন্তধাতুটিকে অভয়- গিরিতে নিয়ে যাওয়ার
জন্য রাজা মহাসেন এক আদেশ জারী করেছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে, পবিত্র দন্তধাতুটিকে নিয়ে যাওয়া
উচিত ছিল মহাবিহারে। মহাবিহারের ভিক্ষুরা পবিত্র দন্তধাতুটিকে অধিকতর মনোযোগ দেননি
বলে মনে হয়। এই যুক্তির উপর নির্ভর করে দন্তধাতুর অভিভাবকত্বকে দূরে রাখা যে
দন্তধাতুর আভিভাবকত্ব ছিল উত্তরমালা বিহার গোষ্ঠীর অর্থাৎ অভয়গিরি বিহারের অধীনে
তাহলে রাজা শ্রীমেঘবর্ণ রাজা মহাসেনের ইচ্ছা অনুসারেই কাজ করেছিলেন। যদিও রাজা
মহাসেন মহাবিহারের প্রতি তাঁর সমস্ত অবিচারের ক্ষতিপূরণ দিয়েছিলেন এবং মহাবিহারের
প্রতি বিশ্বস্ত হিসেবে কাজ করেছিলেন, তথাপি শ্রীমেঘবর্ণের দ্বারা পবিত্র দন্তধাতুর অভিভাবকত্ব অভয়গিরি
বিহারের হাতে তুলে দেওয়া এই পরিস্থিতিরই ইঙ্গিত দেয়। অতএব এটি স্পষ্ট যে রাজা
মহাসেন এবং বৈতুল্যবাদীদের মধ্যে এক শক্তিশালী সম্পর্কের অস্তিত্ব ছিল। এই পর্বে
মহাযান বৌদ্ধধর্ম অন্ধ্রদেশে অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল। এটি ঐতিহাসিকদের বিশ্বাস যে
শ্রীলঙ্কা ও অন্ধ্রদেশের মধ্যে এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল এবং সেই সময়ে অন্ধ্রদেশের
প্রভাব শ্রীলঙ্কার ভাস্কর্যকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল।
এগুলি থেকে আরও জানা যায় যে শ্রীলঙ্কার
শিল্পীদের সঙ্গে অমরাবতী শিল্প সম্প্রদায়ের বিশেষ সম্পর্ক বজায় ছিল। অধ্যাপক
পরাণবিতানের মতে এক বিশেষ ধরণের পাথর কিছু ভাস্কর্য খোদাইয়ের জন্য অমরাবতী এলাকা
থেকে আমদানী করা হয়েছিল। একটি প্রস্তর লিপি আবিষ্কৃত হয়েছে যেটি ঘোষণা করেছে যে মহাবিহারের
অধীনে পাঁচটি প্রধান বিহারের বাসিন্দা ভিক্ষুরা নিয়মভঙ্গ করেছেন। এমনকি যে পাথরের
চাঁইয়ের উপর এই লিপিটি খোদাই করা হয়েছে
অধ্যাপক পরাণাতানের মধ্যে সেটি আমদানী করা হয়েছে অমরবতী অঞ্চল থেকে। এই পর্বে নাগার্জুনকোন্ডা ছিল একটি বিখ্যাত
বৌদ্ধ কেন্দ্র। এক শতাব্দী পর ভদন্ত বুদ্ধঘোষ এই অঞ্চল থেকে শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিলেন।
খ্রীষ্টীয় ৪র্থ ও ৫ম শতাব্দীর নাগার্জুনকোন্ডায় আবিষ্কৃত অনেকগুলি লিপিতে
শ্রীলঙ্কার উল্লেখ রয়েছে। উপরিউক্ত বিষয়গুলি বিবেচনা করে এই বিষয়টিকে অস্বীকার করা
সম্ভব নয় যে দাঠাবংশের তথ্য অনুযায়ী রাজা মহাসেন ও কলিঙ্গের মধ্যে পারস্পরিক
সম্পর্ক বর্তমান ছিল।
পবিত্র দন্তধাতু শ্রীলঙ্কায় আনীত হয়েছিল
খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে। দাঠাবংশ রচিত
হয়েছিল খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ এবং এয়োদশ শতাব্দীতে। পবিত্র দন্তধাতু এসে পৌঁছনোর
আট শতাব্দী পরে রচিত একটি গ্রন্থে খ্রীষ্টীয় ৪র্থ শতাব্দীতে কলিঙ্গ ও শ্রীলঙ্কার
সম্পর্ক বিষয়ক তথ্য কতখানি যথার্থ হতে পারে সে বিষয়ে কেউ কেউ সন্দেহ করতে পারেন।
কিন্তু আমাদের একথা ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে দাঠাবংশ অন্যান্য ইতিবৃত্তের মতই
প্রাচীন সূত্রের উপর ভিত্তি করে রচিত। লেখক স্বয়ং ঘোষণা করেছেন যে দাঠাবংশের
তথ্যগুলি গৃহীত হয়েছে প্রাচীন সিংহলদেশীয় কবিদের দ্বারা রচিত পূর্ববর্তী একটি রচনা
জিনদন্ত ধাতুবংশ গ্রন্থ থেকে।৯
মহাবংশের পবিত্র দন্তধাতুর উপর রচিত একটি
পূর্ববর্তী ইতিবৃত্তের উল্লেখ রয়েছে। মহাবংশ থেকে ইঙ্গিত মেলে যে দাঠাবংশে
উল্লেখিত পদ্ধতি অনুসারেই শ্রীমেঘবর্ণ পবিত্র দন্তধাতুর প্রতিসম্মান প্রদর্শন
করেছিলেন।১০ এর
থেকে মনে হয় অন্তত যে সময়ে এই ঘটনাটি
মহাবংশে লিখিত হয়েছে সে সময়ে দাঠাধাতুবংশের অস্তিত্ব ছিল। এই অনুসারে কলিঙ্গ ও
মহাসেনের মধ্যে যে সম্পর্ক বর্তমান ছিল তাকে শুধুমাত্র ত্রয়োদশ শতাব্দীর
একগ্রন্থের অনির্ভরযোগ্য বিবৃতি বলে মনে করা ঠিক নয়। এটিকে মনে করা উচিত একটি
প্রতিবেদন হিসেবে যা পুরনো সংঘরাম ও বিহারে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য প্রমাণের
অন্তর্গত।
যখন মহাবংশ পবিত্র দন্তধাতু শ্রীলঙ্কায়
নিয়ে আসার ঘটনা বর্ণনা করেছে, এর মধ্যে শ্রীমেঘবর্ণের রাজত্বকালের প্রধান
ঘটনাগুলিরও বিবরণ আছে, যার বর্ণনা দাঠাবংশেও পাওয়া যায়। এই দুটি গ্রন্থের কিছু
কিছু ঘটনা আছে যথা সেই স্থানটিতে যেখানে অনুরাধাপুরে আগমনের পর দন্তধাতুটিকে রাখা
হয়েছিল, অভয়গিরির হাতে দন্তধাতুটিকে তুলে দেওয়া, পবিত্র দন্তধাতুর বাৎসরিক
শোভাযাত্রা এবং দন্তধাতুর ক্ষেত্রে যে পূজা-শ্রুজা-সম্মান অনুসরণ করতে হবে তার
সম্পর্কে রাজা মেঘবর্ণ দ্বারা প্রচারিত ব্যক্তিগত আদেশনামা। মহাবংশের প্রতিবেদনটি
সংক্ষিপ্ত, ক্যেক্তি স্তবকের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
দাঠাবংশে বর্ণিত মূল ঘটনাগুলির মহাবংশে
অন্তর্ভুক্তি দাঠাবংশের বর্ণনাকে বিশ্বাসযোগ্যতা দান করে। মহাবংশে লিপিবদ্ধ আছে যে
জনৈক ব্রাক্ষ্মণ মহিলা দ্বারা পবিত্র দন্তধাতুটি শ্রীলঙ্কায় আনীত হয়, দাঠাবংশ
ঘোষণা করে যে রাজা গুহাশিবের কন্যা হেমমালা তাঁর স্বামীর সঙ্গে পবিত্র দন্তধাতুটিকে
শ্রীলঙ্কায় নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও মহাবংশ ও দাঠাবংশের বিবরণের মধ্যে
কিছু তাৎপর্য্যপূর্ণ পাথর্ক্য রয়েছে।
যদিও মহাবংশ ও দাঠাবংশ উভয় গ্রন্থেই লিখিত
আছে যে পবিত্র দন্তধাতুটি শ্রীলঙ্কায় আনীত হয়েছিল রাজা শ্রীমেঘবর্ণের রাজত্বকালে
কিন্তু এই ঘটনার কারণটি উল্লিখিত হয়েছে একমাত্র দাঠাবংশে। মহাবংশ এই বিষয়ে
সম্পূর্ণ নীরব। এই কারণে কয়েকজন সমালোচক দাঠাবংশে বর্ণিত রাজা গুহাশিব ও রাজা
ক্ষীরধারার মধ্যেকার যুদ্ধকে বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে মনে করেন।
কেন মহাবংশে পবিত্র দন্তধাতুর শ্রীলঙ্কায়
আগমনের পূর্ববর্তী ঘটনাগুলি উল্লিখিত হয়নি? এই প্রসঙ্গে আমরা দুটি উত্তর খুঁজে
পেতে পারি।
এর মধ্যে একটি ঐতিহ্যবাহী। এর থেকে জানা
যায় যে মহাবিহার সম্প্রদায়ের লেখকেরা যাঁরা মহাবংশ রচনা করেছিলেন তাঁরা পবিত্র
দন্তধাতুটি অভয়গিরি সম্প্রদায়ের অভিভাবকত্বে ছিল এই তথ্যে। কিন্তু এই উত্তরের
দুর্বলতা রয়েছে এই তথ্যে যে এটি যুক্তিসঙ্গত নয় যেহেতু সমস্ত সম্ভাব্য জায়গাতেই
দন্তধাতুর বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।
দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি হল এই যে মহাবংশের
লেখকরা মনে করেছিলেন যে ঘটনাবলী পবিত্র দন্তধাতুটির ভারতবর্ষ থেকে শ্রীলঙ্কায় যাওয়ার
কারণ হয়েছিল সেগুলির উল্লেখ যথাযথ নয় কারণ রাজা গুহাশিব ও রাজা ক্ষীরধারার যুদ্ধ
ভারতবর্ষের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত। সম্ভবতঃ এই যুদ্ধ অনেক বছর ধরে চলেছিল। দাঠাবংশ
কেবলমাত্র যে এইযুদ্ধ বর্ণনা করেছিল তাই নয় একই ধরণের আরও যুদ্ধের বর্ণনা দিয়েছিল
যাতে পবিত্র দন্তধাতু রক্ষক কলিঙ্গ রাজাবংশ অংশগ্রহণ করেছিল। এই সমস্ত ঘটনা
ভারতবর্ষের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। মহাবংশ শ্রীলঙ্কার ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত।
মহাবংশ শ্রীলঙ্কার ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। শ্রীলঙ্কার কোন রাজা যদি বিদেশী কোন
রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করে থাকেন বা কোন বিদেশী শক্তি যদি শ্রীলঙ্কা আক্রমণ করে তাহলে
তার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া মহাবংশের রচয়িতার দায়িত্ব। সম্ভবত রচয়িতার এই বিষয়ে দৃঢ়
ধারণা ছিল অন্যদেশের যুদ্ধের বিষয়ে বর্ণনা করা তাঁর অধ্যয়নের বা রচনার ক্ষেত্রে
প্রাসঙ্গিক নয়।
এছাড়া আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় আছে যেটিকে
আমাদের করা উচিত যে মহাবংশের দ্বিতীয় অংশ যার অন্তর্গত হল মেঘবর্ণের রাজত্বকাল
রচিত হয়েছিল খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে এবং যা সাধারণত স্বীকার হয় সেই খ্রীষ্টীয়
এয়োদশ শতকে নয় বলে ঐতিহাসিকদের মধ্যে ঐক্যমত্য হয়েছে। খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতকের
মধ্যে শ্রীলঙ্কার সাহিত্যে একটি নতুন প্রবণতা পরিলক্ষিত হতে শুরু করে অর্থাৎ
পৃথকভাবে প্রতিটি আরাধনার স্থান এবং পবিত্র বস্তুর উপর গ্রন্থ রচনা। অবশিষ্ট দুটি
পালিগ্রন্থ মহাবোধিবামা এবং ধাতুবংশ খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতকের থেকে বেশী প্রাচীন।
অন্যান্য ইতিবৃত্ত যথা থূপবংশ, দাঠাবংশ এই
ঘোষণা করে তাদের উৎস হল মূল সংস্কৃত গ্রন্থ। অতএব এটি সুস্পষ্ট অনেকগুলি সিংহলীয়
গ্রন্থ ছিল যা এই পালি গ্রন্থগুলির উৎস ছিল যা বর্তমানে অস্তিত্বশীল এবং এদের
অধিকাংশই খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দী থেকে প্রাচীনতর। এর অর্থ হল এই যে সিংহলী ভাষায়
রচিত একটি দাঠাবংশের অস্তিত্ব ছিল সেই সময়ে যখন মহাবংশের দ্বিতীয় অংশ রচিত হচ্ছিল।
মহাবংশের রচয়িতা এই বিষয়টি জানতেন যে পবিত্র দন্তধাতু বিষয়ক সমস্ত প্রাসঙ্গিক তথ্য
সিংহলীয় দাঠাবংশে বর্ণিত হয়েছে। তিনি মনে করতেন তাঁর রচনায় এই বিস্তারিত বিবরণগুলি
অন্তর্ভুক্ত করা অপ্রাসঙ্গিক হবে।
দাঠাবংশে সিংহলীয় রাজবংশের তিনজন রাজা
যথা মহাসেন, কীর্তিশ্রী মেঘবর্ণ ও বুদ্ধদাসের নাম মহাবংশে প্রদত্ত হয়েছে। এঁদের
মধ্যে বিস্তারিত বিবরণ প্রদত্ত হয়েছে কীর্তিশ্রী মেঘবর্ণের সম্পর্কে। মহাসেন
সম্পর্কে একথা বলা হয়েছে যে তিনি কলিঙ্গদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন
এবং অসুস্থতার কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। দাঠাবংশের সর্বশেষ স্তবকের পূর্বেকার
স্তবক বুদ্ধদাসের নাম উল্লেখ করে এবং এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছে যে তাঁকে নিয়ে আরও
কয়েকজন রাজা পবিত্র দন্তধাতুতে অর্ঘপ্রদান করেছিলেন।১১
রাজা কীর্তিশ্রী মেঘবর্ণের উত্তরসূরী
বুদ্ধদাস নন অন্য কোন রাজা ছিলেন। কেন দাঠাবংশ রাজা মেঘবর্ণের ঠিক পরবর্তী উত্তরসূরীকে
অবহেলা করে তার পরবর্তী রাজার নাম উল্লেখ করেছে তা জানা সম্ভব নয়। যাই হোক,
দাঠাবংশের শেষ দুটি স্তবক পরে সংযোজিত করেছিল বলে মনে হয় যেহেতু তাদের অনুবাদ
সিংহল দালাদ সিরিয়ায় দেখা যায় না। এই দাঠাবংশকে রাজা কীর্তিশ্রী মেঘবর্ণের
রাজত্বকালের সঙ্গে যুক্ত একটি ইতিবৃত্ত হিসেবে চিহ্নিত করা সঠিক কারণ এই
রাজত্বকালে সম্পর্কিত এই গ্রন্থের তথ্যগুলি মহাবংশদ্বারা সমর্থিত হয়েছে। শ্রীলঙ্কার
ইতিহাসে একটি বিশ্বাসযোগ্য সূত্র হিসেবে দাঠাবংশের মূল্যায়ণ করা সম্ভব। কিন্তু
একটি ঐতিহাসিক সমস্যা আছে যার মুখোমুখি দাঠাবংশের ছাত্র হতে পারেন। সেটি হল
ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্পর্কে দাঠাবংশের বিবরণ কতখানি বিশ্বাসযোগ্য।
এটি স্বীকৃত যে পবিত্র দন্তধাতুটিকে শ্রীলঙ্কায়
নিয়ে আসা হয়েছিল খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতকে। দাঠাবংশে ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্পর্কে
প্রায় এক হাজার বছরের তথ্য রয়েছে। ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্পর্কিত অনেকগুলি ঘটনা
দাঠাবংশে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যেমন কলিঙ্গে অরহন্ত ক্ষেমা কর্তৃক পবিত্র দন্তধাতু
দাঠাপুরার রাজা ব্রক্ষ্মদত্তকে প্রদান এবং তাঁকে সত্য ধর্মে বিশ্বাসী করে তোলা,
সংক্ষেপে গুহাশিব পর্যন্ত কলিঙ্গ রাজবংশের নামোল্লেখ, নিগ্গন্থদের প্রতি গুহাশিবের
বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা, অতঃপর গুহাশিব কর্তৃক মন্ত্রিগণ কর্তৃক অবগত হয়ে পবিত্র
দন্তধাতুর শোভাযাত্রা দর্শন, বুদ্ধ শাসনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও নিগ্রন্থদের
নির্বাসনদান, নিগ্রন্থদের পাটলিপুত্র পর্যন্ত গমন, সেখানে বসবাসরত রাজা পাণ্ডুর
সমর্থন লাভ, রাজা গুহাশিবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য একজন আঞ্চলিক নেতা
চিত্রায়ণের সঙ্গে আলোচনা, পড়ে রাজা চিত্রায়ণ কর্তৃক বুদ্ধ শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা
প্রদর্শন, পবিত্র দন্তধাতুর শোভাযাত্রা দর্শন এবং বুদ্ধের কাছে আশ্রয়তিক্ষা,
পাণ্ড্য রাজার আমন্ত্রণে পবিত্র দন্তধাতুটি নিয়ে পাটলিপুত্রে গমন, পাণ্ড্য রাজার
ত্রিরত্নে আশ্রয় প্রার্থনা এবং পবিত্র দন্তধাতুর পূজা, ক্ষীরধারা নামক এক রাজার
পাণ্ড্য রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অগ্রসর হওয়া, রাজা গুহাশিব কর্তৃক পবিত্র
দন্তধাতুটি কলিঙ্গ দহে স্থানান্তর করা, হেমমালা ও রাজপুত্র দন্তর বিবাহ ও গুহাশিব
এবং ক্ষীরধারার যুদ্ধ।
দাঠাবংশ খ্রীঃ পূঃ ৬ষ্ঠ স্তকের কাশীরাজ
ব্রক্ষ্মদত্তের কথা উল্লেখ করেছে এবং তার আরও অনেক রাজার পর গুহাশিব নামক এক রাজা
ও মগধের দুজন রাজার নাম উল্লেখ করেছে। এর মধ্যে একজন পাণ্ডুও অপরজন তাঁর পুত্র।
যেহেতু এই দুজন রাজাগুহাশিবের সমসাময়িক, এটি সিদ্ধান্ত করা সহজ যে তাঁরা খ্রীষ্টীয়
চতুর্থ শতাব্দীতে বর্তমান ছিলেন। দাঠাবংশ এই শতকের আরও দুজন রাজার নাম উল্লেখ
করেছে। এর মধ্যে একজন চিত্রায়ণ। একথা বলা হয়েছে যে তিনি পান্ডুর অধীনস্থ একজন
আঞ্চলিক রাজা ছিলেন। অপর হলেন ক্ষীরধারা। দাঠাবংশে এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই যে
তিনি কোন রাজ্যের শাসনকর্তা ছিলেন। তিনি রাজা পাণ্ডুর সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন।
দাঠাবংশে খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে উজ্জ্বয়িনী থেকে শাসনরত এক ব্যক্তির নাম
উল্লেখ করেছে। কিন্তু তাঁর নাম উল্লেখিত হয়নি। রাজপুত্র দাঠা ছিলেন তাঁর পুত্র।
ক্ষীরধারা পবিত্র দন্তধাতুর অভিভাবকত্ব দাবী করে যুদ্ধ ঘোষণা করেননি করেছিলেন তাঁর
ভ্রাতুষ্পুত্র।
উপরের আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে
দাঠাবংশের বিবরণীতে বিভিন্ন অঞ্চলের রাজা ও রাজবংশের নাম অনুপস্থিত। অন্য কোন সূত্র
থেকেও কোন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না এটি অত্যন্ত আশ্চর্যজনক। যখন রাজা শ্রীমেঘবর্ণ
লঙ্কায় রাজত্ব করছিলেন রাজা সমুদ্রগুপ্ত তখন ভারতবর্ষের মগধের রাজা ছিলেন। উপরে
ইঙ্গিত করা হয়েছে রাজা শ্রীমেঘবর্ণ তাঁর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতেন।
গুপ্ত রাজবংশ দীর্ঘ সময় ধরে ভারতবর্ষে রাজত্ব করেছিল। দাঠাবংশ অনুসারে রাজা মহাসেন
ও রাজা শ্রীমেঘবর্ণের সমসাময়িক পাটলিপুত্রের রাজা ছিলেন পাণ্ডু। গুপ্ত রাজবংশের
রাজাদের নামের তালিকায় এরকম কোন রাজার নাম নেই। এমনকি ‘পাণ্ডু’ উত্তর ভারতের কোন
রাজার নামের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে না এটি দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে জড়িত। এটি উপরে
ইঙ্গিত করা হয়েছে যে দাঠাবংশে রয়েছে ক্ষেমা নামক একজন অরহৎ বুদ্ধের চিতা থেকে
পবিত্র দন্তধাতুটি তুলে নিয়ে সেটির দায়িত্ব আরোপ করেছিলেন কলিঙ্গের রাজা
ব্রক্ষদত্তের উপর।
ত্রিপিটক বিভিন্ন স্থানে ভারতবর্ষের
বিভিন্ন স্থানে শাসনরত বিভিন্ন রাজার নাম উল্লেখ করেছে। মহাপরিনিব্বান সুত্তে সেই
রাজাদের নামের তালিকা পাওয়া যায় যাঁরা বুদ্ধের চিতাভস্ম দাবী করেছিলেন। কিন্তু কোন
জায়গাতেই ব্রক্ষদত্ত নামে কোন রাজার নামোল্লেখ নেই। অপরপক্ষে দাঠাবংশ অনুসারে এই
রাজা ছিলেন একজন অবিশ্বাসী। এই বিষয়টি চিন্তা করা অত্যন্ত কঠিন যে কেন একজন
অবিশ্বাসী রাজার তত্ত্বাবধানে পবিত্র দন্তধাতুটি দান করা হয়েছিল যখন এতজন বিশ্বাসী
শাসক কাছাকাছি ছিলেন। বুদ্ধের পরিনির্বানের মাত্র ১/২ শতাব্দী পরে কলিঙ্গর ইতিহাস মগধের ইতিহাসের
সঙ্গে একত্রিত হয়ে যায় সম্রাট অশোক দ্বারা কলিঙ্গ অধিকারের মধ্যে দিয়ে।
আমরা দাঠাবংশে প্রাপ্ত নামের তালিকা ও
ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রতি আমাদের মনোযোগ ফেরাব। গুহাশিব, পাণ্ডু, চিত্রায়ণ,
ক্ষীরধারা, হেমমালা ও রাজপুত্র দাঠা এই নামের তালিকার দিকে মনোযোগ দিলে আমরা দেখতে
পাই গুহাশিবের নাম প্রাচীন সাহিত্যের কাহিনীতে পাওয়া যায় এবং হেমমালা ও রাজপুত্র
দাঠা বাস্তবের মানুষের মন তাঁদের পবিত্র দন্তধাতুর কাহিনীর জন্য সৃষ্টি করা
হয়েছিল।
সম্ভবত গল্পের কথক সেই রাজকুমারী যিনি
তাঁর বেণীতে করে লুকিয়ে পবিত্র দন্তধাতু নিয়ে এসেছিলেন বলে বিশ্বাস তাঁকে হেমমালা
এবং যিনি তাঁকে বিবাহ করেছিলেন তাঁকে দাঠা নামকরণ করেছেন। দাঠাপুরা কোন ঐতিহাসিক
এলাকা নয়, একটি একজন কবির দ্বারা দেওয়া নাম। ক্ষেমা নামে একজন অরহৎ পবিত্র
দন্তধাতুটি রাজা ক্ষেমের তত্ত্বাবধানে দিয়েছিলেন বলে প্রকাশ। যদিও বৌদ্ধধর্মের
বিভিন্ন গ্রন্থে হাজার হাজার ভিক্ষুর নাম পাওয়া যায়। কিন্তু ক্ষেমা নামতি সেখানে
পাওয়া যায় না, কিন্তু ক্ষেমা নামে এক অর্হতের সম্পর্কে তথ্য সেখানে পাওয়া যায়।
ধাতু পূজার ধারণার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশঃ
ধাতু পূজার ধারণার বর্ণনা পাওয়া যায় দীঘ
নিকায়ের মহাপরিনিব্বাণ সুত্তে। যে সময়ে এটি লিপিবদ্ধ হয়েছিল সেকথা চিন্তা করে ধাতু
পূজা যে বুদ্ধ কর্তৃক অনুমোদিত প্রর্দশনের উপায় হিসেবে ছিল সেকথা বলা সম্ভব নয়। বৌদ্ধদের
মধ্যে প্রথাগত শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ব্যবস্থার বিস্তৃতির সঙ্গে বুদ্ধ সমাজে ধাতু
পূজা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকবে, যা ঘটেছিল বুদ্ধের মহাপরিনিব্বানের বহুবছর পর।
যখন আটটি রাজ্যের রাজারা বুদ্ধের অস্থির অধিকারের দাবী নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিবাদ
করছিলেন তখন দ্রোণ নামে একজন ব্রাক্ষণ এগিয়ে এসেছিলেন এবং তাঁদের সকলের মধ্যে
অস্থিগুলি সমানভাবে ভাগ করে দিয়েছিলেন। যাঁরা এই অস্থিগুলি নিয়ে তার উপর স্তুপ
রচনা করেছিলেন। আরও দুটি স্তুপ নির্মিত
হয়েছিল সেই পাত্রের উপর যার দ্বারা ধাতুগুলি বিতরিত হয়েছিল।
মহাপরিনিব্বান সুত্তের সর্বশেষ স্তবকগুলি
অনুসারে ভারতবর্ষে ৭(নালি) ও রামগ্রামে এক নালি পরিমাণ ধাতু রাজাদের দ্বারা পূজিত
হত। একটি পবিত্র দন্ত তাবতিংশ স্বর্গে, একটি গান্ধার নগরে, একটি কলিঙ্গ দেশে এবং
অপর একটি নাগদের বাসস্থানে পূজিত হত। দেবতারা ৪০টি পবিত্র দন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন,
প্রত্যেকে একটি করে কেশ ও দেহলোম নিয়েছিলেন।
একা হি দাঠা তিদিবেহি পূজিতা-একা পন
গন্ধারপুরে মহীয়তি
কলিঙ্গরঞে্ঞা বিজিতে পুনেকং একং পুন
নাগরাজা মহেন্তি।
চত্তালীস সমা দন্তা-কেস-লোম চ সব্বাসো
দেবা হিরিংসু একেকং চক্কবাল পরংপরা।
-
মহাপরিনিবানসুত্ত
ধাতু পূজার গবেষণায় এটি অত্যন্ত
তাৎপর্য্যপূর্ণ যে ‘ধাতু’ এই প্রিভাসাতি মহাপরিনিব্বান সুত্তে অনুপস্থিত, বুদ্ধের
অবশিষ্ট অস্থিগুলিকে ‘শরীরাণি’ বা ‘শরীরম্ ভাগম্’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে।(তেননি
ব্রাহ্মণ ত্বন্নেব ভগবতো শরিরানি অত্থধ সমং সুবিভজহি।) এই বাক্যগুলি থেকে প্রমাণিত
হয় এগুলি রচনার সময়েও ধাতুপূজা পরিণতি লাভ করেনি। অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল
ব্রাহ্মণ দ্রোণ কর্তৃক ধাতু বিতরণের সময় দন্তধাতুটির উল্লেখ না করা। এই ঘটনার গদ্য
সংস্করণে দেখা যায় সমস্ত অবশিষ্ট অস্থি কেবলমাত্র নালী যেটি ছাড়া ব্রাহ্মণ দ্রোণ
কর্তৃক পরিমিত অংশের অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। যদি এই স্তবকগুলিকে যথেষ্ট বলে মনে করা
হয় তাহলে এই মতটিই প্রতিষ্ঠিত হয়।
দাতাবংশে এই ধারণা প্রকাশিত হয়েছে যে যখন
বুদ্ধের দেহাবশেষ চিতায় দাহ হচ্ছিল তখন কিছু কিছু অংশ ছাড়িয়ে পড়ে, কিন্তু
মহাপরিনিব্বাণ সুত্তে এটির উল্লেখ করা হয়নি।
৪৭। ধাতুয়ো অবসিস্সিনসু-মুত্তাভা কাঞ্চনপ্পভা
আধিট্টানেন বুদ্ধস্স উপ্পকিন্ননেকধা
৪৮। উনহিসং আকখকা দ্বে চ-চতস্সো দন্তধাতুয়ো
ইচ্ছেতা ধাতুয়ো সত্ত-বিপ্পাকন্না
ন সথ্থুনো।–দাঠাবংস।
মহাপরিনিব্বান সুত্তে
কেবলমাত্র একথা বলা হয়েছে যে আনুষ্ঠানিক দাহকার্যের পর, শরীরের কিছু অংশ থেকে
গিয়েছিল। সম্ভবতঃ এটির অর্থ হল ছাই ও কিছু ধাতুর সঙ্গে রয়ে গিয়েছিল। এই শব্দবন্ধটি
ব্যাখ্যা করে সুমঙ্গলবিলাসিনীতে মন্তব্য করা হয়েছেঃ ‘পূর্বে অস্থিগুলি ঘনসন্নিবদ্ধ
ছিল। কিন্তু এখন এগুলি ছড়িয়ে পড়েছে। অতএব এখন এগুলিকে দেহাংশ(সরীরাণি) বলা যেতে
পারে। অবশিষ্ট ধাতু গুলি ছিল জুঁই ফুল এবং সাদা মুক্তো। বুদ্ধ ইচ্ছা প্রকাশ
করেছিলেন, “আমার ধর্ম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েনি তাই আমার মৃত্যুর পর সাধারণ মানুষ আমার
ধর্মের সামান্য পরিমাণ লাভ করুক(সরিষা বীজের পরিমাপের), তাদের বাসস্থানে স্তূপ
নির্মাণ করুক এবং স্বর্গে পৌঁছুক”। এইভাবে বুদ্ধ ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন যে ধাতুগুলি
সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ুক। যখন সাতটি পবিত্র ধাতু যেমন চারটি পবিত্র দন্ত, দুটি চোয়াল
অস্থি এবং উন্হিস ছড়িয়ে পড়েনি। অবশিষ্ট ধাতুগুলি ছড়িয়ে পড়েছিল। এগুলির মধ্যে
ক্ষুদ্র ধাতুগুলি ছিল সরিষার বীজের মত। বৃহৎধাতুগুলি ছিল চালের দানার মত, যা
মাঝখানে ভাষা ছিল। এই মতামত সুত্তনিপাতেও প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে সমস্ত
ধাতু ছড়িয়ে পড়িয়ে পড়েছে। এই অনুসারে এই ধারণা জন্মায় যে দাহ করবার পর ছাই ও কয়েকটি
ধাতু রয়ে যায়। পরবর্তীকালে, বুদ্ধের দেহের কোন কোন অংশ থেকে গিয়েছিল যথাস্থানে এই
ধারণা প্রচলিত হওয়ায় চারটি পবিত্র দন্ত বিষয়ক স্তবকটি অন্তর্ভুক্ত হয়। এটি অনুমান
করা যায় যে সিংহলদেশীয় ভিক্ষুদের দ্বারা এই স্তবকগুলি যুক্ত হয়েছিল।
যখন ভদন্ত আনন্দ ভগবান বুদ্ধকে এই বিষয়ে
জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে মহাপরিনিব্বানের পর বুদ্ধের দেহ কোথায় দাহ করা হবে, তখন
বুদ্ধ উত্তর দিয়েছিলেন একজন রাজ চক্রবর্তী মতই দাহ করবার পর তাঁর দেহাবশেষ একটি
স্তূপে স্থাপন করা উচিত যেটি চারটি রাস্তার সংযোগস্থলে নির্মিত হবে এবং সাধারণ
মানুষের কাছে দৃশ্যমান হবে। এই নির্দেশ অনুসারে একটিমাত্র স্তূপ নির্মাণ করা যাবে।
যারা বিশ্বাসী তারা এই দাহস্থানে এসে প্রচন্ড দুঃখ অনুভব করে এবং এই স্থান থেকে
ভস্ম নিয়ে যায়। এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক। পরবর্তীকালে, যাঁরা এই ধরনের বা ভাষ্য
গ্রন্থ রচনা করেছেন তাঁরা এই স্বাভাবিক ঘটনাটিকে অতিরঞ্জিত করে থাকবেন। এর ফলে পূর্বে
উল্লিখিত উপকাহিনীর রচিত হয়েছে বলে মনে করা হয়।
কপিলাবস্তুতে প্রত্নতাত্বিক খননে
প্রাপ্ত শাক্যদের একটি স্তূপে এই বিবৃতিটি রয়েছে, “ইয়ং সলিলনিধনে বুধস ভগবত শক্যানং
সুকিতিভতনং সভগিনিকনং সপুত দলনং”। মন্দিরের মধ্যে স্থাপন করা বুদ্ধের শরীরের এই
অংশ শাক্যদের অধীন, এদের অন্তর্গত হল তাদের বিশ্বাসী ভ্রাতা, ভগিনী ও তাদের
বংশধররা। এটিই কি সেই স্তূপ যেটি বুদ্ধের বিবৃতি অনুসারে নির্মিত হয়েছিল।এটি
অত্যন্ত স্বাভাবিক যে আত্মীয়রা দগ্ধ দেহাবশেষকে সঞ্চিত করে রাখবেন (‘শরীরাণি’
শব্দটির সঙ্গে ‘সলীনিধন’ শব্দটির সামঞ্জস্য রয়েছে)। এটি স্পষ্ট যে সেই সময়ে ও
ধাতুপূজার প্রচলন ছিল না। সেই কারণে এটি ধারণা করা সম্ভব যে এটি সেই স্তূপ যেখানে
বুদ্ধের দাহস্থানে যে ভস্ম ও অস্থির যে অবশেষ পাওয়া গিয়েছিল তা রক্ষিত হয়েছিল।
ধাতুপূজার ধারণার উৎপত্তিঃ
‘বুদ্ধবংশ’এ ধাতুগুলিকে
ভাগ করে দেওয়ার যে বর্ণনা রয়েছে তা মহাপরিনিব্বান সুত্তের সঙ্গে মেলে। প্রতিটি
নগরের বাসিন্দাই বুদ্ধ দ্বারা ব্যবহৃত সমস্ত প্রয়োজনীয় দ্রব্য যথা যষ্ঠি, ছাকনি,
কেদারা, বিছানার দ্রব্য, ক্ষুর ধারালো করবার পাথর, সুঁচ ইত্যাদি নিয়েছিল এবং তাদের
প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছিল। বুদ্ধবংশের এই বিবরণ অনুসারে তারা ধাতুপূজার
বিস্তারের কথা বলে।
এর থেকে এটি স্পষ্ট যে ধাতু পূজার ধারণা
বুদ্ধবংশ রচনার সময় এত শ্রদ্ধা লাভ করেছিল যে এটি বলা হয়েছে বুদ্ধের কপালের
মধ্যস্থলের কেশ বুদ্ধের চিতায় স্থান পরিবর্তন করেনি। সুমঙ্গলবিলাসিনী সূ্ত্রে বলা
হয়েছে যে ধাতু সমূহ বিতরণকারী দ্রোণ দক্ষিণ দন্ত ধাতুকে তাঁর উষ্ণীষের মধ্য গোপন
করেছিলেন, এটিকে স্বর্গে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং সিলুমিনি স্তূপে স্থাপন করেছিলেন।
এই অজাতশত্রুর শাসনকালে ধাতু পূজার যে
সমারোহ অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা এখানে বর্ণিত হয়েছে। এটি আরও বলে রাম গ্রামে প্রেরিত
ধাতু নাগদের দ্বারা রক্ষিত হয়েছিল এবং এই ধাতুগুলি রক্ষিত হয়েছিল মহাযুগে
ভবিষ্যতের কোন একটি দিনে এবং ভদন্ত মহাকাশ্যপ থের রাজা অজাতশত্রুকে অন্যান্য
ধাতুগুলিকে একটি বিশেষ স্থানে স্থাপন করতে অনুরোধ জানান। প্রতিটি ধর্মেই সাধারণ
মানুষের বিশ্বাসের উপযোগী কাহিনী উদ্ভাবন করা হয়ে থাকে। অতএব এই কাহিনীগুলির
সত্যতা নিরূপণ করা কঠিন।
যে সময়ে ক্ষুদ্দক নিকায় রচিত হয়েছিল তখন
ধাতুপূজার ধারণা প্রচলিত ছিল। বিমানবত্থু, অপাদান পালি, বুদ্ধবংশ ইত্যাদি গ্রন্থ
ধাতুপূজা ও তার ফলাফলের উল্লেখ পরিপূর্ণ। “যখন জীবন্ত বুদ্ধকে আরাধনা করা এবং
এমনকি অনুপস্থিত বুদ্ধের সর্ষে বীজের মত ধাতুর আরাধনা করার আধ্যাত্নিক আনন্দ সমান
তখন উভয়ই সমান কুশল দায়ক। অতএব একটি স্তূপ নির্মাণ করা এবং শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা
যথোপযুক্ত। বিমানবত্থুও বুদ্ধের ধাতু পূজা ও বুদ্ধ পূজা উভয়কে সমান বলে উল্লেখ
করেছে।
অপাদান পালি উল্লেখ করেছে ভদন্ত সারিপুত্তের
পরিনির্বানের পর ভদন্ত চুন্দ থের একটি
পাত্রের মধ্যে ভদন্ত সারিপুত্রের ধাতুগুলি রেখে তা বুদ্ধকে অর্পণ করেন। বুদ্ধ উভয়
হস্তে এটিকে গ্রহণ করেন এবং ভদন্ত থেরের প্রশংসা করেন। এই গ্রন্থে এটিও বর্ণিত
হয়েছে কিভাবে ভদন্ত ভিক্ষুণী মহাপ্রজাপ্রতি গোতমীর মৃত্যুর পর ভদন্ত আনন্দ তাঁর
ধাতুসমূহ রাখা পাত্রকে তাঁর হাতে ধরে তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। এটি
আশ্চর্যজনক নয় যে পরবর্তীকালে ত্রিপিটকে ভগবান বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের প্রতি যে
ভালোবাসা প্রদর্শন করতেন তাকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য এই ধরণের ঘটনাকে সন্নিবেশিত করা
হয়েছিল।
যদিও এটি নির্দ্ধারণ করা কঠিন অপাদান পালিতে
বর্ণিত ধাতুপূজার ফলাফল কতখানি মূল বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, তবে এটি হওয়া
সম্ভব যে এই মতবাদগুলি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এমন একটি যুগে যখন শ্রদ্ধা প্রদর্শনের
সাধারণ উপায়গুলি আধ্যাত্মিক শ্রদ্ধাপ্রদর্শনের থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ণ হয়েছিল। এই
কারণে সেই সমস্ত ভিক্ষুরা যাঁরা কেবলমাত্র ধাতুপূজার মাধ্যমে অরহত হয়েছিলেন এবং তাঁদের
সম্পর্কে কাহিনীও রচিত হয়েছিল।
এমনকি যে সময়ে মিলিন্দ পণ্হ রচিত হয়েছিল সে
সময়েও পরিনিব্বাপিত বুদ্ধ ও তাঁর ধাতুসমুহ পূজা করবার বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে
প্রশ্ন থেকে গিয়েছিল। “পুজেথ পুজনিয়স্স ধাতুং এবেংকর সগ্গমিনো গমিস্সথ” এই
বাক্যাংশটি মিলিন্দ পণ্হে এটি বুদ্ধ ভাষিত
বলে কথিত। কিন্তু এটিকে ত্রিপিটকের অন্য কোন গ্রন্থে পাওয়া যায় না। বিমান
বত্থুতে এটিকে বুদ্ধভাষিত বলে উল্লেখ করা
হয়নি, ভদন্ত মোগল্লানের প্রশ্নের উত্তরে একজন দেবতার বিবৃতিরূপে উল্লেখ করা হয়েছে।
এর থেকে স্পষ্ট হয় যে সময়ে মিলিন্দ পণ্হ রচিত হয়েছিল সে সময়ে বৌদ্ধদের মধ্যে ধাতু
পূজাও তার ফলাফল সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন উপস্থাপিত হয়েছিল।
ধাতুপূজার ধারণার বিস্তারঃ
অশোকের সময়ে ধাতুপূজার যথেষ্ট বিস্তৃতি ঘটে।
সুমঙ্গলবিলাসিনী, ফা হিয়েনের বিবরণী ও দিব্যাবদান এবিষয়ে একমত যে এই সময়ে ভারতবর্ষ
জুড়ে ৮৪০০০ স্তূপ নির্মাণ করে এই ধাতুগুলিকে সেখানে স্থাপন করা হয়েছিল। ধাতু পূজার
বিস্তারের একটি বিশেষ পর্যায় ছিল সেটির বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়া সেই সমস্ত
প্রচারকের দ্বারা যাঁরা সেই সমস্ত দেশ পরিভ্রমণ করেছিলেন। পপঞ্চসুদনির ভাষ্যে
লিপিবদ্ধ আছে পবিত্র ধাতুসমূহের প্রতি অশ্রদ্ধা মহাপাপের সামিল। ভাষ্যগুলির মত এই
যে যতদিন এই ধাতুগুলির অস্তিত্ব আছে ততদিন বুদ্ধ জীবিত। এটি বলা হয় যে যে স্থানে
যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শিত হয় সেখানে অলৌকিক শক্তির প্রভাবে পবিত্র ধাতুগুলি একত্রিত
হয় এবং শেষে সমস্ত পবিত্র ধাতু একত্রিত হয় বুদ্ধগয়ায়। তারা একটি বুদ্ধ
প্রতিচ্ছবিতে প্রিন্ট হয় এবং অগ্নিতে ভস্মীভূত বুদ্ধ শাসন অন্তর্হিত হয়।
ধাতুপূজা যে শুধুমাত্র পুণ্য সঞ্চয়ের উপায়ে
পরিণত হয়েছে তা নয়, এটি বুদ্ধশাসনের দীর্ঘস্থায়ী হওয়ারও উপায়। বুদ্ধ যিনি ২৫০০ বছর
পূর্বে দেহত্যাগ করেছেন তিনি আজও বেঁচে আছেন এই ধারণা প্রাচীনকাল থেকে বৌদ্ধ
সমাজের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত। এই ধাতু পূজার ধারণার কারণেই মহাযান বৌদ্ধধর্মের ধারণার
মত একটি ধারণা যে বুদ্ধ দেহত্যাগ করেননি তিনি সুখাবতী স্বর্গে চিরকাল বসবাস করেছেন
যা পরবর্তীকালে থেরবাদী সম্প্রদায়ের মধ্যেও এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়।
মহাযান সম্প্রদায়ের একটি মত হল যে বুদ্ধের
তিনটি কায় আছে যেমন নির্মাণকায়, সম্ভোগকায় ও ধর্মকায়। এর মধ্যে ধর্মকায় হল স্থায়ী
এবং এর মৃত্যু নেই। ক্ষুদ্র সর্ষেবীজের মত ধাতুও পাওয়া যায় না। সদ্ধর্মপুণ্ডরীকের
মত মহাযানীর গ্রন্থেও ধাতু পূজা ও ধাতুর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মত ধর্মীয় আচার
অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। যারা পবিত্র ধাতুযুক্ত স্তূপে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন
এবং বুদ্ধ মূর্তি নির্মাণ করেন তাদের বুদ্ধত্ব লাভ সুনিশ্চিত। এই ভাবে মহাযান
সম্প্রদায়ের অনুগামীরা একদিকে যেমন ধাতুপূজার ধারণাটিকে প্রত্যাখান করেছেন,
অপরদিকে তা গ্রহণও করেছেন।
শ্রীলঙ্কায় ধাতুপূজার ধারণার বিস্তারঃ
শ্রীলঙ্কার উপাসক-উপাসিকারা সম্ভবতঃ
ধাতুপূজার আচার অনুষ্ঠানকে অনুসরণ করে আসছিল খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক থেকে। ইতিপূর্বে
যে তথ্য পাওয়া গেছে তা থেকে প্রকাশিত হয় যে থের মহেন্দ্রর আগমনের পূর্বেই
শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনের এক উর্বর পটভূমিকা প্রস্তুত ছিল। মহেন্দ্র থেরের
আগমনের পর ধাতুপূজার রীতিনীতি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ভদন্ত মহেন্দ্র থের বলেছেন
পবিত্র ধাতুর দর্শন বুদ্ধকে দর্শনের সমান। বুদ্ধের কোন শারীরিক ধাতুর অধিকারী হওয়া
বা তাঁর দ্বারা ব্যবহৃত কোন বস্তুর অধিকারী হওয়া এই দুটি এই দেশের মানুষের জীবন ও
রাষ্ট্রশাসন ব্যবস্থায়ও পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। পূজার শ্রদ্ধার বস্তুগুলি থেকে
শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার ও শ্রীলঙ্কায় উন্নত সংস্কৃতির সৃষ্টি উৎপত্তি হয়
যথা থূপারামের নির্মাণের জন্য ভদন্ত সুমন থেরর ভারতবর্ষে গমন ও বুদ্ধ কর্তৃক
ব্যবহৃত পবিত্র ধাতুকে পরিপূর্ণ পাত্রটি নিয়ে আসা, তাঁর সঙ্গে শত্রুর সাক্ষাত এবং
দক্ষিণের পবিত্র দন্ত ধাতু আনয়ন, প্রতি যোজনে স্তূপ নির্মাণ, রাষ্ট্রীয় প্রতীক
হিসেবে পবিত্র দন্ত ধাতু ও পাত্রের শ্রদ্ধা লাভ, বুদ্ধের ব্যবহার্য বস্তু হিসেবে
মহাবোধির সম্মিলিত পূজা লাভ। রাজরত্নকারতে উল্লেখ আছে বুদ্ধের কপালের কুঞ্চিত কেশ
ভদন্ত মহেন্দ্র থের দ্বারা সেগিরি স্তূপে রক্ষিত হয়েছিল।
ধাতুবংশ থেকে জানা যায় যে রাজা দুতুগেমুনু
তাঁর ত্রিশূলে পবিত্র ধাতুগুলিকে স্থাপন করেছিলেন এবং তিনি অপরিসীম শ্রদ্ধার কারণে
এটিকে রক্ষা করেছিলেন। এটি আরও উল্লেখ করে যে রাজা কাওয়ানতিষ্যের আমলে গিরিয়াবা
নামে এক শাসক সোমাবতী স্তূপে দক্ষিণ দন্ত ধাতুটিকে স্থাপন করেছিলেন রাণী সোমাবতীর
নামে এবং রাজা কাওয়ানতিষ্য যে সেরুবায়িলা স্তূপ নির্মাণ করেছিলেন সেখানে কপাল
ধাতুটি স্থাপন করেছিলেন। এর থেকে অনুমান করা সম্ভব যে রাজা দেবানামপিয়তিষ্যের আমল
থেকে যে বুদ্ধের দৈহিক ধাতু ও ব্যবহৃত সামগ্রী এই বিশ্বাসের বৃদ্ধি ঘটাচ্ছিল যে
তারা জীবন্ত বুদ্ধের প্রতিরূপ। এই পটভূমিকাতে পবিত্র দন্তধাতুটি আনুষ্ঠানিকভাবে
শ্রীলঙ্কায় নিয়ে আসা হয় শ্রীমেঘবর্ণের রাজত্বকালে ৩৬০ খ্রীষ্টাব্দে। এটি ছিল এমন
একটি পর্ব যেখানে বৌদ্ধ সমাজে ভক্তি ও বিশ্বাসের বদ্ধমূল অস্তিত্ব ছিল। দন্ত
ধাতুটির আগমনের সঙ্গে সঙ্গে শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে এক নবজাগরণের সুচনা
হয়। জীবন্ত বুদ্ধকে চিত্রায়িত করতে দন্ত ধাতুটি এক বিরল সম্পদ।
পবিত্র দন্ত ধাতুটি বুদ্ধ এই বিশ্বাস আজও
কিছু বৌদ্ধের মধ্যে রয়েছে। এই বিশ্বাসটি আরও শক্তিশালী হয়েছে দন্ত ধাতুটির ইতিহাস
এবং তার প্রতি প্রদর্শিত শ্রদ্ধা ও সম্মানের কারণে। এর ফলে অন্যান্য ধাতুগুলির
তুলনায় পবিত্র দন্তধাতুটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অভিজ্ঞানে পরিণত হয়েছে। যিনি পবিত্র
দন্তধাতুটির রক্ষাকর্তা তিনি রাজ্যের প্রধান। অতএব পবিত্র দন্তধাতুর সুরক্ষা
রাজাদের প্রধান কর্তব্যে পরিণত হয়।
দাঠাবংশের উৎসঃ
দাঠাবংশ হল সর্বপ্রাচীন
গ্রন্থ যেখানে পবিত্র দন্তধাতুটির আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রীলঙ্কায় নিয়ে আসবার কাহিনী
রয়েছে। এটির শুরুতে জাতকত্থকথার মত বুদ্ধের জীবনের পালি উৎস আছে।
বুধিতো নভমে
মাসে-ফুস্সপুণ্ণিমিয়ং জিনো
লঙ্কদীপং ভিসোধেতুং-লঙ্কদীপনুমুপাগমী
।।(মহাবংস ১-১৯)
বুধিতো ফুস্সমাসমহি-নভমে পণ্ণনাসিয়ং
লঙ্কমাগম্ম গঙ্গায়-তীরে
যোযন বিত্থতে ।।(দাঠাবংস ২-২)
যে জলট্ঠে থেলট্ঠে
চ-বুজগেসিতি কোতিয়ো
সরনসু চ্স সীলেসু-পতিট্ঠাপেসি নায়কো।।
(মহাবংস ১-৬১)
অসীতি কোটিযো নাগা-অচলমবুদ্ধিবাসিনো
পতিট্ঠাহিনসু মুদিতা-সীলেসু
সরনসু চ (দাঠাবংশ ২-১৬)
বুদ্ধের দাহ এবং ধাতুসমূহ
বিতরণের উৎস হল মহাপরিনিব্বাণ সূত্র ও সুমঙ্গলবিলাসিনী ভাষ্য।
মহাবংশের ৩৭নং স্তবক (৯২-৯৯) বিবৃত করে যে
একজন ব্রাহ্মণ মহিলা রাজা কীর্তিশ্রী মেঘবর্ণের রাজত্বকালের নবম বছরে দন্তধাতুটি
কলিঙ্গ থেকে শ্রীলঙ্কায় নিয়ে আসেন এবং দাঠাবংশে যে পদ্ধতি বলা হয়েছে সেই পদ্ধতিতে
এর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শিত হয়। এতে আরও লিপিবদ্ধ রয়েছে যে দন্তধাতুটি
আনুষ্ঠানিকভাবে স্থাপিত হয় ধম্মচক্ক নামে একটি বানীতে।এটি ব্যাখ্যা করে সেই পদ্ধতি
যার দ্বারা রাজা দন্তধাতুর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছিলেন এবং আরও ইঙ্গিত দেয়
প্রতি বছর দন্ত ধাতুটি শ্রদ্ধাসহকারে আনীত হত অভয়গিরি বিহারে। দন্তধাতু সম্পর্কে
এর থেকে অধিক কিছু সেখানে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
৩৭-৯২ নবমে তস্স বস্সমহি-দাঠাধাতুং মহেসিনো
ব্রাক্ষ্মনী কাচি আদায-কলিঙ্গম্হা
ইধানযি।।
৯৪ ধম্মচক্কব্হযে গেহে-বদ্ধযিত্ব মাহীপতি
ততো পট্ঠায় তংগেহং-দঠাধতুঘরং অহু।।
যেহেতু দাঠাবংশেও এই
তথ্যের পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে, এটি এই প্রাচীন কাহিনীর প্রাচীনত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট
প্রমাণ। মহাবংশ থেকে জানা যায় যে রাজা কীর্তি শ্রীমেঘবর্ণ কিভাবে দন্তধাতুটিকে
আনুষ্ঠানিকভাবে অভয়গিরি মহাবিহারে নিয়ে যাওয়া হবে এবং কিভাবে এর প্রতিশ্রদ্ধা
প্রদর্শন করা হবে সে বিষয়ে একটি আদেশ জারী করেছিলেন।
অনুসংবুচ্ছরং নেত্বা – বিহারমভযুত্তরং
তস্স পুজবধিং কাতু নেবরুপং নিযোজযি।।(মহাবংশ
৩৭-৯৫)
এই ঘটনাটি দাতাবংশে
শ্রদ্ধাপ্রদর্শনের পদ্ধতি সম্পর্কে তথ্য প্রমাণ রূপে উল্লেখিত হয়েছে।
ধাতুংবিহরমভযুত্তরমেব নেত্বা
পুজাবিধাতুমনুসবুচ্ছচ্ছর মেবরূপং
রাজাথ কিত্তিসিরিমঘ সমব্হায়ো সো
চারিত্তলখমভিলেখয়ি সচ্চসন্ধো ।।
(দাঠাবংস ৫-৬৭)
দাঠাবংশে এই ঘটনার বিবরণ
যখন মহাবংশের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তখন দেখা যায় যে দাঠাবংশে যে বর্ণনা করা হয়েছে
তা প্রাচীনকাল থেকেই জনপ্রিয় আচাগুলির অন্তর্গত ছিল। এই থেকে একথা অনুমান করা
সম্ভব যে মহাবংশকে অনুসরণ করেই দাঠাবংশ রচিত হয়েছিল। মহাবংশে এই বিষয়ে কোন ইঙ্গিত
দেওয়া নেই কেন পবিত্র দন্তধাতুটিকে নিয়ে আসা হয়েছিল। দাঠাবংশ থেকে জানা যায় যে
দন্তধাতুটি এখানে আনা হয়েছিল কারণ রাজা গুহাশিব, দন্তধাতুর রক্ষক একটি যুদ্ধে
জড়িয়ে পড়ে তাঁর পরাজয় হলে তাঁর কন্যা ও জামাতাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন পবিত্র দন্তধাতুসহ
শ্রীলঙ্কার পথে অগ্রসর হতে যেখানে একজন মিত্র রাজা রাজত্ব করতেন। মহাবংশ এই
ঘটনাটির উল্লেখ করেনি কেবলমাত্র এই কারণে ঘটনাটিকে মিথ্যা বলে অস্বীকার করা উচিত
নয়।
দাঠাবংশের বর্ণনা যদিও তা কাব্যিক কল্পনা ও
অতিরঞ্জনের দ্বারা অলঙ্কৃত এর মধ্যে স্বল্প পরিমাণ ঐতিহাসিক সত্য রয়েছে। অন্যান্য
ইতিবৃত্তগুলির মত, দাঠাবংশও একটি কাব্য।
এটি কোন ইতিহাস গ্রন্থ নয়। কিন্তু অন্যান্য কাব্যগ্রন্থগুলির তুলনায় এই
ইতিবৃত্তগুলি একটি বিশেষত্ব আছে। এই ইতিবৃত্তগুলি ঐতিহাসিক ঘটনার উপর ভিত্তি করে
রচিত কিন্তু অনেক কাব্য রচিত কল্পিত বিষয়বস্তুকে অবলম্বন করে।
অভয়গিরি বিহারের ভিক্ষুদের হাতে দন্তধাতুর
সুরক্ষার ভার অর্পিত হত্তয়ায় মহাবিহারের ভিক্ষুরা ইচ্ছাকৃতভাবে এটি সম্পর্কে
স্বল্প পরিমাণ তথ্য সরবরাহ করেছেন। পক্ষান্তরে, মহাবংশে একটি জনপ্রিয় গ্রন্থের
অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করে যেখানে দন্তধাতুর ইতিহাস লিপিবদ্ধ আছে।
দাঠাধাতুবংসমব-বুত্তেন বিধিনা স নং
গহেত্বা বহুমানেন-কত্বা সম্মানমুত্তমং।।(৩৭-৯৩)
নিঃসন্দেহে এরকম মনে করা হয়েছিল যে মহাবংশে
দন্তধাতুর ইতিহাস আবার নতুন অন্তর্ভুক্ত করা অর্থহীন ছিল যেহেতু এটি সেই গ্রন্থে
বর্ণিত আছে। এই গ্রন্থটির এখন কোন অস্তিত্ব নেই। অতএব এটির রচয়িতা তা রচনাকাল
অজানা।
প্রাচীন
সিংহলীয় দাঠাবংশঃ
দাঠাবংশের রচয়িতা তার মুখবন্ধে
উল্লেখ করেছেন তিনি অন্য দেশের মানুষদের জন্য ও মাগধী ভাষায় বুদ্ধের পবিত্র
দন্তধাতুর ইতিবৃত্ত করেছেন যা সিংহল দেশে সিংহলী ভাষায় কবিদের দ্বারা রচিত হয়েছিল।
তিনি বিবৃত করেছেন যে তিনি একটি দেশীয় ভাষায় রচিত একটি পূর্ববর্তী গ্রন্থকে পালি
ভাষায় রূপান্তর করে দাঠাবংশ রচনা করেছিলেন এবং এটি কেবলমাত্র একটি ঘটনা নয় যা
জনপ্রিয় ঐতিহ্যের অস্তিত্বশীল ছিল। অতএব, দাঠাবংশের প্রধান সূত্র হল প্রাচীন
সিংহলীয় দাঠাবংশ। এটি নিরূপণ করা সম্ভব নয় যে এই দাঠাবংশই মহাবংশে উল্লেখিত দাঠাধাতুবংশ
কিনা। যে কথা পূর্বেই বলা হয়েছে যে সিংহলীয় দালাদাবংশ সিংহলীয় কবিদের একটি রচনা,
এটি পদ্যে রচিত হয়ে থাকবে, মহাবংশে উল্লেখিত দাঠাধাতুবংশ একটি গদ্য রচনা হতে পারে।
এমনকি এটি যদি প্রমাণিত হয় যে দুটি গ্রন্থ পবিত্র দন্তধাতুর উপর রচিত দুটি পৃথক সূত্রের
উল্লেখ করেছে তাহলেও বিষয়বস্তুর দিক থেকে এদের মধ্যে খুব বেশী পার্থক্য থাকতে পারে
না। সম্ভবতঃ পালিতে দাঠাবংশ রচনার পর সিংহলীয় দালাদাবংশের প্রচলন কমে যায়।
এটি
অনুমান করা সম্ভব যে সিংহলীয় দালাদাবংশে লিখিত হয়েছিল শ্রীলঙ্কায় পবিত্র দন্ত
ধাতুটির আগমনের দুই শতাব্দী পর। দাঠাবংশ থেকে জানা যায় বারোজন মহান সমসাময়িক কবি
অনেকগুলি সুন্দর কাব্য রচনা করেছিলেন।
কবয়ো তস্স রাজম্হি-সিহলায় নিরুত্তিয়া
কবয়্যে বহুকেকঙসু-বিচিত্রনয়সালিনো।।
(মহাবংশ ৪১-৪৩)
দাঠাবংশে উল্লিখিত সিংহল
দেশের কবিদের দ্বারা রচিত সিংহলদেশীয় দালাদাবংশ রচিত হয়ে থাকতে পারে একজন কবি বা
অনেক কবি যথা দালবিপো, দালাগোতুকমারু, এর দ্বারা যাঁরা এই সময়ে বসবাস করতেন। এই
মতবাদ যদি গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে এই রচনাটি খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মত প্রাচীন। যে
রচনাটি লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে সেটি একটি অবিচ্ছিন্ন ধারায় মৌখিক
ঐতিহ্যের অংশ হয়ে থাকবে। এটির কিছু ঐতিহাসিক ভিত্তিও থাকবে। মহাবংশ ও অন্যান্য
প্রাচীন গ্রন্থগুলির বিষয়বস্তু মৌখিক ঐতিহ্য দ্বারা বহন করা তথ্যসমূহ। কখনও কখনও
কোন ইতিবৃত্তের অস্তিত্ব থাকবে যেখানে প্রধান বিষয়গুলির উল্লেখ থাকবে। রাজা প্রথম
আগবোর রাজত্বকালে যখন সিংহলদেশীয় দালাদাবংশ লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল তখন দন্ত ধাতুর
ইতিহাসের ইতিবৃত্তের অস্তিত্ব থেকে থাকবে।তবে, এই ব্যাপারে প্রমাণ দেওয়া সম্ভব নয়।
এই তথ্যসমূহ থেকে এটি স্পষ্ট যে দাঠাবংশ
রচনার ক্ষেত্রে যে সূত্রগুলি ব্যবহার করা হয়েছিল সেগুলি হল জাতকত্থকথা, নিদানকথা,
মহাপরিনিব্বাণসুত্ত, সুমঙ্গলবিলাসিনী, মহাবংশ, প্রাচীন নথিথত্র, জনপ্রিয় ঐতিহ্য
এবং বিশেষতঃ প্রাচীন সিংহলদেশীয় দালাদাবংশ।
দাঠাবংশ রচনার ভাষা ও শৈলীঃ
দাঠাবংশের প্রথম,
দ্বিতীয়, ও তৃতীয় অধ্যায়ের ভাষাশৈলী সহজবোধ্য, এবং পাঠকদের কাছে আকর্ষণীয়।
দাঠাবংশের রচয়িতা তাঁর শৈলীকে এমনভাবে ব্যবহার করেছেন যে পালি ভাষার জটিলতায়
অনভ্যস্ত একজন শিক্ষানবিশও এটিকে পড়তে এবং উপভোগ করতে সমর্থ হবে।
১-৩০ কদাচি উয্যানপথে জরাহতং
তথাতুরং কালকতঞ্চ সংযমিং
কমেন দিস্বান বিরত্তমানসো
ভবেসু সো পব্বজিতুং অকাময়ী।।
এটি অত্যন্ত সহজবোধ্য
ভাষায় গার্হস্থ জীবনের বিষাদকে প্রকাশ করে। ভাষার এই সহজবোধ্যতা পাঠকের কাছে একটি
সুন্দর ও আকর্ষণীয় গ্রন্থ হিসেবে দাঠাবংশের সমাদরের অন্যতম কারণ।
১-৪১
লভিংসু অন্ধা বিমলে বিলোচনে
সুসু সদ্দে বধিরাপি জাতিয়া
লপিংসু মূগা বচনেন বগ্গুনা
চরিংসু খেলং পদসাব পনগুলা
এই উদাহরণটি সেই বিরাট সমর্থনকে প্রকাশ করে যা
সরবরাহ করা হয়েছিল সেই সহজবোধ্য শৈলী দ্বারা যাতে করে পাঠকেরা স্তবকের প্রতি চার পঙতিকে
একটি পৃথক বাক্য হিসেবে আলাদা করে নিয়ে অর্থটিকে সহজে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে।
অবত্থরনতিং বসুধংব অম্বরং
বিরূপবেসগ্গহনেন ভিনসনং
পকম্পযন্তো সধরাধরং মহিং
জিনো পোদোযে জিনি মারবাহিনিং।
এই গাথাটিতে রচয়িতা
অনুষ্টুপ ছন্দে (কোকিলের রব) সুন্দর শব্দ মালা প্রয়োগ করেছেন।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে মহাবংশ রচয়িতারা সেই অনুষ্টুপ
ছন্দে গ্রহণ করেছেন যেটি মহাবংশে যে ধরণের ঐতিহাসিক কাহিনী লিপিবদ্ধ করা হয়েছে
তাকে বর্ণনা করতে সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত। যেহেতু পাঠক যা পাঠ করছেন তার অর্থ সহজেই
উপলব্ধি করতে পারছেন, তাই পাঠ চালিয়ে যেতে তাঁর আগ্রহ জাগে।
২-১১ বুধিতো পঞ্চমে বস্সে-চিত্তমাসে মহামুনি
উপোসথে কালপক্খে-নাগদিপমপাগমা।।
এখানে একটি সুন্দর ও মনোরম ভাষার প্রয়োগ
দেখা যাচ্ছে যা মহাবংশের শৈলীকে অনুকরণ করেছে। তৃতীয় অধ্যায়ে এই সহজবোধ্যতা আরো
গভীর। চতুর্থ ও পঞ্চম অধ্যায়ে রচনাশৈলী প্রাণশক্তিকে পরিপূর্ণ কিন্তু তাতে প্রচুর
পরিমানে যৌগিক শব্দ এবং এর সঙ্গে সংস্কৃত রচনাশৈলীকে অনুসরণ করবার এক ঋণসুলভ মানসিকতা।
এই বিশেষ রচনাশৈলী এক মহান কাব্য হিসেবে সিংহলীদের কাছে দাঠাবংশকে মর্যাদা লাভ
করতে সাহায্য করেছে।
এই অংশে সংস্কৃত ভাষার প্রভাব খুব স্পষ্ট
বলে মনে হয়। এই অংশটি থেকে পল্লানুরভ যুগে সংস্কৃতের প্রভাবে মাত্রা ও পালি ভাষার
রচয়িতার বহুমূখী প্রতিভা সম্পর্কে বোঝা সম্ভব।
৪-২ করিবরমথ দিস্বা সো গুহাদ্বার যাতিং
পতিভয়রহিততো সীহরজাব রাজং
নিজনগরসমীপায়াতমেত্তং নরিন্দ
অমিত বল মহোখেনোত্থতোরনয়াসিভি।।
‘সুবোধালঙ্কার’ থেকে জানা যায় যৌগিক
শব্দের প্রাচুর্য একটি কাব্যকে সুন্দর করে তোলে। “ও যো সমস বহুল্লংতং গজ্জস্স
পিরিতগং”-দাঠাবংশের ভাষাশৈলী সম্পর্কে বলা চলে এবং কোন কোন অংশে সহজবোধ্যও কোন কোন
অংশে গভীর। এটি অর্থ বলা হয়েছে যে ভাষাশৈলী মিশ্রিত বহু এবং জীবনীশক্তিতে
পরিপূর্ণ।
দাঠাবংশের সাহিত্যিক মুল্যঃ
পালি কাব্য সাহিত্যে
দাঠাবংশ এক বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছে। এটি প্রতিটি বর্ণনার পক্ষে উপযুক্ত শব্দকে
নির্বাচিতও ব্যবহার করেছে। দাঠাবংশ রচিত হয়েছে মহান সাহিত্যিক রচনাগুলির সঙ্গে
সঙ্গতি রেখে যেমন সংস্কৃত কাব্য শৈলী ও প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে বিশেষ ছন্দের
ব্যবহার। কাব্যের ছন্দ ও অলঙ্কার সম্পর্কে আলোচনাকারী গ্রন্থে মহানকাব্যের
নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলির উল্লেখ করা হয়েছে।
১) নিম্নে কোন একটি
দ্বারা গ্রন্থটির আরম্ভ
শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, কাহিনীর সংক্ষিপ্তসার
(দাঠাবংশ শুরু হয়েছে
ত্রিরত্নের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে।)
২) কাব্যের নায়ককে একজন
বিখ্যাত এবং উচ্চ বংশেজাত ব্যক্তি হতে হবে।(দাঠাবংশের নায়ক হলেন বুদ্ধ।)
৩) ঐতিহাসিক কাহিনীর
অন্তর্ভুক্তি (দাঠাবংশে দন্তধাতুর কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে।)
৪) সর্বনিম্ন ৮ এবং
সর্বোচ্চ ২৪টির অধ্যায়ের উপস্থিতি। (দাঠাবংশে ৫টি অধ্যায় আছে। সেই কারণে এটিকে
মহাকাব্য বলে মনে করা হয় না, এটিকে মনে করা হয় খণ্ডকাব্য।)
৫) কাব্যরচনাশৈলীতে
অনেকগুলি ছন্দ আছে এবং প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে ছন্দের পরিবর্তন ঘটে।
৬) যুদ্ধ, মহাসাগর, নারী,
বিবাহ, প্রভাত, পর্বত, অরন্য ইত্যাদির কাব্যিক বর্ণনার অন্তর্ভুক্তি।
৭) কামনা, প্রশান্তি,
সাহিত্যিকতার মত একটি বা একাধিক কাব্যিক আবেগের প্রাধান্য।
৮) চতুরমুখী ফলাফলের
উৎপত্তি-প্রায়োগিক বিকাস, ধর্মের জ্ঞান, কামনার পরিপূরণ ও মুক্তি।
দাঠাবংশ রচনা করতে গিয়ে ভদন্ত ধর্মকীর্তি
উপরিউক্ত সমস্ত বৈশিষ্ট্যকে অক্ষুণ্ণ রাখতে চেষ্টা করেছেন। যাই হোক, সমালোচকরা এই
রচনাটিকে একটি খণ্ডকাব্য বলে গণ্য করেছেন কারণ এটিকে মাত্র পাঁচটি অধ্যায় রয়েছে।
এই গ্রন্থের কাব্যিক বর্ণনা অনেক কিছু প্রকাশ
করে, পশ্চিম অধ্যায়ের সর্বশেষ গাথাটিকে ছন্দটি রয়েছে (পয়াদন্ত যমক)। অনুপ্রাসের
অনায়াস প্রয়োগ রয়েছে। কষ্টকর প্রচেষ্টার দ্বারা সৃষ্ট ধারণা ও অলঙ্কার থেকে এটি
মুক্ত। এগুলি থেকে কবির উচ্চমানের দক্ষতা প্রমাণিত হয়। আবেগ উৎপত্তিতে ভদন্ত
ধর্মকীর্তির প্রচেষ্টা সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে।
২-৭৪ বস্সারত্তে যথা চন্দো মোহক্খন্ধেন আবতো
নাসক্খি গুণরংসীহি-জলিতুং সো নবাসভো
গুহাসিব চাঁদের মত। তবে বর্ষাকালে মেঘাচ্ছন্ন
হলে চাঁদ কিরন দেয় না। একইরকম, যে রাজার ধর্মীয় বিশ্বাস ভ্রান্ত তিনি ধর্মে
উজ্জ্বল নন। এখানে লেখক উপমা ব্যবহার করে এই আবেগটিকে সহজে প্রকাশ করতে সক্ষম
হয়েছেন। দন্তধাতু কখনো করা প্রভাবে অতিপ্রাকৃত ঘটনার বর্ণনা কবির উচ্চমানের
কাব্যদক্ষতার প্রমাণ করে।
৩-৮৪ হণসন্গনোথ মুনিন্দধাতু
সা পঙ্কজা পঙ্কজ মোক্কমন্তি
কুন্দাবদাতাহি বিধাবমানা
খরোদকুচ্ছিং ব পুরং অকাসি।।
৫৯ সা বাজহনসীব বিধাবমানা
সুগন্ধিতোয়ম্হি পদক্খিনেন
উম্মুজজমানা চ নিমুজ্জমানা
জনে পমোদস্সুধরে অকাসি
(A Description of a
battle).
৪-৩ উদিতবহলধূলীপালিরুদ্ধন্তলিক্খে
সমদ বিবিধ যোধা রাব সমরমভ ভিমে
নিসিলসরসতালি বস্সধায় করলে
অজিনি মহতি যুদ্ধে পন্দুকো খিরধারং।।
আকাশ ধুলার বিশাল মেঘে
ঢাকা, অনেক যোদ্ধার গর্জনে আতঙ্কের রাজত্ব করছিল, বৃষ্টির
মত তীর ছোঁড়া হচ্ছিল। এই বিশাল যুদ্ধে রাজা পাণ্ডু রাজা ক্ষীরধারাকে পরাজিত
করেছিলেন। এখানে লেখক পাঠকের সামনে শব্দের দক্ষ ব্যবহারের মাধ্যমে যুদ্ধের
ভয়াবহতাকে চিত্রায়িত করেছেন। এখানে তাঁর শক্তিশালী এবং স্বাধীন কবি প্রতিভা
স্পষ্ট।
এখানে লেখক পাঠকের সামনে বর্ণনা দিচ্ছেন কিভাবে
নাগরা এক সন্ত্রাসের রাত্রি তৈরী করেছিল মহাসাগরের মাঝখানে, এবং কিভাবে পরের দিন
দন্তধাতুকে সম্মান জানাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে এসেছিল, যেন পাঠক স্বচক্ষে ঘটনাটি
দেখেছেন।
৪-৪৮ অথ বিততফনল ভিন্সনা কেচি নাগা
সুরভি কুসুম হত্থা কেচি সন্ধারযন্তা
রুচির মন পদীপে কেচি সনধরযন্তা
নিজসিরসি করোনতা কেচি কন্দুপ্পলানি।।
কয়েকজন নাগ শত শত সৃষ্টি
হওয়া শিরস্ত্রাণ মাথায় হঠাৎ করে আবির্ভূত হয়েছিল। অপর কয়েকজন স্বর্গীয় আকৃতিতে
হাতে সুগন্ধী ফুল নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল। অপর কয়েকজন রত্নখচিত বাতি হাতে নিয়ে আবির্ভূত
হয়েছিল। আরও অনেকে হাতে কদুপুল ফুল নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল।
বিভিন্ন ছন্দ, অধ্যায়ের নির্মাণ, সংযোজন
অব্যয় ও যৌগিক শব্দের ব্যবহার ইত্যাদিকে সংস্কৃত কাব্যের প্রভাবে আনীত পরিবর্তন
হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে। যদিও কোন কোন জায়গায় ত্রুটি রয়েছে তবে তারা কবিতাটি
উপভোগ করতে কোন বাধা দেয় না।
দাঠাবংশ একটি কাব্য, যা কাব্যিক আবেগ দ্বারা
পরিপূর্ণ এবং সুন্দর। যদিও এটি মহান সংস্কৃত কবিদের অনুসরণ করেছে এটি ঋনগ্রন্থের মত সংস্কৃত
শৈলীকে অনুকরণ করেনি। এই কারণে দাঠাবংশ প্রাঞ্জলতা ও সৌন্দর্য রয়েছে। ভন্তে
ধর্মকীর্তির কবি প্রতিভা পাঠকের মধ্যে কাব্যের অর্থ সংক্রান্ত আবেগ অনায়াসে সৃষ্টি
করে।
দাঠাবংশে অন্তর্ভুক্ত কাহিনী ও তাদের ঐতিহাসিক তাৎপর্য্যঃ
বাম দন্তধাতুটি একজন
অর্হৎ ক্ষেমা কর্তৃক সেই চিতা থেকে কুড়িয়ে নেওয়া হয়েছিল যেখানে
চিতা জ্বলছিল। দন্তধাতুটিকে কলিঙ্গের দন্ত শহরের রাজা ব্রক্ষ্মদত্তের হাতে তুলে
দেওয়া হয়েছিল। তাঁর রাজবংশের রাজাদের এটিকে সম্মান প্রদর্শন করতেন এবং রক্ষা
করতেন। সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বংশের রাজা গুহাশিবের রাজত্বকালে
পাটলিপুত্রের শাসনকর্তা পাণ্ডু ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করবার আদেশ জারী করেন
যিনি পাণ্ডুর অধীনে এক শাসক ছিলেন। পাণ্ডু গুহাশিবকে এবং দন্তধাতুটিকে পাটলিপুত্রে
নিয়ে আসবার আদেশ দেন। দন্তধাতুটির অমর্যাদা ও অসম্মান সম্পর্কিত তথ্য পরীক্ষা করে,
তিনি অত্যন্ত প্রশংসার সঙ্গে দন্তধাতুটিকে নিরীক্ষণ করেন এবং সেটিকে কলিঙ্গে
ফিরিয়ে দেন।
রাজা গুহাশিব তাঁর জামাতা এবং ক্ষীরধারা
নামে রাজার ভ্রাতুস্পুত্র রাজপুত্র দন্তকে ও তাঁর কন্যা হেমমালাকে নির্দেশ দেন
দন্তধাতুটিকে নিয়ে হেমমালা এই দুজন গুহাশিবের পরাজয় দেখে পবিত্র দন্তধাতুটিকে নিয়ে
লঙ্কায় এসে পৌঁছন এবং এই ঘটনাটি ঘটেছিল শ্রীমেঘবর্ণের রাজত্বকালের নবম বছরে। রাজা
দন্তধাতুর একটি মন্দির নির্মাণ করেন ধর্মচক্র ভবনের অভ্যন্তরে, সাড়ম্বরে
দন্তধাতুটিকে সেখানে স্থাপন করেন এবং কিভাবে দন্তধাতুটির প্রতি বাৎসরিক সম্মান
প্রদর্শিত হবে সে বিষয়ে এক নথিপত্র রচনা করেন। বুদ্ধদাসক প্রমুখ তাঁর বংশধরেরা
ঐতিহ্যগতভাবে এই শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন।
দাঠাবংশের ঐতিহাসিকত্বঃ
পালি দাঠাবংশ কোন
ইতিহাসের গ্রন্থ নয়। কিন্তু ইতিবৃত্তগুলি কাব্যসাহিত্যে এক বিশেষ স্থান গ্রহণ করে
থাকে, যেহেতু ঐতিহাসিক কাহিনী তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। দাঠাবংশ পবিত্র দন্তধাতুটিকে
লঙ্কায় আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি বর্ণনা করে, কিন্তু সমগ্র কাহিনীটিকেই
সত্য বলে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। মূল কাহিনীটিকে পরবর্তীকালে পবিত্র দন্তধাতুটিকে
ঘিরে নানা ধরণের কাহিনীর দ্বারা অতিরঞ্জিত করা হয়েছিল। ক্ষীরধারা, গুহাশিব প্রমুখ
রাজার নাম কোন ভারতীয় সূত্রে উল্লেখিত হয়নি, এতএব এদের ঐতিহাসিক চরিত্র বলে মেনে
নেওয়া যায় না। দাঠাবংশের সমস্ত ঘটনাবলীর মূল বিষয় হল পবিত্র দন্তধাতুটিকে
শ্রীকীর্তিমেঘবর্মণের আমলে লঙ্কায় নিয়ে যাওয়া।
দাঠাবংশের প্রতিবেদন যে লঙ্কার রাজা
মহাসেন ও কলিঙ্গের মধ্যে সম্পর্ক ছিল ঐতিহাসিক সত্য। দাঠাবংশে উল্লেখিত রয়েছে যে
গুহাশিব পবিত্র দন্তধাতুটিকে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন কারণ লঙ্কার রাজা
মহাসেন ছিলেন তাঁর বন্ধু। রাজা গুহাশিব বলেছিলেন যে রাজা মহাসেন যে কেবল তাঁর তাই
নয়, উপরন্তু রাজা মহাসেন বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে উপহার পাঠিয়েছেন এবং
সেই জলের এক বিন্দু পাওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন যা পবিত্র দন্তধাতুর স্পর্শ লাভ
করেছিল। এই ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক যা বিশেষত রাজা মহাসেনের আমলে অস্তিত্বশীল
ছিল তা দন্তধাতুটিকে শ্রীলঙ্কায় নিয়ে আসবার জন্য অবদান রেখেছে। যেহেতু মহাবংশ এই সমস্ত
বিবরণকে অবহেলা করেছে, তাই দাঠাবংশে তাদের উল্লেখের
ঐতিহাসিক তাৎপর্য্য রয়েছে।
যদিও মহাবংশ দন্তধাতুর আগমনের কথা উল্লেখ
করেছে, এটি বর্ণনা দৈর্ঘ্যে দাঠাবংশের মত নয় এবং এটি এই বিষয়টিকে আলোচনা করেছে
সামান্য ভিন্নভাবে। মহাবংশে উল্লেখ আছে যে রাজা শ্রীমেঘবর্ণের রাজত্বকালের নবম
বছরে এক ব্রাক্ষ্মণ মহিলা (কাচি ব্রাক্ষ্মণী) বুদ্ধের পবিত্র দন্তধাতুটিকে কলিঙ্গ
থেকে নিয়ে আসেন। যদিও এই বর্ণনায় বলা হয়েছে দন্তধাতুটি কলিঙ্গ থেকে আনা হয়েছিল,
এটিতে একথা উল্লেখ করা নেই যে এই দন্তধাতুটি বহন করে নিয়ে এসেছিলেন রাজপুত্র দন্ত
ও রাজকন্যা হেমমালা, এটিকে বলা হয়েছে এই দন্তধাতুটি বহন করে নিয়ে এসেছিলেন জনৈক
ব্রাক্ষ্মণ মহিলা। যে তথ্য মহাবংশ থেকে পাওয়া যায় না তা মহাবংশে পাওয়া
যেতে পারে। কিন্তু এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে উভয় গ্রন্থই একই ঘটনার কথা বর্ণনা
করেছে।
ভারতবর্ষে খ্রীঃ পূঃ ৩য় শতকে ধর্মীয় রীতি
নীতি নিয়ে যে সংগ্রাম চলেছিল তার বিবরণ এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে (দাঠাবংশ)। সম্ভবতঃ এই তথ্যটি
সংকলিত হয়েছে সমসাময়িক বিবরণী থেকে। এটিও ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। রাজকন্যা
হেমমালা ও রাজপুত্র দন্ত তাম্রলিপ্ত থেকে সমুদ্র পথে যাত্রা শুরু করেছিলেন এবং
সিংহলদ্বীপে লঙ্কাপত্তন নামে একটি স্থানে এসে উপনিত হয়েছিলেন।
উপরোক্ত স্থানটি শ্রীলঙ্কার একটি প্রাচীন
বন্দর। দন্তধাতু নিয়ে হেমমালা নগরে পৌঁছে মহাগিরি বিহারে গমন করেন, সাময়িকভাবে
দন্তধাতুটি মহাগিরি বিহারে স্থাপন করেন।
রাজা এই পবিত্র দন্তধাতুটিকে অত্যন্ত
শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করেন, দন্ত ধাতুটির জন্য একটি বিহার নির্মাণ করেন এবং
দন্তধাতুটিকে সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সেটিকে সাধারণ মানুষের সামনে প্রদর্শনের
ব্যবস্থা করেন। তিনি এই মর্মে আদেশ জারী করেন যে প্রতি বছর দন্তধাতুটিকে
আনুষ্ঠানিকভাবে অভয়োত্তর বিহারে নিয়ে গিয়ে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে। তিনি এই
অনুষ্ঠানের কার্যক্রম লিপিবদ্ধও করে রাখতেন। এই অনুষ্ঠানটি যে কিছু সময় ধরে
ধারাবাহিকভাবে অনুষ্ঠিত হত তার প্রমাণ পাওয়া যায় ফা-হিয়েনের বিবরণীতে যেখানে তিনি
লিখিছেন যে তিনি স্বচক্ষে দন্তধাতুর এই অনুষ্ঠানটি দেখেছিলেন। এই ঘটনাটির উল্লেখ
মহাবংশে পাওয়া যায়, কিন্তু সংক্ষিপ্ত ও কিছুটা পৃথকভাবে, এর থেকে জানা যায় যে রাজা
দন্তধাতুটি গ্রহণ করেছিলেন এবং সেটিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে ধম্মচক্ক ভবনে স্থাপন
করেছিলেন।
মহাবংশ থেকে জানা যায় তারপর থেকে ভবনটি
দাতাধাতুগৃহ নামে পরিচিত হয়। এই প্রসঙ্গে বলা যায় সিংহলীয় দাঠাবংশ যেহেতু সিংহলীয়
দালাদাবংশ যা রচিত হয়েছিল দন্তধাতুর ইতিহাস নিয়ে এখন অস্তিত্বহীন এবং দন্তধাতুটি
আনয়নের ব্যাপারে মহাবংশ থেকে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় না, তাই মহাবংশকে ঐতিহাসিক
দিক থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা বলে মনে করা যেতে পারে যাতে এই ঘটনার বিস্তারিত
বিবরণ রয়েছে।
বৌদ্ধ-হিন্দু দ্বন্ধঃ
ভন্তে ধর্মকীর্তি
থের দ্বারা রচিত দাঠাবংশ পবিত্র দন্তধাতুর ইতিহাস বর্ণনা করে। ভন্তে ধর্মকীর্তি
জীবিত ছিলেন পোলান্নারুবা যুগে। এই গ্রন্থের বিভিন্ন বর্ণনাকে উপস্থিত করা হয়েছে অতিশয়োক্তির
মাধ্যমে যা একটি কাব্যগ্রন্থের ক্ষেত্রে অত্যন্ত স্বাভাবিক। এই গ্রন্থের তৃতীয় ও
চতুর্থ অধ্যায়ে ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ও হিন্দুদের দুই গোষ্ঠীর দ্বন্ধের বিষয়ে তথ্য
পাওয়া যায় যে ঘটেছিল খ্রীষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে।
বুদ্ধের মহাপরিনিব্বাণের পর ভন্তে ক্ষেমা
থের বুদ্ধের চিতা থেকে দন্তধাতুটি নেন এবং সেটিকে কলিঙ্গের রাজা ব্রক্ষ্মদত্তকে
দান করেন। এই রাজবংশের রাজা গুহাশিব দন্তধাতুটিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে সুরক্ষা দান
করেছিলেন। রাজা গুহাশিব যদিও প্রথমে হিন্দু ধর্মের অনুগামী ছিলেন, পরে বুদ্ধের
গুণের কথা শুনে বৌদ্ধধর্মের অনুরক্ত হয়ে পড়েন এবং এই ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন।
তিনি একটি বিহার নির্মাণ করে তাতে প্রত্যহ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন, তিনি সমস্ত
নির্গ্রন্থকে তাঁর রাজ্য থেকে নির্বাসিত করেছিলেন। নির্গ্রন্থ যারা কেবলমাত্র লাভ
কামনা করত তারা সম্রাট পান্ডুর কাছে গিয়ে অভিযোগ করে যে তাঁর একজন প্রতিনিধি
ব্রক্ষ্মার মত পূজনীয় দেবতাদের বাদ দিয়ে একটি মানুষের অস্থিকে পূজা করছে। রাজা
পাণ্ডু তৎক্ষণাৎ রাজা চিত্তায়নকে আদেশ দিলেন গুহাশিবকে গ্রেপ্তার করে তাঁকে ও সেই
মানুষের অস্থিটিকে তাঁর সামনে হাজির করতে।
রাজা চিত্তায়ন সেখানে গিয়ে বুদ্ধের গুণের
কথা শুনলেন এবং বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করলেন। পরে দন্তধাতুটি হিন্দু রাজা পাণ্ডুর কাছে
নিয়ে আসা হল। তিনি এটিকে ধ্বংস করতে আদেশ দিলেন। প্রথমে এটিকে কামারের নেহাইয়ের
উপর রেখে বড় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করা হল, তারপর এটিকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করা হল এবং
হাতীর পায়ের নীচে ফেলা হল। দাঠাবংশের রচয়িতা অতিশয়োক্তির দ্বারা বর্ণনা করেছেন
দন্তধাতুটিকে কোন উপায়ের দ্বারাই ধ্বংস করা যায়নি এবং সেই সময়ে এটি
প্রত্যক্ষদর্শীদের আনন্দিত করে অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শন করেছিল। এগুলি ছিল বহু
প্রজন্মের জন্য বিশ্বাস ও ভক্তির বর্ণনা।
যাইহোক শেষপর্যন্ত পাণ্ডু তার ভ্রান্ত
বিশ্বাসকে পরিত্যাগ করে বৌদ্ধে পরিণত হয়। এর থেকে প্রমাণিত হয় হিন্দুদের সঙ্গে
দ্বন্ধে বৌদ্ধরাই জয়ী হন। তারপর গুহাশিব দন্তধাতুটির দায়িত্ব লাভ করেন। তারপর রাজা
ক্ষীরধারা দন্তধাতুটিকে হস্তগত করবার উদ্দেশ্যে গুহাশিবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা
করেন। এই যুদ্ধে গুহাশিব জয়ী হলেও ক্ষীরধারার ভ্রাতুষ্পুত্রদের হাতে পরাজিত হন।
এটি থেকে বৌদ্ধবাদের পরাজয় প্রমাণিত হয়। গুহাশিব রাজপুত্র দন্তকে ছদ্মবেশে পবিত্র
দন্তধাতুটি নিয়ে শত্রুদের এড়িয়ে শ্রীলঙ্কায় নিয়ে যেতে এবং সেটিকে সুরক্ষা দান করতে
আদেশ দেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে ব্রক্ষ্মদত্ত, সুনন্দ, গুহাশিব, ক্ষীরধারা এই
নামগুলি পাওয়া যায় না। অতএব এগুলিকে ঐতিহাসিক হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। তবে,
পবিত্র বৌদ্ধ গ্রন্থসমূহের উপর হিন্দুদের শ্রদ্ধা সম্ভবত ভারতবর্ষের ইতিহাস থেকেই
গ্রহণ করা হয়েছে।
আকর কুঞ্চিকাঃ
১। বিভূসমং কালকনাগরনবযং-
পরক্কমো কারুনীকো চমূপতি
গবেসমানো জিনসাসনস্স যো-
বিরুল্হিমত্থং চ জনস্স পত্থযং (দাঠাবংস ১-৪)
২। তদা ধিতিমত্তা
সেটঠে-মহাবলো পরব্কমো
পরক্কম চমুনাথো-কলনগর বংসভো
লীলাবথীং মহেসিংতন চন্দাদিচ্চকুলো দিতং
রজ্জেভিমিবিত পচ্ছাপি রাজতেজো বিলাসিতং
(মহাবংস অধ্যায় ৭৮,৪৯-৫০ গাথা)
৩। পিযং পরক্কন্তি ভুজস্স
রাজিনো
মহেসিংমচ্চুন্নত বুদ্ধি সম্পাদং
বিধায় লীলাবথি মিচ্ছিতত্থদং
অসেস লঙ্কাতলরজ্জ লক্খিথং (দাঠাবংস, অধ্যায়
৫)
৪। লীলাবথয
পরক্কন্তিভুজিন্দ গ্গমহেসিয
বজ্জং করপথি তিনি বস্সানি নিরুপদ্দবং (মহাবংস
অধ্যায় ৮, গাথা ৩১)
৫। ত্ততরিত্বান তেজস্সি
পন্ডুরাজ পরক্কমো
অপনেত্বান তং দেবিং সেননিঞ্চ পরক্কমং (মহাবংস
অধ্যায় ৭৮, গাথা ৫৪৩)
৬। ধাতুং
বিহারামভযুত্তরমেব নেত্বা
পূজং বিধতু মানবুচ্ছরমেব রূপং
রজথ কিত্তিসিরিমেঘ সমব্হযো সো
চরিত লেখমভিলেখয়িত সচ্চসচ্চো (দাঠাবংস অধ্যায়
৫, গাথা ৬৭)
৭। দাঠাবংস -অধ্যায় ৪,
গাথা- ১৫।
৮।দাঠাবংস - অধ্যায় ৫,
গাথা ১।
৯। দাঠাবংস-অধ্যায় ৩,
গাথা ৬৭।
১০। দাঠাধাতুস্স বংসম্হি
বুত্তেন বিধিনে স নং।
গছেত্বা নহুনেন কত্বা সস্মানমুত্তমং
নবমে তস্স বংসম্হি দাঠাধাতুং মহেসিনো
ব্রাক্ষনি কচি আদায় কলিঙ্গম্হি ইধানয়ি। (মহাবংস, অধ্যায় ৩৭, গাথা ৯২-৯৩)
১১। দাঠাবংস, অধ্যায় ৫,
গাথা ৬৮।