সুমনপাল ভিক্ষু
বঙ্গদেশে বুদ্ধ শাসনের ইতিহাসে তথা সদ্ধর্মের বিকাশের ইতিহাসে শ্রীমৎ বুদ্ধরক্ষিত মহাস্থবির এক উজ্জ্বল অধ্যায়। ১৯৪৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী তিনি তদানীন্তন পূর্ববঙ্গের (অধুনা বাংলাদেশ) চট্টগ্রাম অঞ্চলের আধারমানিক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতার নাম রমনী মোহন চৌধুরী এবং মাতা জানকী বালা চৌধুরী। তিনি তাঁর পরিবারের ৬ষ্ঠ সন্তান ছিলেন। তাঁর পিতৃদত্ত নাম সুকুমার বড়ুয়া। পরবর্তী সময়ে তিনি বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার উপসংঘরাজ জ্ঞাননিধি বুদ্ধরক্ষিত মহাস্থবির।
পবিত্র মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে (১৯৫৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী) তিনি বর্তমান প্রয়াত উপসংঘরাজ শ্রীমৎ গুণালংকার মহাস্থবিরের নিকট প্রব্রজ্যা ধর্মে দীক্ষিত হল। এই সময় তিনি বুদ্ধরক্ষিত শ্রমণ রূপে পরিচিত হন।
শ্রামণ্যধর্মে দীক্ষা নিয়ে গুরু পূজনীয় কবিরত্ন ধর্মানন্দ মহাস্থবির এর সান্নিধ্য লাভ পূর্বক তিনি ধর্ম-বিনয়'এর অভিবৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করেন।
তিনি আধারমানিক উচ্চবিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ধর্মবিনয়ে পারদর্শীতা লাভ করেছিলেন এবং ১৯৬৬ সালে কবিরত্ন মহাস্থবির'এর উপাধ্যায়ত্বে এবং ভিক্ষু সংঘের উপস্থিতিতে আধার মানিক বোধিনিকেতন বিহারে ধর্মীয় বিনয় বিনয়ানুসারে উপসম্পদা লাভ করেন। শ্রামান্য ধর্ম হতে ভিক্ষু জীবনে উন্নীত হয়ে তিনি ১৯৬৮ সালে এসএসসি পরীক্ষার উত্তীর্ণ হন এবং পরবর্তীতে রাঙ্গনীয়া কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক'এ ভর্তি হন।
১৯৭৭ সালে মধ্যম আধার মানিক বোধিনিকেতন বিহারে পালি এবং সংস্কৃত শিক্ষা বোর্ড (ঢাকা হতে অনুমোদিত) বোধিনিকেতন পালি টোল নামক ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে তিনি অত্যন্ত কৃতিত্ত্বের পরিচয় প্রদান করেছিলেন। অতঃপর উক্ত প্রতিষ্ঠার হতে তিনি পবিত্র ত্রিপিটক'এর মূল তিনটি কোর্স সুত্ত বিনয় এবং অভিধর্ম সার্টিফিকেট লাভকরেন।
১৯৮২ সালের ১০ অক্টোবর তিনি আধার মানিক উচ্চ বিদ্যালয়'এর পালি শিক্ষকপদে যুক্ত হন এবং দীর্ঘ ৩৪ বৎসর উক্ত কর্মে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
এক সময় তিনি শিক্ষকতার জীবনে ইতি টেনে পুনঃ সদ্ধর্মের প্রচার প্রসারের স্বার্থে বৌদ্ধ পল্লী সমূহে 'বহুজনের হিতার্থে এবং সুখার্থে লোকানুকম্পায় ভগবান বুদ্ধের উপদেশ বাণী প্রচার করেছিলেন।
.... জীর্ণতরী বিসর্জিয়া নাবিক যেমন
অবহেলে চলে যায়, না করে শোচণ,
নবদ্বারে যেই দেহে ক্লেদ অবিরাম
করি তাহা পরিত্যাগ হব মুক্তকাম।'
বুদ্ধ শাসনের সংগঠনিক কার্যে অতীব দক্ষতা সম্পন্ন ভদন্ত বুদ্ধরক্ষিত মহাস্থবির বৈল্ল্যার দীঘির পাড় (চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ) পল্লী উন্নয়ন সমিতি গঠনের মাধ্যমে বৌদ্ধ সমাজ ও সদ্ধর্মের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তিনি তাঁর শ্রম এবং মেধার মাধ্যমে বিভিন্ন বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠান সমূহের প্রতিষ্ঠাতা তথা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন-
১) সভাপতি বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভা।
২) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বৈল্ল্যার দীঘির পাড় পল্লী উন্নয়ন সমিতি।
৩) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ভিক্ষু প্রশিক্ষণ এবং সাধনা কেন্দ্র, কদলপুর (বাংলাদেশ)
৪) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং উপদেষ্ঠা অমলেন্দু ফাউণ্ডডেশন, কদলপুর।
৫) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং উপদেষ্ঠা প্যারীমোহন সুমনতিয্য দুঃস্থ অনাথালয় (কদলপুর)
৬) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সংঘরাজ ভিক্ষু মহামণ্ডল ধর্মীয় শিক্ষা পরিষদ।
৭) প্রধান উপদেষ্টা দি বুড্ডিষ্ট কো-অপরোটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন, কদলপুর।
৮) চেয়ারম্যান বাংলদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহামণ্ডল বিচার নিরসন বোর্ড।
৯) পরিচালন পর্ষদ সদস্য আধার মানিক উচ্চ বিদ্যালয় (২ বৎসর)।
১০) পরিচালন পর্ষদ সদস্য পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি (চট্টগ্রাম) (২ বৎসর)।
১৯৮১ সালে তিনি পূর্ব বাংলার মুক্তিযুদ্ধে (অধুনা বাংলাদেশ) নির্যাতিতদের আশ্রয় এবং সহায়তা প্রদান কার্যে আত্মনিয়োগ করে প্রশংসিত হয়েছিলেন।
'মনুষ্যত্ব, পুরুষত্ব, শাপ্তাদরশন, প্রব্রজ্যা, অর্হত্ব প্রাপ্তি হেতুরূপ ধন, ঋদ্ধিবল-অধিকার, ছন্দ-সমাবেশ, জীবন উৎসর্গ যাঁর বুদ্ধের উদ্দেশ, এই অষ্টগণ সেবা করে অধিগম, সার্থক প্রার্থনা তার, সফল জনম।
মহাতাপস বুদ্ধরক্ষিত মহাস্থবির মহাপ্লাবনে একাকার চক্রবালের একপ্রান্ত হতে অপর প্রান্তে বাহুবলে সাঁতার কেটে পাড়ি দিতে সক্ষম ছিলেন, বংশলতায় সমাচ্ছন্ন বিশাল ব্রহ্মাণ্ডের দুশ্ছেদ্য বংশজটা অপসারিত ও পদদলিত করে যিনি আপনার গমন পথ করে যেতে সক্ষম ছিলেন, তিনি সুতীক্ষ্ম ধারযুক্ত অস্ত্রশাস্ত্রে পরিপূর্ণ সুবিশাল ধরণীবক্ষের উপর দিয়ে নগ্নপদে গমন করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং তিনি প্রজ্বলিত অঙ্গার পূর্ণ চক্রবালের উপর দিয়ে পদব্রজে গমন করতে সমর্থ হয়েছিলেন এই অর্থে তিনি হয়ে উঠেছিলেন মঞ্চ অভিজ্ঞা এবং অষ্ট সমাপত্তি লাভের অধিকারী।
অর্থাৎ তিনি উপরোক্ত কোনটিকে দুঃসাধ্য মনে না করে এই সব দুরতিক্রম বাধাকে অতিক্রম করে সুবিশাল ব্রহ্মাণ্ডের পরপারে উপনীত হওয়ার নিমিত্তে সকল ইচ্ছাশক্তি, অসীম উৎসাহ, দৃঢ়বীর্য ও অমানুষিক চেষ্টা প্রভৃতি গুণের অধিকারী হয়েছিলেন।
'এত ন্যূন বুদ্ধগুণ কভু নাহি হয় অধিক কি আছে আর জানিব নিশ্চয়, আপনারে নিয়োজি হইনু অগ্রসর, জন্মান্তর চক্র হতে মুক্তির লাগিয়া কারারুদ্ধ নরসম ছিলাম জাগিয়া।
১৯৯৪ সালের ২৮ জানুয়ারী ভান্ত বুদ্ধরক্ষিত মহাস্থবির বাংলাদের বংশরাজ ভিক্ষু মহাসভার দ্বারা মহাস্থবির উপাধি লাভ করেন। সর্বোপরি এই মহান ভিক্ষু যে সকল উপাধি লাভ করেছিলেন-
১। ২০১৪ সালের ৬ জুন বাংলাদেশে ভিক্ষু মহাসভা কর্তৃক জ্ঞাননিধি উপাধি।
২। ২০২০ সালে জ্ঞানসেন বুড্ডিষ্ট ভিক্ষু ট্রেনিং সেন্টার কর্তৃক 'জ্ঞাননিধি' উপাধি।
৩। বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভা দ্বারা প্রদত্ত মহামান্য সংঘরাজ ও মহামৈত্রী উপাধি লাভ।
৪। শিক্ষিকা স্মৃতি বড়ুয়া ও ড. অনিমেষ বন্ধুয়া মেমোরিয়াল ফাউণ্ডেশন কর্তৃক 'শ্রেষ্ঠ শিক্ষক' সম্মান তথা উপাধি লাভ।
'যে জন আচরে ধর্ম হয় নিষ্ঠাবান অপ্রমেয় পুণ্যলাভ, শান্তি অধিষ্ঠান, ধর্ম-পথে শুদ্ধ যার অন্তর বাহির তার তরে নাহি কোন হেতু অশান্তির।'
তিনি মনে করতেন এই অশুচি পূর্ণ দেহ ত্যাগ পূর্বক অনাসক্ত চিত্তে নির্বাণ নগরে প্রবেশ করা উচিত। কারণ এই দেহ ও রত্নপহারী তস্করের ন্যায় কালিমাগ্রন্থ। সুতরাং এতে আসক্তি উৎপন্ন করা কোনও ভাবেই সমীচীন নয়। আর যদি আসক্তি উৎপন্ন হয় তাহলে আর্যমার্গ কুশলধর্ম রূপ এক লহমায় বিনষ্ট হয়ে যাবে।
'দুর্গন্ধ অশুচিশূন্য ঘৃণ্য শবভার চলিব সম্মুখপানে করি পরিহার, নানা আবর্জনা ভরা এদেহ আকর ত্যজিয়া আপনপথে হন অগ্রসর। জীর্ণতরী বিসর্জিয়া নাবিক যেমন অবহেলে চলে যায়, না করে শোষণ, নবদ্বারে সেই দেহে ক্লেদ অবিরাম করি তাহা পরিত্যাগ হব মুক্তকাম।'
আমার দৃষ্টিতে এই শাসনভাস্কর সম্যক বুদ্ধপুত্র শ্রদ্ধেয় শিক্ষাচার্য ভন্তে বুদ্ধরক্ষিত মহাস্থবির সদ্ধর্মনুরাগী, বিচক্ষণ ভিক্ষু এইরূপ মহান ব্যক্তির জন্ম পৃথিবীতে সত্যই দুর্লভ। চমরী মৃগ যেমন জীবনের মায়াকে তুচ্ছঙ্গন করেও কষ্টকাবাদ স্বীয় লাঙ্গুলকে রক্ষা করে তদ্রুপ তিনিও জীবনের প্রতি মমতা না রেখে শীলপারমী পূর্ণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। তিনি বারংবার বলতেন, 'সামনে কিংবা অল্পমানে সবাবস্থায় ক্ষমাশীল হওয়া উচিত। যেমন পৃথিবীতে শুচি বা অশুচি পদার্থ প্রশিক্ষণ হলেও তদ্দেতু পৃথিবী তৎপ্রতি স্নেহ কিংবা ঘৃণাভাব কোনটাই ঘোষণা করে না, সকল কিছুই সমানভাবে গ্রহণ করে সহ্য ও ক্ষমা করে ঠিক সেই ভাবেই বুদ্ধ শাসনে নিজেকে উৎসর্গ করা উচিত।
'জন্মিলে মরণ যেমন সুনিশ্চিত, বুদ্ধবাণী চিরন্তন নহে বিপরীত রাত্রিশেষে নিশ্চিত যেমন সূর্যোদয়, বুদ্ধবাক্য সেইরূপ ব্যর্থ নাহি হয়।'
তিনি সকল সময় আমাকে পুত্রজ্ঞানে স্নেহ করতেন। সর্বোপরি তাঁর সান্নিধ্য লাভ করে আমি অতিশয় উপকৃত হয়েছি। বৌদ্ধ সমাজ সদ্ধর্মের উন্নয়নে নিবেদিত এই মহান ভিক্ষু আজীবন ভিক্ষু সংঘ এবং উপাসক উপাসিকার স্বার্থে সবর্দা গুরুত্ব পূর্ণ আদেশ পালন করেছেন। তাঁর প্রতি সেবা প্রদান করে আমি অতিশয় তৃপ্ত হয়েছি। কারণ তাঁর ন্যায় মহান ভিক্ষুর সান্নিধ্য লাভ এই জগতে অত্যন্ত দুর্লভ। পরিতাপের বিষয় এই যে মহাতাপস উপসংঘরাজ বুদ্ধরক্ষিত মহাস্থবির মহোদয় গত ২০২০ খ্রীঃ ৩০ এপ্রিল আনাপান বায়ু ত্যাগ করেন। তাঁর এই মহাপ্রয়ান বুদ্ধ শাসনের অপরিমেয় ক্ষতি। কারণ তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক এবং পরিচালক। তাঁর ন্যায় আদর্শ ভিক্ষু বাংলাদেশের বৌদ্ধ ইতিহাসে সত্যই দুর্লভ। আমি তাঁর প্রতি আভূমি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।
No comments:
Post a Comment