সুমনপাল ভিক্ষু
এক
একটি মহীরূহ, মাথা যার আকাশে ঠেকেছে—সুনীতিকুমার পাঠক। বৌদ্ধজ্ঞানের সংরক্ষণ সংস্কৃতি কী রকম? কীভাবে তা স্মৃতি থেকে অক্ষরবদ্ধ করা হয়েছে? পুথির পাতায় লিপিবদ্ধ সেই জ্ঞান মনাস্ট্রির গ্রন্থাগারে গ্রন্থাগারে সঞ্চিত হয়ে কীভাবে তা শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে জ্ঞানার্থীদের তৃষ্ণা নিবারণ করেছে? যা হারিয়ে যাওয়ার কথা ছিল তা কীভাবে দেশে দেশান্তরে রূপে রূপান্তরে প্রবাহিত হয়ে চলেছে?—এইসকল প্রশ্ন স্রোতের সমাধান ছিলেন ‘জীবন্ত অভিধান’ স্বরূপ সুনীতিকুমার। উদার ও ছাত্র বৎসল সুনীতিকুমার অনর্গল শ্লোকের পর শ্লোক, শাস্ত্রের পর শাস্ত্র বলে যেতেন। তিনি জ্ঞানবৃদ্ধ—জ্ঞানের পরিমাপে ও বয়ঃক্রমে। মানসিক ও শারীরিক সামর্থ্যে চিরতরুণ জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি তরুণের মতো গবেষণায় উৎসাহী ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে নম্র স্বভাবের মানুষ সুনীতিকুমারের কাছে সকলের অবারিত দ্বার। অধ্যাপক পাঠকের কাছে যখনই গেছি, তখন তিনি তাঁর বিদ্যার ভাণ্ডার উজার করে দিয়েছেন। তাঁকে দেখে মহাসমুদ্রের মত অতলান্ত জ্ঞানের গভীরতার অনুভুতিতে বিস্ময়বিমুগ্ধ হয়েছি। তাঁর মধ্যে এইটুকু ক্লান্তির অবসাদ দেখিনি কিংবা কোন কার্পণ্য দেখিনি। সস্ত্রীক সুনীতিকুমার আমায় সন্তান-স্নেহ করতেন। স্যারের পরামর্শেই অনেকটা পথ পারি দিতে পেরেছি। সেটা লেখালেখি হোক, প্রকাশনা হোক, সম্পাদনা হোক, সেমিনারে যোগদান হোক—তাঁর নির্দেশিত মার্গেই সব শাখায় বিচরণ করতে পেরেছি।
মহামহোপাধ্যায় ‘আচার্য’ সুনীতিকুমার পাঠক ছিলেন একজন মহান বৌদ্ধপণ্ডিত এবং তিব্বতি ভাষাবিদ। বৌদ্ধসাহিত্য তথা দর্শনের গৌরবময় ঐহিত্যকে আচার্য পাঠক তাঁর গবেষণালব্ধ প্রমাণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। উনিশ শতকে বাংলা ভাষায় বৌদ্ধচর্চা বিকাশের ক্ষেত্রে বঙ্গীয় মনীষীদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, বিধুশেখর ভট্টাচার্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ধর্মাধার মহাস্থবির, বেণীমাধব বড়ুয়া প্রমুখ। এই সকল মহামেধাসম্পন্ন আচার্যদের পূর্বে আমরা প্রাচীন মধ্যযুগের বৌদ্ধকবি রামচন্দ্র কবিভারতীর সন্ধান পাই। তবে একটা সময়ে মনে হয়েছিল এমন ক্ষমতাসম্পন্ন বৌদ্ধ পণ্ডিতবর্গ হয়তো আর এ বঙ্গে জন্মগ্রহণ করবেন না। আর ঠিক তখনই বঙ্গের আকাশে বিংশ শতাব্দীতে সুনীতিকুমারের আবির্ভাব। বাংলার এই কৃতি সন্তান ১৯২৪ সালের ১ মে বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার মলিঘাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মাতৃহারা সুনীতিকুমারের শৈশব জীবন অতিবাহিত হয় মাতুলালয়ে। স্নাতক এবং উচ্চশিক্ষা কলকাতার সংস্কৃত কলেজ এবং পরবর্তী সময়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিব্বতি ভাষাবিদ সুনীতিকুমার ১৯৫৪ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। ওই বছরেই তিনি এবং অধ্যাপক সি. আর. লামার তত্ত্বাবধানে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে ওঠে ভারত-তিব্বত চর্চার নতুন বিভাগ ইন্দো-টিবেটান স্টাডিজ। তবে তিনি অধ্যাপনার পাশাপাশি বিদ্যাশিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে চলার অভিপ্রায়ে চীনাভাষা শিখতে চিনাভবনে ভর্তি হয়েছিলেন। তিনি বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধের প্রকৃত শিক্ষক ছিলেন। বাংলার জিজ্ঞাসু পাঠককে তিনি অনেকগুলি মূল্যবান বৌদ্ধগ্রন্থ উপহার দিয়েছিলেন, যে সকল গ্রন্থ অনেককাল ধরে বাংলা সাহিত্যের জগতকে সমৃদ্ধ করবে। সুনীতিকুমারের বৌদ্ধিক গুণাবলীসমূহ কত বিচিত্র পথে ছড়িয়ে পড়েছিল, তা তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহে বৌদ্ধসাহিত্যের সমাবেশ দেখে উপলব্ধি করা যায়।
শতবর্ষ অতিক্রান্ত হয়েও সুনীতিকুমার পাঠক ভাষাচর্চা ও গবেষণা বিষয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। তাঁর অসামান্য প্রতিভার স্বকৃতিস্বরূপ ২০০৯ সালে তাঁকে ভারত সরকার রাষ্ট্রপতি পুরস্কারে ভূষিত করেন। ২০১৮ সালে তিনি বিশ্বভারতীর সর্বোচ্চ সম্মান ‘দেশিকোত্তম’ লাভ করেন। এছাড়াও পালি সুত্তবিশারদ স্বর্ণপদক, পুরাণরত্ন স্বর্ণপদক, মঞ্জুশ্রী পুরস্কার, এশিয়াটিক সোসাইটি ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদসহ নানা সম্মাননাতেও তিনি ভূষিত হয়েছেন। গবেষণার পাশাপাশি নিজের শব্দজ্ঞানকে দেশসেবার কাজেও আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ১৯৬১ সালে তিনি ভারত সরকারের অনুরোধে সেনাবাহিনীর চিনা-তিব্বতি ভাষার অনুবাদক হিসেবে যোগদান করেন। দুশোর বেশি প্রবন্ধ-নিবন্ধের রচয়িতা সুনীতিকুমার বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, পালি, সংস্কৃত, প্রাকৃত, তিব্বতি, চিনা এবং মঙ্গোলিয়া ভাষা অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। প্রতি ভাষাতেই তিনি নিজের লেখক সত্তার উৎকৃষ্ট পরিচয় প্রদান করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে স্মর্তব্য—
সত্ত্বেষু সমতাজ্ঞানং ভাবনাশুদিতোঽমতম্।
অপ্রতিষ্টসমাবিষ্টং সমতাজ্ঞানমিষ্যতে।।
—যোগসূত্রালংকারম্
অর্থাৎ, সত্তাগুলির মধ্যে সমতার জ্ঞান, যা ভাবনার দ্বারা শুদ্ধ হয়ে থাকে, যে জ্ঞান স্থিরতা বা প্রতিষ্ঠার অভাব নিয়ে অধিষ্ঠিত, তা সমতার জ্ঞান হিসেবে অভিহিত হয়। সমতার জ্ঞান এবং তার শুদ্ধতা বা স্থিতিশীলতা অনুসারে সমতার জ্ঞানকে সঠিকভাবে শুদ্ধ ও প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। দৈনন্দিন জীবনাচরণে প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে কীভাবে আত্মস্থ করতে হয়, সুনীতিকুমারের আজীবনের সাধনার মধ্যে ছিল সেই অন্বেষণ। সেই পথের সন্ধানেই একসময় তিনি থিতু হয়েছিলেন বৌদ্ধমতে। তাত্ত্বিকভাবে যে বুদ্ধের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন, তাঁকে সম্যক উপলব্ধির জন্য প্রয়োজন বুদ্ধের পথে নিবিড় অবগাহন। ১৯৭২ সালে সুনিতিকুমার অরুণাচল তাওয়াঙ গুন্ফায় গ্যা-লুক-পা নিকায়ের আচার্যের কাছে দীক্ষা নিয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে গভীর চর্চা তাঁকে হিমালয়ের দুর্গম অঞ্চলে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। তিনি বহু দুষ্প্রাপ্য মূল্যবান পুঁথি সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁর জন্যেই পুঁথির পাশাপাশি ভাষা সংগ্রহের কাজ পুষ্ট হয়েছিল। অধ্যাপক তেনজিন শেডুপের মতে ভারতে বর্তমানে যে দুইজন টিবেটোলজিস্ট রয়েছেন, তাদের মধ্যে একজন সুনীতকুমার পাঠক, অন্যজন লোকেশ চন্দ্র। সুনীতিকুমার দীর্ঘদিন সেন্টার অফ হায়ার টিবেটান স্টাডিজের বোর্ড সদস্যও ছিলেন। ১৯৯০-৯১ সাল থেকে দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর তিনি উক্ত বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। অধ্যাপক শেনডুপ তেনজিন আরও বলেছেন—“আমি একজন এমন ভারতীয়কে দেখেছি, যিনি অত্যন্ত সাবলীলভাবে তিব্বতি ভাষায় কথা বলতে এবং লিখতে পারতেন। এই বিষয়টি আমাকে অত্যন্ত বিস্মিত করেছিল।” এই প্রসঙ্গে স্মর্তব্য—
সঙ্কেতধর্ম তালব্দং সংবরস্থেযু বিদ্যতে।
শীলমেবং পরিদানায় পণ্ডিতঃ সমুজ্ঞায়েত্।।
—যোগসূত্রালংকারম্
অর্থাৎ, সংকেতের ধর্ম তালাবদ্ধ থাকে এবং সংবরণের মধ্যে বিদ্যমান থাকে। পণ্ডিত ব্যক্তি শীল দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে নির্দেশ প্রদান করে। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৮৬ সালের অবসর গ্রহণ পর্যন্ত তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। সর্বোপরি তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৌদ্ধবিদ্যা অধ্যয়ন বিভাগেও দীর্ঘদিন অতিথি অধ্যাপকরূপে যুক্ত ছিলেন। তিনি স্বীয় অধীত প্রখর বিদ্যাবত্তার প্রভাবে আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর বহুল সমাদৃত গ্রন্থসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—ইন্ডিয়ান নীতিশাস্ত্রস্ ইন টিবেট্ (১৯৭৪), এ বাইলিঙ্গুয়াল গ্লোসারি অফ দ্য নাগানন্দ (১৯৬৮), বুদ্ধিজম্ ওয়ার্ল্ড গ্রীস্ এ হারমোনি (২০১১), দ্য এ্যালবাম অফ দ্য টিবেটান আর্ট কালেকশনস্: কালেকটেড্ বাই পণ্ডিত রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন ফর্ম দ্য নোর, ঝালু, এ আদার (১৯৮৬), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্বাচিত কবিতার তিব্বতি রূপান্তর প্রভৃতি। তিনি সম্পাদনা করেছেন এ ডেক্রিসটিভক্যাটালগ অফ দ্য টিবেটান লাসা (ঝোল এডিশন)।
মাত্র কিছু সময়কাল পূর্বেও এমন একজন তিব্বতি এবং চিনা ভাষায় বুৎপন্ন বহুভাষাবিদ এবং বৌদ্ধপণ্ডিত এই বাংলায় জীবিত ছিলেন ভাবলেই অবাক হতে হয়। অধ্যাপক পাঠক কথা বলতে বলতে প্রবেশ করে যেতেন শব্দের গভীরে। এই প্রসঙ্গে স্মর্তব্য—
মুনিবিহিত সুধর্মসুব্যবস্থো, মতিমুপনিধায় সমূলধর্মধাতৌ।
স্মৃতিগতিস্বগম্য বল্পমাত্রাং, ব্রজতি গুণার্ণবপারমাশু ধীরঃ।।
—পরমার্থজ্ঞানমাহাত্ম্যম্
অর্থাৎ, মুনির নির্ধারিত সঠিক ধর্মব্যবস্থা বুদ্ধি সংযুক্ত করে মূলধর্মের মূলভূমিতে। স্মৃতিগত পথ অনুসরণ করে সামান্য পরিমাণে গুণের মহাসাগরের পাড়ে দ্রুত পৌঁছে যায় ধীর ব্যক্তি।
মৌখিক আলাপচারিতায় অধ্যাপক সুনীতিকুমার বলতেন—“মার্গ’ কথাটা এসেছে ‘মৃগ্’ ধাতু থেকে। তার থেকেই মৃগ বা হরিণ। আবার তার থেকেই মৃগয়া বা শিকার। অর্থাৎ শিকারী যেমন হরিণ খুঁজে বেড়ায়, বুদ্ধ বলতেন—তোমরা তেমনি করে জীবন খুঁজে বেড়াও। বলতেন, আমি তোমাদের মধ্যমার্গ প্রতিপদ দিচ্ছি। চন্দ্রকলার মতো প্রতিপদ থেকে একটু একটু করে মধ্যমায়; অর্থাৎ পূর্ণিমায় উত্তরণের সাধনার সুলুক-সন্ধান দিয়েছিলেন বুদ্ধ।” তিনি আরও গভীর অথচ সহজ সরলভাবে বুঝিয়ে দিতেন—“বুদ্ধ মতের ‘তন্ত্র’ মানেও তুকতাক, ঝাড়ফুক বা কালাজাদু নয়। বুদ্ধ এসবে বিশ্বাস করতেন না। বুদ্ধ বলতেন, জলের ওপর তোমাকে হাঁটতে হবে না, তার জন্য নৌকা আছে। ‘তন্ত্র’ আধুনিক কায়বিজ্ঞান, অর্থাৎ ফিজিওলজি আর মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। এর মূল কথাটা হল সবার সঙ্গে সমতার অনুভব। একটা কসমিক হারমনিকে অনুভব করার কথা বলে তন্ত্র। এটাকে অনুভব করা হল ‘সহজ’-এরও সাধনা। বুদ্ধ কার্যকারণ নিয়মে বিশ্বাস করতেন। ‘কর্মফল’ কথাটা এখানে প্রচলিত অর্থের ‘অদৃষ্ট’ নয়। ‘কর্ম’ হল কার্যকারণ পরম্পরা। জগতের প্রবাহধর্ম আছে বলেই ‘কর্মফল’ কথাটা ভারতীয় মনে খুব গভীরে রয়ে গেছে। জগতে দুঃখ আছে, এবং সেই দুঃখের হেতু আছে—গৌতমবুদ্ধ বস্তুত প্রয়োগবাদী বলেই বৈজ্ঞানিকের মতো অনুসন্ধান করেছিলেন সেই জাগতিক দুঃখের কার্যকারণ সম্পর্ক। জন্ম থেকে পুর্নভব পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত একটা কার্যকারণের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে আছি সবাই। কার্য আর কারণ মিলে গিয়ে তৈরি হয় একটা আলাদা রকমের দেশ-কাল সন্ততি, মানে প্রবাহ। বিজ্ঞান হয়তো এই কথাটাই বলবে, কিন্তু বলবে তার নিজস্বভাবনায়।”
অধ্যাপক সুনীতিকুমার পাঠকের সাধনার অভিমুখ পর্যালোচনা করলে সেই সূচনাকালের জ্ঞানতীর্থ বিশ্বভারতীর প্রতিবিম্ব খুঁজে পাওয়া যাবে। ‘বৌদ্ধদর্শন’ কথাটা অবশ্য তিনি ব্যবহার করতেন না। বিকল্পে তিনি ব্যবহার করতেন ‘বুদ্ধমত’ বা ‘বুদ্ধজীবনদৃষ্টি’ বা ‘শুদ্ধিতার জীবন প্রণালী’ শব্দ। তিনি বলতেন—“বুদ্ধের মত অনুধাবনের জন্য প্রয়োজন তার প্রায়োগিক চর্চায় অবগাহন।” বিশ্ববিভারতী অধ্যাপনা কার্য সম্পাদনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি একজন আজীবন গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন। যুক্ত ছিলেন কলকাতার বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভা সঙ্গে। এই প্রসঙ্গে স্মর্তব্য—
উৎপত্তিবাচিত্তশুভাশুভাধি-তৎস্থাননিঃ সারপদা পরোক্ষম্।
জ্ঞানং হি সর্বত্রগসপ্রভেদে-ষবব্যাহতং ধীরগতঃ প্রভাবঃ।।
—স্বভাবার্থশ্লোকম্
অর্থাৎ যার সৃষ্টি ও গুণের মাধ্যমে শুভাশুভের সৃষ্টি হয়, সেই ব্যক্তি তার স্থান থেকে সমস্ত কর্মের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। জ্ঞান সর্বত্র বিরাজিত থাকে এবং তার প্রভাব ধীরভাবে এবং সঠিকভাবে প্রকাশ পায়। এই শ্লোক অনুযায়ী গুণ, কর্ম এবং জ্ঞানের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে, যেখানে জ্ঞান সর্বত্র বিরাজমান এবং এর প্রভাব সঠিকভাবে পরিচালিত হয়।
অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বৌদ্ধগবেষক সুনীতিকুমার পাঠকের তিব্বত গ্রন্থের ভূমিকায় সম্পর্কে অত্যন্ত সাবলীল মন্তব্য প্রদান করেছেন—“প্রীতিভাজনেষু শ্রীমান সুনীতিকুমার পাঠক তিব্বত সম্পর্কিত যে ক্ষুদ্র পুস্তকখানি লিখিয়াছেন তা তথ্যপূর্ণ এবং সময়োপযোগীও বটে।....তিব্বত এ পর্যন্ত যা ছিল, তার একটি আলেখ্য তিনি এই পুস্তকে প্রদান করতে সচেষ্ট হয়েছেন।” তিব্বত কৃশকায় গ্রন্থ হলেও, এতে তিব্বতের ইতিহাস ও জীবনের মুখ্য বিষয়গুলি সহজবোধ্য ভাষায় লিখিত হয়েছে। গ্রন্থকার তিব্বতি ভাষা, লামাতন্ত্র, ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রে গভীর ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে স্মর্তব্য—
চারেনাধিগমেনাশি জ্ঞানেনাপি চ কর্মনা।
—সর্বভূমিক সূত্র
অর্থাৎ, চারেণের অধিগমে নাশ, জ্ঞানেও কর্মণায়ও। অধ্যাপক পাঠক ছিলেন আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সঙ্গে আমার পিতা-পুত্রের মতো সখ্য গড়ে ওঠে। তাঁর সঙ্গে ২০০১ সালে প্রথম সান্নিধ্য লাভ করি, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগের সেমিনারে। তারপর ২০০৬ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা বিভাগে তিব্বতি ভাষা শিক্ষার সুবাদে তাঁর নৈকট্য লাভ করেছি। সেই থেকে তাঁর কাছে অবাধ গমনাগমন। ২০০৭ সালে ইন্দো-টিবেটান স্টাডিজ বিভাগে সেমিনার যোগদান এবং সেই সেমিনার প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্রের পালি অনুবাদ করে গবেষণাপত্র পাঠ করাতে তিনি আমাকে আরও নৈকট্য দান করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। এছাড়াও ২০১২ সালে একই বিভাগে সেমিনারে যোগদান করেছি সেখান ‘যোগাচার বিজ্ঞানবাদ’ নিবন্ধ পাঠ তাতেও তিনি গবেষণাপত্রের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। পালিভাষায় ধ্যানকে বলে ‘ঝান’। তাঁর মতে—“ঝান মানে আগুনে পুড়িয়ে শুদ্ধ হওয়ার মতো একটা ব্যাপার। যাবতীয় অবিদ্যা নিরোধ করার জন্য একটা প্রক্রিয়া হল ‘ধ্যান’।” পরবর্তীকালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ ২০১৪ সালে পর পর দু-বার তাঁর সঙ্গে প্রজ্ঞাপারমিতা পুঁথির উপর কাজ করা এবং পাঠোদ্ধার ও রক্ষণাবেক্ষণ সেই সুযোগ লাভ করেছি। তাঁর জ্ঞানের বিষয়টি অত্যন্ত সুবিশাল মরুভূমির ন্যায় আদিগন্ত বিস্তৃত। এই প্রসঙ্গে স্মর্তব্য—
সর্বাগ্ সত্ত্বাঁস্তারপিতুং স প্রতিপন্নো।
যানে জ্ঞানে সর্বগতে কৌশল্যমুক্ত।।
—সর্বত্রগাথা
অর্থাৎ, সকল সত্তাকে তার পিতারূপে গ্রহণ করা উচিত, এবং যে ব্যক্তি জ্ঞান দ্বারা সর্বত্র একাকার হয়ে যায়, সে মুক্ত হয়ে যায় সব কৌশল থেকে। এই শ্লোকটি জ্ঞান ও কর্মের মাঝে সম্পর্ক বোঝায়, যেখানে ব্যক্তি জ্ঞান দ্বারা পৃথিবী ও সত্তার প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে এবং কৌশলমুক্ত হয়ে সত্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। অধ্যাপক পাঠক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি সহজভাষায় জিজ্ঞাসু ছাত্র-ছাত্রীর প্রতি সহজসরল উপস্থাপন করতেন। তিনি ছিলেন এক অর্থে অভিভাবক। তিনি মনে করতেন শিক্ষা প্রদানের বিষয়গুলি জটিলতা মুক্ত হওয়াটায় শ্রেয়। তিব্বতি ভাষা শিক্ষার বিষয়ে তিনি আমাকে নানাভাবে সহায়তা প্রদান করেছিলেন। কর্মতাপস সুনীতিকুমার বৌদ্ধবিদ্যা এবং তিব্বতি ভাষার টানে তাঁর আধ্যাত্ম মানসজ্ঞানকে বিকশিত করেছিলেন। এই অর্থে তিনি ছিলেন ধ্রুবস্মৃতি, অর্থাৎ প্রকৃত জ্ঞানের অধিকারী। আমি আমার শিক্ষাজীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তাঁর সান্নিধ্যলাভ করেছি। আকাশের মতো নির্মল এবং স্বচ্ছ শতবর্ষী সুনীতিকুমার সারস্বত চর্চায় জীবনের প্রায় শেষদিন পর্যন্ত নিয়োজিত ছিলেন। ১০১ বছর বয়সী এই পণ্ডিতের প্রয়াণে ভারত-তিব্বত চর্চার ও বাংলার শিক্ষাজগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। তাঁর গভীর প্রজ্ঞার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁকে নিয়ে আরো গবেষণা হোক। বাঙালি মেধাজগতে তিনি ক্রমশ স্পষ্টতর জ্যোতিষ্ক হয়ে উঠুন।
দুই
অধ্যাপক সুনীতিকুমার পাঠকের তিব্বত গ্রন্থটি ১৮৮১ শকাব্দে রচিত। গ্রন্থের তথ্যপ্রকাশ অংশে প্রকাশকালের ক্ষেত্রে ইংরেজি সাল দেওয়া না হলেও গ্রন্থের ভূমিকাতে ১৯৬০ সালের উল্লেখ দেখা যায়। অধ্যাপক পাঠক বলেছেন—“ভোট তথা তিব্বতের সংস্কৃতি ও তার বিভিন্ন আঙ্গিক বিষয় জানার প্রভূত প্রয়োজন আছে। তিব্বতের ভাষা-সাহিত্য-ধর্ম-ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজব্যবস্থা ইত্যাদির ভিতর দিয়ে তিব্বতের সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ হচ্ছে। সুতরাং তিব্বত ও তিব্বতিদের সম্পর্কে অধ্যয়ন ও গবেষণা করে যা কিছু উপাদান সংগ্রহ করতে পেরেছি তা সংক্ষেপে সাধারণের উপযোগী করে এই গ্রন্থে (তিব্বত) লিপিবদ্ধ করতে চেষ্টা করেছি।” তিব্বত গ্রন্থটির রচনার ক্ষেত্রে তিনি শ্রদ্ধাপদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, নলিনাক্ষ দত্ত প্রমুখ ব্যক্তির নাম কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গ্রন্থকার স্মরণ করেছেন। গ্রন্থটির বিষয় ইত্যাদি অতি স্পষ্ট—অবতরণিকা, তিব্বতের নামকরণ, ভৌগোলিক অবস্থিতি, ঐতিহাসিক বিবরণ, প্রাচীন জনতত্ত্ব, ভাষা সাহিত্য, ধর্ম-সমাজজীবন, শিল্প ও চিত্রকলা, লোকগীতি ও নৃত্য, চিন-তিব্বত রাজনৈতিক সম্পর্ক, চিন-তিব্বতি জনসংযোগ, ভারত-তিব্বত রাজনৈতিক সম্পর্ক, তিব্বতি ও ভারতীয় জনসংযোগ, ভোট উপজাতি এবং তিব্বতের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা। পরিশিষ্ট চারটি ভাগে বিভক্ত, যেমন—তিব্বতি রাষ্ট্রের লামাতন্ত্র, তিব্বতি বর্ণের বাঙলা প্রতিবর্ণীকরণ, তিব্বতি রাজবংশাবলী এবং টীকা ইত্যাদি।
তিব্বত গ্রন্থের অবতরণিকাতে একটি বিষয় অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে যে ‘তিব্বত’ বর্তমানে কালে প্রাচীন লাল প্রজাতন্ত্রের (গণপ্রজাতন্ত্রী চিন) একটি বিশেষ অঞ্চল। তবে ভৌগোলিক অর্থে ভারত ও তিব্বত পাশাপাশি দুইটি দেশে ইংরাজিতে এর অর্থ ‘সিস্টার কানট্রি’। তিনি বলেছেন—“কোন দেশের পরিচয় জানতে গেলে যেমন সে দেশের অবস্থিতি নৈসর্গিক তথ্য জানতে হবে তেমন সে দেশের জনমানসের অন্তর্গত ও ভাবসমীদের কথা অবধান করতে হবে। এক কথায়, সে দেশের সংস্কৃতি আজ যেভাবে দেখছি তা হলো কয়েকটি প্রতিবেশী জাতির বিমিশ্র সংস্কৃতির এক রূপান্তর মাত্র।” তিব্বতের নামকরণ প্রসঙ্গে এই গ্রন্থে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সুদৃঢ় তথ্য পাওয়া যায়। যেমন, প্রাচীনকালে ভারতীয় সাহিত্যে তিব্বতকে ‘ভোট’ দেশ বলা হয়েছে, আর ভোটদেশের অধিবাসীরা ছিলে ভোট্ট। কোন কোন পণ্ডিতের মতে ‘বোদ’ কথার সঙ্গে সংস্কৃত ‘ভোট’ শব্দের মিল আছে। তাঁরা অনুমান করেন তিব্বতিরা তিব্বতকে ‘বোদ’ বলে যে নামকরণ করেছে তা আসলে ভারতীয় ‘ভোট’ শব্দের বিকার মাত্র (ভোট> ভোত, বোত্ > বোদ)। তিব্বত শব্দটি সম্ভবত ‘স্তোদ্-বোদ’ থেকে এসেছে বলে কেউ কেউ মনে করেন (তোদ্-বোদ্, তোঅ বোদ, তো বোত্ > তিব্বত)।
অন্যদিকে মধ্যযুগের ঐতিহাসিক ও ভূ-পর্যটকগণ তিব্বত কথাটি নানাভাবে ব্যবহার করেছেন। বেঞ্জামিন (দ্বাদশ শতক)—থিবেট। মার্কোপোলো (ত্রয়োদশ শতক)—টেবেট। রু ব্রু কুইস্ (ত্রয়োদশ শতক)—টেবেট। প্ল্যানো কারপিনি (ত্রয়োদশ শতক)—থবেট। ইবনেবতুতা (চতুর্দ্দশ শতক)—থবট। আবার বাংলা ভাষায় থুব্বেত (থুব্বেট) থেকে তিব্বত শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু চিনা প্রাচীন গ্রন্থে থু-বট্, থু-মো-টে, থিয়ে-বু-টে, থু-বো-টে ইত্যাদি। বিভিন্ন শব্দানুকরণে খ্রিস্টিয় পঞ্চম—দ্বাদশ শতক পর্যন্ত শব্দ প্রচলিত ছিল। অন্যদিকে মোঙ্গলীয় ভাষাতে অনুরূপ ভাবে থুয়ে বেট, তো-বো-তো-ট প্রভৃতি শব্দে তিব্বতের কথা বোঝানো হয়েছে। তিব্বতের ভৌগোলিক চিত্রটি অত্যন্ত বিচিত্র রূপেই প্রতীয়মান হয়। এক অর্থে তিব্বতের ভূখণ্ডটি হিমালয় এর পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত চিন ও ভারতের তুলনীয় তিব্বতের আয়তন কম হলেও নিতান্ত ছোট নয় প্রায় বারো লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। তবে একথা বলতে অত্যুক্তি হয় না যে আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা অতি সামান্য। তিব্বতে বিস্তীর্ণ কোন নিম্ন সমভূমি দৃষ্ট হয় না। উত্তর তিব্বতের সুবিশাল মালভূমি প্রায় সকল সময় বরফাচ্ছন্ন, কোন জনবসতি নেই বললেই চলে।
খ্রিস্টিয় ৭ম শতকে তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম প্রচারিত হয়। সেই সময় তিব্বতের ইতিহাস প্রসিদ্ধ রাজা ছিলেন স্রোঙ্ ব-চন গাম্ পো। তাঁর সময়কালেই ভারতবর্ষের কাশ্মীর এবং গান্ধার (আফগানিস্থান) থেকে বৌদ্ধধর্ম তিব্বতে প্রবেশ করেছিল। দশম-দ্বাদশ শতকে গৃহযুদ্ধের প্রভাবে রাজতন্ত্রের উচ্ছেদের ফলে তিব্বতের নানা স্থানে অমাত্যতন্ত্র বা গোষ্ঠীপ্রধানের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু অমাত্যতন্ত্রের অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রভাবে তিব্বতে চিন এবং মোঙ্গলদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে ত্রয়োদশ—পঞ্চদশ শতকে তিব্বতে বৌদ্ধ লামাতন্ত্রের অধিকার সুস্পষ্ট হয়। তিব্বতে লামাতন্ত্র ১৯৫০ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। অবশেষে গণপ্রজাতন্ত্রী চিন বা লালচিনা কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৫১ সালে তিব্বতের লামাতন্ত্রকে উচ্ছেদ করে তিব্বত দখল করে নেয়।
অধ্যাপক সুনীতিকুমার পাঠকের মতে, তিব্বতের সংস্কৃতিতে যে বিমিশ্রধারার সম্মিলন দেখা যায়, তার মূলে রয়েছে তাদের রক্তের ভিতর বিভিন্ন শ্রেণীর সংমিশ্রণ। অপরদিকে, তিব্বতি সাধারণের বিশ্বাস এবং কিংবাদন্তি অনুসারে এই তথ্য পাওয়া যায় যে অতি প্রাচীনকালে কোনো এক ও আরেক মহাকায় বানর জাতীয় জীবের মেলবন্ধনে প্রাচীন তিব্বতি জাতির সৃষ্টি হয়েছে। তিব্বতি ধর্মশাস্ত্রে যক্ষিণী ও মহাকায় বানরের মিলনের কথা বলা হয়েছে। ওই যক্ষিণী ছিলেন তারাদেবী, আর মহাকায় বানর জাতীয় জীবটি ছিলেন আর্য অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্ব। আরও একটি কিংবদন্তি কাহিনি তিব্বতি ঐতিহাসিকদের গ্রন্থগুলিতে দেখা যায়। সেই কাহিনি অনুসারে এই তথ্য পাওয়া যায় যে অনেক বছর আগে ভারতবর্ষ থেকে এক রাজা তাঁর অনুচরসহ ভারতে চলে আসেন। তাঁর নাম ছিল রূপতি। তিনি কৌরব এবং পাণ্ডবদের যুদ্ধের সময়কালের সমসাময়িক রাজা ছিলেন। সেই রূপতি এবং তাঁর অনুচরগণের বংশ থেকে তিব্বতের প্রাচীন জনজাতির উদ্ভব হয়েছে। আবার, তিব্বতের প্রাচীন ‘বোন’ ধর্মশাস্ত্র অনুসারে এক সুবৃহৎ ডিম থেকে তিব্বতিদের জন্মের তথ্য পাওয়া যায়। তিব্বতি বৌদ্ধগ্রন্থে এই তথ্য প্রদান করা হয়েছে যে বিম্বিসার অথবা প্রসেনজিতের বংশধর ছিলেন তিব্বতের আদি রাজা। তিব্বতি ইতিহাস পগ্-সম্-জঙ্-সঙ্ অনুসারে, ভারতের হোর জাতির সংমিশ্রণে তিব্বতি জাতিগোষ্ঠীর উৎপত্তি হয়েছে।
তিব্বতি ভাষা চিন-জাপান ইত্যাদির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়। খ্রিস্টিয় শতকে ‘থোন-মি-সম্-ভোট’ নামে এক রাজমন্ত্রী ভারতে আসেন। তিনি এদেশে এসে বৌদ্ধশাস্ত্র ও সংস্কৃত ভাষাশিক্ষা পাঠ সম্পূর্ণ করে তাঁর মাতৃভূমি কাশ্মীরকে তিব্বতি লিপি উপহার দিয়েছিলেন। তবে তাঁদের মাতৃভূমির অর্থাৎ তিব্বতি লিপি সংস্কৃত লিপির প্রভাব মুক্ত হতে পারেননি। তিব্বতি আঞ্চলিক কথ্যভাষায় মোঙ্গল, বর্মী এবং অস্ট্রিক ভাষার প্রভাব পূর্ণ মাত্রায় বজায় আছে। অধ্যাপক সুনীতিকুমার পাঠকের মতে তিব্বতি সাহিত্য শুধুমাত্র সংস্কৃত এবং অপভ্রংশ বৌদ্ধ সাহিত্যের তিব্বতি অনুবাদ নয়। অনুবাদ সাহিত্য ব্যতীত তিব্বতে মৌলিক সাহিত্যের কোনো অভাব নেই। তিব্বতি সাহিত্য মূল অর্থেও তিনভাগে বিভক্ত। যেমন বৌদ্ধ পূর্বযুগের ধর্মীয় সাহিত্য (বোন্ সাহিত্য), বৌদ্ধধর্মীয় সাহিত্য এবং সাধারণ সাহিত্য। প্রসঙ্গত এক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন, বৌদ্ধ অনুবাদ সাহিত্য তিব্বতের সাহিত্যের ইতিহাসের বিপুল অংশ জুড়ে রয়েছে। তিব্বতে বোন্ ধর্মের লোকেরা বৌদ্ধপূর্ব যুগে তাঁদের ধর্মসংক্রান্ত বিষয়গুলি কীভাবে সংরক্ষণ করতেন সেই সম্পর্কে বিস্তর মতভেদ দৃষ্ট হয়। বৌদ্ধ ঐতিহাসিকগণের মতে, বোন্ ধর্মের সাহিত্য বলতে যা পাওয়া যায় তার সিংহভাগ অংশই সপ্তম শতকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
বৌদ্ধসাহিত্য রচনার প্রথম অধ্যায়ে তিব্বতে ভারতীয় বৌদ্ধসাহিত্যের অনুবাদ প্রয়াস অত্যন্ত বেশি ছিল। কারণ ভারতের যে সকল বৌদ্ধভিক্ষু তিব্বতে ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন তাঁরা সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলেন বোন্ ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা। সেই সময় তাঁরা তিব্বতি ভাষায় বৌদ্ধশাস্ত্র অনুবাদে যত্নশীল হন। প্রসঙ্গত মনে রাখা প্রয়োজন চিনা বৌদ্ধগ্রন্থ অনেকক্ষেত্রে ভারতীয় মূল গ্রন্থের আক্ষরিক অনুবাদ নয়। কিন্তু তিব্বতি বৌদ্ধগ্রন্থ ভারতীয় মূলগ্রন্থের আক্ষরিক অনুবাদ। সুতরাং সেই অর্থে বৌদ্ধতন্ত্রের গবেষণার কাজে তিব্বতি অনুবাদ অনেক বেশি ফলপ্রসূ এবং গুরুত্বপূর্ণও বটে। অধ্যাপক পাঠকের তিব্বত গ্রন্থ হেকে অবগত হওয়া যায় যে সপ্তম—ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতক সময়কাল পর্যন্ত এই অনুবাদের কাজ চলেছিল। তার পরবর্তী সময়কালে বৌদ্ধশাস্ত্রের টীকা, ভাষা ইত্যাদি কাঞ্জুর এবং তাঞ্জুর সংকলনে সংকলিত হয়েছে। তবে বৌদ্ধশাস্ত্র ব্যতীত অন্যান্য ভারতীয় গ্রন্থসমূহ যেমন—মহাকবি কালিদাসের মেঘদূত, দণ্ডীর কাব্যাদর্শ, পাণিণীর ব্যাকরণ, অমরসিংহের অমরকোষ, চাণক্যের নীতিশ্লোক এবং অঘোমবর্ষের প্রশ্নোত্তর রত্নমালিকা প্রভৃতি নানা শাস্ত্রের তিব্বতী ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। সুনীতিকুমার তিব্বতি মৌলিক সাহিত্যকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। যেমন—ক) প্রাচীন বা বৌদ্ধাচার্য অতীশ দীপঙ্কর পর্ব এবং খ) অর্বাচীন বা দীপঙ্করোত্তর পর্ব। তিব্বতের বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে তিনি বলেছেন—“এই অঞ্চলের বৌদ্ধধর্ম মূল অর্থে মূল সর্বাস্তিবাদ এবং মন্ত্রযানের এক রূপান্তরিত স্বরূপ মাত্র। তার মূল কারণ এই যে পদ্মসম্ভব এবং আচার্য শান্তিরক্ষিত যারা সর্বপ্রথম তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেছিলেন তাঁরা উভয়েই তন্ত্রযানী ছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে আচার্য অতীশ দীপঙ্করের হাত ধরে ভারতীয় আচার্য পরম্পরা এবং বজ্রযানী ভাবাদর্শের সম্বন্ধে এক নতুন ধরণের বৌদ্ধধর্ম তিব্বতের ভূখণ্ডে বিকশিত হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়।”
আচার্য সুনীতিকুমার পাঠক এক অর্থে ভারততত্ত্বের প্রথিতযশা অধ্যাপকরূপে সমগ্র বিশ্বে নন্দিত এবং নমস্য। পালি, সংস্কৃত, মিশ্র সংস্কৃত, তিব্বতি, চিনা প্রভৃতি ভাষায় প্রাপ্ত এবং অনূদিত বুদ্ধবচন ও বৌদ্ধ বিদ্যাচর্যার আকর গ্রন্থ তথা পুঁথি ইত্যাদি গবেষণা করে তিনি অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত প্রদান করেছেন। কারণ, যিনি চর্য এবং অচর্য সম্পর্কে জ্ঞানপ্রদানের অধিকারী বা যাঁর জীবনচর্যার মধ্য দিয়ে চর্যাই বা কী আর অচর্যাই বা কী তা অনুধাবণ করা যায়—তিনিই তো আচার্য হয়ে ওঠার অধিকারী হন। এই বিশিষ্ট অর্থেই অধ্যাপক সুনীতিকুমার পাঠক হয়ে উঠেছেন ‘আচার্য’।
No comments:
Post a Comment