Friday, October 3, 2025

পালিভাষার সংক্ষিপ্ত পরিচয়

 সুমনপাল ভিক্ষু


আলাপ-আলোচনার আদান-প্রদান দুই ভাগে হতে পারে, ১. সংকেত দ্বারা তথা ২. একটি বিশেষ মানব সম্প্রদায় দ্বারা স্বীকৃত।

সাদৃচ্ছিক বাচিক প্রতীক দ্বারা, যাকে আমরা ভাষা বলি। ভাব-বিনিময় দ্বারা আদান-প্রদানের প্রথম মাধ্যমটি মূলতঃ ভাববস্তুকে ব্যক্ত করা পর্যন্ত সীমিত থাকে। তবে ভাষার ক্ষেত্রটি অপেক্ষাকৃত অধিক বিস্তৃত হয়। ভাষা স্থান-কাল-পাত্র ভেদের কারণে হাজার প্রকার হতে পারে। ভাষা-বৈজ্ঞানিকগণ তাদের গবেষণার পরিমাণ স্বরূপ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে বর্তমান যুগে পৃথিবীর বুকে প্রায় ২ হাজার ভাষা রয়েছে, যাকে জীবিত ভাষা বলা যায়। পৃথিবীতে প্রাপ্ত জীবিত ভাষাসমূহের মধ্যে প্রাচীনতম ভাষার লিখিত প্রমাণ প্রাপ্তির কারণে ভারতীয় প্রাচীন ভাষার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। অধ্যয়নের সুবিধার্থে ভারতীয় ভাষাকে ৩ ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। যেমন

১. প্রাচীন ভারতীয় ভাষা,
২. মধ্য (৫ম খ্রীঃ পূর্ব) ভারতীয় ভাষা এবং
৩. আধুনিক ভারতীয় ভাষা।

প্রাচীন এবং আধুনিক, এই দুই যুগের ভাষাকে সংযুক্ত করার কারণে মধ্য ভারতীয় ভাষা একটি স্বতন্ত্র ঐতিহাসিক গুরুত্ব দাবী করে। সূক্ষ্মভাবে অধ্যয়নের স্বার্থে এই মধ্যভারতীয় ভাষাকেও তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়।

১। পালি (খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে ১৪শ শতক পর্যন্ত)।
২। প্রাকৃত (খ্রিষ্টপূর্ব ৬-৫ শতাব্দী থেকে ১৩ম শতক পর্যন্ত)।
৩। অপভ্রংশ (আনুমানিক ৬-১৩শ শতক, খ্রিষ্টাব্দ)।

তবে একথা স্মরণযোগ্য যে বৌদ্ধধর্ম-সাহিত্যের প্রসারের ক্ষেত্রে পালি ভাষার একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। সুতরাং এই অর্থে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই ভাষার ব্যুৎপত্তি, প্রদেশ এবং নিহিত অর্থের অধ্যয়ন অত্যন্ত জরুরী।

পালি শব্দের বুৎপত্তি :

'পালি' শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ সম্পর্কে পণ্ডিতগণ বিভিন্ন অভিমত প্রকাশ করেছেন, যা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

১। পালি শব্দের প্রয়োগ ৪র্থ শতাব্দীতে আচার্য বুদ্ধঘোষ রচিত অট্ঠকথা এবং বিসুদ্ধিমগ্গ গ্রন্থে দেখা যায়। বুদ্ধঘোষ 'বুদ্ধবচন' বা মূল ত্রিপিটক রূপে তথা 'পাঠ' বা 'সুত্ত পিটকের পাঠ' অর্থে পালি শব্দের প্রয়োগ করেছেন। সর্বোপরি তিনি পোরাণ অট্ঠগাথা (প্রাচীন
অর্থকথা) হতে ভিন্নতার অর্থে মূল ত্রিপিটকের কোন অংশকে ইঙ্গিত করেছেন। যেমন-বিসুদ্ধিমগ্গ'তে 'ইমানি তাব পালিয়ং, অট্ঠকথায়ং পন....” (এ তো পালিতে রয়েছে, কিন্তু 'অট্ঠকথা'তে তো) ইত্যাদি। এইভাবে চতুর্থ শতাব্দীর রচনা। 'দীপবংস', পঞ্চম-ষষ্ঠ শতাব্দীর আচার্য ধম্মপাল বিরচিত 'পরমত্থ দীপনী', তের শতাব্দীর রচনা 'চূল বংস' ইত্যাদিতে পালি শব্দের প্রয়োগ 'বুদ্ধবচন' এবং 'মূল ত্রিপিটক' অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে।

২। মহামহোপাধ্যায় বিধুশেখর ভট্টাচার্য'র মতে 'পালি' শব্দ সংস্কৃত 'পংতি' হতে উদ্ভূত। তিনি এর অর্থবোধ এইভাবে করেছেন, পংতি, পত্তি, পল্লি, পালি।

এই মতের আলোচনা প্রসঙ্গে ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যাপ বলেছেন, ক) 'পংতি'র ক্ষেত্রে লিখিত গ্রন্থ অত্যন্ত আবশ্যক। ত্রিপিটক খ্রিষ্ট পূর্ব ১ম শতাব্দীর পূর্বে লিপিবদ্ধ হয়নি। অতএব সেই সময়ের ক্ষেত্রে ত্রিপিটকের উদাহরণ রূপে 'পালি' বা 'পংতি' শব্দ এই অর্থে প্রযুক্ত হয় না।

খ) 'পালি' শব্দের অর্থ যদি 'পংতি' হয় তাহলে সেই অবস্থায় 'উদান পালি' ইত্যাদি প্রয়োগের ক্ষেত্রে 'উদান পংতি' প্রযুক্ত হলে কোন উপযুক্ত অর্থবোধ হয় না।

গ) 'পালি' শব্দের অর্থ যদি 'পংতি' হয় তাহলে অট্ঠকথা ইত্যাদি কোথাও তার বহুবচনে প্রয়োগ দৃষ্টিগোচর হওয়া উচিত ছিল, যা নেই। অতএব 'পালি' শব্দর 'পংতি' অর্থ তার মৌলিক স্বরূপকে উন্মোচন করে না।

৩। ভিক্ষু সিদ্ধার্থ 'পালি' বা 'পালি' শব্দ মূল সংস্কৃত 'পাঠ' শব্দ রূপে স্বীকার করেছেন। তাঁর মতে যখন বেদপাঠী ব্রাহ্মণ বৌদ্ধ হলেন তখন বেদপাঠ শব্দ পরিচিত হওয়ার কারণে বুদ্ধবচনের ক্ষেত্রেও তাঁরা পাঠ শব্দের প্রয়োগ শুরু করলেন। পূর্বাভ্যাসের কারণে এইরূপ হতে পারে। পরবর্তীতে ওই 'পাঠ' শব্দ পাল>পালি হয়েছে। কিছু পণ্ডিত ভিক্ষু সিদ্ধার্থের অভিমত এবং এই ব্যুৎপত্তি সঠিক মনে করেন নি কেননা তা ঐতিহাসিক রূপে সঠিক হওয়া ক্ষেত্রে এইটি আবশ্যক হয় যে 'পাল' শব্দের প্রয়োগ পালি সাহিত্যের অবশ্যই দেখা হবে। এইরূপ হলে এই তথ্যের প্রতি ভিত্তি করে 'পালি' শব্দের ব্যুৎপত্তি স্থাপন করা সম্ভব হবে, কিন্তু ভিক্ষু সিদ্ধার্থ এইরূপ কোন তথ্য প্রদান করেন নি।

৪। ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যপ 'পালি মহাব্যাকরণ'এর 'বস্তুকথাতে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে পালি শব্দের প্রাচীনতম রূপ 'পরিযায' শব্দতে পাওয়া যায়। পরিযায শব্দ ত্রিপিটকে অনেকবার এসেছে, যেমন 'কো নামো অয়ং ভন্তে, ধম্মপরিযাযো তি' তথা 'ভগবতা অনেক পরিযায়েন ধম্মো পকাসিতো' ইত্যাদি। এক্ষেত্রে 'পরিযায়' শব্দের অর্থ 'বুদ্ধোপদেশ'। 'পরিযায়' হতে 'পলিযায়' হয়েছে। সম্রাট 'ইমানি ভন্তে, ধম্মপলিযায়ানি অশোকের প্রসিদ্ধ 'বাভ্রু' শিলালেখতে' 'পলিযায়' শব্দের প্রয়োগ এই অর্থে পাওয়া যায়। যেমন এতানি ভন্তে, ধম্ম পলিযায়ানি ইচ্ছামি...। পলিযায় শব্দ পালি'র দীর্ঘ হয়ে 'পালিযায়' শব্দে রূপান্তরিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে এই শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ 'পালি' হয়ে বুদ্ধবচন বা মূল ত্রিপিটকের অর্থে প্রযুক্ত হতে থাকে।

৫। জার্মান পণ্ডিত ড. ম্যাক্স ওয়েলসন 'পাটলি', 'পাডলি' (পাটলিপুত্রের ভাষা) শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপই হল পালি, এইরূপ অভিমত প্রকাশ করেছেন।

৬। কিছু পণ্ডিতের মতে 'পল্লি' (গ্রাম/গাঁ) 'পালি' শব্দের ব্যুৎপত্তির কারণ হয়েছে।

৭। কিছু অন্য মতে পালি শব্দের বিকাশ এইভাবে হয়েছে প্রাকৃত> পাকট> পাঅড> পাঅল> পালি।

৮। বেশকিছু বিদ্বান পালি শব্দকে 'প্রালেয়' বা 'প্রালেয়ক' (প্রতিবেশী) এইভাবে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস করেছেন। তবে এইরূপ কল্পনা কোনরূপ পরিস্থিতিতে স্বীকার করা সম্ভব নয়।

এই সকল সিদ্ধান্ত ব্যতীত পালি শব্দের ব্যুৎপত্তি সম্পর্কিত বেশ কিছু কোশ (আকর) গ্রন্থের প্রতি আলোকপাত করা যেতে পারে যা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এই কোশ গ্রন্থ সমূহকে আমরা ৩ ভাগে বিভক্ত করতে পারি। যেমন-

১। পালিকোশ গ্রন্থ,
২। সংস্কৃত ভাষার কোশ গ্রন্থ (অভিধান),
৩। অমরকোশ ইত্যাদি কোশ গ্রন্থ।

১। মোগ্গল্যান' পালিকোশ অভিধানপ্পদীপিকা'তে পালি সম্পর্কে লিখেছেন 'পালি রেখা তু রাজি চ' তথা 'সেতুস্মিং তন্তিমন্তাসু নারিয়ং পালি কথয়তে'। এই উক্তির ব্যাখ্যা প্রদান পূর্বক সুভূতি 'অভিধানপ্পদ্দীপিকা সূচী" নামক নিজ গ্রন্থে বলেছেন-

"পালি পা রক্খনে লি, পাতি রক্খতীতি পালি, পালী তি একচ্চে' (তন্তি (সংস্কৃত তন্ত্র), বুদ্ধবচনং পত্তি পালি, ভগবতা বুচ্চমানস্স অত্যস্স বোহারম্স চ দীপনতো সদ্দো যেব পালি নামা তি গণ্ঠীপদেসু বুত্তং তি অভিধম্মকথায় লিখিতং)।

তাৎপর্য এই যে যিনি পালন করেন, রক্ষা করেন, তাই পালি হয়। এই ব্যুৎপত্তি সম্ভবতঃ সেই ঐতিহাসিক তথ্যের প্রতি ইঙ্গিত করে যার উল্লেখ মহাবংসে পাওয়া যায় "যখন ভিক্ষুগণ, যারা সমগ্র ত্রিপিটক এবং অট্ঠকথা সমূহ কন্ঠস্থ করেছিলেন, তাঁরা একত্রিত হয়ে জনগণের কল্যাণার্থে সেগুলি লিপিবদ্ধ করেছিলেন।"

২। ক. মোনিয়ার উইলিয়ামস'এর সংস্কৃত কোশে একে পাল ধাতু দ্বারা নিষ্পন্ন করেছেন তথা এর অনেক গুলি অর্থ সীমা, কিনারা, অবধি পংতি ইত্যাদি করেছেন।

খ. বাচস্পত্যম্' পালি শব্দের ব্যুৎপত্তি এইভাবে প্রদত্ত হয়েছে-

"পালি (লী) স্ত্রী, পল বা৹ ইন। ১. কর্ণলতাগ্রে, ২. অশ্রৌকোণে, ৩. শ্রেণী, ৪. অংকভেদে, ৫. ছাত্রাদিদেয়ে চ (মেদিনীকোশ), ৬. যুকায়াং, ৭. পোটায়াং, ৮. প্রশংসায়াং, ৯. প্রস্থে, ১০. উৎসংগে ক্রোড়ে চ (হেমচন্দ্র), বা ভীপ্ দীৰ্ম্মন্তঃ, ১১. স্থাল্যাম্ (শব্দ চ)।"

এখানেও অনেক অর্থ প্রদান করা হয়েছে যা মোনিয়ার উইলিয়ামস্'এর অর্থকেই সমর্থন করে।

৩. সংস্কৃত ভাষার পালি শব্দের পর্যায়'এর গণনা প্রসঙ্গে অমরকোশ কার, 'কোনবস্তু স্ত্রিয়: পাল্যশ্রিকোটয়: (অম৹ ২/৮/৯৩) লিখেছেন। অমরকোশ'এর টীকাকার অনুদীক্ষিত পালি শব্দের ব্যুৎপত্তি এইভাবে বলেছেন-

'পাল রক্ষণে' ধাতু হতে 'অচ ইঃ' (উ৹ ৪/১৩৯) সূত্র হতে ই' প্রত্যয় হয়ে পার্শি শব্দ হয়েছে। ভানুজী দীক্ষিতের পূর্বে অমরকোশ'এর টীকাকার রায়মুকুট 'পা রক্ষণে' ধাতু হতে 'ধাতুব্যঞ্জি' (উ৹ ৪/২) সূত্র হতে বাহুলকাত 'আলি' প্রত্যয় দ্বারা পালি শব্দ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বলার তাৎপর্য এই যে পালি ভাষার বৈয়্যাকরণ দ্বারা স্বীকৃত উভয় ধাতু পা তথঃ পাল হতে পালি³ শব্দের বুৎপত্তি সংস্কৃতের বৈয়্যাকরণ এবং কোশকার দ্বারা পূর্ণ স্বীকৃত হয়েছে। 'রাজদন্তাদিষু পরম' (পা৹ ২/২/৩১) এই পানিনীয় সূত্রে রাজদন্তাদি গণ'তে 'গোপালিয়ান পুলাসম্' শব্দের পাঠ দ্বারা পালি শব্দ সংস্কৃত ভাষার ব্যবহার অতিপ্রাচীন এবং সুপ্রচলিত অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে। গণপাঠের পরম্পরা পানিনি পূর্ব হওয়ার কারণে প্রকৃত অর্থে এর প্রচলন (পালি) স্বীকার করতেই হবে।

অমরকোশ ব্যতীত মেদিনীকোশ, হলায়ুধকোশ ইত্যাদি হতে পালি শব্দের ব্যুৎপত্তির প্রতি আলোকপাত করা যায়।

এখানে প্রদত্ত সকল মতের বিষয়গুলিকে পর্যালোচনা করলে এই সিদ্ধান্ত উপনীত হওয়া যায় যে সংস্কৃত ভাষাতে 'রক্ষাকর্তা' বা 'রমনকারী' অর্থে পালি শব্দের প্রয়োগের সংস্কার এবং অপরদিকে পরিনাম বা পংতি বা অন্য কোন প্রামাণিক (প্রমাণিত) শব্দ হতে উদ্ভুত, 'বুদ্ধবচন, বুদ্ধোপদেশ না বুদ্ধোপদেশনা, এই অর্থবোধ পালি শব্দের সংস্কার ছিল। উভয় অর্থে সংস্কারের সম্মিলন দ্বারা যে ভাষাতে বুদ্ধবচন সুরক্ষিত এবং যে ভাষা প্রায় বুদ্ধবচন ময়, সেই ভাষাই হল পালি ভাষা, এই নামকরণ হয়েছে।

এখন প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে পালি ভাষার মূল প্রদেশ কি ছিল? এই বিষয়ে বিদ্ধানগণ তাদের নিজ নিজ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। যেভাবে বাংলা, মৈথিলী, কন্নড়, তামিল ইত্যাদি ভাষা দ্বারা কোন না কোন প্রদেশ বা অঞ্চলের প্রতি ইঙ্গিত করে, ঠিক সেই ভাবে 'পালি' শব্দ দ্বারা বা এই শব্দের উপযুক্ত ব্যুৎপত্তি দ্বারা সঠিক কোন প্রদেশের প্রতি ইঙ্গিত করে না। ব্যুৎপত্তি দ্বারা এইরূপ অবগত হওয়া যায় এই ভাষা দ্বারা বুদ্ধবচন সুরক্ষিত করা হয়েছিল এবং এই কারণেই পালিকে মগধের ভাষা বলা হয়েছে। যদিও উভয় ভাষার মধ্যে (মাগধী এবং পালি ভাষা) অনেক মৌলিক ভিন্নতা পাওয়া যায়।

যেখানে বুদ্ধ বচন রক্ষার প্রশ্ন, মহাযান পরম্পরা অনুসারে 'মূল-সর্বাস্তিবাদ' এর গ্রন্থ সংস্কৃততে, 'মহাসাংঘিক'এর প্রাকৃততে, 'মহাসম্মীতীয়দের অপভ্রংশতে এবং 'স্থবির সম্প্রদায়'এর পৈশাচী ভাষায় লিপিবদ্ধ হয়েছি। থেরবাদী মতানুসারে ভগবান বুদ্ধ মূলতঃ পালিভাষাতে উপদেশ প্রদান করেছিলেন। শ্রীলংকার ভিক্ষুগণ এই তথ্যের প্রতি ভিত্তি করে মাগধী ভাষাকেই পালিভাষা বলেছেন এবং এই বিষয়টি কিছু অর্থে স্বাভাবিক ছিল।

তবে এই বিবাদগ্রস্ত প্রশ্নের প্রতি অনেক প্রাশ্চাত্য এবং ভারতীয় বিদ্বানগণ তাদের মতামত ব্যক্ত করেছেন, যা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

১। ড. ওল্ডেনবার্গ'এর মতে পালিভাষার মূল ভিত্তি হল কলিঙ্গের ভাষা। তাঁর মতে সিংহলে 'মহিন্দ' দ্বারা বৌদ্ধধর্মের প্রচারের বিষয়টি ঐতিহাসিক নয়, অধিকন্তু ভারত এবং সিংহলের অনেক বর্ষের সম্পর্কের কারণে সিংহলে বৌদ্ধধর্মের প্রচার-প্রসার হয়েছিল। অন্যদিকে খারবেল'এর খণ্ডগিরি অভিলেখের ভাষা পালি ভাষার অত্যন্ত নিকটস্থ ভাষা, অতএব মনে হয় কলিঙ্গ হতে লংকা (সিংহল/শ্রীলংকা) তে বৌদ্ধধর্ম প্রচারিত হয়েছিল এবং এই অর্থে কলিঙ্গের ভাষা পালি ভাষার আধার (মূল) মনে হয়।

২। ওয়েষ্টগার্ড এবং কুহ্ন পালিভাষাকে উজ্জয়নী প্রদেশের ভাষা বলেছেন। সম্রাট অশোকের গিরনার (গুজরাট) অভিলেখের ভাষা পালিভাষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ তথা রাজকুমার মহিন্দ (মহেন্দ্র)'র জন্ম উজ্জয়িনী হয়েছিল, অতএব তাঁর মাতৃভাষার জ্ঞান, এই দুই কারণ তাঁদের অভিমতকে পুষ্ট করেছে।

৩। আর.ও. ফ্রাঙ্ক এবং স্টেনকোনো অনেক পরিশ্রমের সঙ্গে পালিভাষাকে বিন্ধপ্রদেশের ভাষা রূপে প্রমাণিত করার চেষ্টা করেছেন।

৪। প্রিয়ারর্সন পালিভাষাতে মাগধী এবং পৈশাচীর অনেক বৈশিষ্ট্যকে পর্যালোচনা করে পালিভাষাকে মাগধীর ভিত্তি বলেছেন।

৫। অধ্যাপক রীস্ ডেভিডস্'এর মতে ভগবান বুদ্ধ 'কোসল খত্তিয়' (কোশল 'ক্ষত্রিয়) ছিলেন, অতএব কোশল অঞ্চলের ভাষায় তিনি উপদেশ প্রদান করেছিলেন, ভগবান বুদ্ধের উপদেশ যেহেতু পালি ভাষায় অতএব পালি এবং কোসল ভাষা একই তথা কোশলই পালি ভাষার মূলপ্রদেশ।

৬। উইলিয়াম গাইগার বলেছেন, পালি একটি সাহিত্যেক ভাষা এবং এই ভাষা সকল জনপদে গ্রাহ্য ছিল, কিন্তু তিনি এই বিষয়ে কোন অভিমত ব্যক্ত করেন নি যে এই সাহিত্যিক ভাষা কোন জনপদের ভাষা ছিল।

৭। মহাপণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের অভিমত হল, ত্রিপিটক মূলতঃ মাগধী ভাষায় লিপিবদ্ধ হয়েছিল, কিন্তু সিংহলে যে গুজরাতী প্রবাসীদের প্রায় ২৫০ বর্ষ পর্যন্ত ত্রিপিটক কন্ঠস্থ করার দায়িত্বভার প্রদান করা হয়েছিল সেই সময় সম্ভবতঃ মাগধীর সম্পূর্ণ বৈশিষ্ট্য বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।

৮। সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে ভারতবর্ষে মধ্যদেশের ভাষার সর্বদা বিশেষ প্রভাব ছিল। অতএব পালিভাষা এই ভাষার'ই মূল ভিত্তি ছিল। তিনি বলেছেন, ভগবান বুদ্ধের উপদেশ সর্বপ্রথম পূর্বদেশের ভাষাতেই প্রণয়ন হয়েছিল এবং পরবর্তী সময়ে এর অনুবাদ পালিভাষাতে হয়েছিল যা মধ্যদেশের প্রাচীন ভাষা সমন্বিত একটি সাহিত্যিক ভাষা ছিল।

উপযুক্ত মতের পরিপ্রেক্ষিতে ৩টি তথ্য আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হয়-

১। প্রত্যক্ষ মাগধী ভাষাই হল পালি ভাষা।
২। মহিন্দের সম্পর্ক অনুসারে উজ্জয়িনীর ভাষা মূল অর্থে পালি ভাষা।
৩। পূর্ব দেশের ভাষার সাহিত্যিক রূপই হল পালিভাষা।

এক্ষেত্রে প্রথম অভিমত সম্পর্কে বলা যায় যে তৎকালীন মগধ জনপদের ভাষায় ভগবান বুদ্ধ উপদেশ প্রদান করেছিলেন, এই তথ্য যুক্তিগ্রাহ্য নয়। দ্বিতীয় অভিমত সম্পর্কে এই কথা বলা যায় যে মহিন্দ তাঁর সম্পূর্ণ ধার্মিক ভাবনার প্রভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে মূলরূপে যথাস্থিত বুদ্ধবচনের উপদেশ প্রদান করেছিলেন, না কি তাঁর ভাষা সংযুক্ত করেছিলেন। ফলে এই অভিমতটির প্রতি সংশয় থেকেই যায়। অতএব তৃতীয় অভিমত অবশিষ্ট থাকে। এইটি পর্যাপ্ত রূপে সম্ভব যে স্বয়ং বুদ্ধবচন কিছু সাহিত্যিক ভাব ভঙ্গিমা পূর্ণ ভাষাতে হয়েছিল যেরূপ ড. চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, এর অনুবাদ এই ভাষাতে হয়েছিল, আর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে মধ্য দেশের ভাষা হওয়ার কারণে তার দ্বারা প্রভাবিত ভাষাতে এই কার্য হয়েছিল। 

পালি ব্যাকরণ :

পালি ভাষার সাহিত্য যতটা প্রাচীন ব্যাকরণ সাহিত্য সেইরূপ প্রাচীন নয়। কিন্তু সেই সাহিত্যকে উপেক্ষা করা সম্ভবপর নয়।

এই অভিমতের পশ্চাতে এর সুবিশাল পরম্পরা রয়েছে। ব্যবস্থিত রূপে তা প্রাপ্ত না হলেও পালি ব্যাকরণ পরম্পরার অতিরিক্ত পালি সাহিত্যের বিভিন্ন গ্রন্থের অনুশীলন দ্বারা অবগত করা যায় যে ব্যাকরণ সম্পর্কিত বিষয় আচার্য বুদ্ধঘোষ এর সময়কালে অবশ্যই বিদ্যমান ছিল। তবে পারিভাষিক অর্থে এর পরিগমন পালি ব্যাকরণ রূপে সম্ভবত ছিল না। পালি ব্যাকরণ তত্ত্বের এই সংকেত পালি ত্রিপিটক সাহিত্যের অনেক স্থানে পাওয়া যায়। ধম্মপদ'এর একটি পদে মহাপ্রাজ্ঞ ভিক্ষুর ক্ষেত্রে 'নিরুত্তিকোবিদো' তথা 'অক্খরানং সন্নিপাতং' হতে পরিচিত হওয়া অবশ্যক বলা হয়েছে।" এর দ্বারা উপলব্ধি করা যায় ধম্মপদ'এর পূর্বে ব্যাকরণ সম্পর্কিত এমন কোন ব্যবস্থা অবশ্যই হয়ত ছিল যার দ্বারা পণ্ডিত ভিক্ষু নিরুক্তি, পদ এবং শব্দযোজনা ইত্যাদির অধ্যয়ন করতেন। বৌদ্ধ অনুশ্রুতি অনুসারে যখন ভগবান বুদ্ধ'র নিয়ম এবং উপদেশ শ্রোতার ক্ষেত্রে কঠিন হয়ে পড়েছিল, তখন তা উপলব্ধি করার প্রশ্নে ভগবান'এর এক প্রধান শিষ্য মহাকচ্চান সমাধির দ্বারা পালি ব্যাকরণ সহ উপস্থিত হয়েছিলেন। এইরূপ অনুশ্রুতি অনুসারে প্রথম পালি ব্যাকরণের রচয়িতা ভদন্ত মহাকচ্চানকেই বলা হয়। তবে পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে এই কথনের প্রতি পূর্ণ রূপে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়।

বর্তমান স্থিতিতে প্রাপ্ত সামগ্রী তথা সূচনার প্রতি ভিত্তি করে পাঁচ ব্যাকরণ সম্প্রদায়ের উল্লেখ পাওয়া যায়-

১। কচ্চান ব্যাকরণ।
২। বোধিসত্ত্ব ব্যাকরণ।
৩। সব্বগুণাকর ব্যাকরণ।
৪। মোগ্গল্লান ব্যাকরণ।
৫। সদ্দনীতি ব্যাকরণ।

উপরিউক্ত পাঁচ ব্যাকরণের মধ্যে বোধিসত্ত ব্যাকরণ এবং সব্বগুণাকর ব্যাকরণ পাওয়া যায় না। শুধুমাত্র বৌদ্ধ পরম্পরা অনুসারে এর উল্লেখ রয়েছে। ফলে অবশিষ্ট ও ব্যাকরণের ভাষার ব্যাখ্যা করার নিজস্ব একটি পদ্ধতি তথা এই সকল'এর ভিন্ন-ভিন্ন পরম্পরা বিদ্যমান। যেমন

১। কচ্চান ব্যাকরণ :

কচ্চান-ব্যাকরণকে কচ্চায়ন ব্যাকরণও বলা হয়। এর অপর নাম কচ্চায়ন গন্ধ (কাত্যায়ন গ্রন্থ) সর্বোপরি এই ব্যাকরণের 'সন্ধিকপ্প'র প্রতি ভিত্তি করে 'সুসন্ধিকল্প'ও বলা হয়।

কান্ড বিশেষ অনুসারে গ্রন্থের নামকরণের এই প্রক্রিয়া পালিত্রিপিটক সাহিত্যেও দৃষ্ট হয়। যেমন- পারাজিক কান্ড অনুসারে বিনয়পিটকের একটি গ্রন্থের নাম 'পারাজিকো'। অনেক বিদ্ধান এই ব্যাকরণের রচয়িতা রূপে ভগবান বুদ্ধের একজন প্রধানশিষ্য মহাকচ্চায়নের নাম স্বীকার করেন। কিন্তু এই বিষয়ের পর্যাপ্ত কোন প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। কখনও কখনও পানিনির অষ্টাধায়ীর সমালোচক তৃতীয় শতাব্দীর বার্তিককার কাত্যায়ন'এর সঙ্গে এই কচ্চান ব্যাকরণ এর সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়াস করা হয়েছে, তবে উক্ত কাত্যায়ন কচ্চান (পালি ব্যাকরণ) এর রচয়িতা নয়।

এই ব্যাকরণ গ্রন্থের রচয়িতাকে এই সম্পর্কে বিভিন্ন পরম্পরা এবং বিদ্বানগণের সিদ্ধান্তকে বিধিবত অনুশীলন করার পরে এই তথ্য পাওয়া যায় যে এই ব্যাকরণের রচয়িতা সপ্তম শতাব্দীর কচ্চায়ন (কচ্চান), যিনি উপযুক্ত সকল কচ্চায়ন বা কাত্যায়ন হতে ভিন্ন। কচ্চান ব্যাকরণের রচয়িতা সম্পর্কিত বিভিন্ন ব্যক্তির তথ্য যুক্ত হওয়ার কারণে কচ্চানের কাল নির্ণয় সম্পর্কে আমাদের সম্মুখে বিভিন্ন মত উপস্থিত হয়েছে। এই সকল অভিমতের মধ্যে কোনটি সঠিক সেই বিষয়ে আলোচনা করা আবশ্যক। এক্ষেত্রে তাঁর সময়কাল সম্পর্কিত চারটি মুখ্য অভিমত রয়েছে যা অতীব গুরুত্বপূর্ণ তথা অধিকাংশ বিদ্বান এই সকল অভিমতের মধ্যে কোন না কোন মতকে সমর্থন করেছেন, যা এইরূপ-

১। ৬০০ খিষ্ট পূর্ব যখন মহাকচ্চায়ন (ভগবান বুদ্ধের প্রধান শিষ্য) এর সঙ্গে কচ্চান'এর সম্পর্ক যুক্ত করা হয় সেই স্থিতিতে কচ্চান ব্যাকরণের রচয়িতার সময় ৬০০ খ্রিষ্টাব্দ পূর্ব নির্ধারিত হয়। এই অভিমতটি গ্রহণযোগ্য নয়। এর দুটি প্রধান কারণ বিদ্যমান।

ক। যদি কচ্চান চতুর্থ শতাব্দীর বুদ্ধঘোষ'এর পূর্বে বিদ্যমান হতেন তাহলে নিশ্চই তিনি তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করতেন।

খ। কচ্চান ব্যাকরণে চতুর্থ শতাব্দী (খ্রীঃ)'র কাতন্ত্র ব্যাকরণ তথা ৭ম শতাব্দী (খ্রীঃ)র কারিকাবৃত্তির স্পষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। অতএব তাঁর সময়কাল ৬০০ খিষ্টাব্দের পূর্বে সম্ভব নয়।

২। তৃতীয় শতাব্দী খ্রিষ্টপূর্ব শ্রীযুক্ত সতীশ চন্দ্র বিদ্যাভূষণ কচ্চান ব্যাকরণ'এর দুটি সূত্র'কে উদ্ধৃত করে, উল্লেখিত উপযুক্ত এবং দেবানাং পিয় তিস্স উভয়ত সম্রাট অশোকের সমকালীন হওয়ার কারণে কচ্চান কাল ২৫০ খ্রিষ্টপূর্ব বলেছেন। তাঁর এই মত যুক্তিসঙ্গত নয়। কারণ এর দ্বারা শুধুমাত্র এতটাই নির্ধারণ করা যায় যে কচ্চান অশোকের পূর্বে বিদ্যামান ছিলেন না। সময়কালের অন্তিমসীমা বাস্তবিক অর্থে এইভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। 

৩। প্রথম শতাব্দী খ্রিষ্টপূর্ব কচ্চানকে অনেকে বররুচি মনে করে তাঁর সময়কাল ১ম শতাব্দী খ্রিষ্টপূর্ব বলেছেন। তবে এই অভিমতটি কল্পনা প্রসূত বলেই মনে হয়।

৪। ৫০০-১১০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়কাল- চতুর্থ শতাব্দীকালে আচার্য বুদ্ধঘোষ'এর পূর্বে কচ্চানের উল্লেখ পাওয়া যায়, তথা ১১ শতাব্দীর পরবর্তী সময়ে পালি ব্যাকরণের টীকাতে কচ্চান ব্যাকরণের সংজ্ঞার প্রয়োগ হয়েছে। অতএব এর পূর্বে অবশ্যই এই ব্যাকরণের রচনা সম্পন্ন হয়েছিল।

বর্তমানে অধিকাংশ বিদ্বান কচ্চান ব্যাকরণকে কারিকাবৃত্তি রচনার উত্তরকালীন গ্রন্থ বলেছেন। কারিকাবৃত্তির সময়কাল ৭ম শতাব্দী। অতএব এই কচ্চান ব্যাকরণের রচনা এর পরবর্তী সময়ে হয়েছিল। যাইহোক, উপরিউক্ত তথ্য অনুসারে বলা যায় যে এই গ্রন্থের রচনা কাল ৭ম শতাব্দীর পরবর্তী সময়ে হয়েছিল।

কচ্চান ব্যাকরণের রচয়িতার বাস্তবিক নাম কচ্চান বা কচ্চায়ন না হয়ে (বসিষ্টস্য গোত্রাপত্যং) বাসিষ্ঠ ন্যায় গোত্র' নাম হয়েছে। পালি সাহিত্যে 'গোত্র' নামরূপে এর প্রয়োগ পকুধকচ্চায়ন, পুব্বক কচ্চায়ন ইত্যাদি রূপে অনেক স্থানে দৃষ্ট হয়। এই নামের ব্যাখ্যা এই রূপে দেখা যেতে পারে-

"ইদং হি কচ্চায়নস ইদং তি কচ্চায়নং তি বুচ্চতি।"
ইতি কচ্চোসপুত্তো তু তত্স কচ্চায়নো মতো।
তেনেব কতসতথাম্পি কচ্চায়নত্তি ঞায়তি।
কচ্চায়নসিসদং সত্থ তিথিনাবচনত্থতো।"

কচ্চায়ন ব্যাকরণ রচনার ক্ষেত্রে মুখ্যত তিনটি বিষয়কে গুরুত্বদান করা হয়েছে। এই তিনটি মুখ্য বিষয় হল সুত্ত, বুত্তি তথা পয়োগ (উদাহরণ)। তবে ভরতসিংহ উপাধ্যায়, এই তিন বিবেচ্য বিষয় ব্যতীত 'ন্যাস' (ব্যাখ্যাত্মাক টিপ্পনী) কে কচ্চায়ন ব্যাকরণের বিবেচনার বিষয় রূপে স্বীকার করেছেন। ন্যাস একটি ভিন্ন পুস্তকে পাওয়া যায়, এর অপর নাম 'মুখমত্ত দীপনী। এইরূপ পরম্পরা রয়েছে যে এই চার সুত্ত, বুত্তি, পয়োগ তথা ন্যাস'এর রচয়িতা ভিন্ন-ভিন্ন, যেমনটি নিম্ন কারিকাতে ব্যক্ত হয়-

"কচ্চায়নের কতো যোগো বুত্ত চ সঙ্ঘনন্দিনো।
পয়োগো ব্রহ্মদত্তের ন্যাসো বিমলবুদ্ধিন।।১১

অর্থাৎ যোগ (সুত্ত) কে কচ্চায়ন, বুত্তিকে সঙ্ঘনন্দি, পয়োগ (উদাহরণ) ব্রহ্মাত্তে তথা ন্যাস বিমলবুদ্ধি রচনা করেছিলেন। যাই হোক, বর্তমান কচ্চায়ন ব্যাকরণে সুত্ত, বুত্তি এবং প্রয়োগ এই তিনটি বিষয় দেখা যায়।

কচ্চায়ন ব্যাকরণের সূত্রের সংখ্যা সম্পর্কে বিবাদ বহুপূর্ব হতে বিদ্যমান রয়েছে। বর্তমান কচ্চায়ন ব্যাকরণে প্রাপ্ত সূত্রের সংখ্যা ৬৭৫। 'ন্যাস' এ এই ব্যাকরণের সূত্রের সংখ্যা ৭১০ বলা হয়েছে। বার্মা (মায়ানমার)র ১১ শতাব্দীর ধম্মসেনাপতির 'কারিকা'তে এই সূত্রের সংখ্যা বলা হয়েছে ৬৭২টি। কিন্তু বর্তমানে প্রমুখ বিদ্বান দ্বারা এই সংখ্যা ৬৭৫ স্বীকার করা হয়েছে।

৬৭৫ সূত্র সংখ্যা বিশিষ্ট এই কচ্চায়ন ব্যাকরণ ৪ কপ্পো (কল্পো)তে বিভক্ত। পরিচ্ছেদ সংখ্যা সর্বমোট ২৩ (কণ্ড কাণ্ড)১২। এই ৪ কপ্পোর বিভাজন বিষয়বস্তু অনুসারে করা হয়েছে

১। সন্ধি কপ্পো 
২। নাম কপ্পো
৩। আখ্যান কপ্পো তথা
৪। কিবিধান কপ্পো।

সন্ধি কপ্পতে সাবিধান, নাম কপ্পতে কারক, সমাস তথা তদ্বিত এবং কিবিবধান কল্পতে উনাদি বিভিন্ন কন্ডো রূপে বর্ণিত হয়েছে।

বুদ্ধপ্পিয় দীপঙ্কর সাত কান্ডো (যাকে কল্প বলা যেতে পারে)'র আলোচনা করেছেন। যেমন-

১। সন্ধি, ২। নাম, ৩। কারক, ৪। সমাস, ৫। তদ্ধিত, ৬। আখ্যান তথা ৭। কিত্।

কচ্চায়ন ব্যাকরণ সম্প্রদায়'এর অন্য গ্রন্থ সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ সমূহের মধ্যে অত্যধিক প্রচার-প্রসার যে ভাবে পাণিনীয় ব্যাকরণের গ্রন্থ অষ্টাধ্যায়ী'র হয়েছে, ঠিক সেইভাবে পালি ব্যাকরণের ক্ষেত্রে কচ্চায়ন ব্যাকরণের অত্যধিক প্রচার-প্রসার হয়েছিল।

পাণিনী অষ্টাধ্যায়ীকে সুগম এবং সুবোধ করার ক্ষেত্রে যেভাবে ভাষা এবং টীকা রচিত হয়েছিল, অনুরূপভাবে এই গ্রন্থের (কচ্চায়ন ব্যাকরণ) ক্ষেত্রে অনেক টীকা ও রচিত হয়েছিল। ফলে এইভাবে কচ্চায়ন ব্যাকরণের একটি সম্প্রদায় গড়ে ওঠে। এই সম্প্রদায়ে রচিত সকল গ্রন্থ প্রায়ঃ এর টীকা রূপে আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হয়। তবে এক্ষেত্রে কিছু গ্রন্থ রয়েছে যা টীকার অতিরিক্ত আরও কিছু রয়েছে। এই গ্রন্থ সমূহের মধ্যে 'সম্বন্ধ-চিন্তা', 'সদ্দত্থভেদচিন্তা', 'সদ্দসারত্থসালিনী' ইত্যাদি অন্যতম। এগুলিতে স্বতন্ত্র রূপে ব্যাকরণের কিছু অন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে। কচ্চায়ন ব্যাকরণ সম্প্রদায়'এর কিছু মুখ্যগ্রন্থ হল

এইরূপ-

১। ন্যাস

এই গ্রন্থকে কচ্চায়ন ন্যাস বা মুখমত্তদীপনী নামে অভিহিত করা হয়। এইটি কচ্চায়ন ব্যাকরণ সম্পর্কিত সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাচীন ভাষ্য। এর রচনা ৭-১১ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়কালে সিংহল নিবাসী কোন বিমলবুদ্ধি নামক টীকাকার করেছিলেন। কিছু বিদ্ধান তাঁকে বার্মা (মায়ানমার) নিবাসী বলেছেন।

২। ন্যাস প্রদীপ

কচ্চায়ন ব্যাকরণের টীকা ন্যাস'এর টীকা স্বরূপ এই গ্রন্থের রচনা বর্মী ভিক্ষু ছপ্পদ ১২ শতাব্দীর অন্তিমে করেছিলেন। এর অতিরিক্ত ন্যাস'এর বিষয়ে ১৭ শতাব্দীতে আরও একটি টীকা'র সংকেত পাওয়া যায় এবং উক্ত গ্রন্থের রচনাকার বর্মী ছিলেন।

৩। সুত্তনিদ্দেস

ন্যাস প্রদীপের রচনাকার ছপদ, ১১৭১ খ্রিষ্টাব্দে কচ্চায়ন ব্যাকরণের টীকা রূপে, এই গ্রন্থের রচনা করেছিলেন।

৪। কারিকা

১১ শতাব্দীতে ধম্ম সেনাপতি কচ্চায়ন ব্যাকরণের প্রতি ভিত্তি করে এই গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এই গ্রন্থে ৫৬৫ কারিকা রয়েছে।

৫। সম্বন্ধ চিন্তা

১২ শতাব্দীর অন্তিমে স্থবির সংঘরক্ষিত কচ্চান ব্যাকরণের প্রতি ভিত্তি করে পালি শব্দ যোজনা বা পদ জোজনা সম্পর্কিত এই গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থে বাক্যতে পদ এবং কারকের প্রয়োগ সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। ক্রিয়ার সঙ্গে কারকের কিরূপ সম্পর্ক হওয়া প্রয়োজন, এই সম্পর্কিত আলোচনাও রয়েছে। এই গ্রন্থটি গদ্য-পদ্যময়। এই গ্রন্থের ২ টীকার সংকেতও পাওয়া যায় এর মধ্যে ১টি সম্ভবতঃ সারিপুত্তের শিষ্য বাচিস্সর প্রণীত সম্বন্ধ চিন্তা টীকা এবং দ্বিতীয়টি পাগান (বাগান, মায়ানমার)'এর অভয় নামক স্থবিরের।

৬। সদ্দত্থভেদ চিন্তা

কচ্চান ব্যাকরণ সম্পর্কিত টীকা গ্রন্থ। এই গ্রন্থে শব্দ, অর্থ এবং শব্দার্থ বিষয়ে সুন্দরভাবে আলোচনা করা হয়েছে। ১২ শতাব্দীর অন্তিমে বর্মী স্থবির 'সদ্ধম্মসিরি' এই গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

৭। রূপসিদ্ধি

এইটি একটি প্রক্রিয়া গ্রন্থ। এই গ্রন্থে কচ্চান ব্যাকরণের সূত্রকে প্রক্রিয়া অনুসারে ভিন্ন ক্রমে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। পালি ব্যাকরণের এইটি একটি উৎকৃষ্ট গ্রন্থ। এই গ্রন্থের অপর নাম 'পদরূপসিদ্ধি'। এই গ্রন্থের রচনা বুদ্ধপ্পিয় দীপঙ্কর ১১ শতাব্দীর অন্তিম লগ্নে সম্পন্ন করেছিলেন। রূপসিদ্ধি ৭ পরিচ্ছেদে বিভক্ত। বুদ্ধপ্পিয় এই গ্রন্থের প্রতি ভিত্তি করে একটি টীকাগ্রন্থ রচনা করেছিএলন এবং তিনি স্বয়ং সিংহলী ভাষাতে উক্ত গ্রন্থের অনুবাদও করেছিলেন।

৮। বালাবতার

১৪ শতাব্দীতে ধম্মকিত্তি এই গ্রন্থের রচনা করেছিলেন। কচ্চান ব্যাকরণের এইটি একটি লঘু সংস্করণ গ্রন্থ। বার্মা (মায়ানমার) এবং শ্যামদেশে (থাইল্যান্ড) এই গ্রন্থের গুরুত্ব অপরিসীম। এই ব্যাকরণের ২টি টীকাগ্রন্থ সিংহলী এবং পালি ভাষাতে পাওয়া যায়। পালি ভাষার ব্যাকরণে প্রবেশের ক্ষেত্রে বালাবতার ব্যাকরণ গ্রন্থ অতন্ত উপযোগী বলে মনে করা হয়।

১। সদ্দসারত্থজালিনী

৫১৬ কারিকাতে বদ্ধ এই গ্রন্থের রচনা ১৩৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ভদন্ত নাগিন বা কন্টক থিপ নাগিন কচ্চান ব্যাকরণের টীকা স্বরূপ করেছিলেন। বিষয় বস্তুর দৃষ্টিকোণ অনুসারে এই গ্রন্থটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সদ্ধ, অথ, সন্ধি, নাম, কারক, সমাস, তদ্বিত, আখ্যাত তথা কিত ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আলোচনা এই গ্রন্থে পাওয়া যায়। এর অতিরিক্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞার পরিভাষাও এই গ্রন্থে প্রদত্ত হয়েএছ। এই গ্রন্থের ১টি টীকা গ্রন্থ ও রয়েছে।

১০। কচ্চায়ন ভেদ

থাটন (মায়ানমার)'এর স্থবির মহাস্স ১৪ শতাব্দীর অন্তিমে এই গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। অন্যান্য গ্রন্থের ন্যায় এই গ্রন্থটিও কারিকা দ্বারা রচিত হয়েছে। এই গ্রন্থে কারিকার সংখ্যা ১৭৮টি। ১৭ শতাব্দীর প্রারম্ভে 'সারত্থবিকাসিনী' নামক তথা অজ্ঞাত সময়কালে 'কচ্চায়ন ভেদ মহাটীকা' নামক ২টি টীকা গ্রন্থ রচিত হয়েছিল।

১১। কচ্চায়ন সার

মহাস্স ৭২ কারিকাতে এই গ্রন্থ রচনা করেছিলেন এবং গ্রন্থটিতে ব্যাকরণের মূলভূত সিদ্ধান্ত যেমন, আখ্যান, কৃত, কারক, সমাস ইত্যাদি আলোচনা করা হয়েছে।

১২। সন্দবিন্দু

১৫ শতাব্দীতে বর্মী (মায়ানমার) রাজা 'ক্যল্প' এই গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এই গ্রন্থে কারিকার সংখ্যা ২০। কচ্চান ব্যাকরণ'ই হল এর মূল ভিত্তি। উক্ত গ্রন্থে সন্ধি, নাম, কারক ইত্যাদি অলোচনা করা হয়েছে। সদ্দবিন্দু'র একটি টীকা গ্রন্থেরও উল্লেখ পাওয়া যায়।

১৩। কচ্চায়ন বণ্ণনা

১৭ শতাব্দীর প্রারম্ভে মহায়িজিতাবী কচ্চান ব্যাকরণ সম্পর্কিত একটি পৌঢ় টীকাগ্রন্থ রূপে এই গ্রন্থের রচনা করেছিলেন।

১৪। বাচকোপদেস

ব্যাকরণ শাস্ত্রকে নৈয়ায়িক দৃষ্টিকোণ অনুসারে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে এই গ্রন্থটি গুরুত্বপূর্ণ মহাবিজিতাবী (মহায়িজিতাবী) এই গ্রন্থের রচনাকার। গ্রন্থটি গদ্য-পদ্যময়।

১৫। অভিনব চূলনিরুত্তি

কচ্চান ব্যাকরণের নিয়মের অপবাদকে নিবারণ রূপে এই গ্রন্থের রচনা করা হয়েছে। কিছু ব্যক্তি এই গ্রন্থের রচয়িতা রূপে 'সিরিসদ্ধম্মলংকার'এর নাম উল্লেখ করেছেন, কিন্তু অন্তিম রূপে এই গ্রন্থের রচয়িতা এবং রচনাকাল সম্পর্কিত কোন তথ্য পাওয়া যায় নি।

১৬। বল্লি প্লবোধন

১৬ শতাব্দীর মধ্যভাগে এই ব্যাকরণের রচনা হয়েছিল। এই রচয়িতার নাম অজ্ঞাত রয়েছে।

১৭। ধাতুমঞ্জুসা

কচ্চান ব্যাকরণ অনুসারে ধাতু'র সূচী এই গ্রন্থে সংকলিত করা হয়েছে। এই রচনাটি পদ্যবদ্ধ। সুভূতি অনুসারে কবি কল্পদ্রুমে এই গ্রন্থে সহায়তা গ্রহণ করেছিলেন। পানিনীয় ধাতুপাঠের প্রভাব এই গ্রন্থে পরিলক্ষিত হয়।

১৮। মোগল্লান ব্যাকরণ

এই ব্যাকরণ'এর নাম মোগ্গল্লান বা মোগল্লায়ন ব্যাকরণ। এর অপর নাম মাগধসন্ধলক্খন। সম্ভবতঃ এই নামকরণ পালি ভাষাকে মাগধী ভাষা এবং মগধ নিবাসী (স্থান বিশেষ) হওয়ার কারণেই করা হয়েছে। এই গ্রন্থের রচয়িতা মহাথের মোগ্গল্লান এবং তাঁর সময়কাল পরাকমভুজ (পরাক্রম বাহু প্রথম)'এর শাসনকাল রূপে গণ্য করা হয়। পরাক্রম বাহু প্রথম'এর সময়কাল ১২ শতাব্দীর মধ্য হতে ১২ শতাব্দীর অন্ত পর্যন্ত। তাঁর ব্যাকরণ বুত্তির শেষে মোগ্গল্লান উক্ত সময়কালের উল্লেখ করেছিলেন। এর সঙ্গে তিনি তাঁর নিবাস স্থানের উল্লেখও করেছেন এবং এই তথ্য দ্বারা অবগত করা যায় যে তিনি লংকার অনুরাধ পুবের থূপারাম নামক বিহারে অবস্থান করতেন।

যদিও এই গ্রন্থ কচ্চায়ন ব্যাকরণ অপেক্ষা অর্বাচীন তবুও ভাষা সম্পর্কিত ব্যবস্থিত নিয়ম এবং সর্বাঙ্গীন বিবেচনার কারণে এর প্রচার-প্রসার কচ্চায়ন ব্যাকরণের তুলনায় অধিক। বর্তমানে পালিভাষা শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে প্রায়ঃ অধিকাংশ এই গ্রন্থের অধ্যয়ন করেন।

এই গ্রন্থে সুরের সংখ্যা ৮১৭টি, যেখানে সূত্রপাঠ, নত্রাদিপাঠ, গণপাঠ ইত্যাদি সংকলিত হয়েছে। এর একটি ধাতুপাঠ ও রয়েছে যাকে ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যাপ তাঁর পালি মহাব্যাকরণ গ্রন্থের পরিশিষ্টতে সংকলিত করেছেন। তিনি তাঁর গ্রন্থের সূত্র'তে স্বয়ং বৃত্তি (বৃত্তি) এবং পুনঃ বৃত্তির একটি পাণ্ডিত্যপূর্ণ টীকা পঞ্জিকা রচনা করেছেন। ফলে এই গ্রন্থের (মোগ্গল্লান-ব্যাকরণ) গুরুত্ব আরও অধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। মোগ্গল্লান লিখিত পঞ্জিকার সম্পাদনা শ্রীলংকার কোনও এক মহাথের করেছিলেন যা লংকার বিদ্যালংকার পরিবেণ হতে প্রকাশিত হয়েছে।

মোগ্গল্লান ব্যাকরণে প্রাচীন পালি ব্যাকরণের প্রভাব ব্যতীত পাণিনীর অষ্টাধ্যায়ী, কাতন্ত্র ব্যাকরণ এবং চন্দ্রগোমিন এর চান্দ্র ব্যাকরণের পর্যাপ্ত প্রভাবও রয়েছে।

মোগল্লান ব্যাকরণ সম্প্রদায়'এর অন্য গ্রন্থ : 

যেভাবে কচ্চান ব্যাকরণের অধিক প্রচার-প্রসার হয়েছে এবং সেই সম্প্রদায়ের অনেক গ্রন্থের রচনা হয়েছে ঠিক সেইভাবে মোগ্গল্লান ব্যাকরণ পরম্পরাতে ও অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। যেমন-

১। পদসাধন

এই গ্রন্থের রচনা মোগ্গল্লান'এর এক শিষ্য পিয়দস্সী করেছিলেন। তিনি মোগ্গল্লান'এর সমকালীন ছিলেন। এই গ্রন্থ, কচ্চান ব্যাকরণের সংক্ষিপ্ত রূপ 'বালাবতার'এর ন্যায় মোগ্গল্লান ব্যাকরণেরই সংক্ষিপ্ত রূপ। এই গ্রন্থের একাধিক টীকা রচিত হয়েছিল, যার মধ্যে বাচিস্সর উপাধিধারী রাহুল পদ সাধনা টীকা বা বুদ্ধিপ্পসাদিনী নামক টীকা রচনা করেছিলেন।

২। পয়োগ সিদ্ধি

এর রচয়িতা বনরতন মেধঙ্কর। তাঁর সময়কাল, ভুবনবাহু প্রথম এর সমকালীন হওয়ার কারণে ১২৭৭-১২৮৮ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়কাল অর্থাৎ ১৩ শতাব্দীর অপ্তে। তিনি সিংহল নিবাসী ছিলেন। মোগ্গল্লান ব্যাকরণ সম্প্রদায়ে এই গ্রন্থের গুরুত্ব অপরিসীম।

৩। মোগ্‌গল্লানপঞ্জিকা প্রদীপ

পদ সাধন টীকা'র রচয়িতা বাচিস্সর (বাগীশ্বর) উপাধিকারী রাহুল এই গ্রন্থের রচয়িতা। এই গ্রন্থটি মূল অর্থে মোগ্গল্লান পঞ্জিকা'র ব্যাখ্যা গ্রন্থ। মোগ্গল্লান পঞ্জিকা প্রদীপ অংশতঃ পালি এবং অংশত সিংহলী ভাষাতে রচিত হয়েছে। এই গ্রন্থের রচয়িতা বাচিস্সর রাহুল স্বয়ং বিদ্বান এবং বহুভাষাবিদ ছিলেন। সিংহলী ভাষা ব্যতীত তিনি পালি, অপভ্রংশ, পৈশাচী, শৌরসেনী, তামিল এবং সংস্কৃত ভাষার পণ্ডিত ছিলেন। এই কারণে তাঁকে 'ষড়ভাষাপরমেশ্বর' ও বলা হত। এই গ্রন্থে ভাষা সম্পর্কিত অনেক মূল্যবান সামগ্রী সংকলিত এবং অনেক প্রাচীন সংস্কৃত এবং পালি ব্যাকরণ হতে উদাহরণ প্রদান করা হয়েছে। এই গ্রন্থের রচনাকাল ১৪৫৭ খ্রিষ্টাব্দ।

৪। ধাতুপাঠ

ধাতুপাঠ'এর রচয়িতা এবং সময়কাল সম্পর্কে কোনরূপ সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। উইলিয়াম গাইগারের মতে এই গ্রন্থটি অত্যন্ত প্রচীন। তিনি তাঁর গ্রন্থ 'পালি লিটারেচার অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ'এ বলেছেন ধাতুমঞ্জুসা রচনাকালে লেখক ধাতুপাঠ'এর সহায়তা গ্রহণ করেছিলেন। এই গ্রন্থ গদ্যে রচিত এবং ধাতুমঞ্জুসা অপেক্ষা সংক্ষিপ্ত।

৫। সদ্দনীতি

পালি ব্যাকরণ সম্প্রদায় এই গ্রন্থটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সদ্দনীতির রচনা বর্মী রাজা নরপতি সিন্ধুর শাসনকালে (১১৬৭-১২০২ খ্রিষ্টাব্দ) পাগান (বাগান) নিবাসী ভিক্ষু অগ্রবংস করেছিলেন। তিনি উক্ত রাজার আচার্যও ছিলেন। তাঁর অত্যধিক পাণ্ডিত্যের কারণে সম্ভবতঃ তাঁকে 'অগ্গমহাপণ্ডিত' নামে ভূষিত করা হয়েছিল। অগ্রবংস তাঁর ব্যাকরণ গ্রন্থ 'সদ্দনীতি' প্রস্তুত কালে মূল ত্রিপিটক সাহিত্য এবং সংস্কৃত ব্যাকরণ, বিশেষ রূপে পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী'র অধ্যয়ন করেছিলেন তথা উপগ্রন্থের আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই গ্রন্থের অধ্যায় সংখ্যা ২৭ এবং তিন ভাগে বিভক্ত। যেমন-

১। পদমালা
২। ধাতুমালা এবং
৩। সুত্তমালা

পদমালাতে পদ, ধাতুমালাতে ধাতু এবং ধাতু দ্বারা নিষ্পন্ন শব্দ তথা সুত্তমালাতে সূত্র আলোচিত হয়েছে। ধাতুমালাতে লেখক পালি রূপকে সংস্কৃত প্রতিরূপ প্রদান করেছেন। এইভাবে ২৭ অধ্যায় যুক্ত এই গ্রন্থ একটি বৃহৎ পালি ব্যাকরণ গ্রন্থে পরিণত হয়েছে। সুত্ত মালাতে সর্বমোট সূত্রের সংখ্যা ১৩৯১। এই ২৭ অধ্যায়কে স্থূলরূপে ২ ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে

১। মহাসদ্দনীতি: প্রথম ১৮ অধ্যায়কে 'মহাসদ্দনীতি' বলা হয়।
২। চুল্লকসদ্দনীতি: অবশিষ্ট ৯ অধ্যায় হল 'চুল্লকসদ্দনীতি'।

এই গ্রন্থ অত্যন্ত পাণ্ডিত্যপূর্ণ হওয়ার কারণে শুধু বার্মা (মায়ানমার) তে'ই নয় অধিকন্তু অন্যায় স্থানেও এই গ্রন্থটি বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছে। বার্মাতে তো শাস্ত্ররূপে এর অধ্যয়ন হয়।

কিংবদন্তী অনুসারে বার্মাতে এই গ্রন্থ রচনার কিছু দিন পরে যখন এর প্রতিলিপি সমুদ্র মার্গ দ্বারা উত্তরজীবলংকার মহাবিহারে আনয়ন করা হয়, তখন এই গ্রন্থের অধ্যয়নের পর সিংহলী ভিক্ষুগণ উক্ত গ্রন্থের উচ্ছসিত প্রশংসার পর অত্যন্ত প্রচার-প্রসার করেছিলেন। এই গ্রন্থ যদিও কচ্চান ব্যাকরণের প্রতি ভিত্তি করে রচিত হয়েছিল তবুও একটি সম্প্রদায় রূপে তার স্বতন্ত্র সত্ত্বা বজায় রেখেছে।

সদ্দনীতি ব্যাকরণ সম্প্রদায়

এই গ্রন্থ বার্মা (মায়ানমার) এবং লংকাতে (শ্রীলংকা) প্রসিদ্ধি লাভ করলেও এই সম্প্রদায়'এর অধিক গ্রন্থ রচিত হয় নি। শুধুমাত্র 'ধাতুবত্থুদীপনী' নামক ১টি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়।

১। ধাতবত্থুদীপনী

এই গ্রন্থ সদ্দনীতি ব্যাকরণের প্রতি ভিত্তি করে রচিত পালি ধাতু'র পদ্যবদ্ধ সংকলন মাত্র।

এর রচয়িতা রূপে বর্মী ভিক্ষু 'হিঙ্গুলবল জিনরতন'এর উল্লেখ করা হয় কিন্তু এই গ্রন্থের রচনাকাল সম্পর্কিত কোনরূপ তথ্য পাওয়া যায় না। এই গ্রন্থে কচ্চান ব্যাকরণের ধাতুমঞ্জুসা, মোগ্গল্লান ব্যাকরণের ধাতুপাঠ ব্যতীত পাণিনীয় ধাতুপাঠের পর্যাপ্ত আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে।

উপযুক্ত গ্রন্থ ব্যতীত এই পরম্পরার অন্য কোন গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায় না।

অন্য পালি ব্যাকরণ গ্রন্থ :

এই উপযুক্ত মুখ্য পালি ব্যাকরণ ব্যতীত কিছু ফুট (অন্য) পালি ব্যাকরণ গ্রন্থ ও রয়েছে। এই সকল ব্যাকরণ গ্রন্থ আলোচ্য স্থানে বর্ণিত পালি ব্যাকরণ'এর কোন সম্প্রদায়তে সম্পৃক্ত করা হয় নি। এর মধ্যে কিছু প্রমুখ পালি ব্যাকরণ হল এইরূপ- ১। বচ্চবাচক বার্মা (মায়ানমার) নিবাসী ভিক্ষু সামনের ধম্মাদসী ১৪ শতাব্দীর অন্তিম লগ্নে এই গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এর অপর নাম 'বাচবাচক'।

১৮ শতাব্দীর উত্তরার্দ্ধে (১৭৬৮ খ্রীঃ) বর্মী ভিক্ষু সদ্ধম্মনন্দী এই গ্রন্থের একটি টীকা লিখেছিলেন।

২। গন্ধট্ঠি

বার্মা নিবাসী ভিক্ষু মঙ্গল ১৪ শতাব্দীতে এই গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এই গ্রন্থে পালি উপসর্গ ব্যাখ্যাত হয়েছে।

৩। বিভত্তাত্থল্পকরণ

বর্মী রাজা ক্যচ্চার কন্যা ১৪৮১ খ্রিষ্টাব্দে এই গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এতে ২৭টি শ্লোক রয়েছে এবং বিভক্তির প্রয়োগ আলোচিত হয়েছে। পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের ৩টি টীকার উল্লেখ পাওয়া যায় বিভ্যত্থটীকা, বিভত্ত্যত্থদীপনী তথা বিভত্তিকথাবণ্ণনা।

৪। গন্ধাভরণ

অরিয়বংস ১৪৩৬ খ্রিষ্টাব্দে এই গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এর অপর নাম 'গন্থাভরণ' তথা 'গন্ডাভরণ'। এই গ্রন্থে উপসর্গ আলোচিত হয়েছে।

৫। সংবণ্ণনানয়দীপনী

১৬৫১ খ্রিষ্টাব্দে জম্বুধন এই গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

৬। কারকপুপ্ফমঞ্জরী

লংকার (শ্রীলংকা) রাজা কীর্তিশ্রী রাজসিংহের (১৭৪৭-১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দ) শাসনকালে সরণংকর সংঘরাজ'এর শিষ্য লংকা নিবাসী উত্তরগমবন্ডার (রাজগুরু) দ্বারা এই গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। এই গ্রন্থে শব্দ যোজনা অত্যন্ত সুন্দরভাবে উল্লেখিত হয়েছে।

৭। সদ্দবুত্তি

১৭ শতাব্দীর উত্তরার্দ্ধে বার্মা (মায়ানমার) সদ্ধম্মপাল (সদ্ধম্মগুরু) এই গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। কিছু ব্যক্তির মতে এই গ্রন্থের রচনাকাল ১৪ শতাব্দী।

৮। সুধীর মুখমণ্ডল

পালি সমাস সম্পর্কিত এই গ্রন্থটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ, তবে এর রচয়িতা এবং রচনাকাল সম্পর্কিত সঠিক তথ্য পাওয়া যায় নি।

৯। নয়লকখনবিভাবনী

১৮ শতাব্দীর উত্তরার্ধে বর্মী ভিক্ষু বিচিত্তাচার দ্বারা এই গ্রন্থ রচিত হয়েছিল।

এই সকল গ্রন্থ ব্যতীত সদ্দবিন্দু, সদ্দকলিকা, সদ্দবিনিচ্চয় ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। বর্তমানে পালি ব্যাকরণ গ্রন্থের অনুবাদ বিভিন্ন ভাষাতে সম্পন্ন হয়েছে। ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যপ (বিংশ শতাব্দী) কর্তৃক পালি মহাব্যাকরণ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এই গ্রন্থটি মোগ্গল্লান ব্যাকরণের প্রতি ভিত্তি করে রচিত হয়েছিল কিন্তু তবুও এর একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট রয়েছে। তবে একথা স্মরণ যোগ্য যে রবীন্দ্র বিজয় বড়ুয়া কর্তৃক পালি সাহিত্যের ইতিহাস রচিত হলেও পালি ব্যাকরণ গ্রন্থ এই বঙ্গে অপ্রতুল। পালি ভাষা কবে, কাদের নিকট আশা এই যে তারা হয়তো একদিন এই সীমাবদ্ধতাকে অবশ্যই পূরণ করবেন।

সহায়ক গ্রন্থ সূচী:

১। দ্রষ্টব্য: অতিধানপপদীপিকা, সূচী, পৃঃ ২৩৮, কচ্চায়ন ব্যাকরণ (শ্রী লক্ষ্মীনারায়ণ তিওয়ারী) এর ভূমিকা পৃষ্টা ৩১ হতে উদ্ধৃত।
২। দ্রষ্টব্য: বাচস্পতম্, খণ্ড ৫, পৃষ্টা ৪৩২, ১।
৩। সদ্দনীতি, হেলমার স্মিথ, খণ্ড ২, পৃষ্টা ৫৬২। কচ্চায়ন ব্যাকরণের ভূমিকা, পৃষ্টা ৩২ হতে উদ্ধৃত।
৪। ধম্মপদ।
৫। কচ্চায়ন ব্যাকরণ (সম্পাদনা, শ্রী লক্ষ্মীনারায়ণ তিওয়ারী এবং বীরবল শর্মা), তারা পালবিকেশন্স, বারানসী, ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দ।
৬। কালে বত্তমানাতীতে দ্বাদয়ো, কচ্চায়ন ব্যাকরণ ৪.৬.২৭'এ উনাদয়ো ভতেহপি' কাতন্ত্র ব্যাকরণের প্রভাব দৃষ্ট হয়। এইভাবে কিরিয়ায়ং খুতবো, কচ্চায়ন ব্যাকরণ ৪.৬.২৯'এ 'বুতুমৌ ক্রিয়ায়ং ক্রিয়ার্থায়াম্' কাতন্ত্র ব্যাকরণের প্রভাব রয়েছে (দ্রষ্টব্য)। এই ভাবে আরও অনেক প্রভাবের সম্প্রমান দৃষ্ট হয়।
৭। কিম্মা বো চ, কচ্চায়ন ব্যাকরণ, ২.৫.৫'এর বৃত্তি 'কব গতোসি এবং দেবানম্পিয় তিস্স'। তথা যো করোতি স কত্তা, কচ্চায়ন ব্যাকরণ, ২.৬.১১'এর বৃত্তি... উপগুত্তেন বদ্ধো মারো।
৮। ন্যাস, পৃষ্টা ৫। কচ্চায়ন ব্যাকরণের (শ্রী লক্ষ্মীনারায়ণ তিওয়ারী)-এর ভূমিকা, পৃষ্টা ৫৮ হতে উদ্ধৃত।
৯। কচ্চায়ন ভেদ, ৩-৪ কারিকা। কচ্চায়ন ব্যাকরণের (শ্রী লক্ষ্মীনারায়ণ তিওয়ারী)-এর ভূমিকা, পৃষ্টা ৫৮ হতে উদ্ধৃত।
১০। পালি সাহিত্যের ইতিহাস, ভারত সিংহ উপাধ্যায়, পৃঃ ৬৪৬।
১১। জেমস্ এলবিস্ দ্বারা "ইনট্রোডাকশন টু কচ্চায়ন'স গ্রামার'এ কচ্চায়ন ভেদ টীকা' হতে উদ্ধৃত।
পালি ব্যাকরণের (শ্রী লক্ষ্মীনারায়ণ তিওয়ারী)-এর ভূমিকা, পৃষ্টা ৫৯ হতে উদ্ধৃত।
১২। ভরত সিংহ উপাধ্যায় ৮ পরিচ্ছেদ'এর কথা বলেছেন। সম্ভবতঃ এই ৮ পরিচ্ছেদ ৮ পকার বিষয় বস্তুর ক্ষেত্রে বলা হয়েছে ১। সন্ধি, ২। সংজ্ঞা, ৩। নাম, ৪। কারক, ৫। সমাস, ৬। তদ্ধিত, ৭। আখ্যান এবং ৮। কিত।
দ্রষ্টব্য: পালি সাহিত্যের ইতিহাস, ভরত সিংহ উপাধ্যায়, পৃ: ৬৪৫-৪৬।
১৩। শ্রী লক্ষ্মীনারায়ণ তিওয়ারী 'কচ্চায়ন ব্যাকরণের' ভূমিকাতে (পৃ: ৭৪) সুভূতি কে উদ্ধৃত করে এই সময়কাল ১১৮১ খ্রিষ্টাব্দ বলেছেন। ভরত সিংহ উপাধ্যায় ১১৭১ খ্রিষ্টাব্দ বলেছেন।
১৪। বালাবতার, বঙ্গানুবাদ। দেবনাগরী লিপিতে হিন্দি অনুবাদ এবং সম্পাদনা স্বীী দ্বারিকাদাস শাস্ত্রী ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে করেছিলেন। প্রকাশক বৌদ্ধভারতী, বারানসী।
১৫। মোগ্গল্লান ব্যাকরণের হিন্দি অনুবাদের সঙ্গে নাগরীলিপিতে এর সম্পাদনা ভদন্ত আনন্দ কৌশল্যায়ন করেছিলেন।


No comments:

Post a Comment