ভিক্ষু সুমনপাল
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, পন্ডিত, সুসাহিত্যিক জীবন সংগ্রামী ঈশানচন্দ্র ঘোষ জন্মগ্রহণ করেন ১৮৫৮ সালে মে মাসে যশোহর জেলার খরসূতি গ্রামে। পিতা চন্দ্রকিশোর ও মাতা কালীতারা দেবী। কঠোর দারিদ্র্যের মধ্যে ঈশানচন্দ্রের জীবন অতিবাহিত হয়। ঈশানচন্দ্র ঘোষ পাঁচ বছর বয়সে গ্রামের এক পাঠশালায় তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয়। ১৮৬৮ সালে পিতার মৃত্যুর পর অভাব অনটনের কারণে তাঁকে কিছু দিন ফরিদপুরেও অবস্থান করতে হয়। তিনি ১৮৭১ সালে উচ্চ প্রাথমিক পরীক্ষায় (M.V) দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন।
১৮৭২ সালে তিনি ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তি লাভ করেন।
১৮৭৩ সালে ফরিদপুর স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীতে ( বর্তমান সপ্তম শ্রেণী) ভর্তি হন। ১৮৭৭ সালে সরকারি বৃত্তি সহ এন্ট্রাস পাশ করেন। তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে (বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ) এফ. এ. ক্লাসে ভর্তি হন এবং ১৮৭৮ সালে এফ. এ. পরীক্ষায় ( তখন রেঙ্গুন থেকে লাহোর পর্যন্ত এর পরিধি) চতুর্থ স্থান অধিকার করে বৃত্তি সহ এফ. এ. পাশ করেন। জেনারেল এসেম্বলি ইনষ্টিটিউশনে (বর্তমান স্কটিশচার্চ কলেজ) ঈশানচন্দ্র বি. এ ক্লাসে ভর্তি হন এবং 'এ' কোর্সের ছাত্রদের মধ্যে তিনিই প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। ঈশানচন্দ্র ঘোষ ইংরেজিতে এম. এ. পরীক্ষা দেন এবং ১৮৮১-৮২ সালে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উচ্চস্থান লাভ করেন। ১৮৮২ সালে ঈশানচন্দ্র যশোর জেলার নড়াইল হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৮৮৪ সালে জুলাই মাসে সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলে অস্থায়ী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে মাস দুই কাজ করেন। ১৮৮৫ সালে ১০ মার্চ ১০০০ টাকা বেতনে তিনি প্রথমে অস্থায়ীভাবে এবং ১ জুন থেকে স্হায়ীভাবে সরকারি চাকরির ডেপুটি স্কুল ইন্সপেক্টর পদে নিযুক্ত হন। ১৮৯৫- ৯৬ শিক্ষা বিভাগের বার্ষিক বিবরণীতে ছোটনাগপুরের দুর্গম অঞ্চলে তাঁর অক্লান্ত ভ্রমণ, হিন্দি ভাষায় তার বুৎপত্তি হয় ও প্রশাসনিক কাজে তাঁর অভিজ্ঞতা ও কার্যকুশলতার ফলস্বরূপ তিনি কিছুদিনের জন্য সহকারী ডি.পি. আই. পদে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
১৯০৩-১৬ সাল পর্যন্ত তিনি হেয়ার স্কুলে প্রধান শিক্ষকরূপে কাজ করেন। ১৯১৬ সালের ১৬ জানুয়ারি প্রধান শিক্ষকরূপে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯২১ সালে নিখিল বঙ্গ শিক্ষক সংস্থা এ.বি.টি.এ. স্থাপিত হলে তিনি এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি'র পদ অলংকৃত করেন এবং তাঁর সম্পাদনায় প্রতিষ্ঠানের মুখপত্র "টিচার্স জার্নাল" প্রকাশিত হয়। ঈশানচন্দ্র প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন কিন্তু বিদ্যাচর্চাই তার ভিত্তি।
তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পুস্তক "নতুন শিশুপাঠ্য, হিতোপদেশ, ভারতবর্ষের ইতিহাস, ইংল্যাণ্ডের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, মহাপুরুষ চরিত' ইত্যাদি। তিনি নানা বিষয়ে ইংরেজি বাংলায় ১৩ টি স্কুল পাঠ্য বই রচনা করেছিলেন ও সম্পাদনা করেছিলেন এবং অন্য গ্রন্থকারের সহযোগিতায় যেমন "যোগীন্দ্রনাথ বসু ( আদর্শ শিশু পাঠ্য) ও রামেন্দু সুন্দর ত্রিবেদী বিজ্ঞাপন সহ আরো ৬ টি গ্রস্থ রচনা করেছিলেন।
বাংলা সাহিত্যে ঈশানচন্দ্রের অবিস্মরণীয় কীর্তি মূল পালি ভাষা থেকে জাতক অট্ঠকথার বঙ্গানুবাদ, এই অমূল্য গ্রন্থ প্রণয়নের পিছনে কারণ হল ১৯১৩ সালে তাঁর জেষ্ঠ্যপুত্র প্রফুল্লচন্দ্রের একমাত্র সন্তান বিমলচন্দ্রের অকাল মৃত্যুতে প্রিয় পৌত্রকে হারিয়ে শোকাপনোদনের যে বিশাল ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ গ্রন্থ তিনি রচনা করেছিলেন তা পালি সাহিত্যে তথা বাংলা সাহিত্যের অক্ষয় সম্পদ হয়ে আজও দেদীপ্যমান।
শেষ জীবনে ঈশানচন্দ্র ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হন ( যক্ষা)। তাঁর চিকিৎসা করেছিলেন তাঁরই প্রিয় সুহৃদ চিকিৎসাবিদ ডা. নীলরতন সরকার। ১৯৩৫ সালে ২৮ অক্টোবর ৭৭ বছর বয়সে ঈশানচন্দ্র প্রয়াত হন।
তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পর বহু শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়।
তাঁর জোষ্ঠপুত্র প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের কাছে ভিয়েনা থেকে নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসু লিখেন- শ্রদ্ধাভাজনেষু, "সংবাদপত্র মারফত আপনার পিতৃদেবের স্বর্গারোহণের খবর জানিয়া বিশেষ ব্যথিত হইলাম। তিনি বিদ্বান, চরিত্রবান ও সকল দিক দিয়া যোগ্য পুরুষ ছিলেন, তদ্ব্যতীত তাঁহার সমাজ হিতৈষিকা সকলের গৌরবের বিষয় ছিল। তাই তাঁহার অমর আত্মার উদ্দেশ্যে ভক্তি অর্ঘ্য নিবেদন করিয়া আমি ধন্য মনে করিতেছি। আপনারা আমার আন্তরিকপূর্ণ শোকার্ত বার্তা গ্রহণ করুন।" ব্রিটিশ সরকার তাঁকে "রায়" সাহেব উপাধিতে ভূষিত করেন"। ঈশানচন্দ্র ঘোষের গভীর পাণ্ডিত্য, প্রখর ব্যক্তিত্ব, সততা অনমনীয়, চারিত্রিক দৃঢ়তার জন্য তিনি সকলের শ্রদ্ধার পাত্র।
ঈশানচন্দ্রের অবিস্মরণীয় কৃর্তি জাতকের বঙ্গানুবাদ কার্যে তাঁর সহিষ্ণুতা ও স্থৈর্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের একটি মন্তব্য স্মরণ করে ড. সুবোধচন্দ্র সেন বলেছিলেন-
ঈশানচন্দ্র যে উপায়ে জীবনে গভীরতম শোককে পরাস্ত করিয়া তাঁহার অবিস্মরণীয় স্মারক রচনা করিয়াছেন তাহা তুলনাহীন। রবীন্দ্রনাথের ভাষা উদ্ধার করিয়া বলা যায়, গিরিশৃঙ্গে অঙ্কুরিত দেবদারুদ্রুমের ন্যায় এই কায়স্থ সন্তান আভ্যন্তরীণ কঠিন শক্তির দ্বারা শুধু দারিদ্র্যকে জয় করেন নাই পরন্তু আপন অপর্যাপ্ত বলবুদ্ধি মৃত্যুশোককে অবিস্মরণীয় রূপদান করিয়াছেন। সার্দ্ধোশত বর্ষেও তাঁর কীর্তি মহিমায় উজ্জ্বল ভাস্বররূপে দেদীপ্যমান। পালি-বাংলা ভাষা ও সাহিত্য যতকাল স্থায়ীত্ব লাভ করবে ততকাল তাঁর কীর্তি নক্ষত্রসম আলোকদান করবে। অলং ইতি বিত্থারেন।
No comments:
Post a Comment