Friday, July 12, 2024

ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্ম

 ভূমিকা


ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্ম - কখনও কখনও অজ্ঞেয়বাদী বৌদ্ধধর্ম, বৌদ্ধ অজ্ঞেয়বাদ,  বাস্তববাদী বৌদ্ধধর্ম বা বৌদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষতা হিসাবেও উল্লেখ করা হয় - মানবতাবাদী, তত্ত্বগত মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে বৌদ্ধ ধর্মের একটি রূপের জন্য একটি বিস্তৃত শব্দ। বাস্তববাদ এবং (প্রায়শই) প্রকৃতিবাদ, অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক বিশ্বাসকে এড়িয়ে যাওয়া। 

ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধরা বুদ্ধের শিক্ষা এবং বৌদ্ধ গ্রন্থগুলিকে যুক্তিবাদী এবং প্রায়শই প্রমাণবাদী পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করে, যে সময়ে বুদ্ধের আবির্ভাব এবং যে সময়ে বিভিন্ন সূত্র ও তন্ত্র রচিত হয়েছিল তার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে।

ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্মের মূল রয়েছে বৌদ্ধ আধুনিকতাবাদ এবং মানবতাবাদে এবং এটি ধর্মনিরপেক্ষকরণের বিস্তৃত প্রবণতার অংশ যা রেনেসাঁয় ধ্রুপদী গ্রীক সংস্কৃতির  পুনরুদ্ধারের পর থেকে পশ্চিমে চলমান রয়েছে। বিভিন্ন ধরণের বৌদ্ধ আধুনিকতার বিপরীতে, যা আধুনিকতার বক্তৃতার আলোকে বৌদ্ধ চিন্তাধারা এবং অনুশীলনের ঐতিহ্যগত স্কুলগুলির পরিবর্তন হতে থাকে, ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধ ধর্ম নিজেই ধর্মের মূল উপাদানগুলির পুনর্বিন্যাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই লক্ষ্যে এটি ঐতিহাসিক বুদ্ধ সিদ্ধার্থ গৌতমের মূল শিক্ষা পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করে, তবুও "বুদ্ধ আসলে কী বোঝাতে চেয়েছিলেন" তা প্রকাশ করার দাবি না করে বরং, এটি প্রাথমিক প্রামাণিক শিক্ষাগুলিকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করে যা বুদ্ধের নিজস্ব ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে (খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে গাঙ্গেয় সমভূমির সংস্কৃতি) তাদের অর্থ রচিত হয় এবং  নিজেদের সময়ে বসবাসকারী মানুষের কাছে তাদের মূল্য এবং প্রাসঙ্গিকতা প্রদর্শন করে। 

ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধ ধর্ম ভারতীয় ধর্মীয় সংস্কৃতির আধিভৌতিক বিশ্বাস এবং সোটেরিওলজিকে পিছনে ফেলে দেওয়ার শিক্ষা দান করে। এই সংস্কৃতি মানব জীবনকে দুর্ভোগের এক অপূরণীয় ক্ষেত্র হিসাবে দেখেছিল, যেখান থেকে একজনের একটি স্থায়ী-মানবীয় অবস্থার সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া উচিত - এমন একটি অবস্থান যা কার্যত সমস্ত বৌদ্ধ বিদ্যালয়, সেই সঙ্গে হিন্দু ও জৈন ধর্ম স্থায়ী হয়। অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্ম এই জীবন এবং এই পৃথিবীতে পূর্ণ মানব বিকাশের পথপ্রদর্শক হিসাবে বুদ্ধের শিক্ষা প্রদান করেছে। 

ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্ম অর্থোডক্স বৌদ্ধ বিশ্বাসের অধিবিদ্যা দ্বারা বৈধ ক্ষমতা কাঠামো প্রত্যাখ্যান করে। এটি ধ্যান অনুশীলনের জন্য প্রমিত প্রায়োগিক পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে আধ্যাত্মিক অগ্রগতির ধারণা, সেই সঙ্গে এই ধারণাটি যে বৌদ্ধ অনুশীলন মূলত একটি ঐতিহ্যগত স্কুল বা শিক্ষকের কর্তৃত্ব দ্বারা অনুমোদিত ধ্যানের কৌশলগুলির একটি সেটে দক্ষতা অর্জনের সঙ্গে সম্পর্কিত। পরিবর্তে, ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্ম অনুশীলনের  উপর জোর দেয় , স্বায়ত্তশাসনকে উৎসাহিত করে এবং মানবতার প্রতিটি দিককে সমানভাবে  অন্তর্ভুক্ত করে, যেমনটি মহৎ অষ্টাঙ্গিক পথ (যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গি, অভিপ্রায়, বক্তৃতা, কর্ম পদ্ধতি, জীবিকা, প্রচেষ্টা, মননশীলতা এবং একাগ্রতা), এই ধরনের একটি পদ্ধতি নির্দিষ্ট ব্যক্তি এবং সাম্প্রদায়িক চাহিদার জন্য বিস্তৃত প্রতিক্রিয়া তৈরি করার জন্য উন্মুক্ত, সব সময় এবং স্থানের জন্য বৈধ "আলোকিতকরণ" করার "একটি সত্য উপায়" থাকার উপর জোর দেয়।

 বৌদ্ধধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষ বলতে গেলে বিশাল আকার ধারণ করে, কিন্তু এই আলোচনা বিস্তৃতি না ঘটিয়ে অতি সংক্ষেপে পরিবেশিত হল। এই গ্রন্থের প্রকাশক সৃষ্টি প্রকাশনীকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই। অলং ইতি বিত্থারেন।

                                                                                                                                   সুমনপাল ভিক্ষু
অক্ষয় তৃতীয়া
১৪৩০, বঙ্গাব্দ 
২৫৬৮ বুদ্ধাব্দ

একজন তীর্থযাত্রীর সঙ্গী (পবিত্র স্থানগুলিতে তীর্থযাত্রাকে উন্নত করতে বৌদ্ধ গ্রন্থ থেকে পাঠ)

 ভূমিকা

মূল লেখক ও সম্পাদক কেন এবং বিশাখা কাওয়াসাকি 

বৌদ্ধধর্মে অনেক তীর্থ, মহাতীর্থ ও ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে। 'তীর্থ' শব্দের অর্থ হল 'পুণ্যস্থান'। সুতরাং যে স্থান দর্শন করলে পুণ্য অর্জন হয়, তাকে 'তীর্থস্থান' বলে, বুদ্ধের জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলীর স্মৃতি বিজড়িত স্থানসমূহকে বৌদ্ধ 'তীর্থস্থান' বলা হয়। এ সকল পবিত্র স্থানগুলোকে দু'ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- তীর্থ ও মহাতীর্থ। বুদ্ধের জীবনে নানা ঘটনাবহুল পবিত্র স্থানসমূহকে 'বৌদ্ধ তীর্থস্থান' বলা হয়। ঐতিহ্যমণ্ডিত স্মৃতিবহ এ সকল স্থানে বিহার, চৈত্য, স্তূপ প্রভৃতি নির্মিত হয়েছে। বৌদ্ধধর্মে এ সকল স্থানকে 'তীর্থ' বলা হয়। যেমন, কপিলাবস্তু, শ্রাবস্তী, লুম্বিনী, বৈশালী, রাজগৃহ, প্রভৃতি। বুদ্ধের জীবনের উল্লেখযোগ্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি বিজড়িত পবিত্র স্থানগুলোকে 'মহাতীর্থ' বলা হয়। তীর্থস্থানগুলো হল পবিত্রস্থান, পুণ্যস্থান, পুণ্যক্ষেত্র। ধর্মপালনের মত তীর্থদর্শনও গুরুত্বপূর্ণ। চিত্তশুদ্ধি ও মনের শুচিতার জন্য তীর্থদর্শন উত্তম। মনের প্রসারতা বৃদ্ধি পায়। বুদ্ধ যেসব স্থানে গিয়ে ধর্মপ্রচার করেছেন, সেসব স্থান তাঁর জীবিতকালে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। এগুলো পবিত্র তীর্থস্থানরূপে বিবেচিত।

 বুদ্ধ লুম্বিনীতে জন্ম করেন, বুদ্ধগয়ায় বুদ্ধত্ব লাভ করেন, সারনাথে প্রথম ধর্মপ্রচার করেন এবং কুশীনগরে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। ভগবান বুদ্ধের উক্ত চারটি মহৎ ঘটনা এ চারটি স্থানে সংঘটিত হয়েছিল। তাই এ চারটি স্থানকে 'মহাতীর্থস্থান' বলা হয়। বুদ্ধ জীবনের বিশেষ ঘটনাবলির জন্য আরো চারটি স্থান বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। স্থানগুলো হলো- রাজগৃহ, বৈশালী, শ্রাবস্তী এবং সাংকাশ্য নগর। উপরি-উক্ত আটটি স্থান বৌদ্ধধর্মে 'অষ্টমহাতীর্থস্থান' নামে পরিচিত। বুদ্ধ ও বৌদ্ধধর্মের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো বৌদ্ধদের নিকট অতি পবিত্র পুণ্যভূমি। ঐতিহ্যমণ্ডিত স্মৃতিবহ এ সকল স্থানে বিহার, চৈত্য, স্তূপ, স্তম্ভ প্রভৃতি নির্মিত হয়েছে।

খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৩ অব্দে গৌতমবুদ্ধ বর্তমান নেপালের কপিলাবস্তুর লুম্বিনী কাননে জন্মগ্রহণ করেন। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেন। বুদ্ধত্ব লাভের পর সর্বপ্রাণীর কল্যাণের জন্য বিভিন্ন স্থানে বিচরণ করে তিনি ধর্ম প্রচার করেছেন। 

ঐতিহাসিক স্থান

বৌদ্ধদের অনেক ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে। ঐতিহাসিক স্থানসমূহও সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। বুদ্ধ, বুদ্ধের শিষ্য, বৌদ্ধ রাজন্যবর্গ কিংবা প্রাচীন সভ্যতা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও শিল্পকলার নিদর্শনসম্পন্ন স্থানকে ঐতিহাসিক স্থান বলা হয়। যেমন- গান্ধার, মথুরা, সাঁচি, অজন্তা, ইলোরা, তক্ষশীলা, নালন্দা প্রভৃতি। ঐতিহাসিক স্থান হল অতীতের বৌদ্ধ রাজা-মহারাজা বা স্বনামধন্য মহাপুরুষের রেখে যাওয়া কীর্তি। এসব কীর্তি কালের আবর্তে ধ্বংস হয়ে হারিয়ে যায়। পরবর্তীতে প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকরা আবার তা আবিষ্কার করেন। 

চার মহাতীর্থের মধ্যে লুম্বিনী প্রথম মহাতীর্থ। লুম্বিনী গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান। নেপালের দক্ষিণ সীমান্তের অন্তর্গত বুটন জেলার ভগবানপুর তহশিলের উত্তরে 'রুম্মিনদেই' নামক স্থানে অবস্থিত। শুদ্ধোদনের স্ত্রী রানি মহামায়া শ্বশুর বাড়ি থেকে পিত্রালয়ে যাবার পথে লুম্বিনী কাননে সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্ম হয়। রাজপুত্রের জন্মের কারণে লুম্বিনীর পরিচিতি বৃদ্ধি পায় এবং এটি 'মহাতীর্থ' হিসেবে বিখ্যাত হয়।  লুম্বিনী মন্দিরের পাশেই আছে একটি অশোকস্তম্ভ। 

স্তম্ভে উৎকীর্ণ লিপি পাঠে জানা যায়, এখানেই সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্ম হয় এবং মহারাজ অশোক এ স্তম্ভ স্থাপন করেছিলেন তাঁর রাজত্বের বিংশতিতম বর্ষে। এখানকার প্রধান দর্শনীয় বস্তু হল অশোক স্তম্ভ ও রুম্মিনদেই মন্দির। সম্রাট অশোক তাঁর রাজ্য অভিষেকের ২০ বছরে দ্বিতীয়বার লুম্বিনী আগমন করেন। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ অব্দে তিনি সিদ্ধার্থের জন্মস্থানকে চিরস্মরণীয় ও চিহ্নিত করার জন্য একটি স্তম্ভ স্থাপন করেন। ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে স্তম্ভটি আবিষ্কৃত হয়। এটি ‘অশোক গুপ্ত' নামে পরিচিত। অশ্বমূর্তি সিদ্ধার্থের সংসার ত্যাগের প্রতীক। স্তম্ভটি পরবর্তীকালে মাঝখানে ভেঙে গেলেও এর গায়ে যে শিলালিপি ছিল তা এখনো বর্তমান। শিলালিপিতে প্রাকৃত ভাষায় এরূপ খোদিত আছে - 'এ স্থানে শাক্যমুনি বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেন। স্তম্ভের গায়ে খোদিত অন্য অনুশাসনলিপি থেকে আরো জানা যায় যে, সম্রাট অশোক লুম্বিনী উদ্যান দর্শনের স্মারক এবং বুদ্ধের স্মৃতির প্রতি সম্মানার্থে এ স্থানকে করমুক্ত করেছিলেন। 

'বুদ্ধগয়া' হচ্ছে চার মহাতীর্থের একটি শ্রেষ্ঠ 'তীর্থ'। এটি অন্যতম মহাতীর্থ। যার প্রাচীন নাম ছিল উরুবেলা বা উরুবিল্ব। সিদ্ধার্থ গৌতম এখানে বোধিবৃক্ষের নিচে বসে সাধনার মাধ্যমে শুভ বৈশাখী পূর্ণিমাতে বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন। তখন থেকে তিনি বুদ্ধ বা গৌতমবুদ্ধ নামে পরিচিত। তাই বুদ্ধগয়া জগতের বৌদ্ধদের জন্য সবচেয়ে পবিত্র ও পুণ্যময় স্থান। বুদ্ধগয়া ভারতের বিহার রাজ্যে অবস্থিত। প্রাচীন নৈরঞ্জনা নদীর কূল বেয়ে গেছে এবং সে নদীর বর্তমান নাম ফল্গু নদী। বুদ্ধগয়ার প্রধান আকর্ষণ হলো বিশাল সুউচ্চ চারকোণা বুদ্ধমন্দির এবং মন্দিরের গা ঘেঁষে বোধিবৃক্ষ ও বুদ্ধের বজ্রাসন। এ বোধিবৃক্ষ এক ঐতিহাসিক বৃক্ষ। সপ্তম শতকে হিউয়েন সাং ভারত পরিভ্রমণ করতে এসে বোধিবৃক্ষ ও বজ্রাসন দেখতে পান। এ বজ্রাসন একটি অখণ্ড পাথরে নির্মিত বলে বর্ণিত। বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে যে সমস্ত স্মৃতিসৌধ আছে তার মধ্যে বুদ্ধগয়ার এ মহাবোধি মন্দিরটি সবচেয়ে প্রাচীন। সম্রাট অশোকই সর্বপ্রথম এটা বড় করে নির্মাণ করেছিলেন। বিশ্বের ইতিহাসে বুদ্ধগয়ার এ মহাবোধি মন্দির এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে। 

চার মহাতীর্থের একটি হচ্ছে সারনাথ। সারনাথের পূর্ব নাম ছিল ইসিপতন বা 'মৃগদাব'। গৌতম বুদ্ধ গয়ার বোধিবৃক্ষমূলে বুদ্ধত্ব লাভের পর জীবগণের মুক্তিলাভের জন্য প্রথম ধর্মপ্রচার করেন এই সারনাথে। সারনাথ বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য স্থান। ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের বারাণসী থেকে প্রায় ৭ কিলোমটিার দূরে বরুণা নদীর তীরে সারনাথ অবস্থিত।  বুদ্ধগয়ায় জ্ঞানলাভের পর গৌতম বুদ্ধ সর্বপ্রথম যে পাঁচ শিষ্যের কাছে ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র দেশনা করেন তাঁদের পঞ্চবর্গীয় শিষ্য বলে। তাঁদের নাম হচ্ছে কৌণ্ডিন্য, বপ্প, ভদ্দীয়, মহানাম ও অশ্বজিৎ। বুদ্ধ তাদের নিকট প্রথম যে সূত্র দেশনা করেছিলেন তা ধর্মচক্র প্রবর্তন নামে খ্যাত। বুদ্ধ এখানে ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র ছাড়াও আদিচ্চ পরিযোসান সুত্ত, রথাভর সুত্ত, সচ্চবিভঙ্গ সুত্ত, পস সুত্ত, কুঠবিষ সুত্ত প্রভৃতি আরও অনেক সূত্র দেশনা করেছিলেন।

 বুদ্ধ  ভিক্ষুদের বিভিন্ন দিকে ধর্ম প্রচারের জন্য পাঠান। পরবর্তীকালে সারিপুত্র, মৌদগল্যায়ন মহাকচ্চায়ন প্রমুখ মহাশ্রাবক বাস করতেন। হিউয়েন সাঙের বিবরণ থেকে জানা যায় যে তাঁর সময় সারনাথের সঙ্ঘরাম আটভাগে বিভক্ত ছিল। বুদ্ধের পরিনির্বাণের পরেই সারনাথ ধীরে ধীরে বৃহৎ সংঘরামে পরিণত হয়। অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের অব্যবহিত পরেই সারনাথ পরিদর্শন করেছিলেন। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সৌজন্যে খননকার্যের ফলে এ স্থানে বহু ধবংসাবশেষ আবিস্কৃত হয়েছে। 'ধর্মচক্র প্রবর্তনের স্মারক হিসেবে সম্রাট অশোক এখানে একটি স্তূপ নির্মাণ করেন। স্তূপটি পাথরের তৈরি। এর উচ্চতা ছিল ১৪৫ ফুট এবং প্রস্থ ছিল ৯৪ ফুট। চিনা পরিব্রাজক শুয়াং জাঙ স্তূপটি দেখেছিলেন । 

 তিনি মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন কুশীনগরে। বুদ্ধের সময়কালে স্থানটি মল্ল রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। বুদ্ধের জীবনের চারটি প্রধান ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল বলে এ চারটি স্থানকে মহাতীর্থস্থান বলে। কুশীনগর বৌদ্ধদের অন্যতম পবিত্র তীর্থভূমি। এখানে গৌতম বুদ্ধ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। প্রাচীনকালে কুশীনগর বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। যেমন, কুশীনারা, কুশীগ্রাম, কৃপাবর্তী ইত্যাদি।  গুপ্ত সম্রাট কুমারগুপ্তের সময় হরিবল নামক এক বৌদ্ধ দাতা এখানে দীর্ঘ ২২ হাত লম্বা একটি শায়িত বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ করেন। এর মধ্যে একটি 'পরিনির্বাণ তাম্রপট' নামে তামার পাত দেখা যায়। সম্রাট অশোক এই স্থান পরিদর্শন করে বুদ্ধের পরিনির্বাণ স্থান নির্দিষ্ট করেন। চিনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েন কুশীনগর ভ্রমণ করেন। তিনি এখানে লোকবসতি বেশি দেখেননি বলে লিখে গেছেন।

শ্রাবস্তী হচ্ছে কোশল রাজ্যের এক সমৃদ্ধশালী নগরী। প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের শুরু খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে। এর আগেও যে প্রাচীন ভারতে রাজনৈতিক ইতিহাস ছিল না তা নয়, তবে সেই ইতিবৃত্তটি আজও তেমন স্পষ্ট নয়। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের দিকে প্রাচীন ভারতে ষোলোটি স্থানীয় রাজ্য গড়ে উঠেছিল। এই রাজ্যগুলির নাম বৌদ্ধগ্রন্থ অঙ্গুত্তর নিকয় তে পাওয়া যায়। বৌদ্ধসাহিত্যে এই রাজ্যগুলিকে ষোড়শ মহাজনপদ বলে অবহিত করা হয়েছে। এই ষোড়শ মহাজনপদগুলি হল: 'কাশী, কোশল, অঙ্গ, মগধ, বজ্জি, মল্ল, চেদি, বৎস, কুরু, পাঞ্চাল, মৎস, সুরসেনা, অস্মক, অবন্তী, গান্ধার এবং কম্বোজ। গঙ্গার উত্তরে ছিল কোশল রাজ্য। এই রাজ্যেরই এক সমৃদ্ধশালী নগরী ছিল শ্রাবস্তী। পালি ভাষায় শ্রাবস্তী হল সাবত্থি। বৌদ্ধ ঐতিহ্য বলে, সাবত্থি নগরীতে সাধু সাবত্থা বাস করতেন বলেই ঐ নাম। শ্রাবস্তী নগরীর নামসংক্রান্ত আরও একটি কাহিনি আছে। যেখানে শ্রাবস্তী নগরী গড়ে উঠেছিল সেখানেই এককালে একটি অতিথিশালা ছিল। অতিথিশালায় নানা রাজ্যের বণিকেরা সমবেত হত। বণিকেরা একে অন্যকে জিজ্ঞেস করত, কিম বানডাম আত্থি? (কী আছে সঙ্গে?) উত্তরে বলা হত, সব্বং অত্তি (আমাদের সব আছে)। এই সব্বং অত্তি শব্দ দুটো থেকেই হয়তো নগরীর নাম সাবত্থি বা শ্রাবস্তী হয়েছে।

গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে শ্রাবস্তী নগরীর সম্পর্ক ছিল নিবিড়। সদত্ত ছিলেন শ্রাবস্তী নগরীর একজন ধনী শ্রেষ্ঠী। সুদত্ত ব্যবসায়ের কাজে মগধের রাজধানী রাজগৃহ নগরীতে গিয়েছিলেন। ওই রাজগৃহে নগরীতেই সুদত্ত প্রথম বুদ্ধকে দেখেছিলেন। বুদ্ধের সঙ্গে কথা বলে সুদত্ত বুদ্ধের এক পরম ভক্তে পরিণত হয়। বুদ্ধকে একবার শ্রাবস্তী যাওয়ার অনুরোধ করেন সুদত্ত। বুদ্ধ রাজী হন।

কিছুকাল পরের কথা। বুদ্ধ শ্রাবস্তী আসছেন; সঙ্গে কয়েক হাজার শিষ্য। এত লোককে কোথায় থাকবার আয়োজন করা যায়। সুদত্ত চিন্তিত হয়ে পড়লেন। শ্রাবস্তী নগরীর বাইরে যুবরাজ জেত এর বিশাল একটি বাগান ছিল। সুদত্ত বাগানটি কিনতে চাইলে জেত প্রথমে রাজী হননি। পরে অবশ্য শর্তসাপেক্ষে রাজী হলেন—স্বর্ণমুদ্রায় সম্পূর্ণ বাগান ঢেকে দিতে হবে। সদুত্ত সম্মত হলেন। সুদত্ত গোশকট করে স্বর্ণমুদ্রা এনে বাগান ঢেকে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। সুদত্তর পরম বুদ্ধভক্তি দেখে জেত অভিভূত হয়ে পড়েন। তিনি সুদত্তকে বাগানখানি দান করলেন। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সুদত্ত জেত এর নামে বাগানে নাম রাখেন জেতবন

বুদ্ধ শ্রাবস্তী এলেন। ধ্যান করলেন, দান করলেন; শ্রাবস্তী নগরীকে অমর করে রাখলেন। রাজকুমার জেত অসম্ভব ধনাঢ্য ছিলেন; তিনি বুদ্ধকে আঠারো কোটি স্বর্ণ মুদ্রা দান করেন।

সুদত্ত বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সুদত্ত অনাথদেরকে অন্ন (পিণ্ডক) দিতেন বলে তাঁকে অনাথপিণ্ডিক বলা হত। অনাথপিণ্ডিক নামটি বুদ্ধই দিয়েছিলেন।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব

তীর্থস্থান অতীত ইতিহাসের অনন্য সাক্ষী। তাই তীর্থস্থান ভ্রমণে ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়। বৌদ্ধ তীর্থস্থানসমূহ শুধু বৌদ্ধ ধর্মীয় নয় বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনারও প্রামাণ্য দলিল। বুদ্ধ এবং প্রাচীনকালের রাজন্যবর্গ, রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি এবং ধর্ম-দর্শনের নানা ঘটনা তীর্থস্থানসমূহের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেমন, বৌদ্ধতীর্থ সপ্তপর্ণী গুহায় প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ সঙ্গীতিতে মহাকশ্যপ স্থবিরের নেতৃত্বে এবং পাঁচশত পণ্ডিত অর্থৎ ভিক্ষুর উপস্থিতিতে প্রথম বুদ্ধবাণী সংগৃহীত হয়েছিল। জানা যায়, রাজা অজাতশত্রু প্রথম সঙ্গীতি অনুষ্ঠানে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। সুতরাং সপ্তপর্ণী গুহা ভ্রমণে ত্রিপিটক সংকলনের ইতিহাস জানা যায়। পণ্ডিতগণ প্রাচীন তীর্থস্থানগুলোকে অতীতের সভ্যধর্মচক্র প্রবর্তনের স্মারক হিসেবে সম্রাট অশোক এখানে একটি স্তূপ নির্মাণ করেন। স্তূপটি পাথরের তৈরি। এর উচ্চতা ছিল ১৪৫ ফুট এবং প্রস্থ ছিল ৯৪ ফুট। চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং স্তূপটি দেখেছিলেন। তা ও সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবে গণ্য করেন। প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারগুলো শুধু ধর্ম নয়, নানা শাস্ত্রের শিক্ষাকেন্দ্রও ছিল। বুদ্ধ শিষ্যরা ধর্ম শিক্ষার পাশাপাশি জ্যোতিষশাস্ত্র, আয়ুর্বেদ, গণিতশাস্ত্র, চিত্রকলা, ভাস্কর্য ইত্যাদিও শিক্ষা দিতেন। তক্ষশীলা, নালন্দা, বিক্রমশীলা, ওদন্তপুরী, প্রভৃতি প্রাচীন যুগের অন্যতম শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। এ শিক্ষাকেন্দ্র গুলোর ইতিহাস পাঠে।

তীর্থস্থানসমূহে প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির নানা উপাদান ছড়িয়ে আছে। যেমন, বিভিন্ন তীর্থস্থানের ধ্বংসাবশেষ থেকে বিহারের অবকাঠামো, স্তূপ, স্তম্ভ, ভিক্ষুদের ব্যবহারের দ্রব্যসামগ্রী, বুদ্ধ-বোধিসত্ত্ব ও বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি, প্রাচীন মুদ্রা, পোড়ামাটি ও পাথরের চিত্রফলক, অনুশাসনলিপি প্রভৃতি আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব প্রত্নসামগ্রী হতে প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। যেমন: অলঙ্কৃত ইষ্টক দ্বারা নির্মিত বিহারের অবকাঠামোতে সে যুগের উন্নত নির্মাণ শৈলীর পরিচয় পাওয়া যায়। আবিষ্কৃত মূর্তিগুলো মূল্যবান পাথরে নিখুঁতভাবে নির্মিত, যা প্রাচীনকালের উন্নত ভাস্কর্য শিল্পের স্বাক্ষর বহন করে। চিত্রফলকগুলোতে তৎকালীন ধর্মীয় ও সমাজজীবনের নানা কাহিনী অঙ্কিত আছে। স্তূপ ও স্তম্ভ শীর্ষে স্থাপিত অশ্ব ও সিংহ মূর্তিগুলোতে অপরূপ শৈল্পিক সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটেছে। এসব বিবেচনা করে বলা যায়, তীর্থস্থানের প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব অপরিসীম।


একজন তীর্থযাত্রীর সঙ্গী (পবিত্র স্থানগুলিতে তীর্থযাত্রাকে উন্নত করতে বৌদ্ধ গ্রন্থ থেকে পাঠ) মূল লেখক ও সম্পাদক কেন এবং বিশাখা কাওয়াসাকি গ্রন্থটি অনুবাদ করা হয়েছে শ্রীলঙ্কার প্রখ্যাত ভিক্ষু লেখক সুন্দর করে রচিত হয়েছে। যতটুকু সম্ভব সহজ ও সরল ভাষায় বঙ্গানুবাদ করতে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছি, আমার পিতা মৃত্যুর পূর্বে প্রয়াত দুলাল চন্দ্র বড়ুয়া অনুবাদ কার্য করে গিয়েছেন, আমিও অর্ধেক করেছি। প্রয়াত দুলাল চন্দ্র বড়ুয়া ২০১৫ সালে সমগ্র  বৌদ্ধ তীর্থস্থান স্বচক্ষে ও শ্রদ্ধাসম্পন্ন হয়ে দর্শন করেছেন এবং বুদ্ধ বাণী সত্যিকার নিজে সারাজীবন প্রায়োগিক বিদ্যায় অনুশীলন করেছেন। আশা করি গ্রন্থ সফলতা লাভ করবে, পাঠকবৃন্দ অজানা তথ্য জানতে পারবেন এবং নিজেদের ঋদ্ধ করবেন।  অলং ইতি বিত্থারেন।


সুমনপাল ভিক্ষু


 

মহামানব বুদ্ধের সংক্ষিপ্ত জীবনী

 ভূমিকা

 

গৌতম বুদ্ধ ছিলেন একজন তপস্বী, শ্রমণ। সর্বোপরি তিনি একজন সমাজসংস্কারক মানবতাবাদী যুগপুরুষ। যাঁর উদার চিন্তাধারা এবং যাঁর যুগপোযোগী শিক্ষার ভিত্তিতে বৌদ্ধধর্ম প্রবর্তিত হয়। তিনি সিদ্ধার্থ গৌতম শাক্যসিংহ বুদ্ধ বা বুদ্ধ উপাধি অনুযায়ী শুধুমাত্র বুদ্ধ নামেও পরিচিত। আনুমানিক খ্রি.পূ. ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে প্রাচীন ভারতের পূর্বাঞ্চলে আবির্ভূত হয়েছিলেন ও তাঁর উপদেশিত ধর্ম বিঘোষিত হয়েছিল।

বিভিন্ন পরস্পর বিরোধী ঐতিহ্যশালী জীবনী গ্রন্থগুলি সিদ্ধার্থ গৌতমের জীবনীর উৎস। দ্বিতীয় শতাব্দীতে অশ্বঘোষ দ্বারা রচিত 'বুদ্ধচরিত' নামক মহাকাব্যটি বুদ্ধের প্রথম পূর্ণ জীবনীগ্রন্থ। যেটি শ্রীরথীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক সংস্কৃত হতে প্রথম বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়। তৃতীয় শতকে রচিত 'ললিত বিস্তর' গৌতম বুদ্ধের জীবনী নিয়ে লিখিত পরবর্তী গ্রন্থ। ১৯৯১ সালে বিজয়া গোস্বামী কর্তৃক অনূদিত হয় ও সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার হতে প্রকাশিত হয়।

চতুর্থ শতাব্দীতে রচিত মহাসাঙ্গিক লোকোত্তর ঐতিহ্যের মহাবস্তু গ্রন্থটি অপর একটি প্রধান জীবনীগ্রন্থ হিসেবে পরিগণিত হয়। এই গ্রন্থটি শ্রীরাধাগোবিন্দ বসাক কর্তৃক অনূদিত হয় ও সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনী হতে প্রকাশিত হয়। তৃতীয় শতক থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীতে রচিত ধর্মগুপ্তের ঐতিহ্যের 'অভিনিষ্ক্রমণ সূত্র' গ্রন্থটি বুদ্ধের অপর একটি জীবনী গ্রন্থ। সর্বশেষ পঞ্চম শতাব্দীতে রচিত বুদ্ধঘোষ রচিত থেরবাদ ঐতিহ্যের 'নিদান কথা' উল্লেখ্য। এই গ্রন্থটিকে ত্রিপিটকের অংশ হিসেবে জাতক, মহাপদান সূত্র, আচরিয়ভূত সূত্রে বুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ জীবনী না থাকলেও কিছু নির্বাচিত অংশ রয়েছে। এই 'নিদান কথা' গ্রন্থটি ধর্মপাল ভিক্ষু কর্তৃক অনূদিত ও বৌদ্ধ ধর্মানকার সভা হতে প্রকাশিত হয়। এবং ভিক্ষু সুমনপাল কর্তৃক দ্বিতীয়বার অনূদিত হয় কিন্তু এটি এখনো প্রকাশের অপেক্ষায়।

বুদ্ধের এই সমস্ত ঐতিহ্যশালী জীবনী গ্রন্থ সাধারণ অলৌকিক ও অতিপ্রাকৃত কাহিনীতে পরিপূর্ণ। মহাবস্তু প্রভৃতি গ্রন্থে বুদ্ধকে লোকোত্তর সর্বোৎকৃষ্ট চরিত্র হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যিনি জাগতিক বিশ্বের সমস্ত ভার থেকে মুক্ত। কিন্তু তা হলেও এই সমস্ত গ্রন্থ থেকে খুঁটিনাটি সাধারণ বিবরণগুলিকে একত্র করেও অলৌকিক কথাকাহিনীগুলিকে অপসারণ করে বুদ্ধের জীবনের বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে আলোকপাত সম্ভব হয়েছে।

সুতরাং কোন নামটা ঠিক সেটা নিয়ে মতভেদ আছে। তাঁর 'রাহুল' নামে এক পুত্র সন্তানও জন্মে। মায়াময় জগতের দুঃখ যে সমস্ত জীবকে ঘিরে রেখেছে সেই উপলব্ধি তখন নিশ্চয়ই একটা কিছু করার সংকল্পে পরিণত করেছিল তাঁকে। সুতরাং 'গৃহত্যাগ' ছিল অবশ্যম্ভাবী।

সুত্ত নিপাতের প্রব্রজ্যা সূত্রে বলা হয়েছে কী কারণে সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করেছিলেন। সংসার থেকে অপার্থিব কিছু অর্জন করা খুবই কঠিন। মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে বেরিয়ে আসতে না পারলে সংসারের পঙ্কিলতাতেই এক সময় ডুবে যেতে হবে। এটা সঠিক উপলব্ধি করেছিলেন তিনি। তাই সংসারের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে আকুল হয়ে উঠেছিলেন সিদ্ধার্থ। 

ঊনত্রিশ বছর বয়সে, পুত্র রাহুলের জন্মের পর সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করেন। নিদান কথায় বলা হয়েছে যেদিন তিনি গৃহত্যাগ করেন সেদিন রাহুলের জন্ম হয়। অট্টকথায় বলা হয়েছে রাহুলের জন্মের সপ্তম দিনে সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করেন। 'অরিয় পরিয়েসন সুত্তে' তিনি নজের গৃহত্যাগের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। 'সো গো অহং ভিক্খবে অপরেন সময়েন দহরো ব সমানো সুসু কালকেসো ভরেন যোব্বানেন সমন্নগতো পঠমেন বয়স অধামকানং মাতা পিতুন্নং, অসুমুখানং রুদন্তানং, কেসসম্পুং ওহারেত্বা কাসাবানি বখানি আচ্ছাদেত্বা অগারস্মা অনাগারিয়ং পব্বজিং'। 'হে ভিক্ষুগণ আমি তখন তরুণ। আমার একটি চুলও পাকেনি ও পূর্ণ যৌবনে ছিলাম। আমার মা বাবা আমাকে অনুমতি দিচ্ছিলেন না। চোখের জলে তাঁদের মুখ ভিজে গেছিল। তাঁরা অনবরত কাঁদছিলেন। তাঁদের কান্না উপেক্ষা করে কিছুকাল পরে মস্তক মুণ্ডন করে ও গোঁফ দাড়ি ইত্যাদি মুড়িয়ে, কাষায় বস্ত্র পরিধান করে গৃহত্যাগ করে আমি সন্ন্যাসী হলাম।' উক্ত নিকায় মৃত্ত গ্রন্থ হতে প্রমাণিত হয় সিদ্ধার্থ রাতের অন্ধকারে কাউকে না জানিয়ে ঘর ছাড়েননি। সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগের পর প্রথম গেলেন কোশলে 'আলাঢ় কালামের কাছে। 'অরিয় পরিয়েসন' সূত্রে তাই উল্লেখ রয়েছে। 'মঙ্গলকর পথ ও শ্রেষ্ঠ, লোকোত্তর শান্তিময় তত্ত্বের সন্ধানে আমি আলাঢ় কালামের কাছে গেলাম।'

বুদ্ধ দেহত্যাগ (মহাপরিনির্বাণ লাভ) করেছেন এখন ২৫৬৮ বছরে পতিত হয়েছে। তিনি ৬২৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ৬ এপ্রিল শুক্রবার বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে হিমালয়ের পাদদেশে শাক্যজাতির রাজা শুদ্ধোধনের ঔরসে ও রাণী মহামায়াদেবীর  গর্ভ হতে কপিলবাস্তু নগরী ও দেবদহ নগরীর মধ্যস্থলের লুম্বিনী উদ্যানে জন্ম নেন। বৈশাখ মাসে চাঁদ বিশাখা নক্ষত্রে এসে এই পূর্ণিমা ঘটায়। তখন ছিল গ্রীষ্ম ঋতু, বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি, শুক্রবারের ভোরবেলা, সিংহলগ্ন, বৃশ্চিক ও বিশাখা নক্ষত্রের সম্মিলনক্ষণ এবং এটি ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৪ অব্দ। 

সম্যক সম্বুদ্ধত্ব উপলব্ধি : সুদূর সেই ৫৮৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথির পূর্ণচন্দ্র উদীয়মান, বুধবার ৩৫ বছর বয়সে  সিদ্ধার্থ ধ্যান মগ্ন হয়ে বজ্রাসনে উপবিষ্টাবস্থায় অস্তগামী সূর্যের মত ডুবে গেলেন ধ্যানের  গভীরে। ধীরে ধীরে কাম্যবস্তু হতে, অকুশল সব হতে বিবিক্ত করে সিদ্ধার্থের চিত্ত প্রবেশ করল সবিতর্ক, সবিচার, বিবেকজ প্রীতি সুখমন্ডিত প্রথম ধ্যানে। তদনন্তর তাঁর চিত্ত গিয়ে পৌঁছলো বিতর্ক বিচার উপশমে অধ্যাত্ম স্তরে, চিত্তের একীভাব আনয়নকারী বিতর্কাতীত বিচারাতীত সমাধিজপ্রীতি সুখমন্ডিত দ্বিতীয় ধ্যানে। ক্রমে প্রীতিতেও বীতরাগ হয়ে উপেক্ষারভাবে অবস্থান করতঃ স্মৃতিমান ও সম্প্রজ্ঞাত হয়ে স্ব-চিত্তে প্রীতি নিরপেক্ষ সুখানুভব করতে করতে তিনি লীন হলেন তৃতীয় ধ্যানে। 

অতঃপর, মধ্যম মার্গ আবিষ্কার করে দেশনা করেছেন সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক প্রচেষ্টা, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধির কথা। পদব্রজে ছুটে বেরিয়েছেন সারা উত্তরভারতে, শিষ্য অনুরাগীদেরও শিক্ষা দিয়েছেন নিজে সৎ থেকে অপরকে সৎ হতে উপদেশ দিতে, দেশান্তরে ছড়িয়ে যেতে। জগতকল্যাণে তাঁর সেই ছুটে চলা, আসমুদ্রহিমাচল ছাড়িয়ে, প্রাচ্য হতে প্রচীত্যে।

কুশিনগর অভিমুখে যাত্রা বৃত্তান্ত : তৎপর ভগবান আনন্দ স্থবির ও ভিক্ষুসংঘকে সঙ্গে নিয়ে কুশীনারা অভিমুখে যাত্রা করলেন। যাত্রা পথে বুদ্ধের বার বার রক্ত বাহ্য হলে তিনি অতিশয় ক্লান্ত হয়ে আনন্দকে বললেন, “আনন্দ, সংঘাটি চতুর্গুণ করে বিছাও, আমি ক্লান্ত , আমি বসব।” বুদ্ধ আসনে বসে আনন্দকে বললেন, “আনন্দ, পিপাসা লেগেছে, পানীয় জল পান করব।” 

সেদিন ছিল শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি। ভগবান মহাভিক্ষুসংঘসমেত হিরণ্যবতী (বর্তমান নাম শোন মতান্তারে গন্ডক নদ) নদীর অপর তীরের কুশীনারার পূর্ব-উত্তর পাশের শালবনে উপনীত হলেন। সেখানে গিয়ে স্থবির আনন্দকে বললেন, “হে আনন্দ, তুমি আমার জন্য যমক শাল বৃক্ষের অন্তঃর্বর্তী স্থানে উত্তর শীর্ষ করে  মঞ্চ স্থাপন কর। আমি ক্লান্ত হয়েছি শয়ন করব।” স্থবির আনন্দ মঞ্চ প্রস্তুত করল। ভগবান মঞ্চে স্মৃতি ও জ্ঞানযোগে দক্ষিণ পায়ের উপর বাম পা কিঞ্চিৎ ব্যতিক্রম ভাবে রেখে দক্ষিণ পার্শ্ব হয়ে সিংহ শয্যায় শয়ন করলেন। পূর্বে ভগবান শয়ন করলে ‘অমুক সময় উঠব’ এই অধিষ্ঠান করে শয়ন করতেন কিন্তু এবারে তা করলেন না। এর কারণ হল এটি ভগবান তথাগতের অন্তিম শয়ন, এরপর তিনি আর এ শয়ন হতে উঠবেন না। সে সময় শালবন সর্বাংশে মুকুলিত ও পুস্পিত হল,  পুষ্পিত বৃক্ষের ফুলদল তথাগতের পূত পবিত্র অঙ্গে ঝরে পড়তে লাগল। 

বুদ্ধ ভিক্ষুদের কাছ হতে আনন্দের শোকাতুর রোরুদ্যমান অবস্থা অবগত হয়ে এক ভিক্ষুর মাধ্যমে তাঁকে ডেকে বললেন, “হে আনন্দ, তোমাদের তো আগেই বলেছি সমস্ত কিছুকেই প্রিয়জন-প্রিয়বস্তু হতে বিচ্ছিন্ন হতে হবে।  আনন্দ, তুমি কৃতপুণ্য ব্যক্তি, তোমা কর্তৃক দীর্ঘকাল তথাগত সেবা সম্পাদন হয়েছে।” 

লোকহিতকর বুদ্ধ গৌতম, যাঁর নৈতিকতা, বোধি ও মহাকরুণাবলে আসমুদ্রহিমাচল সাম্য ও শান্তির তলে ঠাঁই নিয়েছিলন। তাঁর করুণাপরশে, ঘাতক-দস্যু অঙ্গুলিমাল শান্ত-দান্ত ভিক্ষুতে রূপলাভ করেছিলেন; ঝাড়ুদার সুনীত হতে নাপিত উপালি, নগরসুন্দরী আম্রপালি, পুত্র-স্বামীহারা পটাচারা প্রমুখ জীবনের পরমার্থ খুঁজে পেয়েছিলন। 

তিনি মানবপুত্র বুদ্ধ। তিনি  মোহ হতে, দ্বেষ হতে, অন্ধতা-অজ্ঞতা হতে তিনি সদা জাগ্রত। তিনি মহাবোধসম্পন্ন সাম্যাচারী, তিনি পথের ধূলায় নেমেছিলেন রাজপ্রাসাদ হতে গণমুক্তির জন্য। ঐশ্বর্য, বিলাস, কামিনীকাঞ্চন ছেড়ে ভরা যৌবনেই তিনি প্রাসাদ ছেড়ে সাধারণের জন্য, সাধারণের কাতারে নেমে এসে করেছিলেন বহু দুষ্করচর্যা। 

কোন ভাব বা আবেগ নয়, ভয় বা লোভ নয়, কোন যুদ্ধ নয়, সঙ্ঘাত নয়, অস্ত্র নয়, নয় কোন অলৌকিক শক্তির জাদুকরী মন্ত্র। করুণা বিলিয়ে, আদর্শ দিয়ে, সচেতনতা ও কায় মনো-বাক্যের শুদ্ধিতা দিয়ে তিনি জগৎ জয়ী হয়েছেন। 

তিনিই পৃথিবীর আধুনিকতম মানব যিনি, অদৃশ্য স্বর্গের লোভ ও নরকের ভয় প্রদর্শনের চেয়ে আত্ম-পর কল্যাণের জন্য সৎ হতে বলেছেন। তাঁর শিষ্যদের প্রতি তাঁর উপদেশ ছিল অল্পেচ্ছু ও অল্পে তুষ্ট হয়ে জীবনবাহন করতে। 

শ্রী বিমল সরকার মহোদয় কতৃর্ক রচিত মহামানব  বুদ্ধের সংক্ষিপ্ত  জীবনী, হলেই উপযুক্ত হবে, তিনি জাতক কাহিনী উল্লেখ করেছেন, তার তেমন পরিচিত প্রকাশ পায় নি, গ্রন্থে তাঁর শিষ্য-প্রশিষ্য, তাঁর মানব হিতৈষী বাণী, বিভিন্ন কিছু তিনি প্রাঞ্জল ও সাবলীল ভাষায় পরিবেশন করেছেন জনসাধারণের বোধগম্য করে। বেশ কিছু পালি শব্দ তথা বৌদ্ধ ধর্মীয় শব্দের, কিছু যথাযথ বাংলার খুব কাছাকাছি সমার্থক শব্দ মূল গ্রন্থে দিয়েছি, তিনি যেসব গ্রন্থ অধ্যয়ন করে গ্রন্থের অবতারণা করেছেন সেসব গ্রন্থে সর্বাস্তিবাদী গ্রন্থ ললিত বিস্তর গ্রন্থের তত্ব ও তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। আশা করি পাঠক সাচ্ছন্দ্তা অনুভব করবে। তিনি গ্রন্থটি রচনা করায় ধন্যবাদার্হ। প্রকাশককেও ধন্যবাদ জানাই।  অলং ইতি বিত্থারেন।


সুমনপাল ভিক্ষু

কোলকাতা

আষাঢ়ী পূর্ণিমা

২৫৬৮ বুদ্ধাব্দ 

২০২৪ ইং।

সুরাপুর বা সিরপুর বৌদ্ধ প্রত্নক্ষেত্র

 ভূমিকা

 

সিরপুর বা শিরপুর শহরের উল্লেখ করা হয়েছে খ্রিস্টীয় ৫ম থেকে ৮ম শতাব্দীর এপিগ্রাফিক এবং টেক্সচুয়াল রেকর্ডে।  শহরটি একসময় দক্ষিণ কোশল রাজ্যের শারভপুরিয়া ও সোমবংশী রাজাদের রাজধানী ছিল।  এটি ছিল দক্ষিণ কোসল রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু, বৌদ্ধ এবং জৈন বসতি।  এটি ৭ তম শতাব্দীর চীনা বৌদ্ধ তীর্থযাত্রী শুয়াং জাঙ পরিদর্শন করেছিলেন।  সাম্প্রতিক খননে ১২টি বৌদ্ধ বিহার, ১টি জৈন বিহার, বুদ্ধ ও মহাবীরের একক মূর্তি এবং ৫টি বিষ্ণু মন্দির, শক্তি ও তান্ত্রিক মন্দির উন্মোচিত হয়েছে৷

১৮৮২ সালে ব্রিটিশ ভারতের ঔপনিবেশিক কর্মকর্তা আলেকজান্ডার কানিংহাম পরিদর্শন করার পর সিরপুর একটি প্রধান প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান হয়ে ওঠে।  সিরপুরের একটি লক্ষ্মণ (লক্ষ্মণ) মন্দিরের বিষয়ে তার প্রতিবেদনটি আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করে।  ২০ শতকের প্রথম দিকে স্থানটি বিশ্বযুদ্ধের দশকগুলিতে অবহেলিত ছিল, এবং ১৯৫৩ সালে খনন কাজ পুনরায় শুরু হয়েছিল। ১৯৯০ এর দশকে এবং তারপরে বিশেষ করে ২০০৩ এর পরে আরও খনন করা হয়েছিল যখন ১৮৪ টি ঢিবি চিহ্নিত করা হয়েছিল এবং কিছু বেছে বেছে খনন করা হয়েছিল।  এই খননের ফলে এখন পর্যন্ত ৫টি বিষ্ণু মন্দির, ১০টি বুদ্ধ বিহার, ৩টি জৈন মন্দির, ৬ষ্ঠ/৭ তম শতাব্দীর একটি বাজার এবং স্নান-কুন্ড (স্নান ঘর) পাওয়া গেছে।  প্রত্নতত্ত্ব স্হলটি ব্যাপক সমন্বয়বাদ দেখায়, যেখানে বৌদ্ধ এবং জৈন মূর্তি রয়েছে।

সিরপুর শহরের ধ্বংস এবং কিসের কারণে রাজধানীর আকস্মিক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটেছে তার দুটি তত্ত্ব রয়েছে। একজনের মতে একটি ভূমিকম্প সমগ্র অঞ্চলকে সমতল করে এবং লোকেরা রাজধানী ও রাজ্য পরিত্যাগ করে।  অন্যটি একটি বিপর্যয়কর ধ্বংসের কথা উল্লেখ করেছেন।

সিরপুর "প্রাথমিক মধ্যযুগ থেকে ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য" এর জন্য একটি প্রধান প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান।  গেরি হকফিল্ড মালান্দ্রের মতে, সিরপুর ছিল প্রাচীন ভারতের একটি উল্লেখযোগ্য ব্রোঞ্জ ওয়ার্কশপ এবং সিরপুর থেকে খনন করা বৌদ্ধ ব্রোঞ্জের শিল্পকর্মগুলি সেই যুগের "শ্রেষ্ঠ ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য"গুলির মধ্যে একটি। সিরপুর এবং ইলোরা গুহাগুলির মধ্যেও অসাধারণ মিল রয়েছে। মালন্দ্রের মতে রত্নাগিরি, এবং এটি দুই অঞ্চলের মধ্যে ধারণা এবং শিল্পীদের প্রবাহের পরামর্শ দিতে পারে।

সিরপুর, প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থ এবং শিলালিপিতে শ্রীপুর এবং শ্রীপুরা (আক্ষরিক অর্থে, "শুভ, প্রাচুর্যের শহর, লক্ষ্মী") নামেও উল্লেখ করা হয়েছে, এটি রায়পুর থেকে ৭৮ কিলোমিটার (৪৮ মাইল) পূর্বে মহানদী নদীর তীরে অবস্থিত একটি গ্রাম। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর এলাহাবাদ স্তম্ভের শিলালিপিতে সিরপুরকে শ্রীপুরা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।  খ্রিস্টীয় ১ম সহস্রাব্দের দ্বিতীয়ার্ধে, এটি ছিল দক্ষিণ কোসল রাজ্যের প্রধান বাণিজ্যিক ও ধর্মীয় তাৎপর্য সহ রাজধানী শহর। প্রাচীনতম নথিভুক্ত প্রমাণগুলি বলে যে এটি প্রথমে শারভপুরিয়া রাজবংশের রাজধানী ছিল, তারপরে পান্ডুবংশী রাজবংশ। শরভপুরিয়া রাজবংশ ৫ম শতাব্দীর শেষের দিকের তারিখ, কিন্তু শিলালিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে এটির প্রথম রাজধানী ছিল শরভপুর, এখনও একটি অজানা স্থান।

এই অঞ্চলে ৬ষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগের প্রচুর শিলালিপিতে হিন্দু শৈব রাজা তিবর্দেব এবং ৮ম শতাব্দীর রাজা শিবগুপ্ত বালার্জুন তাঁর রাজ্যে হিন্দু, বৌদ্ধ এবং জৈনদের জন্য বিহার, মন্দির ও মঠ স্থাপনের উল্লেখ রয়েছে। চীনা তীর্থযাত্রী এবং ভ্রমণকারী শুয়াং জাঙ তাঁর স্মৃতিচারণে ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে সিরপুর সফরের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন যে রাজা ছিলেন একজন ক্ষত্রিয় এবং বৌদ্ধদের প্রতি হৃদ্যতায় অঞ্চলটি সমৃদ্ধ ছিল।  তাঁর স্মৃতিকথা অনুসারে, প্রায় ১০,০০০ মহাযান বৌদ্ধ ভিক্ষু (ভিক্ষু) এখানে প্রায় ১০০টি বিহারে বাস করতেন এবং ১০০টিরও বেশি মন্দির ছিল।

আনন্দ প্রভু কুটি বিহার: হিন্দু রাজা শিবগুপ্ত বালার্জুনের পৃষ্ঠপোষকতায় ভিক্ষু আনন্দ প্রভু দ্বারা নির্মিত একটি মন্দির এবং ১৪ কক্ষের বিহার, যাকে কিছু শিলালিপিতে আনন্দ প্রভা বলা হয়েছে। বিহার এবং মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে রয়েছে অবলোকিতেশ্বর এবং মকরওয়াহিনী গঙ্গের একটি স্মৃতিস্তম্ভ। সিরপুর স্থানে পাওয়া একটি পাথরের শিলালিপি, সংস্কৃতে নাগরী লিপিতে লেখা এবং খ্রিস্টীয় ৮ম শতাব্দীর মাঝামাঝি বৈদিক মিটারের (অনুস্তুভ, স্রাগধারা, আর্য, বসন্ততিলক এবং অন্যান্য) মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়েছে। শিলালিপিতে বলা হয়েছে শুভ চিহ্ন ওম এবং সিদ্ধাম দিয়ে শুরু, সুগত (বুদ্ধ) প্রশংসা করে তারপর রাজা বলার্জুনের প্রশংসা করেন। এর পরে এটি সন্ন্যাসী আনন্দপ্রভাকে উল্লেখ করেছে, যিনি বুদ্ধের প্রতি নিবেদিত মারাভারিন (মারার শত্রু) এবং পুনর্জন্ম ও মৃত্যুর চক্রের ধ্বংসকারী। শিলালিপিতে বলা হয়েছে যে রাজা একটি "বিহার কুটি" (সংঘারাম আবাসস্থল) এবং সেখানে সমস্ত ভিক্ষুদের জন্য একটি বিনামূল্যে খাওয়ানোর ভোজনশালা স্থাপন করেছিলেন যেখানে সেটিক এবং ব্যাঞ্জনা (মশলা সহ ভাতের খাবার) "যতদিন সূর্য আকাশে শোভা পায়" (চিরস্থায়ী)। তারপরে শিলালিপি কবিতাটি সন্ন্যাসীদের রাজার উপহারের চেতনা, সম্পদের অস্থিরতার কথা মনে করিয়ে দেয়, যে ধর্মই দুঃখ-ভরা জাগতিক অস্তিত্বের একমাত্র রক্ষাকারী অনুগ্রহ। শিলালিপিটি শিল্পীর স্বাক্ষরিত যিনি এটি বিহারের জন্য তৈরি করেছিলেন।

স্বস্তিকা বিহার: ১৯৫০-এর দশকে খনন করা, এই স্মৃতিস্তম্ভের বিন্যাসের বায়বীয় দৃশ্য স্বস্তিক চিহ্নের কথা মনে করিয়ে দেয়।  এই স্থানটিতে বৌদ্ধ যুগের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি বুদ্ধ মূর্তি এবং ধাতব মূর্তি পাওয়া গেছে।  বুদ্ধের সঙ্গে পদ্মপানির মূর্তি ছিল একটি মাছি ঝাঁকুনি বহন করে।

তিভার দেব: দক্ষিণ কোশল যুগের একটি বিহার, এই বিহার, তিভ্রদেব নামেও পরিচিত।  বিহারটি সমন্বিত, একজন শৈব রাজা এবং তার বৌদ্ধ রাণী দ্বারা নির্মিত, এটি হিন্দু এবং বৌদ্ধ থিম দেখায়।  স্মৃতিস্তম্ভটি বৌদ্ধ ও হিন্দু শিল্পকলার সমন্বিত সংগ্রহ, কারণ এটি বুদ্ধ মূর্তি এবং বৌদ্ধ শিল্পকর্মের মিল দেখা যায়। 

যদিও রাজারা যথাক্রমে বৈষ্ণব এবং শৈব ছিলেন তবুও পান্ডুবংশী শাসকরাও বৌদ্ধধর্মের সক্রিয় সমর্থক ছিলেন।  খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে  সোমবংশী রাজা তিভারদেবের সময়ে, সিরপুর গৌরবের শীর্ষে পৌঁছেছিল। শুয়াং জাঙ ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে সিরপুর সফর করেন পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে।

বৌদ্ধধর্মের মহাযান সম্প্রদায় থেকে ৭ম-৮ম শতাব্দীতে একটি যৌগিক ধর্মীয় রূপ গড়ে উঠেছিল। সিরপুর বজ্রযান ধর্ম বা তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল এবং এর উৎপত্তি তাদের নারী সমকক্ষদের সঙ্গে ধ্যানী বুদ্ধের বোধিসত্ত্বের মতবাদের ধারণার জন্য।  তারা বিভিন্ন আঙ্গিকে মূর্তি পূজার সঙ্গে যুক্ত রহস্যময় প্রভাব সহ আচারের উপর জোর দিয়েছিল। ধ্যানী বুদ্ধ, রত্নপানি, বজ্রপানি, মঞ্জুশ্রী, তারা, জাম্বল, ভৃকুটি, প্রজ্ঞাপারমিতা, বিজরাতারা, বসুধারার ছবি এবং এই বিহারের কিছু খোদাই করা ছবি স্পষ্টভাবে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের প্রভাবকে নির্দেশ করে।

বিদিশা, উজ্জয়িন, উদয়গিরি, নাগপুর প্রভৃতি মধ্য ভারতের শিল্পকেন্দ্রের আশেপাশে সিরপুর তার শিল্প ঐতিহ্যে স্বতন্ত্রভাবে বিকশিত হয়েছিল। এবং তাদের পরিধি দিয়ে শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু গড়ে তুলেছে। এটি শিল্প শৈলী, বাগধারা এবং পদ্ধতিতে কমবেশি সাদৃশ্য বজায় রাখে। পেরিফেরি অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায়, গুপ্ত শিল্পের উত্তরাধিকারের যোগসূত্রের সঙ্গে যা ভাকাটক শিল্পের সঙ্গে তার পূর্ণ বিশিষ্টতার সঙ্গে একটি প্যান ইন্ডিয়ান চরিত্র অর্জন করেছে – সিরপুর তার নিজস্ব একটি স্ট্যাম্পের সাক্ষী। সমস্ত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অন্তর্গত পাথরের ভাস্কর্যগুলির একটি ভাল সংখ্যক তাদের আদিবাসী শৈলী প্রমাণ করে।

১৩ জানুয়ারী, ২০০৮-এ এসপিআর-৩১ (লক্ষ্মণ মন্দির থেকে প্রায় ২৫০ মিটার দূরে একটি বিহার জায়গায় একটি খনন করা পরিখা) থেকে বৌদ্ধ দেবতাদের ঊনশত্তরটি ব্রোঞ্জের মূর্তি, স্তূপের প্রতিরূপ, কাঁচামাল এবং মডেলিং যন্ত্রের একটি মজুত পাওয়া গেছে।  

আবিষ্কারটি শনাক্ত করেছে যে ৮ম শতাব্দীতে সিরপুরের নিজস্ব ধাতু খোদাই শিল্প ছিল।  গেরি হকফিল্ড মালান্দ্রের মতে, সিরপুর ছিল প্রাচীন ভারতের একটি উল্লেখযোগ্য ব্রোঞ্জ ওয়ার্কশপ এবং সিরপুর থেকে খনন করা বৌদ্ধ ব্রোঞ্জ শিল্পকর্মটি সেই যুগের "উৎকৃষ্ট ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য"গুলির মধ্যে একটি। ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় বুদ্ধ, বোধিসত্ত্ব, বজ্রতারা, মঞ্জুভরা, পদ্মপানি, মজুশ্রী ইত্যাদি তাদের ড্র্যাপারির চিকিৎসা এবং পুরু মোল্ডিং বা পুঁতিযুক্ত রেখা সহ বিভিন্ন প্রভামণ্ডল সূক্ষ্ম খোদাই দেখায়। মহাযান বৌদ্ধধর্ম এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুধর্মের একটি ঘনিষ্ঠ সমন্বয় বৌদ্ধ মূর্তিগুলির প্রতিমায় পাওয়া যায়। মোট আশিটি ব্রোঞ্জের ছবিগুলি স্থানীয় ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করে অলঙ্কার, পোশাক এবং তাদের শারীরিক অভিব্যক্তিতে একটি মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য ধারণ করে যা মানুষের জন্য শান্তি, প্রশান্তি এবং ভালবাসার অনুভূতি দেয়।

২০১৭ সালে আমি পুরো পুরাতাত্ত্বিক সাহস গুলো নিজে পরিভ্রমণ করেছি, তাতে এটাই স্পষ্ট ধারণা করা যায় য, সমগ্র বৌদ্ধ প্রত্নস্হল গুলোকে ভিন্ন ধিকে ধাবিত করা হচ্ছে এবং ভিন্ন নামকরণ করে বিভিন্ন দেবদেবীর তথা শিবলিঙ্গ স্থাপনা করা হচ্ছে, কিন্ত প্রশাসন তথা এ এস আই নির্বিকার ভূমিকা পালন করছে।


সুরাপুর বা সিরপুর বৌদ্ধ প্রত্নক্ষেত্র গ্রন্থটি প্রকাশ করার জন্য ছোঁয়া প্রকাশনীর কর্ণধারকে আন্তরিক কৃতজ্ঞত ও ধন্যবাদ জানাই। ইতিপূর্বে এ জাতীয় গ্রন্থ বা সুরাপুর বা সিরপুর বৌদ্ধ প্রত্নক্ষেত্র নিয়ে কোন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। আশা করি পাঠক নতুন ইতিহাসের সন্ধান পাবেন এবং বৌদ্ধ স্হল সম্পর্কে অবগত হবেন। ইতিহাসবিদ ও ইতিহাসের ছাত্র ছাত্রীরাও নতুন করে গবেষণায় নিজেদের সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হবেন। অলং ইতি বিত্থারেন।


সুমনপাল ভিক্ষু

কোলকাতা

আষাঢ়ী পূর্ণিমা 

২৫৬৮ বুদ্ধাব্দ 

২০২৪ ইং

 

Sunday, June 2, 2024

ধম্মাশোকানুস্মৃতি (মহামতি অশোকের প্রতিফলিত স্মরণ)

 সুমনপাল ভিক্ষু


আজ্ঞাপ্য ব্যবধূতভিম্বভমরাম্‌ একাতপত্রাং মহীং
উৎপাটচ প্রতিগর্বিতামরিগনান্‌ আশ্বাস্য দীনাতুরান।
ভ্রষ্টাহস্থাহসতনো ন ভাতি কৃপনঃ সংপ্রত্যশোকো নৃপশ্
ছিন্নম্লানবিশীর্ণপত্রকুসুমঃ শুষ্যত্যশোকো যথা।।
পুণঃ একচ্ছত্রসমুচ্ছয়াং বসুমতীমাজ্ঞাথয়ত যঃ পুরা
         লোকং তাথয়তি স্ম মধ্যদিবস প্রাপ্তো দিবা ভাস্কর।
         ‘ভাগ্যচ্ছিদ্রমবেক্ষ্য সোহদ্য নৃপতিঃ স্বৈঃ কর্মভির্বঞ্চিতঃ
         সংপ্রাপ্তে দিবসফয়ে রবিরিব ভ্রষ্টপ্রভাবঃ স্থিতঃ।।
                           -অশোকাবদানং, পৃঃ ১৩০।
“আমি প্রকাশ্যে একজন বৌদ্ধ”।
সুমি পাকাসা (সা) কে (ই)।
“আমি প্রকাশ্যে শাক্য”।
রূপনাথ মাইনর রক্, এভিক্ট-ভ’এ অশোক।
মহামতি অশোকের বুদ্ধধম্মোর উপস্থাপনাঃ
অশোকের মাইনর রক্ এভিক্ট এবং অশোক প্রস্তাবিত প্রামাণিক গ্রন্থসূচী রাজস্থানে পাওয়া গেছে। অশোকের ধম্মলিপি’তে ৭টি গ্রন্থের উল্লেখ রয়েছে। সর্বোপরি তাঁর ধম্মলিপি’তে ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের প্রতি সম্বোধন করা হয়েছে।
ধম্মলিপির’র আদেশটি নিম্নরূপ:
আদেশের শুরু :
মগদের রাজা প্রিয়দর্শী সংঘকে অভিবাদন জ্ঞাপন পূর্বক তাদের সুস্বাস্থ্য এবং সুখী জীবনযাপনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
এটা আপনি অবগত আছেন, হে শ্রদ্ধেয় মহাশয়, বুদ্ধ, ধম্ম এবং সংঘের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস কতটা মহান। যাই হোক না কেন, শ্রদ্ধেয় মহাশয়, আশীবার্দ পুষ্ট বুদ্ধের দ্বারা বলা ভাল। তবুও হে শ্রদ্ধেয় মহাশয়, আমি ভাবতে পারি যে এইভাবে ধম্ম চিরকাল স্থায়ী হবে এবং আমি তা করার অধিকারী। এগুলি হল, হে শ্রদ্ধেয় মহাশয়, ধম্মের গ্রন্থ (ধম্মাথালিয়া)।
১. বিনয়সমুকস্ (বিনয় সমর শ্রেষ্ঠত্ব)
২. অলিয়বসানি (আরিয়াভাসা : নোবেল লিভিং)
৩. অনাগতভয় (ভবিষৎ’এ ভয়)
৪. মুনিগাথা (মুনির গাথা/বুদ্ধের দেশনা)
৫. অর্থসূত্তা (মুনির উপর সুত্ত)
৬. উপতিস্‌পসিন (সারিপুত্তের প্রশ্ন)
৭. লাঘুলোবাদ (রাহুলকে নির্দেশাবলী)
ধম্মের এই গ্রন্থসমূহ আমি কামনা করি।
কেন?
কারণ অসংখ্য মানুষ, যাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভিক্ষু। সেইসাথে ভিক্ষুগণ প্রায়শই তাদের কথা শ্রবণ এবং উপলব্দি করতে পারেন। এই কারণে হে শ্রদ্ধেয় মহাশয়, আমি এটি খোদাই করে দিয়েছি, যাতে তাঁরা আমার উদ্দেশ্য অবগত করতে পারি।
আদেশের সমাপ্তি।
মহামতি অসোকের বুদ্ধ এবং তাঁর ধম্মের পাঠ:
অশোকের উল্লেখিত ৭ টি গ্রন্থ এবং ভিক্ষুগণকে সম্বোধনের বিষয়টি তাঁর মনের নীল নকশা প্রদান করবে। পন্ডিতগণ ত্রিপিটকে তাঁর শ্রাস্ত্রীয় উপস্থিতির সন্ধান পেয়েছেন।
৭’ টি গ্রন্থের তালিকা :
১. বিনয়সমুকস্ (বিনয়অমর শ্রেষ্ঠতা)।।
১.১ মধ্যপন্থা অনুশীলন
১.২ চারি আর্যসত্য উপলব্দি
২. অলিয়বসানি (আরিয়াভাসা : নোবেল লিভিং)।।
২.১ পঞ্চপ্রতিবন্ধকতা হতে মুক্তি লাভ (পঞ্চ নিবারণ)
২.২ ৬ ইন্দ্রিয় বস্তুতে লিপ্ত হওয়া হ’তে বিরত থাকা
২.৩ মননশীলতার সঙ্গে মনকে রক্ষা করা
২.৪ ৪টি পরিশ্রম
২.৫ মতবাদ প্রত্যাখ্যান
২.৬ তনহা পরিত্যাগ (তৃষ্ঞা)
২.৭ বিশুদ্ধ মনের কর্ষন
২.৮ সমম ও বিদর্শন কর্ষন করা
২.৯ রাগ, দোষ ও মোহ বর্জন
২.১০ মনের মুক্তি
পঞ্চ বিষাদ পরিতাজ্য করা উচিত :
৩.১ ভিক্ষুগণ তাদের দেহ, শীল, মন এবং প্রজ্ঞার কর্ষন না করে উচ্চতর আদেশ প্রদান করবেন না।
৩.২ ভিক্ষুগণ তাদের দেহ, শীল, মন এবং প্রজ্ঞার কর্ষণ না ক’রে অন্যদের সমর্থন করবেন না।
৩.৩ ভিক্ষুগণ তাদের দেহ, শীল, মন এবং প্রজ্ঞার কর্ষণ না ক’রে অন্যান্য বিষয়ের আলোচনায় প্রবেশ করবেন না।
৩.৪ ভিক্ষুগণ তাদের দেহ, শীল, মন এবং প্রজ্ঞার কর্ষণ না ক’রে গভীর ধম্ম অধ্যয়ন করবেন না এবং তা উপযোগী মনে করবেন না।
৩.৫ ভিক্ষুগণ সুন্দর স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্নসহ কথা বলে আনন্দিত হবেন।
৪. মুনিগাথা (বুদ্ধ দেশনা)।।
এটি মিনিগাথায় পালিত, মুনির আদর্শ যা মিনির গুণাবলী এবং একজন মুনির জীবনযাপনের সঙ্গে গৃহস্থ জীবন যাপনের তুলনা করে।
৫. মুনিসুত্ত (অর্থসুত্তা)।।
যা দুঃখ-কষ্টের দিকে টেনে নিয়ে যায়, তা থেকে কীভাবে দুরত্ব বজায় রাখা যায়, একথায় কায়, বাক্‌ এবং চিত্ত (মন) কে সংযত করা।
৫.১ শরীরের নিস্তব্দতা :
জীবন নেওয়া (হত্যা ইত্যাদি) থেকে বিরত থাকুন।
অদত্ত বস্তু গ্রহণ অর্থাৎ যা প্রদান যোগ্য নয় তা গ্রহণ হতে বিরত থাকুন। যৌন অসদাচরণ হতে বিরত থাকুন।
৫.২ বক্তব্যের নীরবতা :
মিথ্যা বাক্য হতে বিরত থাকুন।
অপবাদ হতে বিরত থাকুন।
কটু (কু-বাক্য) এবং কর্কশ বাক্য হতে বিরত থাকুন।
অলসতা’ হতে বিরত থাকুন।
৫.৩ মনের নীরবতা :
আবেগের বিলোপ সাধন।
আবেগ মু্ক্ত অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করা।
৬. উপতিসপসিন (বারিপুত্তের প্রশ্ন) ।।
৬.১ নির্ভীকতার কর্ষণ করা।
৬.২ সকলের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা পোষন করা।
৬.৩ তৃপ্তি এবং সংযম চাষ করা।
৬.৪ মননশীলতা চাষ করা।
৬.৫ ধৈর্য্য চাষ করা।
৬.৬ বিশুদ্ধতা চাষ করা।
৬.৭ মনের স্বাধীনতা চাষ করা।
৭. লাঘুলোবাদ (রাহুলকে নির্দেশাবলী) ।।
৭.১ ইচ্ছাকৃত মিথ্যাবাক্য ব্যক্ত করার প্রশ্নে লজ্জিত হন।
৭.২ কর্মসম্পাদনের পূর্বে চিন্তা করা। অর্থাৎ যে কর্মটি নিজের তথা অপরের ক্ষেত্রে মন্দ, তা উভয়ের ক্ষেত্রে বিপদ ডেকে আনবে কিনা।
৭.৩ এই প্রতিফলন অবশ্যই শারীরীক ক্রিয়া, বক্তব্য এবং চিন্তার প্রশ্নে করা উচিৎ (শরীর, বক্তব্য এবং মনের ক্রিয়া)।
উপসংহার :
এইভাবে, অশোকের ধম্মের উপস্থাপনা যা তিনি উল্লেখ করেছেন তা ৭টি প্রামানিক গ্রন্থে এইভাবে ব্যক্ত করেছেন।
মহামতি অশোক বুদ্ধের প্রয়োজনীয় শিক্ষাগুলি অনুশীলনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন এবং বুদ্ধের উদাহরণকে সামনে রেখে ভবিষৎ’এর বিপদ এড়াতে তথা উৎকৃষ্ট ‘মনচাষা’ হয়ে মহৎ জীবনকে ধারণ করতে বলেছিলেন।
মহামতি ধম্মাশোক : ভারতীয় ইতিহাস এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি।।
ভারতীয় ইতিহাসের একটি মিথ্যাদৃষ্ট মূলক অধ্যায় ব্রাহ্মণবাদী কল্পনা দ্বারা রচিত হয়েছে। এই ইতিহাসের সম্পূর্ণ অংশই হল অভিসন্ধি মূলক এবং সামন্তবাদী। ভারতীয় উপমহাদেশ হতে বুদ্ধ শাসন এবং তাঁর একনিষ্ট উপাসক সম্রাট অশোক’কে মুছে বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করলে এটি আরও স্পষ্টতর হয়ে উঠবে।
যথা হি চোরঃ স তথা হি বুদ্ধস্তথাগতং নাস্তিকমন্ত্র বিদ্ধি।
তস্মাদি যঃ শঙ্ক্যতমঃ প্রজাণাম্ ন নাস্তিকেনাভিমুখো বুধঃ স্যাত্।।
                      -বাল্মিকী রামায়ণ, ২.১০৯.৩৪।
ইতিহাসবিদ চার্লস্ অ্যালেনের মতে, অশোক ভারতের প্রতিষ্ঠাতা। ভারতীয় ইতিহাস তাই অশোকের নথি হতে অধ্যয়ন করা আবশ্যক। মৌখিক তথ্যের বিপরীতে, অশোকের তথ্যগুলি পাথরে খোদাই করা এবং সেগুলি (শিলালিপি) সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে বিদ্যমান। ভারতের ইতিহাস রচনার প্রামানিক তথ্য রূপে অশোকের অভিলেখ গুলিই হবে একমাত্র প্রামানিক দলিল। এর বিপরীতে অন্যান্য সমস্ত তথ্য সমূহকে অনুমানমূলক রূপে গ্রহণ করা উচিৎ।
প্রাচীন ভারত সম্পর্কিত একজন মহান ইতিহাসবিদ এবং অশোক গবেষনার একজন প্রসিদ্ধ নাম, অধ্যাপক প্যাট্রিক অলিভেলে অশোকের শিলালিপি গুলিকে যথার্থ অর্থে অশোকের লেখা বলে অভিহিত করেছেন।
অশোকের লেখা অধ্যয়নের পরে তার উপসংহারও চমকপ্রদ। তিনি অশোকের নীরবতাকে উল্লেখ করেছেন যা প্রাচীন ভারতে ‘বিশিশ্থ’ রূপে পরিগণিত হয়। অশোকের লেখায় প্রাচীন ভারতে যা জোর দেওয়া হয়েছে তার অনুপস্থিতি ভারতের সমগ্র ইতিহাস পর্যালোচনার একটি মঞ্চ নির্মান করে।
অশোকের অভিলেখ’তে এগুলি অনুপস্থিত :
১. বর্ণ ব্যবস্থা
২. পুর্নজন্ম এবং কর্মবাদ (শ্রম)
৩. বৈদিক শ্রেণী রূপে গৃহস্থ সমাজ
৪. দ্বি-জন্মের ধারণা
যদিও আমরা ৩নং পয়েন্টের আলোচনাকে একপাশে সরিয়ে রেখে অবশিষ্ট পয়েন্ট নিয়ে ও আলোচনা করি (প্রাচীন ভারতের ইতিহাস অধ্যয়নের প্রশ্নে) এবং তা সঠিক রেকর্ড স্থাপনের ক্ষেত্রে অতীব গুরুত্বপূর্ণ হবে।
এখন অধ্যয়ণগুলি দেখায় যে বর্ণাশ্রম ধর্ম’ হল বৌদ্ধধর্মের পরবর্তী বিকাশ এবং এই অর্থে ব্রাহ্মণ্যবাদী সাহিত্যের বেশিরভাগই উত্তর-বৌদ্ধ যুগেই রচিত হয়েছে। সেই সময় ভারতে এক শ্রেণীর ধর্মীয় গোষ্ঠী (বৌদ্ধ মতে অন্য তীর্থিক) রূপে ব্রাহ্মণদে অস্তিত্ব ছিল। এটি ‘দল’ বা গোষ্ঠী ছিল না যেমনটি আজ ইতিহাস বইতে পড়ানো হয়। মনে হয় যে সেই সময় ভারতীয় সমাজে বর্ণ ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ ভাবে গঠিত হয়নি এবং বধিত ভাবে সেখানে কোনরূপ জাতি ভেদও ছিল না। যা এখন আমরা প্রত্যক্ষ করছি।
অশোকের লেখায় পুনর্জন্ম এবং কর্মবাদের অনুপস্থিতি অর্থাৎ দ্বিতীয় পয়েন্টটিও গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় মন কর্মফল এবং পুণর্জন্মের অনুমানে আচ্ছন্ন। বুদ্ধের মূল শিক্ষা হতে এই বিষয়টি সম্পূর্ণ অর্থে ভিন্ন। ব্রাহ্মণ পরিকল্পনায় কর্মফল এবং পুনর্জন্ম বর্ণ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত। এই অর্থে কর্ম (শ্রম) হল বণফের ন্যায্যতা।
চতুর্থ অনুপস্থিতি যা দ্বিগুন জন্ম (দ্বিজ) ধারণারে এক উল্লেখ্যণীয় প্রমাণ এবং যা এই সত্যটিকে নির্দেশ করে যে তৎকালীন বৌদ্ধ ভারত ছিল বাস্তবিক অর্থে সমাজতান্ত্রিক সমাজ। এটি অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীর ন্যায় ব্রাহ্মণদের শুধুমাত্র একটি শ্রেণীরূপেই গ্রহণ করেছিল। সেই ব্রাহ্মণরা ছিল একটি পেরিফেরাল শ্রেণী এবং সেই অর্থে বর্ণ ব্যবস্থার পরিকাঠামো ও তখন নির্মিত হয়নি।
ড. আম্বেদকর যেভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন তা এই আলোচনাতেই স্পষ্টতর হয়ে ওঠে।
১. ভারতীয় অস্পৃশ্যরা বিচারাধীন বৌদ্ধ
২. বর্তমান যাদেরকে শুদ্ররূপে প্রতিপন্ন করা হয় তারা ব্রাহ্মণীয় কল্পনার শ্রেণীবদ্ধ কাঠামোর শুদ্র নয়। বিগত ২০০ বৎসরের ব্রাহ্মণ্য প্রচারের কারণে বর্তমান ভারতীয়দের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে ইচ্ছাকৃত ভাবে (শোষন করার অভিপ্রায়ে) শুদ্র বলা হয়।
যদি সেই অর্থে ভারতীয় ইতিহাসের একটি পরিস্কার ছবি পেতে হয় তাহলে ড. আম্বেদকরের লেখার সঙ্গে মহামতি অশোকের অভিলেখগুলিকেও সমান্তরাল ভাবে অনিশীলন করা উচিত।
অধ্যাপক অ্যালফ্ হিলটেবিটেল বৌদ্ধ ও বৈদিক শাস্ত্রে ধম্ম/ধর্মের বিভিন্ন অর্থ ব্যাখ্যা করেছেন। এই সুবিশাল গ্রন্থটি ধম্ম/ধর্ম শব্দের নানাবিধ অর্থ সম্পর্কিত তথ্যের একটি সমৃদ্ধ উৎস এবং ভারতীয় ইতিহাসের যে কোন ছাত্রের জন্য অপরিহার্য। যাই হোক, এই বিষয় টি অশোকের ধম্ম কে উপলব্দি করার বিষয়ে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে তথা যেমনটি স্পষ্ট অর্থে অধ্যাপক হিলটেবিটেল দ্বারা ব্যাখ্যাত হয়েছে, যা পরে আম্বেদকরের ধম্মের আলোচনার সঙ্গে তুলনা করা হবে। ভারতীয় ইতিহাসের এই দুই মহান ব্যক্তিত্বকে উপলব্দি করা এই মুহূর্তে কতটা জরুরি যখন ভারত সামন্তবাদ তথা কর্তৃত্ববাদী শাসনের মুখোমুখি।
চালর্স অ্যালেন মহামতি অশোককে বৃহত্তর ভরতের প্রতিষ্ঠাতা পিতা রূপে উল্লেখ করেছেন এবং ড. আম্বেদকর ভারতকে একটি গণ-প্রজাতন্ত্রের পরিণত করার প্রশ্নে একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক ভূমিকা পালন করেছেন। অশোক এবং আম্বেদকর, উভয়েরই মার্গপ্রদর্শক হলেন মহান বুদ্ধ। শাক্যমুনি বুদ্ধকে উল্লেখ করার সময় অশোক তাকে ‘আমাদের বুদ্ধ’ রূপে উল্লেখ করার সময় আম্বেদকর তাকে “আমার বুদ্ধ’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। তাদের এই সম্বোধন বুদ্ধের প্রতি গভীর ভালবাসা এবং বিশ্বাস প্রদর্শন করে।
অশোক বিষয়ক পন্ডিত হ্যারিফক্‌ একটি আর্কষণীয় অনুমানের প্রতি ঈঙ্গিত করেছেন যে অশোক সম্ভবত স্বয়ং ধম্মলিপির আবিস্কারক এবং যে শাস্ত্রটি সমস্ত ভারতীয় লিপির জননী হয়ে উঠেছে। তিনি আরও মনে করেন যে অশোক গ্রীক বর্ণমালার উপর তার লেখ্যগুলি তৈরী করেছিলেন। তবে একথা উল্লেখ্যনীয় যে ধম্মলিপি গ্রীক লিপি হতে সম্পূর্ণ অর্থেই ভিন্ন।
প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা বা সিন্ধু সভ্যতায় বর্ণমালার প্রচলন ছিল কিন্তু তা এখনও পাঠোদ্বার সম্ভব হয়নি। অশোক প্রবর্তিত শিলালিপি এবং স্তম্ভের আদেশ সেই অর্থে প্রথম প্রমাণ গঠন করে এবং তাই ধম্ম/ধর্ম শব্দের অনুসন্ধান।
মহামতি অশোক তাঁর আদেশে প্রায় ১১১ বার ধম্ম শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তিনি তাঁর আদেশকে ধম্মলিপি রূপে ঘোষণা করেছিলেন। অশোক প্রদত্ত ‘ধম্ম’ শব্দের অর্থ হল ধর্মপরায়ণতা রাজা এবং পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধা ও সত্য পক্ষ অবলম্বন। তিনি ধম্মের প্রচারার্থে ধম্মযাত্রা পরিচালনা এবং সদ্ধর্মকে রক্ষার প্রশ্নে সদা সচেষ্ট ছিলেন। এখন আমরা ক্রমানুসারে অশোকের জীবনগন বিন্যাসের নানাবিধ বিষয়গুলি আলোচনা করতে পারি।
অশোক তাঁর রাজত্বের মধ্যবর্তী সময়কালে সদ্ধর্মকে একটি সুদৃঢ় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রদান করেছিলেন। এই ধম্মের মূলভিত্তি ছিল ‘ধম্মানুশাসন’।
এই ধম্মের মূল ছিল মাতা ও পিতার প্রতি আনুগত্য, বন্ধুদের প্রতি উদারতা, পরিবারের সদস্য, আত্মীয়, অন্বেষণকারীর প্রতি সহমর্মিতা পোষন, জীবন হত্যা না করা এবং ব্যয়-সম্পদের সংযম। তিনি একইভাবে শীলচর্চাকেও উৎসাহিত করতেন। তিনি জনগনকে যে কোন অপকর্ম হতে বিরত থাকতে বলেছেন।
অশোকের সদধম্ম শব্দের ব্যবহার অত্যন্ত আকর্ষনীয়। অশোকের শাসনের মূলনীতি ছিল কোনো শ্রেণী বা গোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য না করা। তিনি সমতা প্রচার করেছিলেন। ধম্মাশোক এইভাবে ধম্ম শব্দটিকে একটি সমতাবাদী এবং সর্বজনীন স্তরে উথ্থাপন করেছিলেন যা এটিকে ধর্মীয় গোষ্ঠী ও সমস্ত ধরণের অন্যান্য ধারণাগুলির কার্যকারিতা বিচারের দৃষ্টিকোন রূপে নির্মাণ করে। অশোকের ধর্ম সেই অর্থে সর্বজনীন তথা অসাম্প্রদায়িক। তাঁর ধম্ম কূল, বর্ণ, এমন কি রাজধর্মেরও উর্দ্ধে।
পন্ডিতবর্গের অভিমত অনুসারে সম্রাট অশোক ধম্ম শব্দটি অভিধমীয় উপায়ে ধ্যানমূলক আত্ম-পরীক্ষা রূপে ব্যবহার করেছিলেন। ‘ধম্ম’ শব্দের এই ব্যাখ্যা হিংসা, ক্রোধ, নিষ্ঠুরতা, অলসতা এবং ক্লান্তির ন্যায় প্রবণতা হতে মনকে রক্ষা করে নিরপেক্ষতার অনুশীলন অর্থে বোঝায়। তিনি ধম্মকে সমবেদনা (দয়া), ভাগ করা (দান), সত্য (সাককা) এবং মনের বিশুদ্ধতা (সোকায়ে) রূপে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এই বিষয়টি ধ্যানমূলক স্ব-অনুসন্ধানের সাথে অনুশীলন করা হয়। অশোক ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি দুটি উপায়ে ধম্মে অগ্রগতি অর্জন করেছেন। (এটি প্রসারে) ধম্ম নিয়ামেন (ধম্মের আইন দ্বারা) এবং নিজ্জাত্তি (ধ্যান অনুশীলন)।
অশোকের ধম্মে আরও অনেক উল্লেখ্যণীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে কিন্তু উপরোক্ত আলোচনাই তাঁর ধম্মকে সর্বজনীন, অসাম্প্রদায়িক, অ-বৈষম্যহীন, সর্বকালের জন্য, সমস্ত জীবনকূলের উপকারের জন্য অনুশীলনের মাধ্যমে স্পষ্ট ভাবে আলোকপাত করার পক্ষে যথেষ্ট। বিশ্বে দ্বন্ধের উৎসগুলি সম্পর্কে অনুশীলন, নিজের মনকে রক্ষা করা এবং নিরপেক্ষ মনোভাব অর্জনের প্রশ্নে অশোকের ধম্মানুশাসন অত্যন্ত জরুরি। সুতরাং এই অর্থে বলা যায় যে অশোকের ধম্ম রাষ্ট্র পরিকল্পনা আজও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনার প্রশ্নে সমান অর্থে প্রাসঙ্গিক।
আধুনিক বিশ্বে ড. আম্বেদকরের আবির্ভাব একটি উল্লেখ্যনীয় ঘটনা। বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হতে শিক্ষিত হওয়া এবং ভারতবর্ষে অন্ধকার বর্ণপ্রথার অন্ধকূপ হতে মুক্তি প্রদানের অভিপ্রায়ে লক্ষ লক্ষ জনগনকে নেতৃত্ব দেওয়া তথা ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, সাম্য, ভাতৃত্ব, মর্যাদা এবং অখন্ডতার মূল্যবোধের প্রতি ভিত্তি করে গনতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র রূপে ভারতকে একটি সুদৃঢ় ভিত প্রদান করা’র বিষয়টি সম্রাট অশোকের সিদ্ধান্তের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়।
তবে এক্ষেত্রে বলতে ্য় যে ধম্ম্রপচারের জন্য অশোকের নিকট সম্পদ ছিল কিন্তু আম্বেদকরকে ধম্মপ্রচারের প্রয়োজনে সম্পদ তৈরী করতে হয়েছিল। তাকে মানুষকে শিক্ষিত করতে হয়েছে এবং একই সাথে লড়াই ও করতে হয়েছে বর্ণব্যবস্থার বিরুদ্ধে। তাঁর আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হ’ল ‘বুদ্ধ এবং তাঁর ধম্ম’ নামক উল্লেখ্যনীয় গ্রন্থ রচনা। সর্বোপরি তিনি যে বৈপ্লবিক কর্মটি সম্পাদন করেছিলেন তাহ’ল বুদ্ধের ধম্মকে ভারতের নতুন প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি রূপে স্থাপন করেছিলেন। ফলে স্বাধীন ভারতের সংবিধান আইনগত ভাবে সব ধরণের বৈষম্যদূর করেছে এবং বর্ণপ্রথাকে বেআইনি ঘোষণা করেছে।
সম্রাট অশোক হয়ত তেমন ভাবে বর্ণবাদী সমাজ ব্যবস্থার মুখোমুখি হননি। তবে তাঁর সমতাবাদী এবং মানবিক শাসন পরজীবী পুরোহিত শ্রেণীকে শঙ্কিত করে তুলেছিল। ফলে উত্তরকালে তারা অশোকের মূল্যবোধ এবং ধারণাগুলিকে দেবত্ববাদ তথা অদৃষ্টবাদের মাধ্যমে মুছে ফেলেছিল। আম্বেদকর ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের সাথে সাথে সামন্তবাদী এবং অধিকতর সংগঠিত ব্রাহ্মণ্যবাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ফলে মূল অর্থে মনুবাদের পুষ্টপোষক ব্রাহ্মণ্যধর্ম প্রবলভাবে আম্বেদকর বিরোধী এবং ধম্মকে বিকৃত করার প্রচেষ্টায় ক্রমাগত ঘৃণার বাতাবরণ তৈরী করে চলেছে।
সম্রাট অশোক এবং ভারত নির্মাণ ।।
কিছু সূত্র অনুসারে জানা যায় যে ১৪ এপ্রিল মহান সম্রাট অশোকের জন্মদিন। যদিও অশোকের সঠিক জন্মতিথি নির্ণয় করা কঠিন, তবুও সত্য যে তিনি কোনো পৌরানিক বা কাল্পনিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না।
অশোকের নাম এবং গৌরব মহানদী হতে ভোলগা পর্যন্ত অনুরণিত হয়েছিল, যেমনটি মহান ইতিহাসবিদ এইচ.জি.ওয়েলস্‌ বলেছিলেন। সম্রাট অশোক সম্পর্কে আজ আমরা যেভাবে জানি, সম্ভবত অন্য কোন উদারনৈতিক এবং গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন সম্রাটের ইতিহাস সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যায় না।
ভারত পৌরাণিকতা এবং বর্ণাশ্রমের কবলে পড়ে অশোককে সম্পূর্ণ অর্থেই ভূলে গিয়েছিল। এক অর্থে অশোক এবং বুদ্ধের ধম্মকে যারা অপছন্দ করতেন তারা অত্যন্ত সুকৌশলে নিজেদের মনগজ ইতিহাসের আড়ালে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তাঁর শিলালেখ বা অভিলেখ গুলি আবিস্কৃত হওয়ার ফলে আমরা অশোক এবং তাঁর ধম্মনীতি সম্পর্কে জানতে পারি।
আধুনিক ভারত সেই অর্থে অশোকের কাছে ঋণী। স্বাধীন ভারতের জাতীয় পতাকায় যে চক্র প্রতীক রয়েছে তা মূলতঃ ধম্মচক্র বা অশোক চক্র নামে পরিচিত। ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতীকে যে সিংহ চিহ্ন রয়েছে তাও অশোকের রাজকীয় প্রতীক হতে গৃহীত।
অশোক মানবতাবাদী এবং জনকল্যানকামী ছিলেন। তিনি জনগনের সুবিধার্থে চিকিৎসালয়, বিশ্রামাগার, জলাশয় এবং কূপ নির্মাণ করেছিলেন। তিনি নারী সুরক্ষার প্রশ্নেও সদা সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর রাজনীতি ছিল সদ্ধর্ম ভিত্তিক। এমনকি তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষু হওয়ার পূর্বে নিজেকে শাক্য রূপে ঘোষণা করে ছিলেন।
অশোকের শাস্ত্র, চীনা পর্যটক (শুয়াং জ্যাঙ্‌প্রমুখ) দের ভারতীয় ইতিহাস সম্পর্কিত ভ্রমণ বৃতান্ত এবং প্রাচ্যের ইতিহাসবিদ’দের আবিস্কার না হলে ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কিত ইতিহাস ব্রাহ্মণ্যবাদীদের নির্মিত মিথের কুয়াশায় বিলীন হয়ে যেত।
অশোক এবং বৌদ্ধ ধর্মের উপর ব্রাহ্মণ্যবাদী আক্রমণ এখন সর্বজন বিদিত। বৌদ্ধ আদর্শ গঠিত মৌর্য সাম্রাজ্য তথা অহিংসা-শান্তির ভারতকে ধ্বংস করার প্রশ্নে ব্রাহ্মণ্যবাদের পৃষ্টপোষক শুঙ্গবংশ (পুষ্যমিত্র শুঙ্গ) হিংসা, মিথ্যাচার এবং কপটতার আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন।
অশোক অনেক নীতির চর্চা এবং প্রচার করেছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম এবং গুরুত্বপূর্ণ হল ‘সমবায়-সাধু’। ইংরাজীতে যার অর্থ হয় ‘হারমনি ইজ দ্য বেষ্ট’। সমাজে সম্প্রীতি হল সর্বোত্তম নীতি। কারণ সমাজ ধর্ম, ভাষা, বর্ণ এবং জাতি দ্বারা বিভক্ত হয়। যখন একটি’র বৈষম্য দেখা দেয়, তখন সমাজ অত্যন্ত দুর্গতির পঙ্কে নিমজ্জিত হয় এবং তাই সমাজের সর্বোত্তম নীতি হল সম্প্রীতি বজায় রাখা।
দ্বিতীয় নীতিটি হল রাষ্ট্রের প্রশাসন বা যে কোন প্রকল্পের ক্ষেত্রে ‘মধ্যম মার্গ’ ব্যবহার করা। এটিকে স্থির পদক্ষেপ রূপে গ্রহণ করা উপযোগী হতে পারে।
অবিচলিত কর্ম এবং কোন হঠকারিতা নয়।
অশোকের এই নীতি আজ আমাদের প্রয়োজন। কারণ হঠকারি বা তাড়াহুড়ো করে যা কিছু করা হয় তা হবে আমনোযোগী এবং এইটি ধ্বংসাত্মকও হতে পারে। সুতরাং সমাজ বিকাশের স্বার্থে চিন্তার বিকাশ করুণ, শিক্ষার প্রসার ঘটান এবং মানুষকে নিজের বিকাশের প্রশ্নে চিন্তা করতে দিন। এই বিষয়টিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে, ‘অনিভিক্ষি’। এর অর্থ হল চিন্তার সংস্কৃতি, স্পষ্টভাবে এবং সৃজনশীল ভাবে চিন্তা করা। সেই সময় অশোকের অনুসরণে প্রাচীন ভারতে শিল্প-বিজ্ঞান দ্রুত অগ্রসর হয়েছিল এবং ভারত পৃথিবীতে পপধম শিক্ষার বিকাশে নালন্দা, তক্ষশীলা ও বিক্রমশীলা ও বিক্রমশীলার ন্যায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
অশোক দ্বারা প্রচারিত নীতি সমূহ।।
১. সম্প্রীতি সর্বিত্তম এবং সর্বোচ্চ।
২. হঠকারীতা ব্যতীত অবিচলিত কম।
৩. সকলের মঙ্গলার্থে চিন্তা ও জ্ঞানের সংস্কৃতি।
ধম্মাশোক দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন ড. আম্বেদকর, যিনি স্বয়ং শিক্ষা-সংস্কৃতির (অনভিক্ষি) প্রচার করেছিলেন এবং সংগঠিত করেছিলেন সমাজের ব্রাত্যজনকে। অপর অর্থে বলা যায় তিনি অশোকের নীতি শিক্ষা এবং সমাজ বিকাশের ভাবনাকে আন্দোলন-সংগঠনের মাধ্যমে তাঁর সময়ের সমাজকে পরিবর্তন করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন, যা আজও প্রাসঙ্গিক।

১২.০৪.২০২৩ 

একটি সত্যবাদিতার প্রতিভাস সম্পর্কে আমার অন্তিম বাণীl


মাষ্টার শিং য়ুন

ফো-কুয়াং শান মোনাষ্ট্রি

অনুবাদ: সুমনপাল ভিক্ষু


আমি আমার দেহ ও মনকে উৎসর্গ করেছি বৌদ্ধধর্মের জন্য এবং আমার জীবনের পরিস্থিতি অনুযায়ী জীবনযাপন করেছি। প্রিয় ধর্মরক্ষক, বন্ধু ও শিষ্যগণ আমি আপনাদের সকলের কাছে একটি সৎ উন্মোচন করতে চলেছি। আমার সমস্ত জীবনে অনেকে আমাকে ধনী মনে করেছে, কিন্তু সত্যি কথা হল দরিদ্র থাকাটা সবসময় আমার জীবনের উদ্দেশ্য ছিল। আমি একটি দরিদ্র পরিবারে বেড়ে উঠেছি, কিন্তু কখনই নিজেকে দরিদ্র বলে মনে করিনি কারণ আমি অন্তরে সবসময়ই নিজেকে ধনী বলে মনে করেছি। আমি বয়স্ক হয়ে যাওয়ার পরও অনেকে আমাকে ধনী বলে, কারণ তাদের বিশ্বাস আমি অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক সংগঠন, প্রকাশনা সংস্থা ইত্যাদির মালিক। তবে আমি কখনও মনে করিনি যে আমি কোন কিছুর মালিক, কারণ সেগুলি সাধারণ মানুষের, আমার নয়। যদিও আমি এই পৃথিবীতে অনেক বিহার নির্মাণ করেছি, এই ভবনগুলি এমনকি এগুলির কোন আসবাবও আমার নয়। আমার মাথার উপর একটি টালি বা আমার পায়ের তলায় আবর্জনার একটি ছোট ঢিবিও আমার নয়। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত সমস্ত কিছুই সমস্ত পৃথিবীর, তাই সেখানে ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকে কেমন করে? তবু, আমার মনে মনে আমি অনুভব করি যে সমস্ত পৃথিবীটাই আমার। আমার কখনও নিজস্ব দেরাজ বা ডেস্ক ছিল না। যদিও আমার শিষ্যরা আমার জন্য এগুলি তৈরী করে দিয়েছে, আমি কখনও এগুলি ব্যবহার করিনি। আমার জীবনে আমি খুব কম দোকানে কেনাকাটা করতে গিয়েছি, আমার কখনও কোন সঞ্চয় ছিল না। আমার যা কিছু আছে তার সবই সাধারণ মানুষের ফো-কুয়াং শান সংঘের বা বিহারের। একইভাবে আমার সমস্ত শিষ্যের উচিত একই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বৌদ্ধধর্মকে তাদের শরীর ও দান করা এবং নিজের জীবনের পরিস্থিতি অনুযায়ী জীবনযাপন করা।

আমার সমস্ত জীবনে অনেক মানুষ আমাকে এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে ভেবেছি যে সভা সমিতি আয়োজন অত্যন্ত একা কারণ এমন কেউ নেই যাকে আমি আমিত্বের অনুপস্থিতি—একজন অবনমিত ভিক্ষুর উপদেশবাণী আমার সবচেয়ে প্রিয় বা সবচেয়ে অগ্রিম ব্যক্তি বলে মনে করি। অন্য অনেকে ভাবতে পারে আমার অনেক শিষ্য ও ভক্ত রয়েছে, কিন্তু আমি কখনই তাদের আমার নিজের বলে মনে করিনি, কারণ তাদের জন্য আমার ইচ্ছা শুধুমাত্র এই যে তারা বৌদ্ধধর্মে তাদের নিজেদের খুঁজে পাক। আপনাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার মত আমার কোন সম্পত্তি যেমন অর্থ জমি ইত্যাদি নেই। যদি আপনি কিছু চান তাহলে স্মৃতি হিসেবে আমার অনেকগুলি বইয়ের একটি রেখে দিন। যদি আপনি কিছুই না চান তাহলে আমার উপদেশ বাকা আপনার কোন কাজে লাগবে না। আমার দেওয়ার মত কিছু যা কিছু রয়েছে তা হল মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্ম যার থেকে আপনি শিখতে পারবেন এবং বিহার যাকে আপনি সাহায্য করতে পারবেন। আমি কাউকে অনুগ্রহ করি না। সংঘের একটি ব্যবস্থা এবং পদমর্যাদা নির্ধারণের একটি পদ্ধতি রয়েছে। তবুও নিরপেক্ষতা রক্ষা করা সহজ নয়। পদোন্নতি নির্ভর করে একটি বিশেষ পদে একজনের কাজকর্ম, তার শিক্ষা, আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং সাফল্যের উপর এবং এগুলির ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে পার্থক্য হয়। সাফল্য, পদমর্যাদা এবং স্বীকৃতি সমস্ত কিছু একজন ব্যক্তির নিজস্ব সদগুণের উপর নির্ভর করে অতএব ব্যক্তিগতভাবে আমি একথা বলতে পারি না যে কোন ব্যক্তিবিশেষের পদোন্নতি হওয়া উচিত কি উচিত নয়। আমি আমার শিষ্যদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি এই কারণে যে আমি তাদের কারও সম্পর্কে স্বতন্ত্রভাবে প্রশংসা করে তাদের খুশি করতে পারি না। তবে এটিকে তারা নিরপেক্ষতার একটি শিক্ষা বলে মনে। করতে পারে। পরিচালন সমিতির আপনার পদোন্নতি বা পদাবনতি নির্ধারণের অধিকার রয়েছে, এবং একজন ভিক্ষু হিসেবে আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে আপনার সাফল্য নির্ধারিত হবে ধর্মের মাপকাঠিতে। এক্ষেত্রে কোন পার্থিব নিয়ম আপনার মূল্যায়ন করতে পারবে না। ভবিষ্যতের যা নিয়ে আমি চিন্তিত তা হল আমার শিষ্যদের কর্মের স্থানান্তরণ। যদিও ফো-কুয়াং শান কোন সরকার নয় তা সত্ত্বেও এতে অসংখ্য বিভাগ ও কর্ম স্থানান্তরণ ব্যবস্থা রয়েছে। সংঘের পরিচালন ব্যবস্থা প্রতিটি পদে উপযুক্ত ব্যক্তিকে বসাতে চেষ্টা করবে। যে পদে কোন ব্যক্তিকে বসান হবে তার সঙ্গে ব্যক্তিগত আগ্রহ বা ধারণার কোন পার্থক্য হলে তাকে সমাধান করতে হবে। এই পৃথিবীতে সমতাকে মাপা খুব কঠিন, তাই কেমন করে আমরা শান্তিপূর্ণ ও সুখী জীবনযাপন করতে পারব তা নির্ধারিত হয় সমতার সম্পর্কে বিভিন্ন ধরণের সংজ্ঞার দ্বারা।

আমার সমস্ত জীবনে অনেক ভেবেছে যে আমি এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলি গড়ে তুলতে অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু প্রকৃত সত্য হল এই যে বিষয়টি আমার পক্ষে অত্যন্ত সহজ সরল ছিল কারণ সমবেত প্রচেষ্টায় আমি দলের অংশ ছিলাম মাত্র। আমি এই লক্ষ্য পূরণের সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছি এবং বাকীটা রেখে দিয়েছি বাহ্যিক পরিস্থিতির জন্য। অনেকে মনে করে আমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞ; কিন্তু প্রকৃত সত্য হল এই যে আমি শুধুমাত্র বিশ্বাস করি নিয়ন্ত্রণে কোন চেষ্টা না করাতে। আমি সকলকে পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতা করার জন্য ধন্যবাদ জানাই কারণ শীল ও নিয়ম ছাড়া আমাদের অপরকে শৃঙ্খলা শিক্ষা দেওয়ার কোন অধিকার নেই। এই পৃথিবীতে কোন কিছুকে আসতে দেখে আনন্দিত হবার বা কোন কিছুকে চলে যেতে দুঃখিত হবার কোন কারণ নেই। কোন না কোনভাবে আমাদের সকলের মুক্ত হওয়ার অধিকার আছে এবং সহজ হওয়ার অধিকার আছে যখন আমরা পরিস্থিতি অনুযায়ী চলি। ধর্মের পথকে অনুসরণ করে চললে আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হব। আমার সমস্ত জীবনে আমি দানের দর্শনকে অনুসরণ করেছি। আমি সবসময় অপরের প্রশংসা করেছি, তাদের ইচ্ছাকে পূর্ণ করেছি। এর গুরুত্ব সম্পর্কে পরিপূর্ণ সচেতন থেকে আমি যেখানেই যাই সেখানেই ধর্মের বীজ ছড়ানোর চেষ্টা করি। এই কারণে Buddha Light-এর সদস্যদের জীবনের মূলমন্ত্র আমি প্রতিষ্ঠা করেছি : 'অপরকে বিশ্বাস জোগাও, আনন্দ দাও, আশা দাও এবং সুবিধা দাও।” আমার অনেকগুলি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের পিছনে উদ্দীপনা হিসেবে কাজ করেছে আমার কখনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পাওয়া। এর ফলে আমি বুঝতে পেরেছি শুধুমাত্র শিক্ষাই আত্মবিকাশ ও চরিত্রের পরিবর্তনে সাহায্য করতে পারে। আমি লেখালিখিতেও সময় দিয়েছি কারণ বুদ্ধের কাছ থেকে ধর্মের যে ধারা আমি উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছি তা যেন আত্মার নিজের হৃদয় থেকে সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তেই থাকে। আমার সমস্ত জীবন আমি নিম্নলিখিত নীতিগুলি মেনে চলেছি “এগিয়ে যাওয়ার জন্য পিছিয়ে যাওয়া জনতাকে নিজের মত মনে করা; কিছু পাওয়ার জন্য কিছু না থাকা; শূন্যতার মধ্যে আনন্দলাভ করা। আমার সমস্ত সন্ন্যাসী শিষ্যের উচিত সমস্ত কিছুকে অতিক্রম করে যাওয়ার মন নিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা, এবং অতিক্রম করে যাওয়ার মানসিকতা নিয়ে পার্থিব কাজকর্ম অংশগ্রহণ করা।” এছাড়াও তার মিতব্যয়ীতার মধ্যে দিয়ে জীবন কাটাবে এবং কোন পার্থিব সম্পদ সঞ্চয় করবে না। বুদ্ধের সময় থেকে চলে আসা কেবল তিন পোশাক ও একটি পাত্র রাখার নিয়ম এবং একজন ব্রহ্মচর্য অনুশীলনকারীর মাত্র আঠেরোটি ব্যক্তিগত সম্পত্তি আমিত্বের অনুপস্থিতি—–—একজন অবনমিত ভিক্ষুর উপদেশবাণী রাখার নিয়ম শুধুমাত্র যে বিনয় অনুসারী তাই নয়, এগুলি সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবা উচিত এবং মনে রাখা উচিত। ফো-কুয়াং শানের শিষ্যরা কখনও ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে তহবিল সংগ্রহ করবে না, সঞ্চয় করবে না, বিহার নির্মাণ করবে না বা ভক্তদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে না। যদি সকলে এই নিয়ম মেনে চলে তাহলে ফো-কুয়াং শান পরম্পরায় গৌরব অন্তহীন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে।

সকলকে “গৌরব যুদ্ধের, সাফল্য সমাজের, সুফল বিহারের এবং পুণ্য ভক্তের এই কথাটি মেনে চলা উচিত। একজনের অবশ্যই জানা উচিত ‘বুদ্ধের পথ বিশাল শূন্যতাকে পূরণ করে; এই সত্যটি ধর্ম জগতের সর্বত্র উপস্থিত থাকে।” এই ধর্ম জগতের সমস্ত কিছু আমার; কিন্তু অস্থায়ীত্বের ঘটনা আমাকে বলে কোন কিছুই আমার নয়। পার্থিব বিষয়ে অতিরিক্ত আসক্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই, মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্মের অনুশীলনকারীকে অবশ্যই পৃথিবীর সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হবে, কিন্তু ফুল ও পাখিদের উপর নজর রাখা একজন কাকতাড়ুয়ার মত আমাদের খুব বেশি উদ্যোগী হওয়া উচিত নয়। আমার সমস্ত শিষ্যদের ধর্ম ছাড়া আর আর কিছু থাকা উচিত নয়। সমস্ত কিছু যেমন অর্থ এবং পার্থিব জিনিসপত্র যখনই সম্ভব হবে তখনই দান করে দেওয়া কারণ তারা হল সেই সম্পদ যার মালিক হল এই পৃথিবী। বিহারের সমস্ত সম্পত্তি জনগণের সমস্ত হওয়া উচিত কারণ আমাদের যা কিছু আছে বিহার তার সবগুলিই সরবরাহ করে। অতএব সেগুলি নিয়ে খুব বেশি ব্যস্ত থাকা বা তর্ক করার কোন প্রয়োজন নেই। যতদিন আমরা একটি ন্যায়সঙ্গত বিশ্বাসকে প্রচার করছি ততদিন আমাদের মূল প্রয়োজনগুলি নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। এছাড়া আমার ইচ্ছা এই যে আমার শিষ্যরা যেন দৈনন্দিন প্রয়োজনের সমস্যাগুলি নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত না হয় কারণ এগুলি তুচ্ছ বিষয়। আমি বিশ্বাস করি বিহার তার সমস্তbউপার্জনকে সৎ কাজে ব্যয় করবে। কোন অর্থ না রাখাই হল ফো-কুয়াং শানের শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের চাবিকাঠি।

বিহারের দৈনন্দিন প্রয়োজন ছাড়াও যে কোন অর্থ সাংস্কৃতিক, শিক্ষামূলক, বা দাতব্য প্রচেষ্টায় ব্যয় করা উচিত। ফো-কুয়াং শান সকলের কাছ থেকে অর্থ পায়, সেই জন্য তার উচিত সকলকে অর্থ দান করা, আমাদের অবশ্যই জরুরী ভিত্তিক ত্রাণ, নিঃসহায় মানুষদের যত্ন, এবং দরিদ্রদের দান করতে হবে। বিপর্যয় ও দুর্ভাগ্য এই দুটি পৃথিবীর দুর্ভাগ্য, তাই আমাদের ত্রাণকার্যে অবদান রাখা উচিত। ফো-কুয়াং শান, বুদ্ধ মেমোরিয়াল সেন্টার এবং সমস্ত পাখা বিহারের জমি রাষ্ট্রের অধিকারে নয় বা লিজ নেওয়া নয়। এই সমস্ত জমি কেনা হয়েছিল ভক্তদের দেওয়া দানের অর্থ দিয়ে। একমাত্র তাই-চুং-এর ন্যাশনাল ব্রডকাস্ট নেটওয়ার্ক ছাড়া এই সমস্ত সম্পত্তির মালিক হল ফৌ-কুয়াং শানের ভিক্ষু ও গৃহী ভক্ত সম্প্রদায়। এই সম্পত্তির কোনটিই যৌথ মালিকানার অধীনে বা অন্য কোন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নয়। ফো-কুয়াং শানের প্রতিষ্ঠার পর থেকে জমি কেনা বা গৃহ নির্মাণের জন্য কোন অর্থ ঋণ করা হয়নি।

ভক্তদের আরও ভাল পরিবেশ দেওয়ার জন্য শাখা বিহারগুলিকে সাহায্য করতে হবে এবং সেগুলিকে সংস্কার করতে হবে। যদি কোন একটি শাখা চালান কঠিন হয়ে পড়ে তাহলে স্থানীয় ভক্তদের সম্পত্তি নিয়ে সেটিকে বন্ধ করে দিতে হবে এবং সাংস্কৃতিক, শিক্ষামূলক, শিক্ষামূলক এবং দাতব্য কাজকর্মের প্রতি মনোনিবেশ করতে হবে। কোন কিছুকেই ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা যাবে না। অন্য কোন বৌদ্ধ সংগঠন বা কোন ব্যক্তির সঙ্গে কখনই কোন এড়িয়ে চলার জন্য কোন ঋণ নেওয়া যাবে না। আমি আমার সমস্ত জীবন বুদ্ধকে উৎসর্গ করেছি এবং তাঁকে আমার শিক্ষক ও বৌদ্ধধর্মকে আমার পথ হিসেবে গ্রহণ করেছি। অতএব আমাদের ভবিষ্যতের অনুশীলনে আমাদের উচিত বুদ্ধ ও তাঁর দশ শিষ্যকে আদর্শ হিসেবে এবং অন্যান্য বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করা। বৌদ্ধধর্ম প্রচারে সমস্ত পৃথিবীর শাখা বিহারগুলির উচিত স্থানীয়করণের জন্য চেষ্টা করে স্থানীয় ব্যক্তিদের বিহার হিসেবে নিয়োগ করা। মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে আমার সমস্ত শিক্ষাই প্রতিটি পরিবার ও সমস্ত মানুষের কাছে পৌঁছানো উচিত আমার সমস্ত জীবন আমি মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্ম প্রচার করতে চেষ্টা করেছি। যা কিছু বুদ্ধ স্বয়ং শিখিয়েছেন, তা মানুষের প্রয়োজন, তা বিশুদ্ধ, তা পূর্ণশীল ও সুন্দর, যে কোন শিক্ষা যা মানবতা সুখকে বৃদ্ধি করে তাকে মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্ম বলে মনে করা হয়। এছাড়াও আমাদের দুঃখকে সেই শর্ত হিসেবে মনে করা উচিত যা আমাদের শক্তিশালী করে। ক্ষণস্থায়ীত্বের অর্থ হল এই যে কোনকিছুই স্থির নয়, এটি আমাদের ভবিষ্যৎকে পরিবর্তন করতে পারে এবং জীবনকে উন্নত করতে পারে। শূন্যতার অর্থ ‘নাস্তিত্ব’ নয়, বরং এটি অস্তিত্বের ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। একমাত্র শূন্যতা থাকলে তবেই অস্তিত্ব থাকতে পারে। আমার নিজের জীবনে আমি কখনও কোন কিছুর মালিক ছিলাম না; এটি কি প্রকৃত শূন্যতা থেকে জেগে ওঠা বিস্ময়কর অস্তিত্বের ধারণা নয়? আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্মের শিক্ষা মানুষের জন্য ভবিষ্যতে দিক নির্দেশকারী আলোকরশ্মি হতে চলেছে। ভাল কথা বলা সত্যবাদিতা, ভাল কাজ করা পুণ্যশীল, ভাল চিন্তা করা সুন্দর। ভালত্বের তিনটি কাজ করার মাধ্যমে আমাদের অতি অবশ্যই সত্য, সত্য ও সুন্দরকে আমাদের সমাজের গভীরে প্রবেশ করার সুযোগ দিতে হবে। জ্ঞান হল প্রজ্ঞা, উদারতা হল করুণা এবং সাহস হল বোধিজ্ঞান। আমাদের অতি অবশ্যই এগুলিকে অর্জনের জন্য চেষ্টা করতে হবে যাতে করে আমরা আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য বোধিসত্ত্ব পথ অনুশীলন করে নৈতিকথা, মনঃসংযোগ এবং প্রজ্ঞাযুক্ত একটি মনের বিকাশ ঘটাতে পারি।

মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্মের বুদ্ধের থেকে উৎপন্ন হয়ে বর্তমানে বহুদূর বিস্তৃত হয়েছে। তবে, মতভেদের উপর গুরুত্ব দেওয়ার ফলে বৌদ্ধধর্ম ভারতবর্ষে স্থবিরবাদ ও মহাসাংঘিক সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়েছে এবং পরবর্তীকালে চীনদেশে আটটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়েছে। এগুলির মধ্যে দর্শন ও আচার অনুষ্ঠানের পার্থক্য বোধগম্য, কিন্তু আমরা যদি কে ভুল কে ঠিক তা নিয়ে চিন্তা করি তাহলে আমরা বুদ্ধের মন থেকে আরও দূরে সরে যাব। এই কারণে ফো-কুয়াং শান ও বুদ্ধাস লাইট ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের বিকাশ নিঃসন্দেহে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সমন্বয়কারী বৌদ্ধ সংগঠনগুলির অন্যতম হবে। যদি আমাদের মধ্যে কেউ ফো-কুয়াং শানের ভিক্ষু ও গৃহী সম্প্রদায়ের সম্ভাবনা রক্ষায় আগ্রহী হন তাহলে তিনি একটি সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রাচীন ভিক্ষুদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পাবেন। যাই হোক একটি নতুন সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা নির্ভর করে পরবর্তী প্রজন্মের প্রচেষ্টা ও অর্জিত সাফল্যের উপর। যারা মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্মের প্রচেষ্টার সঙ্গে চোখে চোখ মেলাতে পারেন না। তাঁদের জন্য এই প্রবাদটি উদ্ধৃত করতে পারি, যদি কেউ ইতিমধ্যেই আত্মার প্রতি আসক্তিকে দূর করতে পারে; ধর্মের প্রতি আসক্তিকে দূর করা কঠিন। যদি কেউ তাদের নিজেদের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আমাদের খোলা মনে। সেই শাখাটিকে ফো-কুয়াং শান পরিবারের অংশরূপে গ্রহণ করতে হবে। যতক্ষণ না সেই প্রতিষ্ঠানটি ফো-কুয়াং শানের বিরোধী কোন কাজ করছে বা তাকে বিকৃত করছে ততক্ষণ সেটিকে আমাদের সহ্য করতেই হবে। আমাদের লক্ষ্য আমাদের ব্যক্তিগত সাফল্যের উপর নিবদ্ধ নয়, বয়স বা লিঙ্গ নির্বিশেষে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের উপর নিবদ্ধ। বুদ্ধের আলোর মহান পথে ভিক্ষু ও গৃহী সম্প্রদায়ের চারটি সভার ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত ভূমিকা রয়েছে।

ফো-কুয়াং শানের ভিক্ষু, ভিক্ষুণীদের বৌদ্ধধর্ম প্রচারের দায়িত্ব গ্রহণ করা উচিত, এবং BLIA-এর উপাসক-উপাসিকাদের উচিত তাদের ক্ষমতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা। আমাদের শক্তি, সাধারণ বোধ এবং সম্ভাবনাকে একত্রিত করে আমরা সমবেতভাবে BLIA-কে এগিয়ে নিয়ে যাব, যাতে করে বুদ্ধের আলো সর্বত্র ঝলমল করে এবং ধর্মের প্রবাহ বইতেই থাকে। BLIA-এর সদস্যদের এমন একটি জীবিকা গ্রহণ করতে উৎসাহিত করতে হবে যা আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। আমাদের উচিত পরস্পরকে সাহায্য করা যাতে আমরা একত্রে উন্নতি করতে পারি।

যদিও BLIA ফো-কুয়াং শানের সংঘের অধীনস্থ একটি সংস্থা, ভিক্ষু ও গৃহী ব্যক্তি উভয়ই কোনরকম বিতর্ক বা দ্বন্দ্ব ছাড়াই মিলেমিশে থাকতে পারে ঠিক যেভাবে অস্তিত্ব ও শূন্যতা একই মুদ্রার দুটি পিঠ। ফো-কুয়াং শানে ইতিমধ্যেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে; অতএব ফো-কুয়াং শান ও BLIA-এর নেতাদের একমত হয়ে স্বীকৃত মাপকাঠিকে মেনে চলতে হবে এবং জনমতের কথাও মনে রাখতে হবে। সাম্যের একজন প্রবক্তা হিসেবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে নারী পুরুষ, ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সকলেই সমান। সমস্ত জীবিত প্রাণীর মধ্যে বুদ্ধ প্রকৃতি রয়েছে এবং তারা সকলেই নির্বাক লাভ করতে পারে। অতএব আমি ‘মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাও ‘জীবনের প্রতি অধিকার’ এই বিশ্বাসের মাধ্যমে ‘সমস্ত জীবন্ত প্রাণীর মধ্যে সমতা’ ও এই মন্ত্রকে কার্যে পরিণত করতে আশা করি। ফো-কুয়াং শানে আমাদের প্রতিটি গাছ ও ফুলকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতে হয়, প্রতিবেশীদের যত্ন করতে হয়, শিশু আবাসে তরুণদের উৎসাহ দিতে হয়, বৃদ্ধাবাসে বয়স্কদের জন্য দুশ্চিন্তা প্রকাশ করতে হয় এবং সংঘ সম্প্রদায়ে বয়স্কদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হয়। আমি আশা করি যে, আমি মানবতার জন্য উত্তম কারণ ও শর্ত, আমার অনুগামীদের জন্য ধর্মের আবেগ, নিজের জন্য বিশ্বাসের বীজ এবং বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানের জন্য অতুলনীয় গৌরব রেখে যাব। সমস্ত পৃথিবী কার্য কারণ নিয়ম শর্ত, ফল ইত্যাদিতে বিশ্বাস করুক। আমি আশা করি যে প্রত্যেক করুণা, দয়া, আনন্দ ও ক্ষান্তি অনুশীলন করবে এবং পৃথিবীর জন্য তাদের শুভকামনা রেখে যাবে। মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ যেমন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, টেলিভিশন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, সংবাদপত্র প্রকাশনা, প্রকাশনা সংস্থা, মেঘ ও জল ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার, বৃদ্ধাবাস, শিশু আবাস এবং সমাজের মঙ্গলের জন্য সেবা ইত্যাদিকে অবিরাম সাহায্য করে যেতেই হবে। ওয়াটার ড্রপ ট্রি হাউসগুলিকে ‘এক বিন্দু জলের জন্য কৃতজ্ঞতা’র ধারণাকে আরও বেশি করে গুরুত্ব দিতে হবে। যদি আমাদের সুযোগ হয় আমাদের ফো-কুয়াং শানের ভূতপূর্ব বিহার দর্শন করতে হবে যেটি হল চীনদেশের যি-শিং-এর তা-জুয়ে বিহার। আমি সর্বদা সাংস্কৃতিক, শিক্ষামূলক এবং সেবামূলক কাজকর্মের সম্মান করে এসেছি; অতএব আমি সম্মানীয় মাস্টার শিঙ য়ুন পাব্লিক এডুকেশন ট্রাস্ট ফাণ্ড স্থাপন করেছি যা এখনও পর্যন্ত একশ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থসংগ্রহ করেছে। মুষ্টিমেয় কয়েকজন ভক্তের অর্থ সাহায্য ছাড়া এর বেশিরভাগ তহবিলই এসেছে আমার ক্যালিগ্র্যাফি এবং আমার বই থেকে প্রাপ্ত রয়্যালিটি থেকে। ভবিষ্যতে এই প্রচেষ্টাগুলি সহায়তা লাভ করতে পারে ফো-কুয়াং শানের প্রবীনদের কাছ থেকে এবং সেই সমস্ত বৌদ্ধদের কাছ থেকে যাঁরা তাঁদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অর্থকে ট্রাস্টের ফাণ্ডে জমা রাখবেন এবং সমাজের মঙ্গল ও দেশের উন্নতিতে সুদৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। পুরস্কার, যেমন সত্যবাদিতা, ধার্মিকতা ও সুন্দর মিডিয়া পুরস্কার, Three Acts of Goodness Schools Global Chinese Literature Award, ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে যতক্ষণ তহবিলে অর্থ থাকবে। সমাজের প্রগতিতে সাহায্য করা প্রতিটি বৌদ্ধের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হওয়া উচিত। শিক্ষার ক্ষেত্রে বিহারের অর্থের সবচেয়ে বেশী অংশে ব্যয় করা হয় অনেকগুলি বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চবিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে। যতদিন সঠিক পরিস্থিতি বর্তমান রয়েছে সেই সমস্ত বিদ্যালয়ের পরিচালন ব্যবস্থা যতদিন তাদের কেনা বা বিক্রি নাbহয় সেই সমস্ত ব্যক্তির শর্তহীনভাবে তুলে দেওয়া যেতে পারে, যাদের এই বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে। যদি বিদ্যালয়গুলি বিক্রি হয়ে যায় তাহলে তহবিল সংগ্রহে যাঁরা অবদান রেখেছিলেন তাঁদের কাছে আমরা কী জবাবদিহি করব? এটি ফো-কুয়াং শানের সুনামের পক্ষে উপকারী হবে না এবং এর ফলে আমাদের জনগণের সমালোচনার মুখোমুখি হতে হবে। যে কোন গোষ্ঠী যা ফো-কুয়াং শানের সাংস্কৃতিকখ ও শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডে অবদান রাখে তাকে তার ব্যয় করা অর্থ শোধ করে দিতে হবে, যাতে করে যাদের উদ্দীপনা ও উৎসাহ রয়েছে তারা আরও ঘনিষ্ঠভাবে একত্রিত হতে পারে গঠনমূলক মন্তব্য এমনকি সমালোচনাকেও বাতিল করা উচিত নয়, আমাদের ‘নিজেদের ভুল ধরিয়ে দিলে আনন্দ পাওয়া’র মত উদার হতে হবে। আমাদের সকলের মতামতকে স্বীকার করতে হবে যাতে করে তা আরও বেশি করে আমাদের সমর্থন করে। প্রায়শই আমি ভিক্ষু শিষ্যদের আগাছা নির্মূল করতে ও ফুল ছাঁটতে দেখেছি। আমি আরও দেখেছি পরিবেশ যত্ন বিভাগের সহ অনুশীলনকারীরা বিভিন্ন বস্তুরbপুনঃব্যবহার করছে, নির্মাণ বিভাগ মেরামত এবং তত্ত্বাবধানের কাজ করছে, স্বদেশ ও বিদেশের কর্মসমিতি তাদের কাজ করে চলেছে, বিহারের কর্মচারী ও তার প্রধান বিহার দেখাশোনা করে চলেছে। তাদের প্রচেষ্টা ও দায়িত্ব গ্রহণের ইচ্ছা ফো-কুয়াং শানের সাফল্যের অন্তরালের প্রকৃত শক্তি; আমি এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি এবং এর জন্য সাধুবাদ জানিয়েছি। কারও শপথ ছাড়া ফো-কুয়াং শান আজকে যেখানে আছে সেখানে কেমনভাবে পৌঁছত? আজকে থেকে অতিথি আপ্যায়ন, ভক্তদের যত্ন, এবং স্বেচ্ছাসেবকদের যোগদান ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত যাতে করে আমাদের ধর্মীয় সংগঠনটি আরও সম্পূর্ণ হতে পারে। অতএব আমার সারা জীবনের আকাঙ্ক্ষা এই যে সকলের সকলে মিলেমিশে কাজ করার মানসিকতা জয়ী হোক এবং বজায় থাকুক কোনরকম অভিযোগ বা আপশোস ছাড়াই। যেহেতু কেউই একা একা বাঁচতে পারে না, সকলের উচিত একে অপরকে শ্রদ্ধা ও সাহায্য করা যাতে করে সকলে সহাবস্থান ও উন্নতি করতে পারে। একমাত্র তখনই একজন বুদ্ধের শিক্ষার মূল কথাটি বুঝতে পারবে। বিহার বা জনগণের ক্ষতি হবার সুযোগ না দিয়ে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থকে ত্যাগ করে সহিষ্ণু হওয়াই শ্রেয়। আমার নিজের শহরের পূর্বসূরীদের একজন তাং রাজবংশের মাস্টার চিয়ানজেনকে সংস্কৃতি প্রচারের জন্য অনেক কষ্ট করে জাপানে যেতে হয়েছিল। তাঁর গ্রামে ফিরে যাওয়ার আর কোন সম্ভাবনা ছিল না। তিনি নিম্নলিখিত গাথাটি লিখেছিলেন, “পর্বত, নদী, বিদেশ পার হয়ে; একই সূর্য, চাঁদ ও আকাশের নীচেbসমস্ত স্থানে। আমি বুদ্ধের সমস্ত সন্তানের উপর এই আশা রাখছি যে তারা একত্রে সাদৃশ্য তৈরী করবে। জীবনের প্রবাহ একটি নদীর মত যা কখনও ফিরে আসে না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত একদিন ফিরেই আসতে হবে, যেহেতু একটি জীবনের শেষ অপর একটি জীবনের শুরুকে চিহ্নিত করে।”কোন মানুষেই দ্বীপ নয়; বাঁচবার জন্য আমাদের বিভিন্ন মানুষ যেমন পণ্ডিত, কৃষক, শিল্পী, বণিক এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক বস্তু যেমন সূর্য, চাঁদ, তারা, নক্ষত্র, পৃথিবী, জল, আগুন ও বাতাস ইত্যাদির সাহায্য প্রয়োজন। প্রকৃতির সমস্ত কিছু যেমন সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, পর্বত, নদী এবং পৃথিবী সকলেই আমাদের জীবনের অংশ। অতএব আমরা সেই পৃথিবীকে মর্যাদা দেব যাকে আমাদের বাড়ি বলি এবং এই গ্রহের সমস্ত প্রাণীকে সাহায্য করব হাতে করে আমরা সেই সমস্ত উপকার ও সুবিধার দয়ার প্রতিদান দিতে পারি যা আমরা পূর্বে লাভ করেছি। আমরা প্রত্যেকেই এই পৃথিবীতে এসেছি শূন্য হাতে এবং পৃথিবী ত্যাগ করেও যাব শূন্য হাতে। আমি আপনাকে একথা বলতে পারব না যে আমি এই পৃথিবীতে কী নিয়ে এসেছি। কিন্তু আমি আমার সঙ্গে আনন্দ নিয়ে যাব। আমি কখনই ভুলে যাব না সেই সমস্ত ভক্তদের যাঁরা খুশি হয়ে আমাকে সাহায্য করেছেন; এবং সেই সমস্ত সহ অনুশীলনকারীদেরও মনে রাখব যাঁরা আমাকে আশীর্বাদ করেছেন।

আমি কখনই ভুলব না সেই সমস্ত পরিস্থিতিগুলিকে যেগুলি আমাকে সাহায্য করেছে কারণ এগুলি আমার হৃদয়ে স্থায়ী আসন লাভ করেছে। বুদ্ধের আশীর্বাদ এবং এই জীবনে পাওয়া বন্ধুত্বগুলি সত্যিই অসাধারণ; আমি অনুভব করি এই পৃথিবীতে আমার জীবন অত্যন্ত মূল্যবানভাবে অতিবাহিত হয়েছে। আমি শপথ করছি যে আমি জীবনের পর জীবন বুদ্ধকে উৎসর্গ করব এবং চার প্রকার কৃতজ্ঞতার প্রতিদান দিয়ে সমস্ত প্রাণীর সেবা করব। এই জীবনের পরিসমাপ্তি সম্পর্কে বলতে পারি যে কোন নিদর্শন থাকবে না এবং সমস্ত অপ্রয়োজনীয় ও জাঁকজমকপূর্ণ আনুষ্ঠানিকতা বাতিল হয়ে যাবে। শুধুমাত্র কয়েকটি সরল কথা লেখা বা যাঁরা আমার অভাব অনুভব করছেন পার্থিব জীবনের শব্দ থেকে বেছে নেওয়া বৌদ্ধ সঙ্গীত গাইতে পারেন। তবে আমার মতে আমাকে মনে রাখার সবচেয়ে ভাল উপায় যেটি আমার আন্তরিক ইচ্ছাও বটে সরল মনে মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্মের শিক্ষাকে ধারণ করে রাখা এবং সর্বদাই সেগুলিকে অনুশীলন করা। ভক্তদের শান্তি ও সুখ ছাড়াও শেষে আমি যাদের জন্য চিন্তিত তারা হলেন মঠের সকলে—বিশেষত বৌদ্ধ কলেজের ছাত্র ও শিক্ষক সকলে যেহেতু তাঁরা হলেন ফো-কুয়াং শানের ভবিষ্যৎ বোধি বীজ, তাই তাঁদের অবশ্যই শক্তিশালী ও ইচ্ছুক হতে হবে যাতে করে মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্ম ততদিন স্থায়ী হতে পারে যতদিন পৃথিবী স্থায়ী হবে এবং সর্বদা আমাদের একটি অংশ হতে পারে। ধর্মের পতাকা যেন উপড়ে না যায়। জ্ঞানের আলোক যেন কখনও নিভে না যায়। আপনারা সকলে মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্মের পথে অগ্রসর হতে থাকুন যাতে করে আপনারা পরস্পরকে উৎসাহিত করতে পারেন এবং বৌদ্ধধর্মের স্বার্থে ভালভাবে নিজের যত্ন নিতে পারেন।

অনুবাদ: সুমনপাল ভিক্ষু